কলকাতার অভদ্রবিত্তের তিনটি সুপ্রাচীন সঙযাত্রা

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

চৈত্রসংক্রান্তির গাজন ও সঙযাত্রা বড় বাংলার ভূমিনিবিড় গণমানুষের ঐতিহ্যবাহী লোকাচার/ উৎসব। কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি যেহেতু ভদ্রলোকের ‘কালচার’-এর চৌহদ্দির বাইরেই থেকেছে, প্রশ্ন করেছে ক্ষমতাকাঠামো ও তার কেন্দ্রিভুত ব্যবস্থাকে- তাই ভদ্রলোকেরাও সঙযাত্রার মতো উৎসবগুলিকে কোণঠাসা করেছে দিনের পর দিন। কলিকাতার নিম্নবর্গীয় সমাজ বা ‘ছোটলোক সমাজ’-এর তিনটি সুপ্রাচীন সঙযাত্রার পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার বেশ কয়েকটি এলাকার সঙযাত্রা নিয়ে লিখছেন বিশ্বেন্দু নন্দ।

ব্রিটিশ লুঠের বিশ্বকেন্দ্র কেন্দ্র হয়ে ওঠার আগে প্রাচীন এশিয় ব্যবসা রাজপথের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক এলাকা ছিল বড় বাংলা ভৌগোলিক এলাকা। এই অঞ্চলে ইওরোপিয় উপনিবেশিক কৃষ্টিচর্চা জাঁকিয়ে বসার আগে পরম্পরার কৃষ্টিচর্চা সমাজ গঠন ইত্যাদিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি ছিল পরম্পরার অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষ্টিচর্চা। এই ধরণের জনকৃষ্টিচর্চা, ক্ষমতায় থাকা মানুষদের নানান কাজকর্মকে তীক্ষ্ণ সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছে। আজকে যাকে আমরা জনসাংবাদিকতা, অপ্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা বলি, তার ভিত্তিই ছিল এই অপ্রাতিষ্ঠানিক অভদ্রলোকীয় কৃষ্টিচর্চা। প্রতিষ্ঠানের, ক্ষমতাবানদের নানা কেচ্ছা কাহিনী দুর্নীতি অসামান্য দৃঢ়তায় ছড়িয়ে দিয়েছে জনসাধারণের মধ্যে যদিও এই বিষয়টা এই প্রবন্ধে আলোচনার সুযোগ নেই, তবুও আরও একবার বিষয়টা মনে করিয়ে দেওয়া গেল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করে রাখি, নয়ের দশকে বেশ কিছু কাল কলকাতার কৈবর্ত সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ব্যক্তিগত স্মৃতি রয়েছে আমার। কলকাতার কৈবর্ত সমাজের অন্যতম ধারক শঙ্করপ্রসাদ দে, কিঙ্করপ্রসাদ দে’র স্নেহধন্য হয়েছি। উপনিবেশবিরোধী জ্ঞানচর্চার জায়গা থেকে জোরের সঙ্গে বলতে হয়, গনজ্ঞাপন, জনসাংবাদিকতা ছাড়াও ছাড়াও সার্বিকভাবে সঙ আজও গান ছড়া বাদ্য দিয়ে বৃহত্তর অবর্ণিক অভদ্রলোকিয় মানুষদের মনোরঞ্জনের অন্যতম কৃষ্টিমাধ্যম। গত দুই তিন দশক ধরে কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায় ব্রিটিশ এবং ভদ্রলোকিয় অত্যাচারে হারিয়ে যাওয়া সঙ-যাত্রাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার উদ্যম নেওয়া হচ্ছে।

কলকাতার নবজাগরনী ভদ্রবিত্তের উদ্যোগে অশ্লীলতা নিবারণের ইতিহাস  

বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় অশ্লীলতা অর্থে ছোটলোকের পাঁচালি আর মহিলা চাষীর কৃষ্টিকে তাক করলেন ‘অশ্লীলতা বঙ্গদেশিয়দের জাতীয় দোষ বললে অত্যুক্তি হয় না। …যাঁহারা ইহা অত্যুক্তি বিবেচনা করিবেন তাঁহারা বাঙ্গালির রহস্য, বাঙ্গালির গালি, নিম্নশ্রেণীর বাঙ্গালির স্ত্রীলোকের কোন্দল, এবং বাঙ্গালির যাত্রা পাঁচালী মনে ভাবিয়া দেখুন। মুহূর্তের জন্যে বাঙালি কৃষকের কথোপকথন শ্রবণ করিয়া দেখুন – বাঙ্গালির প্রণীত যে সকল কাব্যগ্রন্থ সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া খ্যাত তাহা পাঠ করিয়া দেখুন’। ব্রিটিশ ভদ্রবিত্তের অনুসরণে, চাকুরিদাতা কোম্পানিকে খুশি করতে জনগণের কৃষ্টিগুলোকে ব্রিটিশধন্য সমাজপতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এভাবেই ‘অশ্লীল’ দেগেদিলেন।

