নিউ থিয়েটার্স

।। অনমিত্র রায় ।।

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের ভিত্তি অবিভক্ত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নিউ থিয়েটার্স। যা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম প্রযোজনা সংস্থাও বটে। বলা যায়, হলিউডের মতোই বাংলাতেও সংগঠিত স্টুডিও সিস্টেমের উদ্যোগও এই প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাগের পর অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানটিও বেশিদিন টিকতে পারেনি। তবে একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলে রাখা দরকার, উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের সূচনা বাংলা থেকেই। হীরালাল সেন যেমন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার, তেমনই নিউ থিয়েটার্সই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার সূচনাক্ষেত্রের অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা। হিন্দি সিনেমা ও আজকের বলিউডের জন্মই হতো না যদি নিউ থিয়েটার্স-এর মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা উপমহাদেশে সিনেমার অগ্রযাত্রার সূচনা না করতো।

নিউ থিয়েটার্স নিয়ে নতুন করে কিছুই প্রায় বলার নেই। বলতে গেলে আবার সেই পুরোনো কথাই বলতে হয়। বাঙালি মূলত আত্মবিস্মৃত জাতি (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গীয় বাবু বাঙালি)। তাৎক্ষণিক হুজুগ নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসি আমরা। নাহলে প্রতিষ্ঠার প্রায় ৮৯ বছর পর বাংলার তথা সামগ্রিকভাবে বাংলা সিনেমায় তথা উপমহাদেশের সিনেমায় নিউ থিয়েটার্সের অবদানের কথা নতুন করে পাঠ করা প্রাসঙ্গিক হতো না হয়তো। বাংলার প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, বাংলার তথা উপমহাদেশের সিনেমায় প্রথম নেপথ্যকন্ঠে গান, বাংলার প্রথম পুরুষ এবং মহিলা চলচ্চিত্র তারকা; এইরকম বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বারেবারে নিউ থিয়েটার্স নামটি ফিরে আসবে। বস্তুত এত মনোগ্রাহী তথ্য তুলে ধরা যায় নিউ থিয়েটার্স সম্বন্ধে যে সবকিছু একসাথে গুছিয়ে লিখে উঠতে পারা প্রায় অসম্ভব।

নিউ থিয়েটার্সের প্রতিষ্ঠাদিবস ১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১; প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার। কিভাবে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় উৎসাহী হলেন সে বিষয়ে একটি কাহিনী শোনা যায়। শ্রীমান সরকার লন্ডনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার পর একদিন দক্ষিণ কলকাতার ক্রাউন থিয়েটারের (বর্তমানে নাম পরিবর্তিত) সামনে বিশাল লাইন দেখে থমকে যান। চলচ্চিত্র ব্যবসার এই দিকটি তাঁকে আশ্চর্য করে যে, টিকিট কেটে ছবিটি দেখে ওঠার আগে পর্যন্ত মানুষ আসলে জানে না যে ছবিটিতে কি রয়েছে এবং আদৌ তার সেটি ভালো লাগবে কিনা; অথচ সে অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত। এই ঘটনার কিছুদিন পর কলকাতার ভবানীপুর ক্লাবে কোনো এক সন্ধ্যায় শ্রীযুক্ত হরেন ঘোষ শ্রী সরকারকে রাজি করান তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত প্রেমাঙ্কুর আতর্থী বিরচিত এবং নীতিন বোস পরিচালিত ‘বুকের বোঝা’ (১৯৩০) চলচ্চিত্রটিতে অর্থ বিনিয়োগ করতে। চলচ্চিত্রটি একেবারেই ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ না দেখলেও শ্রী সরকার এরপর আর এই মাধ্যমটির সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিন্ন করতে পারেননি। বাংলায় নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য তিনি নির্মাণ করেন ‘চিত্রা’ নামক একটি প্রেক্ষাগৃহ। এই ‘চিত্রা’-ই পরবর্তীকালে হয়ে উঠলো উত্তর কলকাতার মিত্রা সিনেমা, যা কিছুদিন লুম্পেন পুঁজির উন্নয়নী-বুলডোজারে ভেঙে ফেলার আয়োজন করা হয়েছে, এই প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে নাকি তৈরি করা হচ্ছে ভোগবাদী দুনিয়ার ঝলমলে স্থাপত্য- শপিং মল! ‘চিত্রা’-র উদ্বোধন হয় ১৯৩০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর। কয়েকটি সূত্র অনুযায়ী এই প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন ঘটেছিলো শ্রী সরকারের এলগিন রোডের প্রতিবেশী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে। এরপরই প্রতিষ্ঠিত হবে নিউ থিয়েটার্স।

শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সরকার টালিগঞ্জ অঞ্চলে চার একর জমির ওপর পত্তন করেন দি নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড।  আমগাছ এবং ফুল বাগান ছাড়াও এই স্টুডিওর ভিতর জমির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ছিল এক ‘গোল ঘর’, যে ‘গোল ঘর’টি তড়িঘড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল ‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্রের কাজ চলাকালীন। ‘নটীর পূজা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় একমাত্র চলচ্চিত্র, অথবা বলা ভালো নৃত্যনাট্যের অডিও-ভিজুয়াল রেকর্ডিং। কবিগুরুর আসার কথা স্টুডিওতে, এদিকে শ্যুটিং ফ্লোরের হৈ-হট্টগোল তাঁর হয়তো বিশেষ মনঃপুত হবে না; এমন এক আশঙ্কা থেকেই ‘গোল ঘর’-এর জন্ম। পরবর্তীতে এই ‘গোল ঘর’-এ যাঁদের পদধূলি পড়েছে তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। অন্যান্য দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের মধ্যে পুডভকিন, ফ্রাঙ্ক কাপরা এবং জাঁ রেনোয়াঁ-ও এই ‘গোল ঘর’-এ সময় কাটিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

‘নটীর পূজা’ একটি উদাহরণ মাত্র। নিউ থিয়েটার্স চলচ্চিত্রজগতে পাকাপাকিভাবে আসন দখল করে নেয় ১৯৩২ সালে দেবকী বসু পরিচালিত ‘চণ্ডীদাস’ চলচ্চিত্রের অভাবনীয় সাফল্যের মধ্যে দিয়ে। এ ছবির আগে অবধি যে পাঁচটি ‘টকি’ (সবাক চলচ্চিত্র) এই স্টুডিওর ব্যানারে পরিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে চারটির বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ‘নটীর পূজা’ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘চিরকুমার সভা’ (পরি: প্রেমাঙ্কুর আতর্থী) এর মধ্যে একটি। বাকি দুটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসনির্ভর ‘দেনা পাওনা’ এবং ‘পল্লীসমাজ’। বোঝাই যাচ্ছে যে আজকাল আমরা যে ধরণের চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সাক্ষাৎ পাই কলকাতায়, যাঁরা বাঙালীর সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণাটুকুও রাখেন না, শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সরকার একেবারেই তাঁদের মতো ছিলেন না। ‘পল্লীসমাজ’-এর পরের বছর বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী হয় ‘কপালকুণ্ডলা’। এর দু’বছর পর তৈরী হবে ‘দেবদাস’ এবং জন্ম দেবে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নক্ষত্রের। দেবদাস সম্ভবত ভারতবর্ষের সবথেকে বেশিবার চলচ্চিত্রায়িত উপন্যাস। সেইদিক থেকে দেখলে এক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শক নিউ থিয়েটার্স।

