ফরহাদ মজহারের কবিতা– একটি কালানুক্রমিক অভিযাত্রা

পর্যালোচনা

।। সৌম্য দাশগুপ্ত ।।

ফরহাদ মজহারের বইগুলি টানা পড়লে মনে হয় একেকটা বই একেকটা দীর্ঘ কবিতা। একই ছন্দ বা ফর্ম – সনেট হোক, অক্ষরবৃত্ত হোক, মাত্রাবৃত্ত হোক, এবং বিষয় মোটামুটি একটি, প্রায় সন্দর্ভের মত, নানা ভাবে বলা। ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’ বইটি ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যখন বেরিয়েছে, ততদিনে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা হয়ে গেছে। বইটির দ্বিতীয় প্রকাশে এই সময়ের প্রেক্ষাপট ও তাঁর নিজের গঠনের ইতিহাস নিয়ে ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন – ‘আমার নিজের জানতে খুব সাধ হয় কখন কিম্বা কবে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। পেছনে তাকাই, কিন্তু কিচ্ছু মনে পড়ে না। মনে হয় আমি বুঝি-বা জন্মেরও আগে থেকে চারিদিকে কবিতা গেয়ে বেড়াতাম।…এভাবেই বোধহয় দিন যেতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ – মুক্তিযুদ্ধ আমাকে বদলে দেয়। তখন টের পাই আমি আসলে দুইজন – একজন হচ্ছেন খোকন, অন্যজন প্রতিপুরুষ – খোকনের প্রতিপুরুষ। …যিনি আমার ভেতরে – আমার সময়কালের ভেতরে প্রতিপুরুষ, আমার ভেতরে-বাইরে তাঁর সশস্ত্র উত্থান আমি অনুভব করতে থাকি।’ কালপর্ব অতিক্রম করে ফরহাদ মজহারের কবিতা পাঠ করতে করতে আমরা এই দুটি কেন, আরো কয়েকটি কবিসত্তার সাক্ষাৎ পেতে থাকবো।

যদিও দশকবিভাজন-নির্ভর কবি ও কবিতার চর্চায় একটা ফাঁক রয়েছে: কবি কোন সময়ে সমাজে ক্রিয়াশীল, তার হিসেব তাঁর জীবদ্দশায় না-ও মিলতে পারে (যেমন জীবনানন্দ তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দীরও পরে আমাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল), তবু কবি ফরহাদ মজহারের কাব্যচর্চাকে জানতে হলে তাঁর সময়কাল ও সমকালীন সমাজদর্শন এবং আর্থসামাজিক, রাষ্ট্রিক, ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সামনে না রাখলে তাঁর কবিকৃতি ও ভাবনাকে অনুসরণ করতে অসুবিধে হবে। কারণ তিনি কবি নন কেবল, তাঁর লেখার মধ্যে তাঁর জীবনযাত্রার অনেক উপাদান এসেছে, এবং সেই জীবনে তাঁর দীর্ঘ প্রবাসপর্ব, দেশে ফেরা, কৃষিকাজে ব্যপ্ত থাকা, সুফীদর্শন ও লালন ফকিরের চর্চা, শিল্প, সঙ্গীত, ও রাজনৈতিক কাজের অঙ্গাঙ্গী যোগ রয়েছে। এই লেখাটিতে মূলত তাঁর কবিতার একটি যাত্রাপথের দিশা আঁকলেও এই বহুমাত্রিক নন্দিত ও বিতর্কিত মানুষটির বিশ্বাস ও কর্মের কিছু দিক হয়ত মাঝে মাঝেই উঁকি দেবে। তাঁর কবিতার আলোচনা নানা সময়ে নানা ভাবে হয়েছে, তাই এই লেখাটি কোনো বিশদ কাব্যালোচনা নয়, একটি কালানুক্রমিক কাব্যপরিচিতির অভিযাত্রা মাত্র।

ছয়ের দশকে পূর্বপাকিস্তানের শাসনাধীন পূর্ববাংলায় ভাষার অধিকার ও আর্থসামাজিক জুলুমের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ এবং কবি ও বুদ্ধিজীবী – সমস্ত স্তরেই একটা আত্মশক্তির নির্মাণের খোঁজ চলছিল। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন কে যদি মাইলফলক হিশেবে ধরি, তাহলে সেই সময়ের কবিতা, নাটক, সঙ্গীত ও শিল্পচর্চায় এই গণজাগরণের জোয়ার উঠেছিল। ততদিনে পাঁচের দশকের কবিদের আত্মপ্রকাশ হয়ে গেছে, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের মত কবিদের একটা নামডাক হয়েছে। শামসুর রাহমানের কবিতায় বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও প্রতিবাদের সুর, আল মাহমুদের কবিতায় বিশুদ্ধ নন্দনচর্চা, এবং আরো অনেক শক্তিশালী কবিদের মূলমন্ত্র তাঁদের এক অবশ্যম্ভাবী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। পাশাপাশি, পশ্চিম বাংলায় চলছে পাঁচের দশকে আবির্ভূত হওয়া কবিদের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাবেশ – একদিকে কৃত্তিবাস পত্রিকা-খ্যাত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঈষৎ দূরে থেকেও খ্যাতিমান শঙ্খ ঘোষ, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, এবং অনেকটা দূরে উৎপলকুমার বসু, ও আলোক সরকার দুটি প্রবহমান ধারা নিয়ে কাব্যচর্চা করছেন – একটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনযাপন, আরেকটি নিভৃতচারী মনোযাত্রা ও প্রকৃতির ঘেরাটোপে লুকিয়ে থাকা কোনো অমল সৌন্দর্যের সন্ধান।  ছয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে এসে গিয়েছেন ভাস্কর চক্রবর্তী, দেবারতি মিত্র, শামসের আনোয়ার ও কালীকৃষ্ণ গুহ-র মত কবিরাও, কিন্তু তাঁদের জৌলুস আসবে কিছুটা পর। এই পটভূমি দেয়ার কারণ হলো যে ছয়ের দশকে ফরহাদ মজহারের লেখালেখি শুরু হওয়ার সময়  দুই বাংলায় কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে চলছিল দুটি স্বতন্ত্র ধারা।

সচেতন ভাবে কোনো গল্প বা কোনো তত্ত্ব মনে রেখে কবিতা লিখতে বসেন না ফরহাদ (অগ্রবীজ পত্রিকাকে দেয়া তাঁর সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য), কিন্তু কাব্যিক ভাবে প্রশ্ন করেছেন ‘কবিতা কি দিতে পারে গরীবেরে সশস্ত্র বিপ্লব?’ তিনি এই ধরণের কবিতাকে ‘লিপ্ত’ কবিতা বলেন,  যেটা কোনো একটা বিশেষ সময়ে, বিশেষ কোনো পলিটিক্যাল মুহূর্তকে ধরবার জন্য বা তাকে উৎসাহিত বা অনুপ্রাণিত করার জন্য লেখা। ‘লেফটান্যান্ট জেনারেল ট্রাক’ যেমন। একটা বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন বিচারের জায়গাটা কবিতার জায়গা থেকেই হবে, সাময়িক প্রসঙ্গ হলেও তাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। ফরহাদ মজহারের কবিতায় অনেকগুলি বাঁক আছে। একই ধরণের কবিতা কোনওদিনই তিনি লেখেন নি, তার একটা কারণ তিনি জানান যে সেটা তাঁর হাতে-নাতে কাজ করার আগ্রহ থেকে হয়েছে।