উপনিবেশিক ভদ্রলোকিয় লন্ডনে [আমরা যেন মনে রাখি বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য তৈরির আগে পশ্চিম ইওরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের দেশে চাষী, হকার, কারিগর, পশুচারক ইত্যাদিদের ওপরে ভদ্রলোকিয় এককেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ভর উপনিবেশ চাপিয়ে দেয়] ১৮৫৬য় অবসিন পাবলিকেশন এক্ট চালু হওয়ারও এক বছর আগে একই ধরণের অশ্লীলতা নিবারণী আইন কলকাতায় লাগু হয়েছে। আইনের লগুড় দেখিয়ে যাত্রা, পাঁচালি, কবর লড়াই, ঝুমুর ইত্যাদি প্রকাশভঙ্গী বন্ধ করতে পুলিশ এবং সামাজিক মৈত্রমশাইরা কড়াভাবে উদ্যমী হয়। এর প্রভাব শুধু পুরুষ কৃষ্টিকর্মীদের ওপরেই পড়ল না, সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’ বইতে বলছেন, পুলিশ নিয়ম প্রয়োগ করে খোলাখুলি মেয়েদের যত আখড়া ছিল সব কটাকে তুলে দেয়। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানাচ্ছেন, উনিশ শতকের শেষে মেয়ে পাঁচালি দল অদৃশ্য হয়ে গেছে কারণ ‘শিক্ষিত লোকেরা নিন্দা করিতে লাগিল – ও উঠিয়া গেল’। শিবনাথ শাস্ত্রী বলছেন কবির লড়াই ও হাফ আখড়াই উঠে যাওয়ার কথা – ‘ইংরাজি শিক্ষা দেশমধ্যে যখন ব্যপ্ত হইতে লাগিল, তখন এই সকলের প্রতি শিক্ষিত ব্যক্তিদের বিতৃষ্ণা জন্মিতে লাগিল’। আইন করে, সামাজিক চাপ দিয়ে, কৃষ্টিকে অশ্লীল দাগিয়ে অভদ্রবিত্ত মেয়েদের মুখের কৃষ্টি ভাষা কেড়ে নিল ভদ্রবাঙ্গালি। 

শুধু মহিলাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষ্টিচর্চাই নয় প্রতিষ্ঠান থেকেও ভদ্রকুললনাদেরই নয় বারবণিতাদেরও কাজ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠল অশ্লীলতার অনুষঙ্গে ভদ্রবিত্তিয় সমাজে। ভদ্রবিত্তরা প্রকাশ্যে নাট্যচর্চা থেকে মহিলাদের বাদ দিতে উদ্যোগী হয়। অর্থাৎ নাট্যচর্চা থেকেও যাতে মহিলারা রোজগার না করতে পারে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করল। অর্থাৎ মেয়েদের এই রোজগারেও হাত বসাল ভদ্দরলোকেরা।

তবে সঙ বা কলকাতার ছোটলোকি কৃষ্টিচর্চায় চরমপন্থার বিপরীতে মধ্যপন্থা অবলল্বন করেন বেশ কিছু প্রখ্যাত, তার মধ্যে নাট্যব্যক্তিত্ব রসরাজ অমৃতলাল বসু অন্যতম। আজকের ভাষায় তাঁকে আমরা সং এপোলোজেটিক বলতে পারি। তাঁর নিদান ছিল সঙকে বাঁচাতে ভদ্রলোকেদের অনুপ্রবেশ। তিনি জেলেপাড়ার সঙ-যাত্রায় কলমপাত করেছেন। ১৩৩৬এর মাসিক বসুমতী পত্রিকায় জ্যোতিশচন্দ্র বিশ্বাস অমৃতলাল ও জেলেপাড়ার সঙ প্রবন্ধে রসরাজের সঙ বিষয়ক মন্তব্য পাই। সেই প্রবন্ধ উল্লেখ করে বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাংলাদেশের সঙ’ বইতে অমৃতলালের মন্তব্য লিখছেন, ‘ছোট, মন্দ, অশ্লীল প্রভৃতি বলিয়া আমরা কত জিনিসই না হারাইয়াছি ও হারাইতে বসিয়াছি। ছোটকে বড়, মন্দকে ভাল, অশ্লীলকে শ্লীল করিয়া লইতে যদি আমরা চেষ্টা করি, তাহা হইলে আমাদের অনেক জিনিস নিজস্ব থাকিয়া যায় এবং জগতের দৃষ্টিতে এত ক্ষুদ্র – এত হেয় নই না। …সঙ ছোট নয়, হীন নয়, অশ্লীল নয়। সকল দেশে সকল সময়েই কোনো-না-কোনো রূপে সং লোক-সমজে আত্মপ্রকাশ করে। তবে বাঙ্গালাদেশে কতগুলি অশিক্ষিত, অমার্জ্জিত রুচি লোকের হস্তে পড়িয়া এবং সঙ্গে শিক্ষিত সুধীগণের সহানুভূতি না পাইয়া সং তিন দিন অবনত হইতেছিল’।

