গামছা চরিতকথা (প্রথম পর্ব)

।। শফিকুল কবীর চন্দন ।।

বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’র সুহৃদ হিসাবে একসাথে পথ চলার অঙ্গিকার করেছে বড় বাংলার কারিগরী জ্ঞান ও শিল্প চর্চার পত্রিকা ‘পরম’। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পরম’-এর ৩৪-তম মুদ্রিত সংখ্যার এবারের বিষয় গামছা। যার আমন্ত্রিত সম্পাদক বাংলাদেশের শিল্পী/ গবেষক শফিকুল কবীর চন্দন। তাঁর গামছা চরিতকথা শিরোনামে ‘পরম’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ গবেষণাধর্মী গদ্যটি ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’র কারুকলা বিভাগে প্রকাশিত হচ্ছে।

গৌ র চ ন্দ্রি কা  বা  গা ম ছা চ ন্দ্রি কা

ভায়রাও একটা কুটুম
গামছাও একটা কাপড়

নিছক কথার কথা হলেও গামছার একশো একটা গুণের কথার পাশাপাশি এমন সামাজিক তাচ্ছিল্য বচন ও আছে। তবে তা সংখ্যায় খুব বেশি নয় মোটেও। বাঙলার যত বস্ত্র আছে তার মধ্যে গামছার জন্য এই অনাদর বরাদ্দ কেন? কে না জানে বাঙলার আপামর গরিষ্ঠদের গণ স্কন্ধে, মস্তকে, কোমরে, খোঁপায়, গলায় আজও যে বস্ত্রখণ্ড অবলীলায় শোভা পায় তার নাম গামছা। গামছা কেবল গা মোছায় নয়, জবজবে ঘাম, ক্লান্তি মুছে যায় যেন নিমিষে একখন্ড সুতি বস্ত্রের সংস্পর্শে! জাদু আছে বলতে হয় এই বস্ত্রখণ্ডের। গামছাকে যারা মূলত অষ্টপ্রহর বাহারি কর্ম সম্পাদনের দায় সমর্পণ করে হাজার বছর নিশ্চিত, তাঁদের মর্যাদার সাথে সামাজিক শ্রেণী রাজনীতির সম্পর্কের চক্কর তবে?

আমাগো জোতজিরেতে চাষের ফসল
ধানের গোলা
আমরার তাঁতের কাপড়, গলায় গায়ে
গামছা ভূষণ।

আমার সাথেই বা কেমন কুটুম সম্পর্ক? কোন এক বালকবেলায় দেখা, কৃষি পরিবারের ভিতরবাড়িতে বৌ- ঝিদের, উঠোনে কৃষি-জনদের ডজন ডজন বাহারি গামছার রোদ পোহানোর উড়ান দৃশ্যদিনের `স্মৃতির কুটুম`! এদের আঁতুরঘর বাঙলার নানা গ্রাম মফস্বলের অজ্ঞাত গামছা কারিগরের উষ্ণ তাঁত নরোজ থেকে সোজা বিলাতে সেসব সৃজন গাঁয়ের বাসনা মাখা আমাদের প্রাণের গ্রাম সম্পর্কের কুটুম। যাঁদের সৌজন্যে তারা সহস্র সহস্র মাইল পাড়ি দিয়েছে, তোড়ঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে তাঁরাও আমাদের প্রাণের স্বজন। গা মোছা, মুখ মোছার দায়িত্ব ডিঙিয়ে মাথার ঘাম পায়ে পড়া শুষে নেয়া গামছা কুটুমরা কেমন আছে বিলাতে? হর হামেশা তাদের সাক্ষাৎ মিলে না। তাঁতবাড়ির সুতা, রঙ, টানা হাটা, মাড় শুকানোতে যেমন সাবধানে রোদ মাখে গামছারা, তেমনি বিলাত বাড়ির আঙিনায় বিরল রোদ সাক্ষাৎদিন হয়ে ওঠেছিল `গামছাওরস` দিবস!

জগতের একমাত্র বস্ত্র খন্ড, অসংখ্য বিরল বাহারি দায়িত্ব ও রঙ নকশার দুনিয়াদারি কায়েম করে রেখেছে, যার সমকক্ষ দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই! আমার বয়ন কর্মশালায় টানা পোড়েন সঙ্গতে উজ্বল গামছা অতিথিরা বাঙলার আটপৌরে বর্ণ, গন্ধ, স্মৃতি ও বস্ত্র কারিগরি পরম্পরা নিয়ে জায়মান থাকে।

কোন ঘাটে সান করলি রে কানাইয়া
গামছা কোথায় হারালি?
হাঁটুজলে হারালি গামছা, কমর জলে তোকালি।

বাঙালির গামছা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ একটি সবিস্তার আলোচনা সংকলনের অভাববোধ থেকেই মূলত এ রচনা সৃষ্টির উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। বাঙলার বাইরে পাশ্চাত্যের কোন ভূখণ্ডে বাস করে এমন প্রসঙ্গে কাজ করার মূল ঝক্কি উপাত্ত। তার জন্য বই পুস্তক প্রকাশনার যে সহজলভ্যতা তা বলতে গেলে এখানে প্রায় শূন্যে। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র  সংগ্রহই সেখানে নিয়ামক হয়েছে। নেট মহাফেজখানা খুব সহায়ক না হলেও একেবারে নিরাশ করেনি। তবে বাঙলাভাষায় রচিত নানা বইপত্রে এই বিষয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত তথ্য উপাত্ত দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহের ফলে আপাতত রচনাটি এই অবয়বে থিতু হতে পারল।

এখানে লিপিবদ্ধ হওয়া বহুজনের বহু অনুসন্ধান ও মতামতের ফল যদ্দুর সম্ভব যথাযথ তথ্য নির্দেশ সহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন পূর্বক ধন্যবাদ জানাই। একথা অনস্বীকার্য যে, এ বিষয়ে আরও বিশদ ও পরিপুষ্টতা প্রদানের জন্য আমার যথাযথ উদ্যোগ জারি থাকলেও আপাতত এখানেই বিরতি দেয়া গেল। মূলত অধ্যয়নলব্দ ও জ্ঞাত তথ্যাবলী এই রচনার ভরকেন্দ্রে থেকে বিস্তারিত হয়েছে। পরবর্তীতে বাড়ান্তরে এ বিষয়ে আলোচনা সন্নিবেশিত করার সুযোগ যে রহিত হয়নি এই আশার কথাও জানিয়ে রাখা গেল।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে খোজাখুঁজি করে নেট থেকে মূলত প্রাপ্ত ছবির যথাযথ সূত্র নির্দেশ হয়তো করা গেলো না! এমনকি অনুমতি নেবার প্রতিবন্ধকতাও অতিক্রম করতে না পারার পুরো দায় আমার। যদিও নেট থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু ছবির মূল উৎস সন্ধানে নিশ্চিত হওয়া বহু প্রক্রিয়া অবলম্বন করেও যে বিফল সে কথাও উহ্য রাখা সমীচীন বোধ হলো না। এ ক্ষেত্রে লজ্জার প্রকটতা প্রশমনে সংশ্লিষ্টদের কাছে মার্জনার দাবি রাখছি।

