গোলাপী দৃশ্য বাংরবার (পর্ব-৭)

ধারাবাহিক উপন্যাস

।। সম্বিত বসু ।।

অবিনাশ কফি খেতে মলে গেছে অনেক দিন পর, সেই সুযোগে মাতাল সেলজা ড্রয়ার থেকে তার খাতা বার করে একটু ভেবে নিয়ে লেখে, “Mad are those who see only one side of the object in all their myriad sights; madness is a state which abounds in redundancy.” পিয়ানো খেলে যায় সেলজার মনের অলিগলিতে, কিন্তু সেই ঘর, বছরের পর বছর পেসেন্টদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতার আতুর আশ্রম, আজ নেই। ছ্যাঁক করে ওঠে বুক, একটা বাজে কান্না পায়, সেলজা-সায়েরী দুই মূর্তির এই তারাসাং-দারাসাং-এর চৌকিদারের হুইসিলে ঝালা মধ্যরাতে সিমলা স্টেট অ্যাসাইলামের জন্য মন কেমন করে; আলিঙ্গনবদ্ধ হয় তারা, সায়েরীই প্রথম কান্নায় ভেঙে পড়ায় বুঝতে পারে না যে অপর পিঠে, যে পিঠ তার নিজের সেখানে রাশভারী ব্যক্তিত্বময়ী কাউনসেলার সেলজা শুক্লার চোখেও সমান অশ্রুধারা। সেলজার এলো গায়ে সায়েরীর তপ্ত অশ্রু অচীন অনুভূতি নিয়ে আসে। অস্ফুটে সে আরামসূচক শব্দ করে, সায়েরী তাতে উৎসাহিত হয়ে তাকে আদরে আঁচড়ে ভরিয়ে দেয়। শরীরী সোহাগ যখন তুঙ্গে তখন দরজার বাইরে হোটেলের করিডোরের দিকে একটা হোঁচোট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভারি শব্দ শুনে দুজনেই সতর্ক হয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে।

And humans are no fool
Gravity happens to pull!

গোলাপী দৃশ্য বাংরবার (সপ্তম পর্ব)

ঘরে ফিরে সেলজা সটান শুয়ে পড়ে। শরীর এত গরম হয়ে গেছে যে ঘাম হচ্ছে। লেপ-কম্বল তো দূরের কথা, জামা-কাপড়ও খুলে ফেলে সে। সায়েরী ডিমের পকোড়া কিচেন থেকে টিসু পেপারে মুড়ে নিয়ে এসেছিল, পকোড়া আর টমাটো সস। সে সেলজাকে খাওয়ার জন্য সাধলে পরে সেলজা ধীরে ধীরে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধোয়, মুখে অল্প বমি নিয়েই সে শুয়ে পড়েছিল, মুখ ধুতে ভুলে গিয়ে। সেলজা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে স্নান করে। গিজারের জল তখনও ঈষদুষ্ণ। সায়েরী তখন তার জিন্স আর টপ পাট করে মনে মনে ভাবছে এত রাতে সে জেগে আছে, ওদিকে আসাইলামের ফিমেল ওয়ার্ডে এখন ঘুমের রাজত্ব, সাঞ্জী, রুবি মওসী, সর্মি, সবাই ঘুমিয়ে কাদা, জিনিয়া সিস্টারও চেয়ারে বসে ফোনে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেলজা তার পাশে এসে বসে। সেলজাও ভাবছে আসাইলামের কথা, না, সঙ্গীতা আসান্থের ওপর তার রাগ একটুও কমেনি, সে এও জানে আগামীকালই হয়তো পুলিশ এসে তাদের এই মুক্ত বিহঙ্গের উড়ান প্রয়াসে বাধ সাধবে, তখন অনেক তিক্ত কথা উঠে আসবে, কিন্তু ভয় করছে না তার, মদ-চরসের প্রভাবে না মাতঙ্গিনীর রোয়াবে নাকি উভয়েরই কিছু-কিছুতে তা বলা মুশকিল, মদ্দাকথা তার দিব্বি লাগছে, শুধু ওই সিমলা স্টেট আসাইলামের বাগান, তাপস বাগচী, জানিসার, সর্মি, সাঞ্জীদের মাশুমিয়াৎ আর এক রাশ উন্মাদনা উষ্কোখুষ্কো চুলের কোঁকড়ানীতে লুকিয়ে রেখে মিস্টার সেন্সেব্‌ল অবিনাশ সিনহা আর তার অহেতুক, অসম্ভব প্রয়াস উন্মাদনাকে বারে বারে সঙ্গায়িত করার, বারে বারে প্রচেষ্টায় বিফল হয়েও হতোদ্যম না হয়ে গাধার গোঁয়ারতুমি নিয়ে আবারও খাতার পাতায় কলম চালানো…