ফরহাদ মজহারের বইগুলি টানা পড়লে মনে হয় একেকটা বই একেকটা দীর্ঘ কবিতা। একই ছন্দ বা ফর্ম – সনেট হোক, অক্ষরবৃত্ত হোক, মাত্রাবৃত্ত হোক, এবং বিষয় মোটামুটি একটি, প্রায় সন্দর্ভের মত, নানা ভাবে বলা। ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’ বইটি ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যখন বেরিয়েছে, ততদিনে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা হয়ে গেছে। বইটির দ্বিতীয় প্রকাশে এই সময়ের প্রেক্ষাপট ও তাঁর নিজের গঠনের ইতিহাস নিয়ে ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন – ‘আমার নিজের জানতে খুব সাধ হয় কখন কিম্বা কবে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। পেছনে তাকাই, কিন্তু কিচ্ছু মনে পড়ে না। মনে হয় আমি বুঝি-বা জন্মেরও আগে থেকে চারিদিকে কবিতা গেয়ে বেড়াতাম।…এভাবেই বোধহয় দিন যেতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ – মুক্তিযুদ্ধ আমাকে বদলে দেয়। তখন টের পাই আমি আসলে দুইজন – একজন হচ্ছেন খোকন, অন্যজন প্রতিপুরুষ – খোকনের প্রতিপুরুষ। …যিনি আমার ভেতরে – আমার সময়কালের ভেতরে প্রতিপুরুষ, আমার ভেতরে-বাইরে তাঁর সশস্ত্র উত্থান আমি অনুভব করতে থাকি।’ কালপর্ব অতিক্রম করে ফরহাদ মজহারের কবিতা পাঠ করতে করতে আমরা এই দুটি কেন, আরো কয়েকটি কবিসত্তার সাক্ষাৎ পেতে থাকবো।

সেই সময়কে এই লাইনগুলিতে পাওয়া যায় –

বাইরে এখন মৃত্যু, বাইরে পা বাড়ালেই মৃতদেহ

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ , খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২)

কিংবা

“সময় হবে যখন লীলাকমল হাতে অমল এবং
ফর্সা আমার লাস্যময়ী সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকবে
সারাজীবন শিউলিতলায় শিউলি সাদা অস্থিমালা
কিম্বা মৃত্যু ধারণা করে আমার মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে”

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ।। খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২)

এই একই গ্রন্থের কবিতায় এসে মিলেছে বিজ্ঞানচেতনাও, যেন প্রাণীজগতের মৌলিক উপাদান তাঁর সত্ত্বার অন্বেষণকে রাষ্ট্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘মৃত্যু সম্পর্কীয় স্কেচ’ কবিতার এপিগ্রাফে যখন কবি লেখেন ‘When Matter and Anti-matter meets result is annihilation [তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই]’, তখন ইংরেজি অংশের বিজ্ঞানচেতনাটুকু আমাদের পরের লাইনে ব্র্যাকেট-বিধৃত অংশটুকুর পুরাণকেন্দ্রিক লোককথার আর্তির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়, আর সেই কবিতাতেই তিনি মিলিয়ে দেন সৌরজগৎ আর খোকনের জীবনকে –

‘দুলে উঠবে দুলকি দোলায় আমার সকল সৌর জগৎ
দুলে উঠবে পাগলা ভোলা
দোদুল্যমান দোলনা দোলায় ঝুলন ঝোলায় ঝুলব আমি
আমি এবং আমার খোকন
আধখানা একরত্তি খোকন
এন্টি-খোকন
এন্টি-পুরুষ’

‘মৃত্যু সম্পর্কীয় স্কেচ’।। খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২)।

এই পর্বে ফরহাদের প্রস্তুতিপর্বেরও একটা চিত্র পাওয়া যায়। আমরা তাঁর পাঠাভ্যাসে পেয়ে যাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘বুড়ো আংলা। আমি তো বুড়ো আংলাই, আমি প্রধান–মন্ত্রীত্ব চাই না – আমি বুড়ো আংলা;) পেয়ে যাই বিদ্যাসাগর ও রামেন্দ্রসুন্দরকেও। যেন বাঙালি হিশেবে নিজের অস্তিত্বের সামনে এক ঐতিহ্যবোধকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এই আত্মজিজ্ঞাসা অভিমানের মত ফরহাদকে বারবার ভাবিয়েছে, নানা সময়ের কবিতায় এই আত্মপরিচিতির অস্থিরতা আমরা দেখব –

‘আর রাস্তায় যে মাতাল চিৎকার করছে
স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে
তাকে চিনি বলে মনে হয়
সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর না সে তা নয়
সে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী না সে তা নয়
সে আমার বন্ধুর মতো শত্রু
রেস্তোরাঁয় জরায়ুর মতো চায়ের কাপে
আমাকে হত্যা করে
সুখে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছে’

‘সন্তানের জন্ম’ ।। খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ (১৯৭২)।

কাব্যিক উপমার সৌকর্য এই বইয়েরই আরেক কবিতায় দেখি, বিবৃতির বাইরে এসে যখন লেখেন

এলিয়ট যেমন লিখেছিলেন তাঁর সুপরিচিত Tradition and the Individual Talent প্রবন্ধে – নতুন লিখতে আসা সব কবিরই বোধহয় নিজের ঐতিহ্যের কাছে পরীক্ষা নিতে হয়, আত্মপরিচয়ের সঙ্গে অভিজ্ঞতার তুলনা করে। “No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone; you must set him, for contrast and comparison, among the dead.” ফরহাদকেও এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনায় দাঁড় করিয়ে –

 শিশু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন বয়সে বাইরে ছিলো!
আমার মতোন তার তো তেমন অভিজ্ঞতা নেই, ছিলো না;
আমি বিশদ যুদ্ধ জানি, খুব সহজে মরতে জানি
তোমার জন্য লক্ষ লক্ষ বার এ আমি খুন হয়েছি।

‘মাতৃভাষা/মাতৃভূমি’ ।। খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ

এই বইয়ের পাঁচ বছর পর, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হল তাঁর দ্বিতীয় বই ‘ত্রিভঙ্গের তিনটে জ্যামিতি’। এখানেও খোকন এবং তার প্রতিপুরুষের আত্মপরিচয়ের সন্ধান আছে, যদিও এর মধ্যে ফরহাদ তাঁর কবিতার থেকে ন্যূয়র্কের প্রবাসজীবনের দূরত্বের কারণে খানিকটা সরে গিয়েছন। আরো একটা কারণ ছিল। বাচ্যার্থকে অতিক্রম করার কথা জেনেছেন লজিক্যাল পজিটিভিস্টদের কাছে, যাঁরা বলছেন ‘বাক্যনির্বন্ধের লজিকের ভেতর চরাচরের সত্য কোনোভাবেই প্রতিফলিত হতে পারে না’ (তাঁর ভূমিকায় জানাচ্ছেন ফরহাদ), ‘এবং তাতে ক্ষতি বই লাভ হোলো না’। এর মধ্যে তিনি গণিত হয়ে ভাষাতত্ব ও নৃতত্বে এসেছেন, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, ‘এবং কবিতা চুলোয় উঠেছে’। বিজ্ঞান আর কবিতাকে এক জায়গায় নিয়ে আসা এই সময়ের কবিদের দায়িত্ব হিশেবে ভাবছেন, মার্ক্সীয় রাজনীতির পাঠ নিয়ে লিখছেন ‘কবিতাকে এড়িয়ে …আমার একটি বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে এবং তা হচ্ছে এই সত্য আবিষ্কার যে কেবলমাত্র দুটো বিষয়ই আমাদের কংক্রীট আর অনির্বচনীয় উৎসে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে তা হচ্ছে মার্ক্সীয় বিজ্ঞান ও সঙ্গীত’। ‘খোকন ও নভোজাহাজ’ কবিতায় লিখছেন –

