।। সজল কান্তি সরকার ।।
বড় বাংলার ভাববৈচিত্র্যে, বাংলার ভক্তি ধারায় দীন শরৎচন্দ্র নাথের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর ভাবসঙ্গীতের কারণে। তাঁর ভাবজীবনের উপর ধারাবাহিক আলাপের দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব।
দীন শরৎচন্দ্র নাথ (১৮৮৭-১৯৪১)
৪
এখন পর্যন্ত ‘দীন শরতের বাউলগান’ ও ‘এস্লাম সঙ্গীত’ নামে দুটি গ্রন্থের গ্রন্থরূপ দলিল পাওয়া গেছে। কথিত আছে ‘গৌরগীতি’ নামে আরও একটি গ্রন্থের কথা। এ বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ‘দীন শরতের বাউলগান’ গ্রন্থটি নলিনীরঞ্জন সরকারের পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রন্থিত হয় যার পাণ্ডুলিপি দীন শরৎ জীবদ্দশায় নলিনীরঞ্জন সরকারের ছোট ভাই পবিত্ররঞ্জন সরকারের কাছে হস্থান্তর করেছিলেন। কামীনিকুমার কর রায়ের দীর্ঘ ভূমিকায় যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘দীন শরতের বাউলগান’ বইটিতে মোট পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বাউল, দেহতত্ত্ব, পঞ্চতত্ত্ব, ষটচক্র, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, বৈষ্ণব সাধন পদ্ধতি, গৌরনিতাই, রাধাকৃষ্ণ, কিছু পদকীর্তন, নিমাই সন্যাস, রাই বিরহ, মালসী ও সূর্যব্রত ধামাইলসহ সমকালিন নানা বিষয়ক গান রয়েছে। শরৎচন্দ্র নাথ তাঁর প্রথম পাণ্ডুলিপিটি শ্রীযুক্ত নলিনীরঞ্জন সরকার মহোদয়কে উৎসর্গ করেন। তিনি দীর্ঘ উৎসর্গ পত্রে লেখেন-
‘‘ময়মনসিংহের গৌরমণি বঙ্গজননীর কৃতীসন্তান, ভারত বিখ্যাত অর্থনীতি বিশারদ বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার ভূতপূর্ব সদস্য, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, ‘বেঙ্গল ন্যাশন্যাল চেম্বার অব কমার্স এর সভাপতি, ভারতীয় জীবনবীমা সমিতি ও ভারতীয় বণিক সমিতি সক্সেঘর ভূতপূর্ব সভাপতি, হিন্দুস্থান ইন্স্যুরেন্স সোসাইটির প্রধান কর্মসচিব, কলিকাতা মহানগরীর মিনিস্টার সর্ব্বোপরি আমার আশ্রয় দাদা শ্রীযুক্ত নলিনীরঞ্জন সরকার মহাশয়ের কর কমলে ভক্তিকৃতজ্ঞতার অর্ঘস্বরূপ এই গীতি-পুস্তিকা অর্পিত হইলো- শরৎচন্দ্র নাথ।’’
১২৬ পৃষ্ঠার মূল গ্রন্থটির মুদ্রণ ত্রুটি সংশোধন করে বাকি সব ঠিক রেখে এই গ্রন্থে ছাপা হয়েছে। উল্লেখ্য ‘দীন শরতের বাউলগান’ গ্রন্থটির ছাপানোর কাজ ভারত থেকেই সম্পন্ন হয়। যে গ্রন্থটি আমার সংগ্রহে আছে। তাতে শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশকাল ‘১৩৫৫ সন ১২ই পৌষ’ উল্লেখ আছে শধু তাই নয় দীন শরৎচন্দ্র নাথের জন্ম মৃত্যুর সনও উল্লেখ রয়েছে। তবে তাতে প্রথম বা দ্বিতীয় মুদ্রণের মতো কোনো বিষয় উল্লেখ নেই।
দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘এস্লাম সঙ্গীত’-এর নির্দ্দিষ্ট প্রকাশকাল জানা যায়নি। জীর্ণ-শীর্ণ গ্রন্থটিতে প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠাসহ ৩৩, ৩৪, ৪১, ৪২, ৯৫ ও ৯৬ পৃষ্ঠাগুলি পাওয়া যায়নি। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে কইলাটি নিবাসী সুশীল কুমার বল মহাশয়ের নিকট থেকে প্রাপ্ত মূল গ্রন্থ থেকে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে রফিকুল ইসলাম খান অনুলিখিত ‘এস্লাম সঙ্গীত’ কপিতে উল্লেখ আছে গ্রন্থটি (ধারণা মতে) চল্লিশের দশকে প্রকাশিত হয়। গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে প্রথম গ্রন্থ ‘দীন শরতের বাউলগান’, প্রকাশের পরবর্তী সময়ে তুরুকপাড়ার (এলাকার) মৌলভী সাহেব ও রহমান পিয়ন (এই সময়ে পোস্ট অফিসে চাকুরিরত) নামে দুই সুধীজন গ্রামে গ্রামে সাহায্য তুলে দ্বিতীয় গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি বাউল দীন শরতকে অন্যান্য বাউলদের থেকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। ‘হকনামা’ ‘অজুদনামা’ ‘রুহুতত্ত্ব’ ‘চাইর কলিমা ও ছয় লতিফার স্থিতি’ ‘নূর ভাগ’ ‘দুজকের বয়ান’ ‘আদমত্ত্ব’ ‘আজাজিলের জন্মকথন’ ‘মৌতনামা’ ‘নামাজ নামা’ ও ‘আখেরতত্ত্ব’ প্রভৃতি ভাগে ইসলামের মারফতি ধারার বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দীন শরৎ চন্দ্র নাথ এই গ্রন্থে তুলে ধরেন। ইসলাম সংগীতে মালজোড়া গানের গুরু শিষ্য ধারা এমনভাবে তাঁর আগে কেউ রচনা করেছেন বলে জানা নাই। শ্রী শ্রী হক নাম শিরোনামে প্রথমেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন-
বন্দি গফুরু রহিম আল্লা আপে নিরঞ্জন
যাঁহার কুদ্রতে পয়দা এ তিন ভুবন
…
বিশেষ ভাবে রুহুতত্ত্ব, নূরভাগ, আদমতত্ত্ব আজাজিলের জন্মকথন, মৌতনামা ও আখেরতত্ত্বে তিনি বিশ্লেষণসহ মালজোড়া বাউলগানের ধারায় বিষয়গুলো যেভাবে ছন্দলয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন তা অসাধারণ ও ভিন্ন সৃষ্টি যা এর আগে এমন ভাবে কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। জটিল বিষয়ের সহজ সমীকরণ তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাই তাঁর রচনাগুলো গ্রামীণ সরল মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আদরের ধন। আর তারই বহিঃপ্রকাশ গ্রামে গ্রামে সাহায্য তুলে বইটি মুদ্রণের ইতিহাস। যে ইতিহাসের গর্বিত নায়ক অবোধ প্রশ্নকর্তা ও সুবোধ উত্তরদাতা বাউল কবি দীন শরৎ চন্দ্র নাথ। যেমন-আদম তত্ত্বে তিনি লিখেছেন,
শিষ্যধারা (প্রশ্ন) :
আদমতত্ত্ব জানবো বইলে বাসনা মনে।
গুরু কও শুনি হে আদম হাওয়ার জন্ম হইলো কেমনে।।
গুরুধারা (উত্তর) :
মাটির দেহ হবে মাটি খাঁটি কিছুই না।
মাটি আদম তৈয়ার করিয়াছেন রাব্বানা।।
…
