শীতকালীন অক্ষর শব্দ ও বাক্যরা

গদ্যসাহিত্য

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

ছোটবেলায় আমরা চাচাতো ভাই বোনরা কোনো শীতের ছুটিতে এক হলে আমার দাদী গায়ে কাঁথা পেঁচিয়ে খমক আর কাঠের কী আরেক বাদ্যযন্ত্র জাতীয় জিনিস হাতে বড় একটা ঝাঁকায় কী কী সব মাখানো একগাদা মুড়ি নিয়ে গল্প শোনাতে বসতেন। হাবিজাবি সব গল্প। মাধব মালঞ্চী কইন্যা। কাঞ্চন বাদশা। চান সওদাগর। কিন্তু আমরা শিশুরা সবাই সেইসব ‘শুনো শুনো সাত গো ভাইসাব, শুনো কই তুমরারে, ভিন দেশী গুলামের পুতে জাতি মারলো আমার রে, আমার ঐ তনু আল্লারে’ বা ‘অগ্নিবান দানবগণ যখনই আইলো, মুরশিদ মুরশিদ বইলা সেলামো জানাইলো’ কথাবার্তার কিছুই না বুঝলেও খুব মন দিয়ে শুনতাম। দাদীর গা থেকে জবাকুসুম তেলের অশরীরী গন্ধ আসতো…

শীতকালীন অক্ষর শব্দ ও বাক্যরা

গত বছর ডিসেম্বরে আমার এক সুইস পেলিওবায়োলজিস্ট বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা বন্ধুরা তিন দিনের জন্য জেরমাতে গিয়েছিলাম। সুইটযারল্যান্ড তখনো করোনাকালীন লকডাউন ও মাস্কউৎসব উদযাপনে ব্যস্ত, তবে জেরমাত-সহ আরও বেশ কিছু স্কি রিসোর্ট বিশেষ বিবেচনায় তখনো পারশিয়ালি খোলা। আমি অবশ্য স্কি করতে জেরমাত যাইনি, আমার এক ঠ্যাং এ প্লাস্টার করা, তার কিছুদিন আগে আমি অতি জ্ঞান ও অতি বুদ্ধি ও অতি প্রজ্ঞায় বাসার সামনে ব্ল্যাক আইসে আছাড় খেয়ে পপাৎধরণীতলীয় মূহুর্তে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। জেরমাতে যাওয়ার পেছনে আমার কন্সপিরেসি থিওরি চালিত ব্রেইনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো এই কোভিডনাইন্টিন নাটক থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে পাহাড়ের মাথায় বসে গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কাঠ পোড়ার চ্যাড়চ্যাড়চ্যাড়চ্যাড় জাতীয় শব্দ শুনতে শুনতে জানালায় তুষার ঝড় দেখতে দেখতে ব্রান্ডি মেশানো হট চকলেটের কাপে চুমুক দিতে দিতে শীত উদযাপন করা।

বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও আমি বরাবর খুব রোমান্টিক প্রাণী।

মানুষ বলেন মন আর শরীর মিলিয়ে মানুষের দ্বৈতসত্তা কাজ করে। আমি যদিও শরীরকে উপলব্ধি করার মন, আর মন এবং শরীর দুইকেই উপলব্ধি করা তৃতীয় সত্তার কনস্টান্ট তর্ক টের পাই মাথার ভেতরে এবং বাইরে। আমার এইসব সত্তাদের একজন আগুন জ্বালিয়ে কাঠ পুড়িয়ে পৃথিবীর কার্বন ফুট প্রিন্ট বাড়ানোর বিরোধিতা করেন, অন্য অংশ আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসা আমার দুই মিলিয়ন বছর পুরানো এ্যানসেস্টরদের ভূতদের বলা ভূতের গল্প শুনতে শুনতে ভয় পেতে চান, আর আরেক অংশ লজিক বনাম ইমোশনের বাইনারি থিসিস এবং এ্যান্টিথিসিসের বাইরে বের হয়ে শরীর আর মনের এই তর্কের রহস্য সমাধান করতে করতে ভাবেন, এই তিন সত্তার উপস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য তাহলে চার নাম্বার সত্তার উপস্থিতি আছে কিনা? আর তাহলে চার নাম্বার সত্তার উপস্থিতি কে উপলব্ধি করেন? ভাবেন, ইনফিনিটির সংজ্ঞা কি তাহলে এখান থেকেই এসেছে?

রাস্তায় পড়ার জন্য আমি নামক আমি সাথে করে ‘লাক্সদায়েলা সাগা’ নিয়ে এসেছিলাম। বইটা ১৩ শতকে লেখা। ১৩ শতকে লেখা মানে ঐ সময় এটা লাক্সাদালার আইসল্যান্ডিক প্রাচীন মানুষদের মৌখিক সংস্কৃতির অংশ ছিলো, পরে ‘সাম্যবাদী’ গুটেনবার্গিয় প্রিন্ট মিডিয়া সেটাকে অক্ষর শব্দ-বাক্য নামের চিহ্ন দিয়ে বায়বীয় অর্থের অবায়বীয় টাকার বিনিময়ে বই নামক গাছ ধ্বংস করা কাগজে ছাপিয়ে বিক্রি করেছে। লাক্সদায়েলা সাগা সোজা বাংলায় প্রেমের উপন্যাস, কিন্তু ঠিক প্রেমের উপন্যাসও না। আমার বন্ধুরা মদ খেতে খেতে টাকা দিয়ে তিন তাস খেলছেন, আর আমি আমার শরীর দিয়ে সমুদ্রসীমার প্রায় আড়াই হাজার মিটার উপরে তুষারে ঢাকা আল্পস পর্বতমালার শীতল পেটের ভিতরে ঢোকানো কাঠের বাংলোর ঘুনে গর্ত করা বিছানার গভীরে ঢুকে মাথার ভিতরে ম্যাটারহর্নের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে বইয়ের ভিতরের চরিত্র গুওরোন অসভিফুরসদত্তির আর কিয়ারতান অলাফসন আর বোল্লি বোরলেইকসন আর বইয়ের বাইরের প্রাচীন মানুষদের মাথা থেকে মাথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছি পাহাড়ি ছাগলের মতো আর ভাবছি বইয়ের ভিতরে আর বাইরে বলে কি আদৌ কোনো কিছু হয় কিনা। আমি নিজেই বইয়ের কোনো চরিত্র কিনা, আমাকেও কেউ পড়ছেন কিনা, তা আমি আদৌ জানি কিনা।

শীত, বা বলা ভালো- প্রকৃতির উদযাপন পৃথিবীর সর্বত্রই হতো এক সময়। হয়তো পৃথিবীর বাইরেও, আমাদের স্বপ্নের প্যারালাল ইউনিভার্সেও হতো। পেগান উৎসব বলে উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ভর অর্থনীতির সাইডকিক একেশ্বরবাদী ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক আব্বারা আমাদের সেই সকল উদযাপনকে নাকচ করে দিয়েছেন ম্যালা দিন হলো। কিন্তু নাকচ করলেই তো পৃথিবীতে কিছু নাই হয়ে যায় না, শক্তির নিত্যতার সূত্র ধরেই আমাদের জিনেটিক মেমরিতে, আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসে সেই উৎসবের উপাত্তগুলি অস্পষ্টভাবে ঘুরঘুর করতে থাকে। তাই লজিক্যাল ব্রেইনের কার্বন ফুট প্রিন্টিঙ্গীয় আলাপের পরেও আগুনের পাশে বসলেই আমাদের ভালো লাগে, এবং আমরা টের পাই, এবং টের পেয়েও স্বীকার করতে চাই না যে- সেই ডিসেন্ট্রালাইজড ভালো লাগা শুধু উষ্ণতাকেন্দ্রিক ভালো লাগা না।  

