ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে

।। কনকলতা সাহা ।।

পুতুলের নুতন খেলনার নাম ডলি। বেগুনি রঙের জামা গায়ে ,প্যাটপেটিয়ে সে চায়। কার দিকে তাকায় সে? তার ঠাম্মা কার গল্প বলে? কার তরে যে গায়! ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসে দূর থেকে, গানের ভিতর ভ্রমর আসে পুতুলের কাছে, ডলিও শোনে তার গুনগুন….

নয়নের জল করে টলমল

তুফান উঠেছিল সুলেখার মনে যখন সে জানতে পেরেছিল সে গর্ভবতী। একটা ভ্রণের জন্ম দেওয়ার মতো মাতৃত্ব তাঁর মনের থাকলেও শেষরক্ষা হয়নি। সেদিন অফিসের ডেস্ক থেকে উঠে বাথরুমে পৌঁছে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যতক্ষণ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে সহকর্মীরা ততক্ষণে সে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বহুদিন সেই কান্না গলার কাছে চেপে ছিল। রাতের পর রাত ঘুমতে পারত না সে। সেদিন তাঁর একমাত্র সহায় ছিল সেতার। সুর তুলে সেই সুরে গান গাওয়ার অভ্যাস সেই শুরু… তারপর নদী দিয়ে কত জল বয়ে গেল বেলা-অবেলায়, কত রোদ চিকমিক, কত ভোরের বেলায় আলোর জন্ম নেওয়া দেখা, কত প্রথম আলোয় পাখিসব করে রব, প্রভাতী সংগীত… জীবন তো জীবিতেরই… বাঁচার রসদ পেল। নদীটির মতো বয়ে চলল তার জীবন।

পুতুলের মা গল্প শোনায়

একটি ছোটো পরিবার, সুখী পরিবার কনসেপ্ট থেকে ইউ টার্ন নিয়ে তমালী চলেছিল বেশ। নিজের মতো করে জীবন কাটাতে শিখে গেছে সে। একটি সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি বলে শ্বশুর বাড়িতে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স অবধি গড়ালে নিজেকে নতুন করে গড়ে নেওয়ার পথ খোঁজে। পুতুল আসে তার জীবনে। আদর ভালোবাসায় ভরে ওঠে তমালীর জীবন। দুজনের ইইকির মিকির চাম চিকির খেলাঘরে আসে আরও এক নতুন অতিথি। পুতুল দিনরাত সেই অতিথিকে আঁকড়ে থাকে, যেমনটা থাকে পুতুলের মা। পুতুলের নুতন খেলনার নাম ডলি। বেগুনি রঙের জামা গায়ে ,প্যাটপেটিয়ে সে চায়। কার দিকে তাকায় সে? তার ঠাম্মা কার গল্প বলে? কার জনে‌্য যে গায়! ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসে দূর থেকে, গানের ভিতর ভ্রমর আসে পুতুলের কাছে, ডলিও শোনে তার গুনগুন….

পিঠে কালো কালো ছোপ

গত চার বছর একটা কথাই ভেবেছে নেহা , যেভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সামান্য মাস মাইনের চাকরিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারের কাউকে বুঝতে দেয়নি সে একা একা একটা অপরিচিত শহরে কীভাবে দিন কাটাচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পরিশ্রম সে ছোটবেলা থেকেই করতে পারে। কিন্তু সেবার যখন সমস্ত ছেড়ে চলে এসেছিল রওশনের জীবন থেকে, সেদিন ভাবেনি সে পারবে দীর্ঘ সময়ের পিছুটানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে। উপহার স্বরূপ পিঠে করে নিয়ে এসেছিল সিগারেটের আগুনে পোড়া দাগ। সেই দাগ এখনও আছে কালো হয়ে। উঠানের সারমেয়রা এখন তার সঙ্গী। মানুষের চেয়ে বিশ্বাসী ও প্রভুভক্ত।

আমার এ ঘর বহু যতন করে

তর সইছিল না নন্দিনীর , আজ রঞ্জন আসবে । সকালে সেই বার্তা দিয়ে গেছে বেণু গোপাল। বেণুগোপাল নন্দিনীর আদরের বিলাই। বর্ষার সময় সবুজ বাগানে সাদা-গোলাপি ফুলেরা সেজে উঠেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজ নন্দিনীর জন্মদিন, ঘরদোর গুছিয়েছে সকাল থেকে। পথ চেয়ে বসে আছে রঞ্জনের। মোরগ ডাকা ভোরে কিশোর তুলে এনেছে কুঁদফুলের মালা। নন্দিনীর মন ভরে যায় সেগুলো দেখে। বেলা বাড়ে… নন্দিনী গাঢ় লাল পাড়ের ধানী রঙের শাড়ি পড়েছে আজ। হাতে, গলায়,সিঁথিতে রক্তকরবী মালায় সেজেছে। সবাই এসেছে যাঁরা নন্দিনীর আপন। অধ্যাপক গান শুনিয়েছেন এসে ‘তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো…’
সন্ধ্যা নামে ক্রমশ ঘন কালো হয়ে। রঞ্জন কিন্ত আসে না, কারণটা কেউ জানে না। নন্দিনী একাই বসে থাকে তারা-জাগা রাতের দিকে তাকিয়ে। বেনুবিলাই বারান্দায় ডেকে ওঠে মিঁযাও,,,

ছবি: কনকলতা সাহা

কনকলতা সাহা

বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী, বর্তমানে বোলপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক, বসবাস শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে। গবেষণা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণে বিশেষ আগ্রহ।

Share