কথিত আছে ‘গৌরগীতি’ নামে আরও একটি গ্রন্থের কথা। যা প্রকাশের জন্য কৃষ্টপুরের জমিদার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে এ গ্রন্থের কোন মুদ্রণ কপি পাওয়া যায়নি। প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল বলেন, ‘‘বইটি কৃষ্টপুরের জমিদার ছাপিয়ে দিয়েছেন।’’ আবার অনেকের মতে বইটি ছাপানোর কথা ছিল কিন্তু ‘রায়টের’ ফলে তা আর হয়ে ওঠেনি। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গান প্রকাশিত হয়েছে। ‘মানবমঙ্গল’ গ্রন্থে এযাবৎ সংগৃহীত গানগুলো মুদ্রণ করা হয়েছে। তবে ‘দীন শরতের বাউলগান’ গ্রন্থেও গৌরগীতি বিষয়ক বেশকিছু গান রয়েছে যা লিখিত সংগ্রহেও আছে। যেমন-
ও তুই কি দেখিতে ব্রজধামে যাবে রে নিমাই
সাধের বৃন্দাবন হইল শূন্য
আর তো ব্রজে সেই শোভা নাই
…
গৌরগীতি বিয়ষক গানগুলো সংগ্রহে গ্রামের কুলবধূদের শরণাপন্ন হয়ে যা সংগৃহিত হয়েছে তা আরও পাওয়ার আকাঙ্খা জাগায়। কেন্দুয়া নিবাসী রাখাল বিশ্বাস এ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি আমাকে বেশ কিছু গান সংগ্রহ করে দেন। তাছাড়াও রতিশাস্ত্র বিষয়ক বেশ কিছু গান তাঁর রয়েছে যা মানবমঙ্গল গ্রন্থে ছাপা আছে। সাজিউড়া গ্রামবাসীর সাথে আলাপকালে জানা যায় ‘রাইশ্যাম সঙ্গীত, নামে তাঁর আরও একটি গ্রন্থের কথা। ধামাইল গান তাঁর রচনায় খুব বেশি নেই তবে সূর্যব্রত ধামাইল হিসেবে তার বেশ জনপ্রিয় কয়েকটি গান রয়েছে যা গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠানে গাওয়া হয়। বিশেষ করে করতাল বাজিয়ে ধর্মব্রত, সূর্যব্রত ও সরস্বতী পূজায় বন্দনা পর্বে একটি গান খুব জনপ্রিয়।
বন্দি গুরু পূর্ণব্রহ্ম রামকৃষ্ণ চরণ
শ্রীগুরু গৌরাঙ্গ পদে লইনু স্মরণ
…
৫
আশি নব্বইয়ের দশকেও অলস বর্ষায় আলগঘরের আড্ডায় দীন শরতের গান ঘাম ঝড়িয়ে গাওয়া হতো। শরতের গুরু শিষ্য ধারায় মালজোড়া বাউল গান শুনতে উৎসুক শ্রোতা মাটি কামড়ে বসে থাকত। গানের মাঝে মাঝে শোনা যেত ভাবের-বাহার, আহা-হা হা! অহ-হ-হ! দেহ নাচাতে নাচাতে শ্রোতাদের ভাব গলে গলে পড়ত তালে তালে। শ্রোতারা আত্মমগ্ন হয়ে এক আসরে এক ধারায় মিশে যেত। গানের ভাববোধের সাথে এক হয়ে যেত জনবোধ। শুধু দীন শরতেই নয় আসরে বিভিন্ন জানা অজানা গীতিকারের কোন কোন গান যেন সরাসরি অনেকের জীবনের দুঃখবোধের বেদনার্ত দলিলের মত গ্রহণযোগ্যতা পেত। এক্ষেত্রে একটি গান হচ্ছে-
গুরু উপায় বলো না
জনমদুখী কপাল পোড়া
আমি একজনা
গিয়াছিলাম ভবের বাজারে
ছয় চোরা করলো চুরি
গুরু বাঁধল আমারে,
ছয় চোরায় খালাস পাইলো গো
গুরু আমায় দিল জেলখানা
শিশুকালে মইরা গেল মা
গর্ভে থুইয়া পিতা মইল চোখে দেখলাম না,
আমায় কে করিবে লালন পালন গো
কে দিবে মোর স্বান্তনা