ঈশ্বর ‘আছেন’ কি ‘নাই’ বা তিনি থাকলে ‘এক’ না ‘বহু’- এই নিয়ে লজিক্যাল আলাপ চলতেই পারে, কিন্তু লজিকের বাইরে ঈশ্বরকে যদি ম্যাথমেটিকাল লজিক্যাল শক্তি হিসাবে দেখা যায়, তাহলে ‘আমি’ নামক আমি তাকে বা আমাকে সর্বত্রই দেখি। বা দেখি বলে ভাবি। আমি দেখি, আমাদের এইসব মৌখিক সংস্কৃতিতে, আমাদের প্রকৃতি উদযাপন করা উৎসবের ভিতরে, আমাদের এই এই এই আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে ভূতের গল্প বলার গা ছমছম করা ছায়ার ভিতর দিয়ে স্প্রুস আর পাইনের মতো এভারগ্রিন কনিফার গাছের ডালের আর পৃথিবীর অন্য প্রান্তে চালের  গুঁড়া আর কালো রঙের তরল গুরের জ্বাল দেয়া ভেজা গন্ধের পিঠার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর নামক বায়বীয় শক্তি ফিবোনাচি সিকোয়েন্সের ক্রম অনুযায়ী আমার মাথার পাহাড়ি ছাগলের মতো অভিকর্ষরোধী নাচের ছন্দে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন।

ছোটবেলায় আমরা চাচাতো ভাই বোনরা কোনো শীতের ছুটিতে এক হলে আমার দাদী গায়ে কাঁথা পেঁচিয়ে খমক আর কাঠের কী আরেক বাদ্যযন্ত্র জাতীয় জিনিস হাতে বড় একটা ঝাঁকায় কী কী সব মাখানো একগাদা মুড়ি নিয়ে গল্প শোনাতে বসতেন। হাবিজাবি সব গল্প। মাধব মালঞ্চী কইন্যা। কাঞ্চন বাদশা। চান সওদাগর। কিন্তু আমরা শিশুরা সবাই সেইসব ‘শুনো শুনো সাত গো ভাইসাব, শুনো কই তুমরারে, ভিন দেশী গুলামের পুতে জাতি মারলো আমার রে, আমার ঐ তনু আল্লারে’ বা ‘অগ্নিবান দানবগণ যখনই আইল, মুরশিদ মুরশিদ বইলা সেলামো জানাইলো’ কথাবার্তার কিছুই না বুঝলেও খুব মন দিয়ে শুনতাম। দাদীর গা থেকে জবাকুসুম তেলের অশরীরী গন্ধ আসতো, উনার এক পাটি নকল অতি উজ্জ্বল সাদা আর বাদবাকি আসল হলুদাভ দাঁতে মুড়ি চাবানোর কচরমচর শব্দ হতো, আর আমরা শীতের কারণে অথবা ছায়ায় লুকানো ‘হগলের ছোডপুত মাধবের’ আত্মার ভয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতাম। দাদীর কন্ট্রাডিকটোরি সত্তা অবশ্য ভূতের ভয় দেখানো শেষে ভোর রাতের দিকে আসর ভেঙে দিয়ে ভূত প্রেত যেন আমাদের কোনো অনিষ্ট করতে না পারেন, সেই মর্মে আয়তুল কুরসি পড়ে আমাদের সবার গায়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতেন।

তাহিতি যাপন: পল গগাঁ

আমার জাতিগত বা ধর্মীয় বা লৈঙ্গিক আইডেন্টিটিকে কনফিউজড করার জন্য দাদীর কিচ্ছা বা পুঁথির উল্টাপাশে ছিল আমার বাবা এবং মায়ের সাপ্লাইকৃত বিদেশী উপকথা। হান্সেল এ্যান্ড গ্রেটেল। পেন্সিল ও সর্বকর্মা। অরবিস পিকটাস। মালাকাইটের ঝাঁপি। রিপ ভ্যান উইংকেল। দা প্রিন্স এ্যান্ড দা পপার। এ্যারাবিয়ান নাইটস। কিং সলোমন’স মাইনস। এ্যালিস ইন দা ওয়ান্ডারল্যান্ড। উইযার্ড অভ অজ। ভেলভেটিন র‍্যাবিট। উইন্ড ইন দা উইলোস।

ছোটবেলার ‘হান্সেল এ্যান্ড গ্রেটেল’ বড় হয়ে পড়ার পর আমি টের পাই, ছোটদের জন্য লেখা হলেও এটা আসলে বড়দের গল্প। বড়দের অন্ধকার ইতিহাসের গল্প। আর শুধু হান্সেল এ্যান্ড গ্রেটেলই না, ছোটদের জন্য বলা বা পরবর্তীতে লেখা গল্পদের বেশিরভাগই তাই। এবং এই গল্পগুলিই রূপকের ব্যবহারে, টোটেম চিহ্নের ব্যবহারে, সরলরৈখিক ইতিহাস বইয়ের রাজনৈতিক বর্ণবাদী জাতিবাদী লিঙ্গবাদী ধর্মবাদী বিজিত লেখকের সরলীকৃত ইতিহাসের বাইরে আমাদের এ্যানসেস্টরদের সাইন-ওয়েভিয় আঁকাবাঁকা ইতিহাস ধরে রেখেছে। হান্সেল এবং গ্রেটেলের বর্তমান ভার্শানে দেখা যায়, হান্সেল এবং গ্রেটেল নামের দুই ভাই বোনকে তাদের সৎ মা বনে ফেলে রেখে আসছেন। কিন্তু এর অরিজিনাল গল্পটাতে দেখা যায় সৎ মা নন, বরং আপন মা’ই তার বাচ্চাদের মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিলেন। ১৩১৪ সালে যখন ইওরোপ ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তখন বাবা মায়েরা সত্যি সত্যিই অভাবের কারণে তাদের বাচ্চাদের খুন করতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের রান্না করে খেয়েও ফেলতেন। তাছাড়াও এই বইতে যে ডাইনি বুড়ির দেখা পাওয়া যায়, সেই ডাইনি বুড়িও মানুষের কল্পনার ডাইনি নন। বরং ১৫৭২ সালে জার্মানিতে শুরু হয়ে পরবর্তীতে সুইটযারল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে গোটা ইওরোপে ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর ধর্মীয় রাজনীতির পূর্বরাগ উৎসরিত গল্পের সাধারণ রক্তমাংসের নারী, যাদেরকে ডাইনি নাম দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

প্রাতিষ্ঠানিক সেন্ট্রালাইজড খ্রিস্ট ধর্মকে এই কারণেই আমার সবচাইতে ভয়ংকর ধর্ম বলে মনে হয়। বাইবেলের সাথে কোনোপ্রকার সম্পর্কিত না হয়েও ক্ষমতাধর খ্রিস্টিয় চার্চ খ্রিস্ট ধর্ম বিরোধীদের নামে কুৎসিত প্রপাগান্ডা তৈরির মাধ্যমে জাতিবাদের মোড়কে পুঁজিবাদকে সাহায্য করতে তাদের হত্যা করার নৈতিক বৈধতা তৈরি করেছে যুগ যুগ ধরে। যার প্রথম ধাপ সতেরো শতকের উইচ-হান্টিং, দ্বিতীয় ধাপ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এ্যান্টি সেমেটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষ, তৃতীয় ধাপ হাল আমলের ইসলামোফোবিয়া।

যাক, সেটা অন্য আলাপ।

১৫০০ সালের শুরুতে ক্যাথেলিক চার্চ যখন ধর্ম এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বরের মনোপলি ব্যবসা শুরু করে, তখন ক্যাথেলিক নন এমন সমস্ত মানুষকে হেরেটিক বা শয়তানের পূজারী আখ্যা দিয়ে তাদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য অথবা হত্যা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে প্রোটেস্টান্ট রিফরমেশান শুরু হয়। এইক্ষেত্রে উল্লেখ্য, পেগানিজমের সাথে সম্পর্কযুক্ত ডাইনিবিদ্যা আর জেরল্ড গার্ডনারের হাত দিয়ে ১৯৪০ এ ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া হাল আমলের ডাইনিবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু ইওরোপে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই প্রাচীন তন্ত্রসাধনা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, আর্যীকরণ হয়েছে, পলিটিসাইজড এবং ডমিস্টেকেড হয়েছে। প্রাচীন পেগানিজম উৎসরিত ডাইনিবিদ্যা ছিলো প্রকৃতিকে জানার বিদ্যা। নিজের শরীরে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার বিদ্যা। অমাবস্যা পূর্ণিমা আর চাঁদের হিসাবের মাধ্যমে গাছ গাছড়া কিম্ভুতদর্শণ শিকড় বাকড়ের আলকেমির বুদ্ববুদ ওঠা হাঁড়ির ভিতরের রাসায়নিক ঘ্যাঁট আর চকমকি পাথর আর পাখির পালক আর রূপার প্রলেপ দেওয়া কাচের টুকরার ভিতর প্রতিফলিত রঙিন আলোর মধ্য দিয়ে, নিজেকে জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে, ভবিষ্যতকে দেখতে চাওয়ার বিদ্যা।

