ফুচকাওয়ালা

।। জেসমিন নাহার ।।

“আরিফ যে বাজারে বসে ফুচকা চটপটি বিক্রয় করে তার সম্মুখেই রাস্তা। গলি বললে ভালো হয়। আর ঢাকা শহর তো আঁকাবাঁকা বাহান্ন হাজার তিপ্পান্ন গলির শহর। রাস্তায় দাঁড়ানো কাস্টমারগুলো ছুটে বাজারের উপরে উঠে আসে। ভিড়ের মাঝে একজন মেয়ে তার বান্ধবীর থেকে দূরে গিয়ে একা দাঁড়ায়। তার বান্ধবীটা তাকে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজে বেশ জোরে বলে, আরে তরে কি ভুতে লয়া যাইতাছে? এই জাগায় খাড়া।”


আইচ্চা হুনেন, আপনে আমার থাইক্কা দুই কেজি চটপটি, এক কেজি লবণ আর এক কেজি পেঁয়াজ লয়া আইছেন?
এ্যা রে রে কী কয় দ্যাখো এককেজি! হাফ কেজি পেয়াজ লয়া আইছি। মুহূর্তে বশিরের কথায় ছেদ পড়ে, বিদ্রোহ করে ওঠে সাকিব এবং ইয়াসমিন।
বশির বলে, হ, অইলো, এহন গে এইগুলা রাইখ্যা জলদি কইরা ডাইলপুরি দে এক প্লেট।
খাইবেন না লয়া যাইবেন? জিজ্ঞাসা করে আরিফ।

বশির জবাব দেয়, এইহানেই। পরক্ষণেই বলে, না এডি খাইতাম না, আমার মন চাইতাছে খাইতে, তয় খামু না, আমারে এট্টু ঝাল নুন বাড়াইয়া ফুচকা দে, খামু। ঝাল নুন কইলাম বাড়াইয়া দিস।
আরিফ মুখ কুঁচকে বলে, আরে দিমু এডি ছারা আপনের ফুচকা অইবো ক্যামনে? এগ্লা দিয়েই তো আপনের ফুচকা। এহন কন বাকি খাইবেন নাকি টিয়া দিবেন?

টিয়া দিমু তয় পরে। জবাব দেয় বশির।
আরিফ বলে, তাই কন, এজন্য আইসা সারাই আমার বাকির খাতা উল্টাইতাছেন। বাকির হিশাব নিয়া চিল্লাচিল্লি হলো একটু আগেই। আরিফ ফুচকা, বেলপুরি, চটপটি, ছোলা আর ঝালমুড়ি বিক্রেতা, শুধু ফুচকা না। কিন্তু ফুচকার জন্যই তার নামডাক। ফুচকাওয়ালা।

করোনাকালীন বৃষ্টির শহরে অতি সাধারণ এক ফুচকাওয়ালার দোকানের ছবি আঁকা কঠিন কাজ। এটা গল্প না, নেহাতই বর্ণনা। কিন্তু গল্প তো বর্ণনাই। গল্পে ঘটনা থাকতে পারে, কিম্বা নাও থাকতে পারে। গল্পে চরিত্র থাকে বুঝলাম। কিন্তু বর্ণনাও চরিত্রের বর্ণনা হতে পারে। চরিত্রগুলো ফুচকা, বেলপুরি, ছোলা আর মুড়ির কাস্টমার হয়ে  আরিফের কাছে আসে। তখন দুইপক্ষকেই চেনা যায়। বর্ষায় আরও ভালভাবে। চরিত্রগুলোর ওপর বৃষ্টি পড়তে থাকে। এখন বৃষ্টি পড়ছে। তাহলে বর্ণনার চেষ্টা করি? ক্ষতি কি?

শুক্রাবাদের অলিতে গলিতে আরিফকে দেখা যায়, ভ্যানে করে তার জিনিসপত্র বিক্রি করে বেড়াতে। এখন বর্ষাকাল,  সময়ে অসময়ে ঝুম ঝুম বৃষ্টির আগমন। বিকাল তিনটার পরে তাকে দেখা যায়।  মানুষের এই খাবার গুলোর প্রতি সহজাত আকর্ষণ আছে। শরীরের কোনো কাজে লাগে না কিন্তু মানুষের খাদ্য তালিকার প্রিয় খাবারের মধ্যে এইসব রসনাবিলাস স্থান করে নিয়েছে। শুক্রাবাদ কাঁচাবাজারের দোকানিদের ক্লান্ত হয়ে পড়া কর্মীদের বিশ্রাম আর খাওয়ার একটা প্রিয় স্থান আরিফের ফুচকা-চটপটির ভ্যান। আর শুক্রাবাদের বড় বড় বিল্ডিংয়ের মালকিন এবং তাদের সন্তানেরাও তার নিয়মিত কাস্টমার।

বশিরের খাওয়া শেষ হয়, প্লেটটা আরিফের দিকে বাড়িয়ে বলে, আরেক প্লেট দ্যানচাইন। সাজানো ফুচকার প্লেটটা হাতে নিয়ে বলে, বুড়ি সাথ আয়ো, খাওন শ্যাষে এডি লয়া আয়ো। বুড়িটা আরিফের দোকানের মহিলা কর্মী। নাম ইয়াসমিন। ফুলের নামে নাম তার, কিন্তু সে কি প্রস্ফুটিত হবার আগেই ঝরে পড়বে? বয়েস নয় দশ। প্লেট ধোয়া কাজ তার। মানুষ খেয়ে প্লেট বালতিতে রাখা মাত্র ধুয়ে টেবিলের উপরে রাখছে। ধুয়ে রাখছে ঠিকই কিন্তু একই ময়লা পানিতে বারবার ধুয়ে রাখছে। কারোর তাতে ভ্রুক্ষেপ নাই। সকলে এ খাবারে আসক্ত,  পতঙ্গের ন্যায় এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের খেতেই হবে। আসছে, খাচ্ছে, গল্প করছে,  টাকা মেটাচ্ছে, আর চলে যাচ্ছে।

