বঙ্গের লোকজগতই সুলতানের চিত্রজগত

।। অতনু সিংহ ।।

অখণ্ড বাংলার চিত্রকলা জগতের নক্ষত্র এস এম সুলতানের চিত্রজগৎ ও তাঁর প্রকৃতিনিবিড় জীবনের নানাকিছু নিয়ে তাঁর জন্মদিনে লিখেছেন অতনু সিংহ

তিনি বাংলার লোকজগতকে এমনভাবে চিত্রায়ত করেছেন, যাতে সে জগতের সমৃদ্ধির চিত্র প্রকাশ পায়। তাঁর ছবিতে কৃষকের ছবি ক্লিষ্ট-শীর্ণ নয়, বরং পেশিবহুল। তাঁর ছবিতে নারীরা যেমন কোমল তেমনই সবল। এস এম সুলতান এই ব্যাপারে বলছেন, “আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেটাও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ের ঘাড়ে ভর করেই ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়, আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়?”

বঙ্গের লোকজগতই সুলতানের চিত্রজগৎ

লৌকিক বাংলার অধুনান্তিক চিত্রকর শেখ মোহাম্মদ সুলতানের আজ জন্মদিন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, গণেশ পাইন, জয়নুল আবেদিন, রামকিঙ্কর বেইজ, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ কিংবদন্তী চিত্রকরদের চিত্রসম্ভারে সমৃদ্ধ বাংলা তথা উপমহাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে এক বিশেষ নক্ষত্র এস এম সুলতান। যে অস্তিত্ব উপমহাদেশে আর্যীয় ক্ষমতায়নের আগে থেকেও  অনেক পুরোনো, যে বঙ্গ মানে নদীমাতৃক কৃষি সভ্যতা, যে বঙ্গ মানে লোকসমাজের কৌমযাপন, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা সেই দেশকেই চিত্রায়িত করে গেছেন এস এম সুলতান।

সুলতানের বিষয়ে আলাপ করতে গেলে ইম্প্রেশনিস্ট ধারায় গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী পল গগাঁর চিত্রস্মৃতি আলোচনায় উঠে আসবে। ফ্রান্সের গগাঁ প্যারিস, আরবান আবহ, বুর্জোয়া চিত্রপ্রকরণ থেকে নিজের শ্রেণীচ্যুতি ঘটিয়ে তাঁর চিত্রকল্প ও বাস্তবতাকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর জেগে থাকা তাহিতি দ্বীপের ভূমিপুত্রদের লৌকিক মায়াজগতে। আধুনিকতার বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিবাদ ইত্যাদি সমান্তরালে তাহিতি সিরিজের ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি উন্মোচিত করেছিলেন প্রকৃতিনিবিড় মানুষের কৌমযাপন। তাঁর ওই ছবিগুলির মধ্যে দিয়ে ইউরোপিয় আলোকায়নের বিপ্রতীপে  থাকা আলো-আঁধারি এক মায়া জগত প্রকাশিত হয়েছিল। নাগরিক পরিসর থেকে লোকপরিসরে নিজের অভিমুখ পরিবর্তনের জন্য ইম্প্রেশনিস্ট গগাঁ আধুনিকতার পরিধিকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ইউরোপীয় আধুনিকতার পরিখা পেরিয়ে নিজের শিল্পীসত্ত্বাকে অন্য খাতে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে।  কিন্তু বাংলার  সুলতানের পারিপার্শ্ব ইউরোপীয় সভ্যতার বিপ্রতীপ এক জগত, তাই লোকযাপন মগ্ন এই শিল্পীকে লৌকিক সৃজনের জন্য বেশি দূর কোথাও যেতে হয়নি। বরং বাংলার বাবুসমাজের অধিকাংশের নান্দনিকতা ও শিল্পভাষা যখন ইউরোসেন্ট্রিক, তখন নিজের পারিপার্শ্ব, পরিসর ও তার স্বপ্ন-স্মৃতিকে চিত্রায়িত করে গেছেন এস এম সুলতান। কৃষিনির্ভর বাংলাকে ঘিরে তাঁর স্বপ্ন এক লৌকিক স্বপ্নবাস্তবতা তৈরি করেছিল ক্যানভাস জুড়ে।

তিনি বাংলার লোকজগতকে এমনভাবে চিত্রায়ত করেছেন, যাতে সে জগতের সমৃদ্ধির চিত্র প্রকাশ পায়। তাঁর ছবিতে কৃষকের ছবি ক্লিষ্ট-শীর্ণ নয়, বরং পেশিবহুল। তাঁর ছবিতে নারীরা যেমন কোমল তেমনই সবল। এস এম সুলতান এই ব্যাপারে বলছেন, “আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেটাও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ের ঘাড়ে ভর করেই ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়, আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়?”এছাড়া তাঁর ছবিতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতা উঠে এসেছে। তাঁর এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি, হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এবং চরদখল(১৯৮৮)।

১৯২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বাংলার নড়াইলের একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে এস এম সুলতানের জন্ম।  ১৯২৮ সালে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে তিনি ভর্তি হন। দারিদ্র্যের কারণে সেখানে মাত্র পাঁচ বছর অধ্যয়নের পর তিনি সেই বিদ্যালয় ছেড়ে বাড়ি ফিরে বাবার সহোযোগী হিসেবে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। এ সময় বারার ইমারত তৈরির কাজ সুলতানকে প্রভাবিত করে এবং তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজের ফাঁকে ছবি আঁকা শুরু করেন। তাঁর ছবিতে মুগ্ধ হয়ে ১৯৩৮ সালে তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাঁকে চিত্রকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা করতে কলকাতায় পাঠান। এই সময় চিত্রকলার অন্যতম বোদ্ধা ও আলোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালন কমিটির সদস্য সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে পরিচয় হয় সুলতানের। তিনি ১৯৪১-১৯৪৪ সাল পর্যন্ত্য কলকাতায় পড়াশুনা করেন। বাংলা ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। এখানে কিছুদিন থেকে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে কিছুদিন একটি পার্সি স্কুলে চিত্রকলার শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৫১ সালে আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। সেখানে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো ও বস্টনে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তবে জীবনের নানা সময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকেছেন তিনি। জীবজন্তু ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল অগাধ টান। একটি চিড়িয়াখানাও প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ছবি আঁকার পাশাপাশি মগ্ন হয়ে বাঁশি বাজাতেন। তাঁর ছবির গুণগ্রাহী ছিলেন সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। উল্লেখ্য, আহমদ ছফাই সুলতানের কাজের সঙ্গে বাংলা তথা উপমহাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি মহলকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিচিত করান এবং পরে হাসনাত আবদুল হাই সুলতানের জীবন অবলম্বনে ‘সুলতান’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পুর্ব বাংলায় এস এম সুলতান এবং পশ্চিম বাংলায় রামকিঙ্কর বেইজ বাংলার প্রান্তিক-লৌকিক জগতকে তুলে ধরেছেন তাদের চিত্রকর্মে। উপমহাদেশে ঢাকা ছাড়াও ভারতের সিমলা ও পাকিস্তানের করাচিতে সুলতানের চিত্রকলার প্রদর্শনী তাঁর জীবনের প্রতিষ্ঠার শুরুতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সামরিক হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। অখণ্ড বাংলার এই প্রবাদপ্রতীম চিত্রকরকে ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার তরফে জানানো হচ্ছে গভীর শ্রদ্ধা।

অতনু সিংহ

কবি, গদ্যকার, ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।

Share