স্থানিকের দিনলিপি

গদ্য সাহিত্য

।। জ্যোতি পোদ্দার ।।

শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি বনের মন ও শরীরের ভগ্ন দশা উদ্ধারের জন্য পাখিদের কার্য নির্বাহের অধীনে ছেড়ে দেবার জোড় পক্ষপাতি। পাখি নাকি—তাদের দাবী— পাঁচ বছরেই বনের ভূগোল পাল্টে এনে দেবে এক বৈচিত্রতার কোরাস।  পাখিদের এই সক্ষমতার সংবাদ তারা রাষ্ট্র করে দিচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে গারো পাহাড় ভালো নেই।

স্থানিকের দিনলিপি

বনে কোনও চিহ্নিত পথ নেই। আড়াআড়ি বা খাড়াখাড়ি যে দিকেই হাঁটি না কেন পথিককেই পথ বাতলে নিতে হয়। যে যে পথিক তার তার পথ। প্রতিটি পথ অনন্য হৃদয়ের পথ। রোড নাম্বার নেই। হোল্ডিং নাম্বার নেই। নেই ট্র্যাফিকিং। ছকেবাঁধা পথ নয় বলেই দলবেঁধে অরণ্যে এলেও সকলে একই পথে হাঁটে না। যার যার মতো করে তার তার পা ফেলে ফেলে পথ এঁকেবেঁকে হয়ে উঠে বনেরই একজন।

আমি যে দলের লেজ হয়ে এসেছি তারা বার্ড ওয়াচার। দূরে কোথাও পাখির ক্ষীণ ডাকে সর্তক হয়ে ওঠে। ইয়া বড় ক্যামেরা নিয়ে যার যার পজিসনে চোখ আর আঙুল তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। উড়ন্ত কিংবা সবুজ পাতার আড়ালে একটু পুচ্ছ দেখে বলে দিতে পারে এটি লালঘাড়-পেঙ্গা না ছোট-মালাপেঙ্গা নাকি দীর্ঘলেজী সবুজ-তাউড়া অথবা সবুজ ঠোঁট–মালকোয়া।

একই সাথে ঘুরছি ফিরছি—আঙুল উঁচিয়ে না দেখিয়ে দিলে আমার আর জানা হয় না এই পড়শী পাখির নাম কী? নইলে দূরে শুধু পাতাই দেখি—বাতাসে কাঁপছে বা উড়ন্ত কোন পাখির ছায়া দেখি—পাখির কায়া দেখবার আগেই ফুড়ুৎ। পাখি দেখার চোখ সবার হয় না—কারো কারো হয়। এই যেমন শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটির পাখিবন্ধুরা— পলকেই চিনে স্থির ফ্রেমে বন্দি করে ফেলে।

পাখিবন্দি তাদের লক্ষ্য নয়। পাখির আবাসস্থল রক্ষার সাথে সাথে যে বনের মন ও শরীর উৎকর্ষকতার সম্পর্ক— সেটি জানানোও তাদের উদ্দেশ্য। বনের ভঙ্গুরস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য মনুষ্যপ্রণীত নানা কিসিমের প্রকল্প সরকার নিলেও অরণ্যের ভগ্নদশা আর উদ্ধার হচ্ছে না। নানা ক্ষয় রোগে দিন দিন কাহিল বনের মন ও শরীর।

শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি বনের মন ও শরীরের ভগ্ন দশা উদ্ধারের জন্য পাখিদের কার্য নির্বাহের অধীনে ছেড়ে দেবার জোড় পক্ষপাতি। পাখি নাকি—তাদের দাবী— পাঁচ বছরেই বনের ভূগোল পাল্টে এনে দেবে এক বৈচিত্রতার কোরাস।  পাখিদের এই সক্ষমতার সংবাদ তারা রাষ্ট্র করে দিচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে গারো পাহাড় ভালো নেই।

