ইভো মোরালেস দেশে ফিরছেন

।। অর্ণব সাহা ।।

সেদিনের  রাতটার কথা ভাবতে গিয়ে চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠল আরেকবার । আমি শূন্য বাতাসে ভর করে উঠে  দাঁড়াতে চাই । পরক্ষণেই মনে পড়ে ক্রাচ ছাড়া আজ এক-পাও হাঁটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে । কারণ, আমার বাঁ পা-টা হাঁটুর নীচ থেকে নেই । বাসি মলিন পাজামা ঝুলছে ওখান থেকে । ২০১৪-র মার্চ মাসে ছত্তিশগড়ের জগদলপুরের এক রিমোট থানা আক্রমণ করেছিল আমাদের স্কোয়াড । আমরা ভাবতেই পারিনি পুলিশ আর সি.আর.পি.এফ এতোখানি প্রস্তুত ছিল আমাদের জন্য । সেই অসম লড়াইয়ে আমাদের চার মহিলা সদস্য সহ মোট সাতজন শহিদ হয় । আমরা তখন অবশিষ্ট কয়েকজন রিট্রিট করছি । স্পেশাল কমব্যাট ফোর্সের একটা বিরাট বাহিনী ঘিরে ফেলে আমাদের । আমার হাতের অটোমেটিক রাইফেল ছিটকে চলে যায় । ততোক্ষণে আমার ডান কাঁধ মারাত্মক জখম । পুলিশের ছোঁড়া গ্রেনেডে আমার বাঁ-পায়ের হাড় হাঁটুর নীচ থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় । জ্ঞান হারাই আমি ।

ইভো মোরালেস দেশে ফিরছেন

লা-পাজ, বলিভিয়া

…২০ অক্টোবর ২০১৯, বলিভিয়ায় সাধারণ নির্বাচনের ফল গণনা চলছিল। প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোট-গণনার পর  দেখা যায় ইভো মোরালেসের নেতৃত্বাধীন ‘মুভমেন্ট টুওয়ার্ডস সোশ্যালিজম’ ৪৫.৬% ভোট পেয়ে তাদের নিকটতম দক্ষিণপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী কার্লোস মেসার চেয়ে প্রায় দশ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছে। তখনও গ্রামাঞ্চলের একটা বড়ো অংশের ফল ঘোষণা বাকি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল চতুর্থবারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন, পপুলিস্ট বামপন্থী নেতা ইভো মোরালেস। সন্ধ্যা ৭:৪০ নাগাদ সুপ্রিম ইলেক্টোরাল ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট  মারিয়া ইউজেনিয়া চোক ঘোষণা করেন, প্রাথমিক ফলঘোষণার প্রক্রিয়া এখানেই থামিয়ে দেওয়া হল। এরপর অন্তিম ফল ঘোষণার আগে পর্যন্ত আর কোনোরকম নির্বাচনী ফল-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হবে না। রাত ৯:২৫ নাগাদ প্রেসিডেন্ট মোরালেস নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, গ্রামাঞ্চলে তাঁর পার্টি বিপুল মার্জিনে এগিয়ে থাকবে। গোটা নির্বাচনের পর্যবেক্ষক, ‘অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস’ (OAS) মোরালেসের এই দাবি মানতে অস্বীকার করে। পরদিন, ২১ অক্টোবর, বলিভিয়ান নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে, গণনা প্রায় সম্পূর্ণ। ৯৫% ভোটের ফলপ্রকাশের পর এটা নিশ্চিত হয় মোরালেস বিপুল মার্জিনে জিততে চলেছেন। তাঁকে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে আর  প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে না। খেলা শুরু হয় ঠিক এর পরেই। ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকা ছিল আগে থেকেই। এইবার মাঠে নামল বলিভিয়ান সুপ্রিম ট্রাইবুনাল। তারা আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে জানাল নির্বাচন-প্রক্রিয়া  অস্বচ্ছ, গণনায় প্রচুর কারচুপি হয়েছে। দেশের যাবতীয় দক্ষিণপন্থী বিরোধীপক্ষ এইবার একযোগে রাস্তায় নেমে এল, তাদের সমর্থন জানাল বেশ কয়েকটি লাতিন আমেরিকান দেশের সরকার। অবশেষে স্পেন, মেক্সিকো এবং প্যারাগুয়ের পরিদর্শকবৃন্দ ৩১ অক্টোবর নির্বাচনী অডিটের সিদ্ধান্ত নিলেন। এর একসপ্তাহের মধ্যেই, ৬ নভেম্বর, বিরোধী জোট একটি ১৯০ পাতার নির্বাচনী রিপোর্ট দাখিল করল, যাতে রিগিং, ইচ্ছেকৃত  নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গাফিলতি এবং তথ্য লোপাট ও তথ্য পরিবর্তনের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। বলা হয় দেশের রেজিস্টার্ড ভোটার সংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যায় ভোট পড়েছে, সম্পূর্ণ বে-আইনি এই ভোট।

