সংসার

ছোটগল্প

।। ফাতেমা রিয়া।।

সারা শরীর ব্যথা। কিন্তু অনুভূতি শূন্য। রাতে সে খায়নি। প্রবল বেদনা তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার শুধু মনে আসে ছোটবেলায় আম কুড়ানোর কথা। অনেক বাতাস। ধুপ ধুপ করে আম পড়তো। একটা বড় আম রিনার মাথায় পড়লো। তখনও রিনার অনূভুতি অনেকটা শূন্য হয়ে যাচ্ছিল।

সংসার

কলিংবেল বাজছে। তীব্রতম শব্দ মাথায় গেঁথে যায়। রিনা ঘুম থেকে উঠলো। আর ভাল্লাগে না এসব। সকাল সকাল এসে বুয়ার কলিংবেল বাজানি। অবশ্য উপায়ও নাই। এই বুয়াকে সেই রেখেছে। তাকালো রাসেলের দিকে। সে মরার মতো ঘুমাচ্ছে। দুনিয়া উলটে গেলেও রাসেলের সকাল বেলার ঘুম ভাঙবে না। এমনিও ভাঙে না আজকাল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওড়নাটা মশারির মধ্যে থেকে খুজে নিয়ে দরজা খোলে।  

বুয়া বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে, ‘আফা এত দেরি করেন!’
রিনা জবাব দিল না, রান্নাঘরে গিয়ে থালাবাসন গুছিয়ে দিতে লাগলো।

রিনার বয়স ৩২। দেখতে গোলগাল, গায়ের রং ফর্সা। তার একটা ছেলে আছে দুই বছরের। নাম হল রায়ান। রায়ান তার রুমে ঘুমুচ্ছে। রিনার স্বামী রাসেল একজন ব্যাংকার। সে সোনালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। বিয়ে হলো চারবছর। অনেক কিছু পেরিয়ে রিনার এখনই ক্লান্তি লাগে।  
সে বুয়াকে বললো, ‘বারান্দায় কাপড়চোপড় আছে, ধুয়ে চলে যেও। আর ডাকবে না। দরজা ভেজিয়ে যাবে’।  
বুয়া থালাবাসন ধুইছিল। সে বললো, ‘আফা এই মাসের বেতন?’
‘কয় তারিখ আজ?’ রিনা ঘুম ঘুম স্বরে জিজ্ঞাসা করে।
‘আফা কইসিলাম না, মাইয়ার অসুখ, ডাক্তার দেহান লাগবো’।

রিনা বিরক্ত হয়। হাজার বাহানা এদের। কখনো এদের একমাস ঠিকঠাক শেষ হবে না। তার আগেই নানা সমস্যা। রাসেলকে এখন বলা যাবে না। তার অফিসে ঝামেলা চলছে। রিনা তো আয় রোজগার করে না। চাকরি ছেড়েছিল দুইবছর আগে। তার ওপরে বাজার খরচ যা আছে তা দিয়ে দিলে পোষাবে না।
সে বললো, ‘কাল পরশু দেখি, মাস শেষ হবার আগেই প্রতিমাসে ঘ্যান ঘ্যান করো কেন?’
বুয়া এবার নাকি কান্না শুরু করলো, ‘কই ঘ্যান ঘ্যান করলাম আফা? মাইয়াডার জ্বর..কাইল রাইতে…’
রিনা দ্রুত বললো, ‘থাক থাক। আমি দেখব নে।‘

রিনা এসে শুয়ে পড়লো। রাসেলের দিকে তাকালো। সে কখন উঠবে? আটটা বেজে গেছে। অনেক ক্লান্ত সময় যায় সে বুঝতে পারে। তবু সে ডাকলো, ‘এই ওঠো।‘
রাসেল নড়েচড়ে শোয়। রাসেল এখনো সুদর্শন। বিয়ের দিনের মতোই। লম্বা,চওড়া, ফরসা, জোড়া ভ্রু। শরীরের গঠন ও ইউনিভার্সিটির ছেলেদের মতো। রিনা নিজের দিকে তাকালো, কিভাবে সে ফুলে ঢোল হয়ে গেল! রাসেলের কাছে তো তাকে খালাম্মা লাগে। তার একটু মন খারাপ হয়। সে আবার ডাকে, ‘এই ওঠো’।