বশিরের কথায় ইয়াসমিনের কোনো আগ্রহ জাগে না, সে বলে, এ্যা পারুম না, এহানের কাম করবো কেডা? আপনে?
তাদের কথার মাঝে আরিফ বলে ওঠে, এই কারে কী দিমু? ভাই বলেন, আপনারা কী খাইবেন? কী দিমু? চটপটি?  এই কালাম ভাই কি মরিচ খাইবেন? দেশি মরিচ নাকি বুম্বাই মরিচ? কালাম বলে, দিয়া ল, যে ঝাল পারিস, দিয়া ল। আরিফ চটপটি বানাতে থাকে আর কাস্টোমার ডাকে, কি খাইবেন, আয়েন, ঝালমুড়ি, চটপটি, ফুচকা।

ব্যস্ত মানুষেরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যায়,  তার ডাকের পরোয়া করে না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, একজন কইছিল, এহন পাত্তা দ্যাও না যে, এমন সময় আইবো, কাস্টমার ডাইকাও পাইবানা যে। হে সময়ই  আইছে, কাস্টমার ডাইকলেও কি আর অহন পাওন যায়? হে সময় অহন খালি স্মৃতি।.
.তারপর বলে, কালাম ভাই, এইহানে জেডি আছে, এগুলোই দিমু। মগের মধ্যে ঘুঘনি দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে তার কর্মী সাকিব বলে, বেশি লাইগবো না, কমাই দ্যান। বুম্বাই মরিচ কম আছে। হাসির কথা হইলো গিয়া একটা ভিডিও দেখছিলাম একজন ভাত খায়, আর বুম্বাই মরিচের ঘেরান লয়। হেই ভিডিও ভাইরাল। হা হা।

ব্যস্ত মানুষেরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যায়,  তার ডাকের পরোয়া করে না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, একজন কইছিল, এহন পাত্তা দ্যাও না যে, এমন সময় আইবো, কাস্টমার ডাইকাও পাইবানা যে। হে সময়ই  আইছে, কাস্টমার ডাইকলেও কি আর অহন পাওন যায়? হে সময় অহন খালি স্মৃতি।.

আরিফের ক্ষুদ্র দোকানের সামনে দুজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মেয়ে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে তাদের জামার পেছনের দিক দেখে। বলে ভগবান! বলেই নিজেদের ভাষায় কথা বলতে থাকে। তাদের কথা বোঝা যায় না তবে ইশপিশ কার্যাবলী দেখে বুঝা যায় তাদের জামার পেছনে কালো কাদা লেগেছে। সেই কাদাকে আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিকে বকা দিচ্ছে। ঢাকা শহরের অলি গলিতে পঁচা কালো কাদা, গ্রামের কাদায় হাঁটা যায়, গোবর গাদার পাশের কাদাতেও  পা দিতে ঘৃণা বোধ হয় না। কিন্তু এই ইঁট বালি খোয়া দিয়ে তৈরি বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা শহর বর্ষাকালে নোংরা হয়ে ওঠে, পায়ে কাদা লাগলে ঘরে ফিরে গরম পানি দিয়ে না ধোয়া পর্যন্ত গা ঘিনঘিন করতে থাকে, আর কোন ড্রেন খোলা থাকলে তো কথাই নেই, ময়লা পানির সাথে মানুষের পায়খানা ভেসে যায়। তারই মাঝে আসমানিদের রান্না খাওয়া চলে।

না এই আসমানিরা জসীমউদ্দিনের আসমানির মতো গরিব না। বড়োলোক আসমানি। তারা ভাবে বাইরে যামু, অফিস করমু, বাজার করমু আর ঘরে ঢুকমু। কাদা এবং অপরিস্কারে তাদের কোন মাথাব্যথা নাই। মেয়েগুলো বেশ বিব্রত, তবু তাদের খেতে হবে ফুচকা। তারা না খেলে আরিফের ব্যবসাও লাটে উঠবে। তাদের দেখে আরিফ হাসি দেয়, বলে আপারা আবার খাইবেন? মেয়ে দুটো বলে, আমরা তো এখনই আসলাম। ক্যান, আপনেরা না বিকাল খাইয়া গ্যালেন?
একজন মেয়ে হাসে, জিজ্ঞাসা করে যারা আসছিলো তাদের হাতে খাতা ছিলো? আরিফ বলে, আরে আমি লেহাপড়া জানিনা, কইতাছি যে তাইলে যারা আইছিলো তারা আপনাগো কী লাগে?
মেয়েদের একজন জবাব দেয়, আমার মাসতুতো বোন। আরিফ বলে, কিভাবে কারে চিনমু কন। চিনে যে সব একরকম মানুষ থাহে, কিভাবে চিনমু, হ্যাগো মতো অইছে আপনাগো চেহারা।
মেয়ে দুটো মুখ কুঁচকায়, দেখতে আবছা ভেজা মেয়েদুটোকে অসাধারণ সুন্দর লাগে, বলে হায়, ভগবান!  আমরা বাংলাদেশি। জীবন্ত কোনো খাদ্য খাই না, ভিডিও তো দেখেছি চীনাদের খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে ভিডিও। তারা জীবন্ত সব অক্টোপাস, ঝিনুক, শামুক খায়। মরে গেলে খেতে কী সমস্যা! স্যাভেজ!
আরিফ এগুলো বোঝে না, বলে আপনারা কয় ভাইবোন? মেয়েটা বলে আমরা তো তিন। মানে তারা তিন ভাইবোন। তারা বলে একটা বিশ টাকার আরেকটা ত্রিশ টাকার ফুচকা দেন।
আরিফ জিজ্ঞাসা করে এডি কি প্রচুর ঝাল অইবো? একজন প্লেট দেখিয়ে বলে, বিশ টাকার টাই ঝাল দিবেন। আরেকজন বলে, না।