সেলজা সিগারেট ধরায়, সে চলে গেছে আসাইলামের মেল ওয়ার্ডের অফিসে, অবিনাশ কফি খেতে মলে গেছে অনেক দিন পর, সেই সুযোগে মাতাল সেলজা ড্রয়ার থেকে তার খাতা বার করে একটু ভেবে নিয়ে লেখে, “Mad are those who see only one side of the object in all their myriad sights; madness is a state which abounds in redundancy.” পিয়ানো খেলে যায় সেলজার মনের অলিগলিতে, কিন্তু সেই ঘর, বছরের পর বছর পেসেন্টদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপচারিতার আতুর আশ্রম, আজ নেই। ছ্যাঁক করে ওঠে বুক, একটা বাজে কান্না পায়, সেলজা-সায়েরী দুই মূর্তির এই তারাসাং-দারাসাং-এর চৌকিদারের হুইসিলে ঝালা মধ্যরাতে সিমলা স্টেট অ্যাসাইলামের জন্য মন কেমন করে; আলিঙ্গনবদ্ধ হয় তারা, সায়েরীই প্রথম কান্নায় ভেঙে পড়ায় বুঝতে পারে না যে অপর পিঠে, যে পিঠ তার নিজের সেখানে রাশভারী ব্যক্তিত্বময়ী কাউনসেলার সেলজা শুক্লার চোখেও সমান অশ্রুধারা। সেলজার এলো গায়ে সায়েরীর তপ্ত অশ্রু অচীন অনুভূতি নিয়ে আসে। অস্ফুটে সে আরামসূচক শব্দ করে, সায়েরী তাতে উৎসাহিত হয়ে তাকে আদরে আঁচড়ে ভরিয়ে দেয়। শরীরী সোহাগ যখন তুঙ্গে তখন দরজার বাইরে হোটেলের করিডোরের দিকে একটা হোঁচোট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভারি শব্দ শুনে দুজনেই সতর্ক হয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে। আদরের মেজাজ চট্‌কে যায় তাদের। অতিরিক্ত নেশায় আর চরস-মদের পাঞ্চে ঘুম এসে ফিরে গেছে সেলজার।

সায়েরী আসাইলামের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরোনো ইস্তক সুপার-এক্সাইটেড। কেউই আর শোয় না, কে এই মাঝরাতে তাদের ঘরের দরজার সামনের করিডোরে ঘুরফির নিচ্ছে? বিষয়টা ঠিক ভাল লাগে না সেলজার, সে জিন্স আর টি সার্ট চাপিয়ে নেয়। তাকে পোশাক পরতে দেখে সায়েরী জোর বায়না ধরে নদীর ধারে বেড়াতে যাবে, নদীর সাথে নিরালায় ছোটবেলার মত গপ-সপ করবে, আয়া নদী, কুলু-কুলু করতে করতে কখনও বলবে ‘আয়ে-আয়ে’ তো কখনও ‘সায়ে-সায়ে…সায়ে্‌-এরী’ বেয়াড়া আবদারে কান না দিয়ে সেলজা তাকে শুয়ে পড়তে বলে, বাইরে কোন বাদতামিজ ঘুরে বেড়াচ্ছে সে ছেড়-ছাড় করবে ভয় দেখায়, এসবে থোড়িই কিছু হবার, এত কিছুর পর দুজনেই অকুতোভয়, যাকে বলে গিয়ে বিলকুল লাপারওয়া! সায়েরী হেসে বলে, বদতামিজ নেহি, চান্দা দিদি হ্যায়। সে কি করে বুঝলো যে চন্দ্রমিতা করিডদোরের দিকের জানলার বাইরে ছিল, এ কথা জিজ্ঞেস করার আগেই সে আবার নদী যাওয়ার আবদার শুরু করে। এবার একটু বেশীই বাড়াবাড়ি করে, পা দাপিয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, “মুঝে জানা হ্যায়! জানা হ্যায় জানা হ্যায়!” পড়তি নেশায় সেলজা ঘুমের ইঞ্জেকশানের অভাব বোধ করে উদ্বেগ ও কষ্ট অনুভব করে। 