সময়কে আমরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মোটাদাগে দুই ঘটনার মধ্যবর্তী দূরত্ব মাপার একগামী ধনাত্মক বিষয় বলে ভাবি বলেই হয়তো মানুষের এই ভবিষ্যত দেখতে চাওয়ার অনুসন্ধিৎসু চরিত্র তার প্রধান চরিত্র হিসাবে কাজ করে। আমাদের পড়ালেখাও তাই প্রেডিকশান বা ট্রাজেকটরি কেন্দ্রিক। আমরা যত না আবিষ্কার করতে চাই, ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে চাই, তার চাইতে বেশি আমরা ভবিষ্যতকে দেখতে চাই। আমরা যতই শারীরিকভাবে বর্তমানে থাকি না কেন, আমরা মূলতঃ বাস করি আমাদের কাল্পনিক ভবিষ্যতেই। আমরা অংকের সূত্রে আমাদের আগামী তিরিশ বছরের অর্থনীতির সূচক হিসাব করি। আমাদের ব্যবসার লাভ বা লোকসানের ভবিষ্যত নিয়ে আমরা স্টক মার্কেটে জুয়া খেলি। আমরা আজকের দিনের ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে ঠিক করি আজকে ছাতা নিয়ে ঘর থেকে বের হবো কিনা। আমরা অমুক দলের শাসনে ভালো থাকবো বলে ভোট দেই। আমরা আগামীকাল বেঁচে থাকবো এই চিন্তায় এক মাসের বাজার করি।

কিন্তু আমার বিশ্বাস, সময় একগামী ভবিষ্যতমুখী কোনো ঘটনা না, এমনকি আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অভ রিলেটিভিটি প্রসূত কোনো কোয়ান্টাম গ্রাভিটেশানহীন ডিমেনশানের অংশও না। সময় বলে কোনোকিছুর অস্তিত্বেই আমি বিশ্বাস করি না, কারণ আমি বিশ্বাস করি সময় অনির্দিষ্টভাবে ঘূর্ণায়মান আর অনির্দিষ্টভাবে ঘূর্ণায়মান বলেই সময় বলে কিছু হতে পারে না। ইনফিনিটেস্টিমাল ক্যালকুলাসের নিয়মে একটা বৃত্ত থেকে যদি অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ কেটে নেয়া হয়, তাহলে যেভাবে এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুর দূরত্ব একটা সরলরেখা হয়, ঠিক সেভাবে মহাকাল থেকে আমরা যেই অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি অতি ক্ষুদ্র একটা সময়কে কেটে নিয়ে দেখি, তাতে সময়কে সরলরৈখিক বিষয় বলে মনে হতে বাধ্য। আমাদের জীবন মূলতঃ সামগ্রিকভাবে ‘এরিয়া আন্ডার কার্ভ’। আর সেজন্যই শুধুমাত্র লিমিটের সূত্র আরোপ করার মাধ্যমে আমাদের পক্ষে নিয়ত পরিবর্তিত বক্র রেখার নিচের জীবনের শুধুমাত্র ‘একাংশ’ দেখাই সম্ভব হয়। যারা হাই স্কুলে ক্যালকুলাস পড়েছেন, তারাই জানবেন, লিমিটের সূত্রে একই সাথে পজেটিভ ইনফিনিটি এবং নেগেটিভ ইনফিনিটি থাকে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আমাদের জীবনে আমরা আনকাউন্টেবল রিয়েল নাম্বারের নেগেটিভ ইনফিনিটি দূরে থাকুক, কাউন্টেবল নেগেটিভ ইনফিনিটির এ্যাপ্লিকেশান করতে সমর্থ হইনি। অন্ততঃ আজকের দিন পর্যন্ত। তার একটা প্রধান কারণ আমাদের তৈরি করা দৈনন্দিন এনট্রপিকে আমরা এখনও পেছনে ফেরত নিয়ে যেতে পারি না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, একটা কাঁসা বা পিতলের গ্লাস আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরে ধুলায় পরিণত হবে সত্যি, কিন্তু সেই ধুলা নিজে থেকে জোড়া লেগে গ্লাস হয়ে যাবে না। এর একটা প্রধান কারণ হিসাবে আমি যা ভাবি তা হলো, আমরা, আমার সাথে গ্লাসের বা ধুলার পার্থক্য আমরা আপাতঃদৃষ্টিতে শুধুমাত্র ‘কনশাসনেসে’ দেখি। গ্লাস এবং আমি এবং ধুলা- আমাদের তিনজনের এলেমেন্টাল কম্পোজিশান প্রায় একই, আমরা তিনজনই কার্বন নাইট্রোজেন অক্সিজেনের পারমুটেশান কম্বিনেশান সত্যি, কিন্তু গ্লাসের আর ধুলার কনশাসনেস নাই বলে আমরা বিশ্বাস করি। অন্ততঃ আজকের দিন পর্যন্ত।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সেভাবে দেখি না। আমি বিশ্বাস করি, গ্লাস এবং ধুলার আমার মতই কনশাসনেস আছে। এবং আমরা যদি এক শরীর নিয়ে কয়েক বিলিয়ন বছর বেঁচে থাকতে সমর্থ হই, তাহলে দেখা যাবে ধুলাও নিজ থেকে গ্লাসে পরিণত হচ্ছে(ন)।

এখন খুব ক্লিশে ভঙ্গিতেই প্রাইমারি প্রশ্ন আসতে পারে কনশাসনেস কী।

কনশাসনেস কী দেখার আগে আমরা যদি আমাদের শরীর বা গ্লাসের শরীর বা ধুলার শরীরের একটা এলেমেন্টকে ভাঙ্গি, তাহলে তার এ্যাটোমিক নিউক্লিয়াইয়ে যা পাই তা হচ্ছে ০ দশমিক ০১ শতাংশ ঐ এলেমেন্টের নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটোন নিউট্রোন আর বাদবাকি ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ খালি জায়গা। শূন্য। যেখানে ইলেক্ট্রোনরা ঘুরে বেড়ায়। আমি বিশ্বাস করি আর্টিফিশিয়াল নিউক্লিওজেনেসিস বা র‍্যাপিড নিউট্রোন ক্যাপচারের মাধ্যমে সিন্থেটিক এ্যাটোম তৈরির মাধ্যমে শুধুমাত্র ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড না, বরং এই ‘স্টেবল’ খালি জায়গা বা শূন্যস্থান তৈরি সম্ভব হলে আমরা নিজেরাই কনশাসনেস তৈরি করতে সমর্থ হবো, কারণ- এই খালি জায়গা বা শূন্যই হচ্ছে আমাদের কনশাসনেস।

যা নাই বলেই সবকিছু আছেন।

আর এই কনশাসনেসই ঈশ্বর।
‘The Breton Shepherd’: Paul Gauguin

আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর এই এই এইসব ‘সার্চ উইদিন ইয়োরসেলফ’, ‘চেয়ে দেখ না রে মন দিব্যনজরে’, ‘আঁখি মুন্দিয়া দেখ রূপ’, ‘স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে’ আত্মতত্ত্বর এই এই এইসব টেক্সটকে রূপক অর্থে না দেখে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের জিনেটিক কোডিং এর ল্যাংগুয়েজে আর সাব-এ্যাটোমিক স্ফিয়ারেই দেখা সম্ভব হলেই হয়তো কনশাসনেস অর্থাৎ ঈশ্বরের ব্যখ্যা পাওয়া যাবে।

