এক টুকরো মাংস

ছোটগল্প

।। তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ ।।

ওরা বিশ্বকর্মাকে কোপাতে কোপাতে বলে, “শালা মৌলবাদী, জামাত-শিবির”! বিশ্বকর্মা তার পৈতা দেখাতে থাকে আর বলতে থাকে, “আমি হিন্দু, হিন্দু! আমি শিবির না! আমাকে মাইরেন না ভাই!”

সেলাই মেশিনে সেলাই করতে করতে বিশ্বকর্মার কানে আসে কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটার কচকচ শব্দ। দোকানে সে ছাড়া কেউ নাই। সে ভাবতে থাকে তার সেলাইয়ের শব্দ তাকে অন্যমনস্ক করে ফেলেছে, এই শব্দ তার মাথার সৃষ্টি। কিন্তু সে একটু পরেই আবিষ্কার করে বাইরের রাস্তায় শব্দ হচ্ছে। শব্দটা এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। কী হচ্ছে দেখার চেয়ে বরং কিছুটা বিরতি নেবার জন্যই সে সেলাই মেশিন ছেড়ে উঠে এসে দোকানের শাটার খোলে। আজ হরতাল বলে শাটার বন্ধ রেখে দোকানে কাজ করছিল বিশ্বকর্মা। ছোট্ট কোনো এক মেয়ের জামার একটা হাত সেলাই করেছে, বাকি হাতটা না থাকায় কেমন বেখাপ্পা লাগছিল জামাটাকে। শাটারটা খুলতেই বিশ্বকর্মা দেখে পাঁচ-ছ’জনের একটা দল “ঐ ধর ধর” বলতে বলতে হাতে রামদা নিয়ে দৌড়ে আসছে। সে আঁতকে উঠে শাটার বন্ধ করতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ওরা ছুটে এসে শাটার ধরে ফেলে আর টান দিয়ে বিশ্বকর্মাকে রাস্তায় নামিয়ে আনে। বিশ্বকর্মা বুঝতেই পারে না এটা বাস্তব না স্বপ্ন। ফলে সে চুপ করে থাকে। কিন্তু যখন তাকে কোপানো শুরু হয় এবং সে ব্যথা পেতে আরম্ভ করে তখন সে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে পারে এটা বাস্তব তো বটেই অথবা পরাবাস্তব। ওরা বিশ্বকর্মাকে কোপাতে কোপাতে বলে, “শালা মৌলবাদী, জামাত-শিবির”! বিশ্বকর্মা তার পৈতা দেখাতে থাকে আর বলতে থাকে, “আমি হিন্দু, হিন্দু! আমি শিবির না! আমাকে মাইরেন না ভাই!” কিন্তু ঐ আক্রমণকারীদের দরকার ছিল লাশ। কারণ তাদের দরকার ছিল ভয় দেখানো। আর পরিচিত বা প্রতিপক্ষের বড় নেতাকে হত্যা করা যাবে না তা তারা জানে। তাদের শিকার সবসময়ই ছোটরা। আর মৃত্যুর সময় মানুষ কতো কিছু বলেই না চিৎকার করে! বিশ্বকর্মা বারবার নিজেকে ‘হিন্দু’ বলে চিৎকার করলেও তারা বিশ্বাস করেনি। কারণ তাদের কারো পৈতা চেনার মত চোখ ছিলো না। অথবা এতে তাদের কিছু যায় আসে না!  