TRAJECTORY by Tushar Waghela

দেশজোড়া মোরালেস-বিরোধী আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে দেশের সেনাবাহিনী এবং শীর্ষ পুলিশ-কর্তারা এই আন্দোলনকারীদের সমর্থনে এসে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী সরাসরি ঘোষণা করে তারা মোরালেস-বিরোধী আন্দোলনকারীদের পক্ষে। এমনকি এই হিংস্র জনতার বিরুদ্ধে কেউ যদি পালটা আক্রমণ করে তাদের বিরুদ্ধে থাকবে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারীরা  একাধিক পুলিশ ফাঁড়ি, একের পর এক সরকারি দপ্তর-সহ মোরালেস-অনুগামীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ  শুরু করে দিয়েছে। ৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে ডাকা এক গোপন মিটিং-এ দেশের সর্বোচ্চ পুলিশ- কর্তারা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তারা মোরালেসের পাশ থেকে সরে দাঁড়াবে এবং তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করবে। তাদের এই সরে দাঁড়ানোর ফলে মোরালেস আরও  অরক্ষিত হয়ে পড়লেন। ১০ নভেম্বর, বলিভিয়ার আর্মড ফোর্সের প্রধান, কম্যান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল উইলিয়ামস ক্যালিমান সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন তাঁরা। একই দিনে বলিভিয়ার সবচেয়ে বড়ো শ্রমিক সংগঠন ‘বলিভিয়ান ওয়ার্কার্স সেন্টার’ মোরালেসের পদত্যাগ দাবি করে সম্পূর্ণ নতুন নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পক্ষে মত দিল। ওইদিন সন্ধ্যায় এক অজ্ঞাত স্থান থেকে পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস এক টেলিভিশন-বক্তৃতায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আবেদন জানালেন। বললেন, তিনি পদত্যাগ করছেন যাতে আরও বড়ো কোনও রক্তক্ষয় না হয়। যাতে ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’-এর কর্মীদের উপর আক্রমণ বন্ধ হয়।  ওইদিন এল আল্টো বিমানবন্দর থেকে মেক্সিকান এয়ারফোর্সের প্লেনে ওঠেন তিনি। পরদিন, ১১ নভেম্বর, মেক্সিকোর বিদেশমন্ত্রী মার্সেলো এব্রার্দ মোরালেসকে রাজনৈতিক আশ্রয়দানের কথা ঘোষণা করেন। কিউবা, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ে এবং ভেনেজুয়েলা সরকার বলিভিয়ার ঘটনাকে ‘সামরিক-আমলাতান্ত্রিক ক্যু’ হিসেবে ঘোষণা করে।  পরদিন, ১২ নভেম্বর, ফার-রাইট উইং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেনাইন অ্যানেজ। মোরালেস মন্ত্রীসভার  সমস্ত সদস্যকে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়। এমনকী ৩৮ সদস্যের ইলেক্টোরাল কমিশনের সমস্ত সদস্যকেই বরখাস্ত করা হয়। রাজধানী লা পাজ এবং এল আল্টো—দুটি প্রধান শহরকেই সম্পূর্ণ নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলে গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থানের বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে একটি প্রতিবিপ্লবী ক্যু সফল হয় সমাজতান্ত্রিক বলিভিয়ায়।

