শ্রীলঙ্কার দৃষ্টিকোণ থেকে রাবণ

।। মোহন গুরুস্বামী ।।

“অনেকে মনে করেন যে রামায়ণ হয়তো একটি কল্পনামিশ্রিত সত্যকাহিনী, যার কেন্দ্রে ছিলেন রাবণ নামক এক রাজা, যিনি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫৫৪ থেকে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫১৭ অবধি শ্রীলঙ্কা শাসন করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার লোকগাথা অনুযায়ী সেই রাবণ নামক দার্শনিক রাজার শাসনে শ্রীলঙ্কা বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করে। রাবণের পুষ্পকরথ সেই প্রাচীন শ্রীলঙ্কার বৈজ্ঞানিক প্রগতীর একটি নিদর্শন। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার উপকথা অনুযায়ী রাবণ ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং আজও ওনার নামে আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ৭টি গ্রন্থ আছে। অনেকে এও বিশ্বাস করেন যে রাবণ ‘রাবণসংহিতা’ নামক এক প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থেরও রচয়িতা। রাবণের উপাধি ‘দশানন’ বা ‘দশগ্রীব’ তাঁর বিবিধ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের সাক্ষ্য বহন করে।”

শ্রীলঙ্কার দৃষ্টিকোণ থেকে রাবণ

।। অনুবাদ: সায়ন সেন ।।

বেশ কিছু সনাতনী শাস্ত্র মতে মহাবলী রাবণের বিচরণক্ষেত্র ছিল আজকের শ্রীলঙ্কা নামক দ্বীপরাষ্ট্র, যেখান থেকে উনি শাসন করতেন সমগ্র জগতের নর, দেব ও দানবদের উপর। বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে রাবণকে চিত্রায়িত করেন এক প্রভূত শক্তিশালী স্বৈরাচারীরূপে, যাঁর অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, এবং বাল্মীকির সেই চরিত্রচিত্রনের ফলে আজও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাবণ এক অশুভ শক্তির প্রতিমূর্তি।  বাল্মীকির লেখনীতে রাবণ মূলত একজন প্রতিহিংসাপরায়ণ রাক্ষস, যিনি লক্ষ্মণ দ্বারা নিজ ভগ্নী শূর্পণখার নাসিকাছেদনের প্রতিশোধ নিতে রামের পত্নী সীতাকে অপহরণ করেন।

কিন্তু শ্রীলঙ্কাতে রাবণের চরিত্রায়ন করা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে- একজন রাজা ও একজন মানুষ রূপে। শ্রীলঙ্কার আখ্যানে রাবণ একজন মহান শৈবসাধক, মহাপন্ডিত, সুশাসক এবং রাবণহট্ট নামক এক বিশেষ বীণারূপী বাদ্যযন্ত্রের স্রষ্টা। শ্রীলঙ্কার উপকথা অনুসারে রাবণ তাঁর জননীকে তুষ্ট করার জন্য কৈলাশ পর্বতকে শ্রীলঙ্কাতে আনতে মনস্থ করেন। মহাবলী রাবণ যখন বিরাট কৈলাশ পর্বতকে ভূমি থেকে তোলার প্রচেষ্টা করেন, তখন শিব অন্ত্যন্ত রুষ্ট হন এবং নিজের পায়ে চাপ দিয়ে কৈলাশ পর্বতকে রক্ষা করেন।  এর ফলে রাবণ কৈলাশ পর্বতের নীচে চাপা পড়েন। কিন্তু সেই অবস্থাতেই মহান শৈবসাধক রাবণ নিজের হাতের ধমনী ছিঁড়ে রাবণহট্ট নামক এক বিশেষ বীণারূপী বাদ্যযন্ত্রের নির্মাণ করেন এবং সেই বাদ্যযন্ত্র সহযোগে স্বরচিত শিবপ্রশস্তি গাইতে থাকেন। রাবণের ভক্তিতে ও সংগীতে মুগ্ধ শিব রাবণকে ক্ষমা করেন ও তাঁকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন।

শ্রীলঙ্কার উপকথা অনুযায়ী রাবণের রাজত্ব মূলত আধুনিক শ্রীলঙ্কার পূর্ব ও দক্ষিণ অবধি বিস্তৃত ছিল এবং পরবর্তীকালে তা সমুদ্রের গর্ভে চলে যায়। শ্রীলঙ্কার কিছু কিছু পণ্ডিত আরো বিশ্বাস করেন যে রাবণ ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা, যিনি  শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ যথা কুরাগালা ও রাহালগালা নির্মাণ করেন।

পৌরাণিক মতে রাবণের পিতা ছিলেন মহর্ষি বিশ্রবা এবং রাবণের মাতা ছিলেন রাজকুমারী কৈকেশী। দেবগণে রাবণের জন্ম, কারণ তাঁর পিতামহ পুলস্ত্য ছিলেন দশ প্রজাপতিদের (ব্রহ্মার মানসপুত্র) মধ্যে এবং মনুযুগের সপ্তর্ষিদের মধ্যে অন্যতম। রাবণের ভ্রাতা ছিলেন বিভীষণ, কুম্ভকর্ণ এবং অহিরাবণ। রাবণের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ছিলেন কুবের, যাঁকে পরাস্ত করে রাবণ লঙ্কারাজ্য জয় করেন।

