দীন শরৎ: ভাবজীবন (প্রথম পর্ব)

বাংলার ভাববৈচিত্র্য

।। সজল কান্তি সরকার ।।

দীন শরৎচন্দ্র নাথের গান শোনার পর আসরের সবাই স্থবির হয়ে যেতেন। মনে হতো যেন ভাবের দেয়াল ভেঙে সবাই ক্লান্ত ও অনুসন্ধানকাতর। আমি বেশ কদিন এ গান গেয়েই স্কুলের পথ ও  মাঠের পথ পেরিয়েছি। মূলত দীন শরৎচন্দ্র নাথের গানের প্রতি শৈশব কৈশোরের সেই ভালোলাগাই ছিল তাঁকে অনুসন্ধানের মূল কারণ।

দীন শরৎচন্দ্র নাথ (১৮৮৭-১৯৪১)

একসময় গ্রামভিত্তিক সমাজে প্রান্তিক মানুষরূপে বেঁচে থাকার সুযোগ ছিল অবলীলায়। যেখানে সমাজবাদীগণ ছিলেন মানবমঙ্গলের দায়বদ্ধ মহাজন। তাছাড়াও দান-দক্ষিণা সাহায্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছিল গ্রাম্যলোকের সহজাত প্রবৃত্তি; তাই উদাসী মানুষেরা পাখির মতই ভাবস্বভাবী হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত আপন খেয়ালে এবং মাধুকরী করে ভাবজীবন চলে যেত অনায়াসে।

…ভাবধারীদের প্রতি তখন সমাজের দায় ছিল, ছিল ভাববিনিময়ের পরমসঙ্গ ও বন্ধন লাভের বাসনা। অতিথিসেবা ছিল পরমধর্ম। মানবধর্ম ছিল সর্বমঙ্গলের মঙ্গল। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ বৈশাখের কোন এক দুপুর বেলা আমাদের বাড়ির উঠোনে দুই বৈষ্ণবী ও এক বৈষ্ণব কৃষ্ণনামধ্বনি দিয়ে মাধুকরী পাওয়ার আশায় যখন ঘরমুখো দাঁড়ালেন, মা তখন পরম শ্রদ্ধায় তাঁদের মধ্যাহ্নসেবার নিমন্ত্রণসহ বাড়িতে নামকীর্তনের অনুরোধ করলেন। গৃহস্থের কল্যাণ কামনায় ভাবধারীগণ সম্মতি দিলেন। ভাব ভক্তিসহকারেই হল অতিথরূপে নারায়ণ সেবা। তারপর  গানের আসর চললো রাতভর আর শ্রোতারা গানে গানে বাহুবন্ধনে বুক মিশিয়ে ভাবকাতর হয়ে মিশে গেল অন্তরসত্য প্রেমধারায়।

সুনামগঞ্জ জেলার মাঝাইর গ্রামের গৌরী বৈষ্ণবী ছিলেন এ আসরের প্রধান গায়ক। তাঁদের কৃষ্ণকথা ও নামগানে গ্রামবাসী মুগ্ধ হলেন। পরবর্তীতে গ্রামবাসীর অনুরোধে অন্যদের বাড়িতেও আসর চলল বেশ কয়েকদিন। নামকীর্তন শেষে বয়াতিগান ও ভাবসংগীত ছিল এ আসরের বিশেষ আকর্ষণ। আর এ পর্বে গ্রামবাসীও গায়ক হতেন। এভাবেই আসর গেয়ে-গেয়ে তাঁদের যথেষ্ট মাধুকরী (ধান চাল ও নগদ অর্থ) সংগ্রহ হত। একটি বিচ্ছেদি গান ছিল এ আসরের প্রধান আকর্ষণ।

”কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক ছিড়িয়া
অন্তরে তুষেরি অনল জ্বলে গইয়া গইয়া।”

… 
গৌরী বৈষ্ণবী ভাবে মজে অশ্রুত নয়নে এ গানটি গেয়েই আসর শেষ করতেন। একদিন এল তাঁদের বিদায়ের পালা। সেদিন বিদায়ী আসরে ছিল পরমসঙ্গ ত্যাগের বেদনার সুর, যেদিন আমিও চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। বেশ কদিন এই শোকপ্রবাহ বিরাজ করছিল গ্রামের লোকমানসে। গ্রামবাসীর মুখে-মুখে সুরে-সুরে গানের রেশ ছিল অনেক দিন। তারই ধারাবাহিকতায় ভাবকাতর সংসারহীন ভবঘুরে ঠাকুরধন সরকার সন্ধ্যা হলেই বাড়ির আলগঘরে গানের আসর জমাতেন। একে একে ভাবধারী সকলেই আসতেন সঙ্গত করতে। তিনি প্রথমেই গাইতেন জনপ্রিয় একটি গান-

