গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৪)

ধারাবাহিক উপন্যাস

।। সম্বিত বসু ।।

ডাইনিং-এ বছর তিরিশের একটি মেয়ের সাথে বসে সাইকিয়া আলু পরোটা খাচ্ছিল। সেলজাদের দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে; গতকাল পেট্রোল ঝগড়ার জের। কি বলবে কিছু ভেবে না পেয়ে মেয়েটির সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। চন্দ্রমিতা। কলকাতা থেকে এসেছে। সেলজা হেসে বাংলায় তার সাথে কথা বলে। চন্দ্রামিতা অবাক হয়ে চিরাচরিত শব্দ-যুগলের সদব্যবহার করে, “আপনি বাঙালি!” সেলজা হেসে উত্তর দেয়, আমার মা বাঙালি ছিলেন। সাইকিয়া গপাগপ আলুর পরোটা সাঁটিয়ে, “ম্যায় চালা আপলোগ ফুরসাতসে গাপ-সাপ কিজিয়ে, চায়ে পিজিয়ে। ম্যায় আজ লেট হো গায়া” এক টেবিলে বসে চন্দ্রমিতা সেলজার দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তার সেই চাওয়া ভাল ঠেকে না সায়েরির।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৪)

“And humans are no fool  
Gravity happens to pull!”

সাইকিয়া পেট্রোল পাম্পের ক্যাশ সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে গুরুচরণের কাছে সমানে সেলজাদের খবর বার করার চেষ্টা করছে। ওরা টুরিস্ট না সম্বন্ধি, থাকবে না চলে যাবে, বাড়ি ভাড়া নেবে কিনা, তারাসাং-দারাসাং ঘুরে দেখার জন্য গাইড লাগবে কিনা, হিন্দু না শিখ, ভেজ না ননভেজ… আর মাঝে মাঝেই বলছে, “ইয়ে দুবলা লাড়কি কুছ জানা প্যাহচানা মালুম হোতা হ্যায়, কঁহা দেখা, কঁহা দেখা ইসে…” গুরচরণ পেট খোলসা না করে বলে, “সাইকিয়া, আপ্নে বেটি কী উমার কা লড়কি পে নজর! আভি ভি ওয়াক্ত হ্যায়, আপনে উমার কা কিসি অওরাত কে সাথ সেটিং কারলে। কাবতাক ড্রাইভারলোগো কো পিছওয়াড়া দেগা। রাজি হ্যায় তো বোল, তেরা সাদি কা ইন্তেজাম কারু…” একটুও না ভেবে গুরচরণ এসব বলে যায়, বুজুর্গদের সংস্পর্শে সেও থেকে থেকে আজব গঞ্জের আজব খিল্লিতে মাতোয়ারা। টাকা করাটা এখন তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে, ব্যবসায় সে এতটাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে যে কাজ করতে করতে সে আকাশ-পাতাল ভাবে, এই যেমন আজ দুপুর থেকে সায়েরীকে দেখে তার মনে পড়ছে মতি রো-এ জুয়ার ঠেক, গুরচরণ তখন তরুণ তুর্কি জুয়ার আসরে টাকা খাটাচ্ছে মটর সাইকেল কিনবে বলে, গুরচরণ তার শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাহনটির দিকে চায়, ছেদী মদের চাট বিক্রি করতো, পাঁপড় আর ঝাল মটর, সায়েরী স্কিপিং করতে করতে সুর করে কাউন্টিং করতো, “ওয়ান ইয়ানি এক, টু ইয়ানি দো, থ্রি ইয়ানি তিন…” ছেদি বাজখাঁই গলায় সায়েরিকে ডাকতো, সায়েরি পড়ি-মরি করে ঘরে গিয়ে চাট নিয়ে আসতো জুয়াড়ি মাতালদের জন্য। সাইকিয়া তখন তার বাবা ভুপিন্দারের ড্রাইভার, মাঝে-মাঝে আসতো মতি রো-এ ছোটে মালিককে ডাকতে। সায়েরীকে দেখেছে ও কিন্তু গুরচরণ যতটা দেখেছে ততটা নয়। চাট দিয়ে অনেক সময় পাগলীটা যুগল চাচার পেছনে দাঁড়িয়ে তার তাশ দেখতো আর জোরে-জোরে বলতো, লাল পানের টেক্কা, কালো পানের বিবি, এ বাজিতে কেউ তোমায় হারাতে পারবে না  আর যুগল চাচা লাথ খাওয়া কুত্তার মত কঁকিয়ে উঠে তাশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সায়েরির বাপান্ত করত। গুরচরণ সাইকিয়ার মুখের দিকে তাকায়, তখন গোঁফ রাখতো সাইকিয়া, কবে যে গোঁফ ওড়ালো মনে পড়ে না তার। পেট্রলের গাড়ির হর্ন কানে আসে তার। স্মৃতিবিলাস ছেড়ে সে সাইকিয়ার কাছে ক্যাশ কত জানতে চায়। সে বুঝতে পেরেছে এই সায়েরীর ফিরে আসা নিয়ে বিস্তর লাফড়া হতে পারে। আসাইলাম থেকে তো ওর আসার কথা নয়। আর ওই ওর সাথে মোটা মহিলাটিই বা কে? কিন্তু বেশি চিন্তা করার কিছু নেই যদি পাচার কেস হয় ত মায়ের হাতেই পড়বে, ছেদীকে ডিঙিয়ে আজকাল এলাকায় মেয়েদের সওদা হবার নয়। গুরচরণ ভাবে আচ্ছা-খাসা ড্রামা হতে চলেছে, চুপ-চাপ মস্তি আর সাত দিনের অ্যাডভান্স নিতে হবে; পুলিশে তুলে নিলে টাকা চোট যাবে।

