তোমার ছবিটাও হারিয়ে আয়না আরো ভুতুড়ে হলো

।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ।।

ভূতে বিশ্বাস করো না, তবু আয়নায়
যখন তাঁর প্রতিবিম্বটা পড়লো না
আয়নার পেছনে খুঁজতে গেলে
আর তোমার ছবিটাও হারিয়ে আয়না আরো ভুতুড়ে হলো
কাজেই প্রমাণিত হলো অনুপস্থিতিই
ভূত নয়।

তোমার ছবিটাও হারিয়ে আয়না আরো ভুতুড়ে হলো

ভাল্কেনবার্গারস্ট্রাৎ ৭৬ ক:

রেমব্রান্ট, কাটে, রক্তাভা, ফেরারি, আগুনে, গাড়িটা

যেহেতু কাচ ছিলো মধ্যে
গাড়িটা যেন আগুনে জ্বলছে তার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি
সামনের সীটে শিখার রক্তাভা, পুড়ে ফাটার
মিষ্টি ধ্বনি আমার পাশে

এখন অগাস্ট, কিন্তু বাইরে নিশ্চয়ই বরফ কোথাও
নইলে আগুন কেন ফাটছে কোনো এক কোণে
‘জানলার মেয়েটি’র ঠিক বিপরীতে, যেখানে
রেমব্রান্ট একটা ছোট্ট স্টুল রেখেছিলেন, ফ্রেমের বাইরে

ওঁর ছাত্রদের একজন নিশ্চিত সেদিন আসেনি
ছাদের ঘর ফাঁকা, যেগুলো রেমব্রান্ট ওদের ছাত্রাবাসের
জন্য বানিয়েছিলেন

কী যেন ফেরারি ছিলো সে সন্ধ্যায়
তাই কোথাও কোথাও বরফ দেখা যায়নি
কাচের বেড়ার ওদিকে গাড়িটা এখনো আগুনে
কী যেন পুড়ে ফাটছে আমার ভাবনায়, বুলিতে

আমস্টারডাম, ৩০শে অগাস্ট, ২০১৯


ভাল্কেনবার্গারস্ট্রাৎ ৭৬ খ:

রেমব্রান্ট, জলগতিবিদ্যা, রক্তাভা, ফেরারি, আগুনে, গাড়িটা

সামনের সীটে আগুন ফাটছে এখনো ২৫ ডিগ্রি
আর আমাদের মধ্যেকার কাচ
বহির্বিশ্ব ও আমি
জেরেনিয়ামের টব, গাড়ি, কুকুর-হাঁটিয়ে
এমনকি অদূরের যে দম্পতি রামি খেলছে
আজকের মুদ্রা নিয়ে

জাল এসে বরাবরই পিক্সেলে ভেঙেছে জলগতিবিদ্যাকে
ষড়ভূজে ষড়ভূজে ভেঙে গড়া সাগর
জেলেগ্রাম আর পারঘাট আঁকিয়েদের টানতো
টেনে আনতো ভলেন্ডাম পিকাসোকে, হ্রেনোয়াও

শুধু অনুপুঙ্খে নজর, ফুটপাথের বুরুশকাজে চোখ
চিত্রচরিত্রের গোটা বপুটা বাদ
মূলস্রোতের অল্প নিয়ন্ত্রণ আর বাসনার লাগামছাড়া

আমস্টারডাম, পয়লা সেপ্টেম্বর, ২০১৯


বুদ্ধদা নেই:

জঞ্জাল, আলোকস্তম্ভ, সাদা ভূমিকা, উল্টোরথ, চন্দনসাজ, ডুবোপাহাড়

আলোকস্তম্ভ কি জানে
দেখা কতদূর যায়?
টিলার পেছনেই কি সেই প্রতিধ্বনির উল্টোরথ?
পরিচালক, তাহলে ওই জলের ওপর আপনি কি…
জলের ওপর আপনি কে?
জলের নিচে যে লোকটা, সে কি ডুবোপাহাড়ের কেউ?

ভূতে বিশ্বাস করো না, তবু আয়নায়
যখন তাঁর প্রতিবিম্বটা পড়লো না
আয়নার পেছনে খুঁজতে গেলে
আর তোমার ছবিটাও হারিয়ে আয়না আরো ভুতুড়ে হলো
কাজেই প্রমাণিত হলো অনুপস্থিতিই
ভূত নয়।

অনেক জঞ্জাল সরিয়ে সরিয়ে একটা অন্যরূপ
টেনে নেব। পৃথিবীর বিবরণ শুনে যে মুখ আঁকছি
যাকে পুলিশ খুঁজবেনা
তবুও কবির কাগজ সরিয়ে সরিয়ে একটা ঘাসফড়িঙ
ক্যালিগ্রাফির সাদা ভূমিকা কালো স্মৃতি
বা বিন্দু বিন্দু সাদা
সরল শিল্পের মুখে জটিলের চন্দনসাজ

আলোকস্তম্ভ কি জানে
কখন তার বিদ্যুৎ চ’লে গেল!

