উনবিংশ শতকে বাংলা ভাষার সংস্কার,মাহুতের কানাপোলা এবং শূকর পোষা সাহেব

।। রাজু আহমেদ মামুন ।।

উনবিংশ শতকের তথাকথিত বাংলা ভাষা সংস্কারকদের হাতে প্রচুর দেশি শব্দ তথা বাংলা শব্দ ইতরজনের ভাষা বলে ব্রাত্য হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আজও বাংলা সিন্টাক্সের উপর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তৈরি হয় নি। শুরুতেই আমাদের বামুন মানস ব্রাত্যজনের এই ভাষাকে পবিত্র করার জন্য তাল-তাল সংস্কৃতের মৃত শব্দ যেমন ঢুকিয়েছে তেমনই বানান এবং ব্যাকরণও সেদিকে টেনে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে, ফলে বাংলা ব্যাকরণের অর্ধেক হয়েছে ইউরোপীয় ভাষার আর অর্ধেক সংস্কৃতের। কিন্তু বাংলা যে আরবি ফার্সি, সংস্কৃত কিংবা ইংরেজি ভাষা নয়- একটি সম্পুর্ণ আলাদা ভাষা, এর বাক্য গঠনের যে একটা নিজস্ব রকম আছে- তা নানা কিসিমের দালাল এবং সাম্প্রদায়িক পন্ডিতরা ভুলেই গিয়েছিল। আর সেই ভুল প্যারাডাইমে আজও চলছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।

উনবিংশ শতকে বাংলা ভাষার সংস্কার,মাহুতের কানাপোলা এবং শূকর পোষা সাহেব

এক প্রাচীন রাজার হস্তিশালায় অনেক মাহুত কাজ করতো। কালক্রমে রাজা ও রাজ্যের বিলুপ্তি হলো। কিন্তু মাহুতের গুষ্টি গৃহে হাতি পালে, হাতি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে, খেলা দেখায়, অং-বং-সং করে, চাল-ডাল-কলা-মরিচ-সহ নানারকম দ্রব্য জনগনের কাছ থেকে দক্ষিণা হিসেবে নেয়, এতে সংসার কোনোমতে চলে। এভাবে তারা হাতির খেলা দেখাতে দেখাতে আশেপাশের নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ে, আয় বুঝে নতুন দেশে স্থায়ী আবাস গড়ে।

তো, বহুকাল পরে নতুন দেশের এক মাহুতের ঘরে জন্ম হয় এক কানা ছেলের, সে চোখে দেখে না কিন্তু পিতার সাথে হাতি পালতে পালতে বেশ দক্ষ মাহুত হয়। যদিও সেই দেশের প্রধান পশু হলো গরু।

যাই হোক, বহুদূরের বিদেশি একদল সাহেব হঠাৎ সেই দেশটিকে দখল করে নেয়। সাহেব শাসকরা দেখলো, এই নতুন দেশ থেকে সম্পদ লুটতে গেলে গরু নামক প্রাণীটিকে কাজে লাগাতে হবে, এর জন্য রাখাল নিয়োগ করা দরকার, এর একটা বিবরণ তৈরি করা দরকার। যাতে তাদের সাহেব যুবাদের লুঠতে সুবিধা হয়।

যেই ভাবা সেই কাজ। চারদিকে রাখাল নিয়োগের খবর হতেই মাহুতের কানা পোলাও এসে হাজির। সাহেবকে বলে – ‘হুজুর আমার চৌদ্দ গুষ্টি রাখাল, এই দেশে কীভাবে রাখালের কাজ করতে হয় তা আমাদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। ‘