এক সময় এ গানটি পল্লীর জনজীবনে খুবই হৃদয়গ্রাহী ছিল। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে গানটির জীবনঘনিষ্টতা। তৎকালে অস্বাভাবিকভাবে জন্ম-মৃত্যুর হার বেশি ছিল। সন্তান গর্ভে রেখে পিতার মৃত্যু এবং শিশুকালে মাতার মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। আর এ দশায় ভূক্তভোগী ছিল বাউল সাধকসহ অনেকেই। তাই তাদেরকেই গীতিকবি ‘জনমদুখী কপাল পোড়া’ বলেছেন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এমন ‘জনমদুখী’ দু-একজন ছিল যাদের জীবনে এমন ঘটনাটিই ঘটেছে। তাই হয়তবা এই গানটি পল্লীজীবনে অধিক জনপ্রিয় ছিল এবং আছে। এ গানটি বহুজন বহুভাবে উল্লেখ ও উপস্থাপন করলেও কোথাও এ গানের গীতিকারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লোকশ্রুতি আছে গানটি দীন শরৎ রচিত। দ্বিমতও আছে অনেক। ‘গুরু উপায় বলো না’ গানটি চিত্রপরিচালক কামাল আহম্মেদ তার বাংলা চলচ্চিত্র ‘পুত্রবধু’-তে প্রথম (সত্তর-আশির দশকে) ব্যবহার করেন। গানের শিল্পী ছিলেন মলয় কুমার ভৌমিক। যেখানে গানটিতে গীতিকারের নাম উল্লেখ নেই।
তবে এ গানটির রচয়িতা দীন শরৎচন্দ্র নাথ না হওয়ার বিষয়ে কিছু যুক্তি তোলে ধরা যায় যে, তাঁর সকল গানেই ভনিতা পাওয়া গেলেও এ গানটিতে নেই কেন? আবার বলা যায়, তার প্রথম গ্রন্থ ‘দীন শরতের বাউল গান’ যার পাণ্ডুলিপি তাঁর জীবদ্দশাতেই হস্তান্তর হয়েছিল, এ গ্রন্থে উক্ত গানটি অপ্রকাশিত কেন? এমন কী দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘এস্লাম সঙ্গীত’-এ গানটির উল্লেখ নেই। তাছাড়া প্রথম গ্রন্থ ‘দীন শরতের বাউল গান’ (প্রকাশ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ)-এ একটি দীর্ঘ ভূমিকায় কামিনীকুমার কর রায় দীন শরতের কতকগুলো গানের উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন যেখান এ গানটির উল্লেখ নেই। অনেক বিজ্ঞজনেই লিখেছেন, দীন শরৎ যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পিতা এবং শিশুকালে মাতা মারা যান। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি অন্ধ হয়ে যান। তাই এ গানটি দীন শরতের জীবনসঙ্গীত। এক্ষেত্রে বলা যায়- তৈয়ব আলী (১৮৯৩-১৯৮৭), প্রভাত বাউল (১৯১৮-১৯৭১) ও খুরশেদ মিয়াসহ (১৯৩০-?) অনেকেই এতদাঞ্চলে অন্ধ ফকির ছিলেন। যাঁরাও অনেক গান রচনা করেছেন। যেখানে এ গানটি তাঁদেরও জীবন সংগীত হওয়ার দাবী রাখে। তাছাড়া অন্ধত্বের সাথে এ গানটির গাথুনি তৈরির কোন যুক্তি আসে না। কেননা এখানে গানের ভাবধারায় অন্ধত্বের বিষয়টি প্রমাণ করে না। দীন শরৎ অন্ধ ছিলেন এ প্রসঙ্গে কামিনী কর রায় যিনি দীন শরতের সঙ্গ (১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের আশ্বিন) করেছেন, তাঁর ভূমিকায় দীন শরতের অন্ধত্বের বিষয়টি না থাকা খুবই অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। তাই দীন শরৎ ‘অন্ধ’ এ প্রচলিত সত্যটি এবং এই সত্যের কথিত দলিল হিসেবে গানটির বহুবিধ ব্যবহার পুনঃপর্যালোচনার দাবী রাখে।