পাশে দাঁড়িয়ে যখন আমি এই ঘটনার ছবি তুলছিলাম তখন আমার মনে নাই অমি ঠিক কতটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি কি সেই ঘটনাস্থলেই ছিলাম নাকি আমি ফেসবুকে লাইভ দেখছিলাম? নাকি আমি রোমান কলোসিয়ামে বসে পপকর্ন খাচ্ছিলাম? আমি বুঝতে পারলাম ঘটনার আকস্মিকতায় আমি উল্টাপাল্টা ভাবছি। আমাকে এমন কিছু ভাবতে হবে যাতে আমি বাস্তবে ফিরে আসি। আমি অনেকক্ষণ চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে শেষে আর পারলাম না। অন্ধকার কুয়ার মত কোথাও আমি ঢুকে গেলাম। এক টুকরো মাংস আমার গায়ে ছিটকে পরতেই আমার বোধোদয় হয়। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি একটা লম্বা ট্রলিতে শোয়া। ডাক্তারদের ছুড়ির খোঁচায় জেগে উঠি। কেউ একজন আমার বুকের ওপর থেকে একটা মোটা সূতা বা চিকন দড়ির মত কিছু সরিয়ে ফেলে দেয়। হুঁশ হয়, এটা পৈতা আর আমি সম্ভবত মৃত।

পোস্টমর্টেম শেষ করে আমাকে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে হস্তান্তর করার সময় দুইটা পরিবারের পক্ষ থেকে আমার লাশের জন্য দাবি ওঠে। বিশ্বকর্মার পরিবার ও আমার পরিবার। আমি অত্যন্ত ভীত হয়ে উঠি কারণ আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আমাকে কি ওরা পোড়াবে? আমি তো মুসলিম! কিন্তু তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব ঘটে। তারা অত্যন্ত ব্যথিত স্বরে বলে, তারা এই মৃত্যুর বদলা নেবে এবং একে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। শক্তিশালী হওয়ায় তারা আমার লাশ বিশ্বকর্মার বা আমার পরিবারকে না দিয়ে ঠান্ডা এম্বুলেন্সে ওঠায়। এম্বুলেন্সসহ তাদের দলটি শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কারণ সর্বস্তরের জনসাধারণ সেখানে এসে মৃত ব্যক্তিটিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। অনেকদিন আগে আমাকে একজন বন্ধু বলেছিলেন, শহীদ মিনার মসজিদ বা গির্জা না হলেও এখানে লাশ রাখা হয় এবং লাশকে সম্মান জানানো হয়। এটি একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ জায়গা।

শহীদ মিনার যাত্রাটা বেশ উপভোগ্য হয়। এম্বুলেন্সের ঠান্ডায় শুয়ে থাকতে আমার বেশ আরাম লাগে। বাইরের কাঠফাটা রোদের তাপ টের না পেয়ে এম্বুলেন্সে শুয়ে দুলতে দুলতে আমার একটা কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। ফটোগ্রাফার ছাড়াও আমার একটা কবি পরিচয় আছে বৈকি! সেটা নিয়ে চাপা অহংকারে আমি মনে মনে লিখতে থাকি,

বুনো হাঁসের মাংস খাও, নরম শিশুর চিবুক যেমন। মাছ আর কচ্ছপ থাকুক পাশাপাশি।
ভ্রুণটা যখন তোমার হাতে পেট গলিয়ে বেরিয়ে এলো, রক্তে ভেজা, তাজা, মরা, সেই ছবিটা বাঁধাই করি।
ফর্সা নখে একবিন্দু পানি।
মোমের মতন ঠোঁট-কান, পালিশ করি, পালিশ করি।
হালকা কেমন সাদা সাদা লাগে।
মাথায় কেমন ঘাস পোড়ানো চুল, কালচে হয়ে নামছে হাঁটুর নিচে।
ঘৃণায় তুমি ঘৃণা বাড়াও, ঘৃণা বাড়াও, ঘৃণাই বাড়াও!
শিশু তুমি প্লিজ এসো না আর…”

এম্বুলেন্সে আমার পাশে বসে থাকা দু’জন বৃদ্ধের খুচরা আলাপের কারণে আমার মনে মনে লেখাটা আর আগাতে পরি না। আমি বিরক্ত হয়ে তাদের কথার পুনরাবৃত্তি শুনতে থাকি।