সেলজারা রাত্তিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। খেয়ে উঠে সায়েরি বায়না ধরে নদীর ধারে হাঁটতে যাবে, হাত-পা ধোবে ঘাটে। সেলজা বলে তার বাসের ঝাঁকুনিতে সারা গায়ে ব্যথা, আজ একটু মাসাজ করে দিলে সে সায়েরীকে একটা কিস দেবে। কিসের কথা শুনে সায়েরির নদীর বাই নামে। সেলজা তার সালোয়ার খুলে উপুড় হয়ে শোয়, সায়েরির অবাক হয়ে কী যেন বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সেলজার সারা শরীরে হাত বুলোতে বুলোতে যোনিমুখে আঙুল খেলায়। সেলজার অস্পষ্ট গোঙানিতে সায়েরি ধন্য হয়। দুজনেরই মনে এক সাথে সিমলা ভিলার অফিস রুমের গুফতাগু ঝলকায় কিন্তু কেউ মুখ খোলে না কারণ মুখ তখন মুখিয়ে আছে অন্য কিছুর জন্য। কাউনসেলার-কাউনসেলির মত্ত কেলিকে নরম করতে ঘরের নীল ডুমে ভোল্টেজ ড্রপ, সুদূরের বন-বাদাড়ে ঝিঁঝিদের অবিরত, অক্লান্ত শিষে রাত ফালা-ফালা। সায়েরি সায়রে ঢেউ তুলতে তুলতে সেলজা ভাবে কাল দিনদয়ালকে দিয়ে চরস আনাতে হবে। চরস আর স্মার্ন-অফ; ভাবতেই উঠতি খুশী চুঁইয়ে-উপচিয়ে আর্দ্র হড়কানিতে টইটুম্বুর যোনিমুখ। এবার সায়েরীর পোষাক খুলে তাকে আলগা ভালোলাগায় পাগোল করার পালা। এই রাত, যার নির্মাণ শুরু হয়েছিল আসাইলামের শ্বাসরুদ্ধ নজরদারীতে, তার পূর্ণতায় স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ছেঁড়ে-কেটে যায়। ডিনার থেকে ফিরে সেলজা দরজা দিতে ভোলেনি তাই মৃত্যু আপাতত এই কামরায় বন্দি। 

