গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৬)

ধারাবাহিক উপন্যাস

।। সম্বিত বসু ।।

মহারাজ ব্রজকিশোর তখন মৃত্যুশয্যায়; তাঁর পুত্র হরিমোহন সিংহাসনে আসীন। সিরমোরের পশ্চিম থেকে এক দস্যুর দল তারাসাং-দারাসাং লুঠ করতে আসে। নামেই দস্যু, যে কোনো পাহাড়ি রাজ্যের সৈন্যের চেয়ে তারা সংখ্যায় বা পরাক্রমে কিছুমাত্র কম নয়। কম নয় বলেই না দেশ ছেড়ে সিরমোর পেরিয়ে একের পর এক গ্রাম লুঠ করতে করতে এই তারাসাং অবধি পৌঁছে গেছে। সে যুগে এখানকার লোকেরা ধর্ম ঠাকুরের উপাসনা করতো। ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরটাই তারাসাং দারাসাং-এ ছিল সব চেয়ে বড়। দস্যুদের আসার খবর পেয়ে স্বয়ং রাজা হরিমোহন তাঁর পারিষদ ও জনসাধারণ সঙ্গে নিয়ে বিশাল ঘটা করে ধর্মের পুজো দিলেন; একশো আটটা নারকেল ফাটানো হলো, একশো আট মালা চড়লো ধর্ম ঠাকুরের মূর্তিতে। এত করেও যা হওয়ার তাই হলো। তারাসাং-দারাসাং বর্বাদ করে সিরমোরের দস্যুরা (যদিও তাদের দেশ সিরমোরের পশ্চিমে কিন্তু সিরমোরের দিক থেকে এসেছে বলে ওদের সিরমোরীই বলা হতো) হরিমোহনকে খুঁজতে লাগলো শিরচ্ছেদ করবে বলে।

And humans are no fool
Gravity happens to pull!

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৬)

