‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে’

।। ফরহাদ মজহার।।

কালীপূজা বাংলার একটি প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হলেও কালী বাংলার ভাবান্দোলনের খাস দরবারে আছেন। স্বগুণে অধিষ্ঠিতা। শ্যামাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষায় কাব্য, সাহিত্য ও সঙ্গীত ও সংস্কৃতির ধারণা করা কঠিন। তবে তিনি প্রাচীন রূপে কিম্বা কোন এক চিরায়ত বিশ্বাস বা সত্যের দাবি নিয়ে হাজির হবেন, সেটা মনে হয় না। ইতোমধ্যেই বাজার ব্যবস্থায় দুর্গা-রূপ তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একালে পুঁজির স্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের দরকারে মতাদর্শ, সংস্কৃতি রাষ্ট্র, আইন ও ক্ষমতা চর্চার বিভিন্ন রূপের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে লড়তে হচ্ছে। লড়তে গিয়ে সাধারণ মানুষ তার মহাকাল ও ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে কালীকে নতুন অরে আবিষ্কার করবে। এই অনুমান আমরা করতেই পারি। কয়েকটি দিক থেকে ইতোমধ্যেই বিপদ তৈরি হয়েছে।

আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা, চৈতন্যময়ী’

পদকর্তা অজ্ঞাত। কিন্তু কালীকে উদ্দেশ্য করে পান্নালাল ভটাচার্যের ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’ গানটি এখনও দুর্দান্ত জনপ্রিয়। এর আবেদন কমে না। একটা কারন, গানটি আধুনিককালের রচনা। তন্ত্রে কালীর যে ভয়ঙ্করী রূপ-সহ বিচিত্র যে ইতিহাস আমরা জানি তার বিপরীতে এই পদে তিনি অন্যরকম। গানের হদিস পুরাটা জানা নাই। তবে যাঁরা ‘রসিক’ তাঁরা এই গানে একটু চমকে ওঠেন। জ্ঞানের কর্তা লিঙ্গবান পুরুষ বলেই পুরুষ বলেই তাঁরা হয়তো এতোকাল অনুমান করতেন, কিন্তু এই পদে তিনি মেয়ে। জ্ঞানী নন, কারণ তিনি জ্ঞানের অতীত। কিন্তু জ্ঞানের উৎপত্তিকারণ তিনি। তাই তিনি ‘জ্ঞানদাময়ী’ ।

কী করে বুঝি যে পদকর্তা প্রাচীন নন, আমাদের কালেরই মানুষ? কয়েকটি কারণে বুঝি। প্রথমত কালীকে ‘চৈতন্যময়ী’ কিম্বা সকর্মক চেতনা হিশাবে ভজনা প্রাচীন হতে পারে না। পুরানা সামন্ত বা এশীয় উৎপাদন সম্পর্কের শৃঙ্খল ভাঙা শুরু হয়েছে, বোঝা যায়। তাই মানুষ নিজেকে প্রকৃতি থেকে ভিন্ন ভাবতে পারছে। নিজের মধ্যে অতি ক্ষীণ হলেও স্বাধীন কোন কর্তাসত্তার উপলব্ধি ছাড়া এই গান লেখা যেত না।

কালী তাই এখানে চৈতন্যময়ী। মার্কসের ছাত্র হয়ে কিম্বা প্রচলিত বিপ্লবী পরিভাষা ধার নিয়ে দাবি করতে পারি চেতনা থেকে চৈতন্যে উন্নীত হবার প্রকল্পটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রকল্প। ব্যক্তির জীবাবস্থা থেকে আত্মসচেতন হয়ে ওঠার পর্ব। প্রকৃতি বা সকল প্রাকৃতিক সম্পর্ক থেকে আলাদা হওয়া এবং একই সঙ্গে নিজেকে বা ‘মানুষ’ হিশাবে আলাদা ভাববার কাল এটা। কলিযুগ। নদীয়ার ভাষায়, ‘কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার’। ভক্তের ভগবান এখন পুরাণ ছেড়ে গৌর হবেন। পুরাণ থুয়ে মানুষের ইতিহাস হবেন। নোক্তা হিশাবে বলে রাখা যায় সেই প্রকল্প পুরা উপমহাদেশে অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। এর কারণ চিন্তার দিক থেকে আমরা পাশ্চাত্যের অনুকরণ ও গোলামি করেছি, নিজেদের ভাষায় নিজেদের বোঝার চেষ্টা করিনি।