তারাসাং-দারাসাং-এর রেন্ডিবাজির ফিরিস্তি যখন তুঙ্গে তখন সেলজা আর সায়েরী অফিসে ঢুকে প্রাইভেট আড্ডা বুঝে ডাইনিং-এ যায়। সেখানে চন্দ্রামিতা বসে তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে নোকিয়া স্নেক গেম খেলছিল, গেমে সে এতটাই নিমজ্জিত যে সে তাদের প্রবেশ লক্ষ্য করে না। সেলজা আর সায়েরী কিচেন কাউন্টারে গিয়ে আলুর পরোটা অর্ডার করে জানলার ধারে একটা টেবেলে বসে। সায়েরী টেবেলে রাখা মেনু কার্ড তুলে নিয়ে সিট্রায় (সফট ড্রিঙ্ক) আঙুল দেখিয়ে করুণ মুখে আবদার করে। সেলজা বোঝে এই সুযোগ তার মৌনব্রত ভাঙানোর; একদিকে সে বলতে থাকে “তুঝে সিট্রা পিনা হ্যায়, বোল, হাঁ ইয়া না…” আর একদিকে সে ভাবতে থাকে এই  কোল্ড ড্রিঙ্কস্‌ তো কবে উঠে গেছে, এরা তাহলে সিট্রার নাম করে কি বিক্রি করছে, নাকি এই মেনু কার্ড গত বিশ বছর ধরে পালটানো হয়নি।

ঘুম থেকে উঠে সেলজার মাথা ভার, বমি-বমি ভাব; সেই স্টুডেন্ট লাইফে গোদাবরী হোস্টেলের পার্টিগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সুখ-স্মৃতি নয়, ঘাবড়িয়ে ঘেঁটে দেওয়া বেয়াড়া স্মৃতি ড্রেন পাইপ লিক করে চুঁইয়ে পড়ে। সায়েরী পোর্টেবল হিটারে জল গরম করে কফি দেয় তাকে। একটু ভালো লাগে তার। সায়েরীর হাত ধরে দ্বিধাগ্রস্ত চুমু, যে দ্বিধায় সংকোচ নেই, রয়েছে ধকলের কারণে অনিহা। সায়েরী তাকে ইশারায় কিছু বোঝাতে চেষ্টা করে, হাত-পা নেড়ে, চোখ নাচিয়ে, আঙুল বাঁকিয়ে, সেলজা বুঝতে না পেরে তাকে মুখে বলতে বললে সে মাথা নেড়ে মুখে আঙুল দিয়ে ‘চুপ’ দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয় সে মৌনী হয়েছে। সেলজা তার ন্যাকামি দেখে বিরক্ত হয়ে এক ঢোকে তলানী কফি শেষ করে বাথরুমে গিয়ে দেখে কয়েকটা গাছ বার হওয়া আলু জানলার কার্নিশে রাখা, সূতো জড়ানো তাতে, গতকাল এগুলো ছিল না, কে রাখলো, সায়েরী নয়তো দিনদয়াল, জিজ্ঞেস করে বিশষ লাভ নেই এই মুখ-বন্ধ রসিকতার সময়ে, সায়েরীর এই ধ্যাস্টামি সে  আগে দেখেছে, ফিকির-ফিকির হাসবে, ইশারায় এটা ওটা দেখাবে কিন্তু মুখ খুলবে না; আঁতে বা স্বার্থে ঘা লাগলে আবার নিজে থেকেই বকতে শুরু করবে। একদিক থেকে ভাল, আলু গাছের কচি পাতার সকালের হাওয়ায় মৃদু দুলুনী দেখতে দেখতে সেলজা বাইরের দিকে তাকাতেই দেখে উলটো দিকের বাড়ির বারান্দায় এক বয়ষ্ক মহিলা বারান্দায় জামা-কাপড় মেলতে মেলতে তার দিকে রাগী-রাগী চোখে ঠায় তাকিয়ে আছে। কী মনে করে সেলজা একটা আলু গাছ বাইরে ছুঁড়ে  দিয়ে তার চোখে চোখ রেখে হাসতেই সে চোখ সরিয়ে হন্ত-দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর বারান্দার কার্ণিশে একটা বহুদিনের পড়ে থাকা প্যান্টি ঠেলে বাইরে ফেলে আলু গাছের থেকে একটু দূরে। যেখানে অঙ্কুরিত আলু আর প্যান্টি পাশাপাশি পড়ে আছে, সেই রাস্তা দিয়ে বুজুর্গদের আসতে দেখে সেলজা বাথরুমের জানলা বন্ধ করে গিজারের জল গরম হয়েছে কিনা দেখতে কল খোলে। বাকি দুই আলু গাছ বালতির জলে চুবিয়ে আবার জানলার কার্নিশে রেখে দেয়, ‘এ নির্ঘাত সায়েরীর কম্ম’ ভাবতে ভাবতে।

