পেগানিজমের ভূত ও পয়লা বৈশাখ

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

“কে বাঙালি কে বাঙালি না, কে মুসলমান, কে সনাতনী, কে কতদূর কী হতে পারলেন- এমন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী আলাপেও আমি ঢুকছি না। আমি জানি জোর করে সংস্কৃতি চর্চা বা দুনিয়ার কিস্‌সু হয় না। আমি বিশ্বাস করি, যিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান না, তার ১০০ শতাংশ অধিকার আছে তাতে অংশ না নেওয়ার। এবং তাতে অংশ না নেওয়ার ফলে তাকে বাঙালি না বলার, কম বাঙালি আধা বাঙালি পাকিস্তানী রাজাকার বলার শয়তানির আমি বিরোধিতা করি। এবং একই সাথে এও বিশ্বাস করি, যিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান, যিনি চৈত্র সংক্রান্তি পয়লা বৈশাখ পান্তা পোড়া মরিচ শুটকি ভর্তা বাতাসা গুড় মুড়ি আচার ফুচকা একদিনের জন্য আড়ং দেশাল যাত্রার শাড়ি পরে একদিনের জন্য বাঙালি সাজতে চান, যিনি অফিস থেকে বৈশাখি ভাতা নিয়ে বৈশাখে নামাজ পড়ে রোজা রেখে দিন কাটান, যিনি কর্পোরেট স্ট্রাকচারে বৈশাখে ২৫% মূল্যছাড়ে সাদা শাড়ি লাল পাড়ের ব্যবসা করেন, তারও একইভাবে অধিকার আছে বিনা বাধায় তাতে অংশ নেওয়ার। এবং তিনি মুসলমান হয়ে এই কাজ করতে পারেন না, মুসলমানের জন্য বৈশাখ পালন ব্বেদাত, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাওয়া শেরকি, তাকে জোর করে এই ধর্মীয় আলাপ শোনানোর আমি বিরোধিতা করি। আমার অবস্থান দ্বিপাক্ষিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্বিপাক্ষিক ঘৃণার চাষের বিরুদ্ধে।”

পেগানিজমের ভূত ও পয়লা বৈশাখ

আমার কলিগ আমনা হাসান কিছুদিন আগে বিয়ে করে হানিমুন থেকে ফিরেছেন। উনার পোস্ট-বিয়ে সেলেব্রেশানের উদ্দেশ্যে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি মাদ্রিদের প্লাসা দি মাইয়োরের এলেমেলো কবোলস্টোন বসানো প্লাজার উপর সাদা চাদর ঢাকা গোল টেবিলের চারদিকে বসে। আমনার মা সিরিয়ান, বাবা ইজিপশিয়ান। উনি সিরিয়া থেকে আমাদের সবার জন্য সুভেনিয়ার নিয়ে এসেছেন। আমার জন্য এনেছেন সিবিল নামের সিরিয়ান দেবীর ছবি আঁকা সোনালী রঙের হাতে বানানো ব্রোঞ্জের লকেট। আমি দেখলাম, সিবিলের দুই পাশে বসে আছেন দুইজন সিংহ, তিনি এক হাতে ধরে আছেন সিস্ট্রাম নামে এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র, সুতা প্যাঁচানোর তাঁত আর একটা লাঠির মাথায় প্যাঁচানো দুইজন পাখাওয়ালা সাপ, যাকে সচরাচর হার্মিসের চিহ্ন কাডুসিয়াস বলা হয়।

আমি খুব আশ্চর্য্য হলাম। ইচ্ছা থাকলেও এখন পর্যন্ত আমি সিরিয়াতে যাই নি। আমার দুইজন সিরিয়ান বন্ধুর একজনের নাম মরিয়ম, যিনি খুব অল্প বয়সে যুদ্ধের মাঝখানে দেশ ছেড়েছেন, তার কাছে এবং পত্রিকায় এবং ইউটিউবে ‘ভালোবাসার শহর’ নামের শর্ট-ফিল্মে সিরিয়া সম্পর্কে আমার যা অতি সামান্য জ্ঞান, তাতে আমার কোনোদিন সিরিয়ার সাথে হার্মিসের সম্পর্ক কল্পনা করার কথা না।

হার্মিস একজন বার্তাবাহক দেবতা। তিনি পেগানদের দেবতা, বলাই বাহুল্য।

আমাদের এখানে এখন ইস্টার হলিডে চলছে। কট্টর হিব্রু-খ্রিশ্চানরা ইস্টারকে পেগান হলিডে বলে বাতিল করে দেন। তবে সত্য কথা বলতে, ইস্টারের অরিজিন সত্য সত্যই পেগানিজমে। ইস্টারের পাশাপাশি একই সময়ে জাপানীদের সাকুরা মাৎসুরি উৎসব, উত্তর পশ্চিম ইওরোপ ধরে স্প্রিং ইকুইনক্স, পোলান্ডে মারজান্না, বসনিয়ায় চিমবুরিয়াডা, মধ্যপ্রাচ্যে নউরুজ, থাইল্যান্ডে শংক্রান, আমাদের অঞ্চলে বৈসাবি বা বিজু আর চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব চলছে। এই প্রতিটা উৎসবকেই মোটাদাগে ‘পেগান’ উৎসব বলা যায়। যদিও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও গণউৎসবগুলোকে ‘পেগান’ বলে চিহ্নিত করাটা ইওরোপমন্য দৃষ্টিভঙ্গি, সে কথা আগেই স্বীকার করি। আমি পপুলার টার্মে ‘পেগান’ শব্দটাকে আমাদের উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী, পারম্পরিক উৎসবগুলোকে ‘পেগান’ বলেছি। মোটা দাগে। ‘মোটা দাগে’ কথাটাকে খেয়াল করবেন। এনিওয়ে…