লঙ্কা ছিল এক অতি মনোরম নগর, যাঁর নির্মাণ করেছিলেন দেবস্থপতি বিশ্বকর্মা। এই লঙ্কাতেই শাসন করতেন সম্পদের দেবতা কুবের, যাঁর কাছ থেকে রাবণ বলপূর্বক লঙ্কা অধিকার করেন। যদিও রাবণ বলপূর্বক লঙ্কাজয় করেন, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ ও প্রজাবৎসল শাসক। রাবণের শাসনে লঙ্কার প্রভূত উন্নয়ণ হয়, এবং লঙ্কা থেকেই রাবণ জগতের নর, দেব ও দানবের উপর প্রভুত্ব কায়েম করেন।

লঙ্কাপুরী

কথিত আছে যে রামায়ণের ঘটনাক্রমের পূর্বে রাবণ বহু শতাব্দী ধরে লঙ্কাশাসন করেন এবং রামের হাতে তাঁর হত্যার মাধ্যমে সেই যুগের অবসান ঘটে। কিন্তু অনেকে মনে করেন যে রামায়ণ হয়তো একটি কল্পনামিশ্রিত সত্যকাহিনী, যার কেন্দ্রে ছিলেন রাবণ নামক এক রাজা, যিনি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫৫৪ থেকে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫১৭ অবধি শ্রীলঙ্কা শাসন করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার লোকগাথা অনুযায়ী সেই রাবণ নামক দার্শনিক রাজার শাসনে শ্রীলঙ্কা বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করে। রাবণের পুষ্পকরথ সেই প্রাচীন শ্রীলঙ্কার বৈজ্ঞানিক প্রগতীর একটি নিদর্শন। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার উপকথা অনুযায়ী রাবণ ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং আজও ওনার নামে আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ৭টি গ্রন্থ আছে। অনেকে এও বিশ্বাস করেন যে রাবণ ‘রাবণসংহিতা’ নামক এক প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থেরও রচয়িতা। রাবণের উপাধি ‘দশানন’ বা ‘দশগ্রীব’ তাঁর বিবিধ বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যের সাক্ষ্য বহন করে।

শ্রীলঙ্কার উপকথা অনুযায়ী রাবণের রাজত্ব মূলত আধুনিক শ্রীলঙ্কার পূর্ব ও দক্ষিণ অবধি বিস্তৃত ছিল এবং পরবর্তীকালে তা সমুদ্রের গর্ভে চলে যায়। শ্রীলঙ্কার কিছু কিছু পণ্ডিত আরো বিশ্বাস করেন যে রাবণ ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা, যিনি  শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ যথা কুরাগালা ও রাহালগালা নির্মাণ করেন।

বর্তমান শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে রাবণের উপকথা। যেমন শ্রীলঙ্কার সীতা-এলিসা নামক স্থানটি লোকগাথায় প্রচলিত সীতার কারাগার রূপে। আবার শ্রীলঙ্কার ওয়ারিয়াপলা ও হর্টন সমতল লোকমুখে প্রচলিত রাবণের পুষ্পক বিমানেরr অবতরণক্ষেত্র রূপে। দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার সাগরতটে অবস্থিত রুমাসসালা পর্বতটিও রাম-রাবণের যুদ্ধের সাথে জড়িত এবং বিশ্বাস করা হয় যে সেটি হিমালয়ের অংশ। শ্রীলঙ্কার মানুষের বিশ্বাস যে এই পর্বতটি সেই রামায়ণের গন্ধমাদন পর্বত যা রাম-রাবণের যুদ্ধে আহতদের শুশ্রূষা করার জন্য সুদূর হিমালয় থেকে আনা হয়েছিল এবং এই পর্বত আজও দুর্লভ ভেষজের জন্য প্রসিদ্ধ।

আদম সেতু, চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত একটি সেতু, যা তামিলনাড়ুর দক্ষিণপূর্ব উপকূলের রামেশ্বরম দ্বীপের সাথে শ্রীলঙ্কার উত্তরপশ্চিম উপকূলের মান্নার দ্বীপকে যুক্ত করে, তাও রাবণের উপকথার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে এই সেতুই সেই রামসেতু, যা রামের বানরসেনা নির্মাণ করেছিল সমুদ্রের উপর দিয়ে, রামের লঙ্কা আক্রমণের জন্য। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং এজেন্সির গবেষণা জানাচ্ছে যে এই সেতুটির বয়স আনুমানিক ৩৫০০ বছর থেকে আনুমানিক ৫০০০ বছরের মধ্যে, এবং এই সেতুটি সম্ভবত মানবনির্মিত।

কিন্তু শ্রীলঙ্কার পন্ডিতদের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই সেতু রামের বানরসেনার নির্মিত নয়, বরং এই সেতুর নির্মাতা স্বয়ং লঙ্কেশ্বর রাবণ, যিনি এই ভাসমান সেতুর দ্বারা শ্রীলঙ্কাকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার পন্ডিতদের মতে রাম ও তাঁর সেনা এই সেতু ব্যবহার করেই শ্রীলঙ্কা  আক্রমণ করেন এবং রাবণের সহোদর বিভীষণের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসকের অত্যন্ত উন্নত শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেন।

মোহন গুরুস্বামী

মোহন গুরুস্বামী ভারতে ‘পাবলিক পলিসি’ বিষয়ের একজন পথিকৃৎ। ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের প্রাক্তন মুখ্য উপদেষ্টা। বর্তমানে “সেন্টার ফর পলিসি অল্টার্নেটিভস” নামক একটি সর্বভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্কের অধ্যক্ষ।

সায়ন সেন

বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত। কর্মক্ষেত্রর বাইরে ওনার আগ্রহের বিষয় যথাক্রমে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মার্কেটিং।

Share