দ্বিতীয়ত, এই গানে চেতনা আর চৈতন্যের মধ্যে একটা ফারাক টানা হয়েছে। চেতনা থাকলেই আমাদের চৈতন্য থাকবে এমন কোনো কথা নাই। চেতনা জীব মাত্রেরই আছে।  কিন্তু চেতনা নিজে নিজে সচেতন বা চৈতন্য রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না। তার জন্য মাধ্যম চাই, প্রেরণা দরকার। কালী সেই আশ্রয় বা মাধ্যম। শুধু তাই নয়। একমাত্র কালীই আমাদের চেতনার স্তর থেকে চৈতন্যের স্তরে উন্নীত করতে পারেন। আমরা এখনও পুরাপুরি স্বাধীন না। পুরাপুরি স্বয়ম্ভু বা স্বাধীন নই। কালীর  দয়া ছাড়া নিজেকে পুরাপুরি মুক্ত, আত্মসচেতন, স্বাধীন ও স্বয়ম্ভু সত্তা হিশাবে প্রস্ফুটিত হওয়া যাচ্ছে না। এই শ্যামাসঙ্গীত এমন একটা সামাজিক-ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের কাব্য যখন পুরানা ও প্রাচীন সামন্তবাদী সম্পর্ক পুরাপুরি ভেঙে পড়েনি, কিন্তু ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেই ফাটলের মাঝখান থেকে কালীও দেখা দিচ্ছেন। কিন্তু করালী বা ভয়ঙ্করী নন তিনি। তিনি জননী। জন্মদাত্রী।

এই মহা সন্ধিক্ষণে কালীর কাজটা কী? এক নম্বর কাজ হচ্ছে মায়ের ভাবসাগরে ভাসবার ব্যবস্থা করে দেওয়া। মায়ের পদাশ্রয়ী হতে চাওয়া। ভক্তিভাবের এটাই চিরাচরিত আকুতি। ভাবটুকুর যাঞ্চা এখানে প্রধান।  জীব মাত্রই ‘অজ্ঞান’, এটা কালীর জানা উচিত। এটাই জীবের স্বভাব। তাহলে কালীর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে রই জীব-স্বভাব থেকে কা্লী যেন তাঁর আপন স্বভাব গুণে জীবকে ডেকে নেয়, যাতে অজ্ঞানদোষ মোচন হয়। কেন? তাহলে জীবের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হতে পারে। কালী যদি এই দায়টুকু গ্রহণ করেন তবেই কালীরূপ সন্দর্শন হবে। নইলে তিনি কেবলই মূর্তি। প্রাণহীন।

জ্ঞানচক্ষুরও বা কী দরকার! দরকার, কারন যদি জ্ঞানচক্ষু না থাকে জীব কী করে বুঝবে যে তিনি ‘জ্ঞানদাময়ী’? জ্ঞানদাময়ীকে যদি দেখতে চাই তাহলে জ্ঞানচক্ষুর দরকার। অতএব কালীর উচিত তাঁর ‘ভাবের খেলা’ দিয়ে জীবের সকল ‘অ-ভাব’ মিটিয়ে দেওয়া। যেন জীবের ইহজীবনের সকল ‘কৌতুহল’ মিটে যায়। আর কৌতুহল যদি মিটে তাহলে জীবকে রিপু বা প্রবৃত্তির অধীন থাকতে হবে না। ‘সর্বরিপু জয়ী’ হয়ে মানুষ সজ্ঞান ও সচৈতন্য হয়ে উঠবে।

পাশ্চাত্য দর্শনের মতো বাংলার ‘ভাবান্দোলন’ গ্রন্থকেন্দ্রিক কিম্বা ছাপাখানার ন্যারেটিভ না। সেটা গড়ে উঠেছে শ্রুতি ও কন্ঠের পরিসরে। ওপরের ছোট ব্যাখ্যায় আমরা দেখছি একজন অজানা পদকর্তা কিভাবে ভাবের চর্চাকে একটা উন্নত স্তরে নিয়ে যাবার জন্য প্রতিমারূপী কালীকে ভাব বিচারের শক্তিশালী বিষয় বানিয়েছেন। প্রতীকে রূপ দিয়েছেন। ‘জ্ঞানদাময়ী’ কালীকে এখানে নতুন রূপে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। এই সেই শক্তি যেনি জীবের সকল কৌতুহলের নিবৃত্তি ঘটান এবং জীবের রিপুর ওপর চৈতন্যকে জয়ী করেন।

যেটা শিক্ষণীয় সেটা হোল মহাবিদ্যাকে পাশ্চাত্য রিলিজিয়নের নজর দিয়ে দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। অর্থাৎ ধর্ম বলতে যদি ‘রিলিজিয়ন’ বুঝি তাহলে এই কালি আইডোলেট্রি বা পৌত্তলিকতার অধিক কিছু না। যদি ভাবচর্চার চিহ্ন বুঝি, যাকে ষোল আনা বুদ্ধি দিয়ে নয়, একই সঙ্গে কল্পনা, বাসনা ও যুক্তি-সহ মানুষের অপরাপর বৃত্তি সহকারে অচিন্তনীয়কে ভাববার উপায়, তখন বাংলার শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ভাবচর্চার ধারা হিশাবে ভক্তির ধারাকে বোঝার দরজাটা খুলে যায়। এই বোঝাবুঝির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বোঝাতে আমি একটি পরিভাষা ব্যবহার করি, সেটা হোল ‘ভাবান্দোলন’ । এটা পাশ্চাত্য ফিলসফি, কিম্বা গ্রিকদের জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা না। কিম্বা বৈদিক ঋষি-তপস্বীদের দর্শন বা সত্যকে দৃশ্যমান করে তোলাও নয়। বরং মনুষ্যজনোচিত চেতনারই নিজস্ব ‘লীলা’ যেন সে নিজের দেশকাল্পাত্র নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে পারে।