আচার অর্থে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পেগানিজম এবং ভূত-প্রেত,তন্ত্রসাধনা ডাইনিবিদ্যায় পার্থক্য থাকলেও একটা বিশেষ মৌলিক জায়গায় তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। সেই জায়গাটা হচ্ছে, প্রকৃতিকে বোঝা। এবং প্রকৃতির সাথে একাত্ম থাকা। উদ্বৃত্ত সম্পদ নির্ভর অর্থনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক তাই প্রতিটা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম কঠোরভাবে প্রকৃতিনির্ভর তন্ত্রসাধনার বিরোধিতা করেছে। মানুষের জীবন থেকে ‘শেরকী’ চিহ্নের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছে। যেই ঈশ্বর আমাদের খুব একান্তের বিষয় ছিল, প্রেমের বিষয় ছিল, আত্মার কাছের বিষয় ছিল, তাকে আমাদের দোষ গুণ বিচারের সাত আসমান দূরবর্তী ‘অপর’ এনটিটি তৈরির মাধ্যমে রুদ্রমূর্তি বিচারক হিসাবে, অভিভাবক হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের শেখানো হয়েছে, জীবনের অর্থ পরীক্ষায় পাশ করা। ঈশ্বর নামের অহংকারী চরিত্রকে ফুলবেলপাতা দিয়ে দিনে একশ উনচল্লিশবার নাম-জপে তাকে তুষ্ট করা। আমাদেরকে শেখানো হয়েছে, জীবন অর্থই ভোগান্তি। জীবন অর্থই পরিবারের উদ্দেশ্যে, সমাজের উদ্দেশ্যে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে, রাজার উদ্দেশ্যে, রাণীর উদ্দেশ্যে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে দায়িত্ব পালন করা। আমাদের এই হিউম্যান রিসোর্সের ধর্ম শিখিয়েছে, নারীর কাজ সন্তান জন্মদান আর পুরুষের কাজ অর্থ উপার্জন। কারণ তা না হলেই, আমাদের এই দৈনন্দিন ভোগান্তির কারণ হিসাবে এই ঐশ্বরিক ‘মহাদায়িত্ব’র গুরুত্বারোপ না থাকলেই মানুষ হিসাবে আমরা সরলরৈখিক সময়ে ভবিষ্যতের আশা করার সুযোগ না পেয়ে টপাটপ আত্মহত্যা করবো বা রাজা আর রাণী ব্রাহ্মণ পুরোহিতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে সমাজ সভ্যতা ধ্বংস করে ফেলবো।

হয়তো সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেরও দরকার ছিলো। বা হয়তো এখনো আছে।

কিন্তু তা হলেও প্রকৃতিকে জানার তন্ত্রসাধনার প্রাচীন বিদ্যা পৃথিবী থেকে এখনো হারিয়ে যায়নি। কারণ, আগেই বলেছি, থার্মোডায়নামিক্সের সূত্র অনুযায়ীই পৃথিবীতে কিছু ‘নাই’ করে দেয়া সম্ভব হয় না। ১৪৯১ এ আঁকা কার্লো ক্রিভেলির ‘দা ভার্জিন এ্যান্ড চাইল্ড উইদ সেইন্ট ফ্রান্সিস এ্যান্ড সেবাশচিয়ান’ ছবিতে খুব আশ্চর্য্যজনকভাবে দেখা যায়, সেইন্ট ফ্রান্সিসের পায়ের কাছে একজন শামুক বসে আছেন। মেরি আর যিশুর এই ‘পবিত্র’ ছবিতে শামুকের মতো মেরুদণ্ডহীন গা ঘিনঘিন করা একটা প্রাণী কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। খ্রিশ্চান আইকোনোগ্রাফ নিয়ে লেখা বিখ্যাত বই ‘সিউডোডায়ানাইসিয়াস দা আরাপাগাইট’ এ তার খানিক উত্তর পাওয়া যায়। শামুককে পেগানরা পুনরুত্থানের চিহ্ন বলে বিবেচনা করতেন। এছাড়াও শামুকরা যেহেতু হারমাফ্রোডাইট, অর্থাৎ তারা এসেক্সুয়ালি বংশবৃদ্ধি করেন, তাই শামুককে পবিত্র বলে দেখা হতো, যাকে পরবর্তীতে মেরির অযৌন গর্ভধারণের সাথে তুলনা দেওয়া হয়েছিলো। মজার বিষয় হচ্ছে, খ্রিস্ট ধর্মের পুরোহিতদের মাধ্যমে পেগানিজমকে ধ্বংস করার চেষ্টা হলেও আজকের দিন পর্যন্ত খ্রিস্ট ধর্মের পবিত্র সব শিল্পকর্মের মধ্যেই পেগান সব চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। হাল আমলের ‘দা ভিঞ্চি কোড’ নামের বিপুল জনপ্রিয় রহস্যপোন্যাস যারা পড়েছেন বা বইয়ের উপর ভিত্তি করে বানানো ফিল্ম দেখেছেন, তারা সবাই এই নিয়ে ওয়াকিবহাল আছেন নিশ্চয়ই। 

তাহিতি যাপন: পল গগাঁ

আর শুধু শিল্পকর্ম কেন, আধুনিক পৃথিবীতে খ্রিস্ট ধর্ম বলতে যে ধর্মীয় উৎসব আমরা বুঝি, তার প্রতিটাই পেগান ধর্ম থেকে উৎসরিত। যেমন খ্রিসমাস বা বড়দিন। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বার সমগ্র পৃথিবীর খ্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীরা খুব ঘটা করে যিশুর জন্মদিন উদযাপন করে থাকেন। অথচ যেকোনো ইতিহাসবিদই বাজি ধরে বলতে পারবেন, ২৫ ডিসেম্বার শুধু না, ডিসেম্বার মাসের কোনোদিনই যিশুর জন্মদিন নয়। ২১ বা ২২ ডিসেম্বার উইন্টার সোলস্টিস বা সূর্যের ক্ষুদ্রতম দিনে শীতকালীন উৎসবের অংশ হিসাবে সূর্য দেবতা ওডেনের পুজায় পেগানরা এভারগ্রিন কনিফার গাছ আর মিসেলটো দিয়ে ঘর সাজাতেন। মোমবাতি জ্বালাতেন। ফলের মোরব্বা দিয়ে কেক বানাতেন। লবঙ্গ আর দারুচিনি আর কমলালেবুর খোসা জ্বাল দেয়া কালচে রঙের ‘এল’ খেতেন। এই স্যাটারনালিয়া বা মিথরাস উৎসবই পরে ক্রিসমাসে পরিণত হয়েছে। এমনকি ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানে যে সান্তা ক্লজকে দেখা যায়, তার পেট মোটা চেহারা, সাদা দাড়ি এবং লাল রঙের ফারের পোশাক সবকিছুর সাথে ওডেনের অস্বাভাবিক রকম মিল পাওয়া যায়। এছাড়াও যিশুর পুনরুত্থানের দিন বলে আধুনিক খ্রিশ্চানরা যে ইস্টার উৎসব পালন করে থাকেন, তাও পেগানদের স্প্রিং ইকুয়োনক্সের উৎসব। হ্যালোউইন, মার্টি-গ্রা, নেটিভিটি অভ জন দা ব্যাপটিস্ট, ফিস্ট অভ এনানসিয়েশান, এ্যাশ উইন ডে সহ প্রায় প্রতিটা খ্রিস্ট ধর্মীয় উৎসবের সাথেই পেগানিজমের সম্পর্ক আছে। তবে শুধু খ্রিস্ট ধর্মেই না, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বেশিরভাগ উৎসব এবং সংস্কৃতির একটা বড় অংশ পেগানদের কাছ থেকে ধার করা। ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের হ্বানাকা (ফেস্টিভাল অভ লাইট), লেন্ট, ইয়ামতুরাওয়া (রাশা-শানা), সুকাত (ফেস্টিভাল অভ ট্যাবারন্যাকল), আমেরিকানদের থ্যাংকসগিভিং, পারশিয়ানদের নওরুজ, চাহার শানবে সুরি, চিনা নতুন বছর, শ্রমিকদের মে ডে, ব্যবসায়ীদের ভ্যালেনটাইন ডে, মাদার্স ডে, মুসলিমদের রমজান, হিন্দু, জৈন আর শিখদের দীপাবলি – এই সবগুলি উৎসবের সাথে পেগানিজমের সরাসরি সম্পর্ক আছে।

