থিয়োরির পুতুল কখনও নৈরাজ্য বা ধ্বংসের সমার্থক হয়ে উঠতে পারে

।। অর্ণব সাহা ।।

।। অর্ণব সাহা ।।

আমি জানি, নৈরাজ্য আদতে এক বিভ্রম,  মরীচিকা। এক সন্ত্রস্ত আত্মঘাত যা নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সাবোতাজ করে। নৈরাজ্য শেষ পর্যন্ত এক প্রহসন, হঠকারিতা, মিথ্যে। আজ সন্ধের শুরু থেকে আমি যে নৈরাজ্যের বাস্তব/কল্পনায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছি, তাও আসলে এক মুহূর্তের ব্যক্তিগত অভ্যুত্থান ও তার অনিবার্য পরাজয়, ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কারণ, নৈরাজ্য এক গভীর ক্ষমতার প্রযুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত। আমাদের ভয়ঙ্কর ক্ষমতাপ্রয়োগ আর জয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকেই এর জন্ম। উইল টু উইন। কিন্তু শেষ অবধি তা ঘিরে ফেলে আমাদের নিজস্ব সত্তাকেই। তখন ক্ষমতার প্রয়োগকারী আর প্রযুক্ত হয়ে ওঠে আসলে একই ব্যক্তি। সেই ব্যক্তির আত্মসত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আর সে টের পায় তার নিজের শরীরের ভগ্নাংশগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। নীচু হয়ে, নিজেই নিজেকে কুড়িয়ে নিতে হয় তখন আর সেই দুরূহ কাজটুকু সম্পন্ন করতে গিয়ে আমরা টের পাই নিজের অস্তিত্বের মৌলিক কেন্দ্রটিই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের সমস্ত বিপ্লব, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আসলে এক ভঙ্গুর আর অলৌকিক মিথ্যের মায়া। যার জালে আমরা নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি।

থিয়োরির পুতুল কখনও নৈরাজ্য বা ধ্বংসের সমার্থক হয়ে উঠতে পারে

টেবিলের উপর সাজানো স্যালাড। রেশমি বাটার চিকেন। সিদ্ধ ছোলা আর পেঁয়াজ- আদার কুচিমেশানো  ছোট্ট পোর্সেলিনের বাটি। আধো আলো-অন্ধকারে মিউজিক বাজছে। চার পেগ শেষ হয়েছে। সামান্য নেশা টের পাচ্ছি। এইসব অপার্থিব মুহূর্তে তৃষ্ণার আকাঙ্ক্ষা বাড়ে কিন্তু নেই, বৃহৎ ধারাস্রোত ছাড়া জল নেই। বরং   অতৃপ্তি রয়েছে। গোটা পৃথিবীটাকে ডালিমের দানার মতো দু’হাতে ফাটিয়ে তার শেষতম রসটুকু নিংড়ে  নেবার আকুতি রয়েছে। এটা কি প্যাশন? জানা নেই। কোনো কিছুরই সদুত্তর নেই। বস্তুত খাঁচার ভিতর বহুবছর ধরে আটকে থাকা এক অনিবার্য বাঘ, যার শরীরে মেদ জমছে, অবসাদ যার মগজের ভিতর সেঁধিয়ে দিচ্ছে ঘুণপোকার বাসা, তার পক্ষে, এই সাময়িক কৃত্রিম মুহূর্তের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো অপশন নেই… এখনও অবধি নেই! বিশেষত, যখন সময় থমকে গেছে, একটা নিশ্চল গতানুগতিকতা আর বাঁধাধরা সিস্টেমের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পুরো অস্তিত্বকেই সার্বিক লকডাউনের ফাঁদে আটকে ফেলেছে, তখন মুহূর্তের চকিত বিস্ফোরণের জন্য অনন্ত অপেক্ষা এক একটা দুরূহ পাথর ডিঙোনোর চেয়েও কঠিন মনে হয়। যেন এই বাস্তব পৃথিবীর গোটা বেঁচে থাকা একদিকে আর কয়েকটা চকিত অন্তর্ঘাত সেই স্থবির বেঁচে থাকাকে অর্থময় করে তুলতে পারে। আরও অদ্ভুত! আমরা ঠিক আগের মুহূর্তেও জানি না জীবন কোনও অচেনা বাঁক টপকে যাবে কিনা! জানি না, এই ক্লান্ত, রিক্ত বেঁচে থাকার ভিতর কোনও আকস্মিক বারুদ আর কালাশ্নিকভ লুকিয়ে রয়েছে কিনা! যেমন আজকের এই অনির্ধারিত সময়ের বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমি জানি না আমার জীবন ফের কোনো টানেলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় ভেসে যেতে পারবে নাকি আমায় ফের প্লেগবাহিত ইঁদুরের গর্তেই ঢুকে পড়তে হবে, আরেকবার!  