সাহেব বলে, তা ভাই তুমি তো হাতির রাখাল, এখানে তো চড়ে বেড়াচ্ছে সব গরু, তুমি কানা মানুষ পারবে এদের চড়াতে?
কানা পোলা বলে, একশবার পারবো হুজুর, কাজটা দিয়ে দেখুন, আমরা এখানকার লোক, ওই গরু নামক প্রাণীটি আসলে গোহস্তি, আমাদের হস্তি থেকেই জন্মেছে, ওইটা হস্তির বিকৃত রূপ, রুগ্ন-ভ্রষ্ট-অচ্ছুৎ হা্তি বংশ। চাকরিটা দিয়ে দয়া করুন হুজুর।’
এবার সাহেব বলে, যাও, তোমাকে চাকরি দিলাম। তবে তিনমাস পরে সাগরের ওপারে আমাদের যে ইংলন্ডো আছে, সেখান থেকে এক পশু বিশারদ আসবে, সে গরুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করবে, মস্ত বড় পন্ডিত, শূকর খামারের মালিক , যদিও সে কোনোদিন গরু দেখে নাই, কাজেই তোমাকে কিন্তু তার সামনে ঠিকঠাক গরুর বর্ণনা দিতে হবে, কেমন?

এবার কানাপোলা জি হুজুর, আজ্ঞে হুজুর বলতে বলতে গরুর পাল খুজতে বেড়িয়ে পড়ে। চারনভূমিতে গিয়ে একটা একটা করে গরুর শরীর হাতায়। কখনো চিকন ঠ্যাং আর খুড় ধরে বলে ওঠে, ছে ছে, কখনো শিং ধরে বলে ওঠে ছে ছে, কত্তবড় কান শুকিয়ে কেমন শক্ত হয়ে গেছে, একারণেই পূর্ব পুরুষেরা বলে গেছে এদেশের মাটি ভালো না, এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়; কখনও পাছার লেজ আর লেজের মাথার লোম ছুঁয়ে বলে ওঠে, ছেঃ এও হস্তি! শুঁড়ের কী অবস্থা! এমন চিকন শুঁড়, তার মাথায় আবার চুল, নাহ, একে জাতে ওঠানো আর সম্ভব হলো না।

তিন মাস পর সুদূর ইংলন্ডো থেকে শূকর খামারের মালিক, পশু বিশারদ সাহেব এলেন সাহেব নগরে, এবার ডাক পড়লো কানা পোলার। সে সাথে আরো পাঁচপোষ্য নিয়ে হাজির। বিশারদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, বলো কানা পণ্ডিত, গরু প্রাণীটি দেখতে কেমন? ইহার জন্ম পরিচয় কী? ঠিকঠাক বলিবে, কারণ তোমার বর্ণনাই কিতাবে উঠিবে, লোকে পড়িবে,দুনিয়া জানিবে।’
কানা পোলা বলতে শুরু করলো, হুজুর, গরু একটি হস্তি প্রজাতির প্রাণী, ইহার আসল নাম গোহস্তি, হস্তি প্রাণীটি এই দেশের কাদা মাটিতে থাকিয়া কালক্রমে বিকৃত হইয়া খর্বাকৃতির হইয়া গিয়াছে। উহার বিশালাকৃতির কান কালক্রমে শুকাইয়া শক্ত গোলাকৃতির-লম্বা-সুচালো বস্তু ইয়া গিয়েছে। হস্তি ঠ্যাং মোটা মোটা কিন্তু ইহার ঠ্যাং খর্বাকৃতির চিকন চিকন, তবে ইহারও চারটি ঠ্যাং রহিয়াছে।এবার বিশারদ সাহেব উৎসুক হয়ে বলল- চারটি ঠ্যাং! ঠিক বলিয়াছো, শূকরেরও ঠ্যাং চারটি, দারুণ পর্যবেক্ষণ, বলো বলো…