আমাকে অজ্ঞান করো দাও শুদ্ধ জ্ঞানবিমুখতা
তোমাদের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কবিদের অপঘাত ঘটে
বিস্ময় ফিরিয়ে দাও যে বিস্ময় বিশুদ্ধ বিস্ময়
বিস্ফোরণে ভেঙে দাও ইন্দ্রিয়ের ভুল যন্ত্রপাতি।

আমি নভোচারী হবো, সে কেমন বিশুদ্ধ মানব
 সে কেমন নিখিলের বিন্দু আর বিসর্গ না জেনে
আনন্দে পতিত হয় সে কেমন আনন্দ বিলাসী
সে কেমন গুহা মানবের মতো জৈবিক চালাকি শিখেছে!’

'খোকন ও নভোজাহাজ‘ ।। ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি (১৯৭৭)

 বিদেশবাস আত্মপরিচয়কে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা দেয়, তা প্রবাসীমাত্রেই জানেন। বাংলাদেশ থেকে দূরে অবস্থানে নিজের ভেতরের দিকে যেমন তাকিয়ে দেখছেন, তেমনই বাইরে তাকিয়ে অন্য সমাজ, অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি, অন্য রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে তাঁকে আরেক ধরণের আত্মসন্ধান করতে হচ্ছে। ন্যূয়র্কের বন্ধু টমাস, ম্যাগী, জর্জ ও মাইকেল কে বলছেন (কবিতাটির ফর্মটিও লক্ষ্য করার, বাক্যকে ভেঙে দিচ্ছেন একেকটি শব্দের প্রস্বরকে বোঝানোর জন্য) –

একটি সবুজ জলপাই গাছের নিচে
একটি বাদামী বাদক
বাঁশী বাজাচ্ছে
ক্ষুধা এবং মৃত্যুর।
মধ্যরাতে ক্লান্ত ন্যূইঅর্ক ঘুমিয়ে গেলে
আমি আস্তে আস্তে তোমাদের বলব
জলপাই –
বাঁশী, বালক এবং
ক্ষুধা ও মৃত্যুর গল্প
নড়েচড়ে বসো সবাই শান্ত হয়ে বসো
শুঁড়িখানার শেষ গ্রাহকটিকে মাতাল হতে দাও।
কারণ আমি এখন তোমাদের যা শোনাবো
তোমরা
তা কখনো
শোনোনি’।

‘ন্যূইঅর্কে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প’ ।। ত্রিভঙের তিন্টে জ্যামিতি (১৯৭৭)

এই বইয়েই টানা গদ্যে কিছু কবিতা আছে ফরহাদের। সেখানে নৃতত্ত্ব, প্রাণীবিদ্যা, যুদ্ধ, ফ্যাসিজম, জলবিজ্ঞান, ও মানবজীবন একসঙ্গে এসে মেশে। তাঁর উৎসুক চোখে এই বিশ্বপ্রাণচেতনা এবং মানবজগতের সম্পর্ক এক অন্য মাত্রায় দেখা যায়, যেমন –

‘আমি আজ সেই জলনিষ্ঠ মাছটিকে দেখেছিলাম। তার কাচের কানকো জলের মতোন তরতর করে কাঁপছিল। তার চোখ জলে ভেজা, ঠোঁট জলস্বচ্ছতায় মিহি। আমাকে সে মেঘ, নদী, ও সাগরের উজ্জ্বল-বর্ণহীনতার-শঙ্খ বাজিয়ে শোনাচ্ছিলো এবং তার জলজ আঁশের গা ঘেঁষে এক লক্ষ জলকণা কখনো স্থির এবং কখনো বা তরঙ্গলোভী কিন্তু তবুও সেই সমুদয় জলকণা স্পষ্টতই প্রতীয়মান ছিল। কারণ মাছেরা জল থেকে জন্মলাভ করে।

আজ আমার অন্বেষণ ফুরিয়েছে। আমি সব দেখছি। সব্বাইকে অতিক্রম করে এসেছি। এখন আমাকে আমার দেখার সময়।

নিজের ছায়ায় নিজে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছি এখন। আমার দৃষ্টিকাতর চোখ, শব্দবাহী শ্রুতি, আর বহুমাত্রিক স্পর্শ এক্ষুণি আমার বীজ হয়ে উঠবে। আমার শরীরে তার চিহ্ন স্পষ্টতই এখন প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে

কারণ আমি আমার আপন ইন্দ্রিয় থেকে জন্মলাভ করি।’

‘নৃতত্ত্ব’ ।। ত্রিভঙ্গের তিনটে জ্যামিতি (১৯৭৭)

১৯৬৮ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে রচিত রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে এর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’। এই সময় বাংলাদেশে খুব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রাণনাশ, সামরিক অভ্যুত্থান ও প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন, এবং এরশাদ প্রশাসন – অনেকগুলি রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই কবিদের মধ্যে এই ঘটনাগুলি আলোড়ন তোলে, এবং এই সময়ের কবিতায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে কেবল সমকাল নয়, প্রতিবাদের এই ভাষায় ফরহাদ নিজেকে গেঁথে দেন ইতিহাসের অনেকগুলি বিপ্লবের সঙ্গেও, সরাসরি এই বিবৃতিতে –

‘বড়ো দীর্ঘকাল আমি অপেক্ষা করে ছিলাম
উত্তাল ঊনসত্তুর আমাকে ডেকে এনেছে রাস্তায়
প্রণয়ীর মতো মাটিকে আলিঙ্গনে বেঁধে রাখে যে চাষা
তার ঔরসে আমার জন্ম
প্রতিটি কৃষক বিদ্রোহে আমি ছিলাম উলঙ্গ সড়কির হিংসা
পলাশীর আম্রকাননে আমি ছিলাম মীর মদনের তলোয়ার
১৮৫৭-য় সিপাহী বিদ্রোহের কার্তুজ
আমি ছিলাম তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা
  ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবীদের ঘৃণা
একাত্তরে শত্রুভুক স্টেনগানের বঙ্কিম ভঙ্গী নিয়ে
ঘুরে বেড়িয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে…

…আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে
এখন আমার আর ফেরার উপায় নেই ।’

‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’ ।। আমাকে তু্মি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩) ।। ইংরেজি ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে রচিত রাজনৈতিক কবিতা।