১. দীন শরৎচন্দ্র নাথের রচনায় তাঁর জীবনের অনেক তথ্য পাওয়া গেলেও অন্ধত্বের কথা কোথাও উল্লেখ নেই।
যেমন:
বিদ্যাবুদ্ধিহীন আমি অত্যন্ত দরিদ্র।
মনুষ্যের মধ্যে হই ক্ষুদ্রদপি ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্রের ভিতরে যাহা ক্ষুদ্রশক্তি আছে
প্রকাশ করিতে নাহি পারি লোকের কাছে
২. দীন শরৎ চন্দ্র নাথের ঘনিষ্টজন কামিনী কর রায়ের লেখায় অন্ধত্ব ও অন্ধত্বের দাবী নির্ভর গানটির কথা উল্লেখ নেই।
৩. সাজিউড়া গ্রামের বাসিন্দা দীন শরতের প্রতিবেশি প্রত্যক্ষদর্শী প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল (৯৪), প্রতিবেশী সুলতান উদ্দিন ফকির (৯০), ভূপালকৃষ্ণ সরকার (৮৬) ও হারান দেবনাথ (৮৯) এর সাথে সাক্ষাৎ করলে (২০১৭ খ্রিস্টাব্দ) তারা দীন শরতের অন্ধত্বের কথাটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভুল বলে জানান। তাছাড়া যে সকল লেখক বা গবেষক শরৎচন্দ্র নাথের ভিক্ষাবৃত্তি ও দীনমজুরীর বিষয়টি তাঁদের রচনায় প্রচার করেছেন তাঁদের প্রতিও প্রত্যক্ষদর্শীরা নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
তবে তাঁর জন্ম মৃত্যুর নির্দিষ্ট বছর মাস দিনক্ষণ না বলতে পারলেও গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল, প্রতিবেশি ভূপালকৃষ্ণ সরকার, হারান দেবনাথ ও সুলতান ফকিরে সাথে সাক্ষাৎ (২০১৭ খ্রিস্টাব্দ) করলে তারা যে ধারণা দেন তাতে ১২৯৪-১৩৪৮ বাংলা সনটিই যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া ভূপালকৃষ্ণ সরকার ৩রা আশ্বিন ১৪০২ বাংলায় একটি চিঠি লিখে নেত্রকোনা জেলার ধীতপুর গ্রামের ডাঃ দীগেন্দ্র চন্দ্র সরকার (সুন্দরদা, গীতিকার)-কে জানিয়েছিলেন-‘…দীন শরৎ দেবনাথের পিতার নাম কুটীশ্বর দেবনাথ। তাহার জন্ম তারিখ জানা নেই তবে ব্রিটিশ পিরিয়ডের শেষ সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।’ তাছাড়া দীন শরৎ নাথের প্রথম গ্রন্থ ‘দীন শরতের বাউল গান’-এ ১২৯৪-১৩৪৮ বাংলা সনটি মুদ্রিত আছে যার সচিত্র সংযোজন মানবমঙ্গল গ্রন্থে আছে। স্থানীয় দৈনিক জনতা (২ মে ২০০৪) পত্রিকাতেও উক্ত সালকেই তাঁর জন্মমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই যা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার আর সুযোগ থাকে না। ফলে একথা বলা যেতে পারে দীন শরৎচন্দ্র নাথ ১২৯৪ বাংলা (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে) জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৩৪৮ বাংলা (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে) মৃত্যুবরণ করেন। যদিও অনেকের মতে বা অনেক গ্রন্থে উল্লেখ আছে তিনি ১৩১০ বাংলা (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে) জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩৭০ বাংলা (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে) মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য সুমঙ্গল শীল তাঁর দাদাগুরু শরৎচন্দ্র নাথের জন্মমৃত্যু ও অন্ধত্ব নিয়ে এই তথ্যবিকৃতি ও মিথ্যা গল্প রচনার প্রেক্ষিতে মনের দুঃখে একটি গানও রচনা করেছেন।
দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধু দীন শরতের রাখো মান
চোখ থাকিতে অন্ধ বানায় কেন এত অসম্মান
আসল তথ্য না জানিয়া কল্পনায় গল্প সাজাইয়া
অন্ধ ভিক্ষুক মুর্খ কইয়া কেন করছেন অপমান
সঠিক তথ্য প্রমাণ নিয়া যত পারেন যান লিখিয়া
শান্তি পাবে শরৎ হিয়া লেখকেরও বাড়বে মান
আমি সাজিউড়ার সন্তান আরেকজন হয় ফকির সুলতান
গোপালকৃষ্ণ হারাণ নাথের বয়স প্রায় সমান সমান
বাউল সাধক শরৎ নাথে গান লিখেছেন নিজের হাতে
দেখেছি তাঁর চোখেতে চারজন আছি বর্তমান
আধ্যাত্বিক এই বাউল সাধক কৃষিকাজেও ছিলেন সার্থক
ছিল না তাঁর অর্থ সম্পদ অক্ষরজ্ঞানে গুণবান
সুমঙ্গল দিয়েছে প্রমান আরও যদি জানতে চান
কৃপাকরে জানিয়া যান দীন শরতের জীবনমান
৬.
দীন শরৎ চন্দ্র নাথ নিয়ে আমার জানা মতে আশির দশক থেকে এ যাবৎকাল যে সব কাজ হয়েছে তা তাঁর গানগুলো রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখলেও তাঁর ব্যক্তি জীবনের পরিচয়কে করেছে অনেকাংশে খণ্ডিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। তবে আশার কথা পল্লী হৃদয়ে ধারণ করা তাঁর সৃষ্টিগুলি অন্বেষণে আজও একদল মরিয়া হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর মানবমঙ্গল গ্রন্থটি তারই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে বাউল শিল্পীদের সহজভাবে জীবন যাপনের সামাজিক প্রেক্ষাপট নেই বললেই চলে। মাধুকরী এখন চাঁদা আদায়ের মত। ‘অতিথরূপে নারায়ণ’-কথাটির বিশ্বস্ততা ও যথার্থতা বর্তমান জনজীবনের চেতনাশক্তিতে আগের মতো নেই। অতিথসেবা এখন-‘নগদরূপে নারায়ণ’। তাই ভবগুরে, বাউন্ডুলে, যাযাবর, বৈষ্ণব ও বাউল ফকিরগণের মাধুকরী জীবনের নীতিধর্মভাবে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। বাউলধারাকে কেন্দ্র করে কিছু বাউলগান গায়ক, বাউলগান লেখক ও বাউল বেশকের উদ্ভব হয়েছে যারা নিজেদেরকে বাউল বলে পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয় তারা বাউলরাজা, ভাবরত্ন ও বাউলসম্রাট উপাধিতে খ্যাত হয়। এ পদবীদাতারা বাহ্যিক বাউলে বিশ্বাসী বলেই পদতলে পদবী অঞ্জলি দেন। অন্তরসত্য প্রেমধারায় তাদের আসা-যাওয়া নেই। আসল বাউল অক্ষরজ্ঞানের ধার ধারে না। তাঁরা জাত পাতহীন, পুঁথিনির্ভর ভাব তাঁদের নেই। তাই তাঁদের বেদ কোরআন ত্রিপিটক ও বাইবেলের মত