১৯৪৬, কলিকাতা ও নানাজান

।। সৈয়দ ইয়াসের আরাফাত ।।

তারপর ধীরে ধীরে ট্রামলাইন পেরিয়ে গোলতালাবের দিকে এগোতে থাকে সে। একটা ভীষণ চেনা গন্ধ নাক হতে মাথার ঘিলুতে আঘাত করে খালি। খুব চেনা কিন্তু কিছুতেই আইডেন্টিফাইড করা যাচ্ছে না। গন্ধটা নানার শ্রীহরি তেলযুক্ত মাথার গন্ধ কিংবা বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া বিল ধারের আঁশটে গন্ধ বা পাটজাগ দেওয়ার খুসবুর সাথে নানার চল্লিশার দিনের ঘি, মিঠা আতর, মশলা ও গরুর গোস্তের চড়া গন্ধ গিয়ে মিশে যাচ্ছে যেন মনে হয়, কবরতলার লেহানে; সেখান থেকে সবকটা গন্ধ মিলে মিশে হাওয়ার গা ভাসিয়ে জলঙ্গী নদীর মজা চর পেরিয়ে,সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানী খাতুনের লাশ কাটিয়ে কৃষ্ণনগর,রানাঘাট, নৈহাটি টপকে ব্যারাকপুরের গান্ধী আশ্রমে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে; বাঙালি হলেও ফরাসী নাগরিক আরাফাতকে অস্থির করে তোলে।!! গন্ধটার জন্য কি না বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু আরাফতের চোখের লেন্সটা সাদা কালো এপিক ফরাসী সিনেমার মতো হয়ে উঠতে লাগে। সাদা-কালোর মাঝেও রঙ আসে রঙ যায়।

সেদিন আর তারাবির নামাজ শেষ হয়নি। মৌলালির মাজারে হিন্দুদের হামলা দিয়ে শুরু হয়। তালতালা থেকে পুলিশের জিপ উর্দুতে কি যেন ঘোষণা করে যায়।’ আল্লাহ আকবর’ ‘ নারায়ে তকবীর’ রিপন স্ট্রিট, মার্কুইজ স্টিট, পার্ক সার্কাস গমগমে। দূরে ওয়েলিংটনের ওপার থেকে ভেসে আসে ‘ জয় মা কালি’ কলকাতাকে পাকিস্তানে যেতে দেবো না। তখন অবশ্য জয় শ্রী রাম ছিল না!! মসজিদের ভাঙা মাইকে এক বিহারী চিৎকার করছে, ‘‘ভাই লোগ রমজানকে মাহিনে পর, কাফের হিন্দুঁও হামলা চালারাহেঁ… ঈমানকে লিঁয়ে হাতিয়ার উঠাও….ফতেহ হামারি হোগি, ইনশাল্লাহ!’’

লক্ষণ যাদবের দোকান আজ বড়ই খালি। ওরা দুই ভাঁড় চা নেয়। চায়ের ভাঁড় ফেলতে গিয়ে চোখ আটকায়, জব্বর মিয়ার চুন খসে যাওয়া ভাঙা দেওয়ালে নতুন সবুজ কালিতে লেখা উর্দুতে ‘লড়কে লেঙে পাকিস্তান’ । তার পাশে গান্ধীজির ছবি দেওয়া শান্তি পোস্টারের শুধুমাত্র চশমা দুটো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, বেদনার জলছবির চিহ্ন।

– নানা গ্রামে ফিরা চলো। আবার সব শান্ত হলে আমরা আসবনে তোমার কলিকাতায়।



১৯৪৬, কলিকাতা ও নানাজান

সে এক প্রাচীন কথকের আখ্যান । তীব্র রাতের পর যে শহরের যাবতীয় কুকুর দল,ট্রামলাইনের ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওম নিতে থাকে ফ্যাকাসে হলদেটে মার্কা বৃটিশ ইন্ডিয়ার ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে। আজ কুড়িতম রোজা। আজকের দিনে তিনি নেমে আসেন, সাতমহলা হতে একতলায়!! আচ্ছা তখনও কি ট্রাম চলত, ধর্মতলা থেকে পার্কসার্কাস?? তিনটে রঙীন মাছ ও কচ্ছপের পবিত্র সঙ্গমের ফলে, খোয়াবের দুনিয়ায় আলো-রোশনাই আর ভেড়ার পালের নৈশকালের যাত্রা শুরু… তা কি জানে এবাদতের পৃথিবী?? নিশ্চয়ই জানে না।