বিপ্লবচেতনা কেবল রাজনৈতিক বা ইতিহাসচেতনায় নয়, লিঙ্গবৈষম্য নিয়েও তাঁর মনোভাব এই সময়ের কবিতায় উঠে এসেছে। এই বইয়ের বেশির ভাগ কবিতার মতোই সরাসরি বক্তব্যে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেন কবি, কোনোরকম ভণিতা না করেই। নিচের লাইনগুলি যেন জাঁ পল সার্ত্র আর সিমোন দ্য বোভ্যয়ারের কফিশপের নিমগ্ন আলাপচারিতার দৃশ্য তুলে ধরে আমাদের চোখের সামনে –

 …আজ আমি তোমাকে বলতে এসেছি
পুরুষ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব
এবং তোমার কর্তৃত্ব গ্রহণ করার সময় হয়েছে, নারী
পুরুষকে গ্রহণ কর।   

‘কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী’ ।। আমাকে তু্মি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে (১৯৮৩) ।। ইংরেজি ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে রচিত রাজনৈতিক কবিতা।

ওই একই সময়ে, ১৯৭০-৮৫ এর মধ্যেই লেখা সম্পূর্ণ অন্য জাতের কিছু কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘বৃক্ষ’ বইটি, যার সাব-টাইটেলেই বলা আছে ‘মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা’। এই বইয়ের ভাষা, বিষয়, ছন্দ ও প্রকাশভঙ্গী একেবারে আলাদা। সাংকেতিক উপমায় ভরা এর প্রয়োগ, এবং দৈনন্দিনের লোকসাধারণ্যের থেকে খানিকটা বিশ্বের বিস্ময়ের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় এর নানা কবিতা। নিচে তার একটু নমুনা দিলাম, ১৪ মাত্রার পয়ারে, যেন সনেটের ভঙ্গিতে তাঁর উচ্চারণ –

এই দৃশ্যভারাতুর নগ্নতার স্বাদ
আমি বাক্যে পেতে চাই। যা-কিছু সংবাদ
রূপে রসে গন্ধে স্পর্শে প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ে
নিষ্পলক স্বচ্ছতায় প্রতিচ্ছবি হয়ে
দৃষ্টিতে নিক্ষিপ্ত হয় – দ্রুত ধরা পড়ে
ব্যাকরণসিদ্ধভাবে অক্ষরে অক্ষরে
সেইসব দৃশ্য আমি প্রাবন্ধিকতার
অটল অনড় গদ্যে লিখে যেতে চাই
মনোনিবেশিত যত্নে; যেন ফিরে পাই
কারকে ও বিভক্তিতে সমাসে সন্ধিতে
শুদ্ধ পদবিন্যাসের স্থাপত্যশৈলীতে
পুনর্নির্মিত দৃশ্য – দ্বিতীয় প্রকৃতি।

কিন্তু যত চেষ্টা করি তবু পরিস্থিতি
অনায়ত্ত থেকে যায়। এতো উৎসব
প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টা তবু মুষিক প্রসব
হোল ফের পর্বতের। এতো প্রণোদনা-
লিখা হোল তবু এক অক্ষম রচনা
বৃষ্টিবিষয়ক পদ্যে!

‘আষাঢ়ে বৃষ্টি বিষয়ক অক্ষম প্রবন্ধ’ ।। বৃক্ষ: মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা

অন্য একটি প্রবন্ধে আমি প্রয়াত কবিতা-গবেষক ও অধ্যাপক ড. অরুণ সেন এর কাজ নিয়ে মন্তব্য করেছিলাম – কবিদের মানস, রুচি, আদর্শ, শিল্পবোধ এবং কাব্যবোধ নিয়ে নানা সময়ে উঠেছে নানা তর্ক। অরুণ সেন সেইসব তর্কের মধ্যে প্রধান তর্কটি নিয়ে এক দীর্ঘ পরিক্রমা করেছেন নানা সময়ে লেখা তাঁর নানা প্রবন্ধগুলিতে। মুখবন্ধে লিখছেন – ‘… কবির কাজ তো শুধু গলা মেলানো নয়, শুনতে না-পাওয়া স্বরকে কানের গোচরে নিয়ে আসা’।

কী সেই শুনতে না-পাওয়া স্বর? সে কি কবিমানসের গূঢ় অন্তর্যাত্রার নিহিত পাতালছায়া, না কি সামাজিক ও রাজনৈতিক যাপনের যে দৈনন্দিন, তার স্পষ্ট বা আবছায়া প্রতিচ্ছবি? না কি এই দুইয়ের এক সমন্বয়? এই বিচারের খোঁজ সামান্য নয়, আর তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য অরুণ সেনের গবেষণা আমাদের কবিতাচর্চার লক্ষ্য ও উপলক্ষ্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। রাজনৈতিক অবস্থানের পরিমাপে সাহিত্যের যে-ধারণা আমাদের এই দীর্ঘ সময়ের চর্চায় বিধৃত আছে, তার মান্যতা রেখে এক দিক, আর রাজনীতিকে পরিহার করে ব্যক্তিগত বিশুদ্ধতার অন্বেষণ চালিয়ে যাওয়া – এ আরেক দিক, তর্ক কি তাহলে কেবল এই দুই চরম মেরুর? প্রশ্ন করা সহজ, কিন্তু উত্তর তত সোজা নয়, অরুণ সেনের আলোচনায় সেই সত্যটাই শেষ পর্যন্ত উঠে আসে। কবি বিষ্ণু দে এই দুই মেরুকে মনে করতেন ষাঁড়ের দুটো শিং, যা কবিকে দু-দিকে ক্রমাগত টানতে থাকে, আর, ‘শিল্পীর দায় ষাঁড়ের দুটো শিং-কে একসঙ্গে ধরে তাকে বাগে আনা’।

ফরহাদ মজহার একই সময়ে এই দুটি ধারার চিন্তা ও লেখা চালিয়ে গিয়েছেন, এবং এই দু-ধরণের কবিতাকে বেছেও নিয়েছেন আলাদা আলাদা দুটি গ্রন্থে, এই প্রকাশনাপদ্ধতির দিকে তাঁর নজর আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। এড়ায় না এই তথ্যও, যে ওই একই সময়ে তিনি প্রকাশ করলেন কেবল প্রেমের কবিতাভরা দুই ফর্মার বই – কাব্যগ্রন্থের নামেও বইয়ের আকারটি ধরা আছে – ‘সুভাকুসুম দুই ফর্মা’। এই বইয়ের এক পরবর্তী সংস্করণে তিনি লিখবেন – ‘…প্রেমে লিঙ্গ লুপ্ত হয়। কবি ছাড়া এই সত্য আর কে জানে? ওদের মধ্য দিয়ে কবি যেন অনন্তকাল তাঁকে আস্বাদন করতে পারেন, যিনি নানান নামে ও নানান রূপে বঙ্গে প্রকাশিত। তাঁর নিরানব্বই নাম। আমি এই কালে যার নাম দিয়েছি “সুভা”। অপেক্ষায় আছি সেই কাব্য যুগের – লিঙ্গভেদ লুপ্ত হবার পরেই কেবল যার আবির্ভাব ঘটতে পারে। কবে শ্রীমতি রাধার চরণ স্পর্শ করার মুহূর্তটুকু আমার আসবে যেন প্রেম ও প্রজ্ঞার কপাটটি খোলা হয়ে যায়। দেখব – ওপারে যিনি অপেক্ষা করছেন তাঁর নামও “সুভা”। কে নাম রাখে আর কেইবা সেই নাম ধরে ডাকে!!”  বইটির প্রথম কবিতাটির কয়েকটি লাইন দেখা যাক –

‘ কুসুম শব্দটি বেশ, ওর মধ্যে কুসুম কুসুম
উষ্ণভাবাপন্ন বোধ বৃন্তে ও পরাগে লিখা থাকে
উদ্ভিদবিজ্ঞানসহ। উপরন্তু প্রাচীন শিল্পের
স্থাপত্যগরিমা আছে পুষ্পের প্রফুল্ল নির্মাণে
হৃদয়কল্পিত ভাবে ফুলেরা নির্মিত হয়। আমি
ভাবি তুমি কুসুমের কিভাবে এমন কারিগর!’

