এই ভাঙাচোরা মুখ, তার ইতিহাস

।। শৌভ চট্টোপাধ্যায় ।।

“এখন আর মনে নেই, ঠিক কতদূর তারা হেঁটে গিয়েছিল। এমনকী, সময়ের চেতনাও প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছিল তাদের। রাস্তার দু’ধারে, ভাঙাচোরা বাড়িঘর, বাজার, পরিত্যক্ত কলকারখানা আর ইশকুল, মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিরাট ও জনহীন ধ্বংস্তূপের ভেতর, কোথাও কোনো চলাচল নেই, আসা-যাওয়ার প্রত্যাশাও নেই কোনো। যেন এক স্থির, অপরিবর্তনীয় স্মৃতির বরফ-জমাট শরীরের মধ্যে ভুল করে ঢুকে পড়েছে তারা।”


“I teach you Superman. Man is something that should be overcome. What have you done to overcome him?”
Friedrich Nietzsche, Thus Spoke Zarathustra, Trans. R. J. Hollingdale

এই ভাঙাচোরা মুখ, তার ইতিহাস

রক্তের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারি, একদিন
এই পথ দিয়েই আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম
নিচু হয়ে, কুড়িয়ে নিয়েছিলাম পাথর,
আর পথে-পথে ছড়ানো আমাদের হৃৎপিণ্ডগুলি
কুশলসংবাদের আশায়,
সমস্বরে হইহই করে উঠেছিল

শিকলের শব্দকে গান ভেবে, আমরাও তাতে
গলা মিলিয়েছি। নাচতে নাচতে,
আমাদের শরীর থেকে খসে পড়েছিল পোশাক
আমাদের চোখ থেকে অন্ধকার ঝরে পড়েছিল
আমরা অবাক হইনি
আমরা দুঃখিত হইনি
বেজন্মা বাচ্চাদের গলায় দড়ি বেঁধে
হাসতে-হাসতে লটকে দিয়েছি জাল ওকালতনামা

রক্তে আর ঘামে কাদা হয়ে যাওয়া মাটির ওপর
আমাদের পায়ের ছাপ, বহুদিন পর
যখন তুমি আবিষ্কার করবে, তখনও
অনেক উঁচুতে, বাজ-পড়া ডুমুরগাছের মাথায়
একটি শকুন বসে আছে, এবং
আড়চোখে লক্ষ করছে তোমাকে

আড়চোখে সে লক্ষ করছিল, কখন
তুমি তাকে দেখতে পাও, আর বিস্ময়ে
তোমার চলার গতি ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসে

সে জানত, সমস্ত পথের শেষেই
তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তোমার,
যেকোনো ফিরে আসার গায়েই তার ছায়া
পুরোন ক্ষতের মতো লেপ্টে থাকবে, নাছোড়

ফলত, উদ্দেশ্যহীন এই চলার ভঙ্গিমায়
তুমি প্রাণপণ চেষ্টায় ফুটিয়ে তুলতে চাইবে
একটা ছন্দের আভাস। অথচ, তার আগেই
অন্ধকার হয়ে আসবে, আর পেছন থেকে
সে তোমার নাম ধরে ডেকে উঠবে, যখন

বজ্রগর্ভ মেঘের ভেতর থেকে চাপা
একটানা গুমগুম আওয়াজ
ভেসে আসছে, কোনো
ছায়া পড়ছে না মাটিতে, শুধু মাথার ওপর
উপুড় হয়ে আছে একটা প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাস।

এখন আর মনে নেই, ঠিক কতদূর তারা হেঁটে গিয়েছিল। এমনকী, সময়ের চেতনাও প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছিল তাদের। রাস্তার দু’ধারে, ভাঙাচোরা বাড়িঘর, বাজার, পরিত্যক্ত কলকারখানা আর ইশকুল, মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিরাট ও জনহীন ধ্বংস্তূপের ভেতর, কোথাও কোনো চলাচল নেই, আসা-যাওয়ার প্রত্যাশাও নেই কোনো। যেন এক স্থির, অপরিবর্তনীয় স্মৃতির বরফ-জমাট শরীরের মধ্যে ভুল করে ঢুকে পড়েছে তারা।

সরু-সরু অলিগলি দিয়ে, রাবিশের স্তূপ এড়িয়ে হাঁটতে-হাঁটতে, একসময়ে তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। এতটুকু হাওয়া নেই, পোড়া ধাতুর গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। তারা দেখেছিল, পাথরের দেয়ালে, ইঁটে, খোদাই করা দুর্বোধ্য সব সংকেত, অচেনা হরফ। তাদের কি পাঠোদ্ধার করার কথা ছিল?

ঠিক তখনই একটা ছায়া, চুপিচুপি, তাদের পিছু নিয়েছিল। যতবার তারা পিছন ফিরে তাকায়, ততবার বদলে যেতে থাকে তাদের যাত্রার সূচনাবিন্দুটি। এমনকী, এই রাস্তাও যে স্থির নয়, খুব সন্তর্পণে পালটে ফেলছে নিজের অভিমুখ, সে-কথাও আর গোপন থাকেনি। গন্তব্যের উল্টোপিঠে যে-অনিশ্চয়তা, কয়েকমিনিট থেমে, সেদিকেই ওরা পা বাড়িয়েছিল তখন।

বহুদূরে, একটা পাহাড় না কি টিলা, মরীচিকার মতো একবার ভেসে উঠে, মিলিয়ে যাচ্ছে আবার। ওরা ভাবছিল, যারা যায় আর যারা ফিরে আসে, তারা কি একই মানুষ?

স্কেচ: শঙ্কর কর্মকার

শৌভ চট্টোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। জন্ম ১৯৮৩ সালে। বেড়ে ওঠা হাওড়ার শিবপুরে। পড়াশোনার সুবাদে কিছুদিন লাখনৌতে বসবাস। এবং, বর্তমানে, কর্মসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা। প্রায় দেড়-দশক যাবৎ কবিতা লিখছেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অনুবর্তন, কৃত্তিবাস, কৌরব, দাহপত্র, নতুন কবিতা, শুধু বিঘে দুই, যাপনচিত্র ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকায়। এ-যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার—‘অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য’ (২০০৯, ডি কোং), ‘মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ’ (২০১৩, নতুন কবিতা), ‘মায়াকানন’ (২০১৬, সৃষ্টিসুখ), এবং ‘নিঃশব্দে অতিক্রম করি’ (২০১৯, শুধু বিঘে দুই)। যুক্ত ছিলেন ‘অবসরডাঙা’ ও ‘ব্রজী’-নামক দুটি পত্রিকার সঙ্গেও।

Share