ভদ্দরলোকেদের সোসাইটি ফর দ্য সাপ্রেশন অব পাবলিক অবসিনিটি কলকাতার ছোটলোকেদের সঙ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। প্রখ্যাত কাঁসারি ধনী তারক প্রামাণিকের পৃষ্ঠপোষণায় কাঁসারিপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন হগসাহেব। শহরের কবিয়াল পাল্টা ছড়া কাটলেন-

শহরে এক নূতন
হুজুগ উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।           
বৎসরান্তে একটি দিন
কাঁসারিরা যত
নেচে কুঁদে বেড়ায় সুখে
দেখে লোকে কত।
যদি ইহা এত মন্দ
মনে ভেবে থাকো
নিজের মাগকে চাবি দিয়ে
বন্ধ করে রাখো।

কলকাতার হৃদিঅক্ষে বসে অভদ্রলোকেদের তৈরির অসামান্য এই ছড়া মাথায় তুলে এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কলকাতার তিনটি এবং কলকাতার লাগোয়া হাওড়া আর হুগলীর নানা এলাকার মূলত অভদ্রবিত্তের আয়োজনে বিচিত্র সঙ-যাত্রার কিছু বর্ণনা।

১৮৫৬’য় অবসিন পাবলিকেশন এক্ট চালু হওয়ারও এক বছর আগে একই ধরণের অশ্লীলতা নিবারণী আইন কলকাতায় লাগু হয়েছে। আইনের লগুড় দেখিয়ে যাত্রা, পাঁচালি, কবর লড়াই, ঝুমুর ইত্যাদি প্রকাশভঙ্গী বন্ধ করতে পুলিশ এবং সামাজিক মৈত্রমশাইরা কড়াভাবে উদ্যমী হয়। এর প্রভাব শুধু পুরুষ কৃষ্টিকর্মীদের ওপরেই পড়ল না, সুমন্ত্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’ বইতে বলছেন, পুলিশ নিয়ম প্রয়োগ করে খোলাখুলি মেয়েদের যত আখড়া ছিল সব কটাকে তুলে দেয়। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানাচ্ছেন, উনিশ শতকের শেষে মেয়ে পাঁচালি দল অদৃশ্য হয়ে গেছে কারণ ‘শিক্ষিত লোকেরা নিন্দা করিতে লাগিল – ও উঠিয়া গেল’। শিবনাথ শাস্ত্রী বলছেন কবির লড়াই ও হাফ আখড়াই উঠে যাওয়ার কথা – ‘ইংরাজি শিক্ষা দেশমধ্যে যখন ব্যপ্ত হইতে লাগিল, তখন এই সকলের প্রতি শিক্ষিত ব্যক্তিদের বিতৃষ্ণা জন্মিতে লাগিল’। আইন করে, সামাজিক চাপ দিয়ে, কৃষ্টিকে অশ্লীল দাগিয়ে অভদ্রবিত্ত মেয়েদের মুখের কৃষ্টি ভাষা কেড়ে নিল ভদ্রবাঙ্গালি। 