কালীর ধর্মতত্ত্ব নিয়ে হাজার হাজার বই লিখলেও ‘জ্ঞানদাময়ী’ কালীর কিছুই বোঝা যাবে না। একজন অজ্ঞাত পদকর্তার উদাহরণে সেটা টের পাওয়া যায়।  বড় বাংলার ভাবচর্চার এটাই হচ্ছে বৈশিষ্টসূচক দিক। ‘রস’ ছাড়া উপলব্ধি বা জ্ঞান নাই, আর জ্ঞান নাই তো সমাজকে ধরে রাখবার জন্য ধর্মও নাই। অধর্ম করে অরসিকে। কমলাকান্ত কিম্বা রামপ্রসাদ অবধি যেতে হচ্ছে না। অতোটা ম্যাচিউরিটি অভাগা বাঙালি কলোনিয়াল অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারনে আজো অর্জন করতে পারেনি। সেই সোনার খনি বৃহৎ বাংলার ভক্তির ধারার টাঁকশালে আপাতত মজুদ থাকুক। আস্তে আস্তে আগামিতে ধরে ধরে দেখাতে হবে। এখন ‘জ্ঞানদাময়ী’কে উপলব্ধি করে রসমুগ্ধ হতে পারলেই যথেষ্ট।

আমার চেতনা চৈতন্য করে
দে মা চৈতন্যময়ী ।
তোর ভাব সাগরে ভেসে আমি
হব মা তোর পদাশ্রয়ী ।।

অজ্ঞান মোর স্বভাব থেকে,
তোর ভাবে তুই নে মা ডেকে ।
জ্ঞান চক্ষু মেলে দেখি
কেমন তুই জ্ঞানদাময়ী ।

তোর ভাবের খেলা দিয়ে,
দে মা আমার যা কিছু সব,
অভাব মিটিয়ে ।

কুতুহল মোর এ জীবনে,
নিয়ে নে মা তোর ও চরণে ।
মহানন্দে যাই চলে মা
হয়ে সর্ব রিপু জয়ী ।।

পদকর্তা অজ্ঞাত। কেউ কেউ শচিদুলাল বিরচিত বলেন, তবে নিশ্চিত জানা নাই।
পান্নালালের কন্ঠে ‘আমার চেতনা চৈতন্য ক’রে…’
নিজের অবস্থান (‘লোকেশান’) জেনে নিন

বড় বাংলার ভাবচর্চার জায়গা থেকে কালিকে তাহলে কীভাবে আমরা বিচার করব? প্রথমত কালী-সহ বাংলার সকল চিহ্ন, লিঙ্গ, প্রতীক, উপমা, প্রতিমা, পুত্তলিকা, শিল্প, কারুকলা, পদ, সঙ্গীত ইত্যাদিকে  স্রেফ ধর্মতত্ত্বে পর্যবসিত না করে, ভাবুকতার ইতিহাস হিশাবে বোঝার তরিকাটা আবিষ্কার করা দরকার। এর ‘হিন্দুত্বকরণ’ ঘটালে কিম্বা সাম্প্রদায়িক গণ্ডিতে বন্দী করা হলে বড় বাংলার ভাবগত সম্ভাবনা গোড়াতেই মার খাবে। বাংলার ভাবের জগত থেকে কালিকে বিতাড়িত করবার বিরুদ্ধে একটা জিহাদ ফরজ হয়ে উঠেছে। দেবী হিশাবে কালীর গৌণ হয়ে ওঠা এবং শাক্ত ভক্তির ধারার বিস্মৃতি ও ক্ষয় চেতনাকে চৈতন্যে রূপান্তরিত করবার ক্ষেত্রে বিশাল বাধা হিশাবে হাজির হয়েছে। ধর্মীয় জাতিবাদ বা হিন্দুত্ববাদ তাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ।

অন্য ভাষাভাষী কিম্বা অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে বড় বাংলার দেওয়া নেওয়া কি হবে না? পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের দেনাপাওনা বোঝাপড়া আছে। বড় বাংলা তো দাঁড়াবার একটা জায়গা মাত্র। ধারণ করতে হবে পুরা বিশ্বকে। কিভাবে? সেটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে হবে না, এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আগে দরকার। বিশ্বকে ধারণ করতে হবে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু জাতিবাদ বা কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতা বরদাশত করে সেটা হবে না। হোক তা অজ্ঞান ‘বাঙালিত্ব’, ‘বাঙালি জাতিবাদ কিম্বা একই মূদ্রার অন্য পিঠ ‘হিন্দুত্ববাদ’ কিম্বা ইসলামি জাতিবাদ। কীভাবে সেটা সম্ভব?