অতিসম্প্রতি সামাজিক সংযোগ মাধ্যমে উপরোক্ত কথা ব্যক্ত করলে অনেকের সাথেই কথা হয় গামছা বিষয়ে। কলকাতা থেকে কারিগর শিল্পতাত্বিক, গবেষক, সংগঠক বিশ্বেন্দু নন্দ নবপর্যায়ে ‘পরম’ প্রকাশনার শুরুতেই প্রধান রচনা হিসাবে গামছা বিষয়ে হাত খুলে লিখতে প্রণোদিত করেন, বলা ভালো ত্বরিৎ রচনাকল্পে তিনি মদদদাতার ভূমিকায়। অনেকদিন ধরেই ফেলে রাখা এ বিষয়ে কিছু অগোছালো লেখাপত্র গোছাতে গিয়ে আরেকটু খোঁজ খবর করতেই মনে হলো বিলেতে বসে খুব বেশি কিছু উপাত্ত সংগ্রহ ও জুড়ে দেয়া সহজ কর্ম নয়! বিগত বছরগুলোতে আতিপাতি খোঁজাখুঁজি করে যা গাঁথা গেল তা এই `গামছাকথনে`আশ্রয় পেয়েছে। ইতিবৃত্তে গামছা যথেষ্টই রঙ্গীন তার বাহারি সুতোর মতোই। এই রচনাটি একটি পুস্তিকা অবয়বে প্রকাশিত হবে সে লক্ষ্যেই ‘প্রায় নির্মিত’ হয়েছে এই মুসাবিদা। তবে পরম তাঁর প্রকাশনার কলেবর বিবেচনা করে যতটুকু সম্ভব সংকলিত করবে।

আমার বিরামহীন গামছা টোকানিতে অনাগ্রহ নেই কোন! নেই গামছা বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহেরও। ফলে খোলা আহবান থাকলো পাঠকদের কাছে। লক্ষ্যণীয়, গামছা বিষয়ে কেন কোন গবেষণা চোখে পড়লোনা; সে এক বিস্ময় বটে! আপাতত এই নাতিদীর্ঘ রচনা সে খরা কিছুটা হলেও প্রশমিত করবে আশাকরি। লোকায়ত কারিগরি শিল্পচিহ্ন বাঙলার তাঁত বয়ন ঐতিহ্যের গামছা নিয়ে বৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ রচিত হবে এই আকালেও এমন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জারি রাখতে চাই।

এই গ্রন্থখানি একেবারেই কারিগরি মস্তিষ্কে ‘হাতে গড়া’। সুহৃদ পাঠক, আপনার পাঠ নিমিত্তে এবার রচনা দাখিল করিতে মনস্থ করিলাম।

গামছা চরিতকথা এইরূপে হইলো তৈয়ার
শফিকুল কবীর চন্দন এর রচনাকার।।
জন্ম আদিডাহার ডিস্টিক সাং সৈয়দপুর
গামছা আখ্যান হইল এই রচনার সুর।।
বিলাতে নিবাস মোর লাফবরোতে ঘর
তাঁতে বয়নচিত্র বুনি নামে বুনকর।।
দেশেরবাড়ির সন্নিকটেই নরসিংদী শহর
পিতা ছিলেন ছাত্রদের গণিত স্যার কবির মাস্টর।
পূর্বপুরুষের বসত আছিল গেরামে বিলকুল
গামছার কথা কইতে হেন হইলাম আকুল।।
ধীরলয়ে গামছা বস্ত্রনামা রচিতে ছিল  
বিশ্বেন্দু নন্দ’র মদদে তাহা ত্বরিৎ হইল।।
এই রচনা ছাপিল যেই কারিগর জ্ঞাতিজন
প্রকাশক ‘পরম’ সকলেই জ্ঞাত হন।।
সকলকে শুভেচ্ছা আমার সবাইকে সেলাম
জ্ঞাতি অজ্ঞাতি স্বজন শুভার্থী তামাম।।
এক্ষণে রচনাকার কহে শুনেন বন্ধু জন
পাঠক করকমলে গামছা চরিতকথা করি নিবেদন।।

আরজ গুজার –

সন চৌদ্দশ সাতাইশ বঙ্গাব্দের দশ পৌষ রবিবারে দ্বিপ্রাহরিক বেলা এই মুসাবিদা সম্পূর্ণকরত পুণ্য-পঠনার্থ প্রকাশকল্পে দাখিল হইল। 

গামছা মূলত তাঁতশিল্প পণ্যের একটি। তবে শুধু গ্রাম বাঙলার তাঁতীরাই নয় বাঙ্গালী মণিপুরি সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো ইত্যাদি উপজাঁতি জনগোষ্ঠীর দক্ষতা জ্ঞান কল্পনার রঙ ও মনের মাধুরী দিয়ে হাতে বোনে তৈরী করে এই শিল্পপণ্যটি। এই বস্ত্রটির টানা পোড়েনে, ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে এক একটি জনপদের মানুষের সহস্র বছরের সঞ্চিত আবেগ, দক্ষতা, স্মৃতি ও ঐতিহ্য ও জ্ঞান পরম্পরা। এগুলো কেবলই সুতোর পরে সুতো দিয়ে বোনা কোন যেন তেন পণ্য নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে পরম মমতা ও ভালবাসার এক একটি উজ্বল স্মারক।

গামছামঙ্গল

সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী নাকি একবার গামছা পরে জল তুলছিলেন এমন সময় এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ‘আপনি এত বড় বংশের ছেলে, আপনার বাবা এত বড় লোক, আপনি কিনা একটা গামছা পরে এভাবে জল তুলছেন?’

শিবরাম বললেন, `বাপ্ তুললেন, বংশ তুললেন, তাতেও হল না শেষে গামছা তুলে অপমান করলেন’?

গামছাকে কথায় তুলে আনার প্রারম্ভে যে কথা দিয়ে শুরু হলো, তার বাইরে বাড়ান্তরে নানাবিধ কথা আসবে। কথার পিঠে ও কথা আসবে গামছা কে ঘিরে। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক সকল যুগের কথায়ই গামছার প্রসঙ্গ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত গ্রামীণ জনজীবন জুড়ে মানুষের যে জীবনাচার তার কথা, কাব্যে, গানে, গল্পে, ধাঁধা, প্রবচনে সর্বত্রই গামছা তার মহিমা নিয়ে উচ্চকিত! গামছার মহিমার কথাই বেশি, তবে কথা আছে গামছার অপব্যবহার নিয়েও। এমনই গামছার গুণ!

যেই জন জানিবারে করে অভিলাষ
তাহার সৃজনপ্রাণে সপিলাম গামছা বিলাস।।
গামছা বাখান পড়িলে না আছে কোন বর
যে, যা বস্ত্র বাসনা করিবে পুরিবে সত্বর।।
গামছা বস্ত্রের অধিক জানে কোন জন
আয়োজনে প্রয়োজনে যে রাখে সর্বক্ষণ।।
নামেতে কাপড় ক্ষুদ্র কোন সে বস্ত্র
কাপড় মাত্র হয়েও যা বিরাজিত সর্বত্র।।
বস্ত্রের অধিক হয় জানিও গামছাখানি
ঘর বাহির সর্বত্র যার কাছে ঋণী।।
গামছা সঙ্গতে যাপন করে যেই জন
বাঙলা অন্তঃপ্রাণ তাঁর গামছা ভূষণ।।

গামছা বাখান

আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা
আমার বাপের নাম কে না জানে, চাষা-মালকোঁচা
আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত নিম্নজনা

গামছা একখন্ড কাপড় বিশেষ। সুতি সুতায় তৈরী রঙবাহারি বস্ত্রখণ্ড। গ্রামীণ তন্তুবায় কর্তৃক প্রস্তুত হয়। যাঁরা এই কাপড় বোনেন তারা পেশাগত কাজ হিসাবে বহুল প্রশংসিত নন! গামছা এমনকি বস্ত্র হলেও তাকে ঠিক কাপড় না বলারই যেন রেওয়াজ। যেমন কথায় আছে, ‘গামছাও একটা কাপড় আর ভায়রাও একটা কুটুম’। গামছা বয়নকারীরা বয়ন কারিগরদের মধ্যে মর্যাদায় ও নিচের দিকে!