পেগান শব্দটার বাংলা অর্থ কী হতে পারে আমার জানা নাই। পলিথেইস্ট, অকাল্টিস্ট, হিদান বা পেগান প্রতি গোত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই পেগান শব্দের বাংলা বহুশ্বরবাদী বা মূর্তিপূজারি বা প্রকৃতিপূজারি বা গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী বা পৌত্তলিক এরকম অনেককিছুই হতে পারে, আবার এগুলির কোনোটা নাও হতে পারে। এইক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ‘পেগান’ বলতে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বোঝানো হয় না, বরং পেগান একটা ‘আমব্রেলা’ টার্ম, যা একইসাথে অনেকগুলি ‘অকাল্ট’ বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। অকাল্ট বিশ্বাসীদের মধ্যে আছেন ড্রুইড, উইকান, মেকান পলিথেইস্ট, নিওপ্লেটোনিস্ট, সেটানিস্ট, কেলটিক রিকন্সট্রাকশনিস্ট, ইওরোপিয়ান নিও পেগানিস্ট, নরডিক পেগানিস্ট বা ওডেনিস্ট, হেলেনিস্ট, ডোডেকাথেইস্ট, যালমোজিয়ানিস্ট, হিদানস, টারাইস্ট, রডনভার্স্ট ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং শুধুমাত্র ইওরোপ বা আমেরিকা নয়, বরং সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এই সমস্ত গোত্রের বিশ্বাসীদের খুঁজে পাওয়া যাবে আজকের দিন পর্যন্ত। এই গোত্রগুলির মধ্যে উপাস্য বা আচার সংক্রান্ত বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে মৌলিক মিলের জায়গা হচ্ছে, তারা সবাই এ্যানিমিস্টিকভাবে তাদের প্রাচীন পূর্বসূরী, ডিভাইন ফেমিনিন, ডিভাইন মাসকুলিন এবং প্রকৃতির সাথে কোনো না কোনো পদ্ধতিতে যুক্ত থাকায় বিশ্বাস করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মত পেগানদের নির্দিষ্ট বাধাধরা নিয়ম নাই। পেগানিজম বস্তুবাদের চর্চা করে না, কিন্তু বস্তুবাদের বিরোধিতাও করে না। তারা একেশ্বরবাদের কথাও বলে না, বহুশ্বরবাদের কথাও বলে না। নাস্তিকতার বিরোধিতাও করে না, পক্ষেও থাকে না। ঈশ্বর আছে কী নাই এই নিয়েও কোনো নির্দিষ্ট চিন্তা নাই তাদের। 

২০১৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন ডি স্মিথের লেখা ‘পেগানস এ্যান্ড খ্রিশ্চিয়ানস ইন দা সিটিঃ কালচার ওয়ার্স ফ্রম টিবার টু দা (প)টোম্যাক’ বইয়ে দেখা যায় পোস্ট-খ্রিশ্চিয়ান ইওরোপিয়ান ডেমোগ্রাফিতে কিভাবে আধুনিক ইওরোপিয়ানরা সেকুলারিজমকে ‘ইল্যুশান’ বলে মনে করছেন এবং কিভাবে মহাশক্তিধর সৃষ্টিকর্তার প্রতিষ্ঠানবিযুক্ত হয়ে তাদের নিজেদের ‘ভিতরেই’ প্রাচীন ঈশ্বরের বা ঈশ্বরদের সন্ধানে আধ্যাত্ববাদের দিকে ঝুঁকছেন। সম্ভবতঃ খ্রিশ্চানদের হাতে খুন হবার সম্ভাবনা বন্ধ হবার পরেই মানুষ প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠান বিযুক্ত হয়ে প্রকৃতির কাছে ফেরত যাবার ‘ধৃষ্টতা’ দেখাতে সমর্থ হচ্ছেন ইদানিং।

এ্যালান ডি বৌটনের আমার খুব প্রিয় একটা বই আছে, ‘রিলিজিয়ন ফর এথেইস্টসঃ আ নন-বিলিভারস গাইড টু দা ইউজেস অভ রিলিজিয়ন’। এ্যালান ডি বৌটন নিজে একজন নাস্তিক। কিন্তু তিনি বেশিরভাগ নাস্তিকের মত ধর্মকে বা ধর্মের প্রয়োজনীয়তাকে বা মানুষের মনস্তত্বতে ধর্মের ভূমিকাকে নাকচ করে দেন না। উনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস না করলেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে শেখার অনেক বিষয় আছে। আমাদের পূর্বসূরীদের মনস্তত্ব গঠনের একটা প্রধান অনুষঙ্গ যেহেতু অদৃশ্য বিশ্বাস, তাই আধুনিক মানুষের জিনেটিক মেমোরিকে, তাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসকে আগাগোড়া নাস্তিক বানাতে অনেক সময় লাগা স্বাভাবিক। তার হয়তো প্রয়োজনও নাই। আর তাই হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ধর্মের খবরদারির থিসিস আর বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতার খবরদারির এ্যান্টিথিসিসের মাঝখানে সিন্থেসিস হিসাবে পেগানিজমের পুনর্জন্ম হচ্ছে আবার।

তাহিতি যাপন: পল গগাঁ

ডায়েরির পাতা

২৮ অগাস্ট, ২০১৫ (মূল ঘটনা ২০১০ সালের)

….

আমি তানিয়া আপুরে সামনের সিটে ফালায়া একলা একলা বিমর্ষ মুখে বাংলাদেশে জন্মানো অপরাধী আর্টিস্টদের নিয়া ভাবতেছি, আমার সামনে জিপসিদের মত একশ’ রঙ্গা কাপড়ের শার্ট এবং তাপ্পি মারা ঝুলঝুলা স্কার্ট পরা আর সারা শরীরে পঞ্চাশ হাজার ফুটাফাটি করা বেগুনী রঙ্গের ড্রেড-লকওয়ালা চুলের এক মধ্যবয়স্ক ইয়োরোপিয়ান ভদ্রমহিলা আইসা বসলেন। মহিলার মুখভর্তি লাল লাল রঙ্গের ফ্র্যাকেল্‌স্‌ এবং মন ভালো কইরা দেওয়া গৃহচিহ্নের মতন হাসি, “বোন্‌ আপখে মিদি, মাদ্‌মোয়াসেল! (গুড আফটারনুন, মিস্‌!)”

আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ হইলো, ফ্রেঞ্চে বললাম, “হাই! গুড আফটারনুন টু ইউ টু!”

ট্রেইনের জানলার গায়ে শুকনা পাতারা পানির তলার মাছদের মতন একটু পরপর ঘাঁই মাইরা যাইতেছে, উনি উনার ঝিকমিকা ব্যাগ থিকা একটা বিস্কিটের টিন বাইর কইরা নিজে একটা কুকি নিয়া আমার দিকে আগায় ধরলেন। আমিও টিনের ভিতর থিকা একটা চকোলেট চিপ কুকি নিয়া অল্প একটু ভাইঙ্গা মুখে দিলাম। চকোলেটের সাথে কমলার খোসাও গুড়িগুড়ি কইরা কাইটা দেওয়া হইছে, নিশ্চয় বাসায় বানানো! আমার আবার মা’র জন্য মন খারাপ হইলো। উনি আমার হাতগুলি টাইনা নিলেন নিজের হাঁটুর উপর, কইলেন, “তুমি কুম্ভ রাশির জাতক, তোমার জন্ম জানুয়ারি মাসে, তাই না?”