স্মার্টফোন থেকে একটা দারুন শব্দ শিখেছি। সেটা হোল ‘লোকেশান’। স্মার্টফোন জিজ্ঞাসা করে তুমি কি তোমার ‘লোকেশান’ জানাতে চাও? নাকি হাইড করতে চাও? উত্তর হচ্ছে, হাইড করার প্রশ্নই আসে না, লোকেশান জানাতে চাই, জারি রাখতে চাই। সব্বাইকে। যাতে অন্যান্য লোকেশানে যারা আছে তাদের সঙ্গে বাংলাভাষীদের কম্যুনিকেশন ঠিকমতো হয়। এটা জাতিবাদ কিম্বা পরিচয়বাদ না। তাহলে বাংলার সকল চিহ্ন, লিঙ্গ, প্রতীক, উপমা, প্রতিমা, পুত্তলিকা, শিল্প, কারুকলা, পদ, সঙ্গীত ইত্যাদিকে বাংলার ভাবের জগতে মজুদ রাখা দরকারি কাজ। তারপর মেলা বসাতে হবে বড় বাংলায় বেচা কেনার জন্য। নদীয়ার ফকিররা বলেন, ‘ভাবের বাজার’ বসাতে হবে। বাংলার ভাবের ভূগোলকে সমৃদ্ধ রাখা অতি আবশ্যিক একটি কর্তব্য। কিন্তু তারা যেন মৃত মিউজিয়ম বা প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ না হয়। একালে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং সকল প্রকার বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে আমাদের শিরদাঁড়া খাড়া করে নিজের ভাবসম্পদের ওপরই দাঁড়াবার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

তাহলে জ্ঞানদাময়ী কালী নিয়ে আরও কিছু কথা বলা যাক। বঙ্গে তাঁর পূজার প্রচলন আছে। তিনি পুজ্য প্রতিমাও বটে।

মাতৃতান্ত্রিক বাংলার তর্ক !

‘আগমেশ্বরী’ মাতা হল নবদ্বীপে যিনি পূজিত হয়ে আসছেন তিনি ‘আগমেশ্বরী মাতা’। পূজিত কালী প্রতিমা। নবদ্বীপের পণ্ডিত কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রায় চারশ বছর আগে এই পুজা শুরু করেন। এটা তাহলে সাম্প্রতিক ঘটনা। বেশিদিনের কথা নয়। এই পুজো ৪০০ বছরের প্রাচীন।

চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বড় বাংলায়  প্রাচীন উৎসব হলেও ‘কালীপূজা’ নামে আমরা  যা দেখি তা আধুনিক কালের [১] । পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” [২] অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। সাধক রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। এগুলো আমাদের জানা।

এখানে আমাদের বলার কথা এতোটুকুই: ধর্মের যে ব্যবহারিক রূপ আমরা দেখে থাকি সেটা চিরায়ত বা শাশ্বত কোন রূপ নয়।  রূপের নানান বদল ও বিবর্তন ঘটেছে, এখনও ঘটে চলেছে। কোন একটি ব্যবহারিক রূপকে চিরায়ত গণ্য করলে আমরা ভাবের জগতের প্রবাহ ধরতে পারব না। শাক্তভাবের তাৎপর্য এবং বড়বাংলার শক্তিশালী ভাবান্দোলনের অবদানও বুঝব না।  পরিভাষা হিশাবে ‘ভাবান্দোলন’ কথাটার তাৎপর্য এখানে। একটা পর্যালোচনামূলক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী দরকার। ধর্মের শাশ্বত এবং চিরায়ত রূপের অনুমান ইতিহাস সিদ্ধ নয়। ধর্মের ইতিহাস ও মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে তা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

এই শাশ্বতকরণ বা চিরায়তবাদী অনুমান থেকে উগ্র বাঙালি জাতিবাদী ও হিন্দুত্ববাদী ধারার কেউ কেউ দাবি করেন বাংলার ভাব বা সংস্কৃতি ‘মাতৃতান্ত্রিক’।  তাদের দাবি হচ্ছে আগমবাগীশের তিনশো বছর আগে ত্রয়োদশ শতকের বৃহদ্ধর্ম পুরাণে হুবহু একই রকম কালীমূর্তির বর্ণনা আছে। কিম্বা তারও আগে, পালযুগে বজ্রযানে ও সহজযানে মা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপের উদ্ভাস ঘটেছে। যেহেতু আগমবাগীশের আগেও কালীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। অতএব মাতৃমূর্তির পূজাই বাংলার বৈশিষ্ট্য।