এরা সিলেটের মণিপুরি ‘উপজাতি’। থুক্কু ‘আদিবাসী’। আরিফের নিত্যদিনের কাস্টমার। তাদের সকলের চেহারায় মিল থাকাতে তাদের চিনতে আরিফের সমস্যা হয়। সে প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করে, আর মেয়েগুলো প্রতিদিন হাসি মুখে তার ভুল ভাঙিয়ে দেয়। আরিফ তাদের কোনদিন জাপানের আবার কোনদিন চিনের মানুষের সাথে তুলনা করে। আরিফ ফারাক জানেনা। না জেনেই সে তাদের জাত চিনিয়ে দিতে ব্যস্ত থাকে। এতে মেয়েদের অসুবিধা নাই। তারা মজা করেই আরিফের ফুচকা খায়।

একটা গান আছে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যেও ভাইরাল:  এখান তোকে মানাইছে নারে, এক্কেবারে মানাইছে নারে। উপমহাদেশ নানান ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দেশ। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম না। সত্যিই বাংলাদেশে মানাচ্ছে না তাদের। তবুও এটাই বাংলাদেশ। আমরা সংকর, নানান জাতের মানুষের এক সঙ্গে বসবাস। আরিফের সরল অজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী হবার প্রধান কারন সম্ভবত মণিপুরি মধুর তরুণিগুলোর আরিফের ফুচকার দোকানে নিয়মিত আসা। একই বাতচিত তাদের বারবারই শুনতে হয়। তারপরও একটা হাসি লেগে থাকে মুখে। আরিফ শুধু চেনে তার দোকানে ফুচকা খেতে আসা মেয়েদের। মণিপুর কোথায় সে জানেও না। যাদের সকলের চেহারা তার কাছে একই রকম লাগে। আর আশ্চর্য যে আরিফ এই ফারাক করতে জানে না, ও সেটা বোঝে।

আরিফ বলে ওঠে,  দ্যাশ নানান মাইনষে ভইরা গ্যাছে গা। সাদা, কালো, বাইট্টা, লুম্বা, নাক উঁচা আর নাক বুঁচা । ইয়াসমিন বুঁচা শুনে হো হো করে হাসি দেয়। ওর কাছে বোঁচা নাক অতীব হাস্যরসের বিষয়।

পাশ থেকে একজন তরুণ কাস্টমার বলে, ভাইয়া ঝাল মুড়ি দেন এক প্লেট। আরিফ সাকিবকে দেখিয়ে বলে,  ঝালমুড়ি হে বানাইবো। ওইহানে খারাইয়া, হ্যারে কন। হাত খালি নাই।  

সাকিব ঝালমুড়ি বানিয়ে কাস্টমার কে দিতে গিয়ে দেখে ছেলেটা তাকিয়ে আছে মেয়ে দুটোর দিকে, সাকিব প্লেট নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে রাখে, বলে লন না ক্যা ভাই? আরিফ ছেলেটার দিকে তাকায়। বলে ওঠে, এইটা ধরেন না কি লাইগ্যা? চোখ দেহি আটকাইয়া গ্যাছে। বলেই হেসে দেয়। বলে খাইতে আহেন? পরক্ষণেই বলে,  না কিচ্ছু না।

এরা সিলেটের মণিপুরি ‘উপজাতি’। থুক্কু ‘আদিবাসী’। আরিফের নিত্যদিনের কাস্টমার। তাদের সকলের চেহারায় মিল থাকাতে তাদের চিনতে আরিফের সমস্যা হয়। সে প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করে, আর মেয়েগুলো প্রতিদিন হাসি মুখে তার ভুল ভাঙিয়ে দেয়। আরিফ তাদের কোনদিন জাপানের আবার কোনদিন চিনের মানুষের সাথে তুলনা করে। আরিফ ফারাক জানেনা। না জেনেই সে তাদের জাত চিনিয়ে দিতে ব্যস্ত থাকে। এতে মেয়েদের অসুবিধা নাই। তারা মজা করেই আরিফের ফুচকা খায়।

ক্ষণে ধমক, ক্ষণে হাসি আরিফের কাস্টমার ধরে রাখার কৌশল। মেয়ে দুটোর খাওয়া শেষ হয়, বিল মিটিয়ে চলে যেতে গিয়ে রাস্তায় পা দিয়েই রি রি করে ওঠে। তারা খেতে এসেছে কিন্তু কাদায় পা ফেলতে খুব ঘৃণা। যেন পা দুটো মাথায় তুলতে পারলে বাঁচে। হেঁটে কিছুদূর যায়, গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে ওঠে, মামা, পুরা বর্ষাকাল আপনি এই বাজারে বসবেন? গলিতে গলিতে বেড়াবেন না?