শহীদ মিনারে আমার লাশ পৌঁছায়। সকলে লাশের কাছে ভীড় করে ঘেষে আসে। কিন্তু আমার লাশের মুখ খুলতেই তুলকালাম কান্ড ঘটে। একজন এগিয়ে এসে বলেন, “নাহ্, এতো আমাদের বুদ্ধিজীবী নয়! এতো ওদের বুদ্ধিজীবী। শহীদ মিনার পবিত্র স্থান। শহীদ মিনারকে এর লাশে কলুষিত করা যাবে না।”

অথচ আমি কোনোকালেই বুদ্ধিজীবী ছিলাম না। এর বা তার দলের তো নয়ই। এসব নিয়ে বেশ একটা হাঙ্গামা বেঁধে গেলো। কারণ তারাই আমাকে প্রথম তাদের লোক মনে করেছিলো। এখন বুঝতে পারছে, তারা ভুল ভেবেছিলো। এর মাঝে দেখি সারা গায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক তরুণ এসে বলছে, “এটা আমার লাশ। এই ফটোগ্রাফার চুরি করেছে।” খেয়াল করে দেখি এ সেই বিশ্বকর্মা। আমার মনে হচ্ছিল এই ব্যান্ডেজ বাঁধা বিশ্বকর্মাকে আমি খুন করি! নির্বোধ! তোর লাশ আমি কীভাবে হবো! কিন্তু লাশ হবার কারণে কোনো কথাই আমি বলতে পারলাম না।

ওরা বিশ্বকর্মাকে আমার লাশটা দিয়ে দেয়। বিশ্বকর্মা একটা তিন চাকার অটোরিক্সায় চাপিয়ে আমাকে আবার ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এনে ঢুকায়। আমাকে ট্রলিতে শুইয়ে দিতে ওর একটু হাঁফ ধরে। একটু বড় শ্বাস নিয়ে সে কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়, তারপর ওর পেট থেকে একটা মেমোরি কার্ড বের করে বলে, “এটা আপনার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড”। বিশ্বকর্মার চেহারার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার ছেলেবেলার এক বন্ধুর কথা মনে পরে। নামেও দু’জনের মিল আছে। আমার বন্ধুর নাম ছিলো বিশ্বজিৎ। সংক্ষেপে ওকে আমরা ‘বিশ্ব’ বলে ডাকতাম। ওর বাবা রাজনীতি করতো। রাজনৈতিক কোন্দলের জেরে একই দলের আরেক নেতা বিশ্বকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ওর লাশ যখন ভেসে উঠল শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে, তখন মাছে তার বেশিরভাগটাই খেয়েছে। লোকে বলে, নদীর রাক্ষুসে মাছের নাকি যে কোনো মরা প্রাণীর চোখ খুব প্রিয়। লোকেরা বলাবলি করছিল, মাছে নাকি বিশ্ব’র নরম বড় বড় চোখগুলো আগে খেয়েছে। এরপর বহুদিন আমি মাছ খেতে পারিনি। মা যখন মাছের মাথা জোর করে পাতে তুলে দিত, আমি শুধু মাছের চোখটার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। একসময় বমি করে ফেলতাম।

ঠিক করলাম, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা বিশ্বকর্মাকে আমি ‘বিশ্ব’ বলেই ডাকব।

বিশ্ব আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করে। আমি বেশ বসতে পারলাম। বিশ্ব বললো, এই মেমোরি কার্ডে বিশ্বকে রাস্তায় কোপানোর ছবিগুলো আছে যা আমি তুলেছিলাম। সে জানালো, আমার মরার কারণে এই ছবিগুলো প্রকাশ হচ্ছে না। আর আমার লাশের চাপায় তার লাশ গায়েব হয়ে গেছে। ফলে তার লাশ ফেরত দিয়ে আমি যেনো এই ছবিগুলো ছাপাই।

আমি মেমোরি কার্ডটা হাতে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি বিশ্ব নাই। ও ঐ ট্রলিটাতে শুয়ে আছে। তার শাদা শার্ট রক্তে ভিজে লাল টকটকে। কপালে, হাতে, বুকে সব জায়গায় বড় বড় কোপের চিহ্ন। ও এখন মৃত। আমার সারা গায়ে বিশ্ব’র রক্ত ও কিছু মাংসের কুচি লেগে আছে। মনে হচ্ছে কসাইখানা থেকে আসলাম। কিন্তু আমি কীভাবে জানলাম ওর নাম বিশ্বকর্মা? ও যখন চিল্লাচ্ছিল, “আমি হিন্দু! হিন্দু! আমি শিবির না!” তখনই কী যেন ওর নামটা বলেছিল!