কিউবা, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ে এবং ভেনেজুয়েলা সরকার বলিভিয়ার ঘটনাকে ‘সামরিক-আমলাতান্ত্রিক ক্যু’ হিসেবে ঘোষণা করে।  পরদিন, ১২ নভেম্বর, ফার-রাইট উইং অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেনাইন অ্যানেজ। মোরালেস মন্ত্রীসভার  সমস্ত সদস্যকে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়। এমনকী ৩৮ সদস্যের ইলেক্টোরাল কমিশনের সমস্ত সদস্যকেই বরখাস্ত করা হয়।

তাজপুর সি-বিচ, ওড়িশা

এখন পড়ন্ত বেলার আকাশ এসে মিশেছে সমুদ্রের ধুসর দিগন্তরেখায় । এই ছোট্ট দোতলা বাড়ির ব্যালকনিতে বসে দেখতে পাচ্ছি ওদের । মাধবী আর আমাদের মেয়ে তিতাস । বিশাল নোনা জলের ঢেউয়ের ভিতর ওদের কোমর অবধি ডুবে গেছে । মায়ের গায়ে জল ছুঁড়ে দিচ্ছে তিতাস । মাধবীও হেসে উঠে আঁজলা ভরে জল ছুঁড়ে দিল মেয়ের গায়ে । দুজনেরই সালোয়ার ভিজে একশা । এতদূর থেকে টেরও পাবে না কেউ,  মাত্র চল্লিশ পেরোনো বয়সেই কতোখানি বুড়িয়ে গেছে মাধবীর শরীর । তার মুখে আজ বলিরেখা, পরিশ্রম, অনটন আর অনিশ্চয়তার । উচ্ছল তিতাসের মেধাবী চোখের দীপ্তিও সেই ক্লান্তি ঢাকতে পারে না । দীর্ঘ পনেরো বছর আমাদের সংসারটা একলাই টেনে নিয়ে চলেছে মাধবী । তিতাসের এখন তেরো । ক্লাস এইট । মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকালে অবাক লাগে, কীভাবে উত্তাল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ একটা গোটা জীবন আমি বয়ে নিয়ে এলাম । মাধবী পাশে না থাকলে হয়তো এটা অসম্ভবই হতো। হয়তো আরও ঢের আগেই আমার থ্যাঁতলানো মৃতদেহ পড়ে থাকত মালকানগিরি বা অবুঝমাড়ের জঙ্গলে । তাতে অবশ্য আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না। আমি যেদিন এই পথে পা রেখেছিলাম, সেদিন তো জানতামই আর কোনোদিনই ঘরে ফেরা হবে না আমার । তবু যে আজ স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে এই তাজপুরের নির্জন সাগরসৈকতে সময় কাটাচ্ছি আমি, সেটাই কি আশ্চর্য নয় ? বোধহয় এই দুটো মানুষের অদৃশ্য বন্ধন আমায় মরে যেতে দেয়নি । আজও গড়পরতা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ ও পরিবার মেনে নেয়নি, নেবেও না আমাকে । জানি । আমিও চাই না তাদের বিব্রত করতে । বরং যেকটা দিন বেঁচে থাকব, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর বুকের ভিতর জোর-করে নিবিয়ে দেওয়া আগুনপাহাড়টাকে জ্বালিয়ে রাখার এক শান্ত, নিঃশব্দ শপথ নিয়ে এভাবেই কেটে যাবে বাকি দিনগুলো । এইভাবেই ।

