বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বাংলার হালচাল

পর্যালোচনা

।। মোহাম্মদ আজম।।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসাবে বাংলার কথা-যে আমরা ভাবতে পারি নাই, এমনকি আজকাল-যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলায় উচ্চশিক্ষার কোনো প্রস্তাবকে ক্ষতিকর ভাবা হয়, তার এক কারণ আমাদের ঔপনিবেশিক অতীত। উপনিবেশে ‘জ্ঞান’ আসে ওপার থেকে; মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপনিবেশিত মানুষ জ্ঞানের উৎপাদক হিসাবে নিজেদের ভাবতে পারে না, এবং মনিবের জ্ঞান রপ্ত করতে পারাকেই সাফল্যের পরাকাষ্ঠা ভাবে। ইতিহাস পরিষ্কার সাক্ষ্য দিচ্ছে, কলকাতায় এ ঘটনাই ঘটেছিল; আর ভারতের অন্য জ্ঞানকেন্দ্রগুলোর সাথে শিক্ষা-প্রক্রিয়ার দিক থেকে বাংলা অঞ্চলের বেশ কতকটা ফারাক ছিল।


ফেরুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার হালচাল নিয়ে অনেককেই উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এটা খারাপ না। এই উদ্বেগের দরকার আছে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিপর্যস্ত অবস্থাটা খালি চোখে দেখা যায় না। কানে শুনেও মালুম হয় না। কারণ, এই জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে একভাষী। ফলে সর্বত্র বাংলা কথা শোনা যায়। কিন্তু ভাষার ব্যবহারের যেগুলো কার্যকর ও অভিজাত এলাকা— শিক্ষা, আইন ও অফিস আদালত— সেগুলোতে বাংলার অবস্থা এত শোচনীয় যে, উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। ফলে যাঁরা অন্তত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার ব্যাপারে সচেতন হন, তাঁদের প্রশংসা করতে হয়।