হার্মিস

এবং শব্দ হিসাবে পেগানিজমকে পৌত্তলিক বলে চিহ্নিত করার শয়তানির আমি বিরোধিতা করি। পেগানিজম মূলত প্রকৃতির সাথে যোগাযোগের প্রকৃতিনির্ভর জ্ঞান ও আচার। তার কিছু অংশে মূর্তিপুজা আছে অবশ্যই, কিন্তু পেগানিজম মাত্রই মূর্তিপুজা নয়। আবার এটাও মনে রাখা দরকার যে, মূর্তি মাত্রই পৌত্তলিকতা নয়। কারণ পৌত্তলিকতা বলতে যে রাজা ও প্রজার মধ্যকার কেন্দ্রিয় ক্ষমতার রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, তা ভারতীয় উপমহাদেশের বিকেন্দ্রিক টোটেম ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো না। এখানে উল্লেখ্য, এই টোটেমসমূহ পরবর্তীতে উপাস্য দেবদেবীতে রূপান্তরিত হন। টোটেমগুলি প্রাথমিকভাবে অবশ্যই গোষ্ঠির অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা জীবিকানির্বাহের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ইদার সম্পর্কিত ছিল, অথবা প্রকৃতিনিবিড় জ্ঞানচর্চার সঙ্গেও যোগ ছিল এসকল টোটেমের। অন্যদিকে, পেগানিজমে মূর্তি আকারে টোটেমের অবস্থান আছে, যেই মূর্তিকে অনেকক্ষেত্রে উপাস্য বানানো হয়েছে, অনেকক্ষেত্রে শুধুমাত্রই আধ্যাত্মিক যোগাযোগের চিহ্ন হিসাবে ধারণ করা হয়েছে। আরব অঞ্চলে পেগানিজম ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রের অংশ এবং স্বভাবতই তা ছিল কেন্দ্রিভূত (কাবাকেন্দ্রিক)। ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত আরবের মূর্তিসমূহকে কেন্দ্র করে বিবাদ-ফ্যাতনা-ফ্যাসাদ ও রক্তপাতের নজির তৈরি হয়েছিল, যা ছিল মানুষের বিরুদ্ধে মূর্তিকেন্দ্রিক পুরোহিত সমাজের আধিপত্য, সেই আধিপত্যবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকে আরবের মূর্তিব্যবস্থাকে পৌত্তলিকতা বলে চিহ্নিত করা গেলেও বাকি উপমহাদেশ-সহ দুনিয়ার অনেক এলাকার টোটেমিয় সংস্কৃতিকে পৌত্তলিক বলার সুযোগ নাই এই কারণেই যে আরবের মতো সেগুলি ক্ষমতাকেন্দ্রের সম্পর্কিত ছিল না তো বটেই এবং সেগুলি ছিল বিকেন্দ্রিক। এই পার্থক্যটা মনে না রাখলে দুনিয়ার সকল টোটেমিয় সংস্কৃতিকেই পৌত্তলিক বলে মনে হতে পারে। এবং এর ফলেই পরিচয়বাদী, বাজারবাদী, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার রাজনৈতিক শয়তানির এজেন্ডার অংশ হিসাবেই মুসলিম পরিচয়বাদীরা সকল কিছুকেই পৌত্তলিক বলে চিহ্নিত করতে করার চেষ্টা করেন আর তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলে হিন্দুত্ববাদ-সহ আরো অন্যান্য পরিচয়বাদী রাজনৈতিক বর্গগুলোর পারস্পরিক ঘৃণা-রাজনীতির বাণিজ্য।

দ্যাখেন- এই যে সারা পৃথিবীতে, দুই গোলার্ধেই একই সাথে বসন্তের উৎসব হচ্ছে, তুষারপাত বন্ধ হয়ে গরমের শুরুর সাথে সব পশুপাখির ছানাপোনা জন্মানোর সবুজ ঘাসের ভেতর সাদা নার্সিসাস আর হলুদ ড্যান্ডেলিয়ন আর বাটারকাপ আর বেগুনি হায়াসিন্থের সাথে জাপানীজ সাকুরা আর আমাদের রক্তপলাশ জুঁই মধুমঞ্জরী মাধবীলতা স্বর্ণচাঁপা কণকলতা পারিজাত দেবকাঞ্চন ফুলে নউরুজের টেবিলে আবশ্যিকভাবে থাকা সাত বা চোদ্দ পদের খাবার- সাবজি, সির, সিব, সারকা, সুমাক, সানজিদ, সামানুর সাথে চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপনের চোদ্দ পদের শাকের দোলের রঙে মেক্সিকোর শহর লাল নীল সবুজ হলুদ আবীরে হাতে আঁকা ডিমের খোলসে শিশুদের ঝুঁড়ি দিয়ে পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তের মানুষরা এক হয়ে যাচ্ছেন, ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম আলাদা হয়েও ভাষা সংস্কৃতি ধর্মে সবাই একত্রিত হচ্ছেন, একে শুধুমাত্র পৌত্তলিকতা বলে বাতিল করে দেওয়ার শয়তানি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ ছাড়া আর কিছুই না।