গুরুচরণ, চন্দ্রমিতা, সেলজা আর সায়েরী ডাইনিং এ জমায়েত হয়েছে। গুরু এক এক করে চারটে বিয়ারের বোতলের ছিপি খুলছে দাঁত দিয়ে। চন্দ্রমিতা তাকে সাবধান করে যে বোতলের মুখ ভেঙে মুখে কাঁচ ঢুকে কেটে যেতে পারে। সবার হাতে বিয়ারের বোতল ধরিয়ে দিয়ে গুরচরণ হেসে বলে এ তল্লাটে কেউ ওপেনার ব্যবহার করে না। বহুকাল আগে নাকি এক রাজা মৃগয়ায় গেলে তারাসাং-দারাসাং-এর মধ্যে গৃহযুদ্ধ লাগে; রাজধানীর সাথে বাকি দেশের যুদ্ধ। সে যুদ্ধে বহু লোক প্রাণ হারায়। যুদ্ধের ব্যস্ততায় তাদের কারুরই অন্তেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। রাজা ফিরে এলে যুদ্ধ থামে কিন্তু দু’তরফ থেকেই আর্জি আসে তারাসাং দারাসাং এর মধ্যে সিমান্ত রেখা করতে হবে। রাজা গম্ভীর হয়ে হুকুম দেন যে সিমান্ত রেখায় তাঁর আপত্তি নেই কিন্তু তা যেন মৃত যোদ্ধাদের দাঁত দিয়ে করা হয়। শিউরে ওঠে দু’পক্ষই কিন্তু রাজার আদেশ শিরধার্য। অগত্যা তারা মৃত যোদ্ধাদের মুখ থেকে দাঁত উপড়ে সিমান্ত করা শুরু করে। সোলো গজ করতে না করতেই মৃতদের দাঁত যায় ফুরিয়ে। কাঁচুমাচু মুখ করে প্রজারা সেই কথা রাজাকে জানায়। রাজা আগের মতই গম্ভীর হয়ে বলেন, “মৃতদের দাঁত ফুরিয়েছে তো আরো লড়াই করে মরে গিয়ে দাঁতের যোগান দাও” প্রজারা তখন রাজার কাছে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চেয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে তারা আর কোনোদিনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করবে না। এই বলে একটু থেমে গুরু বিয়ারে চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করে, বিশ্বাস না হয় একদিন বাইকে করে জঙ্গলি পথে তলিয়ে যাওয়া সেই অসম্পূর্ণ দাঁতের সীমান্তরেখা দেখিয়ে আনবে সে; সেই থেকে সাঙ্গীরা দাঁতের মর্ম আর ইস্তেমাল দুইই সমান বোঝে, দু’বেলা দাঁত মাজে, আর সমান তালে সুপুরি চিবোয়, আখ ছাড়ায়, বিয়ারের ছিপি খোলে। আর হ্যাঁ চন্দ্রা ম্যাম, এবার আপনার রেকর্ডার দয়া করে বন্ধ করুন। চন্দ্রমিতা ঘাবড়ে গিয়ে মোবাইলে রেকর্ডার বন্ধ করে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, আপনি কি করে বুঝলেন যে আমি রেকর্ড করছি? সেলজা উদ্যোগ নিয়ে চরস পাকিয়ে লম্বা করে পোঁটলা কাটে আর ভাবে, দাঁত নিয়েও এদের গুল-গল্পের অন্ত নেই, পান আর পুরিয়া খেয়ে খেয়ে দাঁতের গুষ্টির তুষ্টি করেও শান্তি নেই আবার তাই নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্বও করা চাই। এখানকার গাঢ় দুধের বড় গেলাসের এক গেলাস কফি খেতে ইচ্ছে করছে সেলজার কিন্তু অলরেডি বিয়ার চলছে, এরপর ভদকা আছে, কফি আর চরস না হয় কালকের জন্যই তোলা থাক। সায়েরীর ওষুধ বন্ধ, তার ওপর আবার বিয়ার; চরস আর ভদকা ওকে কোনোভাবেই খেতে দেওয়া যাবে না, সে কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে ওকে, দুই শর্তে সায়েরীকে এই পার্টিতে নেওয়া হয়েছে, এক-বিয়ার ছাড়া সে আর কোনো নেশার জিনিস খাবে না আর দুই-সে হঠাৎ হঠাৎ টেবেলে উঠে নাচ গান জুড়ে দেবে না। আপাতত সে বাধ্য মেয়ের মত বসে বিয়ার খাচ্ছে, আয়া নদীকে সে চিনতে পারলেও আয়া তাকে চিনতে পারেনি; ছোটবেলায় সে আয়ার স্রোতে নিজের নাম অনবরত শুনতে পেত, ‘সায়েরী সায়ে রীসা য়েরী, সায়ে রীসা…সায়েরী, সায়েরী…” আজ শুধুই ঝিঁঝিঁ পোকাদের মত সুরবিহীন সর্‌-স্র-সর্‌…বুকে চাপ অনুভব করেছিল সায়েরী আর মুখে বলেছিল, “বেইমান আয়া জাংলী হ্যায়!” ফেরার পথে গাছের গায়ে ‘সায়েরী লাভ সেলজা’ লেখার ইচ্ছে উবে গিয়েছিল কারণ বিস্মৃত আয়া নদীকে দেখে-শুনে সে বুঝতে পেরেছে যে তাদের কাছে থাকলেও গাছ-নদীদের চেনা-অচেনা নেই। অতয়েব সেজেগুজে ড্রেস পালটে পার্টি। বারবার সে বেসিনের কাছের আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখছে, মুখে নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করছে, চোখ ছোট করে ফ্লাইং কিস দিচ্ছে নিজেকেই।

গুরুচরণ হালকা করে কোনো এক টুরিস্টের ফেলে যাওয়া ট্রান্স মিউজিকের সিডি চালিয়েছে; সায়েরী ভাবে আর আফশোষ করে যে যখন টেপ চলছেই তখন হিন্দি গান বা রেডিও নয় কেন? কিন্তু মুখ ফুটে সে কিছু বলতে পারছে না, দিদির মানা আছে। অগত্যা সে বিয়ার, আয়না আর দেয়ালের ওপর অপটু হাতে আঁকা সমুদ্রতলের মারমেড ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী, প্রকৃত ও কল্পিতদের দেখছে আর তাদের গল্পটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। চন্দ্রমিতা আর সেলজা স্থির করতে পারছে না কোন গল্প শুনবে গুরচরণের কাছে; চন্দ্রমিতা তারাসাং-দারাসাং-এর প্রচলিত লোককথা, অতীতের রাজাদের আমলের গল্প শুনতে চায় আর সেলজা জানতে চায় দিনদয়ালের ইতিবৃত্ত। গুরু চোখ বুজে চরসের জয়েন্টে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া অনেকক্ষণ ট্র্যাপ করে তারপর নামমাত্র ছেড়ে, জয়েন্ট চন্দ্রমিতাকে পাস করে বলে যে সে এমন এক গল্প শোনাবে যা দু’জনকেই সন্তুষ্ট করবে। দেয়ালের ক্যাবিনেট খুলে স্মারনফের বোতল বার করে গুরু নিজের বিয়ারে মেশায়, বাকিদের এহেন ডাইরেক্ট পাঞ্চে আপত্তি। জয়েন্ট আর বিয়ার শেষ করে গুরচরণ গানের ভলিউম কমিয়ে দেয়। গল্প শুরু করে সে:

মহারাজ ব্রজকিশোর তখন মৃত্যুশয্যায়; তাঁর পুত্র হরিমোহন সিংহাসনে আসীন। সিরমোরের পশ্চিম থেকে এক দস্যুর দল তারাসাং-দারাসাং লুঠ করতে আসে। নামেই দস্যু, যে কোনো পাহাড়ি রাজ্যের সৈন্যের চেয়ে তারা সংখ্যায় বা পরাক্রমে কিছুমাত্র কম নয়। কম নয় বলেই না দেশ ছেড়ে সিরমোর পেরিয়ে একের পর এক গ্রাম লুঠ করতে করতে এই তারাসাং অবধি পৌঁছে গেছে। সে যুগে এখানকার লোকেরা ধর্ম ঠাকুরের উপাসনা করতো। ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরটাই তারাসাং দারাসাং-এ ছিল সব চেয়ে বড়। দস্যুদের আসার খবর পেয়ে স্বয়ং রাজা হরিমোহন তাঁর পারিষদ ও জনসাধারণ সঙ্গে নিয়ে বিশাল ঘটা করে ধর্মের পুজো দিলেন; একশো আটটা নারকেল ফাটানো হলো, একশো আট মালা চড়লো ধর্ম ঠাকুরের মূর্তিতে। এত করেও যা হওয়ার তাই হলো। তারাসাং-দারাসাং বর্বাদ করে সিরমোরের দস্যুরা (যদিও তাদের দেশ সিরমোরের পশ্চিমে কিন্তু সিরমোরের দিক থেকে এসেছে বলে ওদের সিরমোরীই বলা হতো) হরিমোহনকে খুঁজতে লাগলো শিরচ্ছেদ করবে বলে। রাজা তাদের হাতে-পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে, এই দৃশ্য তাদের কাছে অতীব প্রিয়। কিন্তু তারা হরিমোহনকে কোত্থাও খুঁজে পেল না, এক ধনী শেঠের বাড়ির গুপ্তঘরে তিনি আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। রাগে অপমানে দস্যুরা মন্দিরে চড়াও হয়। প্রদীপ, পিলসুজ, বাতিদান ইত্যাদি সর্বস্ব লুঠ করে ধর্মের মূর্তির মাথা ভেঙে দেয় তারা। লালচে কালো পাথরের মাথা নিস্পৃহ দৃষ্টি নিয়ে মেঝেতে লুটোয়। সেই মুন্ড পূর্ব অভিযানের পূর্বতম তাবাহির স্মৃতি হিসেবে দস্যুরা নিজেদের সাথে নিয়ে যায়। দস্যুরা চলে গেলে মহারাজ গুপ্তকুঠি ছেড়ে প্রকাশ্যে আসেন, শুরু হয় লুন্ঠিত তারাসাং-দারাসাং-এর ভাঙাচোরা ঘর-বাড়ি-প্রাসাদ-কোঠার পুনর্নির্মাণের কাজ। সমস্ত শস্য লুঠ হয়ে যাওয়ায় জঙ্গল থেকে ফল-মূল-শাক-সবজি আনা শুরু হয়। বনপথ ধরে একটু এগোলেই ধর্ম ঠাকুরের মন্দির, লোকেরা ফল-মূল আনতে সেই পথে রোজ হাঁটে কিন্তু ভুল করেও মন্দিরে প্রবেশ করে না; যে দেবতা নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম সে মানুষদের কী করে রক্ষা করবে? শয্যাশায়ী প্রাক্তন মহরাজ ব্রজকিশোরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে মহারাজ হরিমোহন নতুন মন্দির বানাতে শুরু করেন মহাদেবের পূজো করবেন বলে। ওদিকে এলাকার সবচেয়ে দক্ষ ভাস্কর অনন্তনাথ মন্দিরে গিয়ে ভাঙা মূর্তিতে মাথা জুড়ে দেয় সুড়কি আর আঠার লেই দিয়ে, তার আগে অবশ্য তাকে ধর্মদেবের মাথাটা বাকি শরীরের সাথে মিলিয়ে খোদাই করতে হয় কালো-পাহাড়ি পাথর দিয়ে। সে খবর চাওর হলে রাজা যার-পর-নাই অপমানিত হন; মূর্তি যদি সারাতেই হত তো রাজার অনুমতি নিয়ে করা উচিত ছিল। রাজা বললেন, মুক্তাঙ্গনে সর্বসমক্ষে তিনি তার বিচার করবেন কিন্তু বাধ সাধলেন তাঁর পিতা ব্রজকিশোর। ব্রজকিশোর ছিলেন ধর্ম ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। সে যাত্রায় ভাস্কর অনন্তনাথ বেঁচে গেলেও সেই সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই প্রাক্তন মহারাজ সকালে প্রাসাদের ছাদে পায়চারী করতে যাওয়ার সময় সিঁড়ি থেকে পড়ে গুরুতর ভাবে আহত হলেন আর সেদিন রাতেই দেহত্যাগ করলেন। অনন্তনাথকে শাস্তি দেওয়ার একটা সুযোগ এমনিতেই মহারাজ হরিমোহন খুঁজছিলেন, পিতৃশোকে জ্ঞানশূন্য হয়ে তিনি ধর্ম মন্দিরেই তার বিচার করলেন। লোকে-লোকারণ্য মন্দির প্রাঙ্গণ। প্রজাবৎসল রাজা ব্রজকিশোরকে অনন্তনাথের পাপে মরতে হলো, অনেকেই মনে করলো যে কুলদেবতা কৃষ্ণের আরাধনা বন্ধ করা উচিত হয়নি তাঁর যৌবনকালে। যা হোক অনন্তনাথকে যখন হাতে-কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে আসা হচ্ছিল কুপিত জনতা তাকে থুতু দিয়ে, পাথর ছুঁড়ে, ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছিল। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়; তার তৈরী দেবতার মুণ্ড মূর্তি থেকে খুলে নেওয়া হয় আর তার গর্দান যায়; তার ভূলুন্ঠিত মুণ্ডুতে সকলে থুতু দিয়ে রোষ উতরিয়ে নিজের নিজের বাড়ি ফেরে। এইভাবেই ধর্মদেব আর ভাস্কর অনন্তনাথের এক সাথে গর্দান যায় যা আজকের দিনেও আহারকালে শিশুরা শুনলে অবাক হয়ে মুখ হাঁ করে গ্রাস চিবোতে বা গিলতে ভুলে যায়।