সৈয়দ ইয়াসের আরাফাত। জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলেও দীর্ঘদিন ফরাসী নাগরিক। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষাবিদ। ফ্রান্সের বিশিষ্টজন। যদিও আরাফত নিজের জীবন নিয়ে সর্বদাই ছিনিমিনি খেলতে খেলতে হঠাৎই মধ্য তিরিশে এসে স্ট্রিট ফটোগ্রাফার হিসাবে সুনাম অর্জন করে ফেলেছে। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ওপর তার তোলা ফটোসিরিজ ইউরোপ, আমেরিকা-সহ দুনিয়াজুড়ে তাকে দিয়েছে নামযশ আর অর্থ এবং অবশ্যই বড় ব্যাপ্তিতে পরিচয়। সে নিছে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও তার সমাজবিজ্ঞান নিয়ে গভীর আগ্রহটাই আজ রিফ্লেক্ট হচ্ছে ছবিতে, রাস্তাঘাট জীবনের কথা বলছে খালি। এই প্রমবার সে ইন্ডিয়াতে এলেও চলমান ভারতীয় রাজনৈতিক ঘটনাবলী সমন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কলকাতা দিয়ে এবারের কাজ শুরু করার কারণ আর কিছুই না, বরং তার নানাজান! এ শহরকে ইন্টারনেট বা পত্রপত্রিকার থেকে বেশি সে চেনে তার নানার থেকে শোনা সেই কোন ছোট্টবেলার শীতের অলস দুপুরের গল্পে। জুম্মার দিনে দুপুরে যখন মা-খালা-নানিরা, কুমড়ো দিয়ে গরুর মাংস ও কাঁচা কলার ভর্তার ঢেকুর তুলতে তুলতে উশরায় সারিবেঁধে উকুন বাছত আর রেডিওর ফিরোজা বেগমের মতো সুর করে নানি চেঁচিয়ে উঠত, ‘‘ও সরিফার মা, কই গেলি তুই…বড়িগুলান তুলবিনে?? কাগে মুখ দেবেরে গতরখাগি’ যখন দূরে সর্ষে ক্ষেত থেকে দলছুট একটা সাদা বক তাদের প্রিয় গরু পাইলটের গা থেকে রক্তচোষা এঁটুলি খুঁটে খেত; ঠিক তখনই নানার শ্রীহরি তেলগন্ধ মাখা কাঁথার ভিতর আরাফত আরও সেঁধিয়ে গিয়ে কলকাতার গল্প শোনার আবদার করত খালি!!

– নানা কলিকাতা কি ঢাকার থিকাও বড়??
– অনেক বড় রে বাপ!
– বাচ্ছারা গেলে হারিয়ে যায় ??? নানি কয়, হিন্দুরা নাকি মানুষ কোরবানি দেয়?
– তোর নানি পাগল!!
– আমি বড় হলে তোমার মতো পড়ার লগে কলিকাতা যামু!!
তার নানা কাঁথা থেকে উঠে বসে অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করত,
– কেন ভাই কলকাতায় কেন??
– তোমার মত ট্রামে চড়ব বলে।