গুরু উপায় বলো না
জনমদুখী কপাল পোড়া
আমি একজনা।

.এ গানটি যেন ছিল তাঁর জীবনদলিল, তাই গাইতে গাইতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। কষ্টের বুক ফুলিয়ে দম আটকাতে আটকাতে চোখ মুছতেন। শ্রোতারা বেশ মজা পেতেন। আমি তখন- গানের রচয়িতা কে ? জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ”ভাই এইডা মাইনষের মুখে মুখে হুনা গান। কোন মাজন (মহাজন) কোনদিন লেখছে ঠিক্ঠিকানা নাই।” তারপর তিনি গাঁজাসেবনে মনোনিবেশ করলে অন্যরা গানে গানে আসর ধরে রাখতেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে গৃহস্থ প্রদত্ত চিড়ামুড়ি খাওয়ারও ধুম পড়ে যেত। গাওইয়া বাজাইয়া সকলেই তখন তেজ ফিরে পেতেন। আসরে ঠাকুরধন ভালো গান গাইতে না পারলেও খুব দরদ ও ভাবে মজে আসর জমাইতে পারতেন। এ ভাবেই আলগঘরে চলত গানের মেলা ভাবের খেলা। ঠাকুরধন একদিন আলগঘরের এক আসরে গাইলেন-

এমন উল্টা দেশ গুরু, কোন জায়গায় আছে,
উর্ধ্বপদে হেটমুণ্ডে, সেদেশের লোক চলিতেছে।

দীন শরৎচন্দ্র নাথের এ গানটি শোনার পর আসরের সবাই স্থবির হয়ে যেতেন। মনে হতো যেন ভাবের দেয়াল ভেঙে সবাই ক্লান্ত ও অনুসন্ধানকাতর। আমি বেশ কদিন এ গান গেয়েই স্কুলের পথ ও  মাঠের পথ পেরিয়েছি। মূলত দীন শরৎচন্দ্র নাথের গানের প্রতি শৈশব কৈশোরের সেই ভালোলাগাই ছিল তাঁকে অনুসন্ধানের মূল কারণ। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গ্রন্থে প্রবন্ধে ও নিবন্ধে যখন দীন শরৎচন্দ্র নাথের ব্যক্তি জীবনের কিছু তথ্য বিশেষ করে তাঁর অন্ধত্বের বিষয়টি জানতে পারি তখন তাঁকে জানার কৌতুহল আরও বেড়ে যায়। আর এ কৌতুহলই আমাকে নিয়ে যায় তাঁর বসতভিটা, দীক্ষাশ্রম ও সৃষ্টিজগতে। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যখন প্রথম আমি দীন শরতের বাড়িতে যাই তখন তাঁর বসতবাড়িতে কোন উত্তরসূরি ছিল না, ছিল না তাঁর বসতভিটার নিজ মালিকানাসত্ব কেবলই গ্রামবাসীর মৌখিক বয়ানের আঙ্গিকে দেখেছিলাম দীন শরৎ নাথের স্মৃতিময় বসতভিটা। তাঁর পতিতভিটা দেখা ছাড়া আর কিছুই জানা হয়নি। সেদিন এ বিষয়টা আমার কাছে কেবলি তাঁর উত্তরসূরীদের জীবন সংগ্রামের পরাজয় বলেই মনে হয়েছিল।

