বৃদ্ধাশ্রম

।। ফাতেমা রিয়া ।।

“বৃদ্ধাশ্রমের নাম ‘মায়া’। মালিক মারা গেছেন কিছুদিন হলো। তার ছেলের হাতে পড়েছে বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্ব। ছেলে খুব একটা আগ্রহী না অবশ্য বুড়োদের পালতে। যদিও বিভিন্ন জায়গা থেকে ডোনেশন আসে। সেসব নিজের পকেটে সরিয়ে কোনোমতে বৃদ্ধাশ্রম চালানোই তার লক্ষ্য। এনা শুনেছে পরের মাসে তার বেতনও কমতে পারে। বৃদ্ধাশ্রমের হাসপাতালের দুরবস্থার একটা কারণ, আর ডোনেশনের টাকা ঠিকঠাক ব্যবহার না হওয়া। জ্বর, সর্দি, কাশির ও অন্যান্য চিকিৎসা মোটামুটি দেওয়া হয়। সিরিয়াস রোগীদের ব্যাপারে পরিবারের কাছে খবর দেওয়া হয়। তারা না আসলে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তারপর যতদিন বাঁচে। এই হলো হাসপাতাল!”

বৃদ্ধাশ্রম

রাত। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে তক্ষক। তক্ষক নাকি ‘কু’ ডাক দেয়। এনার ভয় লাগে। সে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললো, লা ইলাহা ইন্তি কুন্তু আন্তাস সোবাহানাকা মিনাজ জোয়ালেমিন।

পড়েও ভয় কমলো না। বরং আরো বেড়ে গেল। সে বসে আছে বারান্দায়। বারান্দার সামনে গাছগাছালি। দোতলা বাড়ি। দক্ষিণ দিকে একটা পুকুর আছে। পুকুরে মাঝে মাঝে ঝপাং ঝপাং শব্দ হয় রাতের বেলা। এনা আবার মনে মনে পড়ে ফেললো, লা ইলাহা, লা ইলাহা।

সে কাজ করে একটা বৃদ্ধাশ্রমের হাসপাতালে। ১৫ একর জমির ওপর বৃদ্ধাশ্রম। তার পাশেই দোতলা বাড়িতে একটা হাসপাতাল। যদিও হাসপাতাল বলা হয়। কাজের কাজ কিছুই না। একজন রাগী চেহারার ডাক্তার বিরস মুখে সারাদিন বসে থাকেন। তার জন্য থাকার রুমও আছে একটা। রাতের বেলা সেখানে তিনি টিভিতে স্টার জলসায় সিরিয়াল দেখেন। সিরিয়াস রোগী না হলে উদাস মুখে জবাব দেন, সকালে আসেন।

দুইজন সহকারী আছে। তারা সকালে আসে। বিকেল হতে না হতেই যাবার জন্য গাঁইগুঁই শুরু হয়। এনা এখানে নার্স। ১ মাস হয়েছে নিয়োগ পেয়েছে। বাবা মারা যাবার পর দুঃসম্পর্কের এক চাচা এই বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ দিলেন। এনা আসলো। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন। থাকা খাওয়া হাসপাতালেই। ইনজেকশন দেওয়া, স্যালাইন ঠিক করাটা শিখে নিতে হলো। এই ভুতুড়ে জায়গায় কোনো নার্স সহজে আসতে চায় না তাই তড়িঘড়ি করে এনাকে নেয়া হলো। আগেরজন নাকি পালিয়ে গেছে, আর ফিরিয়ে আনা যায় নি। এনার অভাবের সংসার। নাহলে কী আর জঙ্গলে বসে আয়াতুল কুরসি পড়তে হয়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