‘সুভাকুসুম দুই ফর্মা’ ।। সুভা কুসুম দুই ফর্মা : প্রেম ও প্রজ্ঞা বিষয়ক দুই ফর্মা প্রতিবেদন (১৯৮৫)
।। দুই ।।

মেশিন শব্দটি ফরহাদ মজহারের কবিতায় নানাসময়ে নানাভাবে এসেছে। দু-দুটি বইয়ের নামকরণও মেশিন দিয়ে। ‘অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন’ (১৯৮৫) আর ‘মেঘমেশিনের সঙ্গীত’ (১৯৮৮)। শব্দটির নানা ব্যঞ্জনা আছে, তবে একে বাউল-ফকির দর্শনের দেহতত্ত্ববাদের একটি ভিন্ন প্রকাশ মনে হয় আমাদের। মানবশরীর-কে লালন ফকির বলছেন ‘খাঁচা’, (‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’, এখানে খাঁচা শব্দটি আমাদের দেহের একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত), তারই এক আধুনিক রূপায়ন কি এই মেশিন? দীর্ঘকাল ধরে ফরহাদ লালনচর্চা করেছেন, কোনো গবেষকের জায়গা থেকেই নয় শুধু, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অনুপ্রেরণায় একেবারে ডুবে গিয়ে, সাধনার মধ্য দিয়ে। সুতরাং লালনের গুরুত্ব তাঁর মননে থাকা স্বাভাবিক। এই নিয়ে তাঁর ‘ভাবান্দোলন’ বইয়ের ২৬৭-২৬৮ পাতায় দেখি

 নদীয়া বাংলার প্রাণ ও জ্ঞানের তীর্থ। নদীয়া বারবার গোড়ার প্রশ্নগুলো তুলে বাংলার ভাবুকতার ধারাকে অপরিসীম শক্তিশালী করে গেছে। ফকির লালন শাহ হচ্ছেন সেই গোড়ার মানুষ – কবিদের কবি, ভাবুকদের ভাবুক। বাংলা যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই ফকির লালন শাহের গোড়ার কিছু প্রশ্নের মীমাংসা করতেই হবে। না করলে বাংলার কোন জাগরণ, রূপান্তর ও পুনর্গঠন অসম্ভব বলে আমি গণ্য করি।

‘ভাবান্দোলন’ ।। মওলা ব্রাদার্স ২০০৮, ঢাকা।। পৃষ্ঠা ২৬৭ -২৬৮

অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিনের উৎসর্গপত্রে দেখি মেশিন অর্থাৎ পুরুষ ও নারীদেহের বিভেদ ঘুচিয়ে দেয়া তাঁর মন্তব্য –

নারী ও পুরুষের বিভেদ আমি মানি না।
যুগপৎ নারী ও পুরুষের বিলুপ্তি
অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক সমাজ ভেঙে
ব্যক্তি হিসেবে উভয়ের ঐতিহাসিক
উত্থানের দরকারে আমার এসকল
এই ঐতিহাসিক উত্থানের জন্যে যারা লড়ছেন,
কবিতা। কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষে।
নারী বা পুরুষ – উভয়ের জন্য এ গ্রন্থ নিবেদিত হল।

‘উৎসর্গপত্র” ।। অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন’ (১৯৮৫)।

এই বইয়ে যে কেবল লিঙ্গবৈষম্যের সন্দর্ভ তুলে ধরেছেন তা নয়, বরং নারীবন্দনার নানা স্তর দেখিয়েছেন ফরহাদ। সেখানে ইতিহাসচেতনা, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নও এসেছে, যেমন –

এই সাম্প্রদায়িক দেশ ত্যাগ করে যাওনি কেনো তুমি প্রীতিদি?
তোমাদের পাড়ায় এক এক করে তো সবাই চলে গিয়েছিল
সীমান্তের ওপার থেকেও দলে দলে এসেছিল মোহাজের
তাদের ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি


তাদের ইতিহাসে একই হত্যা ও দাঙ্গা
তাদের ইতিহাসে একই ধর্ষণ ও সর্বস্বান্ততা
সমসাময়িক ইতিহাসের মাঝখানে সীমান্ত টানা যায় না
সমসাময়িক ইতিহাসের উভয়দিকে ঘটতে থাকে একই ইতিহাস


দেশকালের কোনো ভিন্ন ভিন্ন ভূখন্ড নেই…
… এবং আদি ও অন্তে যে বিস্তীর্ণ অখন্ড ভূগোল সমাসীন
তাকে মানুষ সাময়িক খন্ডবিখন্ড করলেও সেঈ অখন্ড ভূগোলকে
আমাদের ফের পুনর্নির্মাণ করতে হবে।”

‘প্রীতিলতা গাঙ্গুলী বা ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে একটি দীর্ঘ শোকগাঁথা’ ।। অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন’ (১৯৮৫)।

তারই সঙ্গে আছে সৃষ্টিতত্ত্বের মূল জায়গায় আপত্তি প্রকাশ করা, সেখানে এক অন্যধরণের অঙ্গীকার –

আমাকে বলে হয়েছে আমার পাঁজর থেকে তোমার জন্ম
আমাকে বলে হয়েছে নিষিদ্ধ গন্দম খেয়ে তুমি পাতকিনী
এবং তোমার পাপে আমি পাপী
আমার জিন্দেগী জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত তোমার দোষে
বেহেশত থেকে অধঃপতিত
কিন্তু আমি সাফ সাফ বলেছি মিথ্যে কথা
মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে এইসব গায়েবী উপাখ্যান, মেহেরজান
উপাখ্যান থেকে উৎপন্ন নই, আমরা
আমাদের জন্ম পৃথিবীর পাঁজর থেকে
এবং আমাদের ভেতর দিয়ে পৃথিবী নিজেকে
উপস্থাপিত করে চলেছে
    …
লক্ষ্য কর এ কবিতার মধ্যে নারী নেই, পুরুষ নেই
আমার যে নারী সে পুরুষ
এবং যে পুরুষ সে একই সঙ্গে নারী
লক্ষ্য কর এ কবিতা পুরুষের মতো ভালোবাসে
এবং নারীর মতো ভালোবাসা গ্রহণ করে
এবং একই সঙ্গে এ কবিতা নারীর মতো ভালবাসে
এবং পুরুষের মতো ভালবাসা গ্রহণ করে
আমার ভালবাসা একই সঙ্গে নারী এবং একই সঙ্গে পুরুষ