কারণ, টেবিলের ঠিক উল্টোদিকেই বসে রয়েছে মঞ্জিরা। এইমুহূর্তে যাকে ভেবে নিতে চাইছি আমার মিউজ। আমার সাময়িক স্বপ্ন-কল্পনার লিমিট-এক্সপেরিয়েন্স। মঞ্জিরা একটা ভায়োলেন্ট রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করে। আর ওকে উত্যক্ত করার জন্যই আমি ওই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিরোধিতা করি। কিন্তু জানি আমি নিজে আসলে ওই একই নৈরাজ্যের পন্থী। আমি নিজেও অ্যানার্কিস্ট। মঞ্জিরার মতোই। কিন্তু ফারাক হল আমি ক্যামোফ্লেজড হয়ে রয়েছি। মঞ্জিরা  যখন ওর পার্টনারের সঙ্গে সেক্সের ভিভিড বর্ণনা লিখে পাঠায় হোয়াটসঅ্যাপে, আমি ওই পুরুষের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করি। মঞ্জিরাকে এই নিয়ে মাত্রই চার-পাঁচবার মিট করেছি আমি। প্রথমবার একটা ক্যাফেতে। বাঙালির যৌনতার ইতিহাস নিয়ে আমার যে দীর্ঘদিনের গবেষণার কাজ, বইটা বের হবার পর আমি ওকে সেটার কথা জানাই। ও বইমেলা থেকে আমার ওই থিসিসটা কেনে এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে বাইপাস-লাগোয়া একটা ছোট্ট ঠেকে। আর সেই প্রথমবার ওকে দেখার পরেই আমি জেনে গিয়েছিলাম আমার কোনো কোনো রাতের ঘুম নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে এই মেয়ে। কী আছে ওর মধ্যে? মেয়েদের শরীর, সৌন্দর্য, বুদ্ধি ও দীপ্তির চালু খোঁজ, মঞ্জিরার মতে, পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব নির্মাণ। যেকোনো কথাবার্তার  উপাদানকেই ও ঢেলে সাজিয়ে নেয় তাত্ত্বিক মোড়কে। বলাই বাহুল্য, তাতে আমার আকর্ষণ বাড়ে, কমে না। কারণ, তত্ত্ব ওর-আমার ভিতরের বন্ডিং-এর অদৃশ্য খেলাকে ইনস্টিগেট করে, আরও ঘন করে তোলে…ওর একটা হালকা স্ট্যামারিং-এর অভ্যেস রয়েছে। আর কী আশ্চর্য! এটাও আমার কাছে তীব্র মোহ তৈরি করে।  ওর তোতলামি। আমার উদ্দীপনা!  

আমার দু’পায়ের ফাঁকে, যৌনাঙ্গের উপর একটা নরম অথচ কর্কশ স্পর্শ টের পাই। বুঝতে পারি, মঞ্জিরা চপ্পল খুলে ফেলেছে। ওর পায়ের পাতা দিয়ে ডলে দিচ্ছে আমার যৌনস্থল। আমার শিহরণ হয়। একইসঙ্গে অস্বস্তি হয়, ভয় করে। ভবানীপুরের এই পাব-ভর্তি নানাবয়সী লোক। যদিও সকলেই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত।  ও নিজের ডানপায়ের সামনের পাঁচ আঙুল দিয়ে চাপ দেয়। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে টিপে ধরে  আমার অণ্ডকোষ। আমার গ্লাসের ভদকা হাতেই রয়ে যায়। দম আটকে আসে আমার। আমি এইবার উপভোগ করতে শুরু করি। এর বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই পায়ের আঙুলের খেলা শুরু করেছিল মঞ্জিরা। আমার পায়ের আঙুলের ভিতর ঢুকে কাজ করছিল ওর পায়ের আঙুল। আমার ক্যাজুয়াল ট্রাউজারের ভিতর নীচ  থেকে পা  ঢুকিয়ে দিচ্ছিল ও। ঘষছিল আমার পায়ের লোম। এরপর হঠাৎ আমার এঁটো ডানহাতের মধ্যমা আর অনামিকা টেনে নিয়ে সটান মুখের ভিতর ঢুকিয়ে চুষতে শুরু করল ও। আমার দু’পায়ের ফাঁকে হালকা সেনসেশান হচ্ছিল। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম ওর খেলার প্রতিভা। একঢোঁক ভদকায় সামাল দিলাম নিজেকে। ওর চোখের কোণে তখন মদির আহ্বান আর রেজিস্ট্যান্স। একইসঙ্গে। যেন ও খেলায় অংশ নিতে না ডাকলে আমার পক্ষে আর এগোনো সম্ভব নয়। কট্টর ফেমিনিস্ট ও। নিজেকে সেভাবেই রিপ্রেজেন্ট করে। ওর শরীরের অধিকার ওর নিজের। আর কারও নয়। “আমার দেহ আমার মন/দূরে হটো রাজশাসন”—যাদবপুরের ছেলেমেয়েগুলো এই শ্লোগান দিয়েছিল। কয়েকবছর আগে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে আমার একটা কবিতায় পিতৃতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়ে তীব্র রিঅ্যাক্ট করেছিল মঞ্জিরা। আমিও ছাড়িনি। ওর নাম দিয়েছিলাম—‘থিয়োরির পুতুল’। আমাদের কথা বন্ধ ছিল প্রায় দু’মাস।  

আমার ডানহাতের তালুটা নিজেই মেলে ধরে মঞ্জিরা। চাটতে থাকে।

— সামটাইমস আই লাইক টু বি আ পেট…
— পেট? আর ইউ সিরিয়াস?
— ইয়াপ। মাস্টার্স পেট…
— আই নিড টু মেক ইউ মাই পার্সোনাল বিচ…মাই স্লেভ!

এটা আমি বললাম? নিজের গলার স্বরে সন্দেহ হল!

— ইয়া! হোয়াই নট? আমি কতোদূর সুখ একজন পুরুষকে দিতে পারি তোমার ধারণা নেই লেখক! বাট অবশ্যই আমার নিজের টার্মস আর কনসেন্টে… জোর করলে আমায় পাওয়া যায় না…
— বাট ইয়োর লেগস আর হেয়ারি। হোয়াই ডোন্ট ইউ রিমুভ ইয়োর হেয়ারস?
— স্টপ ইয়োর ফাকিং শভিনিস্ট ওয়ার্ডস। ইটস মাই চয়েস যে আমি আমার পায়ের লোম রাখব কিনা!
— ওকে। বাট যদি এই লোমগুলোই আমার পেনিসের চারপাশে, আমার বলসের নীচে থাকে তোমার ভালো লাগবে সেটা?
—আই হাভ সাকড আ লট অফ ডিকস!  হেয়ারি অ্যান্ড ক্লিন শেভড—বোথ!
সামান্য হেসে বলে ওঠে সে।
আমি টের পাই জাঙ্গিয়ার ভিতর আমার যৌনদণ্ডে রক্তচলাচল বেড়ে যাচ্ছে!