এদিক থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের জন্য আজকাল এক অতি প্রয়োজনীয় বরাত বা দোহাই হয়ে উঠেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি এক সর্বব্যাপ্ত সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে। একুশের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস, আর তার প্রায়োগিক বাস্তবতা কয়েক দশক ধরে এক অন্যরকম মূর্তি পেয়েছে ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরে। আমাদের বইমেলা এতটা জমজমাট হওয়ার পেছনে অন্তত মধ্যবিত্তের সামষ্টিক মনস্তত্ত্বে তৈরি হওয়া একুশপ্রীতির বড় ভূমিকা আছে বলেই মনে হয়। তার এক প্রমাণ এই যে, অন্য সময়ে বিভিন্ন ধরনের বইমেলা হলেও তাতে মেলার আমেজটা ঠিক জমে না। আমাদের জনমানসে এবং কেতাবি ভাষায় ফেব্রæয়ারি হয়ে উঠেছে ভাষার মাস। এই ভাষা বাংলা ভাষা। ফলে গণমাধ্যমগুলোর বৃহৎ পরিসরে বাংলা ভাষা নিয়ে আলাপ-আলোচনার একটা সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যও তৈরি হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে। বহুদিন হল, এর মধ্য দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘উন্নত’ বাংলাদেশ গড়ার তাত্তি¡ক-প্রায়োগিক আলাপও ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে উপস্থাপন করার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আশা করা যায়, এ আলাপ একসময় কার্যকর কর্মসূচির দিকে যাবে। আজকাল আমরা ভাবতে পারি না, ভাষাকেন্দ্রিক এরকম অনেক কিছু ক্রমশ বাস্তব ও সম্ভব বলে প্রতীয়মান হবে।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসাবে বাংলার কথা-যে আমরা ভাবতে পারি নাই, এমনকি আজকাল-যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলায় উচ্চশিক্ষার কোনো প্রস্তাবকে ক্ষতিকর ভাবা হয়, তার এক কারণ আমাদের ঔপনিবেশিক অতীত। উপনিবেশে ‘জ্ঞান’ আসে ওপার থেকে; মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপনিবেশিত মানুষ জ্ঞানের উৎপাদক হিসাবে নিজেদের ভাবতে পারে না, এবং মনিবের জ্ঞান রপ্ত করতে পারাকেই সাফল্যের পরাকাষ্ঠা ভাবে। ইতিহাস পরিষ্কার সাক্ষ্য দিচ্ছে, কলকাতায় এ ঘটনাই ঘটেছিল; আর ভারতের অন্য জ্ঞানকেন্দ্রগুলোর সাথে শিক্ষা-প্রক্রিয়ার দিক থেকে বাংলা অঞ্চলের বেশ কতকটা ফারাক ছিল। তবু বলতেই হবে, ভারত ইংরেজি ভাষাকে অবলম্বন করে উচ্চশিক্ষায় বেশ অনেকদূর সফল হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষদের জন্য ভারতের উদাহরণ ভালোরকম মায়া বা ঘোর তৈরি করেছে।
কেন একই ঔপনিবেশিক অতীতের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও ভারত ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত করে অনেকটাই সফল হল, আর বাংলাদেশ সে সাফল্য পেল না, তার নানারকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জরুরি। আপাতত আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গে দুটো কথা বলে রাখা দরকার। এক. ভারতের সাফল্যের ধরন জাপান বা চীনের সাথে তুলনীয় নয়। সেখানে পুরো ব্যাপারটা উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির মামলা; এবং ভারতের আধুনিকায়ন বা উচ্চশিক্ষার বিস্তার তাদের বড়জোর তিরিশ কোটি মানুষকে স্পর্শ করতে পেরেছে। জীবনযাপনগত সর্বজনীন সূচকে ভারত-যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশ তলানিতে থাকে, তার পেছনে তাদের শিক্ষা ও ভাষা-পরিস্থিতির ভূমিকা কী, তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। দুই. ভাষা-পরিস্থিতির দিক থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের আদতে কোনো তুলনাই চলে না
উচ্চশিক্ষায় বাংলার অবস্থা আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যথার্থ আয়না। আপনি বলতে পারেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলা আছে — অন্তত আংশিকভাবে; সংখ্যা হিসাব করে এমনকি এও বলা যাবে, অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বাংলা মাধ্যমে পড়ছে। শিক্ষার মাধ্যম বলতে আমরা বুঝব শ্রেণিকক্ষের ভাষা, উত্তরপত্রের ভাষা এবং পাঠ্যপুস্তকের ভাষা। সেদিক থেকে আমাদের এখানে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এবং মেডিক্যালে কখনোই বাংলা ছিল না। যেমন ছিল না প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশক আগেও বেশির ভাগ বিভাগে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়া যেত; এখনো পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, কেউ বাংলায় পরীক্ষা দেয় না। সামগ্রিক আবহের মধ্যে—বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের এবং বাইরের — একটা কার্যকর বিরোধিতা আছে। সুতরাং এ কথা প্রথমেই বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় আসলে বাংলা নেই। বাংলা আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারে না বলে বাংলা ব্যবহার করে। এবং আসলে ওরা বাংলাও ব্যবহার করতে পারে না, যে অর্থে আমরা উচ্চশিক্ষায় বাংলা বা অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার বোঝাই। ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা পড়েছে থেকেও না থাকার সংকটে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন না হলে আসলে কোনো আলাপই কাজের দিক থেকে জমবে না।

উচ্চশিক্ষার এই পরিস্থিতিটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে দক্ষতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে সুবিধা করতে পারছে না — এরকম একটা যুক্তিই আসলে আগে থেকেই ইংরেজি অবলম্বনের ন্যায্যতা তৈরি করে। বাংলাদেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণি আগে থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ত। প্রায় দুই দশক হয়ে এল, শিশু শ্রেণি থেকেই ইংলিশ ভার্সন চালু করেছে সরকার। ফলে বাংলা মাধ্যমে পড়ে কেবল তারা, যারা ইংরেজি কিনতে পারে না। রাষ্ট্র একটা শ্রেণিমূলক প্রতিষ্ঠান, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য অংশই কার্যত রাষ্ট্র চালায়। কাজেই যদি শিক্ষার মাধ্যমের ক্ষেত্রে শ্রেণিপ্রশ্ন আমলে না এনে কেবল সংখ্যা বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে সেটা খুব একটা কাজের হবে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোনো স্তরেই বাংলা নেই। এটাই বাস্তবতা। আর এই বিস্ময়কর বাস্তবতা তৈরি হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