এক্ষুনি একটা ট্রাম আওয়াজ করতে করতে তার সামনে দিয়ে চলে যায়। ট্রামের গায়ে অনেক বিজ্ঞাপন। ট্রামটা মোটেই ইউরোপের মতো না। বাতিল পূর্ব ইউরোপের ট্রামের মতো অনেকটা ঝরঝরে, যেন অতীতের গল্প শোনাতে চাইছে। আরাফাত অনেকক্ষণ ধরে গোলতালাবের ধারে ট্রামলাইনটার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ সামনেই তো গোলতালাব। ট্রামলাইন ধরে বাঁদিকে কিছুদূর হাঁটলেই তো নানার কলেজ। মৌলানা আবুল… না না ১৯৪৬ সালে তো কলিকাতা কলেজ! তার নানা মানে মরহুম সৈয়দ ইফতেখার খানের কলিকাতা। দেওয়ালের বুড়ো চুনের গন্ধ গায়ে মেখে কবিতা পাঠের কলকাতা। বাতিল ট্রামলাইনের সাথে আলাপ করার কলকাতা। ইনকিলাবের ছাপাখানা কলকাতা। নির্মাণের কলকাতা, বিনির্মাণের কলকাতা। ২০১৯-এর এক পড়ন্ত বিকেলে আরাফত সেই কলকাতাতেই হাজির। রমজান মাস। ইফতারির পসরা সাজিয়ে প্রচুর অস্থায়ী দোকান। ঢাকার সাথে ভীষণ মিল। যদিও দোকানিদের কথাবার্তাতে হিন্দি- উর্দুর প্রাধান্য। দু’চারটে বলিউডের ছবি দেখলেও, ভাষাগত কোনও জ্ঞানই তার নেই, হিন্দি বা উর্দুতে। সে দীর্ঘকাল রোজা রাখেনা, ইতিমধ্যে বেশ চা তেষ্টা পেতে থাকে। মাটির ভাঁড়ে অত্যাধিক দুধ চিনি দেওয়া চা,তার একদমই ভালো লাগেনা। কয়েক চুমুক দিয়ে ফেলে দেয়। মুখটা টক-টক লাগতে থাকে। অভ্যাসবসত সিগারেট খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে হোটেলের রুমেই ফেলে এসেছে। পাশেই দোকান। পাক্কা কলকাতা স্টাইলের বাঙলায় দোকানিকে বলে, দাদা এক প্যাকেট সিগারেট দিয়েন তো, একটা লাইটারও দিবেন। দোকানি হিন্দিতে উত্তর দেয়, কৌনসা?? আরাফাত বলে, ‘আরে দ‌্যান না কিছু একটা।’কয়েকটান গ্লোডফ্লেক সিগারেটে টান দিতে খানিকটা আরাম লাগে। তারপর ধীরে ধীরে ট্রামলাইন পেরিয়ে গোলতালাবের দিকে এগোতে থাকে সে। একটা ভীষণ চেনা গন্ধ নাক হতে মাথার ঘিলুতে আঘাত করে খালি। খুব চেনা কিন্তু কিছুতেই আইডেন্টিফাইড করা যাচ্ছে না। গন্ধটা নানার শ্রীহরি তেলযুক্ত মাথার গন্ধ কিংবা বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া বিল ধারের আঁশটে গন্ধ বা পাটজাগ দেওয়ার খুসবুর সাথে নানার চল্লিশার দিনের ঘি, মিঠা আতর, মশলা ও গরুর গোস্তের চড়া গন্ধ গিয়ে মিশে যাচ্ছে যেন মনে হয়, কবরতলার লেহানে; সেখান থেকে সবকটা গন্ধ মিলে মিশে হাওয়ার গা ভাসিয়ে জলঙ্গী নদীর মজা চর পেরিয়ে,সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ কাটিয়ে কৃষ্ণনগর,রানাঘাট, নৈহাটি টপকে ব্যারাকপুরের গান্ধী আশ্রমে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে; বাঙালি হলেও ফরাসী নাগরিক আরাফাতকে অস্থির করে তোলে।!! গন্ধটার জন্য কি না বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু আরাফতের চোখের লেন্সটা সাদা কালো এপিক ফরাসী সিনেমার মতো হয়ে উঠতে লাগে। সাদা কালোর মাঝেও রঙ আসে রঙ যায়।