‘আমাদের ভালবাসা মেহেরজান’ ।। অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী নারীমেশিন’ (১৯৮৫)।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত মেঘমেশিনের সঙ্গীত কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় একটি পরিকল্পিত প্রকল্পের ঘোষণা লক্ষ্য করি – ‘মাত্রাবৃত্তে কোথায় জানি মেঘের স্বভাব আর মেশিনের পদার্থবিদ্যা একাকার হয়ে আছে। মাত্রাবৃত্ত একদিকে পদ্য, কিন্তু অপরদিকে গদ্য; একদিকে চাঁদ, অপরদিকে ইলেক্ট্রিসিটি…”। এই বইয়েও বক্তব্য আছে, আবার আছে প্রকৃতি ও প্রেম, বিজ্ঞান ও দর্শনের মেলবন্ধন –

র্ধে উধাও আলুথালু বায়ু নিম্নে নিরুদ্বেগ
নাগরিক বাসভূমি
ওগো মেঘ ওগো আবছা গ্রামের মতো বহুদূর মেঘ
কোথায় যাচ্ছ তুমি?

এ শহরে আমি একাকী বালক চেয়ে থাকি বিস্ময়ে
মেঘ তুমি যাও ভেসে
কি করে অমন উঁচুতে উঠেছো কি করে বা নির্ভয়ে
চলেছো নিরুদ্দেশে।

সব মেশিনের ভেতরে হয়তো একটি মেশিন আমি
যন্ত্রের মর্মরে
একটি মেশিন ইন্দ্রিয়শীল কেবলি ঊর্ধ্বগামী
স্বপ্নে ও কৈশোরে।

মেঘ তুমি বুঝি বালকের ভাষা আদিম উদ্দীপনা
মেঘ তুমি আদি স্মৃতি
    যখন এখানে উৎসাহ ছিল পরিকল্পনা
ছিল নির্মাণরীতি।

‘মেঘমেশিনের সঙ্গীত’ ।। মেঘমেশিনের সঙ্গীত (১৯৮৮)

১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ফরহাদ মজহারের সবথেকে জনশ্রুত ও আদৃত কাব্যগ্রন্থ ‘এবাদতনামা’।      এই বইয়ে তিনি এমন একটি কাব্যভাষা নির্মাণ করেন, যার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা যোগাযোগের একটি নতুন সেতু তৈরি করে কি? এই গ্রন্থটির শেষ প্রচ্ছদে কবি ফরহাদ মজহার ও সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলা ও বাংলাদেশের মৌল ধর্মকে মিলিয়ে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, তার গোড়াতেই বলা হয়েছে – ‘ফরহাদ মজহার কবি, এ পরিচয়ে থাকতে পারলে সম্ভবত তিনি সবচেয়ে বেশি সুখী হতেন। তাঁর রক্তে-মাংসে মিশে আছে কবিতা। কিন্তু কেবল কবি হওয়া তাঁর ধাতে নেই। দর্শন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নানাবিধ সক্রিয়তার জন্যেও তিনি সমান লোকপ্রিয়।’ ধর্ম ও বিশ্বরাজনীতি এল তাঁর কবিতায়, যার উৎসর্গে তিনি লেখেন –

তুমি কি আল্লা মানো? তুমি বেটা পাঁড় কমিউনিস্ট
তুমি কেন লিখিতেছ অকস্মাৎ এবাদতনামা?
কহি শুন :  বহু আছে বুর্জোয়া – সর্বস্ব নাস্তিক
অথচ খাতায় আছে একমাত্র আমার ঠিকানা।
কাহারে দুষ্কের কথা কই আজ শুনিও সকলে
মোমিন ও বুর্জোয়া জোড়ে চলে বগলে বগলে।   
  

‘উৎসর্গপত্র’ ।। এবাদতনামা’ (১৯৯০)

এই কাব্যসংকলনে উঠে এসেছে  ইতিহাসনির্ভর আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মনির্মাণের নানা প্রশ্ন – মানুষ, হিন্দু, মুসলমান, ইসলাম, জাত, নিত্যানন্দ, শ্রীচৈতন্য, নবদ্বীপ, সরস্বতী, মহম্মদ, এমনকি তৈমুর লঙ-ও। কাব্যিক ভাষার নতুনত্বের মধ্যে মিলেছে দর্শনের নানা তর্ক, পূর্ব-পশ্চিমের দ্বন্দ্ব, ও নানা ভাবনার উপাদান। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অগ্রবীজ পত্রিকায় (২০১১ আগস্ট) এক সাক্ষাতকারে তিনি বলছেন – “কবিতা কেমন করে কবিতা হয়ে ওঠে, তার পদ্ধতিটা, তার নির্মাণ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে তার আবির্ভাবপ্রক্রিয়া, সবই দর্শন থেকে আলাদা। দর্শন তো একটা প্রশ্নকে মোকাবেলা করে শুরু হয়। কবিতা একটা ধ্বনি দিয়েও শুরু হয়। শুধু একটা বাক্য দিয়েও শুরু হতে পারে, যার হয়তো কোনো মানে নেই। …কবিতা নিয়ে আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গুলোর সময় আমি ভাবতাম, কবিতার আঙ্গিকটা কীভাবে করব, রাজনীতির প্রসঙ্গ যদি আনি সেটা কাব্যিকভাবে করা যায়। যেমন ‘কবিতার বোনের সঙ্গে আবার’ (কাব্যগ্রন্থ) যখন লিখেছিলাম তখন দুই বাংলা আমার মাথার মধ্যে কাজ করছিল। ‘বঙ্গে সরস্বতীর গর্ভে একটি মেয়ে একটি ছেলে/ নগদ কাব্য নগদ পাব উভয়কে একসঙ্গে পেলে।’ এটা ছিল আমার দিক থেকে অর্থাৎ কবির দিক থেকে বাসনা যে সরস্বতীর গর্ভে দুজনেই জন্মগ্রহণ করব।”

নিচের কয়েকটি লাইনে এই আলোচনার অনেকটাই ধরা পড়ে –

মাঝে মধ্যে দুই চোখে নেমে আসে রাজ্যের আঁধার
তৈমুরের কালো ঘোড়া মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার
নূর ও বরফ ঢেকে দাঁড়িয়েছে – আলো নাই হায়
আলো নাই – অপার ভারতবর্ষে আমি নিঃসহায়।

না আমি মোঙ্গল নই, নই তুর্কী, মুঘলকি বীর
অহংকারী আর্য নই, নই খাস প্রাচীন দ্রাবিড়,
ভূমিষ্ঠ হইনি আমি ব্রাহ্মণ বা মৌলবির ঘরে
আমি নয়া অভ্যুদ্য়য় ভূমণ্ডলে মাটির অন্তরে।

আমার রূহের মধ্যে আমলকি সৃষ্টির সুবাদে
রুয়ে দিয়েছিলে; আমি উদ্ভিদের গর্ভের সংবাদে
সতী যেন মরিয়ম; প্রভু, তবে দাও অভিজ্ঞান
দাও বাক্য, বলো ‘হও’, আমি জন্মদিন করি প্রাণ
বঙ্গোপসাগরে – করি বালি-নুন-শঙ্খ-কাদা-তীরে
আজানুলম্বিত সিজদা, বঙ্গদেশে, এহেন তিমিরে…

‘নয়া অভ্যূদ’য় ।। এবাদতনামা (১৯৯০)।

                  

এবাদতনামার প্রথম সংস্করণের পর কয়েকটি অগ্রন্থিত এবাদতনামা ‘কবিতাসংগ্রহ’-এ সংযোজিত হয়। তবে নিরানব্বইওটি কবিতা নিয়ে ‘এবাদতনামা’ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। সেখানে কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়েও তাঁর একটি বারো লাইনের কবিতা দেখতে পাই। দুই বাংলার ভাষাভেদের তুলনা ছাড়াও কবির কোথাও কি অভিমান মিশে আছে?