পৃথিবীতে এই একমাত্র বস্ত্রখণ্ড বোধকরি বয়নের পর তার আর ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠতে কোন প্রকার প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। নেই কোন দর্জির সেলাইকলের কিংবা কাঁচির তলে যাওয়ার। অর্থাৎ কাঁটছাঁট বা সেলাইয়ের প্রয়োজন নেই। চটজলদি ব্যবহার উপযোগিতা নিয়েই তার জন্ম হয়। রঙে, নকশায় ব্যক্তি ভেদে তার কোন বৈপরীত্য ও নেই। অর্থাৎ নারী পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ নারী পুরুষ উভয়েরই যে কোন রঙের, নকশার গামছাই ব্যবহার উপযোগী।

এমন একটি উদার গণতান্ত্রিক বস্ত্রখণ্ড সারা দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! যা কিনা ব্যবহৃত হয় অসংখ্যভাবে, বহু উছিলায়। অগুনতি যার ব্যবহারবিধি ও বৈচিত্র।কবে, কখন, কোন তাঁতি গামছা বুনেছিল তার যেমন কোন দিন তারিখ, নাম ধাম কিছুই তথ্য নেই তেমনি তথ্য নেই ঠিক কবে এই গামছার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। কোথায় শুরু হয়েছিল? ধারণা করা সঙ্গত যে, বাঙলায় গামছার ব্যবহার ততটাই পুরোনো, যতটা পুরোনো বাঙলার বস্ত্র ঐতিহ্যের। শুরুতে এতো রঙ নকশা ছিল কি? হয়তো না। অন্যান্য তাঁত বস্ত্রের বেলায় যেমনটা, তেমনই রঙ জৌলুসহীন হয়তো ছিল গামছাও। ক্রমেই রঙের সহজ লভ্যতা গামছাকেও করেছে বর্ণিল।

কেন এর নামকরণ হলো গামছা? সহজ উত্তর, গা বা দেহ মোছা হয় বা যায় যে বস্ত্রে তার নাম ‘গামছা’। ঢাকাই মসলিন গ্রন্থে লেখক আবদুল করিম জানিয়েছেন, “গা মোছা থেকেই গামছা শব্দের উৎপত্তি। হাত, মুখ বা শরীর ধোওয়ার পর গা মোছার জন্য অর্থাৎ বর্তমান কালের তোয়ালে রূপে গামছা ব্যবহৃত হত। বর্তমান কালেও গামছার প্রচলন আছে। এর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ গজ এবং চওড়া ৪.৩ থেকে ১.৫ গজ পর্যন্ত ছিল। সাধারণ লোকের টুপী এবং জামা, বিশেষ করে ছেলে মেয়েদের জামা তৈরির জন্য গামছা ব্যবহৃত হত।” ৩

 (আবদুল করিম উল্লেখিত গামছার মাপে মনে হয় একটা গরমিল হয়ে গেছে, ফুটের কিংবা হাতের হিসাবে নিলেও যথাযথ হয় বলে মনে হয় না)।

গোটা সমগ্র বাঙলায় গামছা নামেই এই বস্ত্রের পরিচিতি। তবে ব্যবহার ভেদে বাঙলার অধিবাসীদের কারো কারো মধ্যে এর ব্যবহারের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অঞ্চল, জাতি ভেদে গামছার নামেও আছে ভিন্নতা। গামছাই হয়ে ওঠে অন্যত্র গামোছা, গামচা, আঙ্গছা আবার প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে গাত্রমুঞ্চন, গাত্রমার্জনী ইত্যাদি। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে আছে কাছলা, তঙ্গালী গামছা, খাড়ু গামছা, সেঁওয়ালি গামছা, উড়ান গামছা, সামষলী গামছা ও সাঙালি গামছা।    

গামছা মূলত তাঁতশিল্প পণ্যের একটি। তবে শুধু গ্রাম বাঙলার তাঁতীরাই নয় বাঙ্গালী মণিপুরি সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো ইত্যাদি উপজাঁতি জনগোষ্ঠীর দক্ষতা জ্ঞান কল্পনার রঙ ও মনের মাধুরী দিয়ে হাতে বোনে তৈরী করে এই শিল্পপণ্যটি। এই বস্ত্রটির টানা পোড়েনে, ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে এক একটি জনপদের মানুষের সহস্র বছরের সঞ্চিত আবেগ, দক্ষতা, স্মৃতি ও ঐতিহ্য ও জ্ঞান পরম্পরা। এগুলো কেবলই সুতোর পরে সুতো দিয়ে বোনা কোন যেন তেন পণ্য নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে পরম মমতা ও ভালবাসার এক একটি উজ্বল স্মারক।

তাঁতে বোনা বস্ত্র যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতির তুলনায় আয়তনে ছোট বস্ত্রটিই গামছা। যা আকারে টুকরো কাপড়ের মতো। গামছা নানা রকম বর্ণীল রঙ্গে বোনা হয়। অধিকাংশ গামছাতেই দেখা যায় চেকের ব্যবহার। গামছা সাধারণত উজ্বল রঙ তথা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি রঙের হয়। ঠিক কবে থেকে এই গামছার ব্যাবহার শুরু হয়েছিলো তা জানা নেই, তবে ধারণা করা হয় এই অঞ্চলে মানুষ যখন থেকে কাপড় বুনতে ও ব্যবহার করতে শুরু করেছে হয়তো তখন থেকেই গামছার ব্যবহার ও শুরু হয়ে থাকবে।

গা মোছার বস্ত্রটি তার গুনের দৌলতে সর্বব্যাপী এক কাজের কাজী হয়ে ওঠেছে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই গামছা হয়ে ওঠেছে `হাজার কাজের কাজী`বা `সকল কাজের কাজী`! ব্যবহারভেদে গামছা সাধারণত তিনটি আকারের হয়। ছোট, মাঝারি ও বড়। হাতের মাপে এই দৈর্ঘ্য প্রস্থের মধ্যে একেক অঞ্চলের গামছার একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

কেন এর নামকরণ হলো গামছা? সহজ উত্তর, গা বা দেহ মোছা হয় বা যায় যে বস্ত্রে তার নাম ‘গামছা’। ঢাকাই মসলিন গ্রন্থে লেখক আবদুল করিম জানিয়েছেন, “গা মোছা থেকেই গামছা শব্দের উৎপত্তি। হাত, মুখ বা শরীর ধোওয়ার পর গা মোছার জন্য অর্থাৎ বর্তমান কালের তোয়ালে রূপে গামছা ব্যবহৃত হত। বর্তমান কালেও গামছার প্রচলন আছে। এর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ গজ এবং চওড়া ৪.৩ থেকে ১.৫ গজ পর্যন্ত ছিল। সাধারণ লোকের টুপী এবং জামা, বিশেষ করে ছেলে মেয়েদের জামা তৈরির জন্য গামছা ব্যবহৃত হত।”