মঞ্জিরার পার্টনার অরুণাভ মাওয়িস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। আগে একদিন খুব জোরগলায় মঞ্জিরা বলেছিল— “আই বিলিভ ইন মাওইজম”!

— বাট, ‘বিলিফ’ ইজ অ্যান ইরর‍্যাশনাল টার্ম। মে বি আ রিলিজিয়াস টার্ম অলসো। ইউ মে সে ইউ সাপোর্ট  দেম…বাট নট দ্য ওয়ার্ড ‘বিলিফ’ ইজ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হিয়ার!
— নো। আই জাস্ট বিলিভ দেম…আই বিলিভ ইন দেয়ার আইডিওলজি!
— জাস্ট লাইক আইসিস অর তালিবান, আল-কায়দা, রাইট? দে অলসো বিলিভ ইন দেয়ার আইডিওলজি অ্যান্ড দে অ্যাক্ট অ্যাকর্ডিং টু দ্যাট! আমি হেসে উঠেছিলাম…
— মাওইস্টদের নিয়ে একটা খারাপ কথা বললেও আর কোনোদিন তোমার কাছে আমি আসব না লেখক!
— না না! মাথা খারাপ? আমি তোমায় কোনোভাবেই হারাতে চাই না, প্রফেসর!

মঞ্জিরা শিবপুর বিই কলেজের তরুণ অধ্যাপক। কিছুদিন হল জয়েন করেছে। আমি ওকে ‘প্রফেসর’ বলে  সম্বোধন করি! আমার ফোনেও ওর নম্বর ‘প্রফেসর-আইআইটি’ নামে সেভ করা রয়েছে। এখন আমি যে  কলেজে পড়াই, তার পাশেই সদ্য-ভাড়া-নেওয়া এই ওয়ানরুম ফ্ল্যাটে আমি আর মঞ্জিরা। আজ ও জানিয়েই এসেছিল আমরা বিডিএসএম প্লে করব। আজ কমপ্লিট ‘মেলডম’। ও আমার আন্ডার-কন্ট্রোল ‘স্লেভ’-রোল  প্লে করবে। এই লকডাউনের মধ্যে মাথা সম্পূর্ণ কামিয়ে ফেলেছে মঞ্জিরা। তাতে ওর সেক্সুয়াল অ্যাপিল দশগুণ বেড়ে গেছে। আমার বরাবরের ফ্যান্টাসি ন্যাড়ামাথার কোনও মেয়ে। রাতে পর্ণ দেখে মাস্টারবেশনের সময় আমার একটা পার্মানেন্ট সার্চ থাকে—‘বল্ড স্লাট টর্চার’। জীবনের পয়তাল্লিশটা বছর পেরিয়ে, যখন আমার কোমর আর পিঠের জোর কমে আসছে, এতোদিনে, এই ছোট্ট এককামরার ঘরে আমার সামনে এক নগ্ন ন্যাড়ামাথার রমণী। যে যৌনপটীয়সী, কামনিপূণ। ওর নাকি, আশৈশব স্বপ্ন ছিল ও ‘তওয়ায়িফ’ হবে একদিন। ক্লাস থ্রি থেকেই মাস্টারবেশন অভ্যাস করে মঞ্জিরা, যখন ও আদৌ জানতই না ‘মাস্টারবেশন’ জিনিসটা কী! ও বলে ও নাকি প্রথম নিজের ‘ক্লিটোরিস’ খুঁজে পায় ক্লাস সিক্সে। এখন, ওর গলা টিপে ধরে ওকে দেয়ালের গায়ে ঠেসে ধরি আমি। ঘাড় নীচু করিয়ে ওর ন্যাড়ামাথা চাটতে শুরু করি। ফের ওর গলা অস্বাভাবিক জোরে দশ আঙুলে চেপে ধরি। ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। ওর মুখে রবারের  ব্যান্ডানা পরিয়ে দিই। ও নাক দিয়ে শ্বাস নেয় কিন্তু কথা বলতে পারে না। গোঙায়। ওর জিভের কষ বেয়ে লালা ঝরতে থাকে। সজোরে একদলা থুতু ওর মুখে ছুঁড়ে দিই আমি। ওর বাঁ-চোখ ঢেকে যায় আমার থুতুতে। একটা পাতলা কালো স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া ওর পরণে আর কিছুই নেই। আমি দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলি ওর গেঞ্জি। ওর মাঝারি সাইজের স্তন সামান্য ঝুলে রয়েছে। আমি ওর বামস্তন ধরে মুচড়ে দিই। ও ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। টর্চার-সেক্স। এটা ওর প্রায়োরিটি। কিন্তু যতোক্ষণ অব্দি ও নিজে কনসেন্ট দিচ্ছে ততোক্ষণ অব্দিই। ওর যোনির চারপাশে ঘন, কোঁকড়ানো যৌনকেশ। আমি খামচিয়ে ধরি। লোমগুলো ধরে টানতে থাকি। মঞ্জিরার মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে যন্ত্রণায়। ওর ঘাড় ধরে ওকে মেঝেতে পাতা ম্যাট্রেসের উপর উপুড় করে শুইয়ে দিই। ওর মাথাটা মেঝের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। উঁচু হয়ে থাকে খোলা নিতম্ব। আমার ভিতর হাজার বছরের নিঃসঙ্গতার অজানা অনুভূতি খেলা করতে থাকে। আমি  নিজের কোমরের বেল্ট খুলে ফেলি। আজ ওই ফর্সা নিতম্বযুগলে বেল্টের মারে কালশিটে ফেলে দেব আমি…এখনও অবধিও একটাও কথা বলেনি। আমি একটুকরো নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে দিই মঞ্জিরার দুই হাত। পিছমোড়া করে। কী অদ্ভুত ভালনারেবল লাগে ওকে আমার। আমি জামা-প্যান্ট খুলে ফেলি। বয়সোচিত বেঢপ শরীর আমার। পেট আর কোমরের চারপাশে স্থূল চর্বি জমেছে। আমার লিঙ্গ সজাগ হতে শুরু করে।