পার্সিয়ান নববর্ষ নউরুজের নৃত্য, তেহেরান, ইরান

বাংলাদেশে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ আসার আগে আগে মঙ্গল শোভাযাত্রা পেগানদের উৎসব আর বৈশাখ পালন আমাদের সংস্কৃতি কিনা এই নিয়ে প্যান ইসলামিস্টদের ‘বাঙালি বনাম মুসলিম’ বক্তব্যে ফেইসবুক ফিড বৈধব্যজ্বালায় ভারী হয়ে ওঠে। অপরদিকে তথাকথিত প্রগতিশীলদেরও ‘জাত গেলো জাত গেলো’ স্টাইলে ইসলামপন্থীদের বৈশাখ বর্জনের ‘অপসংস্কৃতি’র আলাপের তাধিন্নাধিন মাতম শুরু হয় একই স্টাইলে।

অপসংস্কৃতি টার্মটাতেই আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, সংস্কৃতির অপ হয় না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয়, সংস্কৃতির আধিপত্যবাদ হয়, কিন্তু তার অপ হয় না। আমি মনে করি, সংস্কৃতির কৌমার্য্য রক্ষার স্বার্থে তাকে মাড় দিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রি করে ভাঁজটাজ করে নেপথলিন আর শুকনা ফুলের পাঁপড়ি আর লবঙ্গ আর কমলার খোসা সমেত যত্ন করে সিন্দুকে ভরে রাখা যায় না।

১৯ শতকের শেষের দিকে অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে’ সহ রবার্ট লুই স্টিভেনসন, এইচ জি ওয়েলস বা এমিল যোলার লেখা বিভিন্ন গল্পকেও অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। এইসব আজেবাজে তত্ত্ব এসেছিলো জ্যাঁ ব্যাপটিস্ট লামার্কের বৈজ্ঞানিক থিওরি নামক অবৈজ্ঞানিক আলাপ থেকে, যা পরবর্তীতে বায়োলজির বাইরে সমাজ ও সংস্কৃতিতেও লম্বা সময় ধরে প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশেও এমন আজগুবি তত্ত্ব এবং এসব তত্ত্ব নিয়ে চ্যাঁচানোর লোকের শেষ নাই।

বাংলা ভাষার জন্ম যিশুর জন্মের অনেক আগে। তবে আধুনিক বাংলার বয়স প্রায় ১,০০০ বছরের কিছু বেশি। বাংলার ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সৈয়দ সুলতান, আব্দুল হাকিম, চণ্ডি দাস, আলওয়াল, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, ভরতচন্দ্ররা। বাংলা ভাষা শংকর। এই ভাষার মূলগত ‘প্রাকৃত’, ‘মৈথিলী’, ‘ব্রজবলি’র মতো অবৈদিক/ অনার্য ভাষার পাশাপাশি আরবি, ফার্সি, তুর্কি ও সংস্কৃতের উপাদান যুক্ত হয়েছে। এরপর উপনিবেশ আমল থেকেই আমাদের এই অঞ্চলের ভাষায় আরো বেশ কিছু বিদেশি শব্দ ঢুকেছে এবং পরবর্তীতে সেসব শব্দ বাংলা ডিকশনারিতে বাংলা হিসাবেই আটকে গেছে। ভাষার পাশাপাশি ধর্মের কারণে পৃথিবীর আর বেশিরভাগ জায়গার মতোই আমাদের সংস্কৃতিও মিশ্র সংস্কৃতি, এবং এ কারণেই আমাদের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, গান, নাচ, সাহিত্য, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা যা অভিব্যক্তি প্রকাশ করি, তা কোনোভাবেই মৌলিক না। এবং একমাত্র পাপুয়া নিউগিনি বা পৃথিবী থেকে দূরে মহাকাশের কোনো দ্বীপে (?) গিয়ে বাস না করলে সেটা সম্ভবও না।

আমার বিভিন্ন লেখায় আমি আমার ঢাকার বাসার দারোয়ান ভদ্রলোকের কথা বলেছি বহুবার। যিনি আগে সনাতনী ছিলেন, বছর দুই তিন হবে, ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু তাতে উনার এক ইঞ্চি চারিত্রিক পরিবর্তন বা আত্মিক উন্নতি হয় নি। বরং উনি ‘যেইয়া লাউ হেইয়া কদু’ ‘যেই তিমির সেই তিমির’ই আছেন। উনি আগের মতোই নিয়মিত চুরি করছেন, মিথ্যা কথা বলছেন, পরনিন্দা পরচর্চা করছেন, প্লাস- নতুন এলেমেন্ট হিসাবে- পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় আঠারো ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন এবং রোজার মাসে সারারাত জেগে থেকে দিনের বেলা প্রমোদশয্যায় ঘুমাচ্ছেন। ফলত, উনাকে কখনোই কাজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে উনার মুসলমানিত্বের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সপ্তাহের সাত দিনের নাম বলতে গেলেই উনার নতুন পাওয়া ভ্যানিটিব্যাগ ধর্মের অবমাননা হচ্ছে। উনি শুক্রবারকে বলছেন জুম্মাবার। আর শনিবারকে বলছেন জুম্মাবারের পরের দিন। বাসার রান্নার খালা উনার সন্তানকে ‘লক্ষ্মী বাবু’ বলায় উনাকে নসিহত করছেন, বাচ্চাকে লক্ষ্মী সম্বোধন না করতে।

কারণ লক্ষ্মী ‘হিন্দুদের দেবী’।

আমি বিশ্বাস করি, এই সূর্যের চাইতে বালি গরম দশার, এই ধর্মীয় সমুচ্চখুরওয়ালা জাতীয়তাবাদের সূচনা অন্য কোথাও না, বরং এর জন্ম আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে। নিজের পরিচয় না জানার হীনম্মন্যতায়, নিজের পরিচয় খুঁজে না পাওয়ার কষ্টে।

আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলে ইসলাম নাযেল হয় নি, বৈদিক বা আর্যদের মতোই মুসলমানদের সাথে ইসলাম এই অঞ্চলে ধর্ম হিসাবে প্রবেশ করেছে। সুতরাং আমাদের চিন্তায় মননে ভাষায় সংস্কৃতিতে প্রাক-ইসলামিক সনাতনী (এবং টোটেমিয় সংস্কৃতি) অনুষঙ্গ থেকে যাবে, তাই স্বাভাবিক। যে কারণে হিসাব করলে দেখা যাবে শুক্র শনি রবি সোম মঙ্গল সব বারই অনৈসলামিক শব্দ। মুড়ি মুড়কি পালা পার্বণ জোড়া ইলিশ গায়ে হলুদ আমপাতা জামপাতা চন্দন তুলশী রথ আলতা বেনারসি কাঞ্জিভরম তাঁত নিধুবাবুর টপ্পা টিপ কাঁসার বাসন আল্পনা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি বৌভাত ফুলশয্যা বাসর ঘর নাটক প্রহসন কালীঘাটের পট পুঁথি পটুয়া ঠাকুমার ঝুলি ঋষি ওঝা পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলক মেলা পালকি সেতার বাউলের একতারা দোতারা ডুগডুগি রাগ-ভৈরবী কোমড়ের চন্দ্রহার সবই অনৈসলামিক। তো এখন করণীয় কী? শরীর থেকে মগজ থেকে দেশ থেকে ভাষা থেকে সমস্ত ‘হিন্দু’ উপাদান শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে ফেলে দিতে হবে? সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস, লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর, দুর্গার বাহন সিংহ বা বাঘ বলে দেশকে ইসলামিফাই করতে এলাকার সব রাজহাঁস প্যাঁচা ইঁদুর ময়ূর বাঘ সিংহ মহিষ ষাঁঢ়কে গুলি করে উড়িয়ে দিতে হবে? চন্দ্র ও সূর্যকে সনাতনীরা দেবতা ভাবেন বলে আকাশ থেকে চন্দ্র সূর্যকে বোমা মেরে ফেলে দিতে হবে? সনাতনী নারীরা শাড়ি পরেন বলে দুনিয়ার সব শাড়ি নিয়ে বুড়িগঙ্গার কালো পানিতে ফেলে দিতে হবে? মঙ্গল শোভাযাত্রায় দেবী দুর্গার চিহ্ন আছে বলে তাকে মোটাদাগে ‘হিন্দু’ বলে বাতিল করে দিতে হবে?

এছাড়া। এখানে পয়েন্ট হচ্ছে, দুর্গা কি শুধুমাত্রই একজন নির্দিষ্ট ধর্মের দেবী? দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে তিনি দেখিয়েছিলেন, সম্রাট আলেক্সান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন, তখন বাংলা ছিলো মাতৃতান্ত্রিক। তিনি তার বিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, দুই লক্ষ পদাতিক, তিন হাজার হাতি ও চন্দ্রগুপ্তের দুই হাজার সৈন্য নিয়ে ভারতে এসে পাঞ্জাব পর্যন্ত জয় করতে পারলেও বাংলাকে কখনো দখল করতে পারেন নি। এই আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার নারীশক্তিই (সূত্র-১)। মজার বিষয় হচ্ছে, আলেক্সান্ডারের প্রতীক ছিলো মহিষ। অলিনথাসের এফিপ্পাসের বয়ানে এথিনিয়াস ‘রাজার পোশাক’-এ লেখেন, আলেক্সান্ডার দা গ্রেট বেগুনী রঙেরও রোবের উপর মহিষের শিং পরতেন (সূত্র-২)। দীনেশচন্দ্র লিখেছেন, “সকলেই অবগত আছেন, আলেকজাণ্ডার মহিষের শিং শিরস্ত্ৰাণ-স্বরূপ ব্যবহার করিতেন। ইনিই কি চণ্ডীর কথিত মহিষাসুর ? কাশ্মীর প্রভৃতি দেশ হিন্দুর চক্ষে স্বৰ্গলোক-পুরু প্ৰভৃতি তদেশবাসী রাজগণ আলেকজাণ্ডারকে বাধা দিতে পারেন নাই। মহিষাসুরের দ্বারা দেবতাদের পরাভব এই সুত্রে পরিকল্পিত হইতে পারে; এত ঘটা করিয়া জয়দৃপ্ত গ্ৰীকবীর পূর্ব্বদিকে অভিযান করিয়া হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হইয়া চলিয়া যান ও অচিরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দেবলীলার দ্বারা এই অচিন্তনীয় পরাভবকাহিনী ব্যাখ্যা করিয়া হিন্দুরা হয়ত দেবী-যুদ্ধপরিকল্পনা করিয়াছিলেন। এই ঘটনার প্রায় চারিশত বৎসর পরে ‘মার্কণ্ডের চণ্ডী’ রচিত হইতে পারে।” অর্থাৎ আলেক্সান্ডার যদি মহিষাসুর হন, আর তিনি পরাজিত হন বাংলার নারীশক্তির হাতে আর দুর্গার অন্য নাম যদি মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কি বলা যায় না, দেবী দুর্গা শুধুমাত্র কোনো দেবী নন, বরং তিনিই ছিলেন বাংলার নারীশক্তির প্রতীক?