জ্ঞ্যানী, ত্যাগী আর রাজীবের মধ্যে রাজীবের বয়স সবচেয়ে কম কিন্তু মাথায় পুরোপুরি টাক পড়ে যাওয়ায় তাকে সবচেয়ে বৃদ্ধ মনে হয়। হোটেলের অফিসে বসে রাজীব বাসান্ত গুরচরণের দেওয়া চরস কুটছে আর গুরচরণ কাজে বেরোতে চেয়েও বুজুর্গদের উপদ্রপে বেরোতে পারছে না। গুরচরণ প্রার্থনা করছে এরা যত শীঘ্র সম্ভব চলে যাক, তার একটা এমন দরকারী ফোন আসুক যে সে ভদ্রতার মাথা খেয়ে বেরোতে বাধ্য হয়, অসুখবিসুখ, ধান্দা-পানি, বিপদআপদ, আকাশ-পাতাল ভেবেও সে বেরোনোর একটা যুৎসই অজুহাত খাড়া করতে পারছে না, সুঢঢাদের কাটিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা এদিকে মুখে ট্যাঁ-ফো করতে না পেরে অসহ্য কিড়িমিড়ি। রোজ-রোজ সকালে এসে চরস খাবে আর নিজেদের সময় তারাসাং-দারাসাঙ্গের কী জাঁক ছিল তাই শুনিয়ে এখনকার তারা-দারার নিন্দে করবে: ‘পুরাকে পুরা তারাসাং- দারাসাং রান্ডিপাট্টি হো গায়া, হার আদমি দালাল অর হার অওরাত রান্ডি, ইহাকে সারে লোগ অর টুরিস্টভি, মু মাঙি কিমাত দেনে সে কোইভি কাপড়া উতারনেকো তেইয়ার…” জ্ঞ্যানীর আপ্তবাক্যে রাজীব সায় দেয়, বলে, “বাচ্চেলোগ আন্ধেরে মে রাস্তে পার পাথথার বিছাতে হ্যায় তাকি বুজুর্গকো চালনে মে দিক্কাত হো অর পাথথার হাটানে কে লিয়ে উনহে প্যায়সা মিলে। জ্ঞ্যানীভাই কা কাহে সেভ কি টোকরিমে জাঙলি ফাল লাল রাঙ করকে বিকা রাহা হ্যায়! ইত্না আচ্ছা পেন্টিং তো পেন্টারলোগোকোভি নাহি আতা হোগা, মেরা কাহা মানো তো ই চিটিংবাজো কা দেশমে সেভ খানা ছোড়দো বারনা লাল রাঙা জহরিলা জাঙলি ফল খাকে মারোগে অর জাহান্নাম্মে সাড়োগে!” মারোগে-র সাথে সাড়োগে মিলিয়ে তৃপ্ত হয়ে রাজীব বাসান্ত মস্তিতে সাররা দিলে পরে বাকিরা অমূল্য মালানা ক্রিম নষ্ট হচ্ছে বলে হাঁ-হাঁ করে ওঠে। গুরচরণের বলতে ইচ্ছে করে, “হাঁ, সহি কাঁহা, চারাসকে নাম চিপকালিকি টাট্টিকা সওদা হো রাহা হ্যায়, ইয়ে যো  হামলোগ পি রাহে হ্যায় চারাস মানকে! অর কাহিয়ে জ্ঞ্যানীজি আজকাল কিনকে দালালী কার রাহে হ্যায়? অ্যালবাম লায়ে কেয়া”, কিন্তু ভীত গুরু এসবের ধার-কাছ দিয়েও কিছু বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না যে তারাসাং-দারাসাং-এর সাথে তার নাতাও কিছু কম দিনের নয়, সে শুধু হেসে খবরের কাগজ থেকে জানতে পারা টুকিটাকি সুযোগ মতো কথার মাঝে গুঁজে দেয় আর চরসের অফুরান সাপ্লাই দিয়ে যায়। তারাসাং-দারাসাং-এর রেন্ডিবাজির ফিরিস্তি যখন তুঙ্গে তখন সেলজা আর সায়েরী অফিসে ঢুকে প্রাইভেট আড্ডা বুঝে ডাইনিং-এ যায়। সেখানে চন্দ্রামিতা বসে তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে নোকিয়া স্নেক গেম খেলছিল, গেমে সে এতটাই নিমজ্জিত যে সে তাদের প্রবেশ লক্ষ্য করে না। সেলজা আর সায়েরী কিচেন কাউন্টারে গিয়ে আলুর পরোটা অর্ডার করে জানলার ধারে একটা টেবেলে বসে। সায়েরী টেবেলে রাখা মেনু কার্ড তুলে নিয়ে সিট্রায় (সফট ড্রিঙ্ক) আঙুল দেখিয়ে করুণ মুখে আবদার করে। সেলজা বোঝে এই সুযোগ তার মৌনব্রত ভাঙানোর; একদিকে সে বলতে থাকে “তুঝে সিট্রা পিনা হ্যায়, বোল, হাঁ ইয়া না…” আর একদিকে সে ভাবতে থাকে এই  কোল্ড ড্রিঙ্কস্‌ তো কবে উঠে গেছে, এরা তাহলে সিট্রার নাম করে কি বিক্রি করছে, নাকি এই মেনু কার্ড গত বিশ বছর ধরে পালটানো হয়নি।