প্রথম আঘাতটা চাবুকের মতো সজোরে পড়ে ওর পাছায়। দাগ বসে যায়। আমি আমার পায়ের পাতা দিয়ে চেপে ধরি ওর মেঝেতে আটকে-যাওয়া মাথা। ওর ব্যথা লেগেছে। আমার উষ্ণ আরাম হয় ওর ব্যথা পাওয়া দেখে। বেশ কয়েকটা এলোমেলো বেল্টের আঘাতের পর ওর মুখ থেকে ব্যান্ডানা খুলে নিই আমি। জড়িয়ে ধরে আদর করি ওকে। করতেই থাকি। ততোক্ষণে আমার যৌনদণ্ড খাড়া হয়ে উঠেছে। ও এমনভাবে চুষতে থাকে, যা আমার জীবনে অভাবিত। প্রথমে অণ্ডকোষে জিভ বোলায় ও। দুটো কোষই মুখের ভিতর ঢুকিয়ে চুষে নেয়। আমার অর্গ্যাজম হয়ে যাবে মনে হয়। আমি প্রাণপণে নিজেকে সামলাই। এই সদ্য খেলা-শুরুর মুহূর্তে ইজ্যাকুলেট করলে পুরোটা মাটি হবে। ও একমনে ‘সাক’ করে চলেছে আমায়। আশ্চর্য জিভের খেলা জানে মঞ্জিরা। ও দুরূহ, কঠিন সমস্ত পেপার লেখে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে, ক্লাসসুদ্ধ ছেলেমেয়েরা ওকে মগ্ন হয়ে শোনে—ভাবা যায়? ওকে অবিকল কুকুরের মতো চার-পায়ে বসিয়ে পিছন থেকে প্রবেশ করি আমি। একটা গতির ছন্দ তৈরি হয়। আমি জোর বাড়াই। মাঝে মাঝেই জোড় খুলে বেরিয়ে আসে।  নিজেকে অবিকল বয়স্ক কুকুর মনে হয় যে তার তরুণী সারমেয়-সঙ্গিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না। হাঁফিয়ে উঠছি আমি। মঞ্জিরা আমায় দেখে করুণা বোধ করে কি? প্রায়-অন্ধকার ঘরে এসি চলছে। সম্পূর্ণ নগ্ন, আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে ও। আজ, কিছুতেই স্বাভাবিক অর্গ্যাজম হচ্ছিল না আমার। শেষে মঞ্জিরা ওর বাঁ হাতের মুঠো দিয়ে ডিসচার্জ করে দিল আমার! আমি জানি আমার বেঁচে থাকা একটা খোপ- কাটা প্যাটার্নে বন্দী। আমার সংসার, সন্তান, যা থেকে ছুটে পালিয়ে আসতে চাই, অথচ যে শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা আজ আর আমার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হয়, আমি আজ আর এই দমচাপা জীবনের জন্য দোষ দিই না কাউকে। আমি জানি আমাদের মতো সুখী, নিরুপদ্রব জীবনের বাসিন্দারা আজীবন নিজেরা সেফ থাকার খেলা চালিয়ে এসেছি বলেই আজও কাউকে কাউকে এই বিরাট দেশের পাহাড়ে-জঙ্গলে-জলায় অটোমেটিক রাইফেল হাতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে শত্রুপক্ষের দুর্বলতম মুহূর্তের জন্য। আমি একহাতে ডলতে থাকি মঞ্জিরার গুরুনিতম্ব। ওরও কোমরে বেশ কিছুটা চর্বি জমেছে। লকডাউনের সামান্য আগেও যখন দেখেছি, ওকে আরও তণ্বী মনে হয়েছিল। ওর কি অর্গাজম হয়েছে আজ? নিশ্চিত, হয়নি। আমি জানি প্রত্যেকরাতে নিজের ভাইব্রেটরের সুখটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তাহলে এই ছক-ভাঙা খেলায় কী বৈশিষ্ট্য ফুটে বেরোল? একটা আল্টিমেট অসমাপ্ত খেলা, যতোবার রিপিট হবে, ততোবারই এটা অসম্পূর্ণ থাকবে, আমি জানি।  এটা আসলে ওই অবুঝমাড়, গড়চিরৌলির দুর্গম রাস্তা-বরাবর হেঁটে-যাওয়া একটা খেই-হারানো পথ। জটিল অথচ অমোঘ। এই আপাতভাবে মেনে-নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া দাম্পত্য, পিতৃত্বের কারাগারের মধ্যে বসে এক অবাস্তব জ্বলন্ত ভবিষ্যতের জন্য বারুদ জমিয়ে রাখা। আমাদের এই সংস্পর্শ তাই বৈপ্লবিক আর ধ্বংসাত্মক। কারণ এটা নরম্যাটিভ রেগুলেশনের সীমানা অতিক্রম করে যায় প্রতিনিয়ত।  যে ছক-আঁটা খোপের মধ্যে আমাদের জীবনকে বন্দী করে ফেলা হচ্ছে প্রত্যেক মুহূর্তে, মঞ্জিরার ইন্সটিটিউট, যেখানে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সামান্য স্বাধীন পদক্ষেপও একজন শিক্ষকের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে, আমার দাম্পত্যজীবনের নর্ম, যা অদৃশ্য আইনি-গাজোয়ারি আর প্রকরণের গণ্ডিতে বাঁধা প্রতিদিন,  আমার লেখকসত্তা, যা হাজারটা পারমুটেশন-কম্বিনেশনের নিগড় ভেঙে বেরোতে পারে না, একধরনের  আলগা সামাজিক সম্মান আর নিশ্চয়তার বলয়ে সচ্ছন্দ থাকতে চায়,  আসলে ভেঙে বেরোতে চায়ও না, সামান্য কিছু মাছের কাঁটার নিশ্চিত সফলতা, কিছু ঠুনকো পরিচিতি, পদক, ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগের অদৃশ্য রক্তকরবীর জালের ভিতর ৬৯ঙ হয়ে বেঁচে থাকার নিঃসীম নিরাপত্তাটুকু চায়… সন্ধে সাতটা পেরিয়ে গেছে। জানি মঞ্জিরা আরও কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে চাইবে আজ। একটা দুর্বোধ্য অথচ একদিন খুব কাছ থেকে চিনতাম এরকম আশ্চর্য শ্লোগান আমার অন্ধকার ঘরের দেয়ালে ঘুরপাক খায়। মঞ্জিরা তা টের পায় না, আমি পাই। আমি  দেখতে পাই, অন্ধকার দেয়াল ফুঁড়ে কে বা কারা যেন লিখে দিয়ে গেছে এইসব হঠকারী এবং আত্মঘাতী পঙ্‌ক্তি :