এক্ষেত্রে অতি অবশ্যই উল্লেখ্য, দীনেশচন্দ্র যদিও নিজেই স্বীকার করেছেন যে উনার এই আলাপ অনুমান নির্ভর, তথাপি আমি মনে করি, এই আলাপ সাবস্টানশিয়াল। এবং সেক্ষেত্রে দুর্গাকে শুধুমাত্র বৈদিক মন্ত্রে আবদ্ধ করে বহিরাগত দেবী বানানোও তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হয় না। বরং তিনি নারীশক্তির প্রতীক হিসাবেই বাংলায় থেকে যান।

হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি, ১৯৬০ এর দিকে ইস্ট পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের এই প্লাবনভূমি- ‘বাংলা’র স্বাতন্ত্র ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলো। আর তাই উঠেছিল স্বায়ত্ত্বশাসনের আলাপ এবং ক্রমে পূর্ণ স্বরাজ। পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা (বাঙালি মুসলিম, বাঙালি হিন্দু, বাঙালি বৌদ্ধ) নিপীড়িত হয়েছেন, তাই নিপীড়িত বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলাপ সেই সময় হয়তো দরকার ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নির্মাণ পরবর্তী সময়ে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনেকক্ষেত্রেই আগ্রাসী এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুঃখজনকভাবে ইসলামোফোবিক ভূমিকা পালন করছে। এবং সেই জাতীয়তাবাদ নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতেই মোটাদাগে নন-ইনক্লুসিভ ছিল। বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোর ক্রমান্বয়ে অপরায়ণের ফলে অনেকক্ষেত্রেই রুটলেভেলের নিপাট সাধারণ বাঙালি মুসলমানের একাংশ এই রাজনৈতিক ডিসকোর্সের সাথে মানসিকভাবে এর সাথে যুক্ত হতে পারেন নি। পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এর একটা উদাহরণ হিসাবে আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় গণমানুষের সংস্কৃতিকে যুক্ত না করা, আদিবাসীদের আলাদা রাখা, আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলকে মোটাদাগে ইসলামপন্থী পাকিস্তানপন্থী রাজাকার যুদ্ধবিরোধী এবং যুদ্ধবিরোধী ইকুয়ালস টু মুসলমানের দাঁড়ি-টুপি প্রমাণ করা মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রকৃত সমন্বয়বাদী বা মোটা দাগে ‘সেক্যুলারাইজেশন’-এর বদলে অনেকাংশেই ধর্মবিরোধী (পড়ুন ইসলামবিরোধী) আওয়ামী ধর্মে রূপান্তরিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ

সুতরাং পঞ্চাশের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদের হেগেলিয়ান থিসিসের বিপরীতে সত্তরের দশকের ইরানিয়ান রেভোলুশান পরবর্তী সৌদি ওয়াহাবিজম প্রজেক্টের হাত ধরে যে এ্যান্টিথিসিস দাঁড়িয়েছিলো বাংলাদেশে, তার নাম মুসলমান জাতীয়তাবাদই হওয়ার কথা। এই ইসলামিক সংস্কৃতি নামক যে জাতীয়তাবাদী প্রস্তাব আমরা দেখি, তা ঔপনিবেশিক আধুনিকতাবাদের পরিচয়বাদী সন্তান ছাড়া আর কিছুই না। যেটা বাংলাদেশের একই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদের অন্য রূপ। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মেলার মাঠে হারিয়ে যাওয়া দুই যমজ ভাইয়ের একজন।

এই দুই জাতীয়তাবাদী ভাইয়ের প্রথমজনের অবদান- যা কিছু হিন্দু তাকেই বাঙালি নাম দেওয়ার আধিপত্যবাদ, আর দ্বিতীয়জনের অবদান- যা কিছু বাঙালি তাকেই হিন্দু বলে ত্যাজ্য করার ঘাড়-ত্যাড়ামি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চোরের সাথে রাগ করে এই মাটিতে ভাত খাবার ঘাড়-ত্যাড়ামি করতে যাওয়ার অর্থ কি নিজেকে শেকড়হীন করে ফেলার প্রক্রিয়া না? ধর্ম হিসাবে ইসলাম এই অঞ্চলে প্রাথমিকভাবে আরব বণিক ও পরবর্তীতে মঙ্গোল ও অটোমান পর্যটক, যোদ্ধা ও সুফি সাধকদের হাত ধরে এসেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই মানুষরা শুধুমাত্র তাদের ধর্ম নিয়ে আসেন নি, তারা তাদের সংস্কৃতিকেও সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। আবার তারা এখানকার আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে মিশেও গেছেন, তাদের সংস্কৃতি আর বঙ্গের আবহমান সাংস্কৃতিক বহুত্বের সঙ্গে ঘটেছে সুন্দর এক মিথস্ক্রিয়া। কিন্তু এই অঞ্চলের ভূমিপুত্ররা (পড়ুন- নিম্নবর্গের সনাতনী এবং দরিদ্র বৌদ্ধরা) যদি ব্রাহ্মণ্যবাদী নিষ্পেষণের কারণে ইসলাম গ্রহণ করেন (বা বাধ্য হন), তাদের কি নতুন ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখাতে আমার ঢাকার বাসার দারোয়ান ভদ্রলোকের মতো যা কিছু আগের জীবনের সাথে যুক্ত তা ত্যাগ করে, নিজের ভাষা ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র আরবীতে কথা শুরু করে, শাড়ি লুঙ্গি ধুতি পাজামা পাঞ্জাবি ছেড়ে আরবের উপযুক্ত পোশাক পরে, ভাত মাছ শাক ছেড়ে ভেড়ার মাংস উটের দুধ যবের রুটি খেজুর আর জয়তুনের তেল খাওয়া শুরু করে দেওয়া উচিত?