এককথায় বলতে গেলে গামছা হলো গিয়ে অলরাউন্ডার। এক্কেবারে যথার্থ মাল্টিটাস্কার। গা মোছে বলে তার নাম গামছা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর কাজের হিসাব নিকাশএত সহজ নয় মোটেও। বাঙালির জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ পর্যন্ত সর্বত্রগামী এই গামছা, বলা ভালো সব কিছুতেই স্বমহিমায় বিরাজমান। ছোট ছেলে মেয়েদের গামছা দিয়ে কুঁচো মাছ ধরা কিংবা মুটের মাথায় গামছার বিঁড়ে। মোটকথা আমরা যেমনই গুরুত্ব দেই না কেন, গামছা ছাড়া কিন্তু বাঙালির জীবন অচল।

ছেলেবেলায় যৎকিঞ্চিৎ ছড়া কবিতা যারা পড়েছেন তারা অবশ্যই মনে করতে পারবেন রবি ঠাকুরের লেখা `আমাদের ছোট নদী`। সেই যে নাইবার কালে গামছায় জল ভরে হুটোপুটি করা আর তার আঁচলায় খেও দিয়ে ছোট মাছ ধরার কসরতের কথা!

শুধু প্রাত্যহিক জীবনের সাথে যুক্ত এই নাতিদৈর্ঘ্যের এই গামছাবস্ত্র বাংলা সাহিত্যে ও তো নিজের স্থান করে নিয়েছে বহু আগেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর কবিতায় এই গামছা কে অপাঙক্তেয় করে রাখেন নি। কবিতায় লিখেছেন-

তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

…………………………………………………………..

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।

বাঙালীর জীবনে গামছার তাৎপর্য কতটুকু, সেটা এককথায় প্রকাশ করতে হলে একটিই যুৎসই শব্দে উত্তর দেয়া যায় আর তা হলো, অপরিসীম। এই অপরিসীম তাৎপর্যের বস্তুটির ব্যবহার্য্যতার পরিধিতে একটু নজর দেয়া যাক। গাঁয়ে কোন শ্রমজীবীর গামছা ছাড়া একটি সুন্দর সার্থক জীবন ভাবাই যায় না। স্নান করতে গামছা, গা মুছতে গামছা, তিন বেলা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে মুছতে গামছা, গরমে হাতপাখাটা কাছে নেই, একটু গা টা জুড়িয়ে নিতে হাওয়া করতে গামছা,ঘামে গা ভিজে গেছে, গায়ের জামা খুলেই গা টা মুছতে হবে, চাই গামছা, গায়ে এসে বসছে মশা মাছি, ঘরে লোডশেডিং, গামছা টা কোথায় মুখ থেকে এই কথাটাই বেরিয়েই আসে সহজে? গামছার হাওয়া দিয়েই মশা মাছির সাথে লড়াই, কোথাও বেড়াতে যেতে হলে খোঁজ গামছাটা নেয়া হয়েছে তো ব্যাগে? বাড়ীতে পুজোর ঠাকুর মশাই এসেছেন, পুজোর ফর্দ তৈরী হয়েছে তাতে ও আছে গামছা। গামছার আছে নানাবিধ ব্যবহার। পথচলতি ক্লান্ত মানুষটি তাঁর নিত্যসঙ্গী গামছাটি পেতেই গাছের ছায়ায় শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নেন। রোদ থেকে বাঁচতেও মাথায় গামছার আড়াল নেওয়া হয়। সেই গামছা যেমন ঘটাচ্ছাদনের তেমনি আবার পুরোহিত সম্মানী। ছানার জল ঝরানো থেকে জিনিসপত্র বা খাদ্যসামগ্রী বেঁধে নিয়ে যাওয়া, বিবাহ অনুষ্ঠান বা দেবতার পুজো, গামছা লাগে সর্বত্র।


লাল-সবুজ চেকচেক, অনেক গামছা
হ্যাঁ গামছাই বটে।
কত কাজে লাগে, পুজোর ঘটের উপর,
শ্মশান যাত্রীর কোমরে বা কাঁধে।

গামছা, লাল সবুজ চেকচেক।
মুখটা মুছিয়ে দিতে সবুজ রঙ,
চোখের কোনায়, গালে ঠোঁটে:
বড্ড কাঁচা রঙ চট করে লেগে যায়।
নার্স দিদিমনির মুখ ঝামটা,
একটু ধুয়ে আনতে পারেননি।

গামছা নয়, হাতের আঙুল দিয়ে
আলতো করে মুখ মোছায় মেয়েটা।
সেই মুখ, কত আদর চুম্বন।
চোখ দুটো বড় অসহায় লাগছে আজ।
কত কিছু বলতে চায়, ঠোঁট আর মন
কিছুতেই এক হয় না।

মনের কথা হারিয়ে যায় ঠোঁটে এসে।
শোনো-ও-ও-ও। আমি অত শক্ত নই।
তোমার তিলে তিলে চলে যাওয়াটা,
দেখার জন্য।
ডুকরে কেঁদে ওঠে মেয়েটা।
অসহায় চোখ দুটো কড়া শাসন করে।
বলে, চোখ থেকে জল কেন?
সামলে যায় মেয়েটা।

শক্ত হাত শিথিল হয়ে আসে।
রেডিয়েশনের কালো ছাপ দাগ ফেলে যায়।
সকাল থেকে রাত। এক করে ফেলে মেয়েটা।
তুমি ফিরবেনা জেনেও করে।
অত শক্ত নয় মেয়েটা। কেন শক্ত করছো তাকে?

এত ভালোবাসে নাকি কেউ
চলে গেলে কোথায় খুঁজবো তোমায়?
লাল-সবুজ চেকচেক গামছা দিয়ে
আর রঙ বেরোয় না।
উনত্রিশ দিন হয়ে গেল।
প্রদীপের তেল শেষ হয়ে আসছে।
দুহাতে শিখা প্রাণপণে সামলায় মেয়েটা।
ভোর রাতে নিভলো প্রদীপ।

সকাল হলো। সবাই এলো।
মেয়েটাকে কেউ কাঁদতে দেখল না।
সব কাজ সাঙ্গ হল।
ঘর ফাঁকা বিছানা ফাঁকা, জামাকাপড়  
জুতো, চশমা, আর লাল-সবুজে চেকচেক গামছা।

অনেকগুলো বছর পরে।
আলমারির দামী দামী শাড়ী জামার মাঝে,
লুকানো সেই লাল-সবুজ চেকচেক গামছা।
মেয়েটা তার ছোট্ট ছেলেটাকে ডেকে বলে-
দেখ, আমি যখন চলে যাব, এটা আমার সঙ্গে দিস।
রঙ আর উঠবে না। এ রঙ বড় গাঢ়।  
বাবার সাথে মেয়ের আত্মার মিলনের রঙ।
সাথে লাল-সবুজে চেকচেক গামছা।