‘দেবদাস’ ছবির পোষ্টার

আরও একটি জায়গায় শ্রী বীরেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতার বর্তমান প্রযোজকদের থেকে অনেকটাই আলাদা। বর্তমানে কলকাতার প্রযোজকরা প্রযোজনা ব্যাপারটাই ভুলে গিয়ে মূলত ফিল্মে পয়সা লাগানেওয়ালা ব্যবসায়ী হয়ে বসে আছেন। তো, পয়সা লাগানেওয়ালা ব্যবসায়ী সবকিছুতেই পয়সা লাগাতে পারে। আজ ফিল্মে লাগালে কাল চাল কিংবা পেঁয়াজের আড়ৎদারী করবেন তাঁরা এটাই স্বাভাবিক। এঁদের কাছে মূল বিষয় পয়সা ফেরত আসা, এবং সেই উদ্দেশ্য সাধিত করতে এঁরা স্ক্রিপ্ট বদলে দেওয়া থেকে জোর করে আইটেম ড্যান্স ঢোকানো, অথবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের পদলেহন করে বেআইনি ভাবে জমি হাতানো পর্যন্ত কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেন না। বাঙালির তথা বৃহৎ বঙ্গের জাতীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি স্বভাবতই এঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এছাড়া আছেন আরেকদল পয়সাওয়ালা মানুষ যাঁরা ‘হামি ভি কালচার বুঝে’ প্রমাণ করার মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক ঠাটবাট আরও একটু বাড়িয়ে নেওয়া, একটু জনপ্রিয় ফিল্মস্টারদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করা, ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে ফিল্মে পয়সা ঢালেন। এঁদের টাকা সেভাবে ফেরত না পেলেও চলে তবে সংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার জায়গাটা এখানেও অনুপস্থিত। বি.এন সরকার এর কোনোটাই ছিলেন না। বহুজায়গায় উল্লিখিত আছে, তিনি কাজ করতেন হলিউড স্টুডিও সিস্টেমের এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার তথা কার্যনির্বাহী প্রযোজকদের মতন করে। বিষয়, পরিচালক, ইত্যাদি নির্বাচন করা হয়ে গেলে তিনি মূলত অর্থের যোগানের দিকে মনোনিবেশ করতেন এবং পরিচালকের কাজের মধ্যে নাক গলাতেন না। এছাড়াও তাঁর প্রতিভা চিহ্নিত করার অস্বাভাবিক সহজাত ক্ষমতা ছিল। অভিনেতা এবং পরিচালক তো বটেই, তিনি এমনকি দক্ষ টেকনিশিয়ান চিনতেও ওস্তাদ ছিলেন। ক্যামেরাম্যান নীতিন বোস এবং তাঁর ভাই সাউন্ড রেকর্ডিস্ট মুকুল বোস, যাঁদের কর্মকুশলতায় নিউ থিয়েটার্স সেইসময় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়, সরকার-এরই আবিষ্কার।

নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাংলা ছবি ‘দেবদাস’

