আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)

।। রওশন সালেহা ।।

রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুণরায় প্রকাশ করছি।

আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং আমাদের বিপর্যয়

তিনি আমাকে নিয়েই এলেন নোয়াখালীতে। স্কুলে সংবাদ হয়ে গেল। বড়দি সৌদামিনী চৌধুরী যুদ্ধের সময় কোথায়ও যাননি। কলকাতা ঘুরে আবার স্কুল খুলেছেন। মিলিটারি ক্যাম্প উঠে গিয়েছে। মিত্রপক্ষ জয়ী। জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় এটম বোমা ফেলেছে। আমেরিকা। ইয়াংকি সৈন্যরা চলে যাওয়ায় শহরবাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। শুধু দেশে দুর্ভিক্ষের গ্রাস। গরিব মেয়েদের পরনের শাড়ি ঘেঁড়া। ইজ্জত বাঁচাতে পারছে না। দশ আনা, বার আনা শাড়ির দাম পাঁচ টাকা। সেই খাট মোটা শাড়ি তার এত দাম। সুতা পাওয়া যাচ্ছে না, কেরোসিন দুষ্প্রাপ্য? তাঁতিরা হাত গুটিয়ে বসে। তবুও যুদ্ধ নেই, সৈন্য নেই-এটাই তো বড় পাওয়া। আবার নতুন উদ্দামের আশায় সকলে উঠে দাঁড়াতে চায়। স্কুল খুললো, শিক্ষক-ছাত্রী হাজির। স্কুলের মাঠে ট্রেঞ্চও ছিল। সেগুলো সমান করা হচ্ছে।

ব্রিটিশদের হারাতে হলে বুঝলাম বাংলার রাজধানী কলকাতাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হবে। জাপানিরা ঠিক ভাবতে পারে, কিন্তু নোয়াখালী এবং ফেনী শহরকে তারা এত গুরুতর ভেবেছিল কেন বড় চিন্তায় ফেলেছিল আমাকে। এই যুদ্ধ আমার জীবনের মূলে আঘাত করতে এল বুঝি। স্বামী থাকেন কলকাতায়। চিঠি দিলেন, “Man proposes, God disposes,কোথায় তোমাকে কলকাতা আনবো, তা আর হল না। রাইটার্স বিল্ডিং-এর আমার অফিসের অংশবিশেষ নাগপুর চলে গিয়েছে। আমি যুদ্ধ এলাকার লোক বলে যুদ্ধ-এডভান্সসহ লম্বা ছুটি পেলাম। কলকাতা সংসার না পেতে আমাদের গ্রামের বাড়িই হবে তোমার জন্য নতুন জীবন”। চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এদিকেও যে স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ.আর.পি অফিস সেখানে। স্কুলের মাঠে ট্রেঞ্চ কাটা শুরু। এয়ার রেইড থেকে কীভাবে জীবন রক্ষা করা হবে সেসব ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। ব্ল্যাক আউট কি সেই জানলাম প্রথম! নোয়াখালী শহর ইয়াংকি সৈন্যের পদভারে কাঁপছিল। প্রায় লোকজন শহর ছেড়ে পালিয়েছে। আমি স্বামীর কাছে চলে যাই, মায়েরা বাটৈয়া গ্রামে।

ফেনীর অবস্থা তদ্রুপ। শহরের আশপাশের গ্রামগুলো সরকার ইভাকুয়েট করে দিয়েছে। সেখানকার আত্মীয়রা নোয়াপুর গ্রামে আশ্রয় নিল। বাড়িতে গমগম। খানাপিনার জোর চলছিল। তবে আমরা পূর্বের সেই ঘরটিতে আগে যেমন ছিলাম, এবারও সেখানেই বাস করতে থাকি। মেজ দেবর মিলিটারি কন্ট্রাক্টর, বাড়িতে কিছুরই অভাব ছিল না, উপরন্তু দুষ্প্রাপ্য জিনিস সহজে এসে যেত। সেটা দেখতাম।

প্রত্যহ, প্রতিবেলা ভোজপর্ব চলছিল। আশ্রিতরা কেন যেন আমাকেই ‘ল্যান্ড লেডি’ বলে আপ্যায়ন করতো আমি বুঝতাম না। কিন্তু স্বামীর এতে ঘোর আপত্তি। আমাকে অনেকের সাথে কথা বলতে দিতেন না। বলতে দেখলে রেগে কটু কথা বলতেন। আমি একদিন প্রতিবাদ যেই করলাম, তার মনের কথা বের হয়ে গেল। অল্পবয়সী ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখি লজ্জা থাকে না। হাসি ঝরে পড়ে। কেবল আমাকে দেখলেই লজ্জা। ধরলে শরীরটা শক্ত করে ফেল। চোখ বন্ধ করে রাখ! আমাকে ভাল লাগে না? কিসের জন্য এমন কর আমি জানি। সেজন্যেই অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করায় আমার আপত্তি ছিল।

উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে জাপানিরা কলকাতায় ডালহৌসী স্কোয়ারে এবং খিদিরপুর ডকে বোমা ফেলেছিল। নোয়াখালীতে প্লেনের আনাগোনা, সাইরেন বাজা চলছিল। তবে ফেনীর কোর্ট এলাকায়, যেখানে শ্বশুরের বাসা ও নানা শ্বশুরের মসজিদ সেখানে ছোট পুকুরটায় বোমা পড়ে বিরাট গর্ত সৃষ্টি করে। কিন্তু বোমা বিস্ফোরিত হয়নি। এ. আর. পির লোকজন এসে বিরাট মিলিটারি ভ্যানে করে এটি কোথায় তুলে নিয়ে গেল। এরপর সহসাই যুদ্ধ থামার মত নিরব হয়ে গেল সর্বত্র। কলকাতায়ও নিরাপদ সংকেত। ওদের অফিস কলকাতায় চলে আসার চিঠি পেয়ে চলে যাওয়ার সময় সেবার আমাকে নিয়ে যান। পার্ক সার্কাসে কড়াইরা রোডে বিরাট পাঁচ কামরাওয়ালা আধুনিক ফিটিংসহ বাড়ি.। আসলে সেটা মেজবুবুর ভাড়া করা ফ্লাট। তারই সাজান ঘরদোরে আমরা গিয়ে উঠলাম। বাড়িটার নাম যোগেন্দ্র ম্যানশন। নিচে দোকানপাট। আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। মেজবুবু তখনও দেশে, সহসা আসবেন। তার বাবুর্চিও আমরা পেয়ে গেলাম। তাই কলকাতা শহর ঘুরে দেখার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া গিয়েছিল তখন।

ওর বাজার করার স্বভাব ছিল। বোনের বাজারও নিজের হাতে করে দিতেন। যুদ্ধের পর বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি আগের থেকে বেশি দামে কিনে এনে প্রায় অসন্তোষ দেখাতেন তিনি। যুদ্ধ কি জিনিসপত্র খেয়ে ফেলেছে? এ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুঠার মওকা। এক সের চালের দাম চার আনা থেকে পাচ আনা, ছয় আনা।

চিনি আট আনা হয়ে গেল! রেশন কার্ড থাকলে কম দামে কিনতে পাওয়া যেত। কিন্তু কে করে ঐসব হাঙ্গামা। মানুষ দুজন হিসাব হলেও প্রায়ই মেহমান আসতো। কলকাতায় আমার কোন আত্মীয়ের খবর পাইনি, কিন্তু তার ছিল। বেতনের টাকায় মাস চলবে না বলতেও শুনতাম। দৈনিক পত্রিকা রাখতাম আনন্দবাজার। তাতে সংবাদ পেতাম বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। গরিব না খেয়ে শাকলতা খাচ্ছে। অসুখে চিকিৎসা পাচ্ছে না। খবর পড়ে মন খারাপ হয়ে যেত। নোয়াখালীর নদীভাঙা গরিব দেশ। সেখানে আরও খারাপ অবস্থা। দেশের কথা ভেবে চোখের পানি সামলাতে পারতাম না। দুর্ভিক্ষের উপর একটা ছবি হচ্ছিল ‘ধরিত্রী-কা-লাল’। উনি দেখতে নিয়ে গেলেন। হলের ভেতরেই কেঁদে কেঁদে শেষে আর দেখতে পারিনি। উঠে এলাম। একটি দৃশ্য ছিল দোতলা-তিন তলার রান্নাঘরের পাইপ থেকে চাল ধোয়া কি ফেনের পানি বাসন পেতে তুলে নিয়ে মা সন্তানদের মুখে দিচ্ছে, থাকলে নিজে খাচ্ছে। সে রকম একটা দৃশ্য ছিল তাতে। মায়ের চিঠি পেলাম, নোয়াখালীতে বাবা আমাদের মাস্টারের ঘরটিতে লঙ্গরখানা খুলেছেন। বাড়িতেই খিচুড়ি রান্না হতো (উনি তখন মুসলিম লীগে রাজনীতি শুরু করেন)। আমি দেশে যাওয়ার জন্য কান্না শুরু তো করলামই, শেষে খাওয়াও ছেড়ে দিই। বমির উপসর্গ দেখে আমাকে স্বামী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। আমাদের রাস্তার অপর পাড়ে ‘ডক্টর মাহমুদা খাতুন সাইন বোর্ড। মুসলমান মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। কলকাতা বড় শহর, মেয়েদের পর্দা না করলেও কেউ খারাপ কথা বলে না। আমি তো পর্দা করি না, কুঁচি দিয়ে সুন্দর পেঁচিয়ে শাড়ি পরতে শিখেছি। পায়ে স্যান্ডেল সু পরি। ডক্টর মাহমুদা আমাকে দেখেই আমার স্বামীকে বললেন, ‘বয়স তো অল্প, সাবধানে রাখবেন। কাছে অন্য কোন মহিলা থাকে? না থাকলে আনিয়ে নিন। আপনার স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’

খবর সুখের ও আনন্দের কতখানি তিনি দেখালেন বটে। আঙ্গুর, আপেল, নাসপাতি কেনার বহর দেখে তাজ্জব হতে হল। লজেন্স, বিস্কুট, হরলিকস কেনাও বাদ দিলেন না। তারপর ভাগনীকে ধরে নিয়ে এলেন। ওদের বিরাট সংসার, সাত-আটজন ছেলেমেয়ে নিয়ে তালতলায় ছোট এক বাসায় থাকে, জামাই রেলের কেরানি। সস্তায় রেশন পায় বলে ওদের সংসার কোনোমতে চলে। ভাগনী তার বড় দুই মেয়েকে আমার দেখাশোনা করার জন্য রেখে গেল। সেও প্রায় আসে, থাকে, খায়। দু মাস এমনি চলার পর তিনি বুঝতে পারলেন, এভাবে চলবে না। খরচ বেশি যাচ্ছে। সামনের জন্য খরচ বাঁচাতে হবে। একদিন হঠাৎ করেই জানালেন, “তোমাকে নোয়াখালী রেখে আসবো, ঠিক করেছি। এরা ঠিকমত তোমার যত্ন করে না। ডাক্তার বলেছে, তোমার শরীরে রক্ত কম, ডেলিভারিতে কষ্ট হবে। আম্মাজানের কাছে যত্নে থাকাই প্রয়োজন তোমার”।

‘আমি যাব না এখানেই থাকবো’ বলার পর তিনি রেগেই গেলেন। “তোমার ভাল তুমি কী বুঝবে, যা বলি তা শোন, তৈরি হয়ে থাক। আমি ছুটির দরখাস্ত করেছি, না পেলেও অসুবিধা হবে না, বন্ধুরা আমার কাজ করে দেবে।” তারপরেও আমি জিদ করেছিলাম, বললাম, যাব না, ওরা বিয়ে দিয়ে আমাকে পর করে দিয়েছে, দূরেই থাকবো। আমি এখানে ভাল আছি, সুখে আছি”।

“বুঝেছি। আর বানিয়ে মিথ্যা কথা বলতে হবে না। সুখে থাকলে মনমেজাজ তোমার খারাপ থাকে কেন? খাওয়ার জিনিস পড়ে থাকে, খাও না , কার জন্য আনি? ঐ ওদের জন্য? সবই ওদের কেন খাইয়ে দাও। এখানে থাকলে না খেয়েই তুমি মরে যাবে।”

আমার মনের কথা কেউ বোঝে না। এ মানুষটিকে চিনতে পারি না, বোঝাতে পারি না। বাপের বাড়ি গেলে কী লাভ! পড়ালেখা করার জন্য, স্কুলে যাওয়ার জন্য সেখানে থাকতে চেয়েছি। এই শরীর নিয়ে স্কুল বাদ, পড়া বাদ। সংসারে ঢুকেছি, সেটাই পালন করে যাই। অন্যদের মতো আমি হয়ে গেলাম—এ দুঃখ আমার কেউ বুঝবে না।

তিনি আমাকে নিয়েই এলেন নোয়াখালীতে। স্কুলে সংবাদ হয়ে গেল। বড়দি সৌদামিনী চৌধুরী যুদ্ধের সময় কোথায়ও যাননি। কলকাতা ঘুরে আবার স্কুল খুলেছেন। মিলিটারি ক্যাম্প উঠে গিয়েছে। মিত্রপক্ষ জয়ী। জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় এটম বোমা ফেলেছে। আমেরিকা। ইয়াংকি সৈন্যরা চলে যাওয়ায় শহরবাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। শুধু দেশে দুর্ভিক্ষের গ্রাস। গরিব মেয়েদের পরনের শাড়ি ঘেঁড়া। ইজ্জত বাঁচাতে পারছে না। দশ আনা, বার আনা শাড়ির দাম পাঁচ টাকা। সেই খাট মোটা শাড়ি তার এত দাম। সুতা পাওয়া যাচ্ছে না, কেরোসিন দুষ্প্রাপ্য? তাঁতিরা হাত গুটিয়ে বসে। তবুও যুদ্ধ নেই, সৈন্য নেই-এটাইতো বড় পাওয়া। আবার নতুন উদ্দামের আশায় সকলে উঠে দাঁড়াতে চায়। স্কুল খুললো, শিক্ষক-ছাত্রী হাজির। স্কুলের মাঠে ট্রেঞ্চও ছিল। সেগুলো সমান করা হচ্ছে। কিন্তু আমার ভাগ্যে স্কুলে যাওয়া ছিল না। তবুও দিদিমনিরা আশা ছাড়লেন না। টেস্ট পরীক্ষা চলার সময় শরীর খুবই খারাপ। রক্তহীনতায় ভুগছি। সারা শরীরে পানি এসে ঢোল হয়ে গেল। সৌদামিনীদি তার স্বামীকে নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন, ইনি তোমার পিতৃতুল্য, তোমাকে ইংরেজি পড়াবেন। তোমার শরীর ভাল লাগলে তার হোমওয়ার্কগুলো করে নিও।

 আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি, আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমার কপালে ম্যাট্রিক পাস নেই। আমার কথায় সৌদামিনীদি একটুও দমে গেলেন না। বললেন, তুমি পরীক্ষায় বসতে পারলেই পাস করবে এবং বেশ ভাল করবে। পরীক্ষা শুরু হবে মার্চ মাসের পহেলা তারিখে। তখন তুমি আশা করি সুস্থ থাকবে। তিনি আমাকে বুকে নিলেন। কপালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। হিন্দু সমাজেও মেয়েদের জীবন এর থেকে উন্নত নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নিজের কাজ করে যেতে হয়। একদিন আসবে, মেয়েদের মতামতের মূল্য থাকবে।

তার কথাগুলো আমাকে স্পর্শ করেছিল, সাহস পেয়েছিলাম। শরীরের কষ্ট সহ্যের মধ্যে যাতে থাকে, চেষ্টা করতাম। নিজের সুবিধা হলে বই নিয়ে বসতাম। হোমওয়ার্ক করতাম। স্কুলের প্রশ্ন নিয়ে উত্তর লিখতাম। স্যার দেখে দিতেন, তিনি আমার কাছে প্রাইভেট টিউটর ছিলেন না। বাবা যেমন আগে অফিস থেকে এসে গায়ের গাউন খুলতেন আর খোঁজ নিতেন স্কুলের সেদিন কি পড়েছি; ইংলিশ ট্রানসলেশন, গ্রামার জিজ্ঞেস করতেন, ইনিও তেমনি জেনে নিতেন; আমার পড়ার অগ্রগতি। আমাদের সিলেবাস ‘নেহেরুজ লেটার টু হিজ ডটার’ বই থেকে কিছু অংশ পাঠ্য ছিল আর ডেভিড কপারফিল্ড। তার কাছে এগুলো পড়ার সময় আমার এতই মনযোগ ছিল যে, বাকি সব ভুলে যেতাম। অবশ্য শেষে আর পারতাম না। রেস্টে থাকতে হয়েছিল। এমন কাশি, পেটের সন্তান উগলে বের হয়ে যাওয়ার মতো কষ্ট পাচ্ছিলাম। কবিরাজি দাওয়াই ছিল; এক সের পানিতে পাঁচটা বাসক পাতা সিদ্ধ করে যখন ঐ পানি এক পোয়াতে কমবে, সেই আরক গরম গরম প্রতিদিন সকাল-বিকেল খাওয়াতে হবে। সাথে তাল মিছরি। মা অন্যসব কাজ রেখে আমার দিকেই লেগে পড়লেন। আর নামাজ শেষে সূরা পড়ে পানি পড়া রাখতেন, আমাকে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে নিজ হাতে খাওয়াতেন। আমার কষ্ট তার নিজের কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম উদ্বিগ্ন থাকতে দেখে আমি প্রায়শ হাসিমুখে কথাবার্তা চালিয়ে যেতাম। এবং শেষে এমন করলাম, পেটে ব্যথা উঠেছে-তাও লুকিয়ে রাখলাম দুদিন। আমার জন্য ঠিক করা ‘ধাই’ তার নিয়মে আমাকে চেক করতে এসে মাকে নিদারুণ কথাই শুনিয়ে ছিল; “আপনার মেয়ের এখন-তখন অবস্থা, আপনি কেমন মা, জলদি সব ব্যবস্থা করেন। হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবকে খবর দিন।” ঐ আয়া খ্রিস্টান, হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের। তখন হাসপাতালে ডেলিভারি করানোর নিয়ম ছিল না।

 সব কষ্টের নিরাময় আছে, তবে ভাল নয়তো মন্দ। আমার শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল এবং ব্যথা একবার দুবার এসে চলে যাওয়ায় ইত্যাদিতে চার দিন গত হয়ে গেল। সারা বাড়ি আল্লাহর কাছে বুঝি নতজানু, আল্লাহ দয়া কর, রহম কর। চৌঠা জানুয়ারি উনিশ’শ চুয়াল্লিশ সালের সকাল এগারটায় বেশ স্বাস্থ্যবান ওজনি এক ছেলের জন্ম দিয়ে আমি বেহুঁশ। ফুল পড়ছিল না। মহিলাদের কেউ বিবি মরিয়মের ফুল ভেজান পানি খাইয়েছিল। ক্রমান্বয়ে আমি জ্ঞান ফিরে পাই এবং সুস্থ হয়ে যাই। একটি ছেলের জন্ম তোলপাড় করে দিল। আনন্দে। শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুড়ি, মেজবুবু, মেজ দেবর এবং কিরণতো আসবেই। আরও অনেকে এসেছিল। মেজবুবু ছেলে কোলে তুলে পাঞ্জাবি পরালেন, সোনার বুতাম আঁটা, শাশুড়ি দিলেন সোনার চেইন, কেউ যেন আংটি, মেজ দেবর বললেন, ব্যাটা বাহাদুর, বাড়িতে প্রথম বংশধর তুই। তোকে বাহাদুর বলেই ডাকবো। ভাল নাম রাখা হল শেখ ছাদ উল্যা। কিন্তু এ নাম আমার পছন্দের হল না। ওর বাবাও এসে উপস্থিত, ‘হোয়াইটওয়ে লেডল’ নামের কলকাতার বড় দোকানের বেবি কিটস কিনে আনেন। তাকেই জানালাম, নামটা আমার পছন্দ হয়নি। ছাদ উল্যা না রেখে সাহেদ সেলিমতো করতে পারি। আকিকার নামের কাছাকাছি। উনি বলেন, নাম দিয়ে কী হবে, বেঁচে থেকে মানুষ হলেই নাম সার্থক। তোমার যা খুশি তাই রাখো। আমি এত সুবিধার লোক তাকে মনে করতাম না। ভয় পেতাম এই বুঝি রাগ করে বলবে-না, আকিকার নাম থাক। আসলে উল্টোটি পেলাম। ছেলে পেয়ে তিনি খুশি, সেটাই জানান দিয়েছেন।

 ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ছেলের বিছানা পড়েছে নানীর কাছে। মুখ উঁচিয়ে দাবি তোলেন, এর উপর আমার দখল চৌদ্দ আনা, বাকি দুই আনা তুই পাবি। বুকের দুধ যখন খাওয়াবি, ঐ সময়ে। আমার খালারা আছেন মাকে সহযোগিতা করেন। ছোট বোন আছে সর্বক্ষণ চোখ রাখে বোনপোটি তার বড় মিষ্টি, অন্য কেউ নজর দিতে আসবে। আমি দেখি, জন্ম দিয়ে আমি দেহের ভারমুক্ত করেছি, আমার চেয়ে এরাই বেশি যত্ন করছে; আমি বই খাতার মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে আসলাম নিজেকে। যুদ্ধের জন্য পড়ালেখা হয়নি, স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। সে জন্য সময়মতো পরীক্ষা যে হবে না, এ রকম চিন্তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় করবে না। আমরাও মনে করতে পারতাম না। পরীক্ষার তারিখ পেছানো-সে অসম্ভব। কে একথা বলতে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকে। সে সময় পড়তে পারনি, রাতদিন করে তা পড়িয়ে দাও, স্কুলগুলোর ওপর হুকুম, না হলে এফিলিয়েশন থাকবে না, লজ্জা পাওয়ার বিষয়তো বটেই, দায়িত্বহীনতারই প্রকাশ হবে।

পহেলা মার্চ, সোমবার, উনিশ শ চুয়াল্লিশ সাল। ম্যাট্রিক পরীক্ষা। চলবে শনিবার পর্যন্ত একটানা সকাল-বিকাল। সোমবার হবে অফশোনাল। আমার ছিল পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন। এক হাজারের মধ্যে পরীক্ষা। এর থেকে চল্লিশ বাদ দিয়ে অতিরিক্ত যা থাকবে সেটি এসে যোগ হবে সর্বমোট নাম্বারের সঙ্গে। এতে ডিভিশন ওঠে। বিজ্ঞান কি কলা এসবের ব্যবস্থা একই পরীক্ষায়, ভাগ ছিল না। আমি ম্যাথমেটিকস নিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানে পড়ার ইচ্ছা করেছিলাম। নাহলে ডমেস্টিক সায়েন্স নিত মেয়েরা। ছেলেদের এ রকম সুযোগ ছিল না। সকলকেই অংক নিতে হয়। আমার পরীক্ষা দেয়া নিয়ে আমার চেয়ে আমার মা-বাবা এবং স্কুলের দিদিদের দুশ্চিন্তা ছিল বেশি। তাদের জন্যই শেষমেস আমি যত্নবান হলাম, শরীরটা সুস্থ রাখতে হবে। কলকাতা থেকে বলকারক ওষুধ সাথে এনেছিলেন ছেলের বাবা, ‘ওয়াইন কারনিস’ নামের বড় বোতল। খাওয়ার পর খেতাম। মাগুর মাছের ঝোল, কবুতরের মাংস, কালিজিরার ভর্তা জাতীয় খাবার ছিল মায়ের তৈরি। কেউ একজন এনে দিতেন ডাহুক, এতে নাকি শরীরে রক্ত হয়। এই পাখিটার শরীরের কোন এক অংশে ওষুধ আছে, সূতিকা রোগ হবে না। সে জন্য গোটা পাখির সব মাংস আমাকে একেবারে খেয়ে নিতে হয়েছে। স্কুলের ঘোড়ার গাড়িতে আসা-যাওয়া করেছিলাম। পরীক্ষার সীটও আমাদের স্কুলে পড়েছিল। নোয়াখালী জেলার সকল মেয়ে পরীক্ষার্থীদের জন্য এই একটাই সেন্টার। ফেনী, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, রামগঞ্জ এবং অন্যান্য স্থানের স্কুলের মেয়েরা। কেউ পুরুষদের স্কুল, কেউ বা মেয়েদের স্কুল, যেখানেই পড়েছিল, পরীক্ষা দেয়ার জন্য জেলা সদরের এই একটি স্কুল, উমা গার্লস হাই স্কুলে হাজির হতো। অন্য কোথায়ও পরীক্ষা সেন্টার ছিল না। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখেছিলাম সিঁদুর পরা মেয়েও ছিল। কিন্তু কোন মুসলমান মেয়ে ছিল কিনা জানতে পারিনি। দিদিমনিরা জানালেন, তুমি এক অসাধ্য সাধন করলে। তোমার মত বিয়ে হয়েছে, নতুন মা হয়ে পরীক্ষা দিতে হিন্দু-মুসলমান মেয়ে একজনও আসেনি। শুধু স্কুল থেকে সুফিয়া, সে তো আনম্যারেড।

পরীক্ষা দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার আগে ছেলেকে কোলে নিতে যাব, মা তেড়ে এলেন! “কাপড় ছাড়, গা ধুয়ে চুল শুকিয়ে তবে ওকে ছুঁতে পারবি। ভাগ্য ভাল, চল্লিশ দিনের পর পরীক্ষাটা হল। তবে পরীক্ষা দিতে পারলি। চল্লিশ দিন মাও ছেলে খুব সাবধানে রাখতে হয়। ঘরের বাইরে যেতে দিতে হয় না, গায়ে কুবাতাস লাগে। সেই বাতাস ভাল না; মায়ের থেকে সন্তানকে ধরে বেশি। মুরুব্বিরা বলেন, এই চল্লিশ দিনে একবার করে কবর খোড়ে শয়তানরা। ছোট বাচ্চার ঘাড় মটকিয়ে খাবে কখন, তক্কে থাকে। আল্লাহর দোয়া আছে তোর ওপর। পড়া পড়া করে সকলকে পাগল বানিয়ে দিলি, উপরওয়ালা না শুনে পারে। শোকর আল হামদুলিল্লাহ।” এই কথা বলে বাহাদুরের কাছে গিয়ে বসলেন। পিন্টুর তখন ঠাঁই হল মেজ খালার বিছানায়। যেন মায়ের এক ছেলে কোল ছাড়লো, অন্যটি জুড়ে বসেছে, মানুষ দেখে সেরকম বলাবলি করে। তার শরীর ভাল ছিল না, তার মধ্যেও নাতিকে এত যত্ন আর পরিচ্ছন্ন রাখতে এতটুকু গাফেলতি করবেন না। প্রস্রাব গায়ে লাগলে সন্ধ্যায় গোসল করে কতদিন জ্বর বাধিয়েছেন। সে নিয়ে আমরা কিছু বলতেও পারতাম না। গোস্বা করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া যে তিনি কোনোদিন কামাই করতেন না। গোসল করবেনই। আবার প্রস্রাব বাচ্চা ছেলের হলেও নাকি নাপাক হাদিসে আছে। আমি ছেলেকে কাছে নিতে চাইলে এক কথা, “নে তোর ছেলে আমি রাখবো কেন! আবার পড়বার তাল তুললে কিন্তু আমি রাখতে আসবো না। মনে থাকে যেন”।

দুই মায়ে লড়াই! অন্যরা দেখে হাসতো। খালারা বলতেন, বুবু নিজের ছেলেমেয়ে নিয়ে যা করেনি, মেয়ের ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা করছেন। ওর এখন অবসর, ছেলে পালুক। চিরকাল কি ওর বাচ্চা পালন করে দেবেন? মা, চটে যেতেন। “দিলে দেব। তোদের গায়ে লাগে কেন। ও জীবনভর লেখাপড়া করুক, আমি ওর বাচ্চাদের পালবো, দুধ খাওয়াব, হাতেখড়ি দেব। আমি নিজে ওকে বিয়ে দিয়েছি, আমি নিজে বাকি কাজও করবো। এ আমার ভাল লাগে। আল্লাহ আমার হায়াত দিলে হয়। শরীরটা যে ভাল থাকে না, সে কথা তোদের মনে আসে না। তোরা কি আমার কাছে চিরকাল থাকবি। একজনের বিয়ে তো ঠিকই হয়ে গিয়েছে। চলে যাবি। ভাল কথা সেটা, কিন্তু তোরা আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবি না।”

মা রাগী এবং রাশভারি ছিলেন। বাবার কোলে বাহাদুরকে দেখলে মা খুশি হতেন; এই যে শেখের নাতি, সাহস তোমার কম নয় তো। উকিল সাহেবের কোলে উঠেছ, উনি কোনদিন নিজের ছেলেমেয়েদের কোলে নিল না, নিল তোকে। দে হি সি করে দে … মজা তখন। টের পাবেন!