সেলজা মন দিয়ে মেনু কার্ডের কাগজ, ল্যামিনেশান দেখে তার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করে, অস্ফুটে সায়েরী বলে, “হাঁ মুঝে পিনি হ্যায়, সিট্রা সুপার কুলার” পেঁয়াজ আর মূলোর সালাড আর মিক্সড পিকল সহযোগে আলুর গরমাগরম পরোটায় মাখনের সুবাস। সেলজা সিট্রা দেখিয়ে এখানে সিট্রা পাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করলে ওয়েটার বলে, “থামসাপ, পেপ্সি, লেমন সোডা মিলেগা।” লেমন সোডা অর্ডার করতে সায়েরী বলে, “নাহি সিট্রা পিনি হ্যায়, সিট্রা সুপার কুলার” তাকে খান্ত করার জন্য সেলজা বোঝায় যে এখানে সিট্রাকেই লেমন সোডা বলে…আর থাকতে না পেরে স্নেক গেম থেকে মাথা তুলে চন্দ্রমিতা মন্তব্য করে, “সাচ আ সুইট কাপ্‌ল!” আচম্‌কা এই কথা শুনে চন্দ্রমিতার চোখে চোখ রেখে আবার চোখ সরিয়ে শিহরিত সেলজা সায়েরীর দিকে তাকায়, আলুর পরোটার কোনা ছিঁড়ে তাতে আচার মাখিয়ে তার মুখে দিয়ে আদুরে গলায় প্রশ্ন করে, “উগ্‌লা হুয়া আলু কা চারা কাব লাকে বাথরুমমে রাখখা, পাগলী কাহিকি!” চন্দ্রমিতা তার মোবাইল পকেটে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে সায়েরি-সেলজাদের পিঠে হাত রাখে, উলটো দিকের চেয়ার খালি থাকতেও তারা পাসাপাসি বসেছে, সেলজা জানলার ধারে বসেছিল, চন্দ্রমিতাকে দেখবে বলে সায়েরী তার পাসে বসে, তখনও তার মৌনতা অটুট ছিল, ‘সিট্রা’য় যা ধ্বসে গেলো। উলটো দিকের চেয়ারটা টেনে চন্দ্র বসতে যাবে সবে, কিচেনের দিক থেকে একটা হৈ-হৈ চিৎকার সাথে চাপা গোঙানি ভেসে এলো, সেলজা আর চন্দ্র ছুটলো কিচেনের দিকে, পেছন পেছন সায়েরী। কিচেনের ব্যাক ডোর খোলা, সেখান দিয়ে বেরিয়ে চৌকোনা ঊঠোনে দিনদয়াল মেঝেতে ছট্‌কাচ্ছে, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে, একজন তাকে জুতো শোঁকাচ্ছে, উঠোন পরিষ্কার করতে করতে তার মৃগীর ফিট হয়েছে। একজন চামচ দাঁতের পাটির মাঝখানে ধরে আছে, আরেকজন একটা ছেঁড়া বেল্ট নিয়ে এলে সেটা মুখে গুঁজে দেয়; চামড়ার ওপর গ্যাঁজলা সাবানের ফ্যনার মত জমতে থাকে। জ্ঞানী, রাজীব, তেয়াগী, গুরু, সকলে ছুটে এসেছে, সোরগোল শুনে চরস খেয়ে গজল্লা তাদের মাথায় উঠেছে। এই সুযোগে বাথরুম যাওয়ার নাম করে সায়েরী কিচেনে গিয়ে দিনুর ব্যাগ থেকে খুলিটা বার করে থুতু দেয়, নিজেই সেই থুতু মাখিয়ে দিয়ে কাউন্টারে খুচরোর বাটি হাতড়াতে গেলে পরে পায়ের শব্দ শুনে ঝটকায় সেখান থেকে চলে আসে। একটা বাচ্চা নেপালী ছেলে টেবেলে রাখা খুলিটা থলিতে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে “ইঁহা কায়কো আয়ে হো? ভাগো, ভাগো ইঁহাসে!” ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকে গিয়ে দ্রুত পায়ে সায়েরী হিলের শব্দ তুলে সেলজাদের টেবেলের দিকে যেতে যেতে শুনতে পায়, ছেলেটা বলেই চলেছে, “ভাগো ইঁহাসে, তারাসাং-দারাসাংসে!”