প্রশ্ন হল, এই অবস্থা অনেকদিন ধরে কীভাবে চলছে, এবং কেন মনে হচ্ছে যে এতেই আমাদের কাজ চলছে। যে কথাটার উপর জোর দিতে চাই তা হল, দুনিয়ার কোনো দেশই আসলে অন্য ভাষায় শিখিয়ে উন্নতি করতে পারেনি। তাহলে এই যে বাংলাদেশে ইংরেজিটা চলছে, এটা চলতে পারছে কেন? চলতে পারছে তার কারণ — সোজা বাংলায়— আমরা আসলে শিক্ষাটা দিচ্ছি না।

কিন্তু এ কথারই বা অর্থ কী? শিক্ষা নাই মানে কী? তাহলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা করিটা কী? আমরা আসলে শিক্ষার নামে কিছু স্কিল সরবরাহ করি। স্কিল দিয়ে যে কাজ চলে আমরা ঠিক সেই কাজই করছি। ইউজিসির বিশ-বছর-মেয়াদি কৌশলপত্রে এ কথাই বলা হয়েছে, এই উদ্দ্যেশ্যের কথাই বলেছে। ওই কৌশলপত্রে শিক্ষার মাধ্যমের কথা একেবারেই আনা হয়নি। তার কারণ, এরা ধরে নিয়েছে, মাধ্যমটা ইংরেজি হয়েই আছে। আর ওই কৌশলপত্রে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করা।

তাহলে আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা-যে চলছে বলে মনে করছি, তার প্রধান কারণ হল, আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী সরবরাহ করছি, অথবা একেই প্রধান লক্ষ্য বলে সাব্যস্ত করছি। আর দেশের অভ্যন্তরেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লোক তৈরি করছে সেবাখাতের জন্য। কাজটাকে সরল করে বলা যায় পণ্য বিক্রির কাজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে চলছে মনে হয়, তার কারণও ওই একই। ওই ছাত্র-ছাত্রীরা বের হয়। শ্রেণিভিত্তির কারণে এবং সামাজিক যোগাযোগের কারণে সেবাখাতে কাজ পায়। এ দুটো — দেশীয় সেবাখাতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মী সরবরাহ —আমাদের মূল লক্ষ্য বলে ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষায় কাজ চলে। এটা কোনো ‘এজুকেশন’ নয়, বড়জোর টেনেটুনে ‘ইনস্ট্রাকশন’।

উল্লেখ করা দরকার, আমাদের রাষ্ট্র আমাদের জ্ঞানে চলে না। বাংলাদেশে এমন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা নেই যা রাষ্ট্র চালানোর মতো জ্ঞান তৈরি করবে। আমরা আমাদের ফতোয়ায় রাষ্ট্র চালাই না। রাষ্ট্র চালানোর জন্য যাবতীয় প্রযুক্তি আমরা বিদেশ থেকে ধার করি। বিস্ময়কর নয়, এমনকি হয়ত আমাদের বাস্তবতায় লজ্জাকরও নয়— আমাদের ইউজিসি’র বিশ-বছর-মেয়াদি কৌশলপত্র বানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। শুধু শিক্ষা নয়, সব ব্যাপারেই আমরা রাষ্ট্র চালানোর প্রয়োজনীয় ‘জ্ঞান’ বা ফতোয়া বিদেশ থেকে ধার করি। ফলে আমাদের-যে ‘শিক্ষা’ নাই তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হয় না। আরেকটা সত্য এই যে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের বিপুল অধিকাংশ ছেলেমেয়ে মনে করে, বাংলাদেশে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যেতে হবে বিদেশে। ফলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়লে কাজটা একটু এগিয়ে রাখা যায়।