ওই তো তালগাছগুলো। পিছনেই মাদ্রাজি চার্চ। রোজাদার মানুষের ব্যস্ততা বাড়তে লাগে। রোজা খোলার তোরজোড়। ওড়িয়া চপওয়ালা দ্রুততার সাথে বেগুনী ভাজছে কালো বাসি তেলে। সিদ্ধ ছোলা আর ফলের দোকানিরা চিৎকার করে ঝগড়া করছে,পাশের রুটি ও বাকরখানিওয়ালার সাথে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বে না, এ দুনিয়ায়। আরাফতের হাসি পায়। আবার একটা সিগারেট ধরায়। সামনে একটা পুরনো আতরের দোকান। সাইনবোর্ডে ইংরেজি তে লেখা ‘কাদের সিদ্দিকী’।তার পাশে লোহার শিকে গরুর মাংস গাঁথা হচ্ছে। সামনের কয়লার আঁচে ঝলসে নিচ্ছে বিহারি বাবুর্চি। মুখের বলিরেখা গুলো অনেক ইতিহাস বয়ে চলার সাক্ষী!! মাংস পোড়ার গন্ধে চনমনে হয়ে ওঠে নেক রোজাদার মানুষ। ঠিক উল্টোফুটের হনুমান মন্দিরের মাথায় বসা কাকেদের মত ডাল!! কাকেদের ধৈর্য আর নেই, কাবাবের গা থেকে যত জল পড়েছে পরিপক্ক কাবাবের আনন্দে তারাও উৎসবের আয়োজন করে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে লাগে ১৯৪৬ সালের মতই। আর কিছুক্ষণ পর আজান দেবে বোধহয়। গোলতালাবের পানিতে কিছু মজদুর ওজু করে। আরাফত ও গোলতালাবের ঘোলা জলে পা চুবিয়ে বসে আছে। ভাবতে থাকে নানাও নিশ্চিত এখানেই ওজু করত।

–তখন পানি অনেক সাফ ছিল,তাই না নানা??
– জ্বী

একটা কিশোর ছেলে। কতই বা বয়স হবে?? সতেরো মেরেকেটে। সাদা কুর্তা পাজামা, মাথায় অবিন্যস্ত চুল। জলে কিছুটা ভেজা, পকেট থেকে ফেজ টুপি বার করতে করতে,তার পাশে না না পাশে না একদম গায়ে গা লাগিয়ে বসে রয়েছে। দেখতে অবিকল নানার ছোটবেলার মতো। আরাফত প্রায় সন্ধার ম্যাজিক লাইটে, উল্টানো তালগাছ আর মাদ্রাজী চার্চের প্রতিবিম্বের তীরতীর করে কাঁপার দিকেই এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে রেখেছিল। কারন সেই জলছবিতে এসে মিশতে লাগে পার্কের দেওয়ালে উর্দুতে লেখা স্লোগান… তার বোধগম্যের বাইরে কিন্তু No NRC NO CAA ইংরেজি তে। মাথায় ফ্রেমটা দেখি করে ক্যামেরা বের করে। ততক্ষণে একগুচ্ছ মেটে কাঁকড়ার দল আরাফতের পায়ে ঠোকরাতে থাকে। ইবলিশের বাচ্চা ইবলিশ কাঁকড়ার দল যত ঠোকরায়,তার শরীর ততই কবুতরের পালকের মতো হালকা হতে লাগে। সেই গন্ধটা আবার অবশ করে দিচ্ছে। তার রুহুর মধ্যে , আরো গভীরে কে যেন ঢুকে পড়ে সব বে দখল করে নিচ্ছে; জমীন -আশমান!! ন্যারেটিভ গ্র‍্যান্ড ন্যারেটিভ সব ঘেঁটে চন্দ্রবিন্দু। গাঁয়ের পীরতলা, মাটির দুলদুল, নামতা পড়ার খারিজী মাদ্রাসা আর কথা বলা বিঘৎ মাছের বিল…মন্তাজের মতো ধাক্কা মারে ডাউনটাউন প্যারির আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াল গ্রাফিত্তিতে। টাইম-স্পেসকে গুলিয়ে ‘ফোর্থ ডাইমেনশন’ বুনে চলছে অনাগরিক সভ্যতা। রিফিউজি যেখানে সবচেয়ে খারাপ গালি। কাঁকড়া হারাম না মাকরু, এ ভাবনা গোলতালাবেই পড়ে রইল।