পুঁথিশাস্ত্র নেই। ফলে পুঁথিবিদগণ (পুঁথিবাদীগণ) ‘পুঁথিয়া’ বাউলের সন্ধান জানলেও ‘অপুঁথিয়া’ বাউলের সন্ধান জানেন না। আর জানলেও রাং-এর দরেই সোনা চেনেন। তাই ‘অপুঁথিয়া’ বাউলদের জানতে হলে মাটির ডেরায় মানুষের সন্ধানেই আত্মমগ্ন হতে হয়। দীন শরৎ এর জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধানের মিলিত সাধনা এই পুঁথিবাদীদের জটিল ও অর্থহীন বন্ধন ছিন্ন করে হয়ত আমাদের সহজ মানুষের সরল দর্শনে দীক্ষিত করবে আর এ মানবমঙ্গলের আশায় ভাবজগৎ থাকুক।
তথ্যসূত্র :
১. দীন শরৎ চন্দ্র নাথ, দীন শরতের বাউল গান।
২. দীন শরৎ চন্দ্র নাথ, দীন শরতের এস্লাম সঙ্গীত।
৩. দীন শরৎ চন্দ্র নাথ, গৌরগীতি (সংগৃহিত গান)।
৪. ডাঃ রবীন্দ্র নাথ দাস ( সম্পাদনা), কীর্তিমঞ্জুষা, ২য় খণ্ড-শরৎ গীতিসম্ভার, প্রতিমা প্রেস, ১৯৯৮, আসাম।
৫. কাঞ্চন বসু (সম্পাদনা), বৈষ্ণব পদাবলী : অখণ্ড সংস্করণ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন ২০০৪, কলকাতা।
৬. কাজী ইমদাদুল হক (সম্পাদনা), নেত্রকোনা মুখশ্রী : নেত্রকোনা জেলা সমন্বয় পরিষদ, ২০০৫, ঢাকা।
৭. সঞ্জয় কান্তি দেব ( প্রকাশনা ও সম্পাদনা), দীন শরৎ গীতি : ২০০৬, সিলেট।
৮. ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, বাংলার বাউল : নবযুগ সংস্করণ ২০০৯, ঢাকা।
৯. ড. আবদুল ওয়াহাব, লালন-হাসন জীবন-কর্ম-সমাজ : বাংলা একাডেমী, ২০০৯, ঢাকা।
১০. দিলীপ বিশ্বাস (সংকলন ও সম্পাদনা), লালন সঙ্গীত (অখণ্ড) : মম প্রকাশ, ২০০৯, ঢাকা।
১১. আবু দানেয়াল (সংগ্রহ ও সম্পাদনা), অন্ধকবি দীন শরৎ ও তাঁর গান : বুকস্ ফেয়ার, ২০১২, ঢাকা।
১২. মোঃ গোলাম মোস্তফা ( সংগ্রহ ও সম্পাদনা), রশিদ গীতিকা : বাংলাদেশ বইঘর ২০১৩, ঢাকা।
১৩. ড. আহমেদ শরীফ, বাউলতত্ত¡ : বুকস্ ফেয়ার, ২০১৪, ঢাকা।
১৪. যতীন সরকার (সম্পাদনা), জালালগীতিকা সমগ্র জালাল উদ্দীন খাঁ : নন্দিত, ২০১৪, ঢাকা।
১৫. সুধীর চক্রবর্তী, বাউল ফকির কথা : আনন্দ, ২০১৬, কলকাতা।
১৬. পার্থ তালুকদার, দীন শরৎ বলে : রোদেলা, ২০১৭, ঢাকা।
১৭. সুমনকুমার দাশ (সম্পাদনা), বাউল-ফকির পদাবলি : অন্বেষা প্রকাশন, ২০১৭, ঢাকা।
১৮. দৈনিক জনতা, ২৭ মে ২০০৪ ইং।
১৯. দীন শরৎ চন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল।
২০. দীন শরৎ চন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি ভূপালকৃষ্ণ সরকার।
২১. দীন শরৎ চন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি হারাণ দেবনাথ।
২২. দীন শরৎ চন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি সুলতান ফকির।
প্রথম পর্বের লিঙ্ক
দীন শরৎ: ভাবজীবন (প্রথম পর্ব)
সজল কান্তি সরকার
হাওর গবেষক ও ‘হাওরপারের ধামাইল (হাপাধা) বাংলাদেশ। মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।