শরৎচন্দ্র নাথ বর্তমান নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলাধীন সাজিউড়া গ্রামে সাধারণ নাথ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ভাটি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত এই কেন্দুয়া উপজেলাধীন কবি কঙ্ক, ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ও লেখক চন্দ্রকুমার দে, প্রভাত বাউল, বিপ্লবী নরেশ রায়, বিজ্ঞানী বি এন চক্রবর্তী, ড. মুসলেহ উদ্দিন মল্লিক, নাট্যকার ফণি চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী ললিতকুমার হেশ, শশীকুমার হেশ, কবিয়াল তালুকদার সূর্যকান্ত চৌধুরী, সঙ্গীত শিল্পী মলয়কুমার গাঙ্গুলী, প্রখ্যাত বাউল সাধক ও কবি জালাল উদ্দীন খাঁ, বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ নলিনীরঞ্জন সরকার, হুমায়ুন আহমেদ ও আব্দুল কুদ্দুস বয়াতীসহ অনেক গুণীজন জন্মগ্রহণ করেন। দীন শরৎচন্দ্র নাথও এই উর্বরমেদিনীর গর্বিত সন্তান। তাঁর পিতা কুটীশ্বর নাথ ছিলেন একজন খ্যাতিমান ‘বাউল’ শিল্পী, ফলে পারিবারিক পেশা গৃহস্থলীতে তাঁর অবস্থান ভালো ছিল না। টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই চলত তাঁর সংসার। শরৎচন্দ্র নাথ যখন মাতৃগর্ভে তখন সাংসারিক দৈন্যতা রেখেই কুটীশ্বর নাথ অজানা রোগে অকালে মুত্যু বরণ করেন। শুধু তাই নয় শরৎচন্দ্র নাথ পিতৃহীন পিতৃভূমিতে শিশুকালে মাকেও হারান। ফলে অযত্নে অবহেলায় প্রান্তিক মানুষরূপে শুরু হয় তাঁর অনাথ জীবন। বাবার মতোই উদাসী হয়ে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। বয়াতি গানের আসর, কীর্তন ও বিভিন্ন আখড়ায় ভাববাদীদের সাথে শুরু হয় তাঁর মেলামেশা। ঘুরে বেড়ান ভাবজগতের আস্তানায় আস্তানায়। গানে গানে আর গীতিকবিতায় প্রকাশ ঘটে ভাববোধের। আর তখন থেকেই স্বাভাবিক খেয়ালে আসরে তাৎক্ষনিক গীতিকবিতা রচনায় উদাসী শরতের নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাতে কারও কারও নজর কাড়লেও অনেকেই উপহাস করতেন। এক পর্যায়ে শরৎচন্দ্র নাথ আটাশ বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং চার সন্তানের পিতা হন। প্রথম সন্তান ছেলে সুধাংশু নাথ, বাকি তিনজনই মেয়ে। বড়ো মেয়ে লাবণ্যনাথ, মেজো মেয়ে সুখদা নাথ; তৃতীয় মেয়ের নাম জানা যায়নি। স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ ও সংসার জীবন- উদাসী শরৎচন্দ্র নাথের ভালোলাগার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেনি। তাই তিনি একপর্যায়ে ভাব জগতের অন্তরসত্য ধারায় আত্মমগ্ন হন। কেন্দুয়া উপজেলাধীন বৈরাটী গৌরী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সচ্চিদানন্দ শ্রীশ্রীমৎ ভারত ব্রহ্মচারী ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। তাঁর কাছেই শিখেন তিনি আসন, যোগ, কুম্ভক ও প্রাণায়ামসহ সাধন স্তরের নানা বিষয়। এক পর্যায়ে তিনি অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানাধীন বিতলং আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে তিনি পূর্ণব্রহ্মরূপে জানতেন। তাই তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন-

বন্দি গুরু পূর্ণব্রহ্ম, রামকৃষ্ণ চরণ।
দয়ার মূরতি যিনি, পতিত পাবন

দ্বিতীয়ে বন্দিনু গুরু ভারত গোস্বামী।
ব্রহ্মচারী মতে যিনি হন অগ্রগামী

শিখাইলেন আসন, যোগ, কুম্ভক প্রাণায়াম।
শিক্ষাগুরু পদে মোর সহস্র প্রণাম

মূলত নাথ সিদ্ধারা গুরুবাদী। গুরুই তাদের একমাত্র উপাস্য। তাই গুরু সাধক শরৎচন্দ্র নাথ মানব জীবন ও মানব ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে সাধনায় মত্ত হয়ে রচনা করেন গীতিকবিতা যেখানে তিনি নিজেকে ‘দীন’ কোথাও কোথাও ‘কাঙাল’ বা ‘অধীন’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। আর একপর্যায়ে অনাথ শরৎ চন্দ্র নাথ ‘দীন শরৎ’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। যেন ‘দীন’ শব্দটি তাঁর নামের আপন হয়ে মাতা পিতা হারা জীবনেরও শোক প্রকাশ করছে। তখন থেকেই তিনি নি:সঙ্গ জীবনে দুঃখকে সাথে নিয়ে হয়ে উঠেন ভাবুক চিন্তক ও সাধক পুরুষ। মরিয়া হয়ে উঠেন সাধন স্তরের অজানা তথ্য জানতে । খুঁজে বেড়ান নানা সাধকের আস্তানা। শিষ্য হয়ে গুরুর কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চান-

জিজ্ঞাসার অপরাধ করিবেন মার্জনা
কেবা গুরু কেবা শিষ্য
কেবা আত্মা মন।
দেহের তত্ত্ব জানতে
আমার মনে আকিঞ্চন

জানার ইচ্ছাই অজানাকে জয় করে নেয় আর তাই এ প্রশ্নের উত্তরে নিজেই আত্মমগ্ন হয়ে পরমসত্য কুড়িয়ে নিয়ে গুরু ভাবে রচনা করেন-

যিনি অখণ্ড মণ্ডলাকার,
গুরু রূপে ভগবান আপনি সাকার।
দেহের গুরু পরমআত্মা,
জীবাত্মা হয় শিষ্য তার