আমার লজ্জা হতো। মাকে কখনও দেখিনি এমন হাসিমুখে বাবাকে নিয়ে মজা করতে। লুকিয়ে উপভোগ করতাম। মনে ভয়ও হতো। কলকাতা নেব কোন উপায়ে। এরা ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আমি ওকে না নিয়েই বা যাব কোন মুখে। ওর মেজবুবু কলকাতার বাসায়, দিন গুণছেন, কখন আমি তার ভাইয়ের ছেলে নিয়ে যাচ্ছি।

কলকাতার শ্বশুরবাড়ি

এক মাস থাকার পর কলকাতা আসার সময় ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে আসি এবং পুনরায় ক্লাস করার জন্য কলেজে যাচ্ছিলাম। পনের দিন পর নোয়াখালী থেকে তার এল, খবর পেয়েই যেন যাই। বাহাদুরের খুব জ্বর হয়েছে, চলে এলাম। ওর জ্বর তখন ছেড়েছে। মুখের সবকটি দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমাকে চিনলো, কিন্তু কোলে এল না। মায়ের কেটেছিল ঐ কয়দিন বিনিদ্র রজনী। চোখের কোণে কালি। বললেন, পাজি হয়েছে রে তোর ছেলে, এতদিন কাঁদিয়ে এখন হাসছে। আর নয়, ওকে নিয়ে যা। ও এখন কলকাতার সাহেব। এখানকার জল-হাওয়া সইবে না। চলে এলাম ছেলেকে নিয়ে।

মহারানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন মেজবুবু, তফাৎ একটাই তিনি লন্ডনে জন্মাননি। দেখতে কিছুটা লাগে, বড় কপাল, মাঝে সিঁথি কেটে দুদিকে পেতে চুল বসান, গলায় মুক্তোর মালা, বেশি’ কুচি দিয়ে বার হাতের কাশ্মিরি সিল্ক শাড়ি পরেন। গায়ের রঙটাও তার লালচে ফর্সা। বয়স প্রৌঢ় হয়ে যাওয়ায় আরেকটা আমূল তফাৎ তার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। ভিক্টোরিয়া বহু সন্তানের জননী। ইনি নিঃসন্তান। এই দুঃখ ঢাকতে গিয়ে তাকে দরবার কক্ষ সাজাতে হয়েছে। সিংহাসন মত একটি দামী চেয়ারে বসে চারপাশে ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ঘিরে থাকার ব্যবস্থা রাখতেন। ভাল ভাল খাওয়া, চা-নাস্তা দেয়ার জন্য একজন সর্বদা একপায়ে দাঁড় করা থাকতো। হুকুমের সঙ্গে হাজির হয়ে যেত। বেশ সাহেবী কায়দায়, ব্রিটিশ মেইড কাপ পিরিচ, প্লেট, গ্লাস হতো ব্যবহার। গল্পও তেমন রাজা-উজির মারার মত হট্টগোল মার্কা।

আমার যেতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। ছেলের ছয় মাস বয়স হলে পর মা ওকে আমার কোলে তুলে দিয়ে বলেন, যার ছা তার কাছে যা, আল্লাহর দুনিয়ায় এটাই নিয়ম। নিয়ম না মানলে আল্লাহ নারাজ হবেন, মা। অতএব, জুলাই মাস শেষ করে কলকাতা এসেছি। ছেলের বাবা বোনের দিকে ছেলে বাড়িয়ে ধরে। খুশির সাথে বলেন, আপনাকে দিয়ে দিলাম। এই নিন মেজবুবু।

মহারানীর মেজাজ বোঝা দায়! এতদিন তাড়া দিয়ে যাকে হাতে পেলেন, নিচ্ছেন না। বলেন, ও আমাকে এখন আর চিনবে না, কাঁদবে। ছোটদের কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। ভাই ও ভাইয়ের বৌ-এর মুখে এমন করে ছাই মেখে দিলেন, আমরা ফ্যাকাশে হয়ে যাই, মুখ দিয়ে একটি কথাও আসেনি যে বলবো, নিন না কোলে, আপন রক্ত না চিনে যাবে কোথায়! ছেলেটিও অপরিচিত লোকজনের মাঝে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। সে মাকেও তেমন করে চিনেনি। বাপকেও দেখেছে অতি কম, কেবল পরিচিত ছিল আয়া, যে ওকে জন্মের পর থেকে কোলে নিয়েছে। শিশুদের মন পেতে হলে তার সাথে ভাব জমাতে হয়।

সপ্তাহ কেটে গেল। আমি এবার অস্থির বোধ করতে লাগলাম। এত ভাল রেজাল্ট, মাসে মাসে বৃত্তি, কলেজের বেতন ফ্রি, তবুও আমি কলেজে ভর্তি হব না! তবে কেন এত কষ্ট করে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে? স্বামীকে প্রত্যেক দিন একবার করে বলতে থাকি, আমাকে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজটা একটিবার দেখিয়ে আনো কেন? ভর্তি হয়ে থাকি। তারপর দেখা যাবে। অবশেষে বোনের সামনে সাহস করে কথাটি বললেন, ছেলেটাকে কেবল একটু দেখবেন, ও ভীষণ লক্ষ্মী। আমরা একটু ঘুরে আসি। বুবু চট করে প্রশ্ন করেন, লুকাতে হবে না। বৌকে কলেজে নিয়ে যাচ্ছ, কিন্তু এটা বাড়াবাড়ি। আমি এত বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না। বৌ তোকে কি রুজি করে খাওয়াবে। তার কথায় একবার উঠতেছিস, একবার বসতেছিস। তোর নিজের ইচ্ছা কি ছেলে কাঁদিয়ে মা ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে বাইরে যাক! তুই নিজে ল’ ক্লাস করা ছেড়ে দিয়ে বৌ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলি। আমাদের বংশের বৌদের আর বিদ্যার দরকার হয় না। শামছুল হকের বৌ কি কলেজে যায়? সে ঢাকার এক বড় লোকের ইংরেজি মিডিয়ামে ম্যাট্রিক পাস। চোখ কান বন্ধ করে রাখিস নাকি তুই! মহারানী কটমট করে চোখ রাখলেন আমার দিকে। তারপর আমাকে কাছে ডাকেন, ‘রান্নাঘরে সিঙ্গারা ভাজা হয়েছে, নিয়ে আস। আমাদের চা বানিয়ে দাও।’

রাত অনেক হল। প্রচুর তর্ক করলেন তারা। দুলাভাই দারোগা সাহেব (আবগারি ইন্সপেক্টরকে দারোগা বলতো) মহারানীর বিপক্ষে যাওয়ার। সাহস করলেন না। বুবু বকেই যাচ্ছেন; “পোকন্যা পাগলামি করছে বুঝি, সারা জীবন এ রকম করে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করলো, ডেপুটির চাকরি পেল, নিল না। বেঙ্গল আর্মিতে যাবে, কই, যেতে পারলো? চারটা বছর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে লেফট রাইট করে বুকের ছাতি বড় করলো। কোনো লাভ হল না। ঐ সব চাকরিতে মুসলমান ঢুকতে দেয় নাকি হিন্দুরা। হিন্দু ডাক্তার, মেডিক্যালে আনফিট করে দিল। ওর বুঝি হাই ব্লাড প্রেসার! এটা একটা অসুখ হল! আর কিছুতো পেল না। তারপর গিয়ে ঢুকলো রাইটার্স বিল্ডিংয়ে।” আমাকে শোনাল, “সন্ধ্যায় রিপন কলেজে ‘ল’ পড়ছে! কোথায় গেল পড়া, পড়ে? তুমি দেখ! নিজের পড়ার কথা বাদ দাও বৌ, ওকে আর নাচিও না। এতো পাগল, নিজের ভাল বোঝে না। আমার সন্তান নেই, সে দুঃখে আমি মরে আছি। তুমি এত সুন্দর একটা ছেলের মা, সন্তানের জন্য ভাব। ওকে লালন-পালন করার কাজ তোমার। অন্যকে দিয়ে হয় না। আমার কথা শোনো।”

একজন নিঃসন্তান মায়ের হাহাকার যতখানি, তার চেয়ে বেশি তিনি আমাকেই শাসন করলেন। তার সঙ্গে হু হ্যাঁ ইত্যাদি করেছিলাম। নিজের মনের কথা বলতে পারিনি। ঐ ক্ষমতার কাছে আমি বন্দি। আমার কলেজে পড়তে চাওয়ার ইচ্ছার টুটি চেপে মেরে দিলেন। এখান থেকে পালাবার পথও নেই। আলাদা থাকার কথা কে বলবে? স্বামী বলবেন না। তবুও আশা অন্তরে পুষে রাখলাম, দেখি সুযোগ একদিন যদি পাই, তবে ইচ্ছা পূরণ করবে। সুযোগ এল, দুলাভাইএর ট্যুর। সাথে বুবু গিয়েছিলেন। পঁচ-ছয় দিন বাইরে থাকার মধ্যে স্বামীকে জোর করলাম, বিনে খরচায় পড়তে পারছি। তাও পারবো না তোমাদের গোয়ার্তুমির জন্য! পড়ি না পড়ি, ভর্তিটুকু হয়ে থাকি না এখন, বুবু জানবেন না। পরদিন উনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আমাকে কলেজে নিলেন। মুসলমান মেয়েদের জন্য লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ, তখন বালিগঞ্জে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে নিয়ে (যুদ্ধের সময়) যাওয়া হয়েছিল। বাসা থেকে বেশি দূর।

প্রিন্সিপাল ছিলেন ব্রিটিশ মহিলা। মিস গ্রস্ (ঠিক মনে নেই) জাতে আইরিশ। ভর্তির সময় শেষ। ক্লাস শুরু হয়েছে এক মাস ইত্যাদি বলে শেষে নিলেনও। হাতে রেজাল্টের সিট ছিল, দেখে খুশি হয়েছিলেন। উপদেশ দিলেন, ম্যারেড! ঠিকমত ক্লাস টেস্ট না দিলে, প্রেজেন্ট হতে না পারলে কিন্তু আমি কোন কথা শুনি না, ডিসএলাও করে দেই। বি কেয়ারফুল। বুঝতে পারছিলাম কথাগুলোর ইঙ্গিত কোথায়, বুক কাপছিল, রেগুলার উপস্থিতি আমার কপালে নেই। আর এখানে নেই সেই সৌদামিনীদের মতো কেউ যে আমার দুঃখ বুঝবেন। একজন বিবাহিতা মেয়ের কত বাধা-বিপত্তি। শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ তাকে কথা শোনায়, তাদের কথামত না চললে নাকের জল চোখের জল একত্রে ঝরায়।

কলেজের করিডোর পেরিয়ে রাস্তায় নামবো, কয়েকজন ছাত্রী পথ আটকায়, “ভর্তি হলে? সাথের জামাইবাবু গোছের লোকটি কে? বললাম, “উনি আমার দুলাভাই। বোনের বাসায় থেকে পড়বো।” মিথ্যা কথা বলে দিলাম ওদেরকে, ইচ্ছা করেই। দৌড়ে রিকশায় উঠে গেলাম। নিজের এই যুদ্ধ জাঁহাবাজি করার কেচ্ছা আর বলতে ভাল লাগে না। বিয়ের পর কলেজে পড়তে চেয়ে মহাঅন্যায় করেছি, পদে পদে কৈফিয়ত দিয়ে আমাকে দোষ স্খলন করতে হয় কেন? উনি বললেন, চল ” ‘ফিরপো’তে খেয়ে তবে বাসায় যাব। অনেক বাধার পর তোমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, একি সাধারণ ব্যাপার। সেলিব্রেট করবো”

আমি বলি, পাগল হয়েছ! ছেলে বাসায় ফেলে এলাম, কাজতো হল আর দেরি নয়। আমার কথা শোনার মন তার নেই, খুশি দেখাতেই হবে। ঝকঝকে, গ্লাস ফিট করা সুন্দর জায়গায় রিকশা নিয়ে গেল। বোধকরি খাওয়ার পর মেট্রোতে সিনেমা দেখার শখও হয়েছিল তার। আমি কোনক্রমেই তাতে রাজি হইনি। ঘরে ফিরে আসি। এ কয়দিনে ছেলে আমাকে চিনেছে মনে হল। অনুপস্থিতি টের পেয়ে কেঁদেছে, দুধ খায়নি, এসব জানতে পেরে ভীষণ কষ্ট হল। ঠিক করলাম, সবদিন যাব না কলেজে, মাঝে মাঝে যাব। কলেজের বাস আসলে কখনও যাই, কখনও যাই না। সবই অবশ্য মেজবুবুর দৃষ্টির আড়ালে।