উপরের বাঁ দিক থেকে। ক- ঢাকার ছায়ানটে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। খ- ওয়াজ মাহফিল। গ- ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঘ- কলকাতায় হিন্দুত্ববাদী সহিংস মিছিল।

না, অপসংস্কৃতি এবং তার উল্টাভাবে ভার্জিন সংস্কৃতি বলে কিছুতে আমি বিশ্বাস করি না আগেই বলেছি। সুতরাং বাংলায় ইওরোপিয়ান শার্ট প্যান্ট চামড়ার জুতা বেল্ট থাকতে পারলে আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের বোরখা জোব্বা হিজাবে কারুর আপত্তি থাকা উচিত না। কিন্তু নব্য মুসলমানরা যে অনুষঙ্গকে মুসলমান বলে ভাবছেন, তা তো মুসলমানের সংস্কৃতি না, বরং তা একান্তভাবেই আরব বা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সংস্কৃতি। যেই জোব্বা বাংলাদেশের মুসলমানরা মুসলমানের চিহ্ন ভেবে পরছেন, তা আরবের ইহুদি খ্রিশ্চান নাস্তিক সকলেই পরেন। যেই বোরখা কুরানের নির্দেশ ভেবে নারীরা পরছেন, তা তো কুরানের কোথাও নাই। এবং এই একই সম্পূর্ণ মাথা ও শরীর ঢাকা কালো বোরখা ইহুদি নারীরাও পরেন। ইহুদিরাও মুসলমানের মতো প্রায় একই পদ্ধতিতে হালাল হারামের বিচার করেন, ওযু করেন, মদ খান না, বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হন না, একই পদ্ধতিতে নামাজের জন্য আজান দেন ও প্রায় একই পদ্ধতিতে নামাজ পড়েন।

না। ইহুদি নারীরা বোরখা পরেন বলে আমি নিশ্চয়ই মুসলমান নারীকে বোরখা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি না। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, পৃথিবীতে যেহেতু কোনো কিছুই স্বতন্ত্র নয়, পৃথিবীতে এক কাপ চায়ের পেছনে কয়েক লক্ষ মানুষের ভূমিকা আছে, আপনার আমার এই মুসলমান শরীরে কয়েক জেনারেশান অমুসলমান সনাতনী রক্ত আছে- তাই এই জিনিস মুসলমানের, এই জিনিস ইহুদির, এই জিনিস নাস্তিকের, এই জিনিস হিন্দুর বলে কোনো আলাপ চালানোই সম্ভব না। উচিতও না।

কিন্তু স্বতন্ত্র না হলেও সবকিছু নিশ্চয়ই একও নয়। নতুন বছর উদযাপনে নউরুজের চোদ্দ পদের খাবার আর চৈত্র সংক্রান্তির চোদ্দ পদের শাক এক হলেও তো তারা এক না। আপনার আর আমার শরীর একই রক্ত একই মাংস একই জিনেটিক কোডিং দিয়ে তৈরি হলেও আপনি ও আমি আলাদা। এবং এই আমার আপনার পূর্বসূরীর কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের ইতিহাসই আপনাকে আমাকে ‘সাবজি পলো’ আর ‘সব্জি পোলাও’-এর মতো সূক্ষ্ণ কিন্তু অনস্বীকার্য পার্থক্যের সামনে নিয়ে আসে। তাই আপনি আমি গ্লোবালাইজেশানের কমোডিটি ফেটিশে আরবের কফি, বৌদ্ধ ভিক্ষুর চা, আমেরিকান খনি শ্রমিকদের জিন্স, চিনাদের রুটি, মঙ্গোল আর অটোম্যানদের কাবাব, পর্তুগিজদের কারি, পারস্যের হালুয়া, রোমান ও গ্রিকদের জোব্বা, আরবের উলুধ্বনি, পেগানদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, ইওরোপিয়ানদের শার্ট প্যান্ট আন্ডারওয়্যার গ্রহণ করার পরেও দিনশেষে আমি বাঙালিই থেকে যাই আর আপনি দিনশেষে পারশিয়ানই থেকে যান।

সুতরাং একজন বাংলাদেশী মুসলমান মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবেন কি যাবেন না, তা তার নিজস্ব ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রায় লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা আছে বলেই সেটা হিন্দুর সংস্কৃতি বলে খারিজ করে দেওয়ার সুযোগ নাই। কারণ, এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় কেউ লক্ষ্মীর পুজা করতে যাচ্ছেন না। ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ বলতেই আগুন দিয়ে সব শুচি করে ফেলা হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ যদি রবীন্দ্রনাথ না হয়ে কায়কোবাদ হতেন, তাইলে নিশ্চয় আগুনের বদলে হাজরে আসওয়াদ দিয়ে সব শুচি বানানোর গান আমরা পেতাম। হাহা। কিন্তু আলফরচুনেটলি, কায়কোবাদ বৈশাখ আর কাবার কালো পাথর নিয়ে কোনো গান লেখেন নি।

পৃথিবী থেকে সমস্ত কুসংস্কার দূরের প্রয়োজন নাই। বিজ্ঞানবাদী বা ওয়াহাবিস্ট হয়ে পৃথিবী থেকে সমস্ত রহস্য, সমস্ত গল্প, সমস্ত উপকথা, বিছানার নিচের ভূত আর যক্ষের ধন আর পত্রিকায় কাউসার আহমেদের রাশিচক্র দূর করে দেওয়ার প্রয়োজন নাই। কারণ যেদিন কুসংস্কার তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে, সেদিন সংস্কারও তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে। যেদিন ভূত প্রেত রাক্ষস খোক্ষসরা তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে, সেদিন গল্প উপন্যাস কবিতা আর ঈশ্বর আল্লাহরাও তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে।