বলছিলাম পথের কথা। হাঁটতে হাঁটতে কখনো বৃক্ষকের পাশে বা বনতলে কোন গুল্মের অথবা লাল নরম মাটিতে বেড়ে ওঠা বিচিত্র বুনোঘাসের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা পেলবতার স্পর্শ নিলাম। পড়শীর উঠানে ঝুঁকে পড়ে যেমন কুশলাদি জিজ্ঞাসা করি তেমন করেই বৃক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরে আত্মীয়তার বন্ধন খুঁজি। রক্তের না কোন হোক প্রাণের তো। প্রাণে প্রাণে প্রাণ বেঁধেই আমি— বৃক্ষের অধ্যক্ষতা বেঁচে থাকা। বৃক্ষ আমার পরাণ সখা— নির্ভরবান্ধব

বৃক্ষ আমাকে নেয় না— ‘কেবলই অবিশ্বাসে সরে সরে যায়।’ এই যে ল্যান্টেনা— গুল্ম জাতীয় বুনোফুলের ঘনঝোপ সরিয়ে সরিয়ে পথ তৈরি করে হাঁটছি খাড়ির দিকে; তাও আমাকে নেয় না। সন্দেহ করে। আমরা যেমন স্টেশনে বা গাড়িতে কোনও আগন্তুক পাশে বসলে ভয় বা সন্দেহে কুঁকড়ে থাকি তেমন ল্যান্টেনা আমার হাতের ধাক্কায় কিছুটা সরে গেল। বেড়ে ওঠা ডালটি আমার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ল।

কিন্তু ল্যান্টেনার মাদকতা আমাকে আটকে রাখল ঘনঝোপে। বুক সমান উঁচু গাছ। ছড়ানোছিটিনো স্বভাব তার। সবুজ কচি ডালে থোকা থোকা ফুল— বর্ষার নয়া জল গায়ে লাগলেই ঝলক দিয়ে উঠে ল্যান্টনা। আশ্চার্য বুনোগন্ধ। মাথা ঝিম ধরে যায়। জৈষ্ঠ্যে–আষাঢ়ে ফুলে ফুলে ঢলে পড়ে। ল্যান্টানার রঙ নানা রঙে রঙিন।

কলি থেকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পৌঁছুতে ফুলগুলো রঙ বদলায়। বিস্ফারিত হয়।

সাদা হলুদ আর গোলাপি রঙে বাহারি থোকা আর থোকা। থোকার পর থোকা। কড়া গন্ধ। করোটির কোষ উল্টেপাল্টে দেয় এই বুনোগন্ধের মাদকতায়।

সবুজ ডগায় ছোট ছোট কাটা। তীক্ষ্ণকাঁটা হলেও আগ্রাসী নয়— সওয়া যায়। রোদ আর বৃষ্টির ভেতর বাতাসে যখন থোকাগুলো দুলছিল— আর পাহাড়ের বাহারী প্রজাপতি উড়ে উড়ে নাচছে ল্যান্টেনা ঘিরে। কোথায় বসবার অবকাশ নেই। নিধু বনে রাধার সখার যেমন ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে তেমন পাহাড়ি প্রজাপতি নাচছে।

ল্যান্টেনা প্রজাপতিবান্ধব গুল্ম। কোনো সৌখিনের বাগান বা টবে ল্যান্টেনা আজকাল রেড়ে উঠলেও গায়ে এমন বুনোগন্ধ পাওয়া যায় না। কাঁটাও ভোঁতা। নাগরিক হল্লায় প্রজাপতিও বজ্জাত; বাগানে বা টবে নাচতে যেতে চায় না। তার ছন্দগীতিনৃত্য বুনো পাহাড়ি ল্যান্টেনা ঘিরেই।

ল্যান্টেনা পড়শির সাথে কত কথাই না হলো আমার। তবু সে আমাকে নিলো না। আমি আউটসাইডার। বৃক্ষেরও কাছে– গুল্মেরও কাছে। এমন কী আমি যে নগর ফ্লাটে থাকি তার পড়শির কাছেও আমি আউটসাইডার। কাঁচাবাজারে ঘামে ভেজা শরীর ঘসে ঘসে তার সাথে  দেখা; লিফটে উঠি নামি যখন তখন— তার কাছেও আমি আউটসাইডার। পারস্পরিক দূরত্ব যোজন যোজন। ঘাটে ঘাটে জলের দেখা মিললেও আমার সাথে কারো  দেখা নাই। চোখাচোখি আছে—তবু  দেখা নাই। দেখা নাই।

জ্যোতি পোদ্দার

জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি। বাসস্থান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯),
‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।
Share

Share