গুরুচরণ চুপ করলে ট্রান্স মিউজিক আবার কানে আসে। চন্দ্রমিতা রেকর্ডার বন্ধ করে গলা নামিয়ে অস্ফুটে বলে, “ইস্‌কে বাদ?” গুরুচরণ হেসে বলে, “ইস্‌কে বাদ ভদকা”

চন্দ্রমিতা তারাসাং-দারাসাং-এর প্রচলিত লোককথা, অতীতের রাজাদের আমলের গল্প শুনতে চায় আর সেলজা জানতে চায় দিনদয়ালের ইতিবৃত্ত। গুরু চোখ বুজে চরসের জয়েন্টে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া অনেকক্ষণ ট্র্যাপ করে তারপর নামমাত্র ছেড়ে, জয়েন্ট চন্দ্রমিতাকে পাস করে বলে যে সে এমন এক গল্প শোনাবে যা দু’জনকেই সন্তুষ্ট করবে। দেয়ালের ক্যাবিনেট খুলে স্মারনফের বোতল বার করে গুরু নিজের বিয়ারে মেশায়, বাকিদের এহেন ডাইরেক্ট পাঞ্চে আপত্তি। জয়েন্ট আর বিয়ার শেষ করে গুরচরণ গানের ভলিউম কমিয়ে দেয়।