ভারতের চলমান দীর্ঘস্থায়ী

গেরিলাযুদ্ধ চলছে চলবে…

জনযুদ্ধের লাল আগুনে

পুলিশরাষ্ট্র ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও!

বিল পেমেন্ট করে আমরা উঠি। মঞ্জিরা বাথরুম যায়। মনে আছে ওর সঙ্গে কিছুদিন আগেই সেক্স-চ্যাট করার সময় একবার লিখেছিলাম—“নিড টু ওয়াচ ইউ আর পিয়িং ইনফ্রন্ট অফ মি”…ও উত্তর দিয়েছিল—“আমার লজ্জা করবে”। আমি জানি ওর আদৌ লজ্জা করবে না। কিন্তু পাবের দোতলার সিঁড়ি থেকে নীচে নামার সময়  দেখতে পাই নীচ থেকে একটা হোঁৎকা মাড়োয়ারি উঠে আসছে। আমি লোকটার চকচকে পুরুষ্টু টাক লক্ষ করি আর বিস্ফারিত উদরের মেদ!  লোকটা বলে—“প্লিজ ডু কাম…নো প্রবলেম…কাম ডাউন!”। ওই সঙ্কীর্ণ সিঁড়ির এককোনায় লোকটা আমাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়। আমি আর মঞ্জিরা দ্রুত ওই সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি। আর, একতলা এবং দোতলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মঞ্জিরা যা করে,  তা অবিশ্বাস্য, ও হঠাৎ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়, কাঁধদুটো ধরে আমায় দেয়ালে ঠেসে ধরে। আমার মাথাটা টেনে নিয়ে জিভ ঢুকিয়ে দেয় আমার মুখের ভিতর, জিভের সঙ্গে জড়িয়ে যায় জিভ। নীচ থেকে একজন ওয়েটার উপরে উঠছিল। লোকটা হকচকিয়ে যায় এরকম অভূতপূর্ব  দৃশ্য দেখে, তারপর চোখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে মদের গ্লাস আর খাবার নিয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠে যায়। আমার হাত শক্ত করে ধরে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে আসে মঞ্জিরা…আমরা এই সদ্য-ঘন-হতে-শুরু-করা রাতের আকাশ, প্রায় জনবিরল ভবানীপুরের মেইনরোড আর বিশাল বড় হোর্ডিং, আধভাঙা পুরোনো বাড়ি, আকাশের আধফালি চাঁদকে সাক্ষী রেখে পা ফাঁক করে দাঁড়াই। আমাদের দুজনেরই সামান্য নেশা হয়েছে সেইমুহূর্তে। মঞ্জিরা বলে—“লেখক, এখন বাড়ি যাব না, চলো এখান থেকে অন্য কোথাও যাই”। আমার ঘরে ফেরার তাড়া। যদিও আমার বাড়ি আসলে একটা সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপ যা নিরাপত্তাহীন আর চরম আশ্রয়হীনতা, সর্বোপরি একটা বারো বছরের খামখেয়ালি, ছেলেমানুষিতে ভরপুর বাচ্চা মেয়ের প্রতি অদম্য মায়া দিয়ে তৈরি স্থিতাবস্থার প্রতি আকুল পিছুটান। একটা বাতাস আঁকড়ে-ধরা অনুভূতি!

স্থিতাবস্থা!
চৌরঙ্গি, রাজভবন, এবিপি আনন্দ, স্টক এক্সচেঞ্জ!
স্থিতাবস্থা!

পরিবার, অণুক্ষমতা, একক প্রদর্শনী,
বঙ্গভূষণ!

ভাঙো! চূর্ণ করো ছদ্মবেশ!