কাঁসারিপাড়ার সঙ

উত্তর কলকাতার কাঁসারিপাড়ার সঙ ছিল কলকাতার অন্যতম পুরোনো সঙ। স্থানীয় জনগন ছিল কলকাতার সব থেকে পুরোনো সঙ-যাত্রার পৃষ্ঠপোষক। জনগনের অর্থদান, অন্যান্য কাজে যোগদান করা ছাড়াও উনবিংশ শতে দুজন প্রখ্যাত মানুষ, তারকচন্দ্র প্রামাণিক (ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ডুবে যাওয়া সপ্তগ্রাম বন্দরের মীরকালা সাহাগঞ্জ থেকে কলকাতায় এসে মধ্য কলকাতার চোরবাগান-কাঁসারিপাড়া অঞ্চলে ভদ্রাসন নির্মাণ করেন কাঁসারী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী উৎপাদক গুরুচরণ প্রামাণিক। সে সময় গুরুচরণ ছিলেন মাঝারিগোছের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পুত্র তারকের জন্ম ১২২৩এর ৫ আশ্বিন। ১২ বছর অবদি অক্ষর চিনে ব্যবসায় প্রবেশ। তাঁর হাতেই পারিবারিক ব্যবসার উন্নতি। বড়বাজারে, চাঁদনিতে বিশাল আড়ত ছিল প্রামাণিক পরিবারের। পিতৃপুরুষের কাঁসা-পিতলের ব্যবসার পাশাপাশি হাওড়ায় সালকিয়াতে গুরুচরণের একটি ডকও ছিল। সেটির বিস্তৃতি ঘটিয়ে ক্যালিডোনিয়া ডক প্রতিষ্ঠা করেন।  সেখানে তিনি জাহাজ মেরামতি করাতেন। জাহাজে যখন স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার হয় নি, তখন ডুবোপাহাড় থেকে বাঁচার জন্যে জাহাজের তলায় লাগানোর জন্যে পিতল ও তামার চাদর বিদেশে রফতানি হতো সেই আড়ত থেকে।  আজ কাঁসা-পিতলের ব্যবসা না থাকলেও কালীপুজোর পরের দিন যন্ত্র-পুজোর (অর্থাৎ, ব্যবসার প্রয়োজনীয় ওজন-যন্ত্র, বাটখারা ইত্যাদি) পারিবারিক প্রথাটি এখনও বজায় রেখেছেন প্রামাণিক পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। একদা তারা কৃষ্ণদাস পালের সঙ্গে কাঁসারিপাড়ার সঙ-এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। পিতাপুত্রের উদ্যোগে রথ-রাস-জন্মাষ্টমীর পাশাপাশি কালীপুজো এবং দুর্গোৎসবও আরম্ভ হয় এখনকার ১৫৪ তারক প্রামাণিক রোডের পারিবারিক ভদ্রাসনে। এডওয়ার্ড আসার সুবাদে তাকে রাজা উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব এলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ১২৯১তে ৭ই চৈত্র তিনি প্রয়াত হন। তারক প্রামাণিক এতই বিখ্যাত হন যে গ্ল্যাডউইন সাহেবের বেনিয়ান বানারসী ঘোষের নামে রাস্তাটির একাংশ তারকচন্দ্র প্রামাণিকের নামে রাখা হয়।) এবং কৃষ্ণদাস পাল(কলকাতার কাঁসারিপাড়ায় এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। হিন্দু প্যাট্রিয়টের হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়াণের পর তিনি সম্পাদক হন। ২৩ বৎসর সম্পাদনায় সে সময়ের রাজনীতিতে লক্ষ্যণীয়ভাবে তার প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ‘ইমিগ্রেশন বিল’, ‘ইলবার্ট বিল’, ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ ইত্যাদি আইন প্রণয়নের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় চা-শ্রমিকদের পক্ষে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে ও দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিসেট্রটদের সপক্ষে বিস্তর প্রবন্ধ রচনা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। চা-শ্রমিকদের নির্যাতন-ব্যবস্থার প্রতিবাদে কৃষ্ণদাস ‘ইমিগ্রেশন বিল’কে ‘দ্য স্লেভ ল’ অব ইন্ডিয়া’ বলে অভিহিত করেন। তিনি রায়বাহাদুর সিআইই হন। হিন্দু মেলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক) কাঁসারিপাড়ার সঙ-যাত্রার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থের ‘প্রাতঃস্মরণীয় তারকনাথ প্রামাণিক’ বইতে বলছেন, ‘সেকালে, কলিকাতার জেলেপাড়ার সংযাত্রা-উৎপত্তি বহুপূর্ব্বে, -প্রতি চৈত্র-সংক্রান্তির দিন কাঁসারী পাড়ার প্রসিদ্ধ সংযাত্রা বাহির হইত; এই সংযাত্রা-সমবায়ের প্রধান পরিচালক ছিলেন তারকচন্দ্র [প্রামাণিক] ও কৃষ্ণদাস পাল মহাশয়। সংযাত্রা দেখিবার নিমিত্ত সাধারণের এরূপ আগ্রহ ছিল যে, সং বাহির হইবার বহু পূর্ব্ব হইতেই রাজপথের সম্মুখ বারান্দাগুলি দর্শনার্থী-জনসংঘ কর্তৃক অধিকৃত হইয়া যাইত; ঐ সকল ভাড়া দিয়া গৃহের মালিকগণ প্রচুর অর্থ লাভ করিতেন। জনসমুদ্র উদগ্রীব হইয়া কৌতুক দেখিবার নিমিত্ত পথের উভয় পার্শ্বে অবস্থান করিত … প্রাচীন-বঙ্গীয়-প্রথার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষক হিসাবেই, তারকনাথ এই অনুষ্ঠানের পরিচালক পদ গ্রহণ করেন এবং ইহাকে লোকপ্রিয় করিবার নিমিত্ত আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেন’। 

বানারসী ঘোষ স্ট্রিট থেকে মিছিল করে বেরত কাঁসারিপাড়ার সঙ। মিছিলে থাকত ছোট ছোট ব্যাঙ্গাত্মক নাটক, নাচ, গান, ছড়া। সঙ-এর জন্যে কাঁসারিপাড়ার সঙ উদ্যোক্তারা বিশেষ প্রকার গাড়ি তৈরি করতেন, যার নাম ছিল ‘কাটরা গাড়ি’। এই ঘোড়ার গাড়িতে করে কুশীলবেরা নানান রকম পোশাকে সেজে যখন কুশীলবেরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গান গাইতেন, নাটক করতেন সে সময় এলাকার মানুষ সে সব দেখার জন্যে উপচে পড়ত।