গামছা আমাদের মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অব্দি মুছে দেয়। আপাদমস্তক সকল অঙ্গের পরিচর্যা করে নিয়মিত। আমাদের যাপন জুড়ে জড়িয়ে থাকে নানা ভূমিকায়। কিন্তু পোশাক উপহারের তালিকায় তার নাম থাকতে নেই। বস্ত্র আলমারিতে বা আলনায় তার ঠাঁই হয় অনাদরে, অবহেলায়, তাচ্ছিল্যে, ঔদাসীন্যে। পরিচ্ছদ একাধিক থাকলেও বাঙালির জনপ্রতি গামছা কিন্তু একটাই! একা গামছা এক হাতেই সব সামলায়।

বঙ্গে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে পশ্চিমা পাদ্রীদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো বাংলা ভাষার বাইবেলের, যাতে করে তৎকালীন বাংলার স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষদেরকে বাইবেলের বাণী পৌঁছে দেয়া যায়। তাতে যেমন সহজ বাংলার ব্যবহার তেমনি যীশুকে যে বস্ত্র খণ্ড ব্যবহার করতে বর্ণনায় আছে তা বাংলায় গামছা হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে। কারণ গামছা তখনকার প্রায় আদুলগা গণমানুষের অতি ব্যবহার্য্য বস্ত্র হিসাবে গামছাকে গ্রহণ করা হয়েছে।

“৩. এবং আমি ঈশ্বরের নিকট হইতে আসিয়াছিলেন, ও ঈশ্বরের নিকটে পুনরায় যাইতেছেন।

৪. য়িশু ইহাই জানিয়ে রাত্রি ভোজন হইতে উঠিয়া আপন বস্ত্র খসাইয়া রাখিয়া একটা গামছা লইয়া আপন শরীরে জড়াইয়া দিলেন।

৫. তত:পরে একটা ডাবরে জল ঢালিয়া শিষ্যেরদের পা সকল ধুইতে লাগিলেন, এবং যে গামছা আপন শরীরে জড়াইয়াছিলেন, তাহা দিয়া মোছাইতে লাগিলেন”।

“ছোটবেলায় দু’টো জিনিসে বেশ আগ্রহ ছিল। বাঁদিপোতার গামছা আর মোল্লার চকের দই। ঠিক ছোটবেলায় নয়, একটু বড় ছোটবেলায়। মানে বুঝবেলায়। গামছা নিয়ে আগ্রহটা কমে গিয়েছে। জীবনভর নানা ছাঁদের গামছা দেখেছি। বাড়ির গামছা ট্রেনের গামছা। মামার বাড়ির গামছা। আমার মামার বাড়ি বর্ধমান জেলায়। জায়গাটা অবশ্য একেবারেই নদিয়া সীমানায়। দুই জেলায় তো ঘরে ঘরে হয় তাঁত, নয় চরকা। ছেলে, বুড়ো, ঝিউড়ি, বউড়ি, শাশুড়ি সকলেই এই দু’টোর কোনও একটার কাজ করত। শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা।
গর্ব ছিল মদন তাঁতির। ‘শিল্পী’ গল্পের মদন তাঁতি। সূক্ষ্ম শাড়ি তৈরিতে ওস্তাদ মদন তাঁতি। শস্তার গামছা সে বুনবে না। নিজেই বলত, তাঁতিপড়ার নাকি প্রবাদ চালু আছে, ‘মদন তাঁতি যেদিন গামছা বুনবে…’। সেদিন তাঁতিপাড়ার শিল্পীসত্তা শেষ। এই সেদিন দেখলাম, গামছার রংবদল। ‘চাষার ব্যাটা’র গলার গামছার টকটকে লাল রংটা কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল’`| ৭

গামছার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাঙলার নারীরা আরও সৃজনশীল, স্নান শেষে তারা ঘনকালো মেঘবরণ দীর্ঘ ভেজা এলোকেশকে গামছা দিয়ে ঝেঁড়ে খোপায় গামছা পেঁচিয়ে প্রকৃতির নিয়মে হেয়ার ড্রায়ার এর কাজ সেরে থাকেন যা বিশ্বে বিরল ঘটনা। যদিও ইদানীং শহরে তোয়ালে ব্যবহার শুরু হয়েছে কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মিটে?

বাঙালির পরিচ্ছদ বিতর্ক ও গামছা

রাজনারায়ণ বসু ১৮৭৪ সালে তাঁর `সেকাল একাল’ বইতে বাঙালির পরিচ্ছদ বিষয়ে খুব চাঁছাছোলা মন্তব্য রেখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ আছে। সেইরূপ পরিচ্ছদ সেই জাতীয় সকল ব্যক্তিই পরিধান কোরিয়া থাকেন। কিন্তু আমাদিগের বাঙ্গালী জাতির একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ নাই। কোন মজলিসে যাউন, একশত প্রকার পরিচ্ছদ দেখিবেন, পরিচ্ছদের কিছুমাত্র সমানতা নাই। ইহাতে এক একবার বোধ হয়, আমাদিগের কিছুমাত্র জাতিত্ব নাই।”

১৮৮৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় `বিলাতের পত্র` বইতে `বাঙ্গালীর পোষাক` নামের নিবন্ধ লেখেন। তিনি লেখেন- “বাঙ্গালীর পোষাক অতি আদিম ও আদমিক (adamite)। বাঙ্গালীর কোনো পোষাক নাই বলিলেও চলে। যদি জাতি, গুটিকয় সভ্য শিক্ষিত যুবকে না হয়, যদি জাতির আচার ব্যবহার ভদ্রতা শিক্ষা কেবল জগতের পঞ্চমাংশের স্বীকৃত না হয়, যদি অশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ কৃষক ও ব্যবসায়ী জাতির মূল হয়; তাহা হইলে দুঃখের সহিত বলিতে হইবে, বাঙ্গালীর কোনোই পোষাক নাই।” পোশাকের আদিমতা জিনিসটা কি? বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠের যে পোশাক ধুতি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, নিমা, চাদর, গামছা এসব কেন জাতীয় বা ঐতিহ্যিক পোশাক হইতে পারলো না?  নবোবরা তো কম চেষ্টা করল না ধুতির উপর আচকান তার উপর ইংরাজ কোট, চাদর, চাপকান, পাম শো জাতীয় পরিচ্ছদে ঢেকে দেশের পোশাকের গুষ্টি উদ্ধার করতে, পারলেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে `কোট ও চাপকান` নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। উনিশ শতকের শেষদিকে যে বাঙালিরা ইংরেজি পোশাক পছন্দ করেছিলেন, তারা সমালোচনার উত্তরে যেমনটা বলতেন সেটা রবি ঠাকুরের ভাষায়, “পুরুষের উপযোগী জাতীয় পরিচ্ছদ তোমাদের কোথায় যে আমরা পরিব? ইহাকেই বলে আঘাতের উপর অবমাননা। একে তো পরিবার বেলা ইচ্চাসুখেই বিলাতি কাপড় পড়িলেন। তাহার পর বলিবার বেলায় সুর ধরিলেন যে, তোমাদের কোনো কাপড় ছিল না বলিয়াই আমাদিগকে এই বেশ ধরিতে হইয়াছে। আমরা পরের কাপড় পড়িয়াছি বটে, কিন্তু তোমাদের কোনো কাপড়ই নাই-সে আরও খারাপ।”