সিন্সিন্যাটি, জুন ১২,২০২১ 

লাস্ট আওয়ার মিউসিক:

জানলা, পিয়ানো, স্বনশূল, আয়না, বিছানা, মালাসাদা

সভ্যতার শেষটা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে
নিজেরটা এসে গেল
ছায়াপথের অন্তিম ছত্রে বিজ্ঞানের সঙ্কোচন না প্রসারণ
অন্য ছায়াপথে – এসবই
খোলা জানলার সামনে, বুনো ঘাসে অল্প অল্প হাওয়ায়
গ্যারাজে শেভ্রোলেটার সারাই শব্দ
আজ আবার পিয়ানোর সুরবাঁধাই করতে এসেছে
ওর তো যেতে যেতে অপরাহ্ন। কত যন্ত্র নিয়ে আসে রজার!
ফ্রাঁসোয়াজকে বলবে, কথায় কথায় ডীপ ফোকাস
আমার দু-চক্ষের বিষ
যখন আমি সাদা-কালো স্বপ্ন দেখবো, সেসব জায়গাতেই যেন,
আচ্ছা, কে যেন বললে ‘টিউনিং-ফর্ক’-এর বাংলা নাকি ‘স্বনশূল’?
আমায় ওতে চড়িওনা, কেমন?

না, তোমরা খেও, আমার খেতে ইচ্ছে করেনা
কেবল রান্নার সুবাসটা উঠলেই হলো
ওতে পিয়ানোটা ভালো বাজবে
শেভ্রোলেটা আবার চলবে, মুচমুচে হবে মালাসাদা।

টের পাচ্ছি অনেক কিছুই এই বিছানা থেকে
সময় এলে বুঝবে। দেখবে বাড়ির সব পর্দা উড়ছে তখন
বন্ধ জানলাতেও। টের পাই অনেক কিছুই, যেমন এখন
রান্নাঘরের লাগোয়াতে হুয়ানিতা আয়নার সামনে এপ্রন পালটায়
টপটাও খুলে নিজের স্তনে হাত বোলাচ্ছে
ওর নিজের হাতটা এখন ওর স্বামীর হাত
এবার বসন্তেও মেয়েটা সংসার ফেলে একা এলো এতদূর!
ওর দৃশ্যগুলোয় একটু ক্ল্যারিনেট দেবে, বিষণ্ণ না
আর ওই নেরুদার মলাটের নিচে ৪০০ ডলার আছে
ওর গ্রামে ফেরার খরচটা দিও।

সময় এলে বুঝবে। দেখবে বাড়ির সব পর্দা উড়বে
তখন ক্যামেরা এ ঘরে ঢুকতে দেবে না, ওদের বোলো
চুপচাপ যেন কাজ করে।
আর তখন ওইটা চালিও –
সার্ভিং বোর্ডের নিচে একটা সিডি আছে দেখবে, লেখা –
লাস্ট আওয়ার মিউসিক।

সিন্সিন্যাটি, নভেম্বর ২৫, ২০২১


পাল-মাস্তুল ও লাভাবন্যার কথা:

লাভাবন্যা, বৃত্যংশ, সার্ফবোর্ড, আণবিক, ভাসমানতা, অনুপল

গল্পবলা কবিতার দু’পাশ দিয়ে লাভা নেমেছিল
পলের পর অনুপল ধ’রে
অনুরাধার ঢেউ দেখা। প্রতি ঢেউ, প্রতি ক্ষণ
কমায়, সেমিকোলনে ভাঙছে; কয়েক গজ বোট সরছে
প্রতিটি ক্ষণে সার্ফবোর্ডে পায়ের ধরতাই আলাদা
ক্ষণ এত জোরালো
আণবিক শক্তির ক্ষমতা মার্কিন রাষ্ট্রপতিরাও কি বোঝে সঠিক!

গল্পে অ-বলা অনুরাধা বরং
জ্বালামুখের ভেতরে নেমে আনন্তিক ঘাসজমি পাবার কথায়
এখানে বিপন্নতার বুকের চুল ছিঁড়ে
পাঁজর ভেঙে লাভাবন্যা আসে
খিচুড়ি বওয়া বন্যাত্রাণ
ক্ষণের ভাসমানতা

বৌটি বলেছিল একদিন জমা লাভার ওপর
মিষ্টি সবুজ ঘাসাচ্ছাদন এসেছিলো
পুরু অনুজ বৃত্যংশ আসে
তোমার রাগ বিস্ফোটে বহিরঙ্গে এসে
লেবুচিনি জলপানি পায়

পাল লাগে মাস্তুল সাজাতে বা উল্টোটা
এটা দেহ-মনের ব্যাপারই না
বরং মাস্তুলের ভঙ্গুরতা

নভেম্বর ১৫, ২০২১, হনোলুলু/ হাওয়াই

অপরাহ্নের কুহেলীরুক:

লেইমাল্য, সিঁদুর-আলতার, বিরুদ্ধাচারণ, দ্বীপবাসিনী, কুহেলী, মধুবালতি

মাথাছাওয়া গাছের ঠিক মাথায়
ফুলবিনুনি
ঠিক বিকেল পাঁচটায় শিশির কুহেলী করে
বাস স্টপের খোকারা ভেজে সেই কুয়াশায়
ভালোবাসে খোকার মায়েরা
একটি কোনো বিকেলবেলার একটি ভেজা ফাঁকা

শয়ে শয়ে দ্বীপবাসিনী ভোররাতে গাঁথে
যে লেইমাল্য
বিরত দিন প’রে ঘোরে সারা কাজে
যতির পরবর্তী বিরুদ্ধাচারণ আসবে
ঝড়প্রাবল্যে মধুবালতি দুরন্ত বেসামাল
বিদ্যুতবজ্র পাখি একে একে কূপে ঝাঁপায়
গোধুলি দুশ্চিন্তায় এলো
সিঁদুর-আলতার দোকানগুলো কেন উঠে যাচ্ছে এভাবে!

নভেম্বর ১৩, ২০২১, হনোলুলু/ হাওয়াই

আলোকচিত্র- ‘আনোয়ার কা আজব কিস্যা’ (চলচ্চিত্র, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত)

আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।

Share