তবে কাঁসারিপাড়ার সঙএর বিরুদ্ধে ভদ্রবিত্ত বিরুদ্ধবাদীরা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মধ্যভারত (১৩১০) পত্রিকা উল্লেখ করে বীরেশ্বর লিখছেন, ‘প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে যদিও তখন বাণ ফোঁড়া প্রচলিত ছিল না, তত্রাচ কাঁসারিপাড়ার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে কাঁসারিরা মহাউৎসাহে সঙের মিছিল বাহির করিত। সেই সময় বাবু কেশবচন্দ্র সেনের যত্নে কলিকাতার অনেকগুলি কৃতবিদ্য লোক ও খ্রিষ্টান পাদরী একটি অশ্লীলতা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠিত করেন; এই সভার অনুরোধে গভর্মেন্ট প্রকাশ্য পথে অশ্লীল সঙ্গীতাদি নিবারণোদ্দেশে দণ্ডবিধির প্রচার করায় ঐ মিছিল বন্ধ হইয়া যায়। …অমৃত বাজার পত্রিকার ন্যায় সংবাদপত্র এই সভাকে বিদ্রুপ করিতে ছাড়েন নাই’। সঙের গানে অশ্লীলতা দোষ দেখে সঙের মিছিল বন্ধ করার যে চেষ্টা হয়েছিল কলকাতার নকুলে মেকলিয় ভদ্রবিত্তের উদ্যোগে, তার বিরোধিতাসয় খুব কম যে জন/প্রতিষ্ঠান গলা তুলেছিল, তার মধ্যে ‘বসন্তক’ পত্রিকা অন্যতম। ১৮৭২-৭৩এ বসন্তক লিখল, ‘এক্ষণে সামান্য লোকের আমোদ- আহ্লাদ ও উৎসব তো সকলি একে একে শেষ হইতেছে। এক্ষণে যাত্রা নাই, পাঁচালী নাই, কবির কথাই নাই। সামান্য লোকেরা কি লইয়া থাকিবেন। কেবল ধান্যেশ্বরী। আর ছোবড়া টেনে কি দিনপাত হয়? সামান্য লোকের কাঁথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে এ সভ্যতা দেখান কেন?’         

আহিরিটোলার সঙ

দেড়শ বছর আগে আহিরিটোলা মূলত গ্রাম্য এলাকা ছিল। পাড়ায় পাড়ায় যাত্রা-পাঁচালির আসর বসত। বিভিন্ন পুজা-পার্বনে সঙ আর গানের যাত্রা/মিছিল বেরত। এরকম এক মিছিলে গানের অংশ ‘বন্দো মাতা সুরধুনি/ পুরাণে মহিমা শুনি/ পতিত পাবনী পুরাতনী।/বিষ্ণু পদে উপাদান,/ দ্রবময়ী তব নাম/ সুরাসুরে নরেরে জননী’। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বীরেশ্বর বলছেন বন্দো অর্থে প্রাচীন বাংলায় বন্দনা করা, বন্দেমাতরম শুদ্ধরূপ। অমরেন্দ্রনাথ রায় ‘বঙ্গসাহিত্যে স্বদেশ-প্রীতির ধারা’য় লিখছেন ‘[অভদ্রলোক]বাঙ্গালী বহুকাল হইতেই ‘বন্দে মাতা সুরধনী’র গান গাহিয়া আসিতেছে, কিন্তু ‘বন্দেমাতরম’ বলিয়া দেশ-মাতার বন্দনা করিতে সে পূর্ব্বে কখনও জানিত না’। বঙ্কিমচন্দ্রের বহু আগে আহিরিটোলার মানুষেরা বন্দো মাতা সুরধুনিতে গঙ্গা-বন্দনা করতেন। এই গঙ্গাবন্দনা করতে করতে তারা আহিরিটোলার বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে চিতপুর রোডের বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে এসে কিছুক্ষণ থামত। মদনমোহন মন্দিরের থেকেও পুরোনো আহিরিটোলার সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। মকরেও আহিরিটোলা, জোড়াসাঁকো, বাগবাজারে একইরকম সঙের নানা দল বেরত। বিভিন্ন সঙের দলের যাত্রাক্রম নিয়েও দলেগুলো মধ্যে ঝগড়া হাতাহাতিতে পর্যবসিত হতো।

জেলেপাড়ার সঙ

জেলেপাড়ার সঙ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। আজ যেটা ক্রিক রো বৌবাজার, মলঙ্গা লেন, অক্রুর দত্ত লেন, তার পাশে আমতার বুজে যাওয়া দামোদরের জেলেরা বাস করতেন, তার আজও নাম জেলে পাড়া (অক্রুর দত্ত লেন – যেখানে হিন্দুস্থান রেকর্ডসের দোকান ছিল, ভি বালসারা বাবুর বাড়ি ছিল, কলকাতার প্রখ্যাত ধনীদের বাস ছিল, মেদিনীপুর থেকে আসা বিদ্যাসাগর মশাই প্রথমে এই অঞ্চলে থাকতেন বা রমানাথ কবিরাজ লেন যেখানে আজও কলকাতা কৈবর্ত সমিতির বিশাল বাড়িটা আছে, কয়েক বছর আগে স্বাধীনতা সংগ্রামী শঙ্করপ্রসাদ দে তাঁর সমাজ কৈবর্তদের ওপরে বই লিখে কর্তব্য করে গিয়েছেন) ১৮০০ সালে বুজিয়ে ফেলে রাস্তা করা হয়।