কালীর মূর্তি পাওয়া আর কালীর মূর্তি সামনে বর্তমান রেখে পুজা পদ্ধতি প্রবর্তন দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার মানেই পূজার নিদর্শন নয়। এই ধরনের দাবির কোন ভিত্তি নাই। যুগে যুগে কালী নানান ভাবে নানান জনের কাছে ধরা দিয়েছে। নদীয়ার ফকিরদের কাছে কালী হচ্ছেন ফাতেমাতুজ জোহরা, রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে সালামের কন্য। যেহেতু ফাতেমা ‘আদ্যাশক্তি’ তিনি ‘অবিম্বধারী’ তাঁর কোন সৃষ্টি নাই, অতএব তাঁর কোন ছায়া নাই। ।

“শুনেছি মা তুমি অবিম্বধারী
বেদের উপর গম্ভু তাহারি
তারে চেনা হোল ভার ওরে মন আমার
ভুলে রইলি ভবের ভাব ভূষণে।
ভজরে মন জেনে শুনে”।।
– ফকির লালন শাহ।

জ্ঞানদাময়ীর উদাহরণ যেমন দিলাম, তেমনি আরও নানান উদাহরণ আছে। যেমন ‘মানুষ’ নামক প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া কালী আদৌ ‘আদ্যাশক্তি’ কিম্বা মহাকাল কিনা কমলাকান্তের বিখ্যাত চ্যলেঞ্জ এখনও বাংলার ভাবান্দোলনের ভূগোলে জ্বল জ্বল করছে: “ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?” কমলাকান্ত জ্ঞানদাময়ী কালিকে প্রশ্ন করেছেন যদি কালী আদির আদি হয়ে থাকেন, যদি মহাকাল সকল সময়েরও অতীত কাল হয়ে থাকে তাহলে নৃমুণ্ডমালিনীর গলায় মানুষের মুণ্ডমালা কোথা থেকে এল?  জ্ঞানদাময়ী কালীর যে যুক্তি বা উপমা ভক্তির ধারায় দেখি তাতে পরিষ্কার পৌত্তলিকতার দিকটি তার বহিরঙ্গের দিক। অন্তরঙ্গে মানুষের সজ্ঞান চৈতন্যই নিজেকে মূর্তিচিহ্ন কিম্বা ভাষাচিহ্নের মধ্য দিয়ে নিজেকেই ভক্তির ভাষায় ব্যক্ত করছে। তাই কালী পুরুষ না প্রকৃতি, অর্থাৎ ছেলে না মেয়ে এই জিজ্ঞাসাও বড় বাংলার ভাবান্দোলনে প্রবল ভাবে আছে। আজ অবধি অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে।

কালী শিবের বুকের ওপরে পা দিয়ে জিভ কেটে ফেলেছেন, কালির এই লোলজিহ্বা রূপটিও ভাবুকতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শশিভূষণ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, কা্লী নামটির প্রথম দেখা পাওয়া যায় মুন্ডক উপনিষদে। বৈদিক সাহিত্যে যে কালীকে আমরা প্রথম দেখি সেখানে তিনি ‘যজ্ঞের আহূতি-গ্রহণকারিনী অগ্নিজিহ্বা মাত্রই; মাতৃদেবীত্বের এখানে কোনো  আভাসই নাই’। তিনি আরও জানিয়েছেন, “দার্শনিক মতে পঞ্চ ইন্দ্রিয় বুদ্ধি ও মন  এই সাতটিকে অগ্নির সপ্তজিহ্বা বলিয়া গ্রহণ করা হইয়াছে” [৩] ।  তাই কালীর মূর্তিরূপ পরিকল্পনায় লোলজিহ্ব রূপটি অতি প্রাচীন হলেও তিনি বৈদিক দেবী নন। এই সত্য স্বীকার করেও যারা বাঙালির সংস্কৃতিকে একাট্টা ‘মাতৃতান্ত্রিক’ দাবি করেন কালীর রূপ ও তাৎপর্যের ঐতিহাসিক বিবর্তন তারা অনুধাবন করতে অক্ষম।

যুগে যুগে কালীরূপের রূপান্তর বা বিবর্তনের মধ্যেই কালী কিম্বা যে কোন চিহ্ন, প্রতিমা বা পুতুলের নান্দনিক, সামাজিক-ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মর্ম আমরা বুঝতে পারি। শশীভুষণ ঠিকই বলেছেন,  “শোণিতলোলুপা ভয়ঙ্করী চামুণ্ডা দেবীকে পরবর্তী কালে  কালিকা দেবীর সাথে অভিন্না দেখিতে পাই, কিন্তু মনে হয় ইহারা মূলে দুই দেবী ছিলেন; আকার, সাদৃশ্যে এবং সাধর্ম্যে ইঁহারা পরবর্তী এক হইয়া গিয়েছেন”। অর্থাৎ কালীর শুধু রূপান্তর ঘটেছে তা নয়, অন্য দেবী এসে যুক্ত হয়ে অভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ করেছে। এই রূপান্তর একই সঙ্গে বাংলার ভাবজগতেরও বিবর্তন। বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। বাংলার শাক্ত ভাবজগতের  দুই শিরোমণি রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তকে বাদ দিয়ে বড় বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতের কথা চিন্তাই করা যায় না।

যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা হোলো কালীপূজা বাংলার প্রধান ধর্মসম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হলেও কালী বাংলার ভাবান্দোলনের খাস দরবারে আছেন। স্বগুণে অধিষ্ঠিতা। শ্যামাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষায় বাংলা কাব্য, সাহিত্য ও সঙ্গীত ও সংস্কৃতির ধারণা করা কঠিন। তবে তিনি প্রাচীন রূপে কিম্বা কোন এক চিরায়ত বিশ্বাস বা সত্যের দাবি নিয়ে হাজির হবেন, সেটা মনে হয় না। ইতোমধ্যেই বাজার ব্যবস্থায় দুর্গা-রূপ তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একালে পুঁজির স্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের দরকারে মতাদর্শ, সংস্কৃতি রাষ্ট্র, আইন ও ক্ষমতা চর্চার বিভিন্ন রূপের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে লড়তে হচ্ছে। লড়তে গিয়ে সাধারণ মানুষ তার মহাকাল ও ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে কালীকে নতুন অরে আবিষ্কার করবে। এই অনুমান আমরা করতেই পারি। কয়েকটি দিক থেকে ইতোমধ্যেই বিপদ তৈরি হয়েছে।

প্রথম বিপদ হচ্ছে শাক্ত ভক্তিবাদী ধারার ক্ষয় এবং আধুনিক সেকুলার হিন্দুর ধর্ম বিদ্বেষ।  অর্থাৎ একদিকে সেকুলার হতে গিয়ে পাশ্চাত্যের নির্বিচার গোলামে পরিণত হওয়া, অন্যদিকে ধর্মকে ধর্ম হিশাবে উপলব্ধির চেষ্টা না করে জাতিবাদী বা পরিচয়বাদী হয়ে ওঠা। ধর্ম আধুনিক জাতিবাদী রূপ পরিগ্রহণ করায় সাম্প্রদায়িক হিন্দুর সঙ্গে বড় বাংলার ভাবের একটি বড়সড় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামি জাতিবাদের জমানায় বড় বাংলার ভাব ও ভক্তির দিগন্ত সংকীর্ণ হয়ে আসছে দ্রুত। কালী বাংলা থেকে অনেক আগেই বিতাড়িত হয়েছেন। পৌত্তলিকতার কংকালগুলো পড়ে রয়েছে কেবল।  কালি এখন বাংলায় গৌণ দেবী। আদ্যাশক্তি ও মহাকাল হলেও তিনিও কালের অধীন হয়ে পড়েছেন। প্রহসন যে মহাকালকে কালের হুকুম মান্য করতে হচ্ছে। তিনি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চলেছেন।

দ্বিতীয় বিপদ হচ্ছে সাহিত্যের সঙ্গে ভাবের সম্বন্ধ তথাকথিত আধুনিক কাব্যে লজ্জাজনক ভাবে এখন অনুপস্থিত। আমরা প্রাচীন পদকর্তাদের মতো নাই আর। কবিতা লিখতে ভুলে গিয়েছি। ঈসায়ী অষ্টম শতক অবধি বিবিধ মঙ্গলকাব্য এবং শিবায়ন প্রভৃতির ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যে শক্তির বিভিন্ন রূপ ও বৈশিষ্ট্য যেভাবে ফুটে উঠেছিল সেই সমৃওদ্ধ লোকায়তিক ধারার সঙ্গে সম্বন্ধের সুতা কহন ছিঁড়ে গিয়েছে আমরা টেরও পাই নি। নাড়ীর বন্ধন যেখানে কেটে গিয়েছে সেই কাটাদাগ এখন শনাক্ত করা সহজ নয়। কঠিন। কিন্তু বড়বাংলার সাহত্য যদি সামনে অগ্রসর হবার বাঞ্ছা রাখে, তাকে নতুন করে অনেক কিছুই শুরু করতে হবে। সেই শুরুর একটা কর্তব্য হচ্ছে আদ্যাশক্তিকে স্মরণ এবং শরণ। সম্ভবত এই আক্ষেপ থেকে বহু আগে আমি লিখেছলাম, ‘হিন্দু কবে ভুলে গেছে, যবন এশেকে বলে তারা’। বৌদ্ধ সাধনায় কালি দিকনির্দেশক তারা।