আরিফের জবাব দেবার আগে ইয়াসমিন জবাব দেয়, না বিষ্টিতে আর অলিত গলিত যামু না।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বর্ষাকালের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ বেলপুরি খাচ্ছে। ডাইলপুরি যতো খাই, ততোই খাইতে মন চায়, ও আরিফ আমারে আরেক প্লেট দে, তার পাশের সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই প্লেটের দাম কিন্তু আমি দিমু।

বয়সে তারা আরিফের থেকে বড়ো হলেও  আরিফ তাদের সাথে তুই করেই কথা বলে। জিজ্ঞাসা করে, খাইবি ঠিক আছে, পয়সা দিবি নাকি বাকি রাখবি? লোক দুটো প্লেট উপরে দিতে গেলে প্লেট থেকে ঝোল পড়ে তাদের গায়ে, বলে ওঠে, ওরে! তরে কইনা ফুচকা নিচে বিক্রি করাই ভালা।

আরিফ বলে, ওইডা করতো ছাওনি কিনতে অইবো, টিয়া জমাইতো অইবো, ভ্যানো কাঠ লাগাইতে অইবো। ঘিরতো অইবো, আমার জইন্যে রেন কোট কিনন লাইগবো। টিয়া জমাইতে দুমাস লাইগবো, জমাইতে জমাইতে ভাদর মাস আয়া পড়বো। কাদা পানি চইল্যা যাইবো। নিচেই বিক্রি করতে পারবো, ঝামালা শ্যাষ।

ক্রেতা আর বিক্রেতার কথার মাঝেই ইয়াসমিন ক্রেতা এলেই জিজ্ঞাসা করতে থাকে,  বেলপুরি না চটপটি,  কি খাইবেন ফুচকা নাকি ঝালমুড়ি?  ঝালমুড়ি দশ টিয়া, অন্যগুলান বিশ টিয়া থাইক্কা শুরু।

হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝমঝমে পরিণত হয়। চারিদিক আবছা কালো হয়ে যায়, কিন্তু বাতি কালোকে উজ্জ্বল করে রাখে। তবু আষাঢ় নিজেকে ফাঁকফোকরে প্রকাশ করে। যেসব পথচারি ঝিরিঝিরি বৃষ্টিকে পাত্তা দিচ্ছিলো না তারা ছাতা মেলতে বাধ্য হয়। যেসব রিক্সার যাত্রীরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপভোগ করছিলো তারা রিক্সা থামিয়ে কাগজ দিয়ে হাত পা ঢেকে নেয়।

আরিফ যে বাজারে বসে ফুচকা চটপটি বিক্রয় করে তার সম্মুখেই রাস্তা। গলি বললে ভালো হয়। আর ঢাকা শহর তো আঁকাবাঁকা বাহান্ন হাজার তিপ্পান্ন গলির শহর। রাস্তায় দাঁড়ানো কাস্টমারগুলো ছুটে বাজারের উপরে উঠে আসে। ভিড়ের মাঝে একজন মেয়ে তার বান্ধবীর থেকে দূরে গিয়ে একা দাঁড়ায়। তার বান্ধবীটা তাকে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজে বেশ জোরে বলে, আরে তরে কি ভুতে লয়া যাইতাছে? এই জাগায় খাড়া।

তুমুল বৃষ্টিতে শুক্রাবাদ মসজিদে মুসুল্লিদের বদলে এখন পথচারীরা জায়গা করে নিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে পাশের হেফজিখানা থেকে দুজন জুব্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরা শিশু আসে। সমস্ত গায়ে পানি। মাথার চুলগুলো পানিতে জবজবে। মানুষ তাদের দাঁড়াবার জায়গা করে দেয়। তারা ফুচকা, চটপটি,  বেলপুরি, ছোলামুড়ির দিকে চেয়ে দেখে। মুড়ি দেখেও বলে, মুড়ি আছে? দশ টাকার দ্যান। টকটা দিবেন বেশি কইরা, মানে ঘুঘনি। দশ দশ কইরা বিশ টাকার দুইটা। প্লেটে দিবেন, কাগজে না।

একজন হঠাৎ আরেকজন গায়ের টোকা দিয়ে বলে, হাফিজ, চটপটিটা সেই টেস্ট। হাফিজ জিজ্ঞাসা করে চটপটি কয় টাকা? আরিফ জবাব দেয়, বিশ টিয়া থাইক্কা শুরু। দুজনের মুখই কালো হয়ে যায়। আরিফ যেন তাদের মুখের ভাষা বোঝে। আরে আপনেরা তো আমার পুরান কাস্টমার, চটপটি দশ টিয়ারও দেওন যাইবো। সে তাদের চটপটি বানায়ে দেয় ঝটপট। প্লেট নিয়ে তারা দূরে সরে দাঁড়ায়। খেতে শুরু করে, দুজনে কানের সাথে কান মিশিয়ে কী  যেন গল্প করে, হাসে আর খায়। বাজারে এতো মানুষের ভীড় তাতে ওদের মাথা ব্যথা নাই।

আরিফ কোনো মানুষকে চটপটি, কোনো মানুষকে ফুচকা, কাউকে ডাইলপুরি দিতে দিতে বলে ওঠে কয়দিন পরে ফুডপান্ডার অর্ডার সব। খানা ভালো, দাম বেশি। ফুডপান্ডার আইডি খুলমু। সব কিছুর রেট ষাট টাহা কইরা দিমু।

ফুডপাণ্ডা বড়লোকদের খাবারের দোকান, বিস্তর বিজ্ঞাপন দেয় তারা। বৃষ্টিতে আরিফের মৌজ এসে গিয়েছে। সে আসলেই স্বপ্ন দেখছে, নাকি মশকরা করছে বোঝা যায় না। একজন ফুচকা খেতে খেতে বলে হে বেটা ষাট কইরা দিলে আমরা খামু ক্যামনে?