দূরে জঙ্গলের দিকে চৌকিদারদের টহলদারী শুরু হয়েছে, অবিরত ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে থেকে থেকে তাদের হুইসেলের আওয়াজ। পেগ বানাতে বানাতে গুরচরণ বলে, “অউর এক গায়া মালুম হোতা হ্যায়!” চন্দ্রমিতা তারাসাং-দারাসাং-এ মানুষদের কথা নেই বার্তা নেই, বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়ার কিসসা জানতো, সেলজা শোনেনি সেই অদ্ভুতুড়ে কাহিনী। সে জয়েন্ট ধরিয়ে জানতে চায় কে গায়েব হলো? গুরুচরণ বলে এরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলে তো শুধু তাকেই গল্প বলে চলতে হবে আর তারাসাং-দারাসাং-এর গল্প রাত কাবার হয়ে গেলেও শেষ হবার নয়। তারও তো গল্প শুনতে ইচ্ছে করে, সিমলার গল্প, দিল্লীর গল্প, কলকাতার গল্প। চন্দ্র হেসে বলে যে অন্যান্য শহর মানুষকে কুমীর করে দেয় আর এখানে মানুষরূপী বাঘেরা খুলে-আম (প্রকাশ্যে) ঘুরে বেড়িয়ে ধান্দাপানি করে, এই যা তফাৎ অন্যান্য শহরের সাথে তারা-দারার। গুরচরণ ভাবে চন্দ্রা ম্যাম কিসসা শুনে শুনে কথাও বলে কাহিনীর মত করে, তাইতো যুবানে তার বাঘ, কুমীর, সমেত একটা গোটা জঙ্গল শহর হয়ে যায়। সায়েরীকে একটা ছোট বিয়ার খুলে দিয়ে গুরুচরণ বলতে থাকে, ‘এই যে তারা-দারায় এত বাজারের রমরমা, মাংসের নিলাম, জ্বাল নোটের খুললাম কারবার, এই সব কোনো না কোনো ভাবে কোথাও না কোথাও থেকে আমদানী করা হয়েছে, ইম্পোর্টেড, এখান থেকে কিচ্ছুটি এক্সপোর্ট হয় না, বছরের পর বছর ধরে মাল আর টাকা হাতে হাতে ঘোরে, হাত বদল হয় শুধু, মোবাইল, হেডফোন, চিনির পুতুল, পিস্তল, চমরি গাইয়ের লেজের চামর আর সিং-এর চিরুনী, আরও কত কি ম্যাম, লাগবে তো বলুন এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি, এই দিনু…দিনদয়াল! বলে তারস্বরে হাঁক পাড়ে গুরচরণ, না, তার নেশা হয়নি, একটা পুরোনো মুখ, অনুগত লোককে বেখেয়ালে হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে করেছে, জানতে ইচ্ছে করেছে সে হতভাগা আছে না গেছে, হোটেলে আছে না গেছে, নিজেতে আছে না গেছে মায় তারাসাং-দারাসাং-এ আছে না গেছে?! হোটেলের কোনো এক কোনে ঘাপটি মেরে ঘুম দিচ্ছে না জঙ্গলে বা নদীর ধারে চরতে গিয়ে পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেছে, জেনে-বুঝে সেঁদিয়েছে কোনো গুপ্তকোটরে। সায়েরী এতক্ষণ চুপ করে ওদের কথা শুনছিল, দিনদয়ালের নাম নিতেই সে তাকে খুঁজে আনতে যেতে চায়। সেলজা চোখ পাকিয়ে তাকে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করে। সায়েরী দমে গিয়ে গুরচরণকে হিন্দি গান চালাতে অনুরোধ করে, আমির খানের গান, কয়ামত সে কয়ামত তক। গুরু বলে যে তার কাছে সেই গান নেই। সায়েরীও নাছোড়বান্দা, বলে দিদির মোবাইলে আছে, মোবাইল থেকে চালাও। মোবাইল মিউসিক সিস্টেমে কানেক্ট করতে করতে গুরচরণের ইচ্ছে হয় মন খুলে মাতলামী করতে। তার কাছে মাতলামী অতিরিক্ত মদ্যপানের পরিণতি নয় বরং মাতলামী একটা চয়েস, কোনো কোনো দিন মন চায় মাতাল হতে। সে আবার দিনদয়ালকে ডাকতেই ডাইনিং হলে উদ্ভ্রান্তের মত হাজির হয় দিনু। প্রথম ডাকে সাড়া না দেওয়ার জন্য গুরু তাকে শাস্তি দিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে। সেলজা আপত্তি করে, এ কি বোকা রসিকতা গুরুর শুধুশুধু একটা ছেলেকে অপদস্ত করা। গুরু হেসে বলে কান ধরে দাঁড়ানোয় কী আর এমন অসুবিধে, ছেলেবেলায় দাদুর কাছে দাবা খেলায় হেরে গিয়ে কতবার কান ধরে দাঁড়িয়েছি। সেই সময় মহল্লার রকে-রকে দাদুরা দাবা খেলতো, আমরা ছোটরা সেই খেলা দেখে দেখে দাবা খেলা শিখেছি। কাচের গেলাসে দাদুদের জন্য কাটিং চা আসতো, সাথে খাস্তা বিস্কুটও। আমরা খেলতে চাইলে বাজি ধরে খেলতে হত: জিতলে খাস্তা বিস্কুট আর হেরে গেলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। হারলে বা জিতলে আমাদেরই যা কিছু করতে হতো, দাদুদের কিছছু নয়। দাবা খেলায় হারিয়ে আমাদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দাদুরা কী যে মজা পেত তা কে জানে! দিনুর একটু পানিসমেন্ট দরকার, নইলে ক্ষ্যাপামো করতে করতে কোনদিন বেঘোরে মরবে! কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক-এর গান চলতে শুরু করে, ‘পাপা কহতে হ্যায় বড়া নাম করেগা” সায়েরী চেয়ার নিয়ে স্পিকারের কাছে গিয়ে বসে, স্পিকারের সামনে টেবেলের ওপর মাথা রেখে চোখ বুজে গুন-গুন করে গলা মেলায়। হোটেলের এক কর্মচারী ডিনার সার্ভ করে, কষা মাংস, রুটি আর সালাড। এক গুরুচরণ বাদে সবাই খায়, গুরু খুব তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করে দাবা থেকে তাসের দিকে সে ঠিক কবে ঢললো? এক কুঁচি পেঁয়াজ মুখে দিয়ে না চিবিয়ে সেটায় জিভ বুলোয়, চোষে; টক-ঝাল প্রলেপ নিমেষে জল হয়ে গেলেও সে আনমনে খুঁজতে থাকে সেই চট্‌পটে স্বাদ। খাওয়ার পর গুরুর ভাঁট আরও বেড়ে যায়, নিজেকে আর নিজের শহর নিয়ে অবান্তর বাড়ফাট্টাই। তারাসাং-দারাসাং-এ হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর মত সেও নাকি একদিন গায়েব হয়ে যাবে, কোনো খবর হবে না, তার সমস্ত স্মৃতি এমনকি নামটুকু পর্যন্ত মুছে যাবে তবু তার বিজনেস থামবে না, হোটেল, পেট্রল পাম্প দারুণ চলবে। সে ছোটবেলা থেকে কতবার এই পোড়া শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো না কোনো কারণে যেতে পারেনি; তার এই তারাসাং-দারাসাং ছেড়ে বেরোনোর অক্ষমতাতেই বোঝা যায় তার অদৃষ্টে গায়েব হওয়া লেখা আছে। সেলজার ঝিম ধরেছে, মোলায়েম ভাবে থেকে থেকে কিছু ভিত্তিহীন চিন্তা মাথায় আসছে যা কাউকে বলার নয়: গুরুচরণের নিয়তি নয় ইচ্ছে গায়েব হওয়া, কিন্তু এ শহরে আগন্তুক চন্দ্রমিতা এখানে গায়েব হতেই এসেছে, তাকে খেলিয়ে কোলে তুলে নিতে চায় শূন্যপাক যা দোসাং-এর আনাচে-কানাচে ঘাপটি মেরে থাকে শিকারের অপেক্ষায়। সেলজা মুচকি হেসে গ্লাস টেবেলে নামিয়ে রেখে বোতল থেকে বেশ কিছুটা ভদকা নিট মেরে দেয়। স্বচ্ছ তরল আগুন হয়ে গলা দিয়ে নামে আর টেবেলের ওদিক থেকে গুরচরণ দোসাং-কীর্তনে বাপ-মা ভুলে স্বগর্বে ঘোষণা করে, “আপলোগ সোচতে হঙ্গে বহুত দেখ-শুনলিয়ে তারাসাং-দারাসাং কি আনোখী ইন্তেজাম পর ম্যাডাম আভি জানলো অর জানকে ভুল যাও কি আপ জিস শহরমে হোটেল লেকে টুরিজিম মানা রহে হো দারাসাল ইয়ে তারাসাং-দারাসাং হ্যায়হি নেহি বলকি উস্কা ডামি হ্যায়! আসলী তারাসাং কাঁহি অর কোহরা-বাদলসে ঢাকে হুয়ে! যো লোক ইঁহা খো যাতে হ্যায় উহ পৌঁহচতে সিধে উধার!” উত্তেজিত শিখ্‌কে শান্ত করতে সেলজা গুরুকে দীনদয়ালের কথা বলতে অনুরোধ করে। জয়েন্ট বানিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিলে সে শুকনো নেশার ধোঁয়া আর লাল টিপ-এ ঘটমান বর্তমানের খবর করে দেওয়ালের দিকে মুখ কোরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দিনদয়ালের কিসসা, চড়তি নেশার সাথে ধস্তাধস্তিপূর্বক গল্পের টুঁটি চেপে শ্রোতাদের কাছে হাজির করে। গল্পটা সে ভুলে, ভেঙে, থমকে থেমে প্রবল প্রচেষ্টায় পেশ করেছিল, সে সব ফাটল, বিরতি বাদ দিলে গল্পটা যা দাঁড়ায় তা হল এই:

দীনদয়াল তখন চোদ্দ কী পনেরো, চাঙ্গা, চ্যাঙড়া ছেলে, লোকের বাড়ির কুকুরকে ঘুরিয়ে পায়খানা করিয়ে নিয়ে আসার কাজ করে, গাড়ি ধোয়, এমন কী নিজের বাড়িতে কোনো কাজ করলেও টাকা নিতে ছাড়ে না। ভালোই চলছিল, মরতে কোথা থেকে যে একটা নরকঙ্কালের খুলি চলে এলো তার হাতে, সেই খুলিই কাল হলো তার। খুলিটা নিয়ে সে কী করবে ভেবে ভেবে একটা বেয়ারা স্কিম ফাঁদে, খুলিটাকে মহাপাপী অনন্তনাথের খুলি বলে চালিয়ে বাজারে, মেলায়, নদীর ঘাটে বসে;, সে যুগে যেমন থুতু দেওয়া হয়েছিল অনন্তনাথের মুখে তার গর্দান নেওয়ার আগে, সেরকম পাপীর খুলিতে থুতু দিলে মানুষের পূণ্য হবে। ভগবানের জয়গান করলে যেমন পূন্য হয় তেমন শয়তানকে ধিক্কার জানালেও পূণ্য হয়। তার এই ঢপের স্কিম কিন্তু লোকে বেশ ভালোরকমই খেলো। মন্দিরে ঢোকার আগে বা মেলায় ঘুরতে এসে অনেকেই তার খুলিতে থুতু দিয়ে একটা টাকা ছুঁড়ে দিত তার দিকে, এইটাই দস্তুর হয়ে গেল, থুতু করোটির টাকে মাখিয়ে মিলিয়ে দিয়ে দীনু বসে থাকতো পরের পূণ্য-সঞ্চয়কারীর অপেক্ষায়। শরৎ, শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত সে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিল তার লোক-ঠকানো কারবার, তপবন থেকে এক সাধু এসে তার ঘুম কেড়ে নিল। সাধু তার সঙ্গে একবেলা বসে আড্ডা দিয়েছিল, চরস খেয়েছিল একসাথে। সাধু দীনুর জালি কারবারের কথা না জেনেই খুলিটা দেখে বলেছিল যে সেটা ভাস্কর অনন্তনাথের খুলি, খুলির পেছন দিকে যে এক চিলতে ফাটা আছে সেটা ফেটেছিল অনন্তর গর্দান যাওয়ার আগে স্বয়ং কোতোয়ালের লাঠির বাড়িতে। বৃত্তান্ত শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে দীনুর, এতদিন না জেনে খোদ অনন্তনাথের খুলি নিয়েই মজা করেছে, এবার ঠ্যালা বুঝবে। কিন্তু যা করেছে তাতে এতদিনে তো কোনো বিপদ হয়নি, হঠাৎ সব থামিয়ে দিলেই হয়তো সর্বনাশ হবে, এই ভেবেই হয়তো দিনু তার কারবার চালিয়ে যায় এরপরও কিন্তু মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায় তার, বাড়ি ফেরা ছেড়ে দেয় সে। প্রথম প্রথম বাড়ির লোকেরা তাকে খুঁজতে বেরোতো, দূর-দূরান্তের নদী-পার, জঙ্গল থেকে তাকে ধরে এনে বেঁধে রাখতো কিন্তু বাঁধন খুলে দিলেই সে আবার বেরিয়ে পড়তো খুলি নিয়ে। একবার তার বাবা রেগেমেগে খুলিটা শ্মশানঘাটের নদীতে ফেলে দিয়েছিল কিন্তু পরদিনই দেখে দীনু সেই খুলি নিয়ে নদীর পারে বসে পূণ্য বেচছে, কী করে কে জানে! বাড়ির লোকেরা হাল ছেড়ে দেয়, তাদের আরও ছেলেপুলে আছে তাদের মানুষ করতে হবে, একটাকে ভূতে নিলে কী আর করা। তারপর থেকে দিনু রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটায়, মাঝে মাঝে মতি হলে গুরুচরণের হোটেলে সাফাই-এর কাজ করে, গাড়ি ধোয়, রাত্তিরে কোথায় থাকে তার ঠিক নেই, কখনও বাস-স্ট্যান্ডের ওয়েটিং রুমের বারান্দায়, কখনো গুরুর হোটেলে তো আবার কখনও জঙ্গলের ভেতর পরিত্যক্ত মন্দিরে। সে পাগল হয়ে গেলেও কারও কোনো অনিষ্ট করে না বলে লোকেও তাকে ঘাঁটায় না বরং খুলি নিয়ে ভাত-রুটি ছড়িয়ে বসলে মর্জিমাফিক করোটিতে থুতু দিয়ে একটা টাকা ছুঁড়ে দেয় তার দিকে।