এসব কারণে মনে হচ্ছে, আমাদের ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা ভালোই চলছে। কিন্তু আসলে শিক্ষার বদলে আমরা শিখছি ‘মাধ্যম’। অর্থাৎ, ইংরেজিটাই শেখানো হচ্ছে, ইংরেজির মাধ্যমে কোনো ‘বিষয়’ নয়। ফলে কাজ চলছে। বিদেশে এবং দেশে সার্ভিস সেক্টরে। কিন্তু এ অবস্থা আসলে চলতে পারে না। আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে, দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা দরকার। বস্তুত কর্পোরেট অফিসগুলো চালানোর মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হয়ে উঠছে না।

যদি আমরা গুণ-সম্পন্ন শিক্ষা চাই, যদি জ্ঞান-উৎপাদক শিক্ষা চাই, যদি এমন শিক্ষা চাই যেখানে আমাদের উচ্চশিক্ষায় উৎপাদিত স্পর্শকাতরতা কার্যকরভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র চালাবেন, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচে পালটাতে হবে। অনেকগুলো বড় পরিবর্তন করতে হবে। সেই পরিবর্তনের প্রথমটি হবে, সম্ভবত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলায় শিক্ষা দেয়ার জন্য, এখনকার বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার দিকে অল্প অল্প করে এগোতে হবে। কারণ, যেমনটি আগেই বলেছি, শিক্ষায় বাংলা আসলে নেই। নেই বলেই কোনো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিলে ভোক্তাস্তরে সম্মতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ধীরে ধীরে সামাজিক সম্মতি তৈরি করতে হবে; একই সাথে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যবহারিক দিক থেকে প্রস্তুত করার কাজটাও সমানতালে চলবে।

কী কী উদ্যোগ নিতে হবে? বাংলা এবং ইংরেজিকে পরস্পরের বৈপরীত্যে স্থাপন করে আমাদের এখানে একটা সামাজিক কুসংস্কার জোরালভাবে জেঁকে বসে আছে, সেটা দূর করা হল প্রধান কাজ। আমাদের প্রত্যেক সক্ষম বাবা-মা আসলে এটাই মনে করেন। এটা একটা সামাজিক কুসংস্কার, এবং এর নিরসন ব্যক্তির কাজ নয়। ব্যক্তি যে কোনো কিছু মনে করতে পারে, এবং তার প্রতি গণতান্ত্রিক কায়দায় শ্রদ্ধাশীল থাকতে রাষ্ট্র বাধ্য। রাষ্ট্রকেই নানাবিধ বাস্তব তৎপরতা নিয়ে বোঝানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে যে দুটি ভাষা আসলে কার্যক্ষেত্রে পাশাপাশি চলতে পারে। সারা পৃথিবীর মানুষ যে দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষা শেখে, দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষার এমনকি সৃজনশীল বা জ্ঞানজাগতিক ব্যবহার করে, এই বাস্তবতাটা সামনে আনতে হবে। বাংলাদেশের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতায় এটাই হবে প্রথম কাজ।

দ্বিতীয়ত, পাঠ্যপুস্তক তৈরি হবে এবং পরিভাষা তৈরি হবে— এজন্য একদিনও অপেক্ষা না করে উচ্চস্তরে বাংলা ব্যবহার শুরু করতে হবে। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, পরিভাষা আসলে বাংলা বা ইংরেজির বিষয় নয়। আমাদের শিক্ষাজগতের লোকজনের মধ্যেও এ বোধ খুবই দুর্লভ। আসলে পরিভাষা সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার। আর পরিভাষা তৈরি করবে সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনের চর্চাকারীরা, একেবারেই তাদের চর্চার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কাজেই পরিভাষা এবং ভাষার জন্য একবিন্দু সময় ব্যয় না করে আসলে শুরু করতে হবে আজই, আংশিকভাবে, যেহেতু হঠাৎ করে পুরোটা বাংলায় প্রবর্তন করা এখনই সম্ভব নয়। ক্রমাগত বাড়িয়ে, অল্পদিনের মধ্যে আমাদের এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে হবে, প্রাইভেট এবং পাবলিক সর্বত্র, যেখানে উচ্চস্তরের শিক্ষার্থীরা বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় লিখতে, পড়তে, এবং পরীক্ষায় উত্তর দিতে পারবে। শুধু বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে এমন ছেলে-মেয়ে এবং বাঙালি বা বাংলাভাষী নয়, এমন শিক্ষার্থীদের এ প্রকল্পের বাইরে রাখা যেতে পারে। এর বাইরে বাঙালি বাবা-মায়ের ছেলে-মেয়ে, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জন্মেছে এবং বড় হয়েছে, এদের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে উচ্চশিক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজিকে কার্যকরভাবে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আগামী অনেক দিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত না আমরা বাংলাকে সরাসরি এককভাবে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করি। ফলে, আপাতত আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, উচ্চশিক্ষা শেষে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেন দ্বিভাষিক দক্ষতা অর্জন করে।