১৯৪৬। ক্যামেরার সামনে ষোড়শী আ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটি। হাতে ব্যাটমিন্টন রাকেট। স্লো মোশনে ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায়। তারপর ঐ যে, চার্চের পাশে সাততলা বাড়ির সাততলার কোণের বেলজিয়ান জানলা খুলে যায়। মেয়েটি কিছুক্ষণ নীচের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাঁসে। আজান হল, পকেটে কয়েকটা মাত্র খেঁজুর নিয়ে; আরাফত রোজা ভাঙার অপেক্ষা করতে থাকে। আরাফত কেন হবে?? সে সাততলার ওপর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি পিয়ানোর সুর শুনতে শুনতে পানির বদলে চা খেতে গিয়ে দেখে তার কাছে মাত্র চার আনা!! রানির ছবি মার্কা। এ দিয়ে চা হয় নাকি?? আলবাত হয়। অনেককিছু হয়। চা-টা যদিও দারুণ লাগে। সিগারেটের দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়ে, পান, বিড়ি, খৈনির ডিব্বার পাশ দিয়ে আয়না টা হাতছানি দিচ্ছে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ইমেজ। লম্বা চুল, দাড়ির বদলে ফেজ টুপি পড়া এক কিশোর। রুহুর মধ্যে রুহু। দুই ভেঙে এক, আবার একে একে দুই! ‘ আহলে হাদীস ‘ মসজিদের দিকে দৌড় লাগায়। নামাজ পড়বে।

চারিদিক থমথমে। রোজা ভেঙেছে অনেকক্ষণ। কালু মিঞার চায়ের দোকানে বড় জটলা। কলকাতাবিহীন পাকিস্তান, ইমপসিব্‌ল! সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগ কলকাতাকে পাকিস্তানে নেবেই। ওদিকে নাকি গোপাল পাঁঠার দলবল, বৌবাজারের দিকে ভালো সংখ্যায় মজুত। লাঠিসোঁটা আর বোমা নিয়ে।

–নানা চলো চা খাবে??
আরাফত ও চ্যাঙড়া (ইয়াং) নানা যমুনা সিনেমার দিকে লক্ষণ যাদবের দোকানে এসে দাঁড়ায়। দুজনেই চুপচাপ চা খেতে থাকে। সিনেমা ভেঙেছে। একদল বিহারি রিক্সাওয়ালা সিনেমা দেখে বেরিয়ে, বিড়ি ধরালো। এরপর খালাসীটলাতে বাংলা মদ খেতে যাবে। কলিজা বা মেটে চচ্চড়ি দিয়ে। এদের দলে হিন্দু মুসলমান সব আছে।মাতালদের দাঙ্গার ভয় থাকেনা।

– তুমি ঐ মেয়েটার জন্যই এখানে আসো , তাই তো??
নানা হাসতে লাগে।একটা গাড়ি যায় পার্ক স্টিটের দিকে। আলো পড়ে ওর নানার মুখে। সে এক প্রেমিক হাসি, সমস্ত উত্তর যেন লুকিয়ে আছে হাসির মাঝে। যেন বলতে চাইছে, হ্যাঁ এই লোহাগরম কলকাতায়। হাওয়ায় ‘নোয়াখালি’র দাঙ্গার খবর উড়ে বেড়়ানো কলকাতায়। অভিজাত হিন্দু বন্ধুদের চোখে হঠাৎ মুসলমান হয়ে ওঠা কলকাতায়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র,জলপানি পাওয়া সৈয়দ ইফতেখার খান, শুধুমাত্র বেলা শেষের ওই ব্যাটমিন্টন খেলে ফেরার পথে এক পলক দেখে গলা শুকিয়ে কেমন দলা পাকিয়ে যাওয়ার অনুভূতি ও পিয়ানোর শব্দ শোনার জন্যই তো রয়ে যাওয়া, কলকাতায়।