ভর্তি হলে যে পড়ার একটা, গরজ আপনা থেকে মনকে তাড়িত করে, সেটা আগে জানা ছিল না। কলেজ কামাই করলে মন খারাপ হয়ে যেত, বুবুও ধরে ফেললেন একদিন, তাকে ফাঁকি দিয়ে তার নিষিদ্ধ কাজ করেছি। বিচারকের আসনে বসে আমাদের হাজির করলেন; “তোমাকে বৌ করে আমিই এনেছিলাম, ভুল করেছি। যা করার করেছ, তা যদি করতে চাও, তবে ভিন্ন বাসায় উঠে যাও। অবুঝ দুধের শিশুর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না”। তিনি অবশ্য জানেন আমাদের অন্যত্র থাকার সামর্থও নেই। তাকে ছেড়ে তার ভাই অন্যত্র যাবেও না। সুতরাং তার আদেশমত আমি কলেজ যাওয়া ছেড়ে দিয়ে দেখালাম, আমি তার অবাধ্য হইনি। তিনিও খুশি। নিজের শাড়ির আলমারি খুলে বলেন, যেটা খুশি নাও, পরে আস। আমি নীরবে চোখ মুছলাম। আমাকে তিনি ইচ্ছা করলেই পড়তে যেতে দিতে পারেন। ভাই এর ছেলেকে আমার মায়ের মতো পালতে পারতেন, কিন্তু করবেন না।আমি যদি কলেজে যাই, ভাল পাস করি, সম্মান তাদেরই হবে। তবুও এ রকম জিদ কেন করেন, মুরুব্বীদের ইচ্ছায় চলতে হবে! তার দাপটকে মাথা নুইয়ে মেনে নেব, এটাই তো চান! একে অত্যাচার আর উৎপীড়ন মনে হতেই বুক ভেঙে কান্না এসে গেল। কিন্তু তিনি এ কান্না দেখেও দেখলেন না, তাকে স্পর্শ করেনি। উল্টো শুনলাম, বোম্বে সিল্কটা আমার প্রিয়, ওটাই তুমি নাও।

দিন একে একে কেটে গেল। কলেজের দু জন বান্ধবী পড়ার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। নোট দিয়ে যেত, ছেলে দেখে আমার কান মলে দিল। সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম কেন? এত সুন্দর ছেলে তোর, আমরা খেয়ে ফেলতাম? নিয়ে যেতাম? খেলনা, জামা-কাপড়, এমনকি হরলিক্সও ওরা নিয়ে আসতো। আমার সেই বান্ধবীদের কাছে মনের কথা কখনও বলিনি। কলেজে যাওয়া যে লুকিয়ে করেছিলাম। বেবি বেশি আদর করতে বাহাদুরকে। ওর হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেল এক স্থপতির সঙ্গে (মজহারুল ইসলাম)। ওর পর আশরাফুন বেশি এসেছিল। লিলি চৌধুরী (পরবর্তীতে মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী) আসতো গল্প করার জন্য। সে সময় আমরা মেজবুবুর সংসার থেকে আলাদা হয়ে তারই ছত্রচ্ছায়ায় নিচের তলার একটি ঘরে থাকতাম। আমার জন্য নয়, তারা ভাইবোনে অকারণ লেগে গিয়েছিল এবং নিচে তার যুবসংঘের কামরাটিতে এসে উঠলো। একখানা খাট এবং একটা টেবিলচেয়ার সম্ভবত তার নিজের কেনা হতে পারে।

এদিকে নোয়াখালীতে আসার জন্য মন কাঁদছিল, এই সুযোগে বায়না ধরলাম এবং তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। স্নেহের এমন টানাপোড়েন ঐখানে আমাকে দেখতে হবে বুঝলে যেতাম না। মা যে কত অবুঝ মনে তার নাতির শয্যাটি পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখেন নিজের পাশে। পিন্টুকে সেখানে শোয়ান না, ও খালার কাছে যেমন থাকতো, তেমনটি থাকতো। সেটা দেখিয়ে দিলেন বাবা। নানুকে তোরা রেখে যা মা। তোর মা নইলে পাগল হয়ে যাবে। ছেলেটিও আমাকে অবাক করে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। স্নেহের এ মিলন দেখার মতো, আমরা হাসতে গিয়ে কেঁদে দিয়েছিলাম।

এক মাস থাকার পর কলকাতা আসার সময় ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে আসি এবং পুনরায় ক্লাস করার জন্য কলেজে যাচ্ছিলাম। পনের দিন পর নোয়াখালী থেকে তার এলো, খবর পেয়েই যেন যাই। বাহাদুরের খুব জ্বর হয়েছে, চলে এলাম। ওর জ্বর তখন ছেড়েছে। মুখের সবকটি দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমাকে চিনলো, কিন্তু কোলে এলো না। মায়ের কেটেছিল ঐ কয়দিন বিনিদ্র রজনী। চোখের কোণে কালি। বললেন, “পাজি হয়েছে রে তোর ছেলে, এতদিন কাঁদিয়ে এখন হাসছে। আর নয়, ওকে নিয়ে যা। ও এখন কলকাতার সাহেব। এখানকার জল-হাওয়া সইবে না।” চলে এলাম ছেলেকে নিয়ে।

সেই সময়ের অন্য একটি অসাধারণ ঘটনা আমাকে হঠাৎ করেই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। মেজবুবু ডেকে পাঠান এবং হুকুম করেন, তোমার বিয়েতে আমি যে যে গহনা দিয়েছিলাম তার প্রত্যেকটি ফেরত দাও। আমার স্নেহের অবাধ্য যারা, তারা আমার গহনা পরবে, আমার অসহ্য। ভেবেছিলাম রাগ করে বলছেন, এমন কি হয়! দেয়া জিনিস ফেরত চায় কেউ। তাছাড়া উনিতো আমার শাশুড়িতুল্যা। কিন্তু এ ছিল তার সিদ্ধান্ত। ফেরত নিয়ে গেলেন। আমি একটুও ক্ষুন্ন হইনি দেখে তার আরও মেজাজ বিগড়ে গেল। আমাকে কিছু না বলে নিজের বেডরুম ছিল, সেখানে গিয়ে দরজায় খিল তুলে দেন। ব্যাপারটি আমার স্বামী জানার পর ভীষণ দুঃখ পেলেন। মায়ের মতো যে বোন তাকে পালন করলেন, তিনি এমন ছোটলোকি ব্যবহার করলেন তার ভাই-এর বৌয়ের সাথে। আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম, পরোক্ষে তিনি আমারই মঙ্গল করেছেন। আমার বাড়তি বোঝা কমিয়ে দিলেন। আমার যা আছে তুমি যা দিয়েছ, সেটাই আসল সম্বল। এ সত্য আজ উপলব্ধি করলাম। কিন্তু ধমক খেলাম, ওসব নিয়ে উনি কি করবেন জা্নো? অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন। ভীষণ রাগী, তুমি ভাল করোনি।

আমি এতদিনে, অনেক ধাক্কা খেয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছি। চুপ করে থাকতে শিখেছি। কেবল দুঃখ সেখানেই একজন মায়ের স্নেহের ঘাটতি পূরণে আমি পদে পদে তৈরি থাকার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমাকে ভুল বুঝলেন। আশ্রিতদের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন। আমি তো সে রকম মেয়ে নই।

উনিশ’শ ছেচল্লিশ সনের শুরুতেই মেজ বুবুরা বদলি হয়ে চাঁটগা চলে যান। ঘরের অনেক জিনিস রেখে গেলেন, বাড়িটাও ব্যবস্থা করে দিলেন দুলাভাই। মাত্র একশ দশ টাকার বাড়ি। বিদ্যুত, পানির খরচসহ। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ায়নি। নিজে একা থাকবো, আনন্দে নাচার বিষয়। কিন্তু কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম। উনি ফিরেও তাকালেন না, ভাইপোকে আদর পর্যন্ত করলেন না। আমার স্বামীর রাগ, বেশ ভাল হয়েছে। বয়স হলে মানুষ কেমন অবুঝ হয় দেখলাম। আমি বললাম, সবসময় তুমি ওদের সঙ্গে সঙ্গে যেতে। এবার না গেলে দুঃখ পাবেন, আর বলবেন, বৌ এনে দিলাম আমি, বৌ পেয়ে আমাকে তাড়িয়েছে। পরে শুনলাম ওঁরা নিজেরা চেষ্টা করেই বদলি হয়েছে। না হলে কলকাতা থেকে কেউ চাটগাঁ যায়? তালতলায় ভাগনী বেগম থেকে সবই শুনি। শুধু আমার সুনাম যদি কিছু বুবু করেছেন সেটা বাদ দিত সে।

সংসার পাতা যাকে বলে হাতির খোরাক যোগান দেয়া। ঝি-চাকর, মেহমান ইত্যাদিতে হিমশিম। উপায় হিসেবে নিচের ঘর এবং উপরের বড় ঘর দুটি নবপরিনীত পরিবারকে ভাড়া দিলেন উনি। বেগম থেকে রেল কোম্পানির দেয়া রেশন কিনতাম একটু সস্তায়। কলেজের গাড়ি আসতো। আয়া এসে আমার সংসার দেখে মাথায় হাত! মা, আপনি কলেজ করেন কী করে? উর্দুতে বলতো। প্রাইভেট পরীক্ষা দেব ঠিক করেছি। আর আসবেন না। তাকে বলে দিলাম।

এদিকে শরীরে আবার নতুন মানুষের আগমন ঘটেছে, টের পেলাম। কলকাতায় ‘ব্রিটিশ তাড়ানো মুভমেন্ট। প্রায় ট্রাম বন্ধ, রাস্তা বন্ধ হতে লাগলো। পরীক্ষার ফিস জমা দিয়ে এসে স্বামী জানালেন, ‘লেইট ফি-লেগেছে, পরীক্ষার মাত্র তিন মাস; এদিকে তোমার ভূগোল বিষয় প্রাইভেট দেয়া যায় না। এই নাও কমার্সিয়েল জিওগ্রাফির দুটো বই, দুশো মার্ক, ঠেসে মুখস্ত করে ফেলো।

আমাকে জানিয়ে যার সুখ করার আনন্দ, সে খুব সহজে বলে গেল। কিন্তু আমি গেলাম ঘাবড়িয়ে। পরীক্ষা দিতে কি পারবো। অসম্ভব কথা। পড়া নেই, প্রস্তুতি নেই। মিসেস শামছুন নাহার মাহমুদ আমাদের বাংলা পড়াতেন, মিস লায়লা খান পড়াতেন ইংলিশ ‘রেটোরিক এন্ড প্রসিডি’। দুজনের স্নেহভাজন ছিলাম। প্রশ্ন করে তারা জেনে নিয়েছিলেন আমি পড়ালেখা করতে কীরকম ভালবাসি। পারিবারিক কারণে কলেজ কামাই করছি। মিস খান অনেকগুলো নোট আমাকে দিয়েছিলেন। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন, পড়াতেনও তেমনি। মেয়েদের নাম না ধরে ডাকতেন মিস ইয়োলো শাড়ি কি মিস রেড শাড়ি। আমরা যে রঙের শাড়ি পরতাম, সেটাই তার রসিকতার স্টাইল। মনস্থির করে নিলাম, যদি ভালমতন পাস করতে পারি, তবে তাদের সঙ্গে আবার দেখা করব। না হলে জীবনেও আর পড়ালেখার নাম নেব না। সাধারণ মেয়ের মত চুটিয়ে সংসার করবো, মায়ের মত মুখভরে পান খাব। সকলের উপর খবরদারি করবো। পড়তে চাই বলে সবার কাছে আমি অন্যায় আবদারি এক মেয়ে হয়ে আর মুখ বুজে থাকবো না।

মাথার উপর থেকে মুরুব্বি সরে যাওয়াতে প্রথম ধাক্কা যাচ্ছিল আমার উপর দিয়ে। মেজবুবু চলে গেলেও তার ঠমক দিয়ে যাদের গড়ে তুলেছেন, তাদের মন যুগিয়ে কাজ করতে হয় আমাকে। ভোজনরসিক স্বামীর খাওয়া ভাল হয় না। নোয়াখালী ও ফেনীর আত্মীয়মেহমানদের আসা, থাকা সামলানো ভাল হয় না। আমার পড়াও আছে। একথা কেউ স্বীকার করে তার জন্য আমাকে রেহাই দেয় না। আমার মাথা ঘুরে গেলেও যাক, সব ঠাঁট তবুও বজায় থাক। অপরাধ যে আমার মেজবুবুর সাথে বনিবনা করে চলতে পারি না। তার জের টানতে যে হবেই। যখন স্বামী বোঝেন, আমার বোঝা ভারি, তিনি দুঃখ করেন। বলেন, তোমার স্বাস্থ্য খারাপ, বেড়াতে যাওয়া হয় না।

তার স্বভাবের মধ্যে হুজুগেপনা; মনে উঠলে আউট রামঘাট, কি ইডেন গার্ডেন, কি বালিগঞ্জ লেইক টেনে নিয়ে যাবেন, মন না চাইলেও আমাকে যেতে হবেই। না গেলাম তত মেজাজ করবেন, খাবেন না, অহেতুক চেঁচামেচি যাকে বলে-ঐ রকম বিছরি পরিস্থিতি করেই শান্ত হবেন। তারপর পরিণতি দেখতাম মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তার হাতখালি। তারপর বোঝাতে থাকেন, রান্নাঘরের লাগোয়া ছোট রুম, যেটা ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার হতো, সেটি ভাড়া দেয়া যায়। অফিসের একটা ছেলে বিয়ে করেছে, ঢাকার লোক, বৌ আনতে চায়।

আমি কথা দিয়েছি। ইচ্ছে হচ্ছিল বলি সারা বাড়ি ভাড়া খাটাও। নবাবি চালের শেষটুকু চমৎকার। কিন্তু আমার বলা আর না বলায় কিছুই তার যায়-আসে না। অর্থের অভাব এ ভাবেই মিটবে কিন্তু খরচ কমানোর কথা তিনি ভাববেন না। মাসের শুরুতে তারা এসে গেল। মুন্সীগঞ্জ বাড়ি, বৌটির ব্যবহার খুবই ভাল ছিল। সে আমার ছেলেকে এত আদর যত্ন করেছিল যে, আমি অনেকটা ভারমুক্ত হতে পেরেছিলাম। কাজের মেয়েটিও রান্নার জন্য কয়লার চুলা ধরিয়ে দেয়, অল্প স্বল্প রান্না শিখে গেল। এক কথায় আমার ছোটবোনের মত পেয়ে ভালই হল। এনিয়ে স্বামীরও গর্ব, রথও দেখা কলাও বেচার মত প্রাপ্তি তার কাছে। আমি লোক চিনি বলেও কথা বলতে শুনতাম বড় গলায়। কিন্তু এ যে ভাল নয়, ভদ্র লোকেরা বাড়ির ভিতর অন্য পরিবার থাকতে দেয় না। আমার মনে এ নিয়ে খুঁত খুঁত করতো। কিন্তু নিরুপায় ছিলাম আমি। আমার মতের সঙ্গে তার মনের সংঘাত দেখা দিলে আমাকেই চুপ করে যেতে হতো। নচেৎ চেঁচামেচি, সেটা আবার আমি সহ্য করতে পারি না। নিত্য খটমট করা কি যায়! সহ্যের সীমা একদিন ছাড়িয়ে গেল, ছাদ সমান উঁচু একটা কাঠের র‌্যাক এনে যখন ঘরে তোলেন। নিচের যুব কল্যাণ সংঘের রুমে রাখতে বললাম, তিনি শুনবেন না। উপরে শোবার ঘরেই রাখা চাই। উনি থান কাপড়ের ব্যবসা করবেন। তার এক বন্ধু কলকাতার বউবাজার থেকে কাপড় কিনে দেবে! উনি সেগুলো ফেনীর মার্কেটে পাঠাবেন। ছোট ভাই সিদ্দিক উল্যাকে দিয়ে মার্কেট করা, আসা যাওয়ার কাজে রাখবেন। বিনা মূলধনে ব্যবসা।

সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে মানুষ স্পষ্টবাদী হয়ে যায়। আমি চিৎকার দিয়ে প্রতিবাদ করি। অসম্ভব, আমি সওদাগরের ঘর করতে পারবো না। যদি এসব ছেড়ে ‘ল’ পরীক্ষা দিয়ে উকিল হতে চাও, তবে আমি তোমার সংসার করব। না হলে ছেলেটা কোলে নিয়ে আমি ঘর ছেড়ে চলে যাব। তিনি ঐ ব্যবসা করার বাতিক ছেড়ে দিলেন। তবে আমার কথায় নয়। গাড়ি কেনার আগে ঘোড়া জুড়ে দেয়ার মত কাজ হয়েছিল সেটা।

আমার পোস্টওয়ার রিকনস্ট্রাকশন মন্দ নয়

আই. এ. পরীক্ষা শুরু। সেন্টার পড়েছিল ভিক্টোরিয়া ইনসটিটিউটে। এদিকে সেদিন পহেলা এপ্রিল। ‘রশীদ আলী ডে’। ফরওয়ার্ড ব্লক হরতাল ডেকেছে। টাই স্যুট পরা সাহেবদের টাই ধরে টেনে গলায় ফাস দিচ্ছে। কলকাতায় পরীক্ষা একমাস পিছিয়ে গেল। নেতাজি সুভাষ বসুকে কৃতজ্ঞতা জানালাম, তিনি অলক্ষ্যে আমাকে সাহায্য করলেন। আর একটু প্রিপারেশন নিতে পারবো। আল্লাহ মানুষকে কিভাবে সাহায্য করে সেটি তারই হাতে। আরও সুবিধা পেলাম পনের দিন ধরে পরীক্ষা চলবে। ইকনমিক্স পরীক্ষার আগে তিন দিন পরীক্ষা নেই দেখে মহা খুশি সময় পাওয়া যাচ্ছে, ভাল নাম্বার তুলবো। নিজের ছকে চিন্তা করছিলাম। বিধাতা তাই বুঝি এর মধ্যে বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে দিলেন। কয়েকজন বিশিষ্ট মেহমান আসার বন্দোবস্ত করে দিলেন ঐ সময়। এ আমার ভাগ্যের খেলা।

ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দেয়া যে অগাধ জলে ঝাঁপিয়ে পড়া! বই হাতে নিলে অন্তর আত্মার ধুকধুকানিও বন্ধ হয়ে যেত। পড়ালেখার নাম-গন্ধ নিই না, বৈতরণী পাড়ি দিব আমি? অসম্ভব। ভেবেছিলাম হেসে-খেলে সকলের সাহায্য-সহযোগিতার মধ্যে ম্যাট্রিক দিয়ে দিব্বি যেমন ছাক্কা নাম্বার পেয়েছিলাম, এবারেও তেমনটি হবে। কার্যতঃ তার উল্টো পরিবেশ। স্বামীর সহানুভূতি যা পাই সেটা আমার জন্য অতিরিক্ত পাওয়া গণ্য করি। সে বাড়িঘরের চালচুলো ঠিক রাখতে গিয়ে অফিসের লোকের কাছে রুম ভাড়া দিয়েছে। আমার জন্যও বেশি আয়ের জোগাড় করছে। তবুও যদি আমায় পড়াতেন, সাজেশান এনে দিতেন কোথাও থেকে! আশা করতাম। ম্যাট্রিকের সময় বড়দি তার স্বামীকে আমাকে পড়াতে পাঠাতেন। বলতেন, ওর এত মেধা, এত শখ পড়ার, তুমি যাও তো পড়িয়ে আস। ভাবতেই চোখে পানি ভরে যেত। একদিন এমনই মনমরা ছিলাম, ভাড়াটে নতুন বৌ কাছে আসতেই ওকে বড়দির স্নেহের কথাগুলো বলে দিলাম। ও বললো, “আমার ভাই কলেজে পড়ায়, ওকে বলবো-আপনাকে রচনার কিছু এনে দিতে পারে।” মেয়েটি অবাক করল আমাকে। দুদিনের মধ্যে ইংরেজি ও বাংলা দু’ভাষাতে কয়েকটি রচনা এনে দিল। পোস্টওয়ার রিকনস্ট্রাকশন অব বেঙ্গল, ফেমিন এবং ফিমেল এডুকেশন। আমি ওকে বুকে ধরে বলি, তুমি আমাকে আকাশের চাঁদ এনে দিয়েছ, এবার আমার মনে আশা হচ্ছে-আমি পাস করবো।

কপালে দুর্ভোগ ওদিকে ঘনিয়ে ছিল, সেটা আমারই বুদ্ধির দোষ। রান্না করতেও রচনাগুলো হাতে রাখি, মুখস্ত করি। রান্না ভাল হয় না, তেল কম, নুন বেশি, ঝাল বেশি, মশলার মাপের দিকে আমার কোন খেয়াল নেই। চমৎকার ভাষায় লিখিত রচনাগুলো আমি নিবিষ্ট চিত্তে

পড়তে গিয়ে রান্না বরবাদ করে দিয়েছি। কড়া দামে মাছ মাংস কিনে ভাল খেতে না পেলে রাগ হবেনই গৃহকর্তা। এ নতুন কথা নয়। স্বামীও প্রত্যহ খিটিমিটি করেন, খাওয়া দাওয়া ছুঁড়ে ফেলেন। আমার রচনা পাওয়ার তথ্য ও তার প্রশ্নের তোড়ে বলে ফেলি; সহানুভূতি পাব। আশা করেছিলাম। রচনাগুলো ছিড়ে কুটিকুটি করলেন তিনি আমার চোখের সামনে।

আই. এ. পরীক্ষা শুরু। সেন্টার পড়েছিল ভিক্টোরিয়া ইনসটিটিউটে। এদিকে সেদিন পহেলা এপ্রিল। ‘রশীদ আলী ডে’। ফরওয়ার্ড ব্লক হরতাল ডেকেছে। টাই স্যুট পরা সাহেবদের টাই ধরে টেনে গলায় ফাঁস দিচ্ছে। কলকাতায় পরীক্ষা একমাস পিছিয়ে গেল। নেতাজি সুভাষ বসুকে কৃতজ্ঞতা জানালাম, তিনি অলক্ষ্যে আমাকে সাহায্য করলেন। আর একটু প্রিপারেশন নিতে পারবো। আল্লাহ মানুষকে কীভাবে সাহায্য করে সেটি তারই হাতে। আরও সুবিধা পেলাম পনের দিন ধরে পরীক্ষা চলবে। ইকনমিক্স পরীক্ষার আগে তিন দিন পরীক্ষা নেই দেখে মহা খুশি সময় পাওয়া যাচ্ছে, ভাল নাম্বার তুলবো। নিজের ছকে চিন্তা করছিলাম। বিধাতা তাই বুঝি এর মধ্যে বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে দিলেন। কয়েকজন বিশিষ্ট মেহমান আসার বন্দোবস্ত করে দিলেন ঐ সময়। এ আমার ভাগ্যের খেলা।

পরীক্ষা আবার শুরু। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় রচনা দেখলাম সেই পোস্টওয়ার রিকনস্ট্রাকশন, ফ্যামিন ইত্যাদির দুঃখে মন ছটফট করছিল হলের ভিতর। আহা! ভাল করে পড়ে দেখার সুযোগ যদি হতো আমার! ভাল করার সুযোগ পেয়ে হারিয়েছি। নিজের ওপর রাগ করে রচনা যতটুকু ভাল লিখতে পারতাম, তাও পারিনি। নার্ভাস হয়ে গেলাম এবং পাস করতে পারবো কি? অতঃপর সেই তিনদিন সময়ের ভোরে চিটাগাং মেইল কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে আমার ভাগ্যের মেহমানদের বয়ে নিয়ে আসে। আমার বাবা এবং তার এক বন্ধু জনাব মুজিবুর রহমান এবং ফেনী থেকে মেজ দেবরের শ্বশুর জনাব সাদেক মিঞা উকিল। প্রাদেশিক এসেম্বলির ইলেকশনের জন্য নমিনেশন পেপার দেয়া কি ইন্টারভিউ দেয়া- এ কাজে তাঁদের কলকাতায় আগমন। বাবা বলছিলেন যে আমরা মেহমান নিয়ে রান্নাবান্নার হুলস্থূল যেন বাঁধিয়ে না দেই। কিন্তু তিনি তো একা নন, অন্যরাও রয়েছেন এবং তার জামাতাকেও তিনি ভাল করে চেনেন না। মেহমানদারির কোনো অংশ কম করা এর স্বভাবে নেই। শ্বশুর সাহেবের জন্য কলকাতার বাজারের সেরা মাছ, ঘি, মিষ্টি কিনে আনেন। রান্নার কাজ তার নয়, এমন কী তিনি ছেলেটাকে কাছে রেখে দিবেন, তাও পারেন না। ফলে আমি নাকানি চুবানি খেয়ে কাজকর্ম করে গেলাম। কথাপ্রসঙ্গে বাবা জেনে নিলেন আমার পরীক্ষা চলছে। খোঁজ-খবর না করে এমন অসময়ে বন্ধু নিয়ে আসা তাঁর মনে হয়েছিল মারাত্মক ভুল করেছেন। আমি রান্না করতাম । কয়লার ধুয়ো, আগুনের তাপ উপেক্ষা করে বাবা আমার কাছে অর্থনীতির কয়েকটা চ্যাপ্টার, ট্যাক্স, ট্যারিফ, রেন্ট পড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন। বুঝতে পারতাম না বলে এ গুলো বাদ রেখেছিলাম। আমার স্বামী অর্থনীতিতে অনার্স এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। তাকে বলেছিলাম এই চ্যাপ্টারগুলো পড়িয়ে দিতে। আজ কাল করে সময় চলে গেল। তার সময় ও ইচ্ছা হল না। বাবা দুদিনের জন্য এসে এমন চমৎকার বুঝিয়ে দিলেন, প্রথমে বাংলায় তারপর সহজ ইংরেজিতে। আমি সেদিন আনন্দ করে রাধলাম, মনোযোগ দিয়ে পড়াও মনে রাখলাম। ভোরে সবাই ফিরে গেলেন, শুধু মন চেয়েছিল বাবাকে ধরে বেঁধে রেখে দিই। বাহাদুরেরও সাথে যাওয়ার জন্য কান্না। বাস্তব আমাদের মনের ইচ্ছায় ভ্রুকুটি হেনেছিল। বাবার যাওয়ার পথে চোখ রেখে অশ্রু বিসর্জন সার হল। বাবা হাতে টাকা গুঁজে দিলেন, নানু ভাইকে নিয়ে নোয়াখালী যাওয়ার খরচ। বাজার খরচ করে উড়িয়ে দিস না যেন।

বাবা আমাকে বেহিসাবে খরচপাতি না করার উপদেশ দিয়ে গেলেন, বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বাবা জানেন না তার মেয়ের সংসার অন্যজনের হাতে। মেয়েকে সেই একজনের কথায় উঠতে হয় বসতে হয়। নিজের বলা কওয়ার মুখ খুলতেও সে পারে না। ভাগ্য ভাল পরীক্ষার বিষয় নিয়ে বাধার সৃষ্টি করেনি, পরীক্ষা দিতে দিয়েছে, আনা-নেওয়া করেছে। আমি তাই কৃতজ্ঞ। এমনকি মনে ভাবি অনেক সময় এই একটা গুণের জন্য তাঁকে আমি চিরকাল ভালবেসে যাব।

স্বভাবে এবং মনমেজাজে স্বামী বেশ শৌখিন। আমি বরং আটপৌরে। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না। পরীক্ষা শেষ করার দিন গুণেছিলেন যেন। শেষের দিনে বাসায় না ফিরে এসে চৌরঙ্গীতে নিয়ে আসেন আমাকে। রক্সী সিনেমা হলে তখন ‘কিসমৎ’ ছবি চলছিল। অশোক কুমার ও মমতাজ শান্তি জুটি তাঁর প্রিয়। আমাকে দেখিয়ে মহাখুশি। গানের কথা ও সুর আমারও ভাল লেগে গেল। কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম এমন দুঃখ পেয়েছিলাম ছবিটি দেখে। এর পরে আরও ছবি দেখান, যেমর কুন্দলাল সায়গল ও কাননবালার অভিনীত ‘পরিচয়’। কয়েকবার দেখেও মন আবারও দেখার জন্য ব্যাকুল হতো। কাননবালার যেমন অভিনয় তেমন গান। ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে কাননবালার গান ‘আমি বনফুল গো ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ আজও বুঝি কানে লেগে আছে তেমন এক মধুর আনন্দ পাই। যোগাযোগ, মানময়ী গার্লস স্কুল, নীলাঙ্গুরীয় দেখেছি সেই সময়। সুচিত্রা-উত্তম। জুটি নিয়ে তারপর তো সিনেমা যা দেখেছি গোনা গাঁথা নেই। সিনেমা দেখেন, সিনেমার গান করেন স্বামী, প্রমথেশ বড়ুয়া স্টাইলের পাঞ্জাবি পরেন। সুগন্ধী মাখেন। অফিসের বন্ধুরাও তাকে হিরো ডাকতেন। একবার আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে ওরা মিনার্ভা থিয়েটারের দুটো টিকেট উপহার দিয়েছিল।

একদিন স্বামীর মুখে শুনলাম, ফেনীর একলোক, নাম ওবায়েদুল হক সিনেমা জগতে নেমেছেন। ছবির ডাইরেক্টর । নিজের লেখা বই ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিসের?’ ছবি করছেন। তিনি হিন্দু নামেই করছেন। স্ত্রীর গহনা এবং নিজের সম্পত্তি বেচাবিক্রি করে নেমেছেন। মুসলমান নাম দেখলে হিন্দুরা বই দেখবে না। অর্থের ওপর মার আসবে। আমার এসব শুনে এত ভাল লাগল যে, বলেই দিলাম, ওনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। চলো, আমাকে নিয়ে চলো, কোথায় থাকেন। আমার উৎসাহ ওকে কিন্তু আনন্দিত করলো না। খুব রাগ করে বললেন, ঐ পিতলা শখ, কেমন বাড়িটা খায় দেখবে। ছবি করা এত সোজা না। থাকেন ঐ পার্ক সার্কাসে, নিয়ে যাব।

খুব কাছেই থাকেন ওরা এবং পরিচয়ে দেখা গেল উনি আমার আত্মীয়। আমার মায়ের মামা ( নানীর ফুফাতো ভাই) এবং স্বামীরও ভাই সম্পর্ক। কাছে থাকেন অথচ যাওয়া-আসা নেই। এর পরে বেশি যেতে পারিনি। আমার আগ্রহ বেশি দেখলে ওকে সবসময় দেখতাম চেপে যেতে। উনি নিয়ে না গেলে আমি কি করে যাই, একা যাওয়ার সাহস ছিল কিন্তু গেলে যে হাজারটা জটিল আর কুটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে!

