।। ইমরান আল হাদী ।।
আছিয়া রাতের কিছু সময় কুকুরগুলো আর তৌরাশিয়াকে নিয়ে চাতালের অন্ধকারে বসে থাকে। যদিও কিছু দোকান খোলা থাকে বড় রাস্তার পাশে। বিদ্যুতের লাল কমলা বাতি একটা একটা নিভতে থাকে। একে একে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকলে কুকুরগুলোর চোখে প্রকৃত অন্ধকার নেমে আসে। আছিয়া উঠে হাঁটা দেয়। অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে তৌরাশিয়ার চোখের মধ্যে হাঁটতে থাকে আছিয়া। সন্ধ্যার পরে এইসব এঁটো দুর্গন্ধ গলিতে মানুষ আসে না। তার উপর কুকুরগুলির সাথে জুটছে এক নতুন পাগলা পাহারাদার। এবং আছিয়া পাগলি যে আছিয়া পাগলি, তাকে এড়িয়ে চলতে হয়। সে কি কাউকে মারে নাকি কামড়ায়। তার কাছ থেকে মানুষ দূরে থাকে তার মুখের বাক্যভয়ে।
মানুষের জীবনে বৃষ্টি থাকে না চিরকাল। তৌরাশিয়া এই আপ্তবাক্য নিয়ে কোন সুদূর অতীতে থেকে বেরিয়ে পড়ে বৃষ্টির সম্ভাব্য সন্ধানে। অবশেষে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে তৌরাশিয়া। হাঁটা পথের ক্লান্তিতে গুলিয়ে ফেলে নিজ নামধাম বাপের নাম, এমনকী অনাগত সন্তানের নাম। তৌরাশিয়ার নিজ নাম বাপের নাম, পরবর্তীকালে তার মৃত সন্তানের নামও যেন হয়ে যায় তৌরাশিয়া।
তৌরাশিয়া বিবিধ পথে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। পেটের পুরোনো ব্যথাটা জেগে ওঠে। ব্যথায় পেট চাকাচাকা হয়ে উঠলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। গ্রাম্য হাট, ভরদুপুর। গুড়ের ভাঙা ভাঁড় চেটে খেয়ে কুকুরগুলি শুয়ে আছে হাটের বাচারি ঘরে। তৌরাশিয়ার পানি খাওয়া দরকার। তবু সে পানির তালাশে না গিয়ে শুয়ে পরে কুকুরগুলির বিপরীতে, বাচারি ঘরের মাটিতে, উপুড় হয়ে। মাটির শীতলতায় কিছুটা ব্যথা উপশম হলে ঘুমিয়ে থাকে, শেষ কুকুরটি উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। কুকুরটি উঠে যাওয়ার আগে তারস্বরে ডেকে ওঠে। যেন দলের শেষ সদস্যটি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে খাদ্যের খোঁজে অথবা পাহারার কাজে। এভাবেই আরও পরে কুকুর সমান বিশ্বস্ততা নিয়ে তৌরাশিয়া পেয়ে যায় দলভুক্ততা স্থিরতা দায়িত্ব— অনাহুত পিতৃত্ব। মানুষের খাতায় নাম ওঠে তার। হয়ে ওঠে রাত পাহারাদার।
তৌরাশিয়া এই গ্রাম্য হাটে রয়ে যাবে কেন? এখানে কি সে পেয়ে গেল চিরকালীন বৃষ্টির খোঁজ? তৌরাশিয়া ভেবেছিল তার এক পরমায়ু কাল ভিজে যাবে চিরকালীন বৃষ্টিতে। সে কি সেই বৃষ্টির খোঁজ পেয়ে গেল, এই হাটের এঁদো গলিতে? এই হাটের কী নাম? গ্রামের নামেই হয়তো এর নাম। হাটের মাঝ বরাবর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে জেলা সদরের বড় সড়ক। সড়কের দুই পাশে বসেন্দা দোকান, খোলা বাচারি ঘর। বাচারি ঘরে শুয়ে আছে তৌরাশিয়া। চারপাশে ঈষৎ অন্ধকার। ওই পাশে, গলিতে কুকুরগুলি জড়ো হয়েছে। কাইকুই করছে, একটা শান্তিপূর্ণ জটলা জমে উঠছে সেখানে। কুকুরগুলি কিছু খাচ্ছে। তৌরাশিয়ারও কিছু খাওয়া দরকার, নিদেনপক্ষে একটুখানি পানি। তবু সে ওঠে না, পেটের ব্যথাটা কমতির দিকে।
একটা মানুষ এসে দাঁড়ায় তৌরাশিয়ার পাশে। তৌরাশিয়াকে পা দিয়ে হালকা নাড়া দেয়। এবং একটি নারীস্বর কানে এলে তৌরাশিয়া উঠে বসে। এই অকস্মাৎ সাক্ষাতে, কার বেশি চমকে ওঠা উচিত সে বিষয়টুকু বাদ রেখে বলা যায় তৌরাশিয়াই বুঝি বেশি চমকায়। নারীটিকে বলতে শোনা যায়— আমি ভাবছিলাম কুত্তা, তা তুমি দ্যাখি মানুষ। কুত্তার লাইগ্গা ভাত আনছি, তুমি খাবা? তৌরাশিয়া বসা অবস্থায় মানুষটার দিকে তাকায়। মুখটি ঠাহর করতে পারে না, হাতে একটি পাত্র। মানুষটা উবু হয়ে বসে পড়ে। নাম জিজ্ঞেস করলে তৌরাশিয়া কিছু বলে না। নারীটি বলে, তুমি কি বোবা কালা নাকি পাগল, কথা কও না ক্যান? আমি কিন্তু পাগলি! আছিয়া পাগলি! তুমি কেডা? বাড়ি কই? তৌরাশিয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায় নাম বলে, বলে বাড়ি নাই। নারীটি বলে, তাইলে তুমিও পাগল! ভাত খাবা নেও, ভাত খাও, ডর নাই, কুত্তায় মুখ দেয় নাই। তাগো কলাপাতায় খাইতে দেই। অন্ধকার বেড়ে গেলেও চোখে সয়ে এসেছে। তৌরাশিয়া অন্ধকার মেখে মেখে বহুদিন পর ভাত খাচ্ছে। বাহিরে তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে।
তৌরাশিয়ার অন্য কোথাও যাওয়া হয় না। দিনে বাচারি ঘরে পড়ে পড়ে ঘুমায়। সন্ধ্যার কিছু পরে আছিয়া ভাত নিয়া আসলে কুকুরের ভাতে ভাগ বসায়। রাত গভীর হলে ঘুমহীন একপেট ব্যথা নিয়ে হাটের গলিতে হাঁটতে থাকে। পেটের ব্যথা আরও তীব্র হলে ন্যাংটা হয়ে ‘নইদের পুকুরের’ কালা জলে নেমে যায়। বুক অবধি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরের কালাজলে। রাতের হাঁটাহাঁটিকালীন তৌরাশিয়াকে পেয়ে যায় হাটের পুরাতন বৃদ্ধ পাহারাদার রকমান ফকির। তৌরাশিয়াকে দাঁড় করায়। যেহেতু তৌরাশিয়া সারা রাত হাঁটতে থাকে, অন্যদিকে রকমান ফকির রবের চা দোকানের বেঞ্চিতে বসে ঝিমায় সারারাত। তাই তৌরাশিয়াকে দাঁড় করানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। দাঁড় করিয়ে জানতে চায় কী নাম কী বৃত্তান্ত, তাতে নাম বলে থেমে যায় তৌরাশিয়া। যেহেতু তৌরাশিয়ার নাম ছাড়া আর কিছু নেই দুনিয়ায়। আর আছে কেবল চিরন্তন ব্যথা যা মানুষকে দেখানো যায় না। ব্যথা দেখানো না গেলে মানুষ কি বিশ্বাস করে? রকমান ফকির বলে, কাজ করবা, পাহারাদারের কাজ? রাইতে তো এমনে এমনেই ঘুরো। তাইলে পাহারাদারি করো, আমি হাট কমিটির লগে কথা কই। তয় এই রকম ল্যাংটা ঘুরতে পারবা না। পাহারাদারের একটা ইজ্জত আছে।
পাহারাদারের পোশাকে তৌরাশিয়ার গরম লাগে, তাতে পেটের ব্যথাও বেড়ে যায়। খালি গায়ে বাজারের গলিতে হাঁটতে থাকে। যেহেতু ন্যাংটা হয়ে নইদের পুকুরে নামতে পারে না আর। ব্যথায় কেবল পাগল পাগল লাগলে বারবার আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টিতে ভিজলে ব্যথা কমে তৌরাশিয়ার। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে চির বর্ষার জল মানুষের হায়াতে থাকে না চিরকাল।
তৌরাশিয়া বাঁশের লাঠি হাতে ঠুকেঠুকে হাঁটে। প্রায় সময়েই পেটে ব্যথা থাকে তার। সন্ধ্যায় তৌরাশিয়াকে পাহারাদারের পোশাকে দেখে আছিয়া চমকায়ে যায়। বলে তোমারে পাহারাদারের চাকরি দিছে কেডা। পাগলের আবার চাকরি কী? পাগল আছিলা সেইটাই তো ভালো ছিল। কুত্তার লগে ভাত খাইতা, কুত্তার লগে ঘুমাইতা। এখন তো তোমার লগে আছিয়া পাগলি বা কুত্তার লগে ফারাক হইয়া গ্যাল। তৌরাশিয়া সে রাতে আর ভাত খায় না, আছিয়াও ভাতগুলি ঢেলে দেয় কুকুরগুলির পাতে।
আছিয়া পাগলি কোথা হতে আসে তৌরাশিয়া কী তা জানে। আছিয়া সকালে হাটের পশ্চিম দিকের খাল পেরিয়ে হাটের উপর দিয়ে চলে যায় উত্তর কান্দা বা কোনো কোনো দিন পুব কান্দা। তৌরাশিয়া তখন ঘুমিয়ে থাকে। তৌরাশিয়া এ-ও জানে না যে আছিয়াও কাজ করে। কাজ করে বড় মানুষের ঘরে, ঘর গৃহস্থালির কাজ— দুই বেলা খায়, রাতের খাবার নিয়ে আসে। খাওয়ায় কুকুর আর তৌরাশিয়ারে। আগে কিছুটা ভাত বাঁচলে আছিয়া খেত। এখন তৌরাশিয়া খায়। পরের দিন আছিয়া আসলে তৌরাশিয়া ভাত খায়। আছিয়া বলে হাটে চুরি হইলে তুমি কি কিছু করতে পারবা? তুমি তো ঠিক কইরা নিজের নামও কইতে পারো না। চুরি হইলে তোমারেই চোর বানাইয়া জেলে দিবে।
রকমান ফকির তৌরাশিয়ার রোগটা কী জানতে চায়। জানতে চায় সে কেবল আকুলিবিকুলি করে কেন। তাতে তৌরাশিয়ার কেবল বলতে পারে তার চিরন্তন ব্যথার খবর। রকমান ফকির দাওয়াই বাতলে দেন— বিলেতি সোডা। বিলেতি সোডার খাঁড় নইদের পুকুরের কালাজলে গুলে খাবে ব্যথার শুরুতে। যদিও তৌরাশিয়া মনে করতে পারে না ব্যথার শুরু কোথায় রেখে এসেছে। তবে সে জানে তার ব্যথার একমাত্র দাওয়াই চির বর্ষার জল। চির বর্ষার জলের তালাশ না পাওয়া অবধি, রকমান ফকিরের দাওয়াই গুঁজে রাখে ট্যাকের খুতিতে। ব্যথা যদিও কিছুটা কমে তবে স্বাদ ভালো না। যদিও রকমান ফকিরের প্রতি যে সংকোচ অথবা ভয়, সেটাও আর থাকে না বেশি দিন। থাকে না যখন রকমান ফকির শীতের শুরুতে পাহারাদারি ছেড়ে দেয়, এমনকী দুনিয়াও, তখন থেকে রাত্রির ভিতর তৌরাশিয়ার পাশে আর কেউ থাকে না।
আছিয়া রাতের কিছু সময় কুকুরগুলো আর তৌরাশিয়াকে নিয়ে চাতালের অন্ধকারে বসে থাকে। যদিও কিছু দোকান খোলা থাকে বড় রাস্তার পাশে। বিদ্যুতের লাল কমলা বাতি একটা একটা নিভতে থাকে। একে একে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকলে কুকুরগুলোর চোখে প্রকৃত অন্ধকার নেমে আসে। আছিয়া উঠে হাঁটা দেয়। অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে তৌরাশিয়ার চোখের মধ্যে হাঁটতে থাকে আছিয়া। সন্ধ্যার পরে এইসব এঁটো দুর্গন্ধ গলিতে মানুষ আসে না। তার উপর কুকুরগুলির সাথে জুটছে এক নতুন পাগলা পাহারাদার। এবং আছিয়া পাগলি যে আছিয়া পাগলি, তাকে এড়িয়ে চলতে হয়। সে কি কাউকে মারে নাকি কামড়ায়। তার কাছ থেকে মানুষ দূরে থাকে তার মুখের বাক্যভয়ে।
আছিয়া পোয়াতি! আছিয়া পাগল তবে রাস্তার পাগল না। সে মানুষের সাথে সহাবস্থান করে। দুনিয়ায় কেউ না থাকার মধ্যে আছে জংলার মধ্যে পিতৃভিটা। মানুষের বাড়ি কাজ করে খায়। আছিয়া মানুষের অনেক নিয়ম না মানলেও কতক নিয়মে সে অভ্যস্ত। যেহেতু মানুষের কাজ করতে হয় তাই অনেক নিয়মে তাকে থাকতে হয়। সে তার নারী শরীর নিয়ে সচেতন। যদিও সে দেখতে সাধারণ। তার বয়স কত সে জানে না। যৌবন যেটুকু আছে তা শরীরের অযত্নে অনিয়মে চিমসে আছে। তবু এত দিন সে তার শরীর পুরুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে রেখেছে। তার প্রধান অস্ত্র তার মুখ। তার মুখের ভয়ে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে সাহস করনি এত কাল। আছিয়া তার নারী শরীর সম্পর্কে অতটা জ্ঞাত না থাকলেও সে বুঝতে পারে কিছু ঘটে গেছে। কেউ বেড়ে চলছে তার ভিতর।
আছিয়ার যে স্বতঃস্ফূর্ত গতি ছিল চলা বলায় তা ধীর হয়ে আসে, হাঁপিয়ে যায়। আছিয়া ধীরে বাচারি ঘরে আসে, বসে পড়ে তৌরাশিয়ার পাশে। কিছু বলতে চাইলেও বলে না। তৌরাশিয়া কি কিছু বুঝতে পারে, সে তো দুনিয়ার কোনো কিছুই জানে না। সে আছিয়ার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়া বসে থাকে। দুনিয়ার গাঢ়তম আঁধারের পরদা নেমে আসে হাটের গলিতে বেড়া ছাড়া বাচারি ঘরের চারপাশে। তৌরাশিয়া টের পায় চিরকালীন বর্ষার উষ্ণ জল তার হাতে এসে পড়ছে। তৌরাশিয়া সে জলের আনন্দে ভিজতে থাকে।
আছিয়া তার ভিতর বেড়ে ওঠা আরেকটি জীবন ঢেকে রাখতে পারে না বেশি দিন। মানুষের চোখে পড়ে যায় পেটের চাঙড়। মানুষেরা নিজেদের কাছে নিজেরাই জানতে চায় আছিয়ার পোলার বাপের খবর। আছিয়ায় গমনের গুপ্ত ইচ্ছা ছিল যাদের। তারা ভাবে, তারা নিজেরা কেন নয়। ভাবে আছিয়া তাহলে সহজ ছিল। অনর্থক ভয়ে আছিয়া হাতছাড়া হল তবে। এই গোপন হিংসা চাপা দিয়ে মানুষেরা বলে পাগলিরা এভাবেই কেন হাটের গলিতে পোয়াতি হয়? মানুষেরা যেন নিজেদের প্রবোধ দেয়। আর এভাবেই আছিয়ার অনাগত সন্তানের পিতৃত্বের ভার বর্তায় তৌরাশিয়া উপর। যদিও পাগলদের মনুষ্যসৃষ্ট কোনো নিয়মের গ্যাঁড়াকলে ফেলতে পারে না, তাই বিষয়টা নানান গুঞ্জনের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। মানুষেরা হাটে ঘাটে মাঠে ময়দানে গল্পটা কেবল পুনরাবৃত্তি করে ইন্দ্রিয়সুখ পায়। যতদিন না আছিয়া হাটের মল্লিকের ভরা হোটেলে চা পরোটা খাওয়ারত মিয়া জয়নালের কাছে জানতে চায়— মিয়াভাই, হেই কয় দিন যা করছেন তা কি আরও করবেন? প্যাটের মধ্য আপনের সোয়াবে লারেচারে। ভাবি কইছে আমারে আর কামে রাখবে না। এহন কি খালি ভাবির লগে সোয়াবের কাম করেন?
এই গল্পের সাথে আরেকটা গল্প তৈরি হয়। হাটে কেরোসিনের ড্রাম চুরি হয়। গলিতে সার করে দাঁড় করানো থাকে তেলের ড্রাম। এই সব সারবাঁধা ড্রাম হাটের গলিতে একটা আবডাল তৈরি করে। মানুষেরা আলগোছে প্রস্রাব করে ড্রামের আবডালে। কুন্ডু তেল ভাণ্ডার, তাদের তেলের ড্রাম রাখা থাকে গলির মধ্যে। কুন্ডুর তেলসুদ্ধ দুইখানা ড্রাম চুরি হলে ঘটনাটা পাকিয়ে উঠে। মিয়া জয়নালেরও মুদিখানা দোকান। তার তেলের ড্রামও থাকে গলিতে দাঁড় করানো। তৌরাশিয়াকে কোন এক দুপুরে মিয়া জয়নাল ভরা ঘুম থেকে জাগায়। সে রাতে মিয়া জয়নালের খালি তেলের ড্রাম ট্রাকে উঠে যায়। মিয়া জয়নাল মোকাম করবে। একটু বেশি রাতে ড্রাম উঠবে, তাই তৌরাশিয়াকে থাকতে বলেছিল মিয়া জয়নাল। তৌরাশিয়া যেহেতু পাহারাদার।
হাটে বিচার বসে, তৌরাশিয়ার চুরির বিচার। মিয়া জয়নাল তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করে। তৌরাশিয়াকে সে তার খালি ড্রাম তোলার দায়িত্ব দিয়েছিল। যেহেতু তার মোকাম করতে আগেই চলে যেতে হয়েছিল সদরে। ড্রাইভারের সাথে যোগসাজশ করে সে কুন্ডুর দুই ড্রাম তেল ট্রাকে উঠিয়ে দেয়। যেহেতু সে পাহারাদার তাই তার জন্য কাজটি সহজ হয়। মিয়া জয়নাল এ-ও জানায়, ট্রাক ড্রাইভার তেল দুইখানা তার পরিচিত আড়তে বিক্রি করতে চাইলে আড়তদারের সন্দেহ হয়। ড্রাম দুইখানা নিরাপদ আছে, তবে ড্রাইভার পলাতক। মিয়া জয়নাল সাথে আরও বলে, তৌরাশিয়া হাটের পরিবেশ খারাপ করছে। তার কাছে আছিয়া পাগলির যাতায়াত ছিল, আছিয়া পোয়াতি, এই বিচারের প্রার্থনাও করে যায় মিয়া জয়নাল।
বিষে বিষক্ষয়, ব্যথায় কি ব্যথা ক্ষয় হয়। তৌরাশিয়া ব্যথা ও অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে আছে বাচারি ঘরে। শ্রাবণের ভর দুপুর, উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার হাটে আসার প্রথম দিনের মতো। কুকুরগুলি পাশে আছে কি না সে বুঝতে পারে না। তবে আবারও কেউ পাশে এসে বসেছে। কারও হাত তৌরাশিয়ার গায়ে আলগোছে পড়লে সে পাশ ফেরে। আছিয়াকে দেখতে পায় সে। আছিয়া মরা পোলা প্রসব করেছে! তৌরাশিয়া কি দেখতে চায় না তার পোলার মুখ? মৃত পোলার মুখ? সে তো পিতৃত্বের দায়ভার নিয়েছিল, তবে কেন আছিয়া খালি হাতে এল। সে কেন পুঁতে দিয়ে এল তার পিতৃভিটায় মরা পোলারে। আছিয়া ধীরে উঠে যায়। রেখে যায় নাড়ি ফুল! আছিয়ার মৃত পোলার নাড়ি ফুল পড়ে আছে তৌরাশিয়ার পাশে বাচারি ঘরের মাটিতে। তৌরাশিয়া মৃতপ্রায় পুরোনো ব্যথা ফিরে পায়। আকাশে দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে গালি দেয় নিজেরে, শাপশাপান্ত করে খোদারে! মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে আছিয়া হারায়ে যায়, সাথে নিয়ে যায় তৌরাশিয়ার চির বর্ষার জল। অথচ আছিয়া হারায়ে যাবার দিন তৌরাশিয়া ধুম বৃষ্টির মধ্যে ঘুমায়ে ছিল মাছ বাজারের চাতালে।
ইমরান আল হাদী
কবি, কথা সাহিত্যিক। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে। সে গ্রামেই বসবাস। প্রকাশিত বই ‘হায়াতুননেছা’ (কবিতা ২০২১)