সময়, শস্য, সত্তা

।। আমাদের কথা ।।

মকর সংক্রান্তি বড় বাংলায় বড় উৎসব। পৌষ মাসের শেষে নিজের কক্ষপথ থেকে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করেন। তাই ‘মকর সংক্রান্তি’। বারো মাসে বারো বার সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে যান, তাই ১২ মাসেই সংক্রান্তি আছে। বড় বাংলায় সংক্রান্তি পালনের একটি সরল মানে হচ্ছে সূর্য সহ সকল গ্রহনক্ষত্রের  সঙ্গে জীব, বিশেষত মানুষের জীবন চক্রের সম্বন্ধ জীবন্ত রাখা। একে কেন্দ্র করেন নানান সংস্কার, আচার এবং খাঁদ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার খুবই এখন আমামদের স্মৃতি কিম্বা চর্চায় অবশিষ্ট আছে। । গড়ে উঠেছে কারন এই গভীর উপলব্ধি আমাদের অতি প্রাচীন যে মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা কোন সত্তা না। যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। কিম্বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা আছে তামানুষের মধ্যেও বিরাজ করে। অতএব মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা কোন রহস্য না, বৈশ্বিক প্রাণচক্রের অন্তর্গত মুহূর্ত।

বাংলার ভক্তি ও ভাবান্দোলনের ধারায় এই সম্বন্ধ চর্চা খুবই গোড়ার জিনিস। পৌষ সংক্রান্তি ছাড়াও একালে বড় বাংলায় পাশ্চাত্যের অনুকরণে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের চল হওয়ায় পাশাপাশি  চৈত্র সংক্রান্তি পালনের রেওয়াজ বেড়েছে। তবে ইতিহাস বলে পৌষসংক্রান্তি  বড় বাংলার বড় উৎসব হিশাবে পালিত হয়ে আসছে। ফসল চক্রের নিয়মে অগ্রহায়ণের শুরুতে সূচনা হওয়া ‘নবান্ন’ উৎসবও মকর সংক্রান্তিতে পরিপূর্ণ হোলো।

এটা পরিষ্কার যে আধুনিক পাশ্চাত্যে মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিচ্ছিন এবং  স্বাধীনসত্ত্বা গণ্য করে যে মানুষ-সর্বস্ব ও মানুষ কেন্দ্রিক (anthopocentric) চিন্তাপদ্ধতি ও কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছে, বাংলার ভক্তি ও ভাবচর্চার বিপরীত। বাংলার ভাবচর্চার গোড়ায় রয়েছে ভাণ্ড ও  বিশ্বব্রহ্মাণ্ড  একে অন্যের পরিপূরক। পশ্চিমা আধুনিকতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করেছে।  

অতএব সংক্রান্তির গুরুত্ব ব্যাপক, তার মধ্যে মকরসংক্রান্তির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। পৌষ মাসের শেষদিন থেকে শুরু হয় উত্তরায়ণ। সৌরসময়ের এই বিশেষ দিনে নতুন ফসল ও তার সঙ্গে সমষ্টিবাচক মানুষের সম্বন্ধ চরচার নিরীখে পৌষ সংক্রান্তি হয়ে ওঠে আনন্দনঘন। অগ্রহায়ণ মাসের সূচনালগ্নে বঙ্গে যে নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়ে থাকে মকর সংক্রান্তির দিন নতুন শস্য পরমের কাছে নিবেদনের শক্তিশালি লৌকিক রীতি রাংলায় রয়েছে, তবে সেই উৎসব আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

অগ্রহায়ণ মাসের সূচনায় বঙ্গে  টুসুকে নিয়ে গানবাদ্যে যে পরবের সূচনা হয়, সেই উৎসব পূর্ণ হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। এই দিন খেঁজুরের নতুন গুড় আর নতুন চালের গুঁড়ায় পিঠাপুলি আর পাইয়েস আত্মীয়-পরিজন আর প্রতিবেশীদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়। যার মাধ্যমে পৌষ সংক্রান্তি  আত্ম ও অপরের এক হয়ে ওঠার দিন। এই দিন আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে নতুন শস্যের আনন্দে মেতে ওঠার উৎসব পালনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