জেলেপাড়ার সঙ যাত্রা শুরু হয় ১৩২০ থেকে। জেলেপাড়ার সঙ যাত্রার গান লিখতেন রূপচাঁদপক্ষী [গৌরহরি দাস], গুরুদাস দাস, নেপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ইত্যাদি। হিদারাম ব্যানার্জী লেনের ভিতরে রামকানাই অধিকারী লেনে বাস করতেন রূপচাঁদ পক্ষী।

জেলেপাড়ার সঙ যাত্রা শুরু হত রমানাথ কবিরাজ লেন, যেখানে এখন কলিকাতা কৈবর্ত সমিতির প্রধান কার্যালয়, থেকে শুরু করে অক্রুর দত্ত লেন হয়ে ওয়েলিংটন স্ট্রিট[আজকের নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট] হয়ে কলেজ স্ট্রিটে এসে যেত আজকের যেটা দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং, তখন ছিল মাধববাবুর বাজার হয়ে মেছুয়াবাজারে কিছুক্ষণ দাঁড়াত। এবারে আজকের কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট হয়ে টিকটিকির বাজারে খাওয়াদাওয়া করত। সেখান থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট আজকের রামমোহন রায় সরনি হয়ে নেবুতলা লেন, আজকের শশীভূষণ দে স্ট্রিট হয়ে আসত রমানাথ কবিরাজ লেনে। নেবুতলা লেনে একটা গির্জা ছিল নাম ন্যাড়া গির্জা। তার পাশে পদ্মপুকুর। প্রথমে পায়ে হাঁটত সঙ-এর দল। পরে জঞ্জাল ফেলার গাড়িতে বাঁশের মাচা বেঁধে ঘোড়া শুরু হল। পরে হার্ড ব্রাদার্স বা কুক কোম্পানির মোষের ট্রাকে চড়ে সঙ বেরত।

বলাইবাহুল্য রাস্তার দুপাশে সঙ দেখার জন্যে বিপুল জনগণ জমে যেত। এ সময় প্রত্যেক বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসত। অচেনা মানুষদেরও পরিচার সেবন করানোর পরম্পরা গড়ে তুলেছিল। পথে দর্শকদের জন্যে শামিয়ানা টাঙ্গানো থাকত। মহিলাদের আলাদা ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, এখনও জেলেপাড়ার সঙযাত্রা টিকে আছে, আগের মতো বহর নেই, কিন্তু বহমান আছে তার অস্তিত্ব।

শিবপুরের সঙ

একসময় কলকাতার পার্শ্ববর্তী হাওড়া জেলার শিবপুরের কালীকুমার মুখার্জী লেন থেকে সঙ বেরত বিভিন্ন সাজে। থাকত নানান ধরণের বাদ্যযন্ত্র। ধর্মতলা লেন, শিবপুর রোড, রামমোহন মুখার্জী লেন এবং আরও কিছু পাড়া ঘুরে এই সঙের দল ফিরে আসত কালীকুমার মুখার্জী লেনে। এই সঙ-যাত্রায় থাকত বেদে-বেদেনি, বরযাত্রী, জুয়াড়ি, ডাক্তার, উচ্ছন্নে যাওয়া ধনীপুত্র, জোর করে চাঁদা আদায়ের দল ইত্যাদি। গান ছাপিয়ে বিলিও সঙযাত্রার সময় করা হত। সঙের দলের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন গৌরীশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তিনি তৈরি করেছিলেন গৌরীশঙ্কর নাট্য সমাজ। স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য অধিকাংশ গানের রচয়িতা অমূল্যচরণ দাস বা অমূল্য মাস্টার। বলা দরকার যাত্রা দলের গায়ক বাদক শিক্ষককে মাস্টার নামে অভিহত করা হত। অমূল্য মাস্টার ঐ যাত্রা দলে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন। খুব ভাল নাচতেও পারতেন। উপনিবেশিক আধুনিকতার যুগের মানুষ হয়েও এই মানুষেরা কোনও দিন হীনমন্যতা বোধ করেন নি, এদের নিয়ে ভদ্রবিত্তের উপনিবেশিক এপোলোজেটিক সিনেমা গপ্প উপন্যাস নামানোর প্রয়োজন হয় নি।