'যতনে’ / ‘সতত হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে

আদরিনী শ্যামাঙ্গিনী দারুণ রূপসী মেয়ে ওকে
যতনে হৃদয়ে রাখি। তসবিতে জননীর নাম
সতত জিকির করি। প্রভূ তাঁকে পাবো বলে আমি
প্রথমে ‘যতনে’ লিখি, লিখে ফের সবুজ কালিতে
তাঁকে কাটি। ভেবে দেখো কালো কালি দিয়ে কি কালিকে
কাটা যায়? অত:পর সবুজাভ অক্ষরের পাশে
‘সতত’ শব্দটি লিখি। কাটাকুটিসহ সব কিছু
ঠিকঠাক রেখে দেই, মোটেও মুছি না। সব থাকে।

আমি কি রামপ্রসাদ? অন্ধ ভক্ত? আমি কালো রূপে
মজেছি আদ্যার্থসহ। অনাদি জননী যন্ত্রে নিজে
নিজেকেই পয়দা করি। প্রভু শুধু কর্মজ্ঞানে নয়
কালজ্ঞান দৃঢ় রেখে পূজা করি। শ্যামার পূজায়
দুটোই একসঙ্গে লাগে জেনে ম্লেচ্ছ আমি দিশেহারা-
হিন্দু কবে ভুলে গেছে, যবন এশেকে বলে ‘তারা’!

[এবাদত নামাঃ ৪৫ ।।  'কবিতাসংগ্রহ', ফরহাদ মজহার ] 

ধর্ম নিয়ে যদি কথা বলতে হয়…

বহু আগে আমার তরুণ বয়সের এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম আমি যেহেতু সিন্ধু নদের এপারে বাস করি তাহলে ভৌগলিক পরিচয়ে আমি ‘হিন্দু’। ‘হিন্দু’ কোন ধর্মের নাম নয়। এর আবিষ্কার ঔপনিবেশিক আমলে। ধর্ম নিয়ে যদি আমাদের কথা বলতে হয় তাহলে কথা বলতে শাক্ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া, নাথপন্থী, ফকির সহ অপরাপর সম্প্রদায়ের বাস্তব জীবন যাপন চর্চা নিয়ে, যেখানে ধর্মকে জীবন যাপন থেকে আলাদা করা হয় না, আলাদা করা যায় না।  কারন দুইয়ে কোন ফারাক নাই।

তাছাড়া ‘ধর্ম’ কথাটা কখনই আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে পাশ্চাত্যের ‘রিলিজিয়ন’ বোঝাতো না। বিশেষত আধুনিক কালে ‘রিলিজিয়ন’ যেভাবে  জ্ঞান, বিজ্ঞান, রাজনীতি ইত্যাদি থেকে আলাদা হয়ে স্রেফ ‘ফেইথ’ বা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে, সেই ‘রিলিজিয়ন’ আমাদের ছিল না। কারন মানুষের সবটুকু নিয়েই ধর্ম,  শুধু তার আচার বা অনুষ্ঠান না। মানুষের বিভিন্ন বৃত্তিকে কাটা মাংসের টুকরার মতো আলাদা আলাদা রাখলে খোদ মানুষটাই হারিয়ে যায়। খুব সহজেই বোঝা যায় ‘ধৃ’ থেকে যদি ‘ধর্ম হয়, তাহলে আমরা জীবনচর্চায় যা ধারণ করি তাকে আগাম তৈয়ারি কোন ধর্মতত্ত্ব বা বিশ্বাসসূত্র দিয়ে বোঝা যায় না। বরং বিপরীতটা করাই তখন জরুরী হয়ে পড়ে। আমাদের সামগ্রিক জীবন চর্চার রূপ বিচার করেই  বুঝতে হয় আমাদের ধর্ম আসলে কী? সেই বিচার পুরা সমাজের হতে পারে, কিম্বা হতে পারে বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের, কিম্বা ব্যক্তি হিশাবে শুধু আমার। জীবন যেহেতু সচল, ধর্মও তাহলে মৃত বা রুদ্ধ কিছু না।  জীবনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ধর্মেরও বদল ঘটে। বদল হয়।

‘রিলিজিয়ন’ নামক জগত ও জীবন বিচ্ছিন্ন মতাদর্শ – অর্থাৎ জীবন ও জগত একদিকে আর রিলিজিয়ন বা জীবনের পারলৌকিক মর্ম অন্যদিকে এইরকম বিভাজন আগাম অনুমান করে এই দেশে ধর্মের ধারণা গড়ে ওঠে নি। ইহলৌকিকতা এবং পারলৌকিকতার যে ভেদ আমরা ইব্রাহিমী ধর্মে প্রবল ভাবে দেখি, সেটা এদেশে একই মাত্রায় প্রবল ছিল  বলে প্রমাণ নাই। এখানে নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী  হয়েও আপনি ‘ধার্মিক’ হতে পারেন। ধর্ম পালনের সঙ্গে আস্তিকতা-নাস্তিকতার সম্পর্ক ‘বাহ্যিক’, ফেইথওয়ালাদের মতো ‘আন্তরিক ‘নয়। তাই ধর্মের প্রশ্ন এখানে আস্তিকতা কিম্বা নাস্তিকতার সঙ্গে যুক্ত না। বাস্তবে সমাজের সদস্য হিশাবে আমরা কি ভূমিকা পালন করছি, নিজের কোন্‌ বিশেষ কর্তারূপ প্রদর্শন করছি সেটাই আসল কথা।

