আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমাদের নীড়গুলি ভাঙা হইছিল

।। জহির হাসান।।

আমরা মুখর বালিহাঁস ঠিকঠাক হারায়ে যাবার আগে উড়তাম
বিভ্রান্তি এড়ায়ে আমন ধানের খেত পার হই
পদ্মফোঁটা বিলে

মানচিত্র আর মালিকানা আর কোন যুদ্ধে
আমাদের নীড়গুলি ভাঙা হইছিল!

উড়বার হক আদায় হয়েছে এতদিনে
হয়রান আমরা ল্যান্ডিং করতে চাই

ওর নাম জাহাঙ্গীর ছিল

ছোটকালে আমার একটা ছোট ভাই ছিল।
ওর একটা জাহাঙ্গীর নাম ছিল। ওরে আমি ভাজা ছোলা
মুখে তুলি খাওয়াইতাম। ওর নাল পড়ত।
ও আমার ছোটকালে একদিনে থামে, একবার মারা যায়।
ফলে কেন আমি কোথাও দেখতি
পাই না। উঠানে আমি খুঁজি ওরে না পাই, না।
আমাদের পুকুর পাড়ে খুঁজলেও কি পাইতাম!
কিছুলোক আমার আব্বা ফুপারা ওরে
কোথাও না-কোথা সরায়ে রাখছে আপাতত।
যেন কিছু চিলের ছোঁগুলি আমার ভিতর
একটা আরশির মধ্যে দেখি
ফলে আমি দৌড়াইতে থাকি নদীর কিনারে
যায়ে দেখি নদী তীরহীন অলরেডি
বস্তুর তেমন ক্ষয় নাই ভাইরে আমি
ঢেউয়ের দিকেই তাকাই
দেখি ওরে পাই কিনা!
একটা জাহাঙ্গীর ছিল আমার ভাই, আমি বিলাপের মইধ্যে
আমি ওরে তখনও পাই না। সময় আগের মতো রহে না
আমার মনে একটা ছোট ভাই
ছিল সেই ওকে বিকাল পর্যন্ত খুঁজি।
বার বার ডাক পড়তেছিল ওর
আমার ভিতর। আমি কাউরেই কিছু বলি না।
আমার মাকে কোথাও দেখি না আঁচলের অন্তরালে।
তারা সবে কন গেল!
আমি বাড়ি থাকি রাস্তায় যাই
দেখি সবাই চুপচাপ
আমারে কিছুই কহে না
তাদের চুপচাপের মধ্যে
খুঁজতি থাকি ওরে। তারা ওকে যেন
রাখি আসছে বাড়ি থাকি অন্য কোথাও
তারা যেন ঘুমের মধ্যে অতিরিক্ত হিসাবে
স্বপ্নরে সহ্য করতেছিল না যেন!
ওদের ব্যাখ্যার জন্য আমি অপেক্ষা করতেছি কেন?
এরা ওকে না হয় আমিই ওকে পুরোটাই দেখেটেখে রাখতাম!
আমি গোরস্থানে যাই না। মরা ওরে রাখি আমি
সত্যিকার জাহাঙ্গীরকে
খুঁজতে বার হই। কাঁঠাল তলায়।
আরও কোথাও খুঁজতে থাকি
কেন ওরে আর
ছোলা খাওয়াতে চাইয়ে ওরে আর খুঁজি পাইতেছিলাম না!
আমি ছোলা মোর মুখে দিই ওর মতো হইতে চাই
দেখি আমি জাহাঙ্গীর হই কিনা!
চিরন্তনভাবে ওরা আমারে কিছুই কয় না।
ওরা কেন নখ কাটতেছে যেন নখ দেহ নয়!
মওত বিষয়ে
গোপনীয় দেয়ালগুলা ভাঙায়ে
তারা কিছু আমারে বলে না!
জাহাঙ্গীর ডাক দিই, জানলার কাছে যাই,
আয়না আসে শত শত আমার সামনে যেন
আমি তাদের ভিতরে ঢুকি না!

শূন্য

দেবদারুর ডাল হইতে ঘুঘু ডাক দিলে
আকাশের জমা সব শূন্য মালা হই উঠে!
হৃদয়ে আমি আর তুমিরে জায়গা না দিলে
কিবা আর রয়!
মহা ঐ শূন্য অগণন মালারূপে
ভাসায় ব্যস্ত না থাকলে
নক্ষত্রের আলোরে জড়াই না ধরি মাটির দিকে
পাঠাই দিত নাকি!