বৃদ্ধাশ্রমের নাম ‘মায়া’। মালিক মারা গেছেন কিছুদিন হলো। তার ছেলের হাতে পড়েছে বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্ব। ছেলে খুব একটা আগ্রহী না অবশ্য বুড়োদের পালতে। যদিও বিভিন্ন জায়গা থেকে ডোনেশন আসে। সেসব নিজের পকেটে সরিয়ে কোনোমতে বৃদ্ধাশ্রম চালানোই তার লক্ষ্য। এনা শুনেছে পরের মাসে তার বেতনও কমতে পারে। হাসপাতালের দুরবস্থা একটা কারণ, আর ডোনেশনের টাকা ঠিকঠাক ব্যবহার না হওয়া। জ্বর, সর্দি, কাশির ও অন্যান্য চিকিৎসা মোটামুটি দেওয়া হয়। সিরিয়াস রোগীদের ব্যাপারে পরিবারের কাছে খবর দেওয়া হয়। তারা না আসলে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তারপর যতদিন বাঁচে। এই হলো হাসপাতাল!

এনা এসেই এভাবে তিনজনকে মরতে দেখলো। শেষের জন একজন মহিলা। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল তার বিশ্বাসই হলো না ছেলে মেয়েরা আসে নি।

কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করলো সে কিছুদিন। শেষদিকে এনাকে ভাবত তার মেয়ে। তারপর একদিন বললো, রেবেকা, তোকে মানা করেছি না পরপুরুষের সাথে কথা বলতে। কিভাবে তোর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিল, ছিঃ!

এনা লজ্জায় হতভম্ব হয়ে গেল। সহকারী দুইজন মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
সে ইনজেকশনের ডোজ ঠিক করছিল। আজো মনে হয় হয়ত সে বেশিই দিয়েছে। নাহলে তারপরের দিন ঘুম থেকে আর উঠলো না মহিলা। সকাল নাগাদ শ্বাস গেল।
এনা ভয়ে ভয়ে রইলো। কেউ কিছু জানতে চাইবে কিনা। কেউ ঘাঁটালো না। যেন মৃত্যুটাই স্বাভাবিক। বিকেল নাগাদ তার ছেলে এসে লাশ নিয়ে গেল। অত্যন্ত উদাসীন, লাশ ছাড়তে সহকারীরা ঘুষ চাইলো। সেটাও দ্রুত দিয়ে সে লাশ নিয়ে সন্ধ্যার আগেই চলে গেল।
কী থেকে পালালো সে? অপরাধবোধ?
সেদিন রাতেই এনা স্বপ্ন দেখল, মহিলা তার কাছে এসেছেন। সে শুয়ে আছে। হাত পা বাঁধা।
মহিলার হাতে ওড়না। উনি বলছেন, রেবেকা, কতবার বলি ওড়না পর। তুই কি বারোভাতারি হবি? ছিঃ ছিঃ!
এনা দেখল, ওড়না জড়িয়ে তার মুখ চেপে ধরা হল। সে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, ছাড়, ডাইনী, ছাড়।

ঘুম ভেঙে গেল। এনা ঘুমায় রোগীদের বেডের পাশেই। ঘুম ভেঙে চারপাশে মরণাপন্ন মানুষ দেখে তার ভয় আরো বেড়ে গেল। সে আয়াতুল কুরসী পড়তে লাগলো দ্রুত।
একটা বড় রুমের মধ্যে ৫ টা বেড আড়া আড়ি পাতা। একটায় এনা ঘুমায়। সে সবার ডানের বেডে। ওইপাশ থেকেই রুমে ঢুকতে হয়।
রুমের মধ্যে পলেস্তারা খসে পড়েছে। সারাক্ষণ ফিনাইলের গন্ধ আসে। সবার বামে বিশাল জানালা, সেখান থেকে আসে বাতাস। এইদিকটা জঙলা।
এনা তাকিয়ে ভাবে, রক্ষা করো মাবুদ।
বারান্দা থেকে গোঙানি শুনতে পায় এনা। নিশ্চয়ই কারো মরার টান উঠেছে। সে যাবে না৷ মরে পড়ে থাক। সে গিয়ে তো আর আটকাতে পারবে না। গোঙানিটা বাড়ছেই। মাথার মধ্যে যেন আঘাত করছে।
নিচতলা থেকে ডাক্তার চিৎকার করে বললো, সব কি মরে গেছে? কেউ যাচ্ছে না কেন?  
এনা মনে মনে গালি দিল, তুই যা শালা গণ্ডার।
সে উঠল। সর্ব বামের জন গোঙাচ্ছেন। জানালার দিকে তাকিয়ে। চোখে কী অদ্ভুত ভয়।