আমি মেমোরি কার্ডটা হাতে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আমার পত্রিকা অফিসে যাই। বিশ্বকে কোপানোর ছবিগুলো পরদিন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। সবগুলো খুনির চেহারা পরিস্কার। ফলে কয়েকদিনের মধ্যে তাদের সবার পরিচয় বের হয়ে আসে।

গল্পটা এখানেই শেষ হতো। যেহেতু প্রমাণসহ খুনিদের পরিচয় মিলেছে। বিচার শেষে তাদের শাস্তি হবে। কিন্তু দু’বছর বাদে যখন রায় হলো তখন সবাই মুক্তি পেলো।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, এই সাজানো নাটক আমি কীভাবে এত ভালো করে নির্দেশনা দিলাম এবং ছবি তুললাম! অথচ বিশ্বকর্মা মারা গেছে। কিন্তু সে কি আসলে খুন হয়েছিলো? নাকি সে এমনি এমনি মরেছে? আমি কি ছবি তোলার রসদের জন্য ক’টা ছেলেকে খুনি সাজিয়ে ছিলাম? রিয়েলিস্টিক ফিল্ম শ্যুট করার মত সেট করে ছবি তুলেছিলাম?  নিশ্চই তাই। নইলে তো এই ছবি দিয়েই প্রমাণ হতো যে এরা খুনি। তার মানে আমি দোষী। কিন্তু কেনো আমি এই কাজ করতে গেলাম?

আমার মনে হতে থাকে এই জট আমাকে খুলতে হবে। আসলেই বিশ্বকর্মাকে কোপানোর ঘটনাটি ঘটেছিল নাকি আমি সাজিয়ে এই ছবিটি তুলেছিলাম তা জানতে হবে। আমি বিশ্বকর্মার সেই দর্জি দোকানটায় যাই। দেখি সেটা খোলা ও বিশ্বকর্মার বড় ভাই সেখানে বসা। একপাশে একটা সেলাই মেশিনে একটা বাচ্চা মেয়ের লাল রঙের জামা অর্ধেক সেলানো অবস্থায় পড়ে আছে। জামার শরীরের সঙ্গে একটা হাত লাগানো ও অন্য হাতটা নাই। দেখে মুন্ড ও ধড়হীন একটি শিশুর মত লাগে। আমি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বিশ্বকর্মার ভাইয়ের দিকে তাকাই। তিনি একমনে অন্য একটি সেলাই মেশিনে একটা বড় রুমাল সেলাই করছিলেন। সেলাই শেষ হলে তিনি বলেন, বিশ্বকর্মার কাজের জায়গাটি উনি সেরকমই রেখে দিয়েছেন যেরকম ছিলো তার মৃত্যুর দিনটিতে। আমি তাকে বলি, বলেন তো বিশ্বকর্মা কীভাবে মারা গেছে? তিনি অবাক হয়ে বলেন, “সেটা তো আপনি সবচেয়ে ভালো করে জানেন!” কিন্তু আমি তাকে বলি যে, আমি আসলে জানি না। তিনি যেনো আমাকে জানান। তিনি প্রথমে বিরক্ত হন এরপর ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে দোকান ঘর থেকে বের করে দেন।