নাস্তি

আমি তো ফুটা পাতাও না
কেমনে মাপবো বাতাসের চাপ!

আমি তো মরমি ঘাস না
কেমনে বুঝব সহজ সবুজ!

আমি তো প্রেমিক মজনু না
কেমনে বুঝাব দৈব বিরহ!

আমি তো বটপাতার মর্মর না
কেমনে অস্তিত্বে ফুটাব নৈঃশব্দ!
আমি তো মানুষ না
কেমনে ধরব অসহ নিঃসঙ্গতা!


বর্ষাযাপন

১.

কী হইলো আমার সবকিছু মোর দিলে কয়দিন ধরি
শুকনা শুকনা লাগতেছে
শূন্যের ভিতর বসি যেন বৃত্তের কেন্দ্রে দু’পা দুলাই,
মনে হইল কারো ভিতরে উদয় হই, গিয়া
লিখি আসি ভুলভাল বানানেই:
’বর্ষাকালে একটানা
নবাঙ্কুর ইক্ষুবনে এখনো ঝড়িছে বৃষ্টি ধাড়া বিশ্রামবিহীন।’
অথচ নাহি তো বর্ষা, তবু থামে না উতলাভাব।
করোনার কালে কত ম্মৃতি মুছি গেল
এ কেন মুছে না সহসায়!
বউ আসছে চা নিয়া , বসেই ছিলাম অপেক্ষায়
বউরে বল্লাম , নারীর আড়ালে থাকে ধোকা ধোকা শিশু।
সে কইল মুখ ভ্যাঙচায়ে:
দুর্বল কল্পনা কিছু!

২.

প্রসঙ্গ কেবল এ শহরে বদলায়
হ্যাঙারের মতো ঝুলি আছি।
বুঝলাম আর একটা স্বপ্নই আমার বাকি আছে
মনে হয়, স্বপ্নে কেহ নাই
তবু তারে বলি, গুডবাই
বাস্তবে মাথার ভিতরে ঝরিছে বৃষ্টি
স্মৃতি, পোড়া ছাই!

৩.

পৃথিবীর সব অসুস্থ শহরগুলি
ধূসর নরম ভেড়া হই যাইত যদি
আমি যদি হইতাম গড্ডলিকাদলের রাখাল
বাদল আসার আগে
তাদেরে সন্ধ্যায় খেদায় নিতাম ঘরে
আর যদি এমন একটা গ্রাম পাইতাম
যেইখানে আত্মার ভিতর পবিত্র শরীর লড়েচড়ে
যেইখানে রজনীগন্ধারা দোলে যত ঝড়ে
তার চাইয়ে বেশি হর্ষে দোলে
মোরগ ফুলেরা
অব্যক্ত রগড়ে!

বালিহাঁস

অচিরেই প্রেম নড়েচড়ে উঠবেনে এই ধড়ে সেই ভরসায়
আসমানে আসমানে শরৎ মেঘের নিচ দিই
বালিহাঁস সাথে ভাসতাম আমি

হাউস করি টিলায় পাহাড়ে মেঘগুলি
বাড়ি খায় ধসি পড়ার তুমুল খায়েসে নামত নিচে

গায়েব ছিলাম
উলঙ্গ আকাশ ছিন্নভিন্ন রঙধনু আমাদের
বালিহাঁসদের জন্ম দিছে আর কতটুকু

আমরা মুখর বালিহাঁস ঠিকঠাক হারায়ে যাবার আগে উড়তাম
বিভ্রান্তি এড়ায়ে আমন ধানের খেত পার হই
পদ্মফোঁটা বিলে

মানচিত্র আর মালিকানা আর কোন যুদ্ধে
আমাদের নীড়গুলি ভাঙা হইছিল!

উড়বার হক আদায় হয়েছে এতদিনে
হয়রান আমরা ল্যান্ডিং করতে চাই

এই ফরিয়াদ
তোমারে জানায়ে রাখলাম শুধু!

ছবি- জহির হাসান

জহির হাসান

জন্ম: ১৯৬৯, যশোর জেলায় মাতুলালয়ে।
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬) ও আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭), বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলি(2018), আমমার আরও হাঁস(2019)।
অনুবাদ : এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) । সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top