বাংলা ছায়াছবি ‘চন্ডীদাস’-এর মুখ্যভূমিকায় অভিনয় করেন দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায় এবং ‘পল্লীসমাজ’ (১৯৩২)-এর দুই অভিনেতার নাম ছিল নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং কৃষ্ণচন্দ্র দে। এইভাবে নিউ থিয়েটার্স নামক ফেনোমেনোনটিকে ঘিরে কলকাতা শহরে এক সংস্কৃতিক মণ্ডল গড়ে উঠছিলো সেই সময়। ১৯৩১ থেকে ১৯৫৫ অবধি সারা দেশ জুড়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি অগ্রগণ্য নাম ছিল নিউ থিয়েটার্স যা কিনা পরবর্তী সময়ের হিন্দি সিনেমাকেও প্রভাবিত করবে। এমনিতেই এই ষ্টুডিও নিজেদের নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলি হিন্দিতে পুনর্নির্মাণ করতো। তবে তা ব্যতিরেকেও এখানে কাজ শুরু করা কয়েকজন কলাকুশলী পরবর্তীতে মুম্বই (তৎকালীন বোম্বে)-তে পাড়ি জমিয়ে সেখানকার চলচ্চিত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ‘উদয়ের পথে’ খ্যাত বিমল রায়। তিনি ঢাকা থেকে কলকাতায় আসার পর এই নিউ থিয়েটার্স-এই ক্যামেরা অ্যাসিট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে কুন্দনলাল সায়গল অভিনীত হিন্দি ‘দেবদাস’-এর কাজ চলাকালীন শ্রী রায় প্রমথেশ বড়ুয়ার ইউনিটে পাবলিসিটি ফোটোগ্রাফারের ভূমিকায় কাজ করতেন বলে জানা যায়। ১৯৫৩ সালে এই বিমল রায়ই বানাবেন ‘দো বিঘা জমিন’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ‘দুই বিঘা জমি’ অবলম্বনে) যাকে হিন্দি চলচ্চিত্রের জগতে ইতালিয়ান নিও-রিয়ালিজমের পদধ্বনি বলে মনে করা হবে। এছাড়া ১৯৫৫ সালে দিলীপ কুমার ও বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘দেবদাস’ পরিচালনা করবেন তিনি যার ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা সর্বজনবিদিত। এছাড়া ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতী’ নির্মাণ করবেন বিমল রায় যার চিত্রনাট্য রচনা করবেন ঋত্ত্বিক কুমার ঘটক মহাশয়। ‘মধুমতী’ সেই সময় ন’টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতে রেকর্ড গড়বে যে রেকর্ড ভাঙতে সময় লেগে যাবে পাক্কা সাঁইত্রিশ বছর। ১৯৯৫ সালে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ধীরে ধীরে বলিউড হয়ে ওঠার দিনগুলিতে শাহরুখ-কাজল অভিনীত এবং আদিত্য চোপড়া পরিচালিত জনপ্রিয় ছায়াছবি ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ অবশেষে এই রেকর্ড ভাঙতে পেরেছিল।

এ তো গেলো মূলধারার চলচ্চিত্রের কথা। এর বাইরে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে নিউ থিয়েটার্স-এর ছবি ‘মীরাবাঈ’ (১৯৩৩)-এর হিন্দি সংস্করণ ‘রাজরানী মীরা’-র সেটে দেবকী বসু প্রথমবার কাজ করেন পৃথ্বীরাজ কাপুর-এর সঙ্গে। কাপুর সাহেবের দীর্ঘ অভিনয় জীবনে সেটি মাত্র দশ নম্বর চলচ্চিত্র। পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে এই পৃথ্বীরাজ কাপুর হলেন পৃথ্বী থিয়েটার্স-এর প্রাথমিক প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তীতে বলিউড-খ্যাত কাপুর পরিবারের প্রথম পুরুষ যাঁর তিন সন্তানের নাম রাজ, শম্মী এবং শশী। সে আরেক ইতিহাস, আমরা তার মধ্যে ঢুকবো না। যাই হোক, ‘রাজরানী মীরা’-র পরের বছর দেবকী বসু রামের চরিত্রে পৃথ্বীরাজ কাপুর কে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ব্যানারে বানান ‘সীতা’ (১৯৩৪)। এই ‘সীতা’-ই প্রথম ভারতীয় সবাক চলচ্চিত্র যা জায়গা করে নিয়েছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ভেনিসে দেখানো হয় ছবিটি এবং সাম্মানিক ডিপ্লোমাও প্রদান করা হয়। সেই হিসেবে নিউ থিয়েটার্সের ‘চন্ডীদাস’খ্যাত দেবকী বসুই প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় পরিচালক যিনি বিদেশী তথা ইউরোপীয় চলচ্চিত্র উৎসবের ময়দানে পুরস্কারে ভূষিত হন। পরবর্তীতে শ্রী দেবকী বসু পরিচালিত জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সাগর সঙ্গমে’ (১৯৫৯) নবম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার-এর জন্য মনোনীত হয়েছিল।