দেশে বেড়াতে আসার কথা তুললাম অতঃপর। এবারে শরীর তত খারাপ নয়। পেটটাও তত বড় হয়নি। কিন্তু কলকাতায় ডেলিভারি হবে এ রকম চিন্তা কিছুতেই মনে আসলে ঠাই দিতাম না। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন না দেখে ঐ কষ্ট সহ্য করা যায় না। মরণ হয়ে যাবে। স্বামীও ভয় করলেন। এদিকে বাবার দেয়া টাকা কবেই শেষ। তিনি টাকার কথা তুললেন। আমি বললাম, বাসার মধ্যে দু ঘর ভাড়াটে বসিয়েছ, তারা যা দেয় তাতে পুরো বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে আরও দশ টাকা বাড়তি মিলে। অফিসের বেতন, এতসব আজে বাজে খরচ করে উড়িয়ে দিলে বিপদে চলবো কি দিয়ে? তার কথার জের আমি কোনদিন টানতে পারতাম না। কারণ উল্টোসুরে তক্ষুণি কী সব বলবে, যেমন আমি কি অন্য কোন মেয়েলোক নিয়ে ফুর্তি করেছি? তোমাকে নিয়ে যা করার করি। আমার মুখে কথা যোগাতো না। এরপর। এমন লোককে আমি কী বলবো! কিন্তু দেশে না গেলে নয়। কোথা থেকে টাকা পাব? বাবাকে লিখতে চাইলাম। উনি এমন চটে গেলেন, আশ্চর্য। তার অর্থ অবশ্য পরে বুঝতে পেরেছিলাম। তার মনে দুঃখ আছে। শ্বশুর তাকে ঘড়ি, পোশাক কিছুই দেয়নি। তার মতে জামাই হিসেবে বাবার পছন্দ হয়নি তাকে। এসব ফরমালিটির বিষয়। আসলে বাবাকে বলে দিতে হতো। আমার মা কি জানতেন না বিয়ের সময় জামাইকে কি দেয়ার নিয়ম? এতদিন পর স্বামী তার অন্তরের বেদনা প্রকাশ করে দিলেন। রাগ অভিমান যা ছিল উদগার করে দিয়ে শান্ত হলেন। সপ্তাহখানেক পর খুশি মনে অফিস থেকে ফিরলেন। অফিস থেকে লোন পাওয়া গেল। মাসে মাসে বেতন থেকে শোধ দেয়ার নিয়ম। এক সপ্তাহের ছুটিও মঞ্জুর। কাল যাব। বাঁধাছাঁদা করে নাও। নোয়াখালী দুদিন থেকে নোয়াপুর; সেখানে থাকতে পারবে?

নোয়াপুর গ্রামে আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হল। শুকনো ছোটখাট শ্যামলা রঙের একটি মেয়ে। আমাকে যতটুকু যন্ত্রণা না দিলে ভূমিষ্ঠ হওয়া যায় না, ততটুকু দিয়েই এল সে। এদিকে ছেলেটার দুরন্তপনা কে সামলায়। দু’বছর বয়স হলেও বুদ্ধিতে পাকা। সকলের মন জয় করে দিব্বি আমাকে ছাড়া বেড়াচ্ছিল। ওর যে মাথায় উদ্ভট বুদ্ধিও আছে সেটি কেমন করে জানবো? উঠানে তিনমুখো চুলায় ধান সিদ্ধ করা হয়। এতে আগুন নিভিয়ে দিলেও ছাইভর্তি আগুন গনগন করে। যে মেয়েটি সবসময় ওকে রাখে, সেটি এখানেও ওকে রাখে। কিন্তু। সকলের চোখে ধূলা দিয়ে বাহাদুর চুলার খোলা মুখের কাছে কোন খড়ি না পেয়ে জুতা সহ নিজের পা ঢুকিয়ে দিয়েই চিৎকার করে। এমন চিৎকার-আমি এবং অন্যরাও ছুটে এলাম ঘটনাস্থলে। ডান পা দিয়েছিল চুলার মধ্যে। গ্রামের চিকিৎসা দিলেন আমার সেই বিধবা জা, কিরণের মা। সির্কা বোতলের পর বোতল পায়ে ঢেলে ডিমের খোসা ভেঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। ওর কান্না নেই, জ্ঞানও ছিল না এমন। মাথা ধোয়ান একজন, আমি কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকি। ভাগ্য ভাল পায়ে জুতা ছিল। আগুন পায়ে ততটা লাগেনি। ডাক্তার বাবুকেও পাওয়া যাবে। হাটের দিন ফেনী থেকে এসে উনি নতুন বাজারে গাঁয়ের লোক দেখেন। কথাগুলো শুনেছিলাম তবে আমি দেখছিলাম একটি শঙ্কিত মুখের ছায়া-আমার মাকে। আসার সময় সাবধান করেছিলেন, এই দুষ্টটাকে তুই সামলাতে পারবি না আমার কাছে রেখে যা। তাঁর আদরের ধনের এমন সর্বনাশ হয়ে গেল, তাঁকে আমি কি জবাব দেব! ঝর ঝর করে কেঁদেই চলেছি। এদিকে বাড়ির সকলেই কাঁদো কাঁদো, এ বাড়ির প্রথম ছেলে, ঐ বাহাদুর নাম দিয়েই যত গোলমাল হয়েছে। কেবল বাহাদুরি করবে। নিজের পা দিয়ে চুলায় লাড়কি ঢুকাচ্ছে… ইত্যাদি বলে ছোট বুবু আক্ষেপ করছিলেন। যে মেয়েটি ওকে কোলে পিঠে করে রাখছে, এতখানি বড় করে তুলেছে, তার উপর খাপ্পা হয়ে আছে কেউ কেউ। ওর নাম তৈয়বা। কিন্তু মেজবুবুর নাম তৈয়বুন্নেসা। সেজন্য ওকে আমরা টোকি বলে ডাকি। বয়স বার/ তের হতে পারে। কিন্তু কাজ সব শিখেছে। রান্নার কাজে ও আমাকে কতই না সাহায্য করেছে। আমি ওর দোষ দেখি না। বেচারীও অঝোরে কাঁদছিল। কিন্তু দু একটা চড় থাপ্পড় হয়ে গেল ওর উপর দিয়ে।

যুদ্ধের পর গাঁয়ের সাধারণ মানুষ আগের থেকে গরিব হয়েছে। সাহের বাড়িতে একমুঠো ভাতের আশায় সবসময় দেখতাম ময়লা-ঘেঁড়া কাপড় পরা মানুষেরা বাসন হাতে বসেই আছে। ছেলের এই কান্ড দেখে আরও ভিড় জমে গেল। কিরণের মা দূর দূর করেও তাড়াতে পারছিলেন না। শেষে বললেন, আমাদের বাছাধন একটু ভাল হোক, চোখ মেলে দেখুক-হাসুক তোদের সিন্নি বেঁধে খাওয়াব। এখন সরে দাঁড়া। ডাক্তার বাবুও মাঠের কোণাকুণি হেঁটে চলে আসেন। মেজ দেবরও সাথে। পায়ের পাতার উপর ফোস্কা গালিয়ে একটা মলম লাগাতে দিলেন ডাক্তার, আর কলাপাতা কেটে আঙ্গুলের ভাজে ঢুকিয়ে দিয়ে সতর্ক করতে ভুললেন না তিনি। পোড়ার ঘা সহজে শুকাবে না। খেয়াল রাখবেন পাতাগুলো দিনে একবার বদলে আবার দেবেন। আঙ্গুল জোড়া লেগে গেলে বিপদ। তাছাড়া আর কোন ভয় নেই। মলমটা লাগাবেন মাছি যেন না বসে। ডাক্তার বাবু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, মেজদেবরকে বললেন, চৌধুরী সাহেব। বৌদিরও যে নাড়ী পরীক্ষা করতে হবে। উনি বোধ হয় বেশি নার্ভাস … টনিক জাতীয় কিছু খাচ্ছেন নাকি, খুব ফ্যাকাশে লাগছে। আমি চোখের পানি মুছে নিলাম। না ভাই আমাকে দেখতে হবে না। একে এমন ওষুধ দিন যেন তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়। ওর বাবা শুনলেই ছুটে আসবে।

ডাক্তার বাবুটি মেজ দেবরের বন্ধু। চট করে আমাকে জিজ্ঞেস করে, বৌদি বলেন তো, বাঙালি মেয়েরা স্বামীকে এত ভয় করে কেন? আমরা কি বাঘ-ভাল্লুক, খেয়ে ফেলবো? বড় ভাইয়ের ভয়ে আপনি দেখছি মরে যাবেন। লেখাপড়া করেন তবুও ভয় কাটে না। আপনার ছেলে শিগগিরই ভাল হয়ে উঠবে। আপনার নিজের শরীরের যত্ন নিবেন। ঘটনা ছিল অপরাহ্বের, সন্ধ্যার পর মেজদেবর আঙ্গুর, নাশপাতি, বিস্কিট, আরও কত কি সব একরাজ্যের বাজার এনে হাজির। তদুপরি কয়েক জোড়া শাড়ি, তেল, সাবান, স্যান্ডেলও কিনে এনেছে। ছেলের সেবা করবেন, রাত জাগবেন। সেজন্য ভাল খাওয়া দরকার। খাবেন আর সাজবেন এই বলে সে তার ঘরে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমিও কান্নার মধ্যে হাসি। আমাকে রাত জাগতে শুধু হত না, সেই সাথে অন্য একটা শিশুকে বুকে নেয়া, দুধ খাওয়ানোও ছিল। আমি আর টোকি দুজনে চোখ বন্ধ করতাম না। পাছে আঙ্গুল খসে কলাপাতার টুকরো পড়ে যায়। ঘায়ের উপর তেলতেলা মলম, পাতা লেগে থাকে না। সেটা বুঝেছিলাম। এক সপ্তাহে ওর পা শুকিয়ে গেল। শুধু উপরের একটা ঘা পোড় খাচ্ছিল। সময় নিতে পারে ভাল হতে।

কলকাতায় খবর পাঠান হয়েছিল মেয়ে হওয়ার কথা। ছেলের পা পোড়ার খবর দিলাম না। তার মনের ধারণা তাকে আমরা অল্প করে বলি। বেশি কিছু হলে গায়ে মাখি না, গুরুত্ব দিই না। ছেলের পা পুড়েছে খবর পেলে মনে করবে, পা শুধু পুড়েনি বোধ হয় জামা কাপড়সহ শরীরেই আগুন লেগেছিল। এদিকে ছেলের পা শুকিয়েছে। তারও হঠাৎ আসা। মেয়ে দেখার শখ। এসে শুনলেন অন্য খবর। ছেলের মুখে তখন রাজ্যের কথা। সে নিজেই বলে দিল সব। ওরে বাপরে! আগুনে বুঝি ঘি পড়লো। চটে গেলেন। শখ করে তার বৌ ছেলে বাড়িতে এনে কেউ তাদের খেয়াল করেনি। সতর্ক হয়নি। উঠানে ছেলে হাঁটবে একথা খেয়াল করল না কেউ?এমন জায়গায় এদের তিনি রাখেন কি করে? আমি একটুও সুযোগ পেলাম না বলতে। তোমার চেয়ে এখানে আমার বেশি যত্ন হয়েছে। মেজ দেবর অগত্যা একটি ছাগল এনে মেয়ের আকিকা ও অন্য ছাগল ভাই পো এর জীবনের ছদকা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিল ঐদিনই। ঝটপট যে নাম মনে এল মেয়ের জন্য দিলাম সাকী সেলিমা । (তখন আমি ও আমার বোন নুরজাহান রুবায়াতে ওমর খৈয়াম, বাংলা তর্জমা পড়তাম) সকলেই এই নাম পছন্দ করলেন।

চলে আসার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। শাশুড়ি আম্মা এবং অন্য মুরুব্বিরা মানা করেছেন। বৌ এর শরীর এখনও কাঁচা। একুশটা দিন হল না। এখন যাওয়া ভাল না। কিন্তু একরোখা লোকটি আমাকে বাড়ি থেকে টেনেই বুঝি নিয়ে আসে। কষ্ট হয়েছিল দরদ মাখা মনের অসুস্থ বুড়ো শাশুড়ি মায়ের জন্য। আমি পালকিতে উঠে গেলে তার করুণ কষ্ঠের আক্ষেপ কানে বাজছিল। এই মা নিজের ছেলেকে কতবারই ত্যাজ্য করেন, আবার বুকে নেন। আক্ষেপ করে গান ধরেন, ‘তোরা কিরে পুত্র আমার? পুত্র আমার হনুমান। অতঃপর তার কণ্ঠ নিস্তেজ . . . ক্লান্ত শ্রান্ত স্নেহবাৎসল মা নেতিয়ে পড়েন। তার আছে একপাল এতিম মেয়ে আর ছেলে নিয়ে নিজের ঘরে গড়া এতিমখানা, তারাই তখন সেবায় লেগে যাবে। তিনি একসময় সুস্থ হবেন, স্বাভাবিক হবেন। একে একে চৌদ্দজন সন্তান হয়েছিল তার, আল্লাহ নিয়ে যান যেটাকে খুশি। এমনি সাতজন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। বাকি সাতজন বেঁচে থাক উনি জীবনে আর কিছুই চান না।