এনার গা শিরশির করে উঠল। সে আস্তে আস্তে ওনার পাশে গিয়ে দাড়ালো। কপালে হাত রাখলো। উনি থামলেন। তবে হেঁচকি তুলতে লাগলেন।
একটু পর পর আস্তে আস্তে বললেন, আমি তোমারে মারি নাই মিরা। তুমি যে বলো আল্লা আমার বিচার করবে ঠিক না।
এনা বুঝলো নিশ্চয়ই পরিবারের কোন সদস্যকে কল্পনা করে বলছে এগুলো। সে বললো, না আমি তো বলি না।
সত্তরোর্ধ্ব বুড়ো স্বস্তি পেলেন মনে হয়। এনা এবার তাকিয়ে দেখলো, অভিজাত দর্শন এক সফেদ ভদ্রলোক। হাত পা সব কুঁচকে গেছে। চোখ ঘোলা।
— আপনে ঘুমান। ইনজেকশন দেব?
ভদ্রলোক চোখ মুদলেন, আস্তে আস্তে না সূচক মাথা নাড়লেন। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।

এই প্রথম এনার এখানকার কারো জন্য মায়া হলো। সে আস্তে করে কম্বল তুলে দিল উনার গায়ে। জানালা আটকে দিল। তার মনে হয় এই ভুতুড়ে জানালাই সব নস্টের গোড়া।

সকালে উঠে এনা শুনলো উনি মারা গেছেন। তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে সারা সকাল রোগীদের সাথে রুমেই কাটালো। দুপুর বেলা শুনলো ওনার মেয়ে এসেছে। সে বাইরে বেরোলো। কমবয়সী একটা মেয়ে। হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে হয়ত এনার বয়সী। তার চোখ ফুলে উঠেছে কাঁদতে কাঁদতে। এসব দেখতে এনার বিরক্ত লাগে। বুড়ো বাপ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়েছে, এখন এসেছে দরদ দেখাতে।
সে আবার ভিতরে যেতে উদ্যত হল। মেয়েটা ডাকলো, শোনেন।
এনা ফিরে তাকালো।
মেয়েটা তার কাছে এগিয়ে আসলো। একটু ইতস্তত করে বললো, আপনি কি উনাকে দেখেছেন মরার সময়?
— না। কাল রাতে দেখেছি। অনেক ভয় পেয়েছিলেন।
— কেন?
— মীরা না কার নাম ধরে বলছিল, আমি মারি নাই।

মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর বললো, আর কিছু বলেছে?
এনার অস্বস্তি লাগতে থাকে, সে বলে, না।
মেয়েটা তাকে ধরে পড়লো। বোন, বলেন প্লিজ। আর কিছু বলে নি?
এনা বললো, না।
মেয়েটা এনার সাথে রোগীদের ওয়ার্ডে আসলো। তার বাবা যেখানে ছিল সেখানটায় সন্তর্পণে বসে হুহু করে কান্না করতে লাগলো।
এনা একটু পর জিজ্ঞাসা করলো, ওনাকে এখানে এখানে রেখেছিলেন কেন?
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমার ভাইরা ভাবত বাবা মাকে মেরে ফেলেছে। মীরা আমার মায়ের নাম।
এনা চুপ করে রইলো। তারপর বললো, আপনি কি ভাবতেন?
মেয়েটা উত্তর দিল না। উঠে চলে গেল। বিকেল তিনটে নাগাদ যাবতীয় অফিসিয়াল ঝামেলা সেরে বাবাকে নিয়ে চলে গেল।
যাবার আগে এনার সাথে আর কথা বললো না। ফিরেও তাকালো না।