খুরুটের সঙ

হাওড়াতেই খুরুটে সঙ বার হত – এর নাম ছিল রং-ঢং-সং। এই সঙযাত্রা বের করত শীতলা সঙ্গীত সমাজের সভ্যরা। আবীর দিয়ে তারা স্বাগত জানাত বসন্তকে। দুপুরে স্নানাহারের পর বিভিন্ন সাজে রূপে সেজে বিচিত্র ভূমিকায় বার হত। খুরুটের রং-ঢং-সংএর মধ্যমণি ছিলেন সতীশচন্দ্র দাস বা বিভূতি মাস্টার। মনমোহন থিয়েটাতে হারমোনিয়ম বাজাতেন। সঙ্গীতঅন্তপ্রাণ মানুষ। দল তৈরি করার অসামান্য দক্ষতা ছিল সতীশচন্দ্রের। তিনি কলকাতা থেকে ১৩২০তে খুরুটে বাস উঠিয়ে আসার পর হাওড়ার পঞ্চানন চ্যাটার্জী লেনে তৈরি হয় খুরুট শীতলা সঙ্গীত সমাজ। হাওড়ার জয়নারায়ণবাবু আনন্দ দত্ত লেন হয়ে খুরুট রোড, হারকোর্টস লেন, বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জী লেন, জি টি রোড, পঞ্চাননতলা রোড, কৈলাস ব্যানার্জী লেন, কালীপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন, জি টি রোড, আবার কৈলাস ব্যানার্জী লেন, কালীপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন, নরসিংহ দত্ত রোড, কালাচাঁদ নন্দী লেন, খুরুট সারকুলার রোড ঘুরে আবার ফিরত জয়নারায়ণবাবু আনন্দ দত্ত লেনে। বের হতো দুপুর একটায়। পরিক্রমা শেষ হত বিকেল চারটেয়। অনেকে হাঁটত। বেশ কয়েকটা সঙ রিক্সাগাড়ি চড়ত। প্রতিবছর নতুন নতুন পরিকল্পনা করা হত। গান ছড়া লেখা হত। মিছিলের মাথায় থাকত ভিল আদিবাসীরা আর শেষ হত তর্জার দল দিয়ে। স্বদেশী আন্দোলনের বার্তা সঙযাত্রায় বলা হত। বিদেশি সেন্ট ছেড়ে স্বদেশি আতর ব্যবহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। যে সব অঞ্চলে কিছু সময় দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখানো হত, সে সব অঞ্চলে এই স্থানে সঙ থামিবে বলে পোস্টার লেখা থাকত।

কাসুন্দিয়ার সঙ

কাসুন্দিয়ার সঙের নাম সঙ-বাহার। চড়ক উপলক্ষ্যে গণেশ মাঝি লেনের শীতলা মন্দির থেকে সঙ যাত্রা বার হত। কাসুন্দিয়ার সঙ=এর আরেকটা নাম ছিল মায়ের মন্দিরের সঙ। ১৩৩৬এর পয়লা বৈশাখে শুরু হয়ে দুবছর চলার পরে স্থির হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে নিয়মিত বের হবে। বেলা চারটেয় মায়ের মন্দির থেকে রওনা হয়ে কাসুন্দিয়া রোড, গদাধর মিস্ত্রী লেন, হালদার পাড়া, আজকের নেতাজী সুভাষ রোড, তাঁতিপাড়ায় সারারাত সঙ চালিয়ে ভোরবেলা ফিরত। উনিশ-কুড়ি রকমের সঙ বেরত। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন বিভূতি মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমবিহারী পাড়ুই, মণিমোহন নাথ, কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়। পরিচালক বিভূতি মুখোপাধ্যায়। তাকে সাহায্য করতেন সত্যচরণ মাঝি আর শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

এখনকার চৈত্রসংক্রান্ত্রির সঙযাত্রা, গ্রামবাংলা, পশ্চিমবঙ্গ

বসুবাটির সঙ

হুগলী জেলার সিঙ্গুর থানার বলরামবাটি স্টেশনের কাছে বসুবাটি গ্রাম। এখানে এককালে সঙ বেরত। আশেপাশের দশবারোটা গ্রামের মানুষজন এই সঙ গানে নানাভাবে যোগ দিতেন। অন্যান্য অঞ্চলের সঙ যেমন বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরত, এখানে অন্য রকমভাবে সঙ উদযাপন হত – এখানে যাত্রার মত স্থায়ী আসর বসত। দুর্গাপুজো এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে সঙের আসর বসত। সঙ আয়োজনে মূলত অংশ দিতেন চাষীরা। তারা নিজেরাই গান ছড়া কাটতেন, তারাই গান করতেন। সঙের গান রচনা করতেন মথুরামোহন মালিক। পরিচালনা করতেন অমূল্য পাল। সুর দিতেন সুধীর হালদার। আসর শুরু হত বিকেল চারটেয় শেষ হত রাত দশটায়। বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায় লিখছেন, এর পাশেই বারুইপাড়া, জালাপাড়া ইত্যাদি এলাকায় সঙের প্রতিযোগিতা হত। এই দুই গ্রামের মেলা বাসি চড়ক নামে পরিচিত ছিল।