চটপটিই খাইবেন। চটপটি তো ফাটাফাটি। বলেই হো হো করে হাসে আরিফ। আরিফের দোকানে ঢাকা শহরের বড়োলোক আসমানিরা সহ পথের প্রান্তিকজন খেতে এসেছে, ফুড পান্ডার অর্ডার নিতে নিতে তার মনে আনন্দ বাড়বে। সে তার খাদ্যর দাম বাড়াবে। এই খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলো কি তখন অন্য কোনো দশ বিশ টাকার ফুচকা চটপটির দোকান খুঁজে নেবে?  কখনো দেখিনি,  তবু পুরানা কাস্টমার বলে হাফিজের মতো শিশুদের দশ টাকার চটপটি খেতে দেবে? দেবে না এরকম নিষ্ঠুর ভাবনা করা যায় না। আরিফের ফুচকার দোকান, আরিফের মতোই হয়ে থাক। ইতিবাচক ভাবনা আনন্দদায়ক।

দেশে অনলাইন কেনা বেচা বেড়েছে। কোভিডের দরুণ অনলাইন ব্যবসা আরো জোরদার হয়েছে। দ্রব্যের দাম ও হয়েছে চড়া, আকাশছোঁয়া। লাগামহীন যাকে বলে। আরিফ হাঁকতে থাকে, আসেন আসেন ঝাল মুড়ি, ফুচকা, চটপটি আসেন, খাইয়া যান।

শিশুদুটো তার কাছে আসে। বলে গুঁড়া মরিচ একটু বেশি কইরা দ্যান। তাদের প্লেটে গুঁড়া মরিচ দিয়ে দেয়া হয়। তারা আলহামদুলিল্লাহ বলে প্লেট নিয়ে চলে যায়, পাশের এক লোক তাদের দেখাদেখি শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলামাত্র ঢেকুর তোলে, খালি প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলে, এই আরিফ ল, এডি। একটা তো ফ্রি খাওয়াইতাছোস না, আর খাওয়াইবি ক্যামনে?  এই সরু জাগাডির ভাড়া হলো গিয়া দিন প্রতি দুশো। মাসে ছ হাজার টিয়া। বাড়িওয়ালা গো অইলো মাঞ্জা মারা কপাল, আর বাজার মালিগগো হইল লাক্ষের কপাল। মোগো অইলো গিয়া ফুডা কপাল।

তার কথা আরিফ মনোযোগ না দিয়ে আবারো হাঁক দেয় আসেন বেলপুরি, ফুচকা, চটপটি।  আরিফ যে স্থানে বর্ষাকালের জন্য দোকান বসিয়েছে সে স্থান বেশ ছোট। তার দোকানের পরেই আম কলা পেয়ারার দোকান। তারপাশে একটা গোশতের দোকান। গোশতের দোকানের পাশে চা বিস্কিটের দোকান। ক্ষুদ্র চার দোকান থেকে চব্বিশ হাজার টাকা আয় হয় দোকান মালিকের।

দেশে অনলাইন কেনা বেচা বেড়েছে। কোভিডের দরুণ অনলাইন ব্যবসা আরো জোরদার হয়েছে। দ্রব্যের দাম ও হয়েছে চড়া, আকাশছোঁয়া। লাগামহীন যাকে বলে। আরিফ হাঁকতে থাকে, আসেন আসেন ঝাল মুড়ি, ফুচকা, চটপটি আসেন, খাইয়া যান।

ছাতা মাথায় দুজন মেয়ে আসে আরিফের দোকানে। বলে আরিফ ভাইয়া, ডালের বদলে আলু দিয়া দুটো ফুচকা বানায়া দেন তাড়াতাড়ি। একজন  একটা সিদ্ধ আলু হাতে তুলে নেয়। সাকিব বলে আলু ধইরেন না। বাজার গরম। আলুর দাম ত্রিশ টাকা। লোকটা বলে, অ্যা, আমি ইচ্ছে করলে ডিমের বাক্স লয়া যামু।