পরদিন সকালে উঠে সেলজা দেখে যে ঘরের জানলা খোলা। তার ভালো মনে আছে সে জানলা ছিটকিনি এঁটে বন্ধ করেছিল। সায়েরি কখন উঠে জানলা খুললো, কেনই বা খুললো এই ঠান্ডার রাতে? সায়েরির কাছে এর সদুত্তর পাওয়া দুষ্কর তবু সে সায়েরিকে জিজ্ঞেস করে, সে উত্তর দেয় সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে সানরাইজ দেখার চেষ্টা করছিল, কতক্ষণ আর জানলার ধারে অপেক্ষা করবে তাই বিছানায় শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে জেগে থাকতে থাকতে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে সে তার মনে নেই। সায়েরি বিড়-বিড় করে বলতে থাকে রাত-মানুষরা জানলা খোলামাত্র হাওয়ায় সওয়ার হয়ে বিদায় নিয়েছে, সেলজা বিচলিত হলে সে তাকে অভয় দিয়ে জানায় যে সেই সব রাত-মানুষদের কাছে লজ্জা বা ভয়ের কিছু নেই কারণ তারা অদৃশ্য ও অন্ধ। সেলজা বলে যে সে তাদের ভয় পাচ্ছে না বরং সায়েরীর উজিয়ে ওঠা ভাঁটে বিরক্ত হচ্ছে। এর জন্যই তাকে শেষ দশ বছর ধরে আসাইলামে কাটাতে হচ্ছে তবু তার বাজে বকার স্বভাব গেল না! সেলজা মজা করে গম্ভীর মুখে বলে,”মেডিসিন সপ সামনেই হ্যায়! সুই লাগাউঁ?” সায়েরির আহ্লাদ ও অভিমান একই সাথে হয়, পাগলখানা থেকে মুক্ত সে, সঙ্গীতা আসান্থ আর প্যাঁট করে সুঁই লাগাবে না পাছায়, টিভি দেখা বন্ধ করে দেবে না সিক-রুমে ট্রান্সফার করে। সেলজাকে জড়িয়ে ধরে সে, আর একটা অযাচিত মন খারাপে হঠাৎ হুহু করে ওঠে বুক, পাহাড়ি বর্ষা বুকে নিয়ে হন্যে বাগান, সিমলা ভিলার বন্ধুদের মিঠে-কড়া ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’, ঘুলঘুলিতে বন চড়াইয়ের ফিরে ফিরে আসা, সুই নিয়ে যে ঘুমে সে পৌঁছে যেত তারাসাং-দারাসাং-এ সেই দো-সাং-এ এসে এখন সে না ঘুমিয়েই সেই পাগলখানার জন্য চোখের জল বওয়াচ্ছে! এই আকুলতাকে না বুঝেই সেলজা বলে, “রো মাত পাগলি, ইন পাহাড়ো মে কিসিকা না কোই ঠিকানা হ্যায় না মাঞ্জিল। হারওয়াক্ত বাল সাফেদ হোতে যা রাহা হ্যায় অর তু রো-রোকে ইসে বাড়ওয়া দেগা? চাল, ডাইনিং চাল, সুপার ব্রেক-ফাস্ট কারেঙ্গে।” সেলজার চোখে তখনও নগ্ন সায়েরির উন্মুখ মুখ যেন সকাতরে মিনতি করছে, ‘তোমার সুট-কেসে জামা-কাপড় রাখতে দেবে আমায়?’’ কী করবে কিছু ঠিক করতে না পেরে সেলজা সায়েরির চুল আঁচড়ে, নিজের জ্যাকেট পরিয়ে ডাইনিং-এ যায়।