সাহেব বলে, তা ভাই তুমি তো হাতির রাখাল, এখানে তো চড়ে বেড়াচ্ছে সব গরু, তুমি কানা মানুষ পারবে এদের চড়াতে?
কানা পোলা বলে, একশবার পারবো হুজুর, কাজটা দিয়ে দেখুন, আমরা এখানকার লোক, ওই গরু নামক প্রাণীটি আসলে গোহস্তি, আমাদের হস্তি থেকেই জন্মেছে, ওইটা হস্তির বিকৃত রূপ, রুগ্ন-ভ্রষ্ট-অচ্ছুৎ হা্তি বংশ। চাকরিটা দিয়ে দয়া করুন হুজুর।’
এবার সাহেব বলে, যাও, তোমাকে চাকরি দিলাম। তবে তিনমাস পরে সাগরের ওপারে আমাদের যে ইংলন্ডো আছে, সেখান থেকে এক পশু বিশারদ আসবে, সে গরুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করবে, মস্ত বড় পন্ডিত, শূকর খামারের মালিক , যদিও সে কোনোদিন গরু দেখে নাই, কাজেই তোমাকে কিন্তু তার সামনে ঠিকঠাক গরুর বর্ণনা দিতে হবে, কেমন?

কানাপোলা: হুজুর ইহার একটি লম্বা শুঁড় রহিয়াছে, উহা শুকিয়ে দড়ি দড়ি হইয়া গিয়াছে এবং উহা কালক্রমে মুখের কাছ থেকে পায়ুদেশে গিয়া পৌছাইয়াছে কিন্তু উহা হস্তি শুঁড়ের মতো নহে, উহার আগায় চিরল চিরল লোম রহিয়াছে।
বিশারদ সাহেব: শুঁড় কী হে কানা পণ্ডিত?
কানাপোলা: হুজুর উহা হস্তির লম্বা নাক, যাহা দ্বারা হস্তি কিছু ধরিতে পারে।
বিশারদ সাহেব: নাহ, ভুল বলিতেছো পণ্ডিত, নাক- উহা লাল, ছুঁচোর নাকের মতো নড়ে, এতো বড় নাক কেন হইবে?
কানাপোলা: আজ্ঞে হুজুর, আমার চৌদ্দ পুরুষ হস্তি পালন করিয়াছে আমরা শুঁড় চিনিবো না! আমরা নেটিভ বলিয়া, চাকর বাকর বলিয়া উহা আমাদের উপর চাপাইয়া দিতে পারেন না!
বিশারদ সাহেব: নাহ কানা পণ্ডিত এই ভাবে ভুল বলিলে তোমার চাকরি থাকিবে না।
কানাপোলা: আজ্ঞে হুজুর! ভুল কিছু বলিনি তো, ওই নাক, আপনি যা বলেছেন, লাল লাল, শূকরের মতো তবে উহার শরীরে হালকা লোম রহিয়াছে, চর্ম মসৃণ।
বিশারদ সাহেব: ঠিক বলিয়াছো, হালকা লোম রহিয়াছে, চর্ম মসৃণ তবে উহা দুই ফুট উঁচা হইবে তাই তো?
কানাপোলা: আজ্ঞে, মার্জনা করিবেন হুজুর, উহা দশফুটের কম উঁচা হইবে তবে দুই ফুটের বেশি।
বিশারদ সাহেব: উহা কি ঘোৎ ঘোৎ করিয়া ডাকে?

এইবার কানাপোলার এক পোষ্য অতিউৎসাহে বলে উঠলো,’ হুজুর উহা হাম্বা হাম্বা ডাকে।’
এবার কানাপোলা তার পোষ্যের উপর ক্ষেপে গিয়ে সাহেবকে বলল, হুজুর, ও মূর্খ, হাম্বা একটি ইতর ধ্বনি , উহা গরুর পশ্চাৎ দেশের বায়ু নির্গমনের ধ্বনি, গরু আসলে হস্তির মতো ডাকে।

এই ভাবে হাতি এবং শূকরের সমন্বয়ে যখন গরুর বর্ণনা রচিত হলো, চারণ ভূমির গরু জানলো না তার কন্ঠের হাম্বা ডাকটিও ইতর ধ্বনি হিসেবে পরিত্যাজ্য হয়েছে।

রাজু আহমেদ মামুন

কবি ও সাংবাদিক, বাড়ি বরগুনা জেলায়, বাস করেন ঢাকা শহরে। সাপ্তাহিক ধাবমান পত্রিকার সম্পাদক।

Share