মেয়ে দুটো তাদের নিজেদের মাঝে বলে দোকানি আমাদের কাছ থেকে আধাকেজি আলু বিশ টাকা নিয়েছে। ঠকিয়েছে আমাদের! ইয়াসমিন তাদের বলে, আন্টি আউজকা চটপটি খাইবেন না? খান খান, চটপটি অস্থির লাগে। ও ভগবান, ইয়াসমিন আবার অস্থির বোঝে। বলেই তার চুলের আগা ধরে একটা টান মারে। ইয়াসমিন সাপের ন্যায় ফোঁস করে ওঠে। বলে,  চুল ধইরে দুষ্টামি কইরেন না আন্টি। বহুত বেদনা চুলের গোড়াত লাগে। মেয়ে দুটো বলে ওঠে আহারে। আরিফকে বলে, কাঁচা মরিচ, গুঁড়া মরিচ, টক বেশি দিয়েন। বাজারের সারি সারি ইটের সান দেয়া স্ল্যাবের পরে বসা মানুষের দিকে তাকায় আর বলে আচ্ছা, এ মার্কেট খালি আছে কেন? দোকান গুলোকে কেমন এতিম এতিম লাগছে।
পাশের আম বিক্রেতা জবাব দেয়, এই মার্কেট বন্ধ হইলো ক্যান? এই মার্কেটের মালিক অইলো আল্লার ভক্ত। হ্যার লাগি বন্ধ। আরিফ হাসে, বলে আরে হুনেন,  এ জাগার অনেক প্যাঁচ আছে। বুঝেন না, এক শুক্রাবাদে কয়ডা বাজার অইবো? চারডা বাজার। আর এই বাজার কেয়ামত পর্যন্ত খালি পইড়া থাকলেও হ্যাগো কমবো না। আপনার আমার ভাইবা লাভ আছে?

আরিফের কথার মাঝে মেয়েটা বলে দেন পুরাটা দেন। মিষ্টি টক দিয়েন না আবার। আরিফ বলতে থাকে, এই পুরা এডি এডি ওডি পুরা তল্লাট তাগো, অভাব নাই হ্যাগো। বৃষ্টিতে আটকে পড়া মধ্য বয়েসি লোকটা বলে, হুদ্দা মরার ফুডা কপাল মোগো। তয় বাজারটা খালি পইড়া আছে, বাজার বানাইলাছে, বিল্ডিং বানাইতো তালো আছিল।টিনশেড বাসা বানালেও অইতো।

ইয়াসমিনের বয়েসি এক শিশু আসে, বলে ঝাল কম দিয়া তাত্তাড়ি একটা ঝালমুড়ি দ্যান।

মেয়ে দুটো ফুচকা খেতে খেতে বাজারটার নাম খোঁজে। লোকটা বলে আন্তর্জাতিক শাহাজালাল কাঁচা বাজার। পরক্ষনেই বলে থুক্কু, শাহজালাল আছে তো, তয় বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক আইসা পড়ছে। ঢাকা বিমান বন্দরের নাম, শাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ফুচকা দোকান ঘিরে রাখা সকলে হেসে ফেলে।

মেয়েটার গাল থেকে ফুচকা পড়ে যায়। বলে, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর? তার বান্ধবী বলে, সরকারদের খেয়ে কাজ নেই, ক্ষমতায় গিয়ে আগেই নেমপ্লেটের পাছায় লাগে। অথচ আধাঘণ্টার পানিতে বাংলাদেশের পানি ভবনই ডুবে থাকে। রাস্তা সংস্কারের নাম নাই। গ্রামের রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাবার সময় কোমর ভেঙ্গে যায়। আজাইরা। কাজ পায় না , মানুষের মুখের জবান কেড়ে নেয়। ছাত্রদের বন্দী করে রাখে।

বৃষ্টির মাঝেই আরিফের কাস্টমার বেড়ে যায়। বেশি কাস্টমার ঝালমুড়ির। সে বলে মুড়ি বেচ্চি আউজকা দু তিনকেজি। এই জাগাতই বইসা। ছোট ছেলেটা ঝাল মুড়ি নিয়ে ফেরার পথে তার ভাই সামনে পড়ে। ধরে ফেলে বলে, তুই তো দৌড় মারবিই। তোর কামই তো হলো দৌড় মারা, আমি হাইটা হাইটা বাসাত যামু, তুই ও হাইটা বাসাত যাবি। বাইত যাইজ্ঞা তারপর বিচার হবে। শিশু ছেলেটা নাকি সুরে বলে, আরিফ ভাইয়ার ঝালমুড়ি মজা পাই দেইখ্যা বারবার আসি।

গোশতের দোকানি বলে, আহারে রাসেল ভায়ে, হ্যারে ছাইড়া দ্যাও, হ্যাতো আইবোই। আমরা তো বুরা বয়েসে মুরি খাই, আর হেরতো শৈশব। রাসেল আরিফের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, কাইলগাত্তে একবারের বেশি যান না আয়ে, আইলে দিবেন না। অতা খাই খাই ক্যান? আরিফ জবাব দেয়, ও আমার রেগুলার কাস্টমার। যতোবার আইবো ততোবার পাইবো।

একজন ছেলে দৌড়ে ভীড়ের মধ্যে ঢোকে, বলে ভায়ের কি আরাম! আর আমাগো বিষ্টি আইলেই দৌড়ানি দেয়া লাগে। মধ্যেবয়েসী বলে আহারে জুয়েল না তুই? একসময় হের দোকানে কাজ করছিস, কতো সম্মান, খাতির আছিল, আউজকা তুই এমন ভাবে কথা কস, যেন হে তর সাথি। হায়রে করোনা বেইজ্ঞুনিরে এক কইরা দিয়া গ্যালা।

আরিফ বলে, চুপ থাকেন চাচা, এডি হুনতো ভালা লাগে না। সুখের দিন গ্যাছে গা, বাঘে খাইছে। জুয়েল সেখানে দাঁড়ায় না। চলে যায়। তাও লোকটা থামে না। বলে চলে, বাজারটাও করোনার সাক্ষী। প্রায় দেড় বছর চলে এখন একেবারে অচল। আগে তাও যাহোক চলতো। হায়রে করোনা মারী। বাঘতো ভালা, হের কাছো গেলে ধরে। করোনা নিজে আয়া দম বন্ধ কইরা মারে। বৃষ্টি তবু খালি বাজারটা মানুষে ভর্তি হয়ে যায়।