আমি দোকান ঘরটার নাম খেয়াল করি। ‘নিমন্ত্রণ সেলাই ঘর’। এরপর আমি আশে পাশের কিছু দোকানদারকে, পথচারীকে ও ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করি, “বলেন তো বিশ্বকর্মা কী করে মারা গেছে?” তারা কেউই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না। তারা কেবল এদিক সেদিক তাকায়। তাদের কেউ বলে, দেখেন ভাই আমরা মুসলমান কিন্তু আমরা জামাত-শিবির করি না। আর কেউ কেউ বলে, দেখেন দাদা, আমরা হিন্দু। আমাদের জামাত-শিবির করার প্রশ্নই ওঠে না। আমার তখন মনে পরে, বিশ্বকর্মাও কোপ খাবার সময় এই কথাগুলো বলছিল। শেষে এক ভিক্ষুক আমাকে জানায়, যে রিক্সাচালকটি বিশ্বকর্মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, এবং পরবর্তীতে কোর্টে স্বাক্ষ্য দিয়েছিল তাকে পুলিশ বেশ পিটিয়েছে! কিন্তু কেন পিটিয়েছে তা ভিক্ষুকটি আমাকে জানাতে পারে না। রিক্সাচালকটির কোনো খোঁজও নেই। হয়তো সে গ্রামে ফিরে চাষ-বাস করে খাচ্ছে। ফলে বিশ্বকর্মাকে নিয়ে কেউ কথা বলছে না।

এর মাঝে এক পাগল আমাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর দিলো। সে জানাল, এলাকার হিন্দুদের ঘরে ঘরে দেবতা বিশ্বকর্মার পূজা করা বন্ধ হয়ে গেছে! অথচ এখানে স্বর্ণকার, কামার ও মৃৎশিল্পীরা রয়েছে। তাদের ব্যবসা বানিজ্যও চলছে।

আমি কোনোভাবেই কারো কাছে জানতে পারলাম না আদৌ বিশ্বকর্মা কিছু ছেলের হাতে রাম দায়ের কোপ খেয়ে মারা গেছে কিনা! অথবা কোনো এক ফটোগ্রাফার এমন কোনো কিছু সাজিয়ে ছবি তুলেছিলো কিনা। কোনো কিছু নিয়েই সেই এলাকার কেউ কিছু না বলায় আমি আরো হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরি। আমার মনে হতে থাকে একমাত্র বিশ্বকর্মাকেই হাজির হতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যে সে কীভাবে মারা গেছে! কিন্তু তার দেহ তো চিতায় ভস্মীভূত হয়ে গেছে। অথবা সে ফিরে এসে তার খুনের কথা বললেই আদালত তা বিশ্বাস করবেন তার কি গ্যারান্টি? তার খুনের স্বপক্ষে তার প্রমাণ কী?

আমি আমার অফিসের চেয়ারে বসে বা বাড়ির খাটে শুয়ে ভাবতে থাকি, একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে আমি মূলত একজন শিল্পী। শিল্পীর কাজ সত্য নির্মাণ করা। সাথে সাথে মনে হয় আমি ভুল ভাবছি। কারণ যে ছবিটি আদালতে বিশ্বকর্মার খুনের প্রমাণ হিসেবে গ্রহনযোগ্য হয়নি তা তো সত্যি নয়। ফলে আমি সাজিয়ে গুছিয়েই বিশ্বকর্মার খুনের ছবিটি তুলেছি। আমি তখন নিজেকে স্বান্ত্বনা দেই এই বলে যে, একজন শিল্পীর কাজ মিথ্যাকে সত্যের মত করে নির্মাণ করা যেন তা বিশ্বাসযোগ্য হয়। কিন্তু এই কথাটা আমার বিশ্বাস করতে একটু অস্বস্তি হয়। আমি তিতা কালো কফিতে চুমুক দিতে থাকি। বিস্বাদের স্বাদ নিতে থাকি। পুরো মুখে নরম তিতকুটে ঢেউ, প্রায় পোড়া আলুর গন্ধ আর ধোঁয়াময় ছোট ছোট ধাক্কা। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বিস্বাদের স্বাদ হয়, বিষাদেরও কি স্বাদ হয়?