ডাইনিং-এ বছর তিরিশের একটি মেয়ের সাথে বসে সাইকিয়া আলু পরোটা খাচ্ছিল। সেলজাদের দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে; গতকাল পেট্রোল ঝগড়ার জের। কি বলবে কিছু ভেবে না পেয়ে মেয়েটির সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। চন্দ্রমিতা। কলকাতা থেকে এসেছে। সেলজা হেসে বাংলায় তার সাথে কথা বলে। চন্দ্রামিতা অবাক হয়ে চিরাচরিত শব্দ-যুগলের সদব্যবহার করে, “আপনি বাঙালি!” সেলজা হেসে উত্তর দেয়, আমার মা বাঙালি ছিলেন। সাইকিয়া গপাগপ আলুর পরোটা সাঁটিয়ে, “ম্যায় চালা আপলোগ ফুরসাতসে গাপ-সাপ কিজিয়ে, চায়ে পিজিয়ে। ম্যায় আজ লেট হো গায়া” এক টেবিলে বসে চন্দ্রমিতা সেলজার দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তার সেই চাওয়া ভাল ঠেকে না সায়েরির। কতক্ষণে নদীতে যাবে সে, জোরে-জোরে পা নাড়িয়ে, শরীর সমানে দুলিয়ে, থুতু দিয়ে চকচক আওয়াজ করে অত্রাহীপনায় বিরক্ত করে সে সেলজাকে। সেলজা জানে এই অসভ্যতাগুলো সে সিমলা ভিলায় এর-ওর-তার কাছ থেকে শিখেছে, যখন প্রথম এসেছিল তখন প্রচুর শান্ত ও বাধ্য ছিল, সবচেয়ে শান্ত ও ভদ্র পেসেন্ট কিন্তু রেগে গেলেই বিপদ, তখন খিস্তির তোড়ে সবার ভুত ভাগিয়ে দিত। তবে বাঁদরামি রপ্ত করতে বেশি সময় লাগেনি, যদিও অধৈর্য্য হলেই একমাত্র সে এই বাঁদরামিগুলো করে থাকে। চন্দ্রমিতা সেলজাকে বলে যে সে তারাসাং-দারাসাং-এর লোককথা সংগ্রহ করতে এসেছে । বুজুর্গদের কাছে গল্প শুনতে গেলে তারা শুধু মৃত্যু নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে জানা গল্প পুনর্বার বলে চলে, মৃত্যু বাড়ির কর্তাকে নিতে এলো, তখন তার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে বাধা দিলে মৃত্যু হেসে বলে, ঠিক আছে ওর জান না হয় আজ বক্সে দেব কিন্তু ওর পরিবর্তে আজ কাকে নিয়ে যাবো তোমাদের মধ্যে তা তোমরাই ঠিক করো। তখন সবাই চুপ।

একে একে পরের জন্য নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে, অবশেষে ‘জানতাম’ বলে হেসে মৃত্যু বাড়ির কর্তাকেই নিয়ে যায়…অথবা এক বুড়ি জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে দিন গুজরান করতো, একদিন হোঁচট খেয়ে মাথা থেকে কাঠের বান্ডিলটা পড়ে গেলে সে বিষম রেগে সগোতক্তি করে, “হা ইশ্বর! মরণও হয় না আমার” আর ঠিক তখনই মৃত্যু তার সামনে প্রকট হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘‘তুমি আমায় ডাকছিলে?” বুড়ি তখন ভয়ে ঘাবড়ে গিয়েও চটপট উত্তর দেয়, “হ্যাঁ যমদূত। আমার এই কাঠের বোঁচকাটা পড়ে গেছে , একটু মাথায় তুলতে সাহায্য করবে?…” ইত্যাদি ইত্যাদি। দোসাং-এর খাস গল্প কেউই বলতে চায় না। মনে হয় সেসব গল্প বলার লগ্ন আছে, উপযুক্ত সময় আছে, সে সময় না হলে সে সব গল্প বলা যায় না। সেলজা হেসে সায়েরিকে দেখিয়ে বলে যে তার এই বন্ধু তারা-দারার অনেক গল্প জানে আর যেকোনো সময়ই সে সেগুলো বলতে পারে কোনো উপযুক্ত লগ্নের তোয়াক্কা না করে। ওই চোখ পাকিয়ে, থুতু চুকচুক করে দুলে দুলে পা ঝাঁকাচ্ছে যে সে যে গল্পও বলতে পারে এই কথায় চন্দ্রমিতা অবাক না হয়ে পারে না। সেলজাদের ডিম টোস্ট এসে গেছে, সাথে স্টিলের কাপে ফিল্টার কফি। খাবার দেখেই সায়েরীর সব বাঁদরামী ঘুচে যায়, প্লেটের ওপর হামলে পড়ে সে খাদ্য সুখে ডুবে যায়।