দুজন যুবক একজন যুবতীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধরা পড়েছে। বেশ জোরে সেই আলাপ করছে। একে অপরকে দোষ দিচ্ছে সে সময় যুবতীর ফোন আসে। ফোন স্ল্যাবের পরে রেখে একে অপরকে বলে ফুনডা ধর। ফুনডা ধর। দুজনেই বলে ওঠে, আমি পারুম না, তুমি সামলাও। বলেই বলে ঐ তো রিস্কা, যাইগা লিটন। লিটন বলে, রিস্কা পামুনে, একটা চটপটি খাইয়া দ্যাখ, ল একটা খাইয়া দেখি। লিটনের বন্ধুর নাম সুজয়। সুজয় অভিমানের সাথে বলে, এখন তোগো দরকার, আমারে আটকাইতাছোস, এখন তো আমার পায়ের নিচে মাডি নাই। লিটনও অভিমান করে, বলে হুদা এককান মেয়ের লাগি বন্ধু ভুইলা যাইতাছোস। মেয়ে তো দ্যাশে কতলাই আছে, হের লগে মুই ও কথা কইছি, প্রেমে পরি নাই।

দুজন যুবক একজন যুবতীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধরা পড়েছে। বেশ জোরে সেই আলাপ করছে। একে অপরকে দোষ দিচ্ছে সে সময় যুবতীর ফোন আসে। ফোন স্ল্যাবের পরে রেখে একে অপরকে বলে ফুনডা ধর। ফুনডা ধর। দুজনেই বলে ওঠে, আমি পারুম না, তুমি সামলাও। বলেই বলে ঐ তো রিস্কা, যাইগা লিটন। লিটন বলে, রিস্কা পামুনে, একটা চটপটি খাইয়া দ্যাখ, ল একটা খাইয়া দেখি

আরিফ কাজ চালায় দু হাতে, তার কাস্টমার আসছে ঠিক বৃষ্টির তোড়ে, নারী পুরুষ উভয়ে। সে তার পেছনে তাকিয়ে দেখে সাকিব নাই, বামে নিচে তাকিয়ে দেখে ইয়াসমিন প্লেট ধুয়ে রাখে। আশে পাশে উকি দিয়ে খোঁজে সাকিব কে।  মাথা বাড়িয়ে দূরে তাকিয়ে দেখে মাথায় টুপি দিয়ে, সাদা পাঞ্জাবি, কালো প্যান্ট পরে ছাতা মাথায় দিয়ে প্যান্টটা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গুটিয়ে একজন মসজিদের দিকে যাচ্ছে। তাকে দেখেই জোঁকের মতো গুটিয়ে যায় আরিফ। লুকানোর মতো করে।

আরিফের বাড়িওয়ালা। বাড়ি ভাড়া দেবার ডেট চলে গেছে তার দুদিন হয়েছে। এজন্য ভয়। যদিও বাড়িওয়ালা তার দিকে চেয়েও দেখে না। এজন্যই হয়তো প্রবাদ, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। সে পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়ি ভাড়ার কথা ভুলে যায়। কাস্টমার দের কেউ একশো, কেউ দুশো টাকা মিলিয়ে বেলপুরি, ফুচকা, চটপটি নিয়ে  যায়। কেউ আবার কিছদূর গিয়ে ফিরে এসে বলে, বাজান বাজান আমার আরো লাইগবো, আমার পেট বড়ো গো। চারিদিক থেকে তাকে অর্ডার দিতে থাকে। ইয়াসমিন প্লেট ধুতে হিমশিম খায়। কেউ বলে ষাট টিয়ার তিন পদ দ্যান, লয়া যামু। আবার কেউ বলে হাত চালান, তাড়াতাড়ি দেন। মুহূর্তে তার বেলপুরি শেষ হয়ে যায়।

একপর্যায়ে হয়রান হয়ে আরিফ বলে সাকিব তুই গেলি গা। এইহানে এতোগুলান কাস্টমার আর তুই চোখের পরে গেলি গা। ক্যামনে পলটি মারলি। আউজকা তরে সাইজ করমু। ভাবতাছি এশার নামাজের আগে সব বিক্রি কইরা ফালামু। পরে আর বিক্রি অয় না। কাস্টমারের আশায় দশটা পর্যন্ত বই থাইক্কা মাত্র এক দুশো টিয়ার বিক্রি হয়।

আরিফের পরিচিত একজন কাস্টমার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝালমুড়ির বিক্রি আপাতত বন্ধ, সাকিবের অভাবে। এই খরিদ্দার ঝালমুড়ির। সাকিব ফিরলে বলে, এ সাকিব মুড়ি দে, আরিফ বলে হের লাগি এতোক্ষণ চুপ কইরা দাঁড়াইয়া আছে, কইতেন, আমি দিতাম। এই সাকিব, মুড়ি একটা দিয়া দে, সরিষার ত্যাল দিয়া। আপনের তো আবার পেট মাশাল্লাহ, মসল্লা পাতি খান না।

বেলপুরি শেষ হবার সাথে সাথে বেলপুরি খাওয়ার জন্য একজন কাস্টমার আসে। আরিফ বলে যেদিন কাস্টমার বেশি থাইকবো, সেদিন মাল সামালা যোগান পাতি থাইকবো না। হেইডা গিয়া দুনিয়ার সিস্টেম। বেলপুরি ছাড়া কিছুই চলে না, চলে, সবই চলে। হের মন চাইছে বেলপুরি খাইবো, পাইলো না, গ্যালো গা। থাউক, আউজকা যাউক গা।