 কলকাতা তোমাকে বিদায়

অতঃপর কলকাতা অস্থির। দাঙ্গা বুঝি এই শুরু হল। আতংক ছড়িয়ে গেল। মিস্টার জিন্নাহর প্রস্তাব অন্যরা মানছেন না। উনি ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে ঘোষণা দেবেন। দোকান পাঠ বন্ধ,চাল ডাল আলু দুধ কিনে রাখার পরামর্শ মুখে মুখে। দ্রুত ঘটনা এগিয়ে আসছিল। একদিন শুনলাম মেটিয়া বুরুজ থেকে ছুরি,বল্লম নিয়ে মুসলমানরা বের হলো বলে। আলীপুরে মুসলমান কেটে শেষ করে দিচ্ছে। কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। রায়ট লেগে গিয়েছে। পার্ক সার্কাসে আমাদের সামনেই চারতলা বাড়ি এক হিন্দু ডাক্তারের। তাতে গলগল করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে দেখছিলাম। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর সমুদ্রের গর্জনের মত শুনেছিলাম। সেদিন আমাদেরও মনে মৃত্যু ভয়। বাড়ির নাম রাস্তার বহুদূর থেকে দেখা যায়—য়োগেন্দ্র ম্যানশন। আল্লাহ বাঁচিয়েছিলেন। ঐ লাঠি-বল্লম সেসব অন্যপথে চলে গেল। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দ যে কি,একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ শব্দে কেঁদে আকুল।

বাসায় এসে পৌঁছেছি লাশ হয়ে। গোয়ালন্দ ঘাটে বার ঘন্টা আটকে পড়া ঠিক যেন হাসরের ময়দান। সেদিন শিয়ালদহে রেলশ্রমিকরা ধর্মঘট করেছিল। ট্রেন রাজবাড়িতে আসতে পারেনি। যাত্রিবোঝাই স্টিমার গোয়ালন্দ ঘাটে কলকাতার পথিকদের নামিয়ে খালাস,আমরা ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরতে যাব,হল না। ট্রেন লাইন খাঁ খাঁ । মানুষ হয়রান-পেরেশান। প্রচন্ড গরম,চরের কড়কড়ে বালু বাতাসে নাকে মুখে ঢুকছে। শশা,ডাব,পেঁপে যা ছিল চিলের মত ছোঁ মেরে যে পেল কিনল। অন্যদের গলদঘর্ম। আমার সাথে ফ্লাক্স দুই বাচ্চার দুধ ছিল,তাও শেষ। খানাপিনার হোটেল ছাপড়ামতন,কত আর অভাব মেটাতে পারে। আমি সেই খোলা চরে ট্রাঙ্কের উপর বসে আঁচলে ঢেকে মেয়েটাকে দুধ খাইয়ে শান্ত রাখছি,ছেলের ঘাম আর কান্না। আমার মা ওকে ননীর পুতুল বানিয়ে আরও বিপদ করেছেন। অগত্যা স্বামী চাকরটাকে নিয়ে ঘুরে এলেন রাজবাড়ি শহর,যা পেলেন তাতে কোনমতে প্রাণ রক্ষা। ট্রেন এলো। রাত হয়ে গিয়েছিল। ঝি-চাকরসহ যাত্রী আমরা পূর্ণ বয়স্ক চারজন,হাফ একটা ছিল সাকীকে কোলে নেয়ার মেয়ে। ইন্টার ক্লাস টিকিট,জায়গা পেতেও রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছিল। ট্রেন ছাড়ার পর অনুভব করলাম,দু’বাড়িতে দুজন। মাকে অমান্য করে এসে আচ্ছা শাস্তি ভোগ করলাম। মাফ চেয়ে চিঠি দেব তাঁদেরকে,ভালোয় ভালোয় কলকাতা পৌঁছে যাই।

শিয়ালদহ স্টেশনে গাড়ি থামার আগ থেকেই কুলিদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গেল। মালপত্র কে টানছে বুঝতেও পারছিলাম না,কেবল গরমে শ্রান্তিতে ক্যাঁতক্যাঁতে হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে দুটোকে আঁকড়ে ধরে থাকি। ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিল এক কুলি। তার মজুরি বেশি চাইল না। তাদের ধর্মঘটের কারণে আমাদের কষ্ট হয়েছিল,এ বোধ মনে ছিল হয়তো বা। পার্ক সার্কাস বাসায় পৌছি, ভোর হয়ে গিয়েছে। বাসার রুম ভাড়া দিয়েছিল কেন,তাই স্বামীকে আবোল-তাবোল বকেছিলাম, এবারে তার প্রশংসা করে নিলাম। ভাগ্যিস এই আপা ছিলেন, কি মজার রান্না খেতে পেলাম;বাচ্চা দুটোর গা গোসল,সুন্দর পরিচ্ছন্ন করে দিলেন কোনো এক ফাকেঁ। এরা চাটগাঁর খাস বাসিন্দা। দুই টুকরা কাপড় পরেন, ভাষাও আমাদের বুঝতে কষ্ট হতো। কিন্তু মন ছিল দেদার বড়। ছেলেমেয়ে ছিল না। তাই বলে আক্ষেপ করতে শুনতাম না। দুদিন আপার রান্না খেয়ে ঘুম পুরিয়ে নিজের সংসারে চোখ মেলে দেখি এতদিনের আমার অনুপস্থিতি, সব ছন্নছাড়া। পুরুষ মানুষেরা নিজেরা ঘরের কি ছিরি করে। নোংরা লাগছিল।

বাসার পিছনে একটা মাঠ ছিল। সেটাকে ট্রেনিং সেন্টার করেছেন স্বামী। তার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ট্রেনিং তো আমাকে দেখান চাই। পাড়ার ছেলে-ছোকরা জুটিয়ে,যারা তার যুব সংঘের মেম্বার, সকাল বিকাল হলেই সেখানে জড় হয়। প্যারেড,জিমনাস্টিক করান, আমি ঘর থেকে দেখি,আবার দেখিও না। বিকেলের আগে ঐ মাঠে ভরে। থাকে উচ্ছল,রঙিন প্রজাপতির মতো কতকগুলো সুইপার মেয়ে-পুরুষ। রসের আড্ডা জমিয়ে নিত। কাজ সেরে এখানে বসে ওরা তাড়ি খেত। সাথে ফুলুরি ইত্যাদি। মুখে কি সব সুরে বেসুরে গান। খিলখিল হাসি। আমি অত্যন্ত উৎসাহে কেবল দেখি;আহা … কাজ কর্ম সেরে গোসল করে লাল ছাপা শাড়ি,কপালে সিঁদুরের টিপ,নিজের কাজের পয়সা খাচ্ছে ,গাইছে … কত আনন্দ! ওদের এই আনন্দ আমাকে মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল আমার প্রিয় টিচার মিস লায়লা খানকে। তিনি খুব সুন্দর কোটেশনের ব্যবহার করতেন; আমি তাঁকে অনুকরণ করে বলতে লাগলাম, “Life is a gift, life is a hapiness, each moment can be an age of happiness”.ওদিকে ওরা তাড়ি খেয়ে চুর আর যুবসংঘের ছেলেরা এসে তাড়া দিচ্ছে,ওদের মৌতাত ছুটে গেল এবং সে সাথে আমারও।

ব্ল্যাক মার্কেটের কথা সে সময় প্রায় শুনতাম। দুধ,চিনি বাজারে পাওয়া যায় না,তবে টাকা দাও মিলবে। আমার দুই সন্তানের জন্য যা প্রয়োজন তালতলার ভাগনীর ছেলে কামাল এসে দিয়ে যেত;ওদের রেল কোম্পানির রেশনের জিনিস আমি নিলেও পুষিয়ে দিতাম ওদের। কিনতু বাজার হিসাব কুলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। নিজের থেকেই একদিন প্রস্তাব দিই,সম্মানের কান তো আগেই কাটা গিয়েছে। বাসার ভিতর অন্যলোক ঢুকিয়েছি। আর একটা রুম তো ভাড়া দেয়া যায়,ছোট বসার ঘরটি তেমন আর কাজে লাগে না। সবার রান্না আর গোসলের জায়গা আলাদা,এরা না হয় আমাদের সাথে শেয়ার করবে। আশ্চর্য এবার তাকে আমি রাজি করাতে পারলাম না। ছেলেমেয়ে দুজনের জন্য এ ঘর। আমি খুশি কী হবো,অবাক হই! ওর কি কোন ভাল চাকরি হচ্ছে, না কি বেতন বেড়েছে! জিজ্ঞেস করতেই লাফিয়ে উঠলো,দেশের অবস্থা কি ভালো? অত সুখের স্বপ্ন দেখ কেন? ওরা বড় হচ্ছে-আলাদা ঘর লাগবে সেজন্যেই বলেছি। ইনকামের একটা ব্যবস্থা হচ্ছে। বারাসৎ (বসিরহাট) থেকে একজন গয়লা দুধ আনে,তার সাথে ব্যবসা ঠিক। প্রতিদিনের হিসেব তুমি রাখবে। অফিস থেকে লোন নিয়েছি আবার। আমি কি আর করি,হেসে বললাম-বাণিজ্যে বসতঃ লক্ষ্মী। তোমার এতে রিশ্বাস, আমি নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু শিগগিরই টের পেলাম,ব্যবসা শেষ। লাভ বলতে তিনমাস খাঁটি দুধ খেতে পেয়েছিলাম। পূর্ব বাংলার লোকেরা কি এখানে দুধের ব্যবসা করতে আসে? আমার কলেজের বাংলার আপা খোদেজা খাতুনের বাসায় গিয়ে একদিন এই দৃশ্যটি দেখি। তার বি. সি. এস স্বামী চাকরি না করে দুধের ব্যবসায় নেমেছেন। ঘরের মধ্যে অবিক্রীত দুধের ভার দেখেছিলাম। আপা আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন,দেখ,আমিও খুব সুখে নেই। লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের বাংলার অধ্যাপিকার সেদিনকার অসহায় অবস্থা,স্বামী ব্যক্তিটি স্ত্রীর মর্যাদা বুঝেন না;আমি তার সঙ্গে সমবেদনায় এক হয়েছি। এতো ভাল। ছাত্রী শিক্ষিকা নই,আমরা মেয়ে জাতি এই একখানে এক।

এদিকে দুধের ব্যবসায় তার মন খারাপ,মাস মাহিনায় খরচ কুলায় না। বাজার থেকে এসে চোটপাট;আমার বাড়ির ভাত কুত্তা বিলাইয়ে খায়,এখানে থাকলে না খেয়েই মরবো চল দেশে যাই। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কথা সারা বিশ্ব জানে,বড়লাট পর্যন্ত কৈফিয়ত দিচ্ছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এদিকে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন কিনা বাংলাদেশের মানুষ ভাতে মরছে। তো ঠিক হায়,ও লোগোকো পোলাউ খিলায়াগা.. মামলা তো ইয়ে হায়। লাট সাহেবকে ঘুঘু দেখাচ্ছে! কলকাতায় নবাবি ঠাঁটে চলে এরা, এদের ভরসায় মুসলমানদের রাজনীতি? তবে আমাদের শিল্পী জয়নুল আবেদীন কাজের মতো কাজ করলেন। দুর্ভিক্ষের কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন। কাকে-মানুষে ডাস্টবিনের খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি,এক ছবিতেই কথা বলেছে। ঘরে আজাদ পত্রিকায় আমিও এসব দেখে মন খারাপ করে চিন্তা করি নিজের কথা। দেশে যদি যেতে হয়,কোথায় থাকব?