অনন্ত জিজ্ঞাসাকাতর দীন শরৎ কখন কিভাবে কার নিকট থেকে এসব উত্তরের পিপাসা নিবারণ করেছিলেন তা বলা মুশকিল। তবে একথা বলা যায় যে, তিনি নিজেই গীতিপদ রচনা করে গুরুধারায় তাঁর উত্তরের সমাধান জানিয়ে দিয়েছেন তৎকালের রক্ষণশীল সমাজের সবার কাছে। তাই তিনি শিষ্যরূপে প্রশ্নের যেমন পদকর্তা তেমনি গুরুরূপে উত্তরেরও পদকর্তা অর্থাৎ উভয় ধারায় গীতিকবিতা রচনার গর্বিত কবি। তাই তিনি শিষ্য ও গুরু উভয়েই। সেকালের বাংলা পণ্ডিত কবিগণ হয়ত দীন শরতের নাম তাঁদের লিখিত কাগজি সূচিপত্রে রাখেননি। কিন্তু সমাজের হৃদয় দলিলে আজও তা সমাদৃত। এ প্রসঙ্গে ‘দীন শরতের বাউল গান’ (প্রকাশ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ)-এ একটি দীর্ঘ ভূমিকায় কামিনীকুমার কর রায় দীন শরতের কতকগুলো গানের উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, ‘এই গানগুলি ঠিক যেন চণ্ডীদাসের প্রতিধ্বনি। কোনও ভূর্জপত্রে এইগুলি পাওয়া গেলে ,দীন শরৎ চণ্ডীদাসের মর্যাদা নিশ্চয় লাভ করিতেন। ইহা কীরূপে সম্ভব হইল? আমরা বলিব, এই গ্রাম্য কবিও সেই চণ্ডীদাসের, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, প্রভৃতিরই কনিষ্ট সহোদর, সকলেই একই রাজ্যের লোক, তাই এইরূপ সম্ভব হইয়াছে, যুগেযুগে আরও হইবে।’

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সকল কবিদের যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে তাঁরা মুখ্যত নগরকেন্দ্রিক। কিন্তু আমরা দেখতে পাই অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত এই নাগরিক কবিদের চেয়ে বেশি সংখ্যক কবি রয়েছে নগরের বাইরে যাঁরা সংখ্যায়ই শুধু গরিষ্ঠ নন রচনায়ও তত্ত্বপ্রবল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই কবিদের কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। দীন শরৎ সম্পর্কে ‘জালালগীতিকা সমগ্র’ (প্রকাশ ২০১৪ খ্রিঃ)-এ যতীন সরকার বলেছেন- ‘…বিশ শতকের গোড়ায় এখানে একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবির আর্বিভাব ঘটেছিল। তাঁর নাম, শরৎচন্দ্র নাথ। তাঁর রচনায় তিনি ‘দীন শরৎ’ ভণিতা ব্যবহার করতেন। দীন শরতের বাড়ি ছিল কেন্দুয়া থানার সাজিউড়া গ্রামে, জালাল খাঁর বাড়ি থেকে মাইল আটেক দক্ষিণে। দীন শরতের দেহতত্ত্বের গানগুলি আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে এক সময় সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘দীন শরতের বাউলগান’ ও ‘দীন শরতের এসলাম সংগীত’ নামে তাঁর দুটো সংকলনগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। দুটো গ্রন্থই এখন দুষ্প্রাপ্য। তবে পল্লী অঞ্চলে এখনো তাঁর গান লোকপ্রিয়তা হারায়নি।’ মানবতাবাদী কবি দীন শরৎচন্দ্র নাথ জাতি ধর্মের উর্ধ্বে থেকে মানুষের মাঝেই সবকিছু চিনে নেওয়ার আহব্বান জানিয়েছেন- 

মানুষ হওয়া কঠিন বিষয় সকলে কি জানতে পারে
মানুষেতে মানুষ আছে চিনে লও মানুষের কাছে।
সেই মানুষকে জানলে পাছে, তবেই মানুষ হতে পারে

অনুসন্ধানী দীন শরৎ মানবকল্যাণে রচনা করেন নানা সাধনস্তরের লোকায়িত জ্ঞানের প্রশ্ন উত্তর পর্বের ধারা। যা তাঁর আগে কেউ এভাবে প্রকাশের প্রমান মিলেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ‘দেহতত্ত্ব’ তাঁর গীতিকবিতায় বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। শুধু তাই নয়, দেহতত্ত্ব নিয়ে সুবিন্যস্ত রচনায় জনমনে তিনিই পণ্ডিত বলে খ্যাত। তাঁর মতে দেহ ঘরেই নিরঞ্জনের বসবাস, এখানেই দেবালয় ও বিশ্বলয় বিরাজমান। তাই আপন ঘর থুইয়া দেবালয়ে নিরঞ্জনের তালাশ অর্থহীন। জীবের মাঝেই শিবের বাস। দেহের ভিতরেই ব্রহ্মাণ্ড পাওয়া যায়। তাই দেহতত্ত্ব জানতে হয়।