তানিয়া আপু সামনের সিট থিকা মাথা ঘুরায়ে আমারে দেখলেন একবার। চোখ ইশারায় সম্ভবতঃ কইতে চাইলেন উনার সাথে কথাবার্তায় না যাইতে, ঝামেলা হইতে পারে। আমি জিপসি মহিলার দিকে তাকায়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

– তুমি একজন আর্টিস্ট, কিন্তু এখন বিজ্ঞানের কোন্‌ শাখায় পড়ালেখা করছো! মাত্র শুরু করেছো, তাই না? 
– হু, ফরেনসিক সায়েন্সে পড়া শুরু করছি। এর আগে ফ্যাশন ডিসাইন পড়ছি।   

ভদ্রমহিলা সম্ভবতঃ নিজের প্রতিভায় মুগ্ধ হইয়া হাসলেন, “ছোটবেলায় তোমার খাদ্যনালী সঙ্ক্রান্ত কোনো রোগ ছিল।” আমি মাথা নাড়লাম, হু, ছিলো।

আমি প্রিম্যাচিওর বেবি ছিলাম, সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমার খাদ্যানালীতে ফুটা ছিলো এবং সেই কারণে আমি নিজে আস্ত কোনো খাবার খাইতে পারতাম না এবং আমার মা’রেও আস্ত কোনো খাবার খাইতে দিতাম না। একবার চার বছর বয়সে আমার বাপের বন্ধুর একজনের বাসায় বেড়াইতে গেছি, উনারা সবাই আমারে দেখাইয়া দেখাইয়া (ঘটনা সত্য নাও হইতে পারে) হাতের তালুর সমান বড় বড় মাওয়া মাখানো হলুদ রঙ্গের চমচম খাইতেছেন দেইখা আমি তাড়স্বরে কান্না জুইড়া দিছি, তখন আমার মা আমার কান্না থামাইতে জসীমউদ্দিনের ‘কবর’ কবিতা মুখস্ত পইড়া শুনাইছিলেন। সেই কবিতা শুইনা আমার কান্নাকাটি আরো বাইরা গেছিলো। কবর কবিতায় লেখকের দাদি মারা গেছিলেন এবং সেইটা একটা দুঃখের কবিতা। চার বছরের বাচ্চার কান্না থামানোর জন্য ‘কবর’ উপযুক্ত না।

আমি জিগাইলাম, “তুমি এইসব জানো কীভাবে?”

ভদ্রমহিলা এইবার ঝিকমিকা ব্যাগ থিকা একটা নীল রঙ্গা ফ্লাস্ক আর ড্রিম-ক্যাচারের ছবিওয়ালা একটা পোর্সেলিনের মাগ বাইর করলেন। এরপর টিস্যু দিয়া ফ্লাস্কের মুখ আর মাগটা মুইছা অল্প একটু কইরা চা ঢাললেন দুইটায়। আমার দিকে মাগটা আগায় দিতে দিতে আমার চোখে চোখ রাইখা কইলেন, “আমি একজন শয়তানের উপাসক, তাই জানি!”

আমি মাগের গায়ে নাক ঠেকাইয়া চায়ের গন্ধ নিলাম। বেরগ্যামট অরেঞ্জের গন্ধওয়ালা আর্ল গ্রে চায়ের সাথে গোলাপ আর পেস্তাবাদাম মিশানো হইছে। ভ্যানিলাও আছে সম্ভবত অল্প একটু। চায়ে চুমুক দিয়া কইলাম, “আচ্ছা।” ততদিনে আমি আর ঐ ধরণের উত্তরে আশ্চর্য্য হই না। বরং উনি যে নিজেরেই শয়তান বইলা ডিক্লেয়ার দেন নাই তাতেই আমি সামান্য আশাহত হইছি। লন্ডনে সেইসময় শয়তানের উপাসক একদল মানুষের সাথে আমার পরিচয় ছিল। প্রায় রোববারেই উনারা আমারে চা আর কেক খাওনের দাওয়াত দেন। মাঝেমধ্যে অমাবস্যার রাতে উনারা কালো কাপড় টাপড় পিন্দা মোমবাতি, ঝাড়ু, আথ’আইমে (উইচক্রাফ্‌টে ব্যবহারের এক ধরণের ছুড়ি), কলড্রোন (এক ধরণের পাত্র) হাতে বনের ভিতরে পেন্টাকল আঁইকা ব্ল্যাক ম্যাজিক ট্যাজিক করেন। সেই ম্যাজিকও দেখার মত কোনো আহামরি বিষয় না। নামে শয়তান হইলেও উনারা আদতে হাসিখুশি পেটমোটা ভালো মানুষ।

– তুমি মনে হয় বিশ্বাস করলে না আমার কথা!

আমি সিটের পাশে হাতলে মাগ নামায়ে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লাম

– না না, আমি অবশ্যই বিশ্বাস করছি। তুমি শয়তানের উপাসক না হইলে আমার সম্পর্কে এতকিছু জানলা ক্যামনে?
– তুমি এরিয়া ৫১-র নাম শুনেছো?
– ফিল্মের কথা বলতেছো না লার্জ হেড্রন কোলাইডারের কথা বলতেছো? 
– ফ্রান্স সুইটজারল্যান্ড বর্ডারে মাটির নিচের ২৭ কিলোমিটার এলাকার কথা বলছি।

আমি এইবার সত্যি সত্যি অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইলাম। মধ্যবয়স্ক জিপসি ভদ্রমহিলার মুখে পৃথিবীর সবচাইতে বড়, সবচাইতে শক্তিশালী, সবচাইতে জটিল ‘পার্টিকেল এ্যাক্সেলেরেটর’এর কথা শুনবো সেইটা কোনোদিন ভাবি নাই। এই জিনিস সম্পর্কে অল্প লোকেই জানেন, আর তাও যারা পার্টিকেল ফিজিক্স বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা এইসব জিনিসে আগ্রহী, উনাদের ছাড়া কাউরে আমি এই বিষয়ে কথা বলতেও শুনি নাই। আমি নিজেও আমার এক প্রফেসারের কাছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়া আলাপ চলাকালে খুব অল্প দিন আগেই এর সম্পর্কে জানছি এবং পরে অল্পবিস্তর পড়ালেখা করছি। লিওন ল্যাডারম্যান ১৯৩৩ সালে এই নিয়া আমার মাথার উপর দিয়া উইড়া যাওয়া একটা বই লিখছিলেন। বইটার নাম, ‘দি গড পার্টিকেলঃ ইফ দ্যা ইউনিভার্স ইজ দ্যা আন্সার, হোয়াট ইজ দি কোয়েশ্চেন?’ এই অসম্ভব জটিল এবং বিশালাকৃতির মেশিনের মধ্য দিয়া ভ্যাকিউয়ামের ভিতর আলোর গতিতে বিপরীত দিকে দুইটা পার্টিকেল বিম্‌রে চলাচল করানো হয়। সুপারকন্ডাক্টিং ইলেক্ট্রোম্যাগনেট দিয়া কোনোরকম এনার্জি লস ছাড়াই একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড চালু রাখা হয়, এবং সেইটা করার জন্য পুরা সিস্টেমরে আউটার স্পেসের থিকা ঠান্ডা একটা পরিবেশ ধইরা রাখতে হয়। সিস্টেমের তাপমাত্রা থাকে শূন্যের নিচে ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমি চোখ বড় বড় কইরা আশ্চর্য্য হইয়া কইলাম, “তুমি হিগ্‌স্‌ বোজোন নিয়া কথা বলতেছো?”

– কী বোজোন?
– হিগ্‌স্‌ বোজোন। হিগ্‌স্‌ বা সাব-এ্যাটোমিক পার্টিকেল। এরে গড পার্টিকেলও বলে। পার্টিকেল ফিজিক্সের মৌলিক বা প্রাথমিক পার্টিকেল। তুমি তার কথা বলতেছো?
– না না। ঐসব তো তোমরা বলছো। এরিয়া ৫১ তে আসলে কী হচ্ছে তুমি জানো?

আমি কাশলাম। এরিয়া ৫১ তে কী হইতেছে সেইটা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা আমার বাপেরও সাধ্য না। “আমি ঠিকমত বলতে পারবো না! তবে আমি যা বুঝি সেইটা হইলো, দুনিয়াতে বেশ কিছু পার্টিকেল আছে যেইগুলি ‘ভর’ আছে এমন আচরণ কইরা হিগ্‌স্‌ ফিল্ডের সাথে ইন্টারেক্ট করে। যেমনভাবে চার্জ আছে এমন কিছু জিনিস ইলেক্ট্রিক ফিল্ডের প্রতি আকর্ষিত হয়- যেইখানে চার্জহীন জিনিসের উপর সেই ফিল্ডের কোনো প্রভাবই পড়ে না! হিগ্‌স্‌ বোজন মূলতঃ হিগ্‌স্‌ ফিল্ডে একধরণের তরঙ্গের উপস্থিতি প্রমাণ করতে চায়, কারণ সম্ভবতঃ আমাদের পুরা ইউনিভার্সটাই হিগ্‌স্‌ ফিল্ড দিয়া ঢাকা, এবং বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই পার্টিকেলের কারণেই দুনিয়ার সব বস্তুর ভর আছে এবং হিগ্‌স্‌ ফিল্ডের উপস্থিতি প্রমাণ হইলে আমাদের সৃষ্টি রহস্যেরও সমাধান হয়।”

– এইসব তুমি বিশ্বাস করো?
– না বিশ্বাস করার তো কিছু নাই। জেনেভাতে তো ‘প্রোটন’ ভাঙ্গার জন্যেই লার্জ হেড্রন কোলাইডার বানানো হইছে বেশ কয়েক বছর হইলো!