এইমুহূর্তে অ্যাসফল্টে গেঁথে-যাওয়া আমার দুই-পা যেন কোনো এক নৈরাজ্যের স্বাদ  নিতে চাইছে। আমাদের এই অস্তিত্ব, তার যৌনতা, কথা-বলা, কর্মস্থলের নিয়মবিধি, সামাজিক কানুন—সমস্তই কতকগুলো নিগড়ে-বাঁধা নরম্যাটিভ রেগুলেশন-চালিত। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে রয়েছে নৈরাজ্যের ভিসুভিয়স, যা ভেঙে-চুরে ধ্বংস করে দিতে চাইছে যাবতীয় নিয়মের শৃঙ্খল। নেশা হালকাই হয়েছে তবু আমার মনে পড়ে গেল মারিও ভার্গাস ইয়োসার ‘ডেথ ইন দ্য আন্দিজ’ উপন্যাসের সেই চরম কয়েকটা লাইন—‘যখন গোলাগুলি শুরু হল, ভেবেছিলাম বোধহয় বাজ পড়ছে, আবার একটা ঝড় উঠবে। কিন্তু তারপর দেখি সামনের দিকের লোকগুলো কেমন যেন অদ্ভুত উন্মাদের মতো আচরণ করছে, সবাই যেন পালাতে চাইছে। কিন্তু টাল সামলাতে পারছে না, পড়ে যাচ্ছে, হুমড়ি খাচ্ছে, তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তারপর চারদিকে আতঙ্ক, মানুষগুলো কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না, দিশাহারা, দৌড়ে মাঠের দিকে যাবে নাকি গুহার দিকে ফিরবে। হঠাৎ হঠাৎ করেই রক্তের ছিটে এসে লাগল। রক্ত ঝরছে, হাড় ভেঙে গিয়েছে, চোখ-কান গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে’। দায়িত্বে থাকা পেরুর মাওবাদী সংগঠন ‘শাইনিং পাথ’-এর তরুণ গেরিলা যোদ্ধা তখন চরম ঔদ্ধত্যে শোনাচ্ছেন—‘আমাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমরা পেরেছি। চারদিকে রক্তের এই লাভাস্রোত, এতো মৃতদেহ, এইসব নিয়ে এবার ওদের বিজ্ঞানীরা  গবেষণা করুন, ওদের পর্যটকরা এসে ছবি তুলুন। আমাদের উপর ওদের মারবার আদেশ ছিল, আমরা ওদের মেরেছি’। ১৯৮০-র এপ্রিল মাসে পেরুর মাওবাদীদের প্রথম সামরিক স্কুলে চেয়ারম্যান আবিমায়েল গুজমানের উদাত্ত আহ্বান থেকে ‘শাইনিং পাথ’-এর যাত্রা শুরু। ঠিক একমাস বাদে আয়াচুকো জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চুসতিতে ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে পেরুর সামরিক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার ডাক দেয় গুজমান ওরফে চেয়ারম্যান গঞ্জালোর সংগঠন। আমার কমবয়সে ‘শাইনিং পাথ’-এর বিস্তর ডকুমেন্ট ছিল আমার সংগ্রহে। পার্টি চেয়ারম্যান গুজমানকে বন্দনা করে গণসংগীতও লিখেছিল ওরা :   

আমাদের প্রধান গঞ্জালো
এক অসাধারণ চিন্তাধারার মানুষ
মার্কস, লেনিন এবং মাওয়ের থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে
উন্নত করেছেন আমাদের শক্তিশালী মতাদর্শকে
আর এই জ্বলন্ত বিশ্বে বয়ে এনেছেন
দুর্জয় জনযুদ্ধকে

“নির্বাচন শ্রমিকশ্রেণিকে কখনও কিছু দেয়নি। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের হাতে কখনও ক্ষমতা আসেনি”—ঘোষণা করেন গুজমান, “এটি একমাত্র দখল করা যেতে পারে দীর্ঘস্থায়ী এবং কঠোর জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রের ভিত ভেঙে পড়েছে”।  ১৯৮০ থেকে ২০০০-এর মধ্যে পেরুতে সামরিক বাহিনী ও মাওবাদীদের হাতে নিহত মোট মানুষের সংখ্যা ৬৯,২৮০। মানে বছরে ৩৫০০ জন। অর্থাৎ প্রত্যেক চব্বিশ ঘণ্টায় ১০ জন। এর মধ্যে ৫৫% মৃত্যুর জন্য দায়ী মাওবাদীরা। শাইনিং পাথ শুরু হয়েছিল গরিব গ্রামবাসীদের দিয়ে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসগুলো তখন বামপন্থী রাজনীতির আখড়া। ভেঙে গিয়েছে শিক্ষা ও রাজনীতির মধ্যেকার প্রাচীর। যে প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ছিলেন গুজমান, সেই হুয়ামাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই ছিল আয়াচুকোর বস্তি আর গ্রাম থেকে আসা  হাইস্কুলের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন দেয়াললিখন—‘পড়াশুনো পরে হবে, আগে চলো যাই পাহাড়ে, যুদ্ধে’। এক নৃশংস গণহত্যার অভিযান সেদিন চালিয়েছিল ‘শাইনিং পাথ’। প্রথমদিকে ড্রাগমাফিয়া, অপরাধী এবং গ্রামীণ জোতদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হলে মানুষের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দ্রুত এই হত্যালীলা কেন্দ্রীভূত হয় অন্যান্য বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃত্ব ও পদাধিকারীদের হত্যার মাধ্যমে। ১৯৯২-এ ‘শাইনিং পাথ’ হত্যা করে রাজধানী লিমার বস্তিবাসীদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক আন্দোলনের নেত্রী মারিয়া এলিনাকে। তাঁর পরিবারের সামনেই এলিনাকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় ‘শাইনিং পাথ’-এর গেরিলারা। মাচেন্তে, আয়াচুকোর মেয়র ও অন্যান্য প্রশাসনিক পদাধিকারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ১৯৮২’র ৩ আগস্ট তারা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় লাম্বায়কুয়ের চিনি উৎপাদন কারখানা। তীব্র বৈনাশিক হামলা চালায় রাজধানী লিমায় বেসরকারি অভিজাত স্কুল এবং ঝাঁ-চকচকে শপিংমলগুলোতে, বিশেষত যেগুলোতে বিক্রি হত বৈদেশিক পণ্য। কিন্তু ক্রমাগত লাগামছাড়া হিংসা দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের। সরকারি সামরিক বাহিনীর পালটা প্রতি-আক্রমণে দ্রুত কোনঠাসা হয়ে পড়ে ‘শাইনিং পাথ’। ১৯৯২-তে ‘সেনদেরো লুমিনোসো’-র (শাইনিং পাথ) নেতা আবিমেয়াল গুজমান গ্রেপ্তার হন। ১৯৯৩ সালে তিনি জেল  থেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম অবসানের ডাক দেন। শান্তি চুক্তি সমপাদনের জন্য নির্দেশ পাঠান তাঁর একদা-কমান্ডারদের কাছে। কিন্তু অধিকাংশ নেতা-কর্মীরা আত্মসমর্পণ করলেও পার্টির একটা ছোট্ট টুকরো অংশ ‘রেড পাথ’ নাম নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের লাইনে অবিচল থাকে এবং দ্রুত ধ্বংস হয়। গুজমান বিনা রক্তপাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১২ সেপ্টেম্বর। ১৯৯২। সঙ্গে তাঁর বারোজন দেহরক্ষী ও সঙ্গিনী এলেনা ইপ্যারাগুয়ের। লিমার এক অভিজাত আবাসনে ব্যালে ডান্সার মার্তিজা গারিদো লেক্কার স্টুডিওতে আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি। তাঁকে গ্রেপ্তার করে সরকারি এলিট গার্ড-বাহিনী ‘ন্যাশনাল ডিরেক্টোরেট এগেইন্সট টেরোরিজম’। প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমোরি গ্রেপ্তারের পর একটি খাঁচার ভিতর আটকে মিডিয়ার সামনে আনেন গুজমানকে। সেইসময় দেশে প্রেসিডেন্ট ফুজিমোরির বিরুদ্ধে বিরাট জনরোষ। ‘নিও লিবারাল’ অর্থনীতির পোস্টারবয় ফুজিমোরি তখন সামাজিক খাতে ব্যয়সঙ্কোচের রেকর্ড করেছেন ফান্ডব্যাঙ্ক আর মার্কিন চাপে। গুজমানকে গ্রেপ্তার করে কৌশলী ফুজিমোরি নিজের হৃত জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। পরদিন  ‘এক্সপ্রেসো’ সহ পেরুর প্রায় সমস্ত প্রধান কাগজে বেরোয় বিরাট হেডলাইন :  