এছাড়া। পৃথিবীর সবকিছু এতো আক্ষরিকও না। মঙ্গল শোভাযাত্রা কুসংস্কার কিনা তা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ নাই। আমাদের সংস্কৃতিতে সংস্কারের পাশাপাশি অতি অবশ্যই বিজ্ঞানহীনতার, যুক্তিহীনতার, কুসংস্কারেরও জায়গা থাকে। আমাদের সংস্কৃতিতে খনার বচন থাকে। আঙ্গুলে পাথরের আংটি থাকে। বাচ্চার কপালে নজর কাটানোর কালো টিপ থাকে। গলায় তাবিজ থাকে। মাজারে সুতা বাঁধা থাকে। হ্বজে গিয়ে শয়তানকে পাথর ছোঁড়া থাকে। কালো পাথরকে চুমু খাওয়া থাকে। কাবাকে আল্লাহর ঘর বলা থাকে।

এখানে প্রশ্ন আসে না, আল্লাহ যদি নিরাকার হবেন তো কাবা তার ঘর হয় কিভাবে? আল্লাহ যদি সর্বত্র থাকেন, তো পশ্চিমমুখী হয়ে নামাজ পড়া হয় কিভাবে?

কারণ এই প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয়। কারণ পৃথিবী থেকে সমস্ত কুসংস্কার দূরের প্রয়োজন নাই। বিজ্ঞানবাদী বা ওয়াহাবিস্ট হয়ে পৃথিবী থেকে সমস্ত রহস্য, সমস্ত গল্প, সমস্ত উপকথা, বিছানার নিচের ভূত আর যক্ষের ধন আর পত্রিকায় কাউসার আহমেদের রাশিচক্র দূর করে দেওয়ার প্রয়োজন নাই। কারণ যেদিন কুসংস্কার তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে, সেদিন সংস্কারও তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে। যেদিন ভূত প্রেত রাক্ষস খোক্ষসরা তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে, সেদিন গল্প উপন্যাস কবিতা আর ঈশ্বর আল্লাহরাও তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে।

সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার শরীফ

হ্যাঁ। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের আবহমান কালের সংস্কৃতি না অবশ্যই। এই শুক্কুর শুক্কুর আষ্ট দিন আগে আশির দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকার সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়। প্লাস, বাংলা নববর্ষও সম্রাট আকবরের আমদানিকৃত অধুনা বস্তু। খাজনা আদায় আর জমির মোঘলাই মালিকানা প্রতিষ্ঠাই যার মূল লক্ষ্য ছিলো। কিন্তু পয়লা বৈশাখের আগের দিন, অর্থাৎ চৈত্র বা মহাবিষুব সংক্রান্তির উদযাপন আবহমান কালের উৎসব অবশ্যই, যা আমাদের দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, পরিচয় আর লোকজ সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। এবং এই সত্য অস্বীকারের উপায় নাই। এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে শিব পাবর্তী আছেন, চড়ক পুজা আছে, মেলা পুন্যস্নান লাঠিখেলা সংযাত্রা আছে এবং অতি অবশ্যই ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আছে। কারণ এই উদযাপন প্রকৃতির সাথে যুক্ত থাকার উদযাপন। সূর্যের আহ্নিক গতিতে ঋতু পাল্টানোর, পুরানোকে ফেলে দিয়া নতুন মেঘের নতুন বৃষ্টির নতুন ফসলের ডিমে তা দিয়ে ফোটা নতুন হাঁসের ছানার নক্ষত্রমণ্ডলীর কালকজ্ঞের চারটি নক্ষত্র কন্যার হীরকের নতুন গতিপথের সাথে নিজের যাত্রার জীবনের উদযাপন। আর সেকারণে সারা পৃথিবীতে পেগান বলে ইস্টার বা নউরুজ বা চৈত্র সংক্রান্তি বাতিল করার চেষ্টা চালানো হলেও সাধারণ মানুষ প্রকৃতির কাছে ফেরত যান বারবার, কারণ কংক্রিট হাইরাইজ ফেইসবুক নাসা ন্যানোটেক মাল্টিভার্স জিনেটিক্স বোটোক্স রাশা ইউক্রেইন হলিউড দুবাই ক্রিপ্টো ম্যাকবুক স্পেস-শাটোল প্রোগ্রামিং মার্কেট-ইকোনমির দুনিয়ায় মানুষ তার কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের ভেতর দিয়ে, ঘুমের অসচেতনতার ভেতর দিয়ে প্রতিদিন টের পান তার একমাত্র পরমসত্তা প্রকাশিত হন প্রকৃতিতে, একমাত্র আইডেন্টিটি মূর্ত হয় প্রকৃতিতে। তাই যিনি প্রকৃতির সাথে যুক্ত না, তিনি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসেই ভুগবেন নিশ্চয়ই। তিনি বাঙালি আগে না মুসলমান আগে এই আলাপে গলদঘর্ম হবেন নিশ্চয়ই।