রিনাদের বাসাটা ছোটখাটো। দুইরুমের বাসা। ছোট একটা ডাইনিং। সেখানেই ছোট বেতের সোফা পাতা। দেওয়ালে সুচিত্রা সেনের পোট্রেট, পেইন্টিং। ছোট একটা ফুলদানি। একপাশে খাবার জন্য ছোট ফোল্ডিং টেবিল। রাসেল অবশ্য ভাবছে সামনের ইনক্রিমেন্ট পেলে বড় বাসা নেবে। ভালো ডাইনিং টেবিলও কিনবে।

রাসেল নাস্তা করছিল। রিনা পাশে দাঁড়িয়ে পানি ঢালতে ঢালতে আস্তে করে বললো, ‘কাজের বুয়ার বেতনটা দিয়ে যেও’।
রাসেল পরোটার মধ্যে ভাজি নিয়ে খেতে লাগলো, চুপচাপ।
রিনা আবার বললো, শুনেছ?
‘কী শুনবো আবার। সারাদিন তো বাসায় থাকো।কাজের বুয়া রাখার কী দরকার এত টাকা দিয়ে?’ রাসেল রেগে গেল।
রিনা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর বললো, ‘বাসার কাজ কতো রকম থাকে তুমি কী জানবে!’
‘না আমি কিছু জানি না।‘ রাসেল উঠে গেল খাবার ছেড়ে।
রিনা বললো, ‘খাবার রেখে উঠলে কেন?’

রাসেল চোখ গরম করে ফিরে এলো, একদম চুপ। আমার জীবনটা তোমরা মিলে শেষ করে দিয়েছ। তোমার এই চাহিদা, ওই চাহিদা।দেখো সংসারটা নিয়ে কত খাটছি, তোমার নবাবিপনা যাবে না।‘
রিনা বললো, ‘আমি তোমাকে কি এমন বলেছি যে তুমি চেঁচাচ্ছ?
রাসেল আরো জোরে চিৎকার করলো, ‘কই চেঁচাচ্ছি আমি? কতো করে বলেছি বুয়াকে বাদ দিয়ে দিতে। শুনেছ তুমি?
‘রাসেল তুমি জানো আমার নিউমোনিয়ার সমস্যা। আমি পানি বেশি ছানতে পারি না’। তাই বুয়াকে রেখেছি।
‘তোমার হাজারটা সমস্যা, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার সমস্যা থাকতে নেই।‘
রিনা চুপ করে অন্য রুমে চলে গেল। রায়ান কান্নাকাটি করছে ঘুম থেকে উঠে।

রাসেল অফিসে না খেয়েই চলে গেল। রিনা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। রায়ান এসে পাশে পাশে ঘেঁষছে আর বলছে, ‘মাম খাবো।‘
‘সরো এখান থেকে। টেবিলে রাখা আছে, নিয়ে খাও’।
রায়ান চুপ করে সরে টেবিলে রাখা পানির বোতল নিয়ে রুমে চলে গেল। সেখানে টিভিতে কার্টুন চলছে। রিনার খেয়াল হলো রায়ানকে খাওয়ানো হয়নি সকালে। সে রায়ানের জন্য দুধ গরম করতে গেল। সুজি বের করে দুধে ঢাললো। কমিয়ে দিলো।