পোশাক নিয়ে এবংবিধ চাপানউতোরের মধ্যে ধুতি পিরান চাদর, ধুতি পাঞ্জাবি -চাদর, ধুতি নিমা চাদর, ধুতি চাদর পাগড়ি, ধুতি শার্ট, ধুতি চাদর কে বাঙালির পোশাক হিসাবে নির্বাচনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় এই পোশাক বিতর্ক উনিশ শতকের শেষ পাদের। প্রশ্ন জাগে তার আগে ১৬, ১৭, ১৮ শতকে বাঙালি পুরুষের ব্যবহৃত সার্বজনীন পরিচ্ছদ কী ছিল? শত শত বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির পোশাক বলতে আমরা কি বুঝবো? পরনে খাটো ধুতি গায়ে গামছা বা পরনে লুঙ্গি গায়ে গামছা,নাকি নেংটি গামছা? অধিকাংশ কৃষক পেশার মানুষের দেশে এমন জুতসই পোশাকই তো হওয়ার কথা! জুতসই কেন? কারণ, জল কাদায় ধুলোমাটিতে যার চাষ বাস চলাচল সেই চাষি শ্রমিক সহ জল-মাটি ঘেঁষা নানা পেশার মানুষদের কর্ম সম্পাদনের নিমিত্তে মালকোঁচা জাতীয় নিম্নাঙ্গের পোশাকই তো সহজ সমন্বয়ক। চাদর কাঁধে নিয়ে যে কায়িক শ্রম করা যায় না তা বলাই বাহুল্য। ফলে সম্পন্ন কৃষক, প্রভু গোছের লোক ছাড়া কাঁধে চাদর ঝুলিয়ে চলাফেরার কারই বা ফুসরত ছিল সেকালে! কটিবস্ত্র বলতে যদি খাটো ধুতি বা গামছার ব্যবহার বুঝি তবে কোমড়ে গামছার অবস্থানকেও অত্যাবশ্যক বুঝতে অসুবিধে হয় না। নানা কায়িক শ্রমের সঙ্গে গামছার সম্পর্কটি অন্য যে কোন কাপড়ের চাইতে অনেক বেশি সম্পর্কিত। ভাবনার বিষয় চাদর নামক বস্ত্রটি যেমন করে পরিচ্ছদের অন্তর্ভুক্ত গামছা কিন্তু সেখানে অপাঙতেয়! 

মালকোঁচা বা মল্লকচ্ছ শ্রমজীবী বাঙালির প্রাচীন পরিধেয় বিষয়ে ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত `বাঙ্গালীর ইতিহাস` বইতে বর্ণিত আছে। `তখনকার ধুতি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে অনেক ছোটো ছিল; সাধারণত হাঁটুর উপর পর্যন্তই ছিল কাপড়ের প্রস্থ। ধুতির মাঝখানটা কোমরে জড়াইয়া দুই প্রান্ত টানিয়া পশ্চাতের দিকে কচ্ছ বা কাছা। ঠিক নাভির নিচেই দুই-তিন প্যাঁচের একটি কটিবন্ধের সাহায্যে কাপড়টি কোমরে আটকানো, কটিবন্ধের গাঁটটি ঠিক নাভির নিচেই দুল্যমান। কেহ কেহ ধুতির একটি প্রান্ত পিছনের দিকে টানিয়া কাছা দিতেন, অন্য প্রান্তটি ভাঁজ কোরিয়া সম্মুখ দিকে কোঁচার মতো ঝুলাইয়া দিতেন।” এই যে ‘কটিবন্ধ’ তা কোমরে জড়ানো শক্ত সুতো, কোমরবন্ধ নাকি গামছা?

কোন একটি এলাকার পোশাক তার আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কোন কিছুর আদি ও অকৃত্তিমতাকে খুঁজতে গেলে তার স্থানিক ইতিহাসটা জানা জরুরি। এই বাংলায় আবহাওয়া গরম ও উষ্ণ। তাই এই এলাকার মানুষের পোশাক ছিল হালকা সুতিবস্ত্র। যখন সেই সব দেশ পৃথিবীময় কর্তৃত্ত্ব করে যাচ্ছে তখন তাদের পোশাকই আমাদের কাছে সভ্য মনে হচ্ছে। আমাদের দেশে এভাবেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শাসকদের কারণে দেশে পোশাকের বৈচিত্র্য ঢুকেছে। একারনেই ইতিহাসবিদদের বাঙালির পোশাক নিয়ে আক্ষেপ।

সুগন্ধি সলিলে    সিনান করিয়া
শীতল হইলা বালা।।
গামছা আনিয়া     গাখানি মোছাঞা
পরায়ে নীলিম-বাস।।

কিন্তু বাঙালির পোশাক যে বারে বারে ক্ষমতার যাতাকলে লন্ডভন্ড হয়েছে সেকথা কি আমরা একবারও ভেবেছি! ভাবার সময় কখনো ফুরায় না। ভাবার দরকার আছে বটে! ক্ষমতার চক্করে বা বাঙালির পোশাক যে ক্ষমতার হাতে পড়ে আমরা এই বিষয়টি কি কখনো ভেবে দেখেছি? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ প্রায় সব ভারতবর্ষীয় পন্ডিতগণ যাদের বিলেত বা অন্য দেশ দেখার সুযোগ হয়েছিল তারা বাঙালির পোশাক নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। আর তাদের সকলকেই আমার কাছে মনে হয়েছে তারা অন্য দেশের প্রভাবশালী সংস্কৃতি দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন।

বাংলায় মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পূর্বে শাসক ছিল সেন বংশ। সে যুগে পুরুষের পোষাক ছিল ধুতি, উর্দ্ধাঙ্গে উত্তরীয়। নারীর ছিল শাড়ি। নারীর উর্দ্ধাঙ্গে তখনও কোন পোশাক চালু হয়নি। সুকুমার সেনের বক্তব্য অনুসারে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় ধুতি ও শাড়ির মধ্যে কোন গুরুতর লিঙ্গভেদ সেকালে মানা হত না।মুসলমান শাসন আমলে শাড়ির সাথে কাঁচুলির চল পাওয়া যায়।

ধুতিই ছিল বাংলার পুরুষের একমাত্র পোশাক। মুসলমান শাসন আমলে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের পোশাকে যোগ হয় পাজামা।  নিম্নবর্গের মুসলমান পুরুষরা ধুতিই পরতো। পোশাকের সঙ্গে যে ক্ষমতার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে তা আমরা মুসলিম শাসন আমলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পোশাক দেখলেই ধারনা পাই। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারের শিক্ষিত ও সন্মানিত সন্তান। ততদিনে মুসলিম শাসনের প্রভাব সংস্কৃতিতে পোক্ত অবস্থান নিয়েছে। পাগড়ি, জোববা সদৃশ জামা, পাজামা- এগুলো সরকারী শিষ্টজনের পোশাক। কালক্রমে ইংরেজরা যখন মসনদে বসলো তখন থেকে শিষ্টমন্ডলীতে যাওয়ার পোশাকে শার্ট, প্যান্ট, কোট যোগ হয়। রবীন্দ্রনাথকেও বিলেত যাওয়ার জন্য সভ্য পোশাক বানাতে হয়েছিল।

‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইয়ের লেখক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘উনিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে পশ্চিমা পোশাক অথবা সে পোশাকের কিছু উপকরণ অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে বহাল থাকে সনাতনী পোশাক।’সনাতনী পোশাক বলতে গোলাম মুরশিদ ধুতি, গামছাকেই বুঝিয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।