এনার গা শিরশির করে উঠল। সে আস্তে আস্তে ওনার পাশে গিয়ে দাড়ালো। কপালে হাত রাখলো। উনি থামলেন। তবে হেঁচকি তুলতে লাগলেন।
একটু পর পর আস্তে আস্তে বললেন, আমি তোমারে মারি নাই মিরা। তুমি যে বলো আল্লা আমার বিচার করবে ঠিক না।
এনা বুঝলো নিশ্চয়ই পরিবারের কোন সদস্যকে কল্পনা করে বলছে এগুলো। সে বললো, না আমি তো বলি না।
সত্তরোর্ধ্ব বুড়ো স্বস্তি পেলেন মনে হয়। এনা এবার তাকিয়ে দেখলো, অভিজাত দর্শন এক সফেদ ভদ্রলোক। হাত পা সব কুঁচকে গেছে। চোখ ঘোলা।
— আপনে ঘুমান। ইনজেকশন দেব?
ভদ্রলোক চোখ মুদলেন, আস্তে আস্তে না সূচক মাথা নাড়লেন। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।

ওয়ার্ডে একজন নতুন রোগী এসেছেন। তেমন কিছু না। জ্বর-সর্দি। ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্র মহিলা। উনি এখানেই থাকতে চান। যদিও সহকারীরা অনেক বললো, রুমে গিয়ে নাপা খেয়ে শুয়ে থাকেন। উনি থাকবেনই না। অনেক চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছিল এ নিয়ে।
মহিলা বললো, তোমাদের সংসার আছে, বাইরে জীবন আছে, আমার কি আছে শুনি? রুমে পঁচে মরতে হয়। সহকারীর একজনের নাম দুলাল, সে বললো, তাই বইলা রোগীদের সাথে থাকবেন। রাত হইলে ভূত আসে এখানে, আজরাইল আসে।

মহিলা বিচলিত হলেন না, গোঁ ধরে বললেন, দরকার হইলে আজরাইলের সাথে আলাপ করবো। তোমাদের কী? সরো এখান থেকে।
এনা গিয়ে ওদের সরিয়ে দিল, বললো, উনি থাকুক দুইদিন। একই ত কথা। ওনার খাবার এখানে দিয়ে দিও।

ওরা কয়েক পলক বিরক্তি দেখিয়ে চলে গেল। এখানে এনার অঘোষিত প্রভাব আছে এনা অবশ্য বোঝে। তাছাড়া রাত হলে এই আজরাইলের আখড়ায় থাকা তো কম কথা নয়। ভয় যে পেয়েছে তাও শোনা যায় না। নিশ্চয়ই এই মেয়ের সাথেও জীন আছে এটা সহকারীদের ধারণা। তারা চলে গেল।
মহিলা অনেক খুশি হলো ওর ওপর। ওনাকে সর্ব বামের বেডটাই দেয়া হল। পাশে জানালা।
এনা জানালার পরদা ঠিক করতে করতে বললো, ওদের কথাই ঠিক। রাত হলে জানালা দিয়ে ভূত আসে। বলে সে হেসে ফেললো।
মহিলা বললো, আর বোলো নাকো। কত দেখলাম। শিবমূর্তি নাচতে দেখেছি মন্দিরে, এ আর এমন কী।
এনা একটু অবাক হলো। তারপর বললো, আসলেই?
মহিলা নির্বিকারে বললেন, হ্যা। এজন্যই ত এখানে আসলাম। আনন্দ নাই জীবনে।
এনা ওনার পাশে বসলো, তারপর বললো, আপনার কয় ছেলে মেয়ে?
মহিলা বললো, নাই। দীর্ঘশ্বাস ফেললো বলেই।
— নাই মানে?
— আমার নানি বলত জ্বীনের আছর আছে আমার ওপর৷ তাই বাচ্চা বাঁচে না। কেউ বাঁচে নি। স্বামীও মরে গেছে কম বয়সে।

এনা হতভম্ব হলো। তারপর ‘একটু আসছি’ বলে চলে গেলো। সারাদিনে আর ওমুখো হলো না।

ফাতেমা রিয়া

তরুণ গল্পকার, উপন্যাসও লিখেছেন। দেশের বাড়ি বরিশাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন ও রাজনীতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

Share