তার মনে আসলো বিয়ের দিনের কথা। রিনা রাসেলকে চিনতো না আগে থেকে। বাবা সব ঠিক করে বিয়ে দিয়েছিলেন। রিনার প্রেম ছিল তার ক্যাম্পাসের ক্লাসমেটের সাথে। বিয়ের আগের দিনও সে লুকিয়ে দেখা করে এসেছিল তানভীরের সাথে। তানভীরের কোনো বিকার ছিল না। সে পার্কে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেছিল, ‘ভাল ছেলে পেয়েছ যখন, বিয়ে করে ফেলাই ভালো।‘
রিনা ব্যথিত স্বরে বললো, ‘চেষ্টাও করলে না!’
‘কী চেষ্টা করবো?’ তানভীর হেসে বললো, তোমার বাবাকে বলো ১০ লাখ টাকা দিতে, বিয়েও হলো ব্যবসা হলো’
রিনা রেগে গেছিল এই প্রস্তাবটা শুনে, ‘তাহলে প্রেম করেছ কেন?’
তানভীর গম্ভীর হয়ে বললো, ‘তুমি করেছ কেন? একটা বছর অপেক্ষা করতে পারছো না!’
রিনা বললো, ‘তোমাকে আমি আগে থেকেই বলছি’।
‘এসব ছাড়ো। তানভীর উঠলো।
‘কই যাচ্ছ?
‘তুমি আর জিজ্ঞাসা করবে না কোথায় যাচ্ছি’। তানভীর অনেকটা রাগ নিয়েই চলে গেল। রিনা সেদিনো স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। শুনেছে তানভীর আর বিয়ে করে নি, বিদেশে চলে গেছে। ফেসবুকে রিকুয়েষ্ট দিয়েছিল কয়দিন আগে। রিনা ব্লক করে দিয়েছে।

সুজি উথলে উঠলো, রিনার জ্ঞান ফিরে এলো। সে তাড়াতাড়ি সুজির পাতিল চুলা থেকে নামালো, তারপর রায়ানকে ডাকলো।রায়ান আসছে না। সে বাটিতে ঢাললো সুজি। তারপর এগোলো রায়ানের রুমের দিকে।
রিনার আজকে রান্না করতে ভাল লাগছে না। সে ভাত চড়িয়ে আলু সিদ্ধ দিল। ডিম সিদ্ধ দিল। রাসেল এসে রাগ করবে, করুক। এমনিও সে খারাপ ব্যবহার করে। রায়ানকে খাওয়ানো হয়েছে। সে রুমে বসে কার্টুন দেখছে। রিনা রায়ানের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। রায়ানের রুমটা ছোটখাট, তবে ভাল করেই সাজিয়েছে রিনা। টিভিটা রায়ানের রুমেই রাখা হয়েছে। রায়ানের জন্য ছোট সিংগল খাট, তার ওপরে অনেক খেলনা। একপাশে রাখা তার সাইকেল। রায়ান এখনো ঠিকঠাক কথা বলতে পারে না। সে রায়ানকে জড়িয়ে ধরলো। রায়ান অবশ্য বিরক্ত হলো বোধহয়, বললো, ‘উম্ম ছালো’।

তার কার্টুন দেখায় ব্যাঘাত ঘটছে। রিনা তাকে ছেড়ে দিল। রায়ানের পাশে শুয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো দূরে।
রাসেল বাসরঘরে এসে প্রথম কিছুক্ষণ কথা বলে নি। চুপচাপ বসে ছিল। তারপর বললো, ‘কেমন আছেন?’
‘জ্বী ভালো। রাসেল একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনার কি ঘুম পেয়েছে? তাহলে ঘুমান’।‘
রিনা শুয়ে পড়লো বাক্যবায় না করে। সে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। রাসেল নাকি সেদিন রাতে ব্যথিত হয়েছিল। সে পরে বলেছে।

সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে রাসেল নেই। সারাদিনই খবর পাওয়া গেল না। সে বন্ধুদের সাথে কোথায় যেন গেছে। রিনার দিন কাটলো শ্বশুড়বাড়ির ব্যস্ততায় আর নতুন অতিথিদের আপ্যায়ন করে। রাসেল ফিরলো রাত ১১ টায়। খুব ক্লান্ত তখন। রিনার তখনো লজ্জা ভাঙে নি। সে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।

রাসেল বাসার ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রিনা খেয়াল করলো, মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছে। রাসেল রুমে আসলো রাত ১২ টায়। রিনা তখন শুয়ে পড়েছে। রাসেলকে দেখে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠে বসলো।

রাসেল হুট করেই বললো, ‘তোমার হাত ধরতে চাই’।
রিনার খুব রাগ হলো প্রথমে। তারপর মনে হলো, এ তো তার স্বামী। চাইতেই পারেো।
তারপর হাত বাড়িয়ে দিল।
সেদিন রাতেই আদর সোহাগ, লজ্জা ভাঙাভাঙি। সে রাসেল আজ কী হয়ে গেল..