দেহখানি দেখি যেন ঘরের নমুনা।
তার মধ্যে হবে কিসে ব্রহ্মাণ্ডের তুলনা  

এ ঘরের তত্ত্ব কেহ জানিতে না পারে।
সকল ব্রহ্মাণ্ড আছে ঘরের ভিতরে

ভেবেছ মন আমি একজন দেহরাজ্যের রাজা
শমন রাজার হাতে একদিন পাইতে হবে সাজা

… সাধ্যবস্তু থুইয়া আপন ঘরের ভিতরে।
ব্রহ্মাণ্ড খুঁজিয়া কোথা পাইবে তারে

দেহঘরে আছে সূর্য সদায় দীপ্তমান।
যেদিন সূর্য অস্ত যাবে হবেরে নির্বাণ

.শুধু তাই নয় ধর্মের দীপ্তমান পথে নির্বাণ সাধনার রহস্য তাকে ভাবিয়ে তুলে তাই সহজ ধর্মের জটিল সমীকরণে বিস্মিত হয়ে তাতে মানব বৈষম্যের কারণ ও পরমতত্ত্ব লাভে গুরু চিনতে তিনি গেয়ে উঠেন-

একটি পরম তত্ত্ব জানতে চাই
মহাপ্রভূর গুরু কেন ভারতী গোঁসাই।

আমাদের যা অজানা তাতেই ভয় এবং ঈশ্বর নির্ভর ভাবনা আসে। কিন্তু দীন শরৎচন্দ্র নাথ ধর্ম রাজ্যের গুরুধারার অজানা তথ্য জানতে ধর্মভীরু অনুগতশিষ্য না হয়ে ধর্মাবতার, ধর্মগুরু, দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু, সাধনসঙ্গী কিংবা বিভিন্ন আসর ও সভায় অজানার সন্ধান খুঁজেন। আর যা জানেন তা তথাকথিত অলৌকিক ধারণার দেয়াল ভেঙে দিয়ে প্রকাশ করেন জনসম্মুখে অবলীলায়- গীতিধারায়। সেজন্য প্রথার বাইরে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন ভিন্ন গীতি আঙ্গিক-মালজোড়া ভাবগীতি (যা অনেকে বাউল গান বলে মনে করেন)। এ গান যুক্তিতর্কধর্মী, তথ্যমূলক ও ন্যায়-নীতিকথায় সমৃদ্ধ বাঁচার মর্মবাণী। গুরু শিষ্য দুইটি ভাবে রচিত প্রশ্ন-উত্তর পর্বে দুইজন গায়ক আসরে এ গান পরিবেশন করে থাকেন। লোকবাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রিকসহ অন্যরা দোহার দেন। আসরে উপস্থিত সময়ে পদ রচনা এ গানের মূল রীতি। সাধারণত সৃষ্টিতত্ত্ব দেহতত্ত্ব পরমতত্ত্ব-সহ সমকালীন বিষয়াদি ও শ্রোতাদের ইচ্ছার বিষয়টিও গুরু ও শিষ্য ধারায় মালজোড়া বাংলার ভাবগীতিতে স্থান পায়।

শিষ্যধারা (প্রশ্ন) :

কী কারনে জন্মে মানুষ, কেন বা মরে !
আমি কোথায় ছিলাম, কেন বা এলাম,
কোথায় যাব দুদিন পরে।।

… 

গুরুধারা (উত্তর) :

কালের উৎপত্তি জীবের, কালে করে লয়।
পঞ্চে পঞ্চ মিশে গেলে, মরণ বলে কয়।।

মালজোড়া ভাবগীতি বা বাউল গানে অনেকটা কবি গানের মত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এ ধারায় কবি গানের মত অশ্লীল ব্যবহার হয় নাই বলে জনমনে আজও সমাদৃত। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোনা অঞ্চলেই সম্ভবত মালজোড়া ভাবগীতির প্রথম সৃজন ও লালন ক্ষেত্র। ধারনা করা হয় বিশ শতকের প্রথমার্ধে তার প্রসার ঘটে। যেখানে দীন শরতের আগে তার প্রমাণ মিলেনি। তিনি আসরে বসেই গান রচনা করতেন। তবে গাইতেন কম। গান গাইতেন তাঁর প্রথম শিষ্য অতুল শীল। অতুল শীল ছিলেন একই গাঁয়ের প্রতিবেশী। বর্তমানে (২০১৭ খ্রিস্টাব্দ) অতুল শীলের ছেলে সুমঙ্গল শীল (৯৪) এ গানের চর্চা ধরে রেখেছেন। সুমঙ্গল শীল ছিলেন তার বাবা অতুল শীলের শিষ্য। তিনিও শরৎ সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তবে দীন শরৎচন্দ্র নাথের মৌখিক রচনাগুলো লিখে রাখার কাজটা বেশির ভাগ করতেন শিষ্য যোগেন্দ্র দে। মালজোড়া বাউল গানের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল বলেন,‘ সাগলী  গ্রামে এক মালজোড়া বাউল আসরে বাউল জালাল খাঁসহ অনেক নামীদামী বাউল উপস্থিত ছিলেন। আসরে দীন শরৎ গানে গানে তাৎক্ষণিক একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন যার উত্তর তখন কেউ দিতে পারেনি।’ প্রশ্নটি নিম্নরূপ :