ওরা সেদিন এসেছিল রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ । দুটো মোটরবাইকে মোট চারজন । অকথ্য খিস্তি দিচ্ছিল বাপি নামের ছেলেটা । ওর ইশারায় দিলীপ আর আজিজুল ছুটে গিয়ে ঢুকল ঘরে । তাকের উপর রাখা বাসনপত্র টেনে ছুঁড়ে ফেলল উঠোনে । বুকর‍্যাক থেকে টেনে নামিয়ে উঠোনে ডাঁই করতে লাগল আমার যাবতীয় বইপত্র । বাড়িওয়ালা ঘর ছেড়ে দেবার নোটিশ দিয়ে চলে গেছে অন্যত্র । বাকি দুজন ভাড়াটেও উঠে গেছে ছ’মাস আগে । এই তিনতলা বাড়ি প্রোমোটিং হবে, বাড়িওয়ালা সেকথা আগেই জানিয়েছিল । কিন্তু, মাধবীর উদয়াস্ত টিউশন-সম্বল আমাদের পরিবার এই অল্প ভাড়ার বাড়ি থেকে বলামাত্র উঠে যেতে পারেনি । তিতাসের স্কুলের পড়ার খরচ, টিউশন খরচ, আমার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতেই মুখে রক্ত উঠে যায় মাধবীর । প্রোমোটারের সঙ্গে রফাও সম্পূর্ণ হয়নি আমাদের । যে টাকা আমাদের দেবার কথা, তার অর্ধাংশও আজ দেব-কাল দেব করতে করতে এখনও দিয়ে ওঠেনি সে । প্রোমোটারের খাস লোক দেবু মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল । উঠোনে স্তূপীকৃত বইয়ের মধ্যে তখনও উঁকি  মারছে ধনঞ্জয় দাশের ‘মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্ক’, ‘এপ্রিল থিসিস’, ‘প্যারি কমিউন প্রসঙ্গে’, পল সুইজির ‘বিপ্লবোত্তর সমাজ’, বাংলা অনুবাদে ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’, মাইকেল প্যারেন্টি-র ‘এগেইনস্ট এমপায়ার’, পাবলো নেরুদা-র ‘অনুস্মৃতি’, ‘ভেনেজুয়েলা—রূপান্তরের লড়াই’, ‘ফ্রম দ্য ফ্লেমিং ফিল্ডস অফ বিহার’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ছেঁড়া ‘গীতবিতান’, ‘গল্পগুচ্ছ’, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘উপন্যাস সমগ্র’, জগদীশ গুপ্ত-র ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’-সহ অজস্র বই । আর গত দু-দশক ধরে জমানো আমাদের পার্টির বিপুল ডকুমেন্টস, ‘পিপলস মার্চ’-এর পুরোনো সংখ্যা, আমার নিজের হাতে বিভিন্ন সময়ে ড্রাফট করা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গোপন দলিলের ছাপা সংস্করণ । সেদিনের  রাতটার কথা ভাবতে গিয়ে চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠল আরেকবার । আমি শূন্য বাতাসে ভর করে উঠে  দাঁড়াতে চাই । পরক্ষণেই মনে পড়ে ক্রাচ ছাড়া আজ এক-পাও হাঁটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে । কারণ, আমার বাঁ পা-টা হাঁটুর নীচ থেকে নেই । বাসি মলিন পাজামা ঝুলছে ওখান থেকে । ২০১৪-র মার্চ মাসে ছত্তিশগড়ের জগদলপুরের এক রিমোট থানা আক্রমণ করেছিল আমাদের স্কোয়াড । আমরা ভাবতেই পারিনি পুলিশ আর সি.আর.পি.এফ এতোখানি প্রস্তুত ছিল আমাদের জন্য । সেই অসম লড়াইয়ে আমাদের চার মহিলা সদস্য সহ মোট সাতজন শহিদ হয় । আমরা তখন অবশিষ্ট কয়েকজন রিট্রিট করছি । স্পেশাল কমব্যাট ফোর্সের একটা বিরাট বাহিনী ঘিরে ফেলে আমাদের । আমার হাতের অটোমেটিক রাইফেল ছিটকে চলে যায় । ততোক্ষণে আমার ডান কাঁধ মারাত্মক জখম । পুলিশের ছোঁড়া গ্রেনেডে আমার বাঁ-পায়ের হাড় হাঁটুর নীচ থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় । জ্ঞান হারাই আমি । দু’দিন পরে যখন চেতনা ফেরে আমি সদর হাসপাতালের বেডে আধশোয়া । আমার ডান হাত লোহার খাটের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বাঁধা । সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা । বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলাম আমি । সুস্থ হয়ে ওঠার পর কোর্টে চালান করে ওরা আমায় ।