‘আম্মো’ রায়ানের ডাকে ঘোর ভাঙলো রিনার।
-বলো বাবা।
– হাগু কব্বো।
রায়ানকে বাথরুমে নিতে হবে। রিনা উঠলো।

ভাত উথলেছে, রিনা রান্নাঘরে গেল। ডিমের খোসা ছাড়িয়ে তেলমসলায় চুবিয়ে দিল। পেয়াজ কেটে রাখলো। আর কাজ নেই আপাতত। রায়ানকে গোসল করাতে হবে গরম পানি দিয়ে।

রাসেল ওলটপালট হলো রায়ান পেটে থাকার সময়। শরীরকে শরীর চাইত, পেয়ে উঠতো না। রিনা অসুস্থ, সারাদিন বমি করে। রাসেল দৌড়োয় অফিসের কাজে। রিনার মা এসে ছিলেন তখন রিনার সাথে।
রাতের বেলা রাসেল তার শরীরে হাত দিত। সে চিৎকার করে উঠতো।
রাসেল চাপা স্বরে বলতো,’চুপ। আম্মা শুনবে’।
‘শুনলে কী হবে? তুমি তো একটা জানোয়ারের পর্যায়েও পড়ো না। এই অবস্থায় আমার গায়ে হাত দাও তুমি..’
রাসেল স্তম্ভিত হয়ে পাশ ফিরে শুলো। হয়তো আর ফিরলো না।
রিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এরপর সে মাঝে মাঝেই খবর পেত রাসেলকে অন্য মেয়ের সাথে দেখা যায়। রিনা কিছু বলে না। সন্তান জন্মদান, সংসারের ক্লান্তি, বন্দীজীবনে সে বুড়িয়ে গেছে। এখন এসব কাজ করে না। রায়ানের চিৎকার শোনা যায়।

রিনা ছুটে যায় রায়ানের রুমে। তেমন কিছু না। একটা দাড়কাক এসে বসেছে জানালায়। রায়ান কাক ভয় পায়। মায়ের মুখে শুনেছে ছোটবেলায় রিনাও কাক ভয় পেত।
কতো রহস্যময় সবকিছু। অথচ রাসেলের সাথে তার ভালোবাসা যেন হয়েও হয়ে উঠলো না। তার অভিমান হয়।
তানভীর আজো বিয়ে করে নি। রিনার মনে হয়, হয়ত তার বিরহেই করে নি। রাসেল সামান্য প্রেগন্যান্সির কয়টা মাস সহ্য কর‍তে পারলো না।।

সে রায়ানের ওপর রেগে যায়। ‘কাক দেখে এত চিৎকার করার কি আছে? কাক কিছু করবে না।
রায়ান মুখ গোমড়া করে থাকে। রিনা তাকে কোলে তুলে নেয়।
বলে, গোসল করবে এখন।
রায়ান কান্না শুরু করে, না না।
‘চুপ, একদম চুপ।
রায়ানের কান্না থামে না, রিনার ধমক ও না।

রায়ানকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে ঘুম পাড়ায় রিনা। নিজেও গোসল করে। গোসলের সময় পেটের কাটা দাগটা নজরে পড়ে। সিজারের দাগ। শুকিয়ে গেছে। তবে ক্ষত রয়ে গেছে। এখনো ভারী কিছু তুলতে পারে না, ভারী কাজ করতে পারে না। রিনা আর কখনো শুকোতেও পারবে না। মেদ এসে সব ওলোট পালোট করে দিচ্ছে। রাসেল কেন ই বা ভালোবাসবে তাকে। রিনার যন্ত্রণা লাগে। সে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