তার আপসোস মিলিয়ে যায়, আবার দোকানে ঢেউয়ের মতো কাস্টোমার এসে পড়ে। সাকিব আর আরিফ দুজনে সমানতালে কাস্টমার কন্ট্রোল করে। আরিফ সাকিবকে ছোলা মুড়ি বানাতে বানাতে বলে কই গেছিলি? গলায় রাগান্বিত স্বর। একটু রাগান্বিত স্বরে সাকিবও জবাব দেয়, ফুডপান্ডার লাইগাই তো গ্যাছি। আমি কি ফাউ কাজে গ্যাছি গা। হেরা ক্যাটালগ দিমু, ইন্টারভিউ দেওন লাইগবো। ইন্টারভিউ আমি দিয়ালমু, আপনের যাওন লাইগবো না। কিয়ের ঘোড়ার ডিম ইন্টারভিউ।

আরিফ বলে আচ্ছা, অহন যা বাসা থাইক্কা শশা লয়া আয়। আনবি অল্প অল্প কইরা। মুড়ি য্যান কাস্টমার আইলে বেঁচতে পারি। চার পাঁচটা লয়া আয়। এই সময় আমের দোকানির আমের খরিদ্দার আসে। আরিফ দোকানিকে চোখ মিটকি মেরে খরিদ্দারকে বলে লয়েন না, লয়েন না, আমি কাওরান বাজার থাইক্কা একটাও খারাপ না হগলডি তাজা আম লয়া আনমু। আমার থাইক্কা লয়েন। আমের দোকানি হাসে। খরিদ্দার তাদের ইয়ার্কি বুঝতে পারে। ফরমালিন মেশানো আম নেয় তিনকেজি। সকলের বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকলেও আষাঢ়ের বাদল তাদের বাজারবন্দী করে রাখে, অনেকে ফুচকা চটপটি খেয়ে চা বিস্কিটের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। বর্ষায় খোশগল্পের সুন্দর মুহূর্ত ফুটে ওঠে। দলে দলে ভাগ হয়ে র’ চা দুধ চা ফুচকা চটপটি ঝাল মুড়ি খেতে থাকে।

জুয়েল ছেলেটা ভিজতে ভিজতে আবার ঝালমুড়ির দোকানে আসে। তাকে দেখে আবারো তার ঝকমকে দোকানের কথা আরিফের মনে পড়ে। যেখানে তার চার পাঁচ জন কর্মী ছিলো। কিন্তু দু হাজার বিশের লকডাউন তার রুজি রোজগারের পথ বদলে দিয়েছে। দোকান ছেড়ে দেয়। সেও তার কর্মীদের মতো পথের বিক্রেতা হয়ে যায়।

কাস্টমার তার নিরবতা কাটায়। সাকিব হাতে শশার প্যাকেট নিয়ে ফিরে আসে। তাকে জানায়, ভাবি কইলো আউজকা বাড়িওয়ালা, বাজার ওয়ালা দুজনেই বাসাত গ্যাছলো। হ্যাগো কাইলকা ভাড়া মিটাতে হবো কইলো।

আরিফের কানে কোন শব্দ যায় না। সে স্বপ্ন দেখে একটা দোকান। বড়ো দোকান! নাহ্‌ , সেটা রেস্টুরেন্ট। গরীবের তো আর স্বপ্ন দেখতে দোষ নাই। তার স্তব্ধ কাজের মাঝে প্লেটের ঝনঝনানি,  ইয়াসমিনের পানি নড়ানোর শব্দ, সাকিবের ‘খাইবেন না লয়া যাইবেন?’–  ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। তার হাতের কাজের গতিও বাড়ে।

 স্বপ্ন আরো রঙিন হয়ে ওঠে।

তার আপসোস মিলিয়ে যায়, আবার দোকানে ঢেউয়ের মতো কাস্টোমার এসে পড়ে। সাকিব আর আরিফ দুজনে সমানতালে কাস্টমার কন্ট্রোল করে। আরিফ সাকিবকে ছোলা মুড়ি বানাতে বানাতে বলে কই গেছিলি? গলায় রাগান্বিত স্বর। একটু রাগান্বিত স্বরে সাকিবও জবাব দেয়, ফুডপান্ডার লাইগাই তো গ্যাছি। আমি কি ফাউ কাজে গ্যাছি গা। হেরা ক্যাটালগ দিমু, ইন্টারভিউ দেওন লাইগবো। ইন্টারভিউ আমি দিয়ালমু, আপনের যাওন লাইগবো না। কিয়ের ঘোড়ার ডিম ইন্টারভিউ।

জেসমিন নাহার

তরুণ গল্পকার। উপন্যাস লিখনেও হাত দিয়েছেন। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকাতেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যশোহর জেলার শার্শা উপজেলায় বাড়ি। গোরপাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম (রহঃ) চিশতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। সেই কারণে ফকিরি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। মা রওশানারা বেগমের সঙ্গে বাস করেন জেসমিন। আধুনিকতার মধ্যে নামসাকিন হারিয়ে বিমূর্ত হতে চান না। প্রকৃতির মাঝে যাপিত জীবনকে মূর্তভাবে পরখ করতে চান। গদ্যেও জীবনের মূর্তভাবকে প্রকাশ করার ইচ্ছায় লেখালেখি করেন।

Share