প্রকৃতিনিবিড় শস্যশ্যামল বাংলায় সময় ও সত্ত্বার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে দার্শনিক চর্চা বহমান, পুরুষ ও প্রকৃতির একত্বে পরমকে আত্মের নিগূঢ়ে খূঁজে পাওয়ার যে লীলাভাব পৌষ সংক্রান্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। এই দিনেই সুন্দরবন সংল্গন সাগর এলাকায় বাংলার আদি দার্শনিক কপিল মুনির আশ্রমে শুরু হয় গঙ্গাসাগর মেলা। এই সেই কপিল মুনি যিনি সাংখ্যদর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতির অভিন্নতার অভিসন্দর্ভ রচনা করে গেছেন।

বঙ্গের ভাবনায় প্রকৃতি, পরিবেশ, সময় , সত্ত্বা ও পরম যে একুই সূত্রে বাঁধা তা বাংলার শস্যযাপনের উৎসব নবান্ন, মকর সংক্রান্তি কিংবা চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নক্ষত্রের অবস্থান, আলো-ছায়া, দিনের দৈর্ঘ্যর কমাবাড়া ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত ঋতুচক্রের সঙ্গে ফসল উৎপাদন ও তা ঘরে তোলার মতো বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে জৈবসত্ত্বা। এই জৈবসত্ত্বা নিজের তার মূর্ত ইন্দ্রিয়চেতনার ভিতরে বিমূর্ত পরমের নিকট নিবেদন করে পরমান্ন।

কিন্তু হায়, আমরা এসব কিছু থেকেই বিস্মৃত আজ। আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি ও পশ্চিমা বাজার সংস্কৃতির কারণে, ভোগবাদ আর বাজারবাদে, ভুবনায়ণে আমরা শস্য, সময় ও সত্ত্বার সম্পর্কটি ছিন্ন করে ফেলেছি হয়তো-বা নিজেরই অজান্তে। যেভাবে নাড়ি ছিন্ন হয়ে গেছি আমরা আধুনিক বাজারতাড়িত বৈশ্বিক লগ্নিপুঁজির বঙ্গীয় দাসানুদাস। এমনকি আমরা টের পাইনি আমাদের নাড়িচ্ছেদের যন্ত্রাণাকেও।

তবুও স্বপ্ন দেখি, কেননা, রাসায়নিক সার আর বহুজাতি গ্লোবাল পুঁজির গুদাম আমাদের শস্যভাণ্ডারকে যতই কুক্ষিগত করার চেষ্টা করুক না কেন, বীজ কোথাও সংরক্ষিত রয়েছে। কোথাও কোথাও নবান্ন আর মকর সংক্রান্তির চালে আজও মিশতে পারেনি বিষ। কেউ কেউ আগলে রাখছে বাংলার মায়াশস্যকে। কোথাও প্রতিরোধ চলছে গায়েবি-সাম্রাজ্যবাদের, নয়া উদারনৈতিক ঔপনিবেশিকতার, জাতিবাদের। গোষ্ঠের গান হচ্ছে প্রতিটি ভোরে আখড়ায় আখড়ায়। টুসুর গানে সবুজ চারাগাছ, সোনালী শস্য আর রাধাভাবে পরমের গান ধরেছে এই মকর সংক্রান্তিতে ভূমিমানবীরা। আমরা বড় বাংলার ক্যানভাসে তাদের রূপবৈচিত্র্য ধারণ করছি আমরা নিরাকার পরমের জন্যে সকল জৈবসত্ত্বার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি পিঠাপুলি, পায়েস। আহা পরমান্ন!



Share