বাঙালির লুঙ্গি পরার ইতিহাস কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। এমনকি এই পোশাকটি আদৌ বাংলা ভাষাভাষীর পোশাক ছিল না। শ্রীলঙ্কা, তামিল ও বার্মায় এর ব্যবহার ছিল। সেই সাথে আরবীয়রা এদেশে লুঙ্গি সদৃশ সেলাই ছাড়া তমুদ্দন আনে যা এদেশের মুসলমান পুরুষরা গ্রহন করে। সেই থেকেই লুঙ্গির বাংলা ভুখণ্ডে প্রবেশ।

বাংলার হোসেনশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শাহর (রাজত্বকাল ১৪৯৪-১৫১৯) সমসাময়িক কবি বিজয়গুপ্তের রচিত ‘পদ্মপুরাণ’এ পাওয়া যায়, সিংহলরাজ চাঁদ সওদাগরের কাছে পট্টবস্ত্র পেয়ে বাঙালিভাবে বস্ত্র পরছেন। পরার ধরন হল-

‘একখানি কাচিয়া পিন্ধে,
আর একখানি মাথায় বান্ধে,
আর একখানি দিল সর্ব গায়।’

গায়ের কাপড় ছিল চাদর আর পরনে ছিল ধুতিজাতীয় কৌপিন। সেকালের মানুষ ধুতি পরতো কাছা দিয়ে। কাছা ছিল ঢিলাঢাল। তবে কর্মজীবী পুরুষ তা পরতো ‘মালকোচা’ দিয়ে। মল্লবীরেরা প্রতিযোগিতার সময় পরনের কাপড় আঁটোসাঁটো করে কাছা দিত। এই থেকে ‘মালকোচা’ শব্দটি এসেছে।

অন্যদিকে গোড়ার দিকে আরবের লোকেরা ধুতি পরতো লম্বা করে কোচা ছাড়া। পরার ধরন ছিল সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতো। পারস্যে এই ধরনের পোশাকের নাম ছিল ‘তাহবন্দ’। বাংলাতে এই শব্দ হয়েছিল ‘তহবন’, ‘তবন’। ‘লুঙ্গি’ নামক নিম্নাঙ্গের পোশাকটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কিন্তু নামটা এসেছে ‘বর্মি’ শব্দ থেকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানদের সূত্রে আগত এই শব্দটি ‘তবন’ শব্দটিকে প্রায় অপসারিত করেছে। সঙ্গে একটু ছোট করে পুরুষদের পোশাকের অন্যতম সঙ্গী হয়ে ওঠা গামছার কথা না বললেই না।

সেকালের গামছাকে বলা হত ‘শাঙালি’। আর ‘গা-মোছা’ শব্দ কালক্রমে ‘গামছা’ শব্দে পরিণত হয়েছে। নামকরণেই এর ব্যবহার নিহিত আছে। মাঠে কাজ করার সময় গাম মোছা থেকে গোসলের পর গা মোছার একমাত্র অনুসঙ্গ ছিল এই গামছা। ধুতির সঙ্গে এটার একটা সহাবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই তখন থেকেই। কর্মজীবী বিশেষ করে চাষীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা ছিল অনস্বীকার্য। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদ ও মহরমের মিছিলের মোট ৩৯টি ছবি এঁকেছিলেন।

মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে নায়েব-নাযিমরা থাকতেন একেবারে সামনের দিকে। দর্শক হিসেবে থাকতেন অভিজাত শ্রেণির লোকজন। এ দেশীয়রাতো থাকতেনই সেই সঙ্গে থাকতেন ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপিয়ানরা। ছবিগুলোতে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের পোশাক লক্ষ্য করার মতো। অভিজাতদের নিম্নাঙ্গে পায়জামা থাকলেও। পালকিবাহকের পরনে কিন্তু ছিল সেই ধুতিই।

আর্যদের সময় সমগ্র ভারতবর্ষের বাকল থেকে তৈরিকৃত কাপড় ব্যবহারের প্রচলন ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গদেশে এক সময় কাপড় তৈরি হতো গাছের বাকল থেকে। সেকালের আর্য-অনার্য বা মিশ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা গাছের বাকলকে পিটিয়ে কাপড়ের মতো পাতলা করে, তারপর তা শুকিয়ে পরিধান করতো। 

সাঁচির বৌদ্ধস্তূপের স্তম্ভে মানুষের অবয়বগুলোতে যে কাপড়ের আবরণ দেখা যায়, তা বাকল থেকে তৈরি হওয়া বস্ত্রই মনে হয়। বাকল থেকে তৈরি কাপড়কে বলা হতো ক্ষৌম। এর ভিতরে সেরা জাতের ক্ষৌম-কে বলা হতো ‘দুকুল’। বঙ্গ নামক জনপদের দুকুলের রঙ ছিল স্নিগ্ধ সাদা। পুণ্ড্র নামক জনপদের দুকুলের রঙ ছিল শ্যামবর্ণের আর বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত জনপদ কর্ণসুবর্ণের দুকুল ছিল উজ্জ্বল। বঙ্গদেশ পুরুষেররা সে সময়ে দুকুল পরতো নিম্নাঙ্গে।

সেকালের মানুষ ধুতি পরতো কাছা দিয়ে। কাছা ছিল ঢিলেঢালা। কিন্তু কর্মজীবী পুরুষ তা পরতো ‘মালকোচা’ দিয়ে। মল্লবীরেরা প্রতিযোগিতার সময় পরনের কাপড় আঁটোসাঁটো করে কাছা দিত। মল্লদের কচ্ছ, এই থেকে ‘মালকোচা শব্দটি এসেছে।

সেকালের গামছাকে বলা হত ‘শাঙালি’। আর ‘গা-মোছা’ শব্দ কালক্রমে ‘গামছা’ শব্দে পরিণত হয়েছে। নামকরণেই এর ব্যবহার নিহিত আছে। মাঠে কাজ করার সময় গাম মোছা থেকে গোসলের পর গা মোছার একমাত্র অনুসঙ্গ ছিল এই গামছা। ধুতির সঙ্গে এটার একটা সহাবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই তখন থেকেই। কর্মজীবী বিশেষ করে চাষীদের কাছে এর জনপ্রিয়তা ছিল অনস্বীকার্য। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদ ও মহরমের মিছিলের মোট ৩৯টি ছবি এঁকেছিলেন।

গামছার প্রাচীন নাম শাঙালি

বৈশাখ বসন্ত ঋতু মুখের সময়।
প্রচণ্ড তপনতাপ তন্তু নাহি সয়॥
চন্দনাদি তৈল দিব সুশীতল বারি।
সামলী গামছা দিব সুগন্ধী কস্তুরী। ৮ক

এই কথা সুনিয়া রাজা ক্ৰোদ্ধমান হইল ।
ঘরর সেওয়ালী গামছা রাজা খেতুক ফেলাইয়া দিল ।
ঐ গামছা দিয়া বান্ধিল ভিড়িয়া।
ময়নামতিক দিল তৈলত ফেলাইয়া ॥ ৮খ