জানবো বলে দয়াল গুরু বাসনা চিত্তে
কোন পদ্মে হয় তোমার আসন কোন শক্তি কোন দলেতে
কোন পদ্মে হয় শিবশক্তির বাস
সেই শিবশক্তির মিলন কথা জানতে অভিলাস
বল তারে ষঠচক্র ভেদ করিয়া নিতে হয় কোন পথে
দীন শরৎ বলে ভারত গোসাইর পায়
ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ রাখি সর্বদায়
তোমার রাঙাচরণ দিয়ে মাথে আমায় নিয়ে চলো সুপথে

আসরে উপস্থিত কেউ তার উত্তর দিতে পারেনি বলে তিনি আসরে কাউকে হেয় মানসিকতায় আঘাত করেননি। ফকির শরৎচন্দ্র নাথ ছিলেন মানবমঙ্গলের কবি। তাঁর রচনায় মানুষের বাঁচা-মরার গল্প আছে, আছে অসংগতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদী সুর। সত্যের আড়ালে সমাজে যে সকল অসত্য মানব বৈষম্যের অবতারণা করেছিল তা তিনি অবলীলায় প্রকাশ করেছেন গানে গানে। এতে সমাজপতিদের রোষানলেও পড়তে হয়েছে থাকে। শুধু তাই নয় জনবিচ্ছিন্ন জীবন যাপনও করতে হয়। কিন্তু সময়ের কথাগুলো তিনি বলে যেতে পিছ-পা হননি। সমকালিন বিষয়াদি নিয়ে বেশ গান রচনা করেছেন তিনি। তন্মধ্য ‘পাটের গান’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া সমকালিন বিশ্বপরিস্থিতিও বাদ পড়েনি তাঁর রচনায়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি গান হচ্ছে-

যুদ্ধ বাঁধলো এবার চীন জাপানে, জার্মানি ব্রিটিশের সনে,
বিজ্ঞানশক্তি যার যেমন, কইরে নানান মত আয়োজন
ডুবু জাহাজ শূন্য কাপ্তান, আরও কত গোলা কামান
নিয়ে স্থলে জলে উভয় পক্ষে করে অস্ত্র বরিষন

শরৎচন্দ্র নাথের পরবর্তিকালে রশিদ উদ্দিনের প্রকাশিত রচনাতেও ‘মালজোড়া বাউলগান’-এর ধারা খুঁজে পাওয়া যায় যা দীন শর চন্দ্র নাথের মতো গুরু-শিষ্যধারায় বিষয়ভিত্তিক সুবিন্যস্ত নয়। অনেকের মতে দরদী রশিদ উদ্দিন (১৮৮৯-১৯৬৪) এই ধারার প্রবর্তক। তবে রচনা ও সময় বিবেচনায় দীন শরৎ তাঁর দাবীদার যাঁর খ্যাতি আশপাশ এলাকাসহ ভারতেও রয়েছে। বাংলার ভাবগীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী বলেন, ‘… লালশীল, লালন, পাঞ্জু শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, কুবির, জাদুবিন্দু, জালাল, দীন শরৎ, রশীদ, দুদ্দু, রাধারমণ, ফুলবাসউদ্দিন, দুর্বিন শাহ, পদ্মলোচন, শীতলং শাহ, হাসন রাজা থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাহিত বাউলবর্গের গান আমাদের সগর্ব অর্জন।’ শরৎ নাথের ভাবস্বভাবী সৃষ্টি নিয়ে কথিত আছে তৎকালে কৃষ্ঠপুরের (বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর থানাধীন) জমিদার হাতিতে চড়ে দীন শরতের বাড়ি আসেন। তখন গ্রামের নলিনীরঞ্জন সরকার (কলকাতা কাউন্সিলর/মেয়র/মন্ত্রী)-এর আতিথ্য উপেক্ষা করে দীন শরৎচন্দ্র নাথের কাঁচা মাটির ঘরে জমিদার মহোদয় রাত্রিযাপন করেন। তিনি দীন শরতের সঙ্গ শেষে তাঁকে জমিদার মহলে স্থাযনভাবে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন, তাতে নলিনী বাবু জমিদার মহোদয়কে অনুরোধ করে বলেন যে, ”প্রয়োজনে তিনি নিজের সকল সম্পত্তি দিতে রাজি তবুও দীন শরতকে দিতে পারবেন না।” মূলত নলিনীরঞ্জন সরকারের ছোট ভাই প্রমোদরঞ্জন সরকারের সাথে দীন শরতের সখ্যতা ছিল নিবিড়, তাই এ পরিবারের সকলেই তাঁকে ভালোবাসতেন। অনেকেই বলেন দীন শরৎ নলিনী বাবুর আশ্রিত ছিলেন যা সম্পূর্ণ ভুল, এখানে ভালোবাসাই ছিল মূখ্য; ছিল ভালোবাসার আশ্রয়। তিনি নিজের হাতে সব্জি চাষ করে বাজারে বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহের কিছুটা সংকুলান করতেন বাকিটা ছিল দয়াল ভরসা। 