বিশ্বকর্মার মাংসের কুচি আমার গায়ে ছিটকে এসেছিলো বলে আমার স্মৃতিতে আছে। কিন্তু আমার কোনো স্মৃতিই আর আমি বিশ্বাস করতে পারি না। মাংসের দাম বাড়ায় মাংস না খাবার উছিলায় আমি কি এই স্মৃতি তৈরি করেছি?

এক বিশ্ব মরে আমার মাছ খাওয়া বন্ধ করেছিলো। আরেক বিশ্ব মরে আমার মাংস খাওয়া বরবাদ করছে। মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে গেলে যখন কাঁচা মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়, তখন আমার মনে হয় এখনি চাপাতির কোপে টুকরো হয়ে ওঠা মাংসকুচি ছিটকে ছিটকে আসবে আমার শরীরে। যেই মাংসের উৎকট গন্ধ আমার সকল মাংসের তরকারি খাওয়ার বাসনা নষ্ট করে দিয়েছে। আমি কোনো দাওয়াতে যেতে পারি না। কোনো বড় রেস্টুরান্টে খেতে যাই না। সবখানেই মাছ বা মাংসের তরকারী থাকে। সেগুলো সামনে থাকলেই আমার রুচি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমি বন্ধু হারাতে থাকি। আমার অসামাজিক পরিচয় বড় হয়ে ওঠে। আমি একা হতে থাকি। কেবল কালো কফি আমার সাথি হয়।      

এর মাঝেই একদিন আমার কাছে একটা চিঠি আসে।

সেই চিঠির মাঝে ছিলো একটা পুরস্কারের খবর। বিশ্বকর্মাকে কোপানোর ঐ ছবিটা তোলার জন্য আমি একটা বিশ্বখ্যাত ফটোগ্রাফি পুরস্কার লাভ করি। আমার মনে হতে থাকে, এই পুরস্কার পাবার জন্যই কি আমি বিশ্বকর্মাকে কোপানোর ছবিটি তুলেছিলাম? এবং তা আমি পরিকল্পনামাফিক সাজিয়ে তুলেছিলাম? কিন্তু বিশ্বকর্মা মারা গেল কীভাবে? সে তো ছবিটার কারণে মারা যায়নি। এসব ভাবনায় আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। বিষয়টা এমন না যে, এরকম একটা সাজানো ছবি তুলে আমি অপরাধবোধে ভুগছিলাম। বরং আমার মনে হতে থাকে, যদি সেই পুরস্কারদাতারা জানতে পারেন আমি সাজিয়েগুছিয়ে এই ছবিটা তুলেছি, তাহলে তা আমার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত খারাপ হবে। ক্যারিয়ারে ধ্বস নামবে। যেহেতু ছবিটা প্রমাণ হিসেবে বিচারালয়ে ধোপে টিকেনি, তার মানে ছবিটা মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত। আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে আমি তাদের একটা চিঠি দেই, জানাই, ঐ ছবিটা বানানো। ফলে একে আর বাড়তে দেওয়া যায় না।    

লেখক পরিচিতি
তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ

বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পড়ালেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে অডিও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ শুরু করেন, প্রথম পরিচালিত প্রামাণ্য-চলচ্চিত্র, ‘রূপান্তরের রূপকথা’। বাংলাদেশ তিনটি টেলিভিশনে সাংবাদিকতা এবং অনুষ্ঠান প্রযোজনার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ, নাসির উদ্দীন ইউসূফ বাচ্চু, রুবাইয়াত হোসেনের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ‘কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি’, ‘নায়িকার এক রাত’, ‘পারফর্মার’ এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ‘টোকাই ২০১২’, ‘বিসর্জন’, ‘তারপর হবো ইতিহাস’, ‘বীর’ ইত্যাদি। তিনি জুরি হিসেবে নেপাল, ভারত এবং মিশরের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর লিখিত প্রথম ছোটগল্পের বই ‘বাক্সবন্দি’ আদর্শ, বাংলাদেশ প্রকাশনা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘কাক’ নিয়ে কাজ করছেন।

Share