পরের বছর, ২০১৫-র জুনে পার্টির কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের আরও দুই সদস্যের সঙ্গে আমিও আত্মসমর্পণ করি ছত্তিশগড় সরকারের কাছে । আমার এক দশকের আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের সেই ইতি । যদিও নেতৃত্বের সঙ্গে একের পর এক প্রশ্নে ও বিতর্কে বিভাজনটা তৈরি হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই ।  হয়তো এমনিতেও পার্টি ছাড়তে হতো আমায় । ততোদিনে আমার মেয়ের বয়স দশ বছর হয়ে গেছে । মাধবী  আমার বা ওর বাপের বাড়ি—কোথাওই আশ্রয় পায়নি । ওরা থাকত রুবি বাইপাসের পিছনের একটা কলোনিতে । একদিনের জন্যও অনুযোগ করেনি  ও আমার বিরুদ্ধে। একবারের জন্যও বলেনি পার্টি ছেড়ে চলে এসো, সংসারের দায়িত্ব নাও । দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছে । আয়ার কাজ, টিউশনি করে বড়ো করে তুলেছে তিতাসকে । আমাদের মেয়ে তিতাস সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে । বরাবর । ভাবলে আশ্চর্য লাগে, আমি আর মাধবী দুজনেই ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র-ছাত্রী । বিশ্ববিদ্যালয়েই  ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি আমাদের । প্রথমদিকে ও আমার সঙ্গেই পার্টির কাজ করত । পরে, আমি ঘর ছাড়লাম । প্রথমে ওড়িশা, পরে বস্তারের  জঙ্গলে আমাকে  পাঠাল পার্টি । গেরিলা ট্রেনিং নিতে । ততদিনে মাধবী গর্ভবতী । মেয়ের জন্মের সময় আমি ওর পাশে ছিলাম না । আমাদের পার্টির এক সিমপ্যাথাইজারের বাড়িতে ও ছিল তখন । সোদপুরে । মেয়ে জন্মানোর প্রায় এক সপ্তাহ বাদে আমার কাছে খবর পৌঁছয় । আমি তখন বাইলাডিলা খনি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের কিরণডুল নামে এক শ্রমিক-বেল্টে, যেখানে কয়লাখনির আদিবাসী শ্রমিকদের নির্বিচারে উচ্ছেদ করা হচ্ছে । ইতিমধ্যেই ওই এলাকার অধিকাংশ খনি বিক্রি হয়ে গেছে বহুজাতিক  সংস্থাগুলোর কাছে । পাশেই ইন্দ্রাবতী নদী । মনে আছে নদী পেরিয়ে গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের ঘরে সেদিন রাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা । চাটাই পেতে শুয়েছিলাম, যখন আমাদের স্কোয়াড কম্যান্ডার কৃষ্ণমূর্তির মোবাইলে খবরটা এল । গোটা ছত্তিশগড় জুড়ে আমাদের নিকেশ করার জন্য সরকার তখন সালওয়া জুড়ুম-এর অভিযান শুরু করেছে । গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে, উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে । আমার ঘরে ফেরার কোনো উপায় ছিল না । মেয়েকে প্রথম দেখতে পেলাম যখন ওর এক বছর বয়স । খড়দার এক পার্টি-কর্মীর বাড়িতে খুব গোপনে একরাতের জন্য এসে আমি দেখে গিয়েছিলাম আমার তিতাসকে । ওকে কোলে নিয়ে আমি যখন কেঁদে ফেললাম, মাধবীর চোখে তখন এক অভূতপূর্ব গর্ব । আমার কাছে কোনওদিন কোনও কিছু দাবি করেনি সে । যেন তাঁর অন্তরাত্মা বুকের গভীর  থেকে বলে উঠেছিল, “মেয়েকে নিয়ে ভেবো না । আমি তো আছিই”। পরদিন ভোররাতে যখন খড়দার শেল্টার ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসছি, আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরেছিল