মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতা

।। সম্পাদনা বিভাগ।।

আমরা ভাষা, ভাষার বৈচিত্র্য, বহুভাষিকতা ইত্যাদি নানা বিষয়ের গোড়ার কথা ভুলে বসে আছি। একদিকে দরকার স্থানীয় বা লৌকিক ভাষার বিকাশ, তাদের সজীব ও জীবন্ত চর্চাকে নিজগুণে বিকশিত হতে দেওয়া, জীবন্ত ভাষার মধ্যে সাহিত্যকে বর্তমান রাখার চেষ্টা; অপরদিকে দরকার ভাষার বৈচিত্র, সপ্রাণতা ও সজীবতাকে আমলে নিয়ে সবার বোধগম্য ভাষার আবির্ভাব, বিস্তার ও বিকাশ নিশ্চিত করা – সাহিত্য এই দুইয়ের মধ্যবর্তী জায়গায় সক্রিয় বা ক্রিয়াশীল থাকে। কখনও লৌকিক বা মুখের ভাষার প্রতি তার পক্ষপাত দেখা যায়, কখনও আরও বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে সাহিত্য পৌঁছবার বা সবার কাছে বোধগম্য হবার চেষ্টা করে। এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে সাহিত্য নিজের চর্চা জারি রাখে। সৃষ্টিশীল বা সতত জীবন্ত সাহিত্য নতুন ভাষাও তৈরি কিংবা আবিষ্কার করে…

মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতা

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোর ডিরেক্টার জেনারেল অর্ডে আজুরে ২০২১ সালে এই দিবস উপলক্ষ্যে যে ‘বাণী’ দিয়েছিলেন, সেখানে যথারীতি তিনিটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথমটি কমবেশী আন্তর্জাতিক ভাবে গৃহীত প্রাথমিক নীতি বা সংকল্প: মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অধিকার। বাকি দুইটির মধ্যে একটি হচ্ছে ভাষার বৈচিত্র্য (linguistic diversity) সুরক্ষার ওয়াদা। ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র উভয়েরই দায়। তৃতীয়টি হচ্ছে বহুভাষিকতা (multilingualism); অর্থাৎ নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন। এ বছর ইউনেস্কো শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সমাজে বহুভাষিকতা ও মাতৃভাষার ওপর জোর দিয়েছে।

বহুভাষিকতার অর্থ আমরা করি প্রমিত বাংলা ছাড়া বিদেশি ভাষা শিক্ষা। বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব আছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু বহুভাষিকতার মানে বাংলা ছাড়া শুধু ফরাসি, জর্মন, ইংরেজি, হিন্দি, আরবি ইত্যাদি শেখা নয়। আমরা ভুলে যাই বহুভাষিকতার মানে দেশে বাস করা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা জানা ও চর্চা জারি রাখাও বটে। যেমন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাঁওতাল, মুন্ডা, খাসিয়া, মান্দি, ম্রং বা আরও অন্যান্য জাতসত্তার ভাষা জানা। তাছাড়া, নিজ নিজ আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষা জানাও বটে।

‘প্রমিত’ বাংলা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষা না। তাই বহুভাষিকতাকে গুরুত্ব দেয়ার অর্থ একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাকেও গুরুত্ব দেওয়া। সেটা হতে পারে চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, নোয়াখালী, রংপুর, নদীয়া, বীরভুম, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, ত্রিপুর, বরাক কিংবা যে কোনো আঞ্চলিক ভাষা। ভাষার একটি দিক হচ্ছে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষার আশ্রয়ে একটি সাধারণ বা সকলের বোধগম্য ভাষার বিকাশ। যে ভাষায় সবাই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। এটাই ‘সরকারি’, ‘মানভাষা’ বা ‘প্রমিত’ ভাষা হিসাবে গড়ে ওঠে। বহুভাষিকতা মূলত জীবন্ত ভাষার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ রাখবার নীতি ও চর্চা। প্রমিত বা মানভাষা কোন পাথরে খোদাই করা বিধিবদ্ধ ভাষা না। তারও বিবর্তন ও বিকাশ আছে। প্রমিত ভাষার শক্তি ভাষার বৈচিত্রের সঙ্গে সজীব সম্বন্ধ রাখার চর্চার সঙ্গে যুক্ত। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষার বৈচিত্র ও বহুভাষিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সজীব সম্বন্ধ চর্চার এই ক্ষেত্রটি ‘সাহিত্য’ নামেও পরিচিত। বাংলা সাহিত্য সংক্রান্ত ধারণায় ‘সহিত’, ‘সহিতত্ত্ব’ বা সম্বন্ধ রচনার গুরুত্ব  অনেক পুরানা ধারণা। প্রতিপক্ষে একুশে সংখায় এ নিয়ে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করেছি। (দেখুন, “সাহিত্য’ মানে ‘লিটারেচার’ না”। এ আলোচনা আরও চলবে।

আমরা ভাষা, ভাষার বৈচিত্র, বহুভাষিকতা ইত্যাদি নানা বিষয়ের গোড়ার কথা ভুলে বসে আছি। একদিকে দরকার স্থানীয় বা লৌকিক ভাষার বিকাশ, তাদের সজীব ও জীবন্ত চর্চাকে নিজগুণে বিকশিত হতে দেওয়া, জীবন্ত ভাষার মধ্যে সাহিত্যকে বর্তমান রাখার চেষ্টা; অপরদিকে দরকার ভাষার বৈচিত্র, সপ্রাণতা ও সজীবতাকে আমলে নিয়ে সবার বোধগম্য ভাষার আবির্ভাব, বিস্তার ও বিকাশ নিশ্চিত করা – সাহিত্য এই দুইয়ের মধ্যবর্তী জায়গায় সক্রিয় বা ক্রিয়াশীল থাকে। কখনও লৌকিক বা মুখের ভাষার প্রতি তার পক্ষপাত দেখা যায়, কখনও আরও বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে সাহিত্য পৌঁছবার বা সবার কাছে বোধগম্য হবার চেষ্টা করে। এই দুই টানাপোড়েনের মধ্যে সাহিত্য নিজের চর্চা জারি রাখে। সৃষ্টিশীল বা সতত জীবন্ত সাহিত্য নতুন ভাষাও তৈরি কিংবা আবিষ্কার করে। যেমন, নতুন ভাবে বলার ভঙ্গী, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারের নতুন রীতি, বিদ্যমান প্রথাগত ব্যাকরণ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন অর্থোৎপাদনের সম্ভাবনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ইত্যাদি। অতএব ভাষার বৈচিত্র্য ও বহুভাষিকতা উভয়ই সাহিত্যের জন্য জরুরী বিষয়।

‘প্রমিত’ বাংলা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষা না। তাই বহুভাষিকতাকে গুরুত্ব দেয়ার অর্থ একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাকেও গুরুত্ব দেওয়া। সেটা হতে পারে চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, নোয়াখালী, রংপুর, নদীয়া, বীরভুম, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, ত্রিপুর, বরাক কিংবা যে কোনো আঞ্চলিক ভাষা। ভাষার একটি দিক হচ্ছে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষার আশ্রয়ে একটি সাধারণ বা সকলের বোধগম্য ভাষার বিকাশ। যে ভাষায় সবাই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। এটাই ‘সরকারি’, ‘মানভাষা’ বা ‘প্রমিত’ ভাষা হিসাবে গড়ে ওঠে। বহুভাষিকতা মূলত জীবন্ত ভাষার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ রাখবার নীতি ও চর্চা। প্রমিত বা মানভাষা কোন পাথরে খোদাই করা বিধিবদ্ধ ভাষা না…

মানুষ ভাষার মধ্যে বাস করে। সেটা কোনো আরোপিত বা কৃত্রিম ভাষায় না, নিজের মাতৃভাষায়। মাতৃভাষা এবং সাহিত্য একটি জনগোষ্ঠির কল্পনা, উপলব্ধি, মন, ভাব, চিন্তা ইত্যাদির নির্ণায়ক। একটি জনগোষ্ঠির বাস্তবে অস্তিত্বমান থাকা না থাকার প্রশ্ন একই সঙ্গে তার মাতৃভাষায় বর্তমান থাকা ও বিকাশের প্রশ্ন। এই দিক থেকে ভাষা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়। বাংলাদেশের জনগণের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব হচ্ছে এই সত্য তারা বুকের রক্ত দিয়ে তুলে ধরেছে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এই ছিল ভাষা আন্দোলনের দাবি। একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক অস্তিত্ব তার মাতৃভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় কায়কারবার করবার অধিকার এবং সেটা করবার শক্তি অর্জনের ওপর নির্ভর। ভিন্ন ভাষায় – বিশেষত কলোনিয়াল ভাষায় নয়, যতদিন একটি জনগোষ্ঠি তার রাষ্ট্রীয় কায়কারবার নিজের ভাষায় করতে অক্ষম থাকবে ততোদিন তার রাজনৈতিক অস্তিত্বও দুর্বল থাকবে। ভাষার দুর্বলতা কিংবা বিলোপ স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিশাবে বিলোপের প্রক্রিয়া। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের বৈশ্বিক তাৎপর্য এখানে নিহিত।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারার পরও বাংলাদেশ আজ অবধি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করতে পারে নি। কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যর্থতা মারাত্মক। একটি হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরে এবং সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান করার ব্যর্থতা। অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষা তো আছেই, কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন বাংলাদেশে চরম ভাবে ব্যর্থ। বিজ্ঞান চর্চায় বাংলা ভাষা প্রবল ভাবে উপেক্ষিত। দ্বিতীয়  মারাত্মক ব্যর্থতা হচ্ছে সরকারি সকল কাজে এবং সকল দফতরে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করতে না পারা। এই ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ব্যর্থতা সরাসরি ন্যায়বিচারের ধারণার পরিপন্থি। যদি অভিযুক্ত বৈচারিক ভাষা না জানার কারনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বুঝতে না পারে কিংবা কিসের ভিত্তিতে বা কোন আইনী প্রক্রিয়া মেনে তাকে শাস্তি দেওয়া হোল সে সম্পর্কে সম্যক অবগত না থাকে, তবে সেই বিচারকে ন্যায়বিচার বলা চলে না। প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই বাংলায় রায় লেখার কথা বলেছেন, কিন্তু সেটা পুরাপুরি কার্যকর হয় নি।  বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে আইন ও ন্যায়বিচারের সম্বন্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা যা নিয়ে আমাদের অবিলম্বে ভাবা উচিত।

পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি আধিপত্যবাদ শুধুই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়। পশ্চিমবঙ্গের ওপর উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ভাষিক অস্ত্র হিন্দি। বহু ভাষা, বহু জাতি-ধর্ম-বর্ণ সমন্বয়ে ১৯৪৭-এ তৈরি ভারত রাষ্ট্রের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, যা এমনিতেই দুর্বল, সেই দুর্বল কাঠামোটিকেও পুরোপুরি নস্যাৎ করার মূল অস্ত্র হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে ভারতের বিভিন্ন অহিন্দি রাজ্যগুলির স্থানীয় অর্থনীতি ও নিজ নিজ রাজ্যে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে খর্ব করতে চায় সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ । এ জন্য পশ্চিম বাংলার মতো অহিন্দি রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দি চাপিয়ে দিয়ে একদিকে বাংলাভাষা ও বাংলাভাষীদের গৌণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রেখে হিন্দিভাষীদের জন্যে পশ্চিম বাংলাকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের গণমানুষকে হয় হিন্দি না জানার জন্য প্রান্তিক হয়ে পডতে হচ্ছে অথবা বাধ্যত হিন্দি শিখতে বাধ্য হচ্ছে।

ভারতের কোনো জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা নাই। না থাকলেও হিন্দি শিখতে বাধ্য করার মাধ্যমে সাংস্কৃতিকভাবে কায়েম করা হচ্ছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ। অন্যদিকে হিন্দি মাতৃভাষা না হওয়ায় হিন্দি শেখার পরেও কাজের জায়গায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, সাঁওতালি, কুরমালি, রাজবংশী, লেপচা প্রভৃতি অহিন্দি জাতির বঙ্গবাসী হিন্দিভাষীদের থেকে পিছনে পড়ে যাচ্ছে।

হিন্দি আধিপত্য পশ্চিমবঙ্গের গণমানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে কেমনভাবে সম্পর্কিত সেটা জানতে হলে ভারতের আপাত শেষতম জনগণনার একটি তথ্যের দিকে তাকাতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত প্রায় ৮ কোটি অহিন্দি গণমানুষের ৮৩ শতাংশ মানুষ হিন্দি ও ইংরেজি জানে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তার এবং যোগাযোগের ভাষা বাংলা। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাকে সঙ্কুচিত করে হিন্দি চাপানো হলে এইসকল নিম্নবর্গীয় মানুষের পেটে সরাসরি লাথি মারা হবে, যেটা ইতোমধ্যেই দিল্লি শুরু করেছে।

ইংরেজি ভাষা যেমন ঔপনিবেশিক ভাষা, হিন্দি ভাষা হিন্দুত্ববাদের অস্ত্রও বটে। আমরা জানি হিন্দি ভাষা বেশ কিছু ভাষাকে এক প্রকার খুন বা বিলোপ করে দিয়ে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে বৃহৎ বঙ্গের অন্যতম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা, যেমন মৈথিলী, ব্রজবুলি ইত্যাদি। এই ভাষার স্ক্রিপ্ট ধ্বংস করেছে হিন্দি। এছাড়া ভোজপুরী, মাড়োয়া ইত্যাদি ভাষার লিপিও ধ্বংস করেছে হিন্দি। এই সকল ভাষার বোলের সংস্কৃতায়ন করে কৃত্রিমভাবে হিন্দি ভাষা তৈরি হয়। আমরা জানি মৈথিলী, ব্রজবুলি, প্রাকৃত ইত্যাদি ভাষার উপাদানের সহজাত মিশ্রণে বাংলা ভাষা গড়ে ওঠে। যেভাবে বিভিন্ন ধারা, উপধারা এক জায়গায় মিশে নদী স্বাভাবিক গতি পায় বাংলা ভাষার গড়ে ওঠাটা সেভাবেই। পরে আমাদের ভাষা ঋদ্ধ হয় আরবি, ফার্সি, তুর্কির মতো ভাষাগুলির উপাদানে। সেই ক্ষেত্রেও হিন্দিও বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। কিন্তু বাংলা আর হিন্দির সম্পর্ক অসম, এই সম্বন্ধের চরিত্র ঔপবেশিক আগ্রাসনের, চাপিয়ে দেওয়ার। বাংলাকে বিলুপ্ত করবার বাসনা এই আগ্রাসনের রয়েছে। পশ্চিম বাংলায় চাপিয়ে দেওয়া হিন্দির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সে কারণে বাংলাভাষী বা বাঙালি হিসাবে অস্তিত্বমান থাকতে পারা বা না পারার সঙ্গে সম্পর্কিত।

হিন্দি আধিপত্য পশ্চিমবঙ্গের গণমানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে কেমনভাবে সম্পর্কিত সেটা জানতে হলে ভারতের আপাত শেষতম জনগণনার একটি তথ্যের দিকে তাকাতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত প্রায় ৮ কোটি অহিন্দি গণমানুষের ৮৩ শতাংশ মানুষ হিন্দি ও ইংরেজি জানে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তার এবং যোগাযোগের ভাষা বাংলা। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাকে সঙ্কুচিত করে হিন্দি চাপানো হলে এইসকল নিম্নবর্গীয় মানুষের পেটে সরাসরি লাথি মারা হবে, যেটা ইতোমধ্যেই দিল্লি শুরু করেছে।

বাংলা ভাষা যেসকল উপাদানগুলি সহযোগে স্বাভাবিকভাবেই বা প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের বাচনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল, সেই সকল মৌলিক ভাষিক উপাদানগুলিও বাংলার পাশেই ছিল নিজ গৌরবে গৌরান্বিত। কিন্তু হিন্দি ভাষা নিজের বিকাশের প্রয়োজনে মৈথিলী, প্রাকৃত, ব্রজবুলি, ভোজপুরীর মতো ভাষার লিপিগুলিকে খারিজ করেছে, আর এই সকল ভাষার সঙ্গে আরবি-ফার্সির যে সহজাত আদান-প্রদান চলেছে, সেগুলোকেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খারিজ করা হয়েছে। উলটা হিন্দুত্বের বা ব্রাহ্মণ্যবাদের লিঙ্গুয়িস্ট টুল সংস্কৃতের আধারে উল্লেখিত মৌলিক ভাষার বিনির্মাণ করে জন্ম দেওয়া হয়েছে হিন্দি ভাষা।

মজার ব্যাপার হলো পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক বর্ণহিন্দু বাবু বাঙালি রয়েছেন যারা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে গর্ববোধ করেন, উর্দু আধিপত্যের বিপরীতে বাংলা ভাষার দ্রোহ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের সঙ্গে আজও সংহতি পোষণ করেন, অন্যদিকে তারা কিন্তু হিন্দি আধিপত্যবাদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন অফিস-কাছারি, প্রশাসনিক-সরকারি কাজে বাংলা তুলে দিয়ে হিন্দি চাপানো হলে তারা প্রতিবাদ করেন না। এমনকি বেসরকারি সংস্থাও যখন দিল্লির হিন্দি আধিপত্যবাদী নীতিকে অনুসরণ করে পরিষেবার ক্ষেত্রে বেমালুম হিন্দি চাপিয়ে দেয়, তখনও এইসব মানুষেরা নীরব থাকেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এমনকি বাংলা ভাষার বিষয়ে কথা বললে তারা অবলীলায় তাকে ‘প্রাদেশিক’ বলে দাগিয়ে দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না। প্যান ইন্ডিয়া পরিসরে চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষায় হিন্দি ও ইংরেজির পাশাপাশি গুজরাতি ভাষা থাকলেও কেন বাংলা থাকবে না- এই প্রশ্নও তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এর কারন কী?

কারণ একটাই।  এই সকল মানুষ এক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী কল্প জগতের মধ্যে বসবাস করেন, সেই জাতীয়তাবাদের মূল স্লোগান হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। অর্থাৎ হিন্দু ভাষা ও হিন্দুত্বের নিরিখেই ভারতকে হিন্দুস্থান বানাতে চাওয়ার যে হিন্দুত্ববাদী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিকল্পনা, তার সঙ্গে এরা অবচেতনে এক মত। তাহলে উর্দুর বিপরীতে এদের অবস্থান কেন? কারণ, উর্দু আরবি লিপিতে লেখা হয়, উর্দুর বোলে থাকে ফার্সির উপস্থিতি। অর্থাৎ ইসলাম অনুষঙ্গের কারণেই পাকিস্তানের এক সময়কার উর্দু প্রোজেক্টের এরা বিরোধী। কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে অন্যান্য ভাষার বিরাট সংখ্যক মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড তার বোধহয় এরা বিরোধী নয়, কারণ অবিভক্ত পাকিস্তানে হয়েছিল উর্দুকে সামনে রেখে, আজকের ভারতেও সেই একই কাজ হচ্ছে হিন্দির মাধ্যমে। কিন্তু এদের চোখে হিন্দির আগ্রাসন চোখে পড়ে না।

পশ্চিম বাংলাকে যা বিশেষ ভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেটা হলো, রাষ্ট্রবাদকে জাতিবাদে পরিণত করার হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প। এই প্রকল্প রুখে দেওয়াই এখনকার প্রধান কাজ।  হিন্দি, হিন্দু হিন্দুস্তানের রণধ্বণি দিয়ে এক কৃত্রিম ‘হিন্দু’ জাতি বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। অন্যান্য ভাষিক ও সাংস্কৃতিক জাতিসত্তাকে বিলোপ বা গৌণ করে হিন্দুত্ববাদ কায়েমের রাজনীতি মোকাবিলা করা পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু  বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার করার কর্তব্য  যাদের, তারাই প্রকারান্তরে রাষ্ট্রবাদকে জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত করার পক্ষপাতি। সেই সূত্রে এরা জাতীয় ভাষা হিন্দির পক্ষে । কখনো প্রত্যক্ষ ভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে। সব চেয়ে মজার ব্যাপার, এরা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে গর্ব করলেও বাঙলা ভাষার জন্যে যে বাঙালি মুসলিমরা প্রাণ দিয়েছেন, সেই শহীদদের সামাজিক পরিসরের মানুষ বাংলার বাঙালি মুসলমানকে এরা ‘বাঙালি’ বলে স্বীকৃতি দিতে নানা সময়ে গড়িমসি করেছে। এটা বর্ণ হিন্দু  ঐতিহাসিকক পরম্পরায় করে এসেছে। বাংলার গণমানুষের সামাজিক বর্গের শরীক মতুয়া, নমঃশূদ্র, আদিবাসী ও বাঙালি মুসলমানের বিরুদ্ধে  কলকাতার বাবু সমাজের এই ঘৃণাই বিশের দশকে কলকাতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। যে জাতীয়তাবাদ আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত একটি ডিসকোর্স হয়েই ছিল সুদীর্ঘকাল। বাংলার গণমানুষের জাতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের বদলে বাবু বাঙালি নির্মিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে ঘুরিয়ে বাংলার ভুমিমানুষের বিরুদ্ধেই অবস্থাই নেয়। অন্তত অবিভক্ত বাংলায় এমনটাই দেখা গেছে। তাই বাবু বাঙালি বা বর্ণ হিন্দুর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে পশ্চিম বাংলায় আমাদের সতর্ক হতে হবে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসন রুখতে হলে বর্ণ হিন্দু বা বাবু বাঙলালির তৈরি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর পর্যালোচনা পশ্চিম বাংলায় জরুরি হয়ে পড়েছে। হিন্দি আধিপত্যবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ান আসলে জাতীয়তাবাদের বর্ণবাদী ন্যারেটিভকেই হৃষ্টপুষ্ট করে।পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার লড়াই মূলত বাংলার অহিন্দি নিপীড়িত গণমানুষের জীবন-জীবিকা ও ভাষা-সংস্কৃতির গণতান্ত্রিক সংগ্রাম – যার মধ্যে বিশেষ ভাবে মুসলমান, নিম্ন বর্ণের মানুষ, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং তাদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্তিত্ব জড়িত।  হিন্দি আধিপত্যবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও সামাজ্যবাদী গায়েবী লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে বৃহৎ বঙ্গের অহিন্দি গণমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এখন জরুরি একটি কাজ। আমরা বিশ্বাস করি বাংলা সাহিত্য সেই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘প্রতিপক্ষ’ এই দায়টি বহন করে।  

Share