মানুষ যুগে যুগে নানান ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছে, নানা ভাবে নিজে কি ধারণ করে আছে  সেই আত্মতত্ত্ব বা আত্মানুসন্ধানের জন্য আকুল হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক জীবন ও ধর্মীয় জীবনে ফারাক যেমন ছিল না, কার্ল মার্কসও এই সত্যোটা টের পেয়েছিলেন, তেমনি আর্থ-সামাজিক জীবন ও ধর্মীয় জীবনকে আলাদা বা  ভিন্ন গণ্য করবার ঐতিহ্যও গড়ে ওঠেনি।   জীবন বদ্ধ, অনড় ও রূপান্তররহিত নয়। সেখানে নিত্য বদল ঘটছে। মানুষ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছে, নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কারের সম্ভাবনাও বাড়ছে।  অতএব ধর্ম পাশ্চাত্য অর্থে ‘বিশ্বাস’ না। এর মর্ম অনেক গভীর ও বিস্তৃত। ধর্মের এই ধারনা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি হিন্দু, কারন পুরা উপমহাদেশ, হিমালয় এবং বঙ্গোপসাগর আমি ধারণ করি। এমনকি পুরা বিশ্ব আমার হৃৎপিণ্ডে, আমি ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী নিঃশ্বাস নিতে ভালবাসি।   

জন্মসূত্রে আমি ইসলাম ধর্মালম্বী অতএব আমি মুসলমানও বটে; আমি বাংলায় কথা বলি এবং বাঙালি হিশাবে জীবন যাপন করি। বাঙালি আমার কোন বিশেষ বা বিশুদ্ধ নৃতাত্ত্বিক পরিচয় না। বাঙালি ভেজাল জাতি, বহু আদিবাসি ও অনাবাসীর রক্ত এসে মিশেছে । অধিকাংশ সময় আমার নিজেকে মুণ্ডা, সাঁওতাল, ব্যাধ বা শবরদের বংশধর বলে মনে হয়। আমার কৃষি, খাদ্যাবস্থা পোশাক আশাক, প্রেম-ভালবাসা,  ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে যেভাবে ব্যক্ত করি নিজের ‘লোকেশান’ বোঝাবার জন্য তার একটা নাম আছে: ‘বাঙালি’। এটা নৃতাত্ত্বিক, কিম্বা জাতিবাদী পরিচয় না।  স্রেফ একটা সম্ভাবনা। তিনটি বিশাল নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা বদ্বীপের প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যে উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হওয়া, বেঁচে থাকা, খাদ্য ব্যবস্থারসহ নানান জৈবিক সম্পর্কের ঐতিহ্য দিয়ে গঠিত। নানান ভাষা, নানান সংস্কৃতিও আমরা ধারণ করি।

কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে আমরা আমাদের নিজেদের নাড়ির সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলি।  এই লোকেশান ছিন্ন হওয়া এমনই যে নাড়িছেঁড়ার বেদনাও আমরা আর বোধ করি না। নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু তা পর ও অপরের মধ্যে বিভাজন ও সহিংসতায় পরিণতি লাভ করেছে।  ঔপনিবেশিকতার ঔরসে গড়ে ওঠা আধুনিক পরিচয়বাদ, জাতিবাদ, ভোটাভুটির রাজনীতি এবং সংখ্যার হিশাব আমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ে  বিভক্ত করে দিয়েছে। এই বিভক্তির ফলে নিজেদের ইতিহাস, কল্পনা, ভাব ও কল্পনার জগতও খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে বিখণ্ডিকরণ এবং পরস্পরকে দুষমণে পরিণত করার প্রক্রিয়া আমরা রোধ করতে  পারি কিনা। আমি মনে করি সেটা সম্ভব এবং সেটাই উপমহাদেশে হিংস্র পরিচয়বাদের বিভিন্ন রূপ মোকাবিলার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। বড় বাংলার ভাব ও সাহিত্যের জগতে কালিকে তার যোগ্য আসনটুকু দেওয়া সেই দিক থেকে বড়সড় কাজ হতে পারে।

আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী
তোর ভাব সাগরে ভেসে আমি হব মা তোর পদাশ্রয়ী ।।

গ্রন্থসূত্র

[১] ‘হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৫-৮৭

[২] ‘শ্রীশ্রীকালীপূজা’, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গালীর পূজাপার্বণ, অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫৭

[৩] ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৬৪

https://www.youtube.com/watch?v=6EnL09MM814&fbclid=IwAR1bKIR9xedSY8C50RQ_O06_GiOesdk-bSws95rl8syiqmLjQPAHRiffHvo
Share