হঠাৎ করে বিকেলটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় আর্ত বাইক নিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া মেম্বারশিপ কার্ডের একটা ব্যবস্থা করতে বাইক নিয়ে ন্যাশানাল লাইব্রেরি অভিমুখে রওনা হয়। আর সেই যাত্রাতেই অ্যাক্সিডেন্টে তার মৃত্যু। অনুতাপে চুরমার চন্দ্র খালি ভাবে যে সে যদি সারপ্রাইজের নখড়া না করতো তা হলে আর্ত বিকেলে বের হতোও না, মারাও যেত না। এই তো সেদিনের ঘটনা। তারপর তারাসাং-দারাসাং। সেলজা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে, তোমার নাম কি প্রিয়াঙ্কা? চন্দ্র স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “প্রিয়াঙ্কা নয় চন্দ্রমিতা। তবে আর্ত আমায় প্রিয়দর্শিনী নামে ডাকতো, সর্টে প্রিয়া।“ “তুমি আর্ট কলেজে পড়েছো কখনও?” “না, বললাম না আমি আরজিকরে ডাক্তারি পড়তাম।” “আর বেনারস? আর্তর সাথে কখনও বেনারসে গিয়েছিলে?” “কী অদ্ভূত সব প্রশ্ন করছো তুমি! আমি আর্তর সাথে কলকাতার বাইরে কোথাও যাইনি তবে আর্ত আমাদের নিয়ে গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতো। সে গল্পে হয়তো আর্ট কলেজেও পড়েছি, বেনারসেও গিয়েছি। তবে আমার মতো নিয়তি যাদের তাদের আসার একমাত্র জায়গা এই তারাসাং-দারাসাং।