প্রকৃত চুলের মধ্যে অমেয় জলের উৎস আছে
বিনয় মজুমদার

জলের মাবুদ তুমি প্রভু তুমি পানির ঈশ্বর
তবুও বৃহৎ বঙ্গে জল আর পানি মিশিল না
পানি কথাটাকে কেটে বারবার লিখি আমি জল
তবুও পদ্মার জলে গঙ্গার পানি মজিল না।

মানুষ ও ভূগোলের স্রষ্টা তুমি, বুঝেছি তবুও
মন আর মানচিত্র প্রভু কারো মানে না নির্দেশ।
তোমারই দ্রব্য হয় পাত্র ভেদে জল আর পানি
তোমারই ভূগোল হয় ইতিহাস ভেদে ভিন্ন দেশ।

“প্রকৃত চুলের মধ্যে অমেয় জলের উৎস আছে”
আমার ভাইদের মধ্যে বিনয় তা জেনেছে বিশদ
চুলে জটা বেঁধে গেছে মহাদেব এখনো বেহুঁশ
মা জটা ছাড়াচ্ছেন ভেবে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ।

‘বিনয়ের দুই বাংলা’/ এবাদতনামা ৫৫ ।। এবাদত্নামা (২০১০)

এই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থটির শেষ প্রচ্ছদের সেই প্রবন্ধটি শেষ হয় এইভাবে – “আল্লার সঙ্গে তার দোস্ত নবী মুহম্মদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ও অতি আধুনিক টানাপোড়েন বা টেনশন, বা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের দশাপ্রাপ্তি বা শ্রী চৈতন্যের রাধা ভাবে উপাসনার নারীবাদী ভাববৈশিষ্ট্য – এ সবের অসামান্য আধুনিকতা (কারো কারো) চোখে পড়ে না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে আমরা যদি জিততে চাই তাহলে যা আমাদের নিজস্ব সম্পদ – আমাদের মর্মের যা ভাবস্বভাব – তাকে উদ্ধার করা চাই। ‘এবাদতনামা’ এই আলোকে পাঠ করলে পাঠক উপকৃত হবেন। এই কাব্যগ্রন্থটি একদিকে সাম্রাজ্যবাদ অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার কবল থেকে নিজেদের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা।”

পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘অসময়ের নোটবই’ ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটির কবিতাগুলি ঘোষিত ভাবেই রাজনৈতিক। আশির দশকে এরশাদ-শাসিত বাংলাদেশে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ও লড়াই চলে, আফগানিস্তানের যুদ্ধ তেল-কোম্পানিগুলির পরিকল্পনামত শেষ হয়েছে, ইরাকে যুদ্ধপ্রস্তুতি সমাপ্ত, এবং কবি ভাবছেন এই অসময় দীর্ঘস্থায়ী হবে। কবিতাগুলিতে নানা মাপের ফন্ট নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে কিছু শব্দে প্রস্বর আরোপের জন্য। বেশির ভাগ কবিতাই স্লোগানধর্মী, তবু তারই মধ্যে চোখে পড়ে কাব্যসুষমামন্ডিত এই ধরণের কিছু লাইন –

“অকস্মাৎ আসমান জলস্পর্শে গলে গিয়ে তরঙ্গের প্রেমে
ডুবুরির ক্ষিপ্রতায় আড়াআড়ি নেমে যায় নুনে ভর্তি নীল
বঙ্গোপসাগরে – তুমি সেইখানে আমারে করিও তিমিমাছ
আমি শুধু একবার সমুদ্রের একবার আকাশের দিকে
নয়ন নিক্ষেপ করে ছবি নেবো নিরালম্ব তুমুল সঙ্গম।
লো প্রেম, শেখাও শিখি, ভেজাও, ভিজিতে ভারী সাধ। তিমিমাছ
ভাসো, অহো ভেসে ওঠো, রোমহর্ষে লবণাক্ত পুচ্ছ কাঁপাও।

‘ধর্মতত্ত্ব’ ।। অসময়ের নোটবই (১৯৯৪)

১৯৯৪ সালেই প্রকাশিত হয় ফরহাদের অপর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘দরদী বকুল’, উৎসর্গ করেছেন বিশিষ্ট বিদুষী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে – ‘গায়ত্রী দি, দরদী বকুল নামক এই প্রবন্ধ তোমার করকমলে সোর্পদ করিলাম। লজিক আর ব্যাকরণের মুরুব্বিয়ানা এই জমানায় কিয়ৎ পরিমাণ খামোশ হইবার পর পদ্য এখন কলিজায় বল পাইতেছে। অলংকারে প্রতীকে নিজে দুই আনা আর খোশহাল পাঠকদিগকে বাকি চৌদ্দ আনা অর্থ উৎপাদন করিবার এখতিয়ার দিয়া পদ্য খালাস। অতএব বকুলগণ এই সকল প্রবন্ধে কি কারণে কার উসিলায় কোন হুকুমে ফুটিল, আমার হুঁশ নাই। তুমি ক্ষমাঘেন্না করিয়ে গ্রহণ করিও।’

বলছেন ‘প্রবন্ধ’, এদিকে আপাদমস্তক ছন্দে লেখা কবিতার বই। তাহলে প্রবন্ধের সুবিন্যস্ত বক্তব্য সাজানো আছে কি, কবিতাগুলির লাইনে লাইনে? দেখা যাক প্রথম কবিতাটিই –

বড়ো সাধে হয়ে উঠি খোঁপা
বড়ো সাধে বিদ্যুতের গান
পৃথিবীর সুখে ও অসুখে
হয়ে উঠি রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

বকুলের গুচ্ছে তৈরি তোড়া
দেখি নি কখনো কোনো কালে,
 বড়ো সাধে হই সেই হাত
অর্ঘ্য হই সকালে বিকালে।

বড়ো সাধে দশাগ্রস্ত ফুলে
কেশ হয়ে ঢাকি এ আনন
মনুষ্যের মধ্যে হয়ে উঠি
গৌরাঙ্গ, মুখস্ত কানন।

‘বাড়তি পদ্য’ ।। দরদী বকুল (১৯৯৪)

জাত্যাভিমানে কিংবা শ্রেণীদাপটে নিমজ্জিত বাঙালির দীন দশা হিন্দু-মুসলমানকে নির্বিশেষে কীভাবে আচ্ছন্ন করে এসেছে, একটি কবিতায় সহজ ভাষায় জানান তিনি। লক্ষ্যণীয় যে এখানে তাঁর কাব্যভাষায় একটু পরিবর্তন এসেছে।