না। কাউকে আমি জোর করে চৈত্র সংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখ পালন করে, প্রাণ প্রকৃতির সাথে যুক্ত হয়ে বাঙালি হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি না। কে বাঙালি কে বাঙালি না, কে মুসলমান, কে সনাতনী, কে কতদূর কী হতে পারলেন- এমন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী আলাপেও আমি ঢুকছি না। আমি জানি জোর করে সংস্কৃতি চর্চা বা দুনিয়ার কিস্‌সু হয় না। আমি বিশ্বাস করি, যিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান না, তার ১০০ শতাংশ অধিকার আছে তাতে অংশ না নেওয়ার। এবং তাতে অংশ না নেওয়ার ফলে তাকে বাঙালি না বলার, কম বাঙালি আধা বাঙালি পাকিস্তানী রাজাকার বলার শয়তানির আমি বিরোধিতা করি। এবং একই সাথে এও বিশ্বাস করি, যিনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান, যিনি চৈত্র সংক্রান্তি পয়লা বৈশাখে পান্তা পোড়া মরিচ শুটকি ভর্তা বাতাসা গুড় মুড়ি আচার ফুচকা একদিনের জন্য আড়ং দেশাল যাত্রার শাড়ি পরে একদিনের জন্য বাঙালি সাজতে চান, যিনি অফিস থেকে বৈশাখি ভাতা নিয়ে বৈশাখে নামাজ পড়ে রোজা রেখে দিন কাটান, যিনি কর্পোরেট স্ট্রাকচারে বৈশাখে ২৫% মূল্যছাড়ে সাদা শাড়ি লাল পাড়ের ব্যবসা করেন, তারও একইভাবে অধিকার আছে বিনা বাধায় তাতে অংশ নেওয়ার। এবং তিনি মুসলমান হয়ে এই কাজ করতে পারেন না, মুসলমানের জন্য বৈশাখ পালন ব্বেদাত, মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাওয়া শেরকি, তাকে জোর করে এই ধর্মীয় আলাপ শোনানোর আমি বিরোধিতা করি। আমার অবস্থান দ্বিপাক্ষিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্বিপাক্ষিক ঘৃণার চাষের বিরুদ্ধে। এবং আমার চাহিদা সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ইনক্লুসিভিটির চর্চার ক্ষেত্র তৈরিতে, যেখানে প্যাঁচা আর সিংহের পাশে বোরাক, ইস্রাফিলের শিঙ্গা আর পাখাওয়ালা জিব্রাঈলের মোটিফ থাকবে। যেখানে শুধুমাত্র ঢাকার এলিট শুধুমাত্র তথাকথিত প্রগতিশীল শুধুমাত্র ছায়ানট উদীচি ললিতকলা থিয়েটার নাট্যদল রাবীন্দ্রিক সুশীলসমাজ প্রমিত বাংলার উচ্চঘর কংশরাজের বংশধর, শ্যামলাহিড়ি বনগ্রামের, কী যেন হয় মুসলমানের- ছাড়াও সাধারণ মানুষ, রাস্তার মানুষ, অর্ধশিক্ষিত নিরক্ষর রিক্সাওয়ালা মানুষ, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ ও মুসল্লীরা অংশ নিবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাওয়ার পাশাপাশি যুক্ত হবে বাংলার বয়াতি গান, ফকিরি গান, মুর্শিদি গান। আমার চাহিদা পৃথিবীর সমস্ত রূপ রস আনন্দ আর নিজের আম জাম কাঁঠাল বিসর্জন দিয়ে যিনি বেহেশতে গিয়ে শুধু আরবের আঙ্গুর বেদানা নাশপাতিই খেতে চান, তাকে বলা, তিনিও যেন প্যাঁচা বলতে শুধু দেবী লক্ষ্মীর বাহন না বোঝেন, তিনি যেন প্যাঁচা বলতে জীবনানন্দের প্যাঁচাও বোঝেন, প্রথম ফসল ওঠা ঘরে শিশিরের জল আর হিম হয়ে আসা বাঁশ পাতা মরা ঘাস আকাশের তারার ভেতর দিয়ে ধানক্ষেতে ধোঁওয়া জমা ধারালো কুয়াশায় আমাদের গাছের ডালে ডালে ঝিম মেরে বসে থাকা “প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী, খাসা তোর চ্যাঁচানি”ও যেন তিনি বোঝেন।

কারণ আমরা নাহয় শুক্রবারকে জুম্মাবার বানিয়ে মুসলমান হতে পারবো, কিন্তু দুই জেনারেশন আগের অমুসলমান রক্ত কি শরীর থেকে সরাতে পারবো আমরা? রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু আর নজরুলকে হিন্দুঘেঁষা নাস্তিক বলে ত্যাগ করে মুসলমান কবির খোঁজ করতে আমরা কি পারস্যে রওনা হবো?

তথ্যসূত্র:
(১) বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খণ্ড, দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা ১৪৪-১৪৭
(২) American Journal of Philology, Volume 133, Number 3 (Whole Number 531), Fall 2012, pp. 377, https://espace.library.uq.edu.au/data/UQ_285127/UQ285127_OA.pdf?Expires=1649940308&Key-Pair-Id=APKAJKNBJ4MJBJNC6NLQ&Signature=UxjNde6wdpEQQEW4ipCoSuefysgLNTR2rA~w9gWTBrfzx3w219xf1ekXsChZ4dJg~YH6x34O-D2mLC8E0525-Nc-ViGkmJc8QXgzwkOuHO9TDzsG6G6JYYcsWnQBhkV~1oqmXBz13tzL67ogIav4dwhfwCgGzBgtIMohppKUyPD-oMai46GG55nyXRoo6kE~HD5N02q5oO4NRnQMCjSBOX3ys5jD7MxWZmehDB9N05jdWxHsTh~iGYmUvWoAJu2uiahZaKzjOgx4y6dsp18YkQ8P9mQmBzJ-LhPIsx336f9cWgHCfB57Gz2rK1XoK~Jf5lCLOfjpN3AsdISuTDuB3w__

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে।

Share