১৯৩৫ সালে নীতিন বসু পরিচালিত ‘ভাগ্যচক্র’ ছায়াছবিতে প্রথমবারের জন্য বাংলায় নেপথ্যকন্ঠের গান ব্যবহার করা হয়। এই চলচ্চিত্রের হিন্দি সংস্করণ ‘ধুপছাঁও’-ই এই ধরণের প্রি-রেকর্ডেড গান ব্যবহার হওয়া প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র। এছাড়াও এই চলচ্চিত্রটি আরও একটি কারণে উল্লেখযোগ্য। এই প্রথম ভারতীয় সিনেমায় চলন্ত গাড়ির বিভ্রম তৈরী করতে ব্যাক প্রোজেকশনের ব্যবহার দেখি আমরা। ১৯৪০-এর পরের চলচ্চিত্রে এই প্রযুক্তিগত কৌশলটি বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে এবং মানের দিক থেকে তা অনেকটাই উন্নত, তবে ১৯৩৫ সালে এই টেকনিকের সঙ্গে দর্শকের প্রথম পরিচয় ঘটিয়েছিল নিউ থিয়েটার্স।

ভারতবর্ষের প্রথম দু’টি অ্যানিমেশন ফিল্ম নিউ থিয়েটার্স-এই নির্মিত হয় ১৯৩৪ সালে; ‘অন এ মুনলিট নাইট’ এবং ‘দ্য পি ব্রাদার্স’। এর মধ্যে গুণময় ব্যানার্জি পরিচালিত ‘দ্য পি ব্রাদার্স’ থিয়েটারে রিলিজও করে।

আর কী অবদান রয়েছে?

নিউ থিয়েটার্স আমাদের দিয়েছে প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া-র মতো একজন অভিনেতা-পরিচালক যিনি সম্ভবত বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নক্ষত্র বললেও অতিশয়োক্তি করা হবে না। শোনা যায়, ১৯৫১ সালে বড়ুয়া সাহেবের মৃত্যুর পর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে যে ‘দেবদাস’ মারা গেছে!

‘দেবদাস’ ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া ও যমুনা বড়ুয়া

এছাড়া নিউ থিয়েটার্স আমাদের দিয়েছে কানন দেবী। যদিও কানন দেবী ১৯২৬ সাল থেকেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত নিউ থিয়েটার্স-ই সেই মঞ্চ যা তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। ১৯২৬ থেকে ১৯৩২ তিনি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন ম্যাডান থিয়েটার্স-এর সঙ্গে। ম্যাডান থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চার বছর তিনি কাজ করেন রাধা ফিল্মস-এর সঙ্গে। কিন্তু, নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত এবং শ্রী প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ (১৯৩৭)-ই সেই চলচ্চিত্র যা তাঁকে বিপুল পরিচিতি এনে দিয়েছিল।  ম্যাডান থিয়েটার্স-এর কথাও নিউ থিয়েটার্সের আলোচনায় এসে পড়তে বাধ্য। কেননা বাংলায় সবাক ছবি বা টকি সিনেমার অগ্রযাত্রায় ম্যাডানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই ফিল্ম কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ম্যাডনের হয়ে তিনি যেমন চলচ্চিত্রে যুগ্ম পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন, তেমনই সঙ্গীত পরিচালক, সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনয় শিল্পী হিসাবেও তিনি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরও যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুল যুক্ত ছিলেন সেই ছবিগুলো হল, ‘জ্যোৎস্নার রাত’ (১৯৩১), ‘প্রহল্লাদ’ (১৯৩১), ‘ঋষির প্রেম’ (১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘চিরকুমারী’ (১৯৩২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯৩২), ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’ (১৯৩১), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৩৩) এবং ‘জয়দেব’ (১৯৩৩) প্রভৃতি। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকেই ১৯৩৪ সালে মুক্তি পায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে সত্যেন্দ্রনাথ পরিচালিত ছবি ‘ধ্রুব’। এই ছবির যুগ্ম পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এমনকি এতে দেবর্ষি নারদ চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। এই ছবির মোট ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গানই নজরুলের কথা ও সুরে কম্পোজ করা। কিন্তু ম্যাডান থিয়েটার্স নজরুলের সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করে। ফলে এরপর আর কোনো প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ না করে বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন নজরুল। জড়িত হন নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গেও। পাশাপাশি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা, যেমন- পাইওনিয়ার ফিল্মস, কালী ফিল্মস, দেবদত্ত ফিল্মস, ফজলী ব্রাদার্স ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন নজরুল। বলা বাহুল্য, ম্যাডান কলকাতায় তৈরি হওয়া চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা হলেও, ম্যাডানরা বাংলায় বহিরাগত, পার্সী।