সেলজা দিনুর কিসসা শুনে অবাক হয়েও অবাক না হওয়ার ভান করে বদ-রসিকতা করে গুরুকে জিজ্ঞেস করে সে কবার অনন্তনাথের খুলিতে থুতু দিয়েছে আর তা করে কতটা পূণ্য সঞ্চয় করেছে আজ অবধি? গুরু উত্তরে বলে তার জুয়ায় রুচী আছে কিন্তু পূন্যিতে নেই। দিনু লোক ঠকালে কি হবে, ওর জুয়ার ভাগ্যটা দেখো, বন-বাদাড় থেকে কুড়িয়ে আনা যে খুলিটাকে অনন্তনাথের বলে চালালো,পরে সেটা অনন্তনাথেরই নিকলোলো। আর যে সাধুর সঙ্গ করে দিনুর জীবনটাই বদলে গেলো দেখো গিয়ে যাও সে ব্যাটা হয়তো নিজেই ভন্ড, দিনুর খুলি নিয়ে মস্করার কথা শুনে হয়তো তাকে একটু চম্‌কে দিতে চেয়েছিল আর কি থেকে কি হয়ে গেলো… কে বলতে পারে, এই তারাসাং-দারাসাং আজব দেশ, বড় বিচিত্র, ভীষণ ছ্যাঁচড়া, কারণে অকারণে এখানে চুরি-জোচ্চুরি! বহুকাল পর সেলজার হুল্লাট নেশা হয়েছে। সে মনে মনে গুরচরণ, চন্দ্রমিতা আর দিনদয়ালের সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইল বানাতে গিয়ে নেশার পিছল ঘাটে বারংবার হড়কাচ্ছে। সেলজার থেকে থেকে ঝিমুনি আসছিল, সায়েরীর চিমটিতে তার ঘোর কাটে। সে অবাক হয়ে যায়, আসাইলামের ওই গোবেচারা মেয়েটা তার পাছায় চিমটি কাটছে! এই গোপনে চোরা-চিমটি তো আসলে ঘরে যাওয়ার অনুরোধ। সেলজা উঠে পড়ে। উঠতে গিয়ে দেখে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সায়েরীর কাঁধে ভর দিয়ে সে কোনোক্রমে তাদের ঘরে যায়। চন্দ্রমিতাও প্রচুর নেশা করেছে, সবচেয়ে বেশী মদ খেয়েছে সে কারণ তার পেগগুলো নিট ছিল। তারাসাং-দারাসাং-এর শীতের রাতে সে গরমে নাস্তানাবুদ হয়ে সোয়েটার খুলে ফেলেছে, খুলে দিয়েছে জামার বোতাম; তার বুকের ওপর দিকে লাল কালিতে লেখা ‘ভেনা কাভা’ মাতাল গুরুর চোখ টানছে বারবার। গুরু আনমনে বোকার মত বলে ওঠে ‘ভেনা কাভা!” আর তারপর চন্দ্রমিতার সঙ্গে চোখাচুখি হতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, কী রক্ষে তখনই চৌকিদারের বাঁশী, ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে বেজে ওঠায় গুরচরণ টপিক পেয়ে আশ্বস্ত হয়ে বলে, “ভুল বলেছিলাম, কেউ হারিয়েছে বলে ও বাঁশী বাজছে না, এমনিই বাজছে টহলদারীতে যেমন বেজে থাকে, তবু আমার ওই বাঁশী শুনলেই সেই ছোটবেলা থেকে মনে হয়, ওই বুঝি কেউ হারিয়ে গেলো ফর এভার, নেক্সট টাইম ইট উইল হুইসেল ফর মি!”