গামছাকে প্রাচীনকালে বলা হতো শাঙালি। আর গা-মোছা শব্দ কালক্রমে গামছা শব্দে পরিণত হয়েছে। সন্ন্যাসীদের পোশাকের রঙ ছিল পীত। অন্যান্য সাধুরা পরতেন সাদা রঙের ধুতি। তবে সাধু সন্ন্যাসীদের সংখ্যা ছিলো তুলনামূলক কম। গরিব বা নিম্নবর্গের লোকেরা অর্থাৎ অধিকাংশ লোক ঘরে এবং ঘরের বাইরে গামছাই পরতো প্রাচীনকালে।  ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না৷ এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হতো ‘ধুতি’ আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’৷ সেই ধারা সপ্তম শতকেও বহাল তবিয়তেই ছিল৷ কেননা সেসময়ে হিউয়েন সাং-এর বর্ণনাতে বাংলার যে পোশাকগুলির বিবরণ রয়েছে, সেগুলি সেলাই করা নয়৷ দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের গরম থেকে বাঁচার জন্য অধিকাংশ মানুষই শাদা কাপড় পরতেন৷ একসময় পাগড়ি ছিল অভিজাত বাঙালি পুরুষের পোশাক। খালি গায়ে এবং পাগড়ি ছাড়া ঘরের বাইরে বেরুনো অসভ্যতার মধ্যে পরতো।

লুঙ্গি কয় গামছাকে
তুই বড়োই হীন,
জীবনটা দেখি তোর
উদ্দেশ্য বিহীন।
নীচঘরে জন্ম তোর
মেঝেতেই বাস,
তোর জন্মে গৃহস্তের
যত সর্বনাশ।
হতাশা, দারিদ্র্যে ভরা
বড়ো দৈন্যদশা,
দেহ, পদ মোছামুছি
জীবনের পেশা।
সবাই ব্যবহার করে
পা মোছার কাজে,
কী করে মিশবি তুই
আমার সমাজে?
ডাক্তার, প্রফেস
যত গুণীজন,
আমি থাকি তাহাদের
অঙ্গের ভূষণ।
কলেজের লেকচার,
মিটিং, মিছিল,
দাবাখানা, মসজিদ
আমার মঞ্জিল।
দুনিয়া বুঝেছে আজ
আমার কদর,
গৃহস্তের ঘরে পাই
জামাই আদর।
গামছা উত্তরে কয়
বিনয়ের সাথে,
তোমার সৌভাগ্য কেউ
পারে না আটকাতে।
ভালোবেসে চাষীভাই
কাঁধে নিয়ে ঘোরে,
ক্লান্ত দেহের ঘাম
মুছে দিই তারে।
কখনও বা পরিধেয়
কখনও পাগড়ি,
অতি কষ্টে কাটে দিন
গরীবের বাড়ি।
কামনা করি রে আমি
সবার মঙ্গল,
আমি তাই গরীবের
একান্ত সম্বল।
কর্মই আসল ধর্ম
বুঝিবে অচিরে,
তোমার আমার জন্ম
একই কুটিরে। ৯

(মল্লকচ্ছ, কায়িক শ্রম উপযোগী কাছা দিয়ে বস্ত্র পরিধানের প্রক্রিয়া)

ইংরেজি ‘পারগ’ ও ‘বালেগ’ জাতির বস্ত্র বিধান

  

হিন্দুকলেজাদি নানা পাঠশালা দ্বারা অনেক বিষয়ি লোকের সন্তানেরা ইঙ্গরেজী বিদ্যায় পারগ হইয়াছে হইতেছে ও হইবেক। ইহারা কেহ দেওয়ানের পুত্র কেহ কেরাণির ভাই কেহ খাজাঞ্চির ভাতৃপুত্র কেহ গুদাম সরকারের পৌত্র কেহ নীলামের সেলসরকারের সম্বন্ধী ইত্যাদি প্রায় বিষয়ি লোকের আত্মীয় তাহারদিগকে কর্ম্মে উক্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই নিযুক্ত করিয়া দিবেন এবং এই প্রথমতঃ কর্ম্ম হইয়া থাকে… ১০

ইংরেজিতে ‘পারগ’ হইয়া ইংরাজের হুকুমত পালনে ‘বালেগ’ জাতি কাছারি কর্মে গামছা হটাইয়া টাওয়াল লইল। ‘ভাষ’ আর ‘বাস’ এই দুই হইলো দখলদারির অস্ত্র।

১৪৯২ সালে ইস্পানি পণ্ডিত আন্তোনিয়ো দে নেব্রিহা (Antonio de Nebrija, ১৪৪১–১৫২২) স্প্যানিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন।এই ব্যকরণ তিনি রানি ইজাবেলাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই বই দিয়ে তিনি কী করবেন রানির এই প্রশ্নের উত্তরে নেব্রিহা বলেন, ‘শ্রদ্ধেয় রানি, ভাষা হল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।’ সে বছরই স্প্যানিশ রানি ইজাবেলা–র পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার ও ইস্পানি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করে। চলমান ধাবমান উপনিবেশিক `মানসিকতার সাম্রাজ্য`গড়ন, বরণ, পালন-পোষণ বড়বাংলার ক্রনিক অসুখ। এই অসুখের নানা উপসর্গের বহির্প্রকাশের একটি পরিচ্ছদ বস্ত্র। বাঙালির পরিধেয় ধুতি, চাদর, গামছা, লুঙ্গিকে প্রান্তিকের ব্যবহার্য্য দলিত পরিচ্ছদ হিসাবে দাগিয়ে দেয়া হয়েছে! ইউরোপীয় ‘ভাষ’ আর ‘বাস’ স্বাঙ্গীকৃত হয়েছে বাঙালির দেহে যেমন, মগজেও তেমন।

শিক্ষা আর ভাষার নিয়ন্ত্রণে এরা দেশের মানুষ, সংস্কৃতি এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় স্যুট–কোট–টাই–গাউন, লাঞ্চ–ডিনার, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং টেবল ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বাঁচে।

সংকলন -সূত্র নির্দেশ

১. পার্থসারথি বসু।
২. মাটি-বংশধর, আবু হাসান শাহরিয়ার।
৩. ঢাকাই মসলিন, আবদুল করিম, পৃষ্ঠা ৬৫, বাঙলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৬৫।
৪. আমাদের ছোট নদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫. গামছা, দেবযানী আইচ।
৬. য়োহন ও মাতিউ রচিত, ত্রয়োদশ অধ্যায়, মঙ্গল সমাচার,(দ্য গসপেল) কলিকাতা বাইবেল সোসাইটি, ১৮১৯।
৭. দীপক দাস-মিষ্টি মহলের আনাচে কানাচে, গুরুচন্ডালি, ১৯ আগস্ট ২০১৯।
 ৮. পাই অবসরে রাই সে সত্বরে, পদকর্তা:রায় শেখর, রাগ:ভাটিয়ারি, তাল:অজ্ঞাত, সংকলন:পার্থ হালদার, যমুনাকিনারেডটওআরজি।

৮ক. সিংহলের রাজা শালিবাহনের কন্যা স্থশীলার বারমাসী। বংগো সাহিত্য পরিচয়, পৃষ্ঠা ৩৬৬, দীনেশচন্দ্র সেন, ১৯১৪, কলিকাতা বিশবিদ্যালয়। ৮খ. গোপীচন্দ্রের গান
৯ .লুঙ্গি বনাম গামছা, নিতাই মন্ডল (NP Mandal), https://www.ramdhonu.in/
১০. সমাচার চন্দ্রিকা, ১৫ চৈত্র ১২৩৬।

শফিকুল কবীর চন্দন

চিত্রকর, গবেষক। বাড়ি ঢাকায়। পড়াশুনা শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে। বসবাস যুক্তরাজ্যে।

Share