ওদিকে দিনদয়ালের জ্ঞ্যান ফিরেছে, দুধ খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। গুরচরন তাকে বলছে কাজ-টাজ বন্ধ রেখে কদিন হোটেলেই রেস্ট নিতে, জ্ঞ্যানী তার বাড়ির লোককে অভিসম্পাত করে বলছে এরকম ঘরওয়ালা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো, ছেলে যত পাগোলই হোক না কেন বাড়ির ছেলে তো। ত্যাগী তখন মনে করিয়ে দেয়, কেমন করে দিনুর নানি চালের বালতি থেকে চাল নিতে গিয়ে ভোর রাতে সেখানে করোটি দেখে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছিল, সেই থেকে বাড়ির দরজা দিনুর জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ত্যাগীর কথায় সায় দিয়ে রাজীব বলে যে সে জ্ঞানীর কথায় একমত হতে পারলো না, বাড়ির প্রতি দিনুর ছিটেফোঁটাও টান নেই, এখনও রাস্তায় বাবা চাচাদের দেখলে সে চিনতে পারে না, বাড়িতে থাকতে মা-কে শান্তাবাই বলে সম্বোধন করতো, মা তার মুখে ‘মা’ ডাক শোনার জন্য কত তর্সাতো তা বলতে না বলতেই দিনু উঠে পড়ে নিজের থলি নিয়ে প্রস্থান করে। গুরুচরণ নেপালী ছেলেটাকে বলে “ইয়ে কাম্বাখত লওটকে আনে সে লাথ মারকে ভাগা দেনা, মেরে ইঁহা ইন জ্যায়সে অফসাগুনোকে লিয়ে কোই জাগা নাহি।” দিনু হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে আসে। হাত, পা, মুখ ধোয়, গাছতলায় খুলি সাজিয়ে বসে সে নদীর ওপারে কুয়াশায় ঢাকা চীনের পাহাড়গুলোর দিকে ঠায় তাকিয়ে কুম্ভমেলার স্বপ্ন দেখে। এরপর দু সপ্তাহ তাকে কেউ কোথাও দেখতে পায় না। আগাছার লতা-পাতায়, উল্লম্ব, উলঙ্গ মনবাঞ্ছাতে সে মিনারের চৌকাঠ আগলে বসে থাকে মৃতদের প্রত্যাবর্তনের আশায়, বন্য, অনন্য এক ব্যক্তিগত দিনদয়ালী যে আশা।

প্রচ্ছদের ছবি- রাম কুমার

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৬)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৫)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৪)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৩)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-২)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-১)

Share