তৃতীয় ধাপে যেতে হবে আরো অনেকদূর। আমরা যদি সত্যিই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করতে চাই তাহলে আমাদের ঢুকতে হবে গবেষণা-স্তরে, আর সেই গবেষণাটা করতে হবে বাংলায়। এখানে আর একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি : সত্যেন বোস প্রমুখ বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন বলে একটা কথা খুব চালু আছে। কথাটা ঠিক নয়। তাঁরা যেটা করেছেন তাকে বলতে পারি, বাংলায় বিজ্ঞানরস পরিবেশন করা। এটা অন্য ধরনের সাহিত্য মাত্র। একটা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা আর বিজ্ঞানরস পরিবেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা অ্যাকাডেমিক অর্থে কখনোই হয়নি। বিজ্ঞানীরা কখনো কখনো নিজেদের বা অন্যদের গবেষণার ফল সরলভাবে জনগণের জন্য প্রচার করেছেন। এটাকেই আমরা ভুলভাবে বলেছি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা। সত্যিকার বিজ্ঞানচর্চায়— এবং কলা, বাণিজ্য ও সমাজবিজ্ঞানেও — বাংলা ব্যবহারের জন্য উচ্চডিগ্রির সন্দর্ভে বাংলা আবশ্যিক করতে হবে। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা এবং বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে সন্দর্ভ রচনা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ নিশ্চিত করেই এটা করা সম্ভব। গবেষণা-সন্দর্ভ বাংলায় না লিখলে বাংলা ভাষার সেই আভিজাত্য এবং কার্যকরতা কখনোই সম্ভব নয়, যে আভিজাত্যের চাপে উচ্চ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত শিক্ষা-মাধ্যমের বাজে আলাপ চিরতরে নির্মূল হবে।

আজকাল দেশে খুব উন্নতির জিকির চলছে। এটা আসলে বাকোয়াজি; ঠিক রাজনৈতিক সুভাষণের পর্যায়েও পড়ে না। দেশে সর্বজনীন বাংলা-মাধ্যম পড়াশোনা চালুর কোনো কার্যকর উদ্যোগ গৃহীত হলেই কেবল বোঝা যাবে, বাংলাদেশ উন্নতির পথে পা বাড়িয়েছে। আর উচ্চশিক্ষা বাংলা ভাষায় করতে পারলে নিশ্চিন্তে বলা যাবে, বাংলাদেশ কল্যাণময় উন্নতির সিঁড়িতে পা রেখেছে।

মোহাম্মদ আজম

জন্ম ২৩ আগস্ট ১৯৭৫, হাতিয়া, নোয়াখালী। এম এ বাংলা, ঢাবি, পিএইচ ডি, ঢাবি। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাবি। প্রকাশিত বই : প্রবন্ধ ও গবেষণা— বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ [আদর্শ, ২০১৪, ২০১৯] বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার [প্রথমা, ২০১৯, ২০১৯] কবি ও কবিতার সন্ধানে [কবিতাভবন, বাতিঘর, ২০২০] হুমায়ূন আহমেদ : পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য [প্রথমা, ২০২০] সম্পাদনা— নির্বাচিত কবিতা, সৈয়দ আলী আহসান [বাংলা একাডেমি, ২০১৬] ই-মেইল : mazambangla1975@gmail.com

Share