ভদ্রমহিলা আরেকটা টিস্যু দিয়া চা শেষ হইয়া যাওয়া ফ্লাস্কের মুখ মুইছা আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাইলেন, “তুমি গেছো ঐখানে?”

– জেনেভাতে? জেনেভা গেছি, কিন্তু ‘সার্ন’-এ যাওয়ার সৌভাগ্য হয় নাই।

আমি আমার হাতের মাগ ফেরৎ দিলাম উনারে। উনি সেইটাও টিস্যু দিয়া মুছলেন, “আমি গেছি। ওরা একটা টানেল বানিয়েছে। দেখেছো?”

আমি উপর নিচ মাথা নাড়লাম, “ছবিতে দেখছি।”

– হ্যাঁ, ঐ টানেল আসলে একটা স্টার-গেট, ওটা ওরা বানিয়েছে ওসিরিসকে পুনর্জীবিত করতে!
– কাকে পুনর্জীবিত করতে? ওসিরিস? মিশরীয় দেবতা ওসিরিস?
– হ্যাঁ, মৃত্যুর দেবতা ওসিরিস! কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দেবো না!
– আমরা কারা? তোমরা, মানে শয়তানের উপাসকরা?

ভদ্রমহিলার চোখ রাগে ছোট ছোট হইয়া গেল, আমার দিকে ঝুঁইকা আসলেন, ফিসফিস কইরা উত্তেজিত স্বরে বললেন, “হ্যাঁ, আমরা সবাই এক হচ্ছি, স্বয়ং সর্বশক্তিমান শয়তানকে ডেকে আনছি পৃথিবীতে! আর তার কারণেই আমাদের সবাইকে একেকটা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবাই তো আর এই কাজে অংশ নিতে পারবে না, নাকি?”

আমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লাম, “নিশ্চই না!”
– হ্যাঁ, তাই আমি আমার গুরুর কাছ থেকে মানুষের অতীত দেখার যাদু শিখছি। আমি এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই মহাপ্রভু শয়তানকে ডেকে আনার কাজে যোগ দিতে পারবো!

আমার হঠাৎ কইরা মনে হইলো, তানিয়া আপুরে অনেকক্ষণ একা ফেলায়ে আসছি। ভদ্রমহিলারে বললাম, “আমার ধারণা তুমি পরীক্ষায় ঠিকঠাক মত পাশ করতে পারবা। আমার সম্পর্কে সব কথাই তো ঠিক বলছো! কীভাবে বলছো সেইটা ভাইবাই তো আমি আশ্চর্য্য ছিলাম!”

ভদ্রমহিলা খুশি হইলেন আমার কথায়, কইলেন, “তুমি টুরিন শ্রাউড চেনো?”

– না, সেইটা কী জিনিস?
– যিশুকে যেই কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিলো সেই কাপড়। মু্য্যে দেলা সিনদোনিতে কড়া পাহারায় রাখা আছে। মহাপ্রভু শয়তানকে ডেকে আনার জন্য আমাদের টুরিন শ্রাউড লাগবে!     

আমি সিট থিকে উইঠা তানিয়া আপুর দিকে আগাইতে আগাইতে কইলাম, “কিন্তু সেইটা তো তোমার রাস্তাঘাটে বইলা বেড়ানোর কথা না, তাই না? ধরো, আমি যদি পোলিসের লোক হই! বা ঐ সিনদোনি মিউজিয়ামে যদি খবর দিয়া দেই?”

ভদ্রমহিলা সেই প্রশ্ন শুইনা য্যামনে আমার দিকে তাকায়ে একটা হাসি দিলেন, মনে হইলো, সেই রাত্রেই উনি বাড়ি গিয়া আমার নামে একটা কাপড়ের ভুডু পুতুল বানায়ে চোখে সুঁই ফুটায়ে বা আগুনে পুড়ায়ে আমারে মাইরা ফেলবেন! তানিয়া আপুর সাবধানবাণী না শোনায় আমার একটু আফসোস হইলো! মাথার ভিতরের কর্ণ শকুনিরে পরামর্শ দিয়া কইলেন, “বড়দের কথা শুনতে হয়, হে নাদিয়া ইসলাম!”   

‘Vision After The Sermon’: PAUL GAUGUIN

পুঁজিবাদ বরাবরই প্রকৃতিবিরুদ্ধ। পুঁজিবাদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে উন্নয়ন বলতে মানুষ যে বড় বড় ব্রিজ আর হাইরাইজ স্ট্রাকচার আর সুপারসনিক বিমান বোঝেন, তেমন চিন্তার বিপক্ষে আমি অবস্থান করি। আমি বিশ্বাস করি, বড় বড় ব্রিজ আর হাইরাইজ স্ট্রাকচার আর সুপারসনিক বিমানের আবিষ্কার মানুষের চিন্তার স্বাভাবিক অগ্রগতি, তাতে উন্নয়নের ধনাত্মক কনোটেশান যুক্তের প্রয়োজন নাই। সময় নামক বায়বীয় জিনিসের আপাত কনটেক্সটের বিচারে মানুষ হিসাবে আমাদের আদতে কোনো ‘উন্নয়ন’ হয় নাই। আমরা যেই তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি। বা বলা ভালো, আমাদের তিমির আরও গাঢ়তর হয়েছে। মানুষ হিসাবে আমাদের উত্তরণ ঘটে নাই, আমরা সময়ের বিচারে অসহিষ্ণু হয়েছি, লোভী হয়েছি, অসৎ হয়েছি, অনৈতিক হয়েছি, বুদ্ধিহীন হয়েছি, অস্থির হয়েছি, প্রতিভাহীন হয়েছি। আমরা তর্ক করতে শিখেছি, প্রতিবাদ করতে শিখেছি, বিপ্লব নামের হাউকাউ করতে শিখেছি, রাষ্ট্র তৈরি করতে ও ভাঙতে শিখেছি, কু করতে ও এনজিও করতে শিখেছি, মানুষ খুন করতে, আইন লিখতে ও হিউম্যান রাইটস নিয়ে চ্যাঁচাতে শিখেছি, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে গান লিখতে শিখেছি, কিন্তু আমরা, মানুষরা ‘কী’ বস্তু তা বুঝতে শিখি নাই। আমরা প্রেম করতে শিখেছি, কিন্তু প্রেম শিখি নাই। আমরা ধর্মের আচার শিখেছি, কিন্তু ঈশ্বর শিখি নাই।

মানুষের জীবন আদতে জটিল কোনো বিষয় না। জীবন কোনো ইস্কুল না, পরীক্ষার হল টলও না। ওমর খৈয়ামের অতি ব্যবহৃত ওভাররেটেড “এইখানে এই তরুর তলে/ তোমার আমার কৌতুহলে/ যে ক’টি দিন কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে- সঙ্গে রবে সুরার পাত্র/ অল্প কিছু আহার মাত্র/ আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে!” জাতীয় কবিতার মতো জীবন খুব সরল একটা বিষয়, আক্ষরিক অর্থেই গাছের নিচে বসে মদ খেতে খেতে প্রিয় বই পড়ার মত আনন্দময় এবং সরল একটা বিষয়। তবে এটাও ঠিক, আমার মত ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে এই লেখা লিখতে লিখতে গ্রিন টির মাগে চুমুক দিতে থাকা মানুষের বাস্তবতা আর রিক্সাওয়ালা বা দিনমজুরের বাস্তবতা একই জিনিস না। বাস্তবতা যদি নিজের তৈরি করাই হবে, তাহলে অবজার্ভার থিওরিতে বিশ্বাস করলেই কি রিক্সাওয়ালা চোখ বন্ধ করলেই ওমর খৈয়ামের গাছতলায় চলে যেতে পারবেন?

(অবশ্য রিকশাওয়ালা ভদ্রলোক গাছতলায় এমনিতেই থাকেন, আমার ম্তো রোমান্টিসিজমে উনার গাছতলায় যেতে হয় না।) 

আর সেই কারণেই কি পুঁজিবাদের তৈরি করা বাইপ্রডাক্ট দরিদ্রতাও প্রকৃতিবিরুদ্ধ?