ধৃত জনগণের পয়লা নম্বর শত্রু

গ্রেপ্তার আবিমায়েল গুজমান

শতাব্দীর মোস্ট ওয়ান্টেড আততায়ী

যেকোনো নৈরাজ্যই এইভাবে সমাপ্ত হয়। আমি জানি, নৈরাজ্য আদতে এক বিভ্রম,  মরীচিকা। এক সন্ত্রস্ত আত্মঘাত যা নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সাবোতাজ করে। নৈরাজ্য শেষ পর্যন্ত এক প্রহসন, হঠকারিতা, মিথ্যে। আজ সন্ধের শুরু থেকে আমি যে নৈরাজ্যের বাস্তব/কল্পনায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছি, তাও আসলে এক মুহূর্তের ব্যক্তিগত অভ্যুত্থান ও তার অনিবার্য পরাজয়, ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কারণ, নৈরাজ্য এক গভীর ক্ষমতার প্রযুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত। আমাদের ভয়ঙ্কর ক্ষমতাপ্রয়োগ আর জয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকেই এর জন্ম। উইল টু উইন। কিন্তু শেষ অবধি তা ঘিরে ফেলে আমাদের নিজস্ব সত্তাকেই। তখন ক্ষমতার প্রয়োগকারী আর প্রযুক্ত হয়ে ওঠে আসলে একই ব্যক্তি। সেই ব্যক্তির আত্মসত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আর সে টের পায় তার নিজের শরীরের ভগ্নাংশগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। নীচু হয়ে, নিজেই নিজেকে কুড়িয়ে নিতে হয় তখন আর সেই দুরূহ কাজটুকু সম্পন্ন করতে গিয়ে আমরা টের পাই নিজের অস্তিত্বের মৌলিক কেন্দ্রটিই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের সমস্ত বিপ্লব, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আসলে এক ভঙ্গুর আর অলৌকিক মিথ্যের মায়া। যার জালে আমরা নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি।

হুড়মুড় করে ট্যাক্সি এসে পড়ে। মঞ্জিরার পায়ের চপ্পলের সোল খুলে গেছে। কিন্তু তখন নেশাচ্ছন্ন রক্তে খেলা করছে চাঁদ! আমরা চলন্ত ট্যাক্সিটাকে থামাই। আমি নেমে যাব বালিগঞ্জ ব্রিজ টপকে। মঞ্জিরা ফিরবে সেই কালিন্দি। ওর ভারী কোমর জড়িয়ে ধরি আমি। মুহূর্তে মনে হয় নগ্ন মঞ্জিরার কোমরে একটা রুপোর বিছেহার কী অদ্ভুত মানানসই হোতো! কিন্তু এখন রাস্তা উঠে আসবে ফুটপাতে, ফুটপাত বদল হবে ঘন ঘন।  ট্যাক্সিতে উঠে আমি হাত চেপে ধরি মঞ্জিরার। ও ততোধিক ক্ষিপ্রতায় আমার হাত ছাড়িয়ে নেয়। আমি অসহায়ভাবে চেয়ে থাকি ওর দিকে!আজ ও পাবে বসে যা করেছে তা আনএক্সপেক্টেড। আর সেকারণেই আমার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে চলে, নিজেকে রেজিস্ট করতে পারে না!