বাথরুম থেকে বের হয়, তার শীত লাগে। জ্বর এসেছে মনে হয়। শরীর ভাল করে মুছে বিছানায় গিয়ে কম্বল মুড়ি দেয় রিনা। জানালা থেকে নরম রোদের আলো আসে তার মুখে। ভাল লাগছে। ফোনটা হাতে নেয়। আজ সারাদিন ফেসবুকে ঢোকা হলো না। মেসেজ এসেছে বেশ কয়েকটা। রেবেকা ভাবী দি্লেন, রাসেলও দিয়েছে। রাসেল একটা লিংক শেয়ার করেছে মনে হয়। সে খুললো না। মেসেজ রিকুয়েস্ট বক্স চেক করলো।

অর্ফিয়াস নামক এক ফেক আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। রিনা খুললো।
‘জানি না কেমন আছো। পরশুদিন ইস্টার্ন প্লাজায় দেখলাম তোমাকে। খুব মুটিয়ে গেছো। অবশ্য চোখে ক্লান্তি ও দেখলাম। আমি বাংলাদেশে এসেছি। থাকব কয়েক মাস, বিয়ে করে ফিরে যাব।’ -তানভীর

রিনা মেসেজ পড়ে থ হয়ে রইলো কতক্ষণ, তানভীর তাহলে বিয়ে করছে শেষমেশ। রিনার মধ্যে একটা অপরাধবোধ ছিল, একটা অহংকার ও ছিল। আজ সবি চলে গেল মনে হয়। সে লিখবে না, লিখবে না করেও লিখলো, বাহ, ভালো। শুভকামনা।

মেসেজ সিন হল। উত্তর এলো না। রিনা ফোন রেখে শুয়ে পড়লো। একসময় সবকিছু কেমন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। এই তানভীর যেন অন্য মেয়ের দিকে না তাকায় সেজন্যও সে কত সাবধানবাণী দিত, আজ তানভীর বিয়ের খবর জানাচ্ছে। রিনারও কিছু বলার নেই। কিছু বলতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। রাসেলকেও কিছু বলতে ইচ্ছা হয় না। জীবনটা বড় বিষন্ন লাগে। সে ফোন হাতে নিলো আবার, রেবেকা ভাবীর মেসেজ খুললো। ভাবী একটা শাড়ির পেজের লিংক দিয়েছে। নতুন শাড়ির ব্যবসা শুরু করেছে মনে হয়, অনলাইনে। সেও কিছু করবে কিনা ভাবলো। রাসেলের বকাবকি আর ভাল লাগে না শুনতে। রিনা ভেবে দেখলো টাকা নিয়েই বেশি ঝামেলা হচ্ছে তাদের। রাসেল খরচটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না নাকি দিতে চায় না তাও সে বোঝে না।

রিনার ঘুম ভাঙলো কলিংবেলের আওয়াজে। সন্ধ্যা নেমেছে। সে দ্রুত দরজা খুললো। রাসেল বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘এত সময় লাগল কেন?
রিনা উত্তর দিলো না। সে দরজা থেকে সরে দাড়ালো। রান্নাঘরে গিয়ে রাসেলের জন্য পানি গরম দিল। এখন রাসেল গোসল করবে। তারপর খাবে।
সে তরকারিও গরম করলো। দুপুরে সেও খায় নি।

রাসেল বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। সে পানি দিয়ে এলো। এসে ভাত বাড়লো। খুব ক্লান্ত লাগছে। রাসেলের মেজাজ গরম মনে হল। ্কী জানি খাবার সময়ও যদি আবার রাগারাগি শুরু করে। সে জানে রাসেলের অফিসে ঝামেলা চলছে। ৫ লাখ টাকার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। রাসেল ক্যাশিয়ার হিসেবে আছে। কিভাবে হিসাব লোপাট হয়েছে সে অবশ্যই জানে। রিনা রাসেলকে ভালমতই চেনে। সে খুব ঠান্ডা মাথায় বড় কিছু করে ফেলতে পারে। অবশ্য সে তুলনায় তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল থাকার কথা। তবে রাসেল ভীতু। রাসেল বাথরুম থেকে বের হয়ে সোজা টেবিলের দিকে আসলো। রিনা বসে আছে সেখানেই। তরকারী দেখে রাসেল বলল, অন্য কিছু ছিল না?
– ছিলো।
– তবে রান্না করোনি কেন?এমনি। কেন এসব খারাপ কি?