না, দরিদ্র অর্থ সরল বা গ্রামীন না। সরল অর্থ প্রযুক্তিবিমুখও না। টেলিফোন, কম্পিউটার, বাথরুম, জিপিএস ত্যাগ করে বনের মাঝখানে ‘ঠাণ্ডা জলে নাইতে নেমে’ ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচানোও না। দারিদ্রতা এমনকি খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের মৌলিক অভাবও না, দারিদ্রতা হলো একগামী ইরিভার্সিবল এনট্রোপি। সিস্টেমের বিশৃঙ্খল অবস্থা। যার বোল্টৎজমান কনস্টান্ট হচ্ছে আপাত বাস্তবতা, যার কোয়ান্টাম ক্যারেক্টারেস্টিক্স নাই। যা নিউটোনিয়ান ফিজিক্সের মত পুরোটাই অর্ধেক সত্য উপেক্ষা করে হাওয়া বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

তাই, হ্যাঁ, দারিদ্রতা-সহই, অসুস্থতা-সহই, ব্রেকাপ আর ডিভোর্স আর মৃত্যু আর স্টক মার্কেটে ধ্বস আর যুদ্ধ আর ভলকানিক ইরাপশান-সহই জীবন সরল। কারণ এই সব দারিদ্রতা আর অসুস্থতা আর ব্রেকাপ আর ডিভোর্স আর মৃত্যু আর স্টক মার্কেটে ধ্বস আর যুদ্ধ আর ভলকানিক ইরাপশান সিস্টেমের কোনো অত্যাবশ্যকীয় অংশ না, বরং তা সিস্টেমের ট্রান্সফরমেশনাল প্রসেসের আউটকাম। কিছুক্ষেত্রে সিস্টেম-বাগ। আর পুঁজিবাদ বা ধর্ম বা রাষ্ট্রযন্ত্র এইসকল কিছুই সিস্টেমের বাউন্ডারি, যা সিস্টেম এনভায়রনমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই আউটকাম পাল্টাতে সিস্টেম পাল্টানোর প্রয়োজন নাই, বরং সিস্টেম এনভায়রনমেন্টের মোডিফিকেশানেই তা সম্ভব।

যদিও সিস্টেম এনভায়রনমেন্ট পাল্টালে সিস্টেম আর আগের সিস্টেম থাকে কিনা সেই প্রশ্ন আসতে পারে।

বেশ কয়েক মাস আগে আমি ফেইসবুকে আমার হাতে বানানো একটা কাঠের টেবিলের ছবি আপলোড করেছিলাম। তাতে এক ভদ্রলোক কমেন্ট করেছিলেন, (প্যারাফ্রেইজ করছি)- “অর্থের অভাব না থাকলে আপনার মত এমন কত আর্টিস্ট তৈরি হতো পৃথিবীতে!” 

উনার কমেন্টের পরে আমি অনেকদিন কথাটা নিয়ে ভেবেছিলাম।  

দারিদ্রতা কতখানি আমাদের চিন্তাপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে পূর্ণিমার চাঁদকে ‘ঝলসানো রুটি’ বানিয়ে ফেলে, তা আমার মত কোনোদিনই দারিদ্রতা উপলব্ধি না করা মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না অবশ্যই। চিন্তার দারিদ্রতাও কি খাদ্যের দারিদ্রতা থেকে উৎসরিত কিনা তাও বোঝা সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারপুত্রের বিপরীতে নজরুলের মতো অজমিদারপুত্রের সমমর্যাদার আনমেরিটোক্রাটিক উপস্থিতি কি ব্যতিক্রমের উদাহরণ কিনা তাও বলা সম্ভব না। তবে মাজলোর পিরামিড সম্পর্কে না জেনেই বলা সম্ভব, যেই মানুষের চিন্তা সারভাইবাল কেন্দ্রিক, তার পক্ষে তথাকথিত ‘উচ্চ’ পর্যায়ের চিন্তা সম্ভব না।

এবং,

শিল্পচর্চা আর যাই হোক, নিম্ন পর্যায়ের চিন্তা না। কারণ শিল্পচর্চা শুধুমাত্র সৌন্দর্যের চর্চা থেকে আসে না, শিল্পচর্চার সাথে আধ্যাত্বচর্চাও যুক্ত। যদিও আধ্যাত্ববাদ আর সৌন্দর্যের চর্চা সম্ভবত একই বিষয়, নিরাপত্তার বোধ থেকে উৎসরিত হয়ে নিরাপত্তার সংজ্ঞার মাধ্যমে আত্মপরিচয় খোঁজার মাধ্যম।

আর তাই শিল্পের সাথে সম্পর্কহীন ধর্মে বা ধর্মীয় এলিট শ্রেণির চর্চা করা শিল্পে মানুষ তার পরিচয় খুঁজে পান না। তাই মানুষ শেষ পর্যন্ত মাটির কাছে প্রকৃতিতে, পূর্বসূরীর চিহ্নেই, চালের গুঁড়ায় আঁকা আল্পনায় আর চিরহরিৎ পাইন গাছের ডালে সাজানো চিনির পুতুল আর রঙিন বাতিতে আর ফসলের উৎসবে আর ধান ভানতে শীবের গীতে আর পুকুর ঘাটে মাটির কুমির পুজায় আর মিষ্টিকুমড়ার ভিতর জ্বালানো মোমবাতিতে ফেরত যান।

তাই মানুষ এখনো এই গ্যাসচালিত রুম হিটার বন্ধ করেই আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসেন। তাদের পূর্বসূরী ভূতেরাও তাদের পাশে এসে বসেন। দাদী নানীরা ভূতের গল্প বলতে বলতে মাঝ রাস্তায় থেমে যান। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে কীসের যেন শব্দ শুনতে বলেন। শিশুরা কান খাড়া করে থাকেন, ভূতেরা আম গাছের ডাল ধরে মৃদু ঝাঁকি দেন। শিশুরা একইসাথে ভয় ও উত্তেজনায় বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি তো!” উষ্ণতাকেন্দ্রিক ভালো লাগার বাইরেও তারা ডিসেন্ট্রালাইজড ভালো লাগা টের পান। কিন্তু তাদের বৈজ্ঞানিক সত্তা সেই ভালো লাগা স্বীকার করেন না।

কারণ বৈজ্ঞানিক সত্তার পেছনে দাঁড়ানো ইনফিনিট নাম্বার সত্তা পৃথিবীর এই রহস্যময়তা শেষ করে দিতে চান না।

তিনি বা তারা চান,

পৃথিবীতে এই গল্পগুলি থাকুক। শীতের উৎসব থাকুক। ফসলের উৎসব থাকুক। ঘাস লতা পাতায় পেন্টাগ্রামে, গলায় ঝুলানো সোনার লকেটে আগুনে পানিতে মাটিতে বাতাসে কল্পনার স্পিরিট গাইডস এ্যান্ড এঞ্জেলরা থাকুক। পুনর্জন্মের স্মৃতিরা থাকুক। মাটির এবং চিনির পুতুলরা থাকুক। ঘর তৈরি করে ঘরে জমানো বাইরের চিহ্ন থাকুক। গাছ কাটা বইয়ের পাতায় অক্ষর বাক্যর আঁকাবাঁকা অদ্ভুত দাগের ভিতর হাসি আর কান্না আর রাগ আর দুঃখ আর অভিমান আর ঈর্ষা আর ঘৃণা আর ভালোবাসা আর প্রেমরা লুকানো থাকুক।

তিনি বা তারা চান,

পৃথিবী রহস্যময় থাকুক।

কারণ-

পৃথিবীর রহস্যময়তা শেষ হয়ে গেলে বেঁচে থাকার, মহাকালকে ক্যালকুলাসের নিয়মে ভেঙে ভবিষ্যতের কল্পনা করাও কি শেষ হয়ে যাবে না? পৃথিবীর রহস্যময়তা যেদিন শেষ হবে, সেদিনই কি ব্ল্যাক হোলের ভিতর পৃথিবী হারিয়ে যাবে না? সেদিনই কি ডুমস ডে, সেদিনই কি কেয়ামত হবে না?

তাহিতি যাপন: পল গগাঁ

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি: পল গগাঁ

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share