সায়েরিকে কাঙালের মত খাবারে মত্ত হতে দেখে সেলজার গত রাতের কথা মনে পড়ে, মুখের গৌণ কাজ যৌনতায় নাকি সে গৌণতা সভ্যতার বিস্মৃতিহেতু, ভয়াল ভালোবাসায় আপ্লুত সে। চন্দ্রমিতা গড়-গড় করে বলে চলে তার শোকের কথা, যে শোক ভুলতে সে লোককথার আশ্রয় নিয়েছে। সে ডাক্তারির ছাত্রী ছিল। তার প্রথম প্রেমিক ছিল তার সহপাঠী। ক্লাস কামাই করে চুটিয়ে রেস্তোঁরা, পার্ক চষে পড়াশোনা ডকে তুলে অবশেষে পরীক্ষার আগে সে এক প্রফেসরকে সিডিউস করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার আশায়। তার বাড়িতে এক রাত থাকে সে। প্রবল নেশার ঘোরে প্রফেসর রাজি হয় তাকে প্রশ্ন-পত্রের টপিকগুলো বলে দিতে কিন্তু একটা শর্তে। প্রফেসর সেগুলো পেন দিয়ে তার শরীরে ট্যাটুর মত করে লিখে দেবে। চন্দ্রমিতা রাজি হয়। লিখেও দেয় সে। সে ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেগুলো টুকে নিয়ে নেল পালিস রিমুভার দিয়ে মুছে দেবে। কিন্তু সেই কালি কোনো ভাবেই তুলতে পারেনি সে। ইর্ষায়, অপমানে ফার্মাসি থেকে মরফিন চুরি করে আত্মহত্যা করেছিল তার প্রেমিক। প্রফেসরের মতো লাল-নীল-কালো ঝর্না কলমে মরফিন পুরে নিজেকে র‍্যান্ডাম স্ট্যাব করেছিল বায়ান্নখানে। সর্বাঙ্গে রঙিন বুটি নিয়ে সে লুটিয়ে পড়েছিল চেয়ার থেকে। এরপর ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেয় চন্দ্রমিতা; পরীক্ষার সাজেশন তবু তার শরীর ছাড়ে না; আজও আছে এই এখনও, বলতে বলতে জ্যাকেট সরিয়ে বুকের দুটো বোতাম খুলে দেখায় সে। বলে, সেই প্রফেসরও দেশ ছেড়েছিল কিছুদিনের মধ্যে টিসু স্টেনিং-এর ইতিহাসের ওপর কাজ করতে। চন্দ্রমিতার বুকের বোতামের ফাঁক দিয়ে এক ঝলকে যে শব্দটা সেলজা উদ্ধার করতে পেরেছিল সেটি হচ্ছে, ‘ভেনা-কাভা’। শীতে গায়ে কাঁটা দেয় সেলজার, তার জ্যাকেটটাতো সায়েরি পরেছে, তার পরণে কোনো গরম জামা নেই। দশ বছর ধরে কাউন্সেলিং করে করে যে তার ভুবনমোহিনী হাসিতেই কাউন্সেলারের অকৃত্রিম নন-পসেসিভ ওয়ার্মথ ঝলকে ওঠে তা সে জানলে বা না জানলেও বুঝতে পারছে যে চন্দ্রমিতা এমন এক অপেক্ষায় দিন গুনছিল যা সে বা তার মত কেউ না এলে কোনো দিনই শেষ হত না। চন্দ্র বলে চলে, বাংলাতেই, এরপর সে এক বছর প্রায় বাড়ি থেকে বেরোয় না। নেটে নানা দেশের লোককথা পড়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ ছিল না। সর্বদা সর্বাঙ্গ ফুল স্লিভ ডেনিম সার্ট আর ট্র্যাক প্যান্টে ঢাকা। পরের বছর গল্পের খোঁজেই সে ন্যাশানাল লাইব্রেরি যাওয়া শুরু করে। সেখানে এক আঁকিয়ে, কবির সাথে আলাপ, আর্ত। তার সঙ্গে মনের আদান-প্রদান শুরু হয়, আবার নতুন করে প্রেম ভালোবাসা। বাইকে করে তার সাথে শহর চষে বেড়ানো। একবার বাঁকুড়া যায় চন্দ্রমিতা গল্পের কাজে। আর্তকে সারপ্রাইজ দেবে বলে সে ফেরার দিন তাকে ফোন করে বলে আজ সে ফিরতে পারছে না। হঠাৎ করে বিকেলটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় আর্ত বাইক নিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া মেম্বারশিপ কার্ডের একটা ব্যবস্থা করতে বাইক নিয়ে ন্যাশানাল লাইব্রেরি অভিমুখে রওনা হয়। আর সেই যাত্রাতেই অ্যাক্সিডেন্টে তার মৃত্যু। অনুতাপে চুরমার চন্দ্র খালি ভাবে যে সে যদি সারপ্রাইজের নখড়া না করতো তা হলে আর্ত বিকেলে বের হতোও না, মারাও যেত না। এই তো সেদিনের ঘটনা। তারপর তারাসাং-দারাসাং। সেলজা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে, তোমার নাম কি প্রিয়াঙ্কা? চন্দ্র স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “প্রিয়াঙ্কা নয় চন্দ্রমিতা। তবে আর্ত আমায় প্রিয়দর্শিনী নামে ডাকতো, সর্টে প্রিয়া।“ “তুমি আর্ট কলেজে পড়েছো কখনও?” “না, বললাম না আমি আরজিকরে ডাক্তারি পড়তাম।” “আর বেনারস? আর্তর সাথে কখনও বেনারসে গিয়েছিলে?” “কী অদ্ভূত সব প্রশ্ন করছো তুমি! আমি আর্তর সাথে কলকাতার বাইরে কোথাও যাইনি তবে আর্ত আমাদের নিয়ে গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতো। সে গল্পে হয়তো আর্ট কলেজেও পড়েছি, বেনারসেও গিয়েছি। তবে আমার মতো নিয়তি যাদের তাদের আসার একমাত্র জায়গা এই তারাসাং-দারাসাং। এ ছাড়া আমাদের গতি নেই…” দুই প্রেমিক হারিয়ে, সর্বাঙ্গে কবেকার পরীক্ষার সাজেশন নিয়ে ড্রপ-আউট চন্দ্রমিতা ডাইনিং ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে গল্পের সন্ধানে। সেলজা ধাঁধিয়ে গিয়েছে তার গল্পে। সেও চন্দ্রর মত ঘাতে কাহিল, ঘাততো ঘাতই হয় সে অন্তরঘাত হোক বা বহিরাঘাত। একের পর এক অবমাননায় অ্যাড্রিনালিনের যথাযথ ব্যবহার চায় সে, উত্তেজনার জোয়ারে মান বাজি ধরে, প্রাণ বাজি ধরে “বাঘ, তোর খাঁচা খুলে দিলুম, শুনেছি তুই নাকি মানুষ খাস!” মাথা নত করে দিনদয়াল ডাইনিং-এ বালতি আর মগ নিয়ে ঢোকে। সেলজা তাকে কাছে ডাকে। বিলম্ব করে দিনু সেলজাদের কাছে যায়। সেলজা টাকা বার করে দিনুর কাছে ভালো চরসের খোঁজ নেয়। দিনু মাথা নামিয়ে বলে ‘গুরচরণজী’। হোটেলের মালিককে দিয়ে অবশেষে চরস আনাতে হবে, এই হাঁদাটা কোনো কম্মের নয়! সেলজা দমে যায়। তখন কী সেলজা জানতো যে গুরচরণ শুধু পাঁড় চরসীই নয়, সেরা চরসের ডিলারও!

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৩)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-২)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-১)

Share