জনাই বেগমপুরের সঙ

রেণুপদ মুখোপাধ্যায়ের সেকালের জনাই বই থেকে উল্লেখ করে বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, হুগলী জেলার বেগমপুরের সঙ বিখ্যাত ছিল। চৈত্রর শেষে জনাইএর মানুষ বেগমপুরে গিয়ে সঙ গেয়ে আসত। তার পরে এটা জনাইতে এসে জনাই গ্রাম প্রদক্ষিণ করত। আদান, পায়রাগাছা, বাঁশগাছা, হাটপুকুর এবং আরও কিছু গ্রামের মানুষ জনাইএর হয়ে বেগমপুরে গান গাইতে যেতেন। বেগমপুর থেকে জনাইতে বৈশাখের প্রথম বা কোনও ছুটির দিন সঙ পাঠানো হত। বেগমপুরের দলের সঙ্গে তাজপুর, খরসরাই, উত্তর আদান থেকেও দল যেত। তারা অনেকেই কলকাতা থেকে প্রতিষ্ঠিত সুগায়ক নিয়ে যেতেন। শেষ উদ্যক্তাদের মধ্যে ছিলেন মঙ্গলময় মুখোপাধ্যায় এবং পাঁচকড়ি মেদ্দার; তার সঙ্গে থাকতেন বেগমপুরের গোকুল হাম্বির খরসরাইএর কৃষ্ণচন্দ্র দাস। সাধারণত সন্ধ্যার পরে সঙ বেরত। মিছিল বেরোবার আগে হনুমান গ্রাম প্রদক্ষিণ করত। হনুমানকে দেখে গ্রামবাসীরা জানতে পারতেন গ্রামে সঙ বেরোচ্ছে। কিছু পরে গান গেয়ে সঙের দল বেরোত। মাঝেমধ্যে দল এত বড় হত যে অনেক সময় প্রদক্ষিণ করতে করতে ভোর হয়ে যেত।

শ্রীরামপুরের সঙ

হুগলীর শ্রীরামপুর থেকে দুটো সঙ বের হতো। একটা রওনা হ্তো জি টি রোড থেকে। এদের নাম কালীপাড়ার সঙ। এই দল পরিচালনা করতেন স্থানীয় তাঁতিরা। আরেকটা দল বেরোতো শ্রীরামপুর বটতলা থেকে। এর নাম ছিল বটতলার সঙ। এটার আকর্ষণ তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। শ্রীরামপুর বটতলা দলের সঙের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গঙ্গাধর ঘোষ। তারপরে অধর ঘোষ কিছু দিন চালান।

এই দুই দল নীল ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বের হত। ছেলেরা মেয়েরা সন্ধ্যা হলেই সেজেগুজে বরণডালা জলের কলসি, শঙ্খ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সঙের উলুধ্বনিতে সমগ্র এলাকা মুখরিত হয়ে উঠত। আবার সঙের দলটা বেরত রাত নটায়। দুই দল কয়েকবার মুখোমুখি হয়ে মারামারির উপক্রম হওয়ার স্থানীয় মুরুব্বিরা আলাদা আলাদাভাবে সঙ বেরোবার রাস্তা বাতলে দেন। পরের দিকে দুটো দল আলাদা আলাদা পথে ঘুরত।

দুইদলই ময়ূরপঙ্খী বাঁশ, কাপড় কাগজ ইত্যাদি দিয়ে রঙিন নৌকো তৈরি করে গরুর গাড়িতে তুলে ঘুরতেন। নৌকোতে বেশ কয়েকজন সঙ আলাদা করে গান গাইত। আর থাকত প্রকাণ্ড মাটির তৈরি শিব। তিনি চলেছেন বিয়ে করতে, গাজনের সন্ন্যাসী আর সঙের দল বরযাত্রী। এই সঙকে বলা হত হরগৌরী বিয়ের মিছিল। তাছাড়া অনেকেই বাউল সেজে সঙের দলের সঙ্গে ঘুরতেন।

সঙের দলের জনপ্রিয়তার পিছনে ছিলেন বিখ্যাত ইস্কুলের হেডমাস্তার গৌরীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। জনগণের নানান অভাব অভিযোগ সঙের গায়কদের মাধ্যমে জানানো হত। যেমন অঞ্চলের বিখ্যাত টুনিমুনি শ্মশান ঘাটের কথা। এই শ্মশান ঘাটের সমস্যা নিয়ে গান গাওয়ার পর সেবারে মিউনিসিপ্যালিটি এবং স্থানীয় দাতাদের পাকা ঘাট, শবযাত্রীদের জন্যে বিশ্রামের জায়গা ইত্যাদি তৈরি হয়।

আগেই বলেছি মাটির তৈরি শিবমূর্তি নিয়ে সঙের দল ঘুরত। পথে যে বাড়িতে গৌরীমূর্তির পুজো হতো সেই বাড়িতে শিবকে নিয়ে বরযাত্রী সঙেরা উঠত; এবং জলখাবার খেয়ে রাতে যে যার বাড়ি ফিরত। সকালে যুবকেরা হরগৌরী নিয়ে বিসর্জনের মিছিল বার করতেন।

রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে পুরাতনী গান ‘আমি জেলে পাড়ার সঙ’

বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশ্বেন্দু নন্দ

লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share