রাসেল ভাতের প্লেট তুলে রিনার মুখে ছুড়ে মারলো। তারপর বললো, খারাপ না তো তুই খা বেশ্যা মাগী।

রিনা স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে টেবিল ছেড়ে উঠতে গেল। রাসেল রিনার চুলের মুঠি ধরে বললো, ‘কই যাস? শুয়োরের বাচ্চা। নাটক করিস আমার সাথে?’

রিনা কাঁদতে শুরু করলো। রাসেল মুখ চেপে ধরলো। তারপর চুল ধরে মাথা চেপে ধরলো টেবিলে।
– কুত্তার বাচ্চা, আমার খাস৷ আমার পড়িস৷ আর ভালমত রানতে তোর আইলসামি?

রিনার মনে হল তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে কিছু বলতে পারছে না। শুধু হাপাচ্ছে। এরমধ্যে রায়ানের চিৎকার শোনা গেল। সে মনে হয় এসে দাড়িয়েছে।

রাসেল তাকে মেঝেতে ফেলে দিল, তারপর লাথি দিল তলপেটে। রিনা তলপেট চেপে ধরে গোঙাতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে মরে যাবে। শরীরে ছোট ছোট হাতের উপস্থিতি টের পেল। রায়ান তার ওপরে এসে ঝাপিয়ে পড়েছে। সে চিৎকার করছে।

‘ বাবা, আম্মোকে বেতা দিও না। বাবা’
রাসেল মনে হয় থামলো। সে বেডরুমে গিয়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে ফেললো।
রিনা শুয়ে রইলো মেঝেতে। তার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। রায়ান তার বুকের ওপর পড়ে রইলো। একটু পর পর শুধু বলছে, আম্মো, আম্মো।
রিনা উত্তর দেয় না। তার চোখ বেয়ে শুধু পানি পড়ে।

রাত।

রিনা শুয়ে আছে রায়ানের রুমে। বাইরে জোছনা। বিশাল চাঁদ উঠেছে। হালকা বাতাস ও আছে। এটা কী মাস সে মনে করতে পারে না। একটু ব্যথা লাগে তার। রায়ান তার বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে নড়ছে। রিনা রায়ানকে খুব সাবধানে একটু পাশে সরিয়ে দি্লো। রিনার সারা শরীর ব্যথা। কিন্তু অনুভূতি শূন্য। রাতে সে খায়নি। প্রবল বেদনা তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার শুধু মনে আসে ছোটবেলায় আম কুড়ানোর কথা। অনেক বাতাস। ধুপ ধুপ করে আম পড়তো। একটা বড় আম রিনার মাথায় পড়লো। তখনও রিনার অনূভুতি অনেকটা শূন্য হয়ে যাচ্ছিল। ফিরে আসে ব্যথা, অন্য রুপে।
রিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খুট করে শব্দ হয় দরজার কাছে। সে থমকে তাকায়। রাসেল এসেছে। সে কি চায় রিনা জানে।
রিনা চুপ করে থাকে। রাসেল আসে। তাকে ধরে। তারপর অনেকটা টেনেই নিয়ে যায় রুমে।
আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। রিনা মাঝে মাঝে ‘আহ’ করে ওঠে।
সেটা ব্যথায় না সুখে কে জানে!

রায়ান ঘুমের মধ্যে মাকে না পেয়ে কেঁদে ওঠে।

ফাতেমা রিয়া

তরুণ গল্পকার, উপন্যাসও লিখেছেন। দেশের বাড়ি বরিশাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন ও রাজনীতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

Share