প্রথম প্রথম বাড়ির লোকেরা তাকে খুঁজতে বেরোতো, দূর-দূরান্তের নদী-পার, জঙ্গল থেকে তাকে ধরে এনে বেঁধে রাখতো কিন্তু বাঁধন খুলে দিলেই সে আবার বেরিয়ে পড়তো খুলি নিয়ে। একবার তার বাবা রেগেমেগে খুলিটা শ্মশানঘাটের নদীতে ফেলে দিয়েছিল কিন্তু পরদিনই দেখে দীনু সেই খুলি নিয়ে নদীর পারে বসে পূণ্য বেচছে, কী করে কে জানে! বাড়ির লোকেরা হাল ছেড়ে দেয়, তাদের আরও ছেলেপুলে আছে তাদের মানুষ করতে হবে, একটাকে ভূতে নিলে কী আর করা। তারপর থেকে দিনু রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটায়, মাঝে মাঝে মতি হলে গুরুচরণের হোটেলে সাফাই-এর কাজ করে, গাড়ি ধোয়, রাত্তিরে কোথায় থাকে তার ঠিক নেই, কখনও বাস-স্ট্যান্ডের ওয়েটিং রুমের বারান্দায়, কখনো গুরুর হোটেলে তো আবার কখনও জঙ্গলের ভেতর পরিত্যক্ত মন্দিরে। সে পাগল হয়ে গেলেও কারও কোনো অনিষ্ট করে না বলে লোকেও তাকে ঘাঁটায় না বরং খুলি নিয়ে ভাত-রুটি ছড়িয়ে বসলে মর্জিমাফিক করোটিতে থুতু দিয়ে একটা টাকা ছুঁড়ে দেয় তার দিকে।

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৫)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৪)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৩)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-২)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (প্রথম পর্ব)

Share