বকুলনগরে চলো ট্রেন
বকুলনগরে চলো গাড়ি
 চলো রিক্সা, নৌকা, স্টিমার
ওখানে আমার মামাবাড়ি।

আমার মামার নাম শেখ
পরাণ মণ্ডল জাতে চাষা
আমার মামীর নাম বুঁচি
নমঃশূদ্র ঘর থেকে আসা।

মোরা ম্লেচ্ছ, মোরা বঙ্গদেশে
সুখে দুঃখে রয়েছি যবন
দাবড়ায় কখনো সৈয়দ
       লাথি মারে কখনো ব্রাহ্মণ।

জিহবায় বকুলের স্বাদ
       টের পেয়ে বুঝেছি সম্প্রতি
আমার আব্বা মহাদেব
আমার আম্মা পার্বতী।

আমার জন্ম হিমালয়ে
    কৈলাসে গিরির কন্দরে
গ্রাম আমি দেখেছি বিস্তর
তবে থাকি বকুল নগরে।

‘বকুল নগর’ ।। দরদী বকুল (১৯৯৪)

এই বইয়ের দীর্ঘ ছবছর পর প্রকাশিত হয় টানা গদ্যে লেখা ‘গুবরে পোকার শ্বশুর’, যেটি উৎসর্গ করা হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেন কে। এই বইয়ে দীনেশচন্দ্র সেনকে নিয়েও আছে কয়েকটি জাদুবাস্তবতায় ভরা লাইন  –

…শিশুদের উপর দৈত্যের আধিপত্যে বৃদ্ধরা ভীত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। তাদের ঘোর প্রতিবাদ ও তুমুল কান্না সত্ত্বেও বুলডোজার দিয়ে একদিন তারা স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলল।
ঠিক তক্ষুণি ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে পড়ল দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’। বৃদ্ধরা সব কপি পুড়িয়ে ফেলার পর বেচারা দৈত্য শিশুদের জন্য এই একটিমাত্র কপি এতোদিন পাহারা দিয়ে রেখেছিল।

‘দৈত্যের গল্প’ ।। গুবরে পোকার শ্বশুর (২০০০)

লোকাচারের মাধ্যমে বাঙালির একটা জীবনযাত্রা তাদের ধর্ম বা দর্শনবোধের থেকেও সহজ সরল সত্য হিসেবে অন্তর্লীন হয়ে থাকে। নানা কবিতায় নানা অনুষঙ্গে সেই আচারের নানা ছবি আঁকেন ফরহাদ, তাতে যে-সুষমা, তার লেবেল খুঁজতে হয় না। তখন কবরগাহের কাঁটাগাছে ছিন্নবিচ্ছিন্ন পায়ের রক্ত তাঁকে নিয়ে যায় অন্নপূর্ণার কাছে –

  …সব কিছু পার হয়ে আমি যখন দাওয়ায় পিঁড়িতে বসে খেতে বসব, তখন দেখবে আমার পায়ের চিহ্নেই শুধু উঠান আর দিগন্ত আলাদা হয়, নইলে সর্বর্ত্রই আমি এবং তুমি। কসম অন্নপূর্ণা, আমি রক্ত দিয়েই মৃত ও জীবিত সকল জগতেই তোমার নাম লিখে এসেছি। যেন আমাকে ক্ষুধার অন্ন ফিরিয়ে দেবার সাধ্য তোমার না হয়। দাও, ক্ষুধার্তকে পেতে দাও মাটির বাসনে ভাত আর ভর্তা।

‘অন্নপূর্ণা’ ।। গুবরে পোকার শ্বশুর (২০০০)

২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘কবিতার বোনের সঙ্গে আবার’, উৎসর্গ কবি সুফিয়া কামালকে। এই বইয়ের প্রথমেই ‘প্রথম তরঙ্গ’ নামে একটি দু-লাইনের কবিতা আছে – ‘বঙ্গে সরস্বতীর গর্ভে একটি মেয়ে একটি ছেলে/ নগদ কাব্য নগদ পাবো উভয়কে একসঙ্গে পেলে’। গ্রন্থটি সম্পর্কে ফ্ল্যাপে যা ছাপা হয়েছিল তার একাংশ হল ‘তবু কোথায় জানি সিগমুন্ড ফ্রয়েড সাহেবের সঙ্গে এই কবিতার একটা তর্ক শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাকে খানিক মশকরা করে কবিতার ভাই আর বোন হাত ধরাধরি করে চলে যায় অন্য একটি রাষ্ট্রে। যেখানে গুজরাট নাই, সংখ্যালঘু নির্যাতন নাই এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সম্ভাব্য সংঘর্ষ বা ভীতিকর যুদ্ধেরও কোন সম্ভাবনা নাই। শুধু সরস্বতী তাঁর দুই সন্তানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে হাসছেন।’

পাঁচ দশকব্যাপী একজন কবির যাত্রাপথের অভিমুখ এইভাবে বারবার বদলেছে, কেবল কল্পজগতের বিস্তারে নয়, জীবনযাপনের নানা বাঁক থেকে আহরণ করা নানা স্বাদের নানা বর্ণের অভিজ্ঞতার মিশেল সরাসরি এসেছে তাঁর কবিতায়। বিতর্কিত হন বা সমাদৃত হন, ফরহাদ মজহার কবিতার জগতকে যে সুউচ্চ অট্টালিকার থেকে নিসর্গছবি হিসেবে দেখেন নি কেবল, বরং রক্তের দাগ ধুয়ে রবীন্দ্রপাঠের অভিজ্ঞতার মত জীবনের সত্যকে ব্যক্তিগত উপলব্ধির জায়গা থেকে কবিতার নানা বিস্তারে নিয়ে এসেছেন, সেটা তাঁর পূর্বকাল, সমকাল, ও উত্তরকালের অনেক কবিদের তুলনায় তাঁকে বিশিষ্ট করে।

ছবি: অতনু সিংহ, নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি, ২০১৮


লেখক পরিচিতি:

সৌম্য দাশগুপ্ত

আটের দশকের কবি, প্রাবন্ধিক, এবং অগ্রবীজ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক, যিনি আশির দশক থেকেই দুই বাংলার সাহিত্যিকদের নিয়ে সেতুনির্মাণ করে কাজ করে চলেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম “রাজার জামা পরা মায়াবী সাতদিন” (১৯৯৪), “কবিতা, ডালাস” (১৯৯৯), “মহাপৃথিবীর ওয়েবসাইট” (২০০০), এবং “আলো, আলোতর, আলোতম” (২০০৮)। এছাড়া অনুবাদ কবিতার বই “কবিতা, ডাউন আন্ডার” (অস্ট্রেলিয়ার কবিতা, ২০০৭), “টোমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা” (২০১২)।
পেশায় তিনি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থা সাচি এন্ড সাচি র কর্মকর্তা, এবং সাদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্ত অধ্যাপক। থাকেন লস এন্জেলেস ও কলকাতা মিলিয়ে, এবং নিয়মিত ঢাকা-চট্টগ্রামে যান।

Share