ও ভাবী,আপনি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়েছেন? ঘর থেকে সাজেদা (আমাদের ভাড়াটে) বেরিয়ে আসে। ভাইয়াকে আপনার রোল নাম্বার দিয়েছিলাম। উনি কিন্তু জানেন, আগে মিষ্টি খাওয়ান তবে বলবো। আমি মনে মনে ভীত ছিলাম, পাস কপালে নেই। যে রকম রাবিশ পরীক্ষা দিয়েছি,আশা কিছু ছিল না। তাই ওকে বললাম,আমি কিন্তু কোনমতে পাস করলেই খুশি। তারপর ও বলে, ইংরেজি ভাল করলেই আপনি ফার্স্ট ডিভিশন পেতেন। অন্য নম্বর খুব ভাল। আমি খুশি হলাম কিন্তু বুকে কাঁটার মত বিধে যে দৃশ্যটি আছে তা পুনরায় চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কান্না পেয়ে গেল। সাজেদাকে বললাম, তোমরা খুব ভাল আছো,আমার মতো যুদ্ধে নামনি। আমি যে পড়ি, পরীক্ষা পাস করি এনিয়ে কত ঝগড়া। শেষে এমন হল আমার স্বামীকে কত গালাগাল খেতে হল,স্ত্রৈন বলে মেজবোন ধিক্কার দিয়েছে। এ বাড়ি তো তারই। ছেড়ে চলেও গেলেন। স্বামীর সঙ্গে আমার সর্বক্ষণ রাগ,গোস্বা, পড়তে চাই বলে কেউ কি আমাকে কোন কাজ থেকে রেহাই দিয়েছে? শুনবে,তোমার ভাই যে রচনা এনে দিলেন,আমি ঠিকমত পড়তে পারিনি। রাঁধতে বসে পড়ছিলাম,রান্না খারাপ হয়ে  গেল। উনি কেড়ে নিয়ে আমার চোখের সামনে সেটি ছিড়ে কুটি কুটি করলেন।

গ্রামের সরল মেয়ে সাজেদা, প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছিল। ওর স্বামীও ম্যাট্রিক পাস। কিন্তু ওর ভাইকে মেধাবী দেখে মামা নিয়ে পড়ান এবং মেয়ে বিয়ে দেন। সাজেদাকে আরও বললাম,তুমি আমার রেজাল্ট জানালে। একথা আমি স্বামীকে জানাতেও পারবো না। সব পুরুষ হিংসুক কিনা কি করে বলি। নিজেই নিয়ে আসুক। সেটাই ভাল হবে। অফিসের বন্ধুরা খবর দিতে পারে।

যা বলেছিলাম। সেদিনই সন্ধ্যায় মিষ্টি কিনে ঘরে ফিরলেন। আমাকে পাকড়াও করে একটা মিষ্টি মুখে ভরে দিলেন। তারপর হাঁক-ডাক; কই তোরা মিষ্টি খেতে আয়। ছেলে কিছুই বোঝে না। বাপকে এমন খুশি থাকতে সে কমই দেখেছে। টোকি নিয়ে এলো মেয়েটিকে, সকলে একসাথে মিষ্টি খেতে লাগলাম। বাগবাজারের রসগোল্লা ভিমনাগের সন্দেশ বলে আমাদের সাথে গান ধরেন গৃহকর্তা।

তোমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। কলেজ বাসে আসা-যাওয়া,মাসে বিশ টাকা স্টাইপেন্ড, বেতন ফ্রি, বাসের জন্য মাত্র খরচ মাসে তিনটাকা। এতসব কথা শুনছিলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে বুঝেছিলাম আমার উচ্চাশা তাকে পেয়ে বসেছে। ভর্তি হয়ে গেলাম। বইপত্র কেনার প্রয়োজন নেই, কাছেই কলেজ। লাইব্রেরিতে পড়ে নেব। জীবনের সুখ বুঝি মনকে নাচিয়ে গাইয়ে দেয় ! আমি এই সময়ে বড় সুখে দিন কাটিয়েছি। ক্লাসমেটদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। নাদেরা চৌধুরী ডাকসাইটে মেয়ে। আমাকে ডাকে, “এই নোয়াখাইল্যা হুনি যা একখান কতা, নাকে হুল পিন্দস কা, তোর বিয়া অইছে? কানে কানবালা কারে দেয়াস। কলেজে এই গুন হিন্দি আইবি না কইলাম।” ওর সঙ্গে সর্বক্ষণ আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা হতো। একদিন আমরা ক্লাস বর্জন করি। ওর সে কি তেজী বক্তৃতা। মুসলমানেরা চিরকাল কি হিন্দুদের হাতে মার খাবে? আসামের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। বরদলৌ মিনিস্ট্রি হাতির পায়ে পিষিয়ে মুসলমান মারছে। তোমরা শুনেছ? মুসলমানদের বাঁচতে হলে আলাদা হতে হবে। ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র দিতে হবে … দিতে হবে। মিটিং শেষে আমার লম্বা বেণী ধরে টেনে বলে, তুই নোয়াখাইল্যা, যা মুসলমান মেয়েদের সেকেন্ড লিডার তোরে বানাই দিমু।

তারপর কে কোথায়? হোসনে আরা (গোলাম মোস্তফার স্ত্রী) চোখ পাকিয়ে অভিনয়ের ঢঙে কথা বলতো। আমরা ওকে ছেড়ে কথা বলিনি,নায়িকা হলে তোর ছবি ফ্লপ করবে। পেঁতি হতে পারবি এর বেশি তোকে দিয়ে হবে না। কিন্তু তখন অন্য একমেয়ে,বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার মেয়ে কৃষ্ণা সাহা আমাকে দস্তয়েভস্কির বই পড়তে দিত,ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস পড়তে দিল ( আর্নেস্ট হোমিংওয়ের বই)। আমাকে লেখার কথা বলতো। আমার বাংলার টিচার প্রীতি আলমগীরও একই কথা বলতেন। চেষ্টা করলে ভাল লিখবে। উনি বেশ আলাপী মহিলা,মুসলমানকে বিয়ে করে ও শাঁখা সিঁদুর পরতেন দেখে আমার কৌতূহল হয়। কারণ জানতে চাইলাম। একটুও রাগ দেখালেন না।বললেন, ধর্ম নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা নেই। যার যা জন্মগত,তা রেখে দিয়েছি। ছেলেমেয়েদেরও সেই স্বাধীনতা থাকবে। সেদিন প্রীতি আলমগীরের কথা বুঝতে সময় নিয়েছিল। শেষে বুঝলাম ওদের মধ্যে গোঁড়ামি ছিল না। তাই প্রেম করে সুখের সংসার সাজিয়ে দিব্বি আছেন।

অতঃপর কলকাতা অস্থির। দাঙ্গা বুঝি এই শুরু হলো। আতংক ছড়িয়ে গেল। মিস্টার জিন্নাহর প্রস্তাব অন্যরা মানছেন না। উনি ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে ঘোষণা দেবেন। দোকান পাঠ বন্ধ,চাল ডাল আলু দুধ কিনে রাখার পরামর্শ মুখে মুখে। দ্রুত ঘটনা এগিয়ে আসছিল। একদিন শুনলাম মেটিয়া বুরুজ থেকে ছুরি, বল্লম নিয়ে মুসলমানরা বের হলো বলে। আলীপুরে মুসলমান কেটে শেষ করে দিচ্ছে। কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। রায়ট লেগে গিয়েছে। পার্ক সার্কাসে আমাদের সামনেই চারতলা বাড়ি এক হিন্দু ডাক্তারের। তাতে গলগল করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে দেখছিলাম। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর সমুদ্রের গর্জনের মত শুনেছিলাম। সেদিন আমাদেরও মনে মৃত্যু ভয়। বাড়ির নাম রাস্তার বহুদূর থেকে দেখা যায়—য়োগেন্দ্র ম্যানশন। আল্লাহ বাঁচিয়েছিলেন। ঐ লাঠি-বল্লম সেসব অন্যপথে চলে গেল। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দ যে কি,একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ শব্দে কেঁদে আকুল। পরদিন খুব ভোরে কেউ জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল, আমাদের নিচে এবং উপরে দুজায়গায় কলাপসিবল গেট,নিচেরটা খুলছে কে? উপরে ধাক্কা। চাবি থাকে ওর হাতে,খুলতে যেতেই আমরা সবাই

ভাড়াটেরা সব পথ আটকাই, আস আমরা লুকিয়ে যাই। না, তিনি খুলবেনই। আহ, খুলে দেখি আমাদের মুদি, এক ঝাঁকা ভর্তি আলু ডাল, চাল, কুমড়া,লবন নিয়ে এসেছে।মাযিছি কা লিয়ে খোকাবাবু কা লিয়ে, ইয়ে দেনে লিযে স্যারআ য়া, মগর টাইম নেই হ্যায়। ম্যায দোকানছোড়কে যাতা হু…ফ্লোরে মাথা ঠেকিয়ে প্রনামকরে দেহাতি মানুষটা ছুট দিল।আমাদের কারও মুখে একটি কথাও এল না।বলতে পারলাম না,বেলা হয়ে গিয়েছে তুমি কাজে যেওনা,আমাদের এখানে লুকিয়ে থাক। অন্ধকারে যেও।বেচারীকে বেশি দূর যেতে দেয়নি তার নিয়তি।আমাদের এলাকার শেষ মাথায় কোথা থেকে একটা বল্লম এসে মাথার এদিক থেকে ওদিক ফুটো করে আটকে থাকে,ভারে সে রাস্তায় পড়ে ছটফটায়।আড়াল থেকে ছুটে এসেছিল কয়েকজন। টাকা-পয়সা হাতড়ে বল্লম টেনে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। বেলা দশটার ঘটনাটি।মুখে মুখে রটে গেল ঘটনাটি।ওকি জানতো ও মরবেই? অতগুলো জিনিস সাজিয়ে কেন দিয়ে গেল আমাদের? সে প্রশ্নের উত্তর কোনদিন পাইনি।

সংবাদপত্র ঠিকমত পেতাম না। খবর কোথায় কি, এর বাড়ি ওর বাড়ি হয়ে স্বামী যা আনতেন, শুনতাম। আমাদের ভাড়াটেরা চলে গেলে আমি একা হয়ে দিন গুনছি কবে যাব।একদিন উনি অফিস থেকে উল্লাস সহকারে আসেন।পাকিস্তানের দুটো ভাগ।পূর্ব ও পশ্চিম।আমি পূর্বেরটায় অপশন দিয়েছি। অনেকে করাচি দিল কেন। ওখানে নাকি বেতন-ভাতা বেশি পাওয়া যাবে। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদা শুরু করে দাও। ঢাকায় কোথায় যাব? ফেনীর ঠিকানায় সব বুক করে দিতে হবে। ফেনী কোর্টে বসে যাব তারপর, ঢাকা থেকে ‘ল’ পাস আছে আমার ভাগ্যে। কলকাতায় তা হল না। আমি খুশি মনে বললাম, ভালো তবে তাই হোক।তুমি পাস করে ঝটপট ওকালতিতে বসে যাও। বাবা মা দুজনের কাছেই আমি দোষী হয়ে আছি। আসলে তারা তোমার পড়াটায় চায়, তাদের মেয়ে পড়লে ভাল কথা, না পড়লে কি আর স্বামীর সংসার করবে।প্রত্যেকবারই জিজ্ঞেস করে জামাই ‘ল’ পড়া শেষ করেছে? পরীক্ষা দিয়েছে?

কথা আর আগায় না। এমনিতে আমি কথা কম বলি, এ ধরণের কথার প্রতিবাদ করা যায়ও না। নিজের কিল নিজেই গিলে নিই। কতই তো দেখলমি, বুঝতে শিখলাম। আমি যে কুড়িতে পা দিয়েছি, বেশ বুড়ি।দুটো মানব সন্তান এনেছি সংসারে, ওরা ‘মা’ ডেকে মুখে সহস্রবার বুঁদবুঁদ তোলে। ঘরের মধ্যে এই দুঃসময়ে এক দেহাতী মধ্যবয়সী দোকানি মা ডেকে চাল ডাল রেখে গিয়েছে। রিফিউজি হয়ে বাস করছি। টিকিট হাতে পেলে চলে যাব। ঐ দেহাতী লোকটার মৃত্যু সংবাদ শুনেছি। অশ্রু মুছেছি বাবাবার।

দেখছিলাম হাতের কাজ শেষ করে উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। তার আছে যুব সংঘ, রিলিফ ওয়ার্ক করতে যাচ্ছেন। পথরোধ করে দাঁড়াই তোমার সাথে আমিও যাব।আমাদের কলেজের জন্য সামান্য চালডাল বেধে রেখেছি। তোমার সংঘের নামেই না হয় আমি দিয়ে আসি।কলেজকে শেষবারের মত বিদায় জানাতেও ইচ্ছা হচ্ছে।

তোমার যেয়ে কাজ নেই, রিলিফের জন্য যা দিচ্ছ সেটাই দরকার।লেবেলটা তুলে (ডোনেটেড বাই মিসেস রওশন সেলিম লিখে দাও)। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করে দিয়েছি। জানি, তা না করলে জিনিসগুলো দেয়া হবে না।

চৌদ্দই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, ভারতের পনেরো; উনিশ শ’ সাতচল্লিশ। ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক খচিত পতাকা নেই, উড়ছে চরকার পতাকা। রাস্তায় জয় হিন্দ শ্লোগান। ঢাকার জন্য স্পেশাল ট্রেন। ষোলই আগস্ট অতি ভোরে আমরা পার্ক সার্কাস চিরকালের জন্য ছেড়ে শিয়ালদহ স্টেশনে এলাম। প্রচন্ড ভিড় ঠেলে রেল লাইনের কাছে আসি।উঠতে পারলাম না। লাইনের পাশে বসে গেলাম। পরের ট্রেন যেন মিস না করি। কয়েকজন রেলের লোক হাত ঠেকিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল যাত্রীদের। কিন্তু আবার আগের অবস্থা; মানুষ যে মরিয়া হয়ে আছে, এখানে আর নয় মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হয়েছে। সেখানে যেতে দেরি আর কেন! এর মধ্যে ভরসা দিতে, মনে সাহস দিতে একটা লোক কি সুন্দর কথা বলে যাচ্ছে; ‘ঘাবড়াইয়ে মাৎ ইয়ে কলকাত্তাকে পেয়ার হায়। ঝুট নেহি-সাছ। আবলোগোকে থোড়াছা বৈঠনে হোগা। আঁখ, খোলকর দেখনে কা লিয়ে। বহুৎ মজবুরী’।কে সে? চেহারা আর পরনের কাপড়ে তাকে হিন্দু কি মুসলিম, আমি চিনতে পারছি না, সে বুঝি কলকাতার নানান ঘটনার মধ্যে একজন। বেঁচে থাকার মানুষ!

স্পেশাল ট্রেন এসে দাঁড়াল। উঠে গেলাম। যাত্রীরা একে অন্যকে হাসিমুখে স্বাগত জানাচ্ছিল। অধিকাংশ সরকারী অফিসের লোক, ঢাকার যাত্রী। আমরা এক পরিবার ফেনীর। যুদ্ধে জিতে সৈন্যরা যেমন উল্লাসে মেতে দেশে চলে,এও তেমন দৃশ্য। একজন রসিক যাত্রী আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, “এই ঝামেলার আগে ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিলেন না কেন? এই যে আমাদের দেখেন,হাত পা ঝাড়া … সাজো ঢাকা, অফিস করবো। তারপর একটু রসিয়ে স্বামীর মাথাভর্তি পক্বকেশ দেখে নিয়ে বললো, ও বুঝেছি দ্বিতীয় পক্ষ! আছেন ভালো ভাই!”

কামরার সকল মানুষেরা আমাকে দেখছিল, সাকী আমাকে আঁকড়ে বসেছিল কোলে, বাহাদুর ওকে টেনে নামাতে চায়। আমি কোথায় লুকাব? উনি সহজ গলায় ঐ লোকের কথার উত্তর দিলেন, সম্ভব হয়নি,লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী, কলেজে রিলিফের কাজ করেছিল।

আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (প্রথমর্ব)

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share