নলিনী বাবুর অনুরোধ মেনে নিয়ে একপর্যায়ে কৃষ্ঠপুরের জমিদার তাঁর মহলে ফিরে গিয়ে ভাবগীতির প্রতিযোগিতামূলক আসরের আয়োজন করেন। উল্লেখ থাকে যে তাৎক্ষণিকভাবে বাউল গান রচনা করে যে রাজা-রাণীকে গেয়ে শুনিয়ে মন জয় করতে পারবেন তাকেই তিনি পুরস্কৃত করবেন। শিষ্য অতুল শীলকে সঙ্গে নিয়ে বাউল কবি দীন শরৎচন্দ্র নাথ অংশ গ্রহণ করেন। আসরে তাঁর ডাক পড়লে তিনি গান রচনা করে দেন এবং শিষ্য অতুল শীল সুললিত কণ্ঠে গেয়ে শুনান।

কী দেব তুলনা জগতে মিলে না
কৃষ্ঠপুর মহারাজের মহিমা অপার।
তিনি মানুষলীলা করিতে অবতীর্ণ ধরাতে
লোকে শিক্ষা দিতে স্বধর্ম আচার

কৃষ্ণভক্ত মতিমান ছোটবড়ো এক সমান
নাহি মান অভিমান হিংসা অহংকার।
দুখী দরিদ্রের মমতা কর্ণসম দাতা
রাজা যুধিষ্টির যথা ধর্ম অবতার

রাজর্ষি জনকের মত ধর্মে কর্মে সদারত
সুখ্যাতি গাহিব কত বিখ্যাত সংসার।
সাধু সৎজনের বন্ধু করুণার সিন্ধু
যেন পূর্ণ ইন্দু সুধার আধার

ছিলেন কর্তীমা সরুজা দেবী জিয়ন্ত দয়ার ছবি
রাণী কী কমলা দেবী জানতে সাধ্য আছে কার।
প্রসবিয়া তিনটি মণি স্বর্গধামে গেলেন তিনি
রাজ অন্তপুরখানি করিয়া আঁধার

কুমার সুরেশ বাবুর গুণে মুগ্ধ সুরাসুর
মধ্যম সুশীল বাবু বৈষ্ণব আচার।
সত্যেশ বাবুর গুণগান গাহিতে জুড়ায় প্রাণ
গন্যমান্য পূন্যবান রাজ পরিবার

মদনমোহন দেবালয় অচলা কমলা রয়
ভোগারতী নিত্য হয় অতিথি সেবা আর।
কাঙ্গাল শরতে কয় যথা ধর্ম তথা জয়
মহারাজের পূর্ণ হয় শান্তি সতাকার

কথিত আছে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মহারাণী মঞ্চে ওঠে এসে নিজের গলার হার খুলে গায়কের গলায় পড়িয়ে দেন। শুধু এ আসরেই নয় ব্রিটিশ পিরিয়ডে ময়মনসিংহের বাউল আসরে গানের প্রতিযোগিতায় সোনার মেডেল পেয়েছিলেন তিনি। তৎকালের ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত মহোদয়কে নিয়ে চৌপদি সুরে গান রচনা করেন। গানটি ‘ময়মনসিংহ গীতি, নামে গ্রন্থিত আছে। সর্বোপরি ‘দীন শরতের বাউলগান’ গ্রন্থ প্রকাশের পৃষ্ঠপোষক নলিনীরঞ্জন সরকারের পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞাতা প্রকাশেও একটি গান রচনা করেন যা চৌপদি সুরে ‘খুসনামি’ নামে গ্রন্থিত আছে। তাছাড়া ভাওয়াল জয়দেবপুরের রাজপরিবারকে নিয়েও তিনি গান রচনা করেছেন। এইভাবে দীন শরৎচন্দ্র নাথ জীবনের বাঁকে বাঁকে গানের চর জাগিয়েছেন। যেখানে ভাবুক চিন্তক বাউল ফকির ও গান পাগল মানুষের বসবাস। যেখানে হয় মানবমঙ্গলের চাষবাস।

আমাদের যা অজানা তাতেই ভয় এবং ঈশ্বর নির্ভর ভাবনা আসে। কিন্তু দীন শরৎচন্দ্র নাথ ধর্ম রাজ্যের গুরুধারার অজানা তথ্য জানতে ধর্মভীরু অনুগতশিষ্য না হয়ে ধর্মাবতার, ধর্মগুরু, দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু, সাধনসঙ্গী কিংবা বিভিন্ন আসর ও সভায় অজানার সন্ধান খুঁজেন। আর যা জানেন তা তথাকথিত অলৌকিক ধারণার দেয়াল ভেঙে দিয়ে প্রকাশ করেন জনসম্মুখে অবলীলায়- গীতিধারায়। সেজন্য প্রথার বাইরে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন ভিন্ন গীতি আঙ্গিক-মালজোড়া ভাবগীতি (যা অনেকে বাউল গান বলে মনে করেন)। এ গান যুক্তিতর্কধর্মী, তথ্যমূলক ও ন্যায়-নীতিকথায় সমৃদ্ধ বাঁচার মর্মবাণী। গুরু শিষ্য দুইটি ভাবে রচিত প্রশ্ন-উত্তর পর্বে দুইজন গায়ক আসরে এ গান পরিবেশন করে থাকেন। লোকবাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রিকসহ অন্যরা দোহার দেন। আসরে উপস্থিত সময়ে পদ রচনা এ গানের মূল রীতি। সাধারণত সৃষ্টিতত্ত্ব দেহতত্ত্ব পরমতত্ত্ব-সহ সমকালীন বিষয়াদি ও শ্রোতাদের ইচ্ছার বিষয়টিও গুরু ও শিষ্য ধারায় মালজোড়া বাংলার ভাবগীতিতে স্থান পায়।

চলবে…

তথ্যসূত্র :

১. দীন শরৎচন্দ্র নাথ, দীন শরতের বাউল গান।
২. দীন শরৎচন্দ্র নাথ, দীন শরতের এস্লাম সঙ্গীত।
৩. দীন শরৎচন্দ্র নাথ, গৌরগীতি (সংগৃহিত গান)।
৪. ডাঃ রবীন্দ্রনাথ দাস ( সম্পাদনা), কীর্তিমঞ্জুষা, ২য় খণ্ড-শরৎ গীতিসম্ভার, প্রতিমা প্রেস, ১৯৯৮, আসাম।
৫. কাঞ্চন বসু (সম্পাদনা), বৈষ্ণব পদাবলী : অখÐ সংস্করণ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন ২০০৪, কলকাতা।
৬. কাজী ইমদাদুল হক (সম্পাদনা), নেত্রকোনা মুখশ্রী : নেত্রকোনা জেলা সমন্বয় পরিষদ, ২০০৫, ঢাকা।
৭. সঞ্জয় কান্তি দেব ( প্রকাশনা ও সম্পাদনা), দীন শরৎ গীতি : ২০০৬, সিলেট।
৮. ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, বাংলার বাউল : নবযুগ সংস্করণ ২০০৯, ঢাকা।
৯. ড. আবদুল ওয়াহাব, লালন-হাসন জীবন-কর্ম-সমাজ : বাংলা একাডেমী, ২০০৯, ঢাকা।
১০. দিলীপ বিশ্বাস (সংকলন ও সম্পাদনা), লালন সঙ্গীত (অখণ্ড) : মম প্রকাশ, ২০০৯, ঢাকা।
১১. আবু দানেয়াল (সংগ্রহ ও সম্পাদনা), অন্ধকবি দীন শরৎ ও তাঁর গান : বুকস্ ফেয়ার, ২০১২, ঢাকা।
১২. মোঃ গোলাম মোস্তফা ( সংগ্রহ ও সম্পাদনা), রশিদ গীতিকা : বাংলাদেশ বইঘর ২০১৩, ঢাকা।
১৩. ড. আহমেদ শরীফ, বাউলতত্ত¡ : বুকস্ ফেয়ার, ২০১৪, ঢাকা।
১৪. যতীন সরকার (সম্পাদনা), জালালগীতিকা সমগ্র জালাল উদ্দীন খাঁ : নন্দিত, ২০১৪, ঢাকা।
১৫. সুধীর চক্রবর্তী, বাউল ফকির কথা : আনন্দ, ২০১৬, কলকাতা।
১৬. পার্থ তালুকদার, দীন শরৎ বলে : রোদেলা, ২০১৭, ঢাকা।
১৭. সুমনকুমার দাশ (সম্পাদনা), বাউল-ফকির পদাবলি : অন্বেষা প্রকাশন, ২০১৭, ঢাকা।
১৮. দৈনিক জনতা, ২৭ মে ২০০৪ ইং।
১৯. দীন শরৎচন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রশিষ্য সুমঙ্গল শীল।
২০. দীন শরৎচন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি ভূপালকৃষ্ণ সরকার।
২১. দীন শরৎচন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি হারাণ দেবনাথ।
২২. দীন শরৎচন্দ্র নাথের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশি সুলতান ফকির।

ছবি- ইন্টারনেট

লেখক পরিচিতি

সজল কান্তি সরকার

হাওর গবেষক ও ‘হাওরপারের ধামাইল (হাপাধা) বাংলাদেশ। মধ্যনগর, সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

Share