‘ধ্রুব’ ছবিতে দেবর্ষি নারদের ভূমিকায়ন কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলায় ম্যাডন প্রথম নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে, যার নাম ‘বিল্বমঙ্গল’। অন্য দিকে নিউ থিয়েটার্স থেকে আমরা পেয়েছি ‘দেনা পাওনা’, বাংলার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র; কারণ ১৯৩১-এ প্রকাশিত ম্যাডান থিয়েটার্স-এর ‘জামাইষষ্ঠী’ একটি শর্ট ফিল্ম ছিল। আমরা পেয়েছি কৃষ্ণচন্দ্র দে, কে এল সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল এবং অসিত বরণ (মুখার্জী) দের মতো কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতাদের। এঁদের মধ্যে পাহাড়ী সান্যাল দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলার প্রথম সারির অভিনেতা হিসেবে একের পর এক কাজ করে গেছেন। আমরা পেয়েছি রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, এবং তিমির বরণ (ভট্টাচার্য্য)-এর সুর। বলাবাহুল্য, এছাড়াও আমরা পেয়েছি একের পর এক কালজয়ী এবং ব্যবসায়িক ভাবে সফল অথচ শৈল্পিক গুণমানে উন্নত চলচ্চিত্র। দেশভাগের ঠিক আট বছরের মাথায় এই স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় বাংলা চলচ্চিত্রের বাজার ভাগ হয়ে যাওয়া নিউ থিয়েটার্সের পুঁজি কমে যাওয়ার পিছনে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল বলে জানা যায়। বস্তুত বাংলা ভাষায় সিনেমাকে এক বিরাট অংশের দর্শকদের মধ্যে ‘বই’ বলার যে অভ্যাস বা মতান্তরে বদভ্যাস তার পিছনেও নিউ থিয়েটার্স-এর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণকে এই প্রযোজনা ষ্টুডিও রীতিমতো ফর্মুলায় পরিণত করেছিল বলা চলে। সম্ভবত চলচ্চিত্রের এই সাহিত্যনির্ভরতা থেকেই সিনেমাকে ‘বই’ বলে ডাকা শুরু হয়।

কাননবালা দেবী

এইবার এহেন নিউ থিয়েটার্সকে বাঙালি মনে রাখবে কিনা সেটা মনে হয় আজকের পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি আদৌ নিজের জাতীয় ইতিহাস কতটুকু মনে রাখতে চায় তা জিজ্ঞেস করার সমতুল। এ প্রশ্নটা জাতির, এবং তার আত্মঘাতী প্রবণতার। বিশেষত কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির।

তবে একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলে রাখা দরকার, উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের সূচনা বাংলা থেকেই। হীরালাল সেন যেমন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার, তেমনই নিউ থিয়েটার্সই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রার সূচনাক্ষেত্র। হিন্দি সিনেমা ও আজকের বলিউডের জন্মই হতো না যদি নিউ থিয়েটার্স উপমহাদেশে সিনেমার অগ্রযাত্রার সূচনা না করতো।

আজকের কলকাতা শহরের এক নিয়নোজ্জ্বল সন্ধ্যাবেলায় বিশালাকৃতি হিন্দি সিনেমার হোর্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনও কোনো যুবকের মনে হতেই পারে; “আহা, আজকের দিনে একজন বীরেন সরকার থাকলে বড় ভালো হতো!” তবে সেসব ধর্তব্যের মধ্যে না রাখলেও চলে!

অনমিত্র রায়

লেখক কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা।

Share