ওর কি অর্গাজম হয়েছে আজ? নিশ্চিত, হয়নি। আমি জানি প্রত্যেকরাতে নিজের ভাইব্রেটরের সুখটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তাহলে এই ছক-ভাঙা খেলায় কী বৈশিষ্ট্য ফুটে বেরোল? একটা আল্টিমেট অসমাপ্ত খেলা, যতোবার রিপিট হবে, ততোবারই এটা অসম্পূর্ণ থাকবে, আমি জানি।  এটা আসলে ওই অবুঝমাড়, গড়চিরৌলির দুর্গম রাস্তা-বরাবর হেঁটে-যাওয়া একটা খেই-হারানো পথ। জটিল অথচ অমোঘ। এই আপাতভাবে মেনে-নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া দাম্পত্য, পিতৃত্বের কারাগারের মধ্যে বসে এক অবাস্তব জ্বলন্ত ভবিষ্যতের জন্য বারুদ জমিয়ে রাখা। আমাদের এই সংস্পর্শ তাই বৈপ্লবিক আর ধ্বংসাত্মক। কারণ এটা নরম্যাটিভ রেগুলেশনের সীমানা অতিক্রম করে যায় প্রতিনিয়ত।

— বলিনি, নিজের কম্যান্ড আর ইচ্ছে ছাড়া আমি ধরা দিই না?
— তোমায় একটা কথা জিগেস করব?
— নিশ্চয়ই। কী কথা?
— তোমার মতো স্টঞ্চ ফেমিনিস্ট কীভাবে নিজেকে ডমিনেটেড হিসেবে ফ্যান্টাসাইজ করে?
— এটা আসলে একধরনের থেরাপিউটিক ট্রিটমেন্ট আমার কাছে…
— কীরকম সেটা?
— সারাক্ষণ নিজেকে যুদ্ধের আবহে তৈরি রাখতে রাখতে নিজের ভিতরে একটা চাপ জমে ওঠে। আমি এই ডমিনেটেড হবার কল্পনার মধ্যে দিয়ে সেই চাপ থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসি…বুঝলে কিছু?

আমি চুপ থাকি। জানলা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাই…

— তাহলে কী রাত্রিটা এখানেই শেষ হবে? এইভাবেই?
— এটা তো ট্রেলারও দেখলে না লেখক! মঞ্জিরা ইজ মঞ্জিরা! আরও জানো, বোঝো…
— হ্যাঁ। জানতে, বুঝতেই তো চাইছি প্রফেসর!
— শুধু চাইলেই হবে না। ইনডালজ মি!
— কীভাবে ইনডালজ করব? তুমি নিজের ইচ্ছে ছাড়া ধরা দাও না বলেছ!
— সে তো বটেই! সেই দেয়ালটা সরানোর দায়িত্ব তোমার, আমার নয়…হাসে সে!
— তাহলে তোমার দায়িত্বটা ঠিক কী?
— আই লাভ পাওয়ার! আই অ্যাডোর পাওয়ার!
— ইউ ওয়ান্ট টু ডমিনেট মি?
— সেটা আমি বলব না! তুমি বুঝে নেবে!
— নিজেকে ফেমিনিস্ট দাবি করো আর এই মেয়েলি ছলাকলা দেখাও?
— আবার ভুল করলে লেখক। আমি আজ ইনডালজ করেছি তোমায়…তুমিও শো করো হাউ ইউ ক্যান ট্রিগার মি…চার্জ মি!
— আমি তোমার কাছেই আসতে চাইছি প্রফেসর!
— সেইজন্যই তো কাছে আসতে দেব না তোমায়। আই লাইক টু টরমেন্ট মেন!
— ভালো লাগে পুরুষকে এইভাবে জ্বালিয়ে রাখতে?

গড়িয়াহাট মোড় আসতেই, ভরপুর ট্র্যাফিক সিগন্যালে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পাশ থেকে উঠে এসে আমার কোলের উপর উঠে মুখোমুখি বসল মঞ্জিরা। পাশের হন্ডাসিটির ড্রাইভার অবাক হয়ে আমাদের দেখল একবার। একটা স্ব-বশ বাঘিনী চড়ে বসেছে এক ধ্বস্ত পুরুষের কোলে। আমি ট্যাক্সি ঘুরিয়ে দিই গোলপার্কের দিকে। কাঁকুলিয়া ব্রিজ আর শূন্য, ফাঁকা রেললাইন পেরিয়ে ট্যাক্সিটাকে এগিয়ে যেতে বলি শুধু আর একবার ওকে চুমু খাবার অছিলায়। মোট তিনবার চেষ্টা করি। মঞ্জিরা জোর করে মুখ বন্ধ করে দেয়। দাঁত চিপে রাখে। আমি শেষবারের মতো ওর ঊরুতে হাত রাখার চেষ্টা করি। ও একঝটকায় আমার হাত সরিয়ে দেয়। আমি গুম মেরে বসে থাকি। আমার মনে হয় ও আমার এই ভিতরের ছটফটানিটা উপভোগ করছে।

আমি নেমে যাব। বাড়ির সামনে এসে গেছে ট্যাক্সি। হঠাৎ মঞ্জিরা বলে—“কেন আজ তোমায় ডেকেছিলাম জানো”। “না”, বলি আমি—“কেন?” 
— একটা গল্প উপহার দিলাম তোমায়! কবে পাচ্ছি লেখাটা?
— কোন লেখাটা?
— কেন? আজ যে গল্পটা তৈরি করলাম আমি। বাড়ি যাও। চটপট লিখে ফেলো আমার জন্য…

ছবি- শংকর কর্মকার
অর্ণব সাহা

কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেনব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি। পেশায় অধ্যাপক। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই : ধর্ম নেই কোকাকোলা নেই, ব্ল্যাকহোলের বাকি অংশ, প্যারানইয়া, ২০ জুনের ডায়েরি, নিচু গিলোটিন, নীল রঙের হাভেলি, স্বপ্নের কশেরুকা

Share