সেদিন আর তারাবির নামাজ শেষ হয়নি। মৌলালির মাজারে হিন্দুদের হামলা দিয়ে শুরু হয়। তালতালা থেকে পুলিশের জিপ উর্দুতে কি যেন ঘোষনা করে যায়।’ আল্লাহ আকবর’ ‘নারায়ে তকবির ‘ রিপন স্ট্রিট, মার্কুইজ স্টিট, পার্ক সার্কাস গমগমে। দূরে ওয়েলিংটনের ওপার থেকে ভেসে আসে ‘ জয় মা কালি’ কলকাতাকে পাকিস্তানে যেতে দেবো না। তখন অবশ্য জয় শ্রী রাম ছিলনা!! মসজিদের ভাঙা মাইকে এক বিহারী চিৎকার করছে, ‘‘ভাই লোগ রমজানকে মাহিনে পর, কাফের হিন্দুঁও হামলা চালারাহেঁ… ঈমানকে লিঁয়ে হাতিয়ার উঠাও….ফতেহ হামারি হোগি, ইনশাল্লাহ!’’

লক্ষণ যাদবের দোকান আজ বড়ই খালি। ওরা দুই ভাঁড় চা নেয়। চায়ের ভাঁড় ফেলতে গিয়ে চোখ আটকায়, জব্বর মিয়ার চুন খসে যাওয়া ভাঙা দেওয়ালে নতুন সবুজ কালিতে লেখা উর্দুতে ‘লড়কে লেঙে পাকিস্তান’। তার পাশে গান্ধীজির ছবি দেওয়া শান্তি পোস্টারের শুধুমাত্র চশমা দুটো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, বেদনার জলছবির চিহ্ন।

–নানা গ্রামে ফিরা চলো। আবার সব শান্ত হলে আমরা আসবনে তোমার কলিকাতায়।

সামনে ট্রাম জ্বলছে। টায়ার পুড়ছে। সাততলা বাড়িটার বেলজিয়ান জানলা সেদিন শেষবারের মতো খুলেছিল। পিয়ানো বাজেনি।

বর্ষাস্নাত শহরে একপ্রকার কুয়াশার চাদর হয় ভোরবেলা। সে চাদর ঢেকে রেখেছে তিনদিন ধরে জমা মৃত লাশের সারি। লাশের নাম নেই, মিছিল আছে। ভাঙা মসজিদ, আধপোড়া মন্দির, ধর্ষিত কিশোরীর মৃতদেহ খুবলে খাওয়া অভুক্ত কুকুর, উপরানো ট্রামলাইন যে দীর্ঘদিন বোবা থাকবে। রাস্তার রক্ত ধোয়া হচ্ছে পবিত্র গঙ্গার জল দিয়ে। দূরে কোথাও ফজরের আজান শেষে অভ্যাবসতই নামাজিদের আহ্বান জানাচ্ছে মুয়াজ্জিন, সে ভুলে গেছে এ শহরের সমস্ত নামাজিরা জারিগান বুনছে। মানুষের কাবাবের গন্ধ পেরিয়ে, ফুল আঁকা টিনের তোরঙ্গ ও একরাশ স্বপ্নভাঙার গল্প নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে একা ভীষন একা হাঁটছে আরাফতের নানা মানে মরহুম ইফতেখার খান। ট্রেনের সিগনাল সবুজ হয়ে ওঠে নিয়মমাফিক। কবিতার হাতেখড়ির কলকাতা,অ্যালবার্ট হলে আড্ডা, দূর্গাপূজার সিদ্দি, রয়ালের চাপ , কমিউনিস্ট ইস্তহার, নৌবিদ্রোহের গান আর পার্সি কেকের গন্ধ নিয়ে থাকা নাম না জানা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কিশোরী…বিদায়।

গাড়ি ছেড়ে দেয়। শেষ খুলনা মেল। ১৯৪৬।

সৈয়দ ইয়াসের আরাফাত

কবি ও গল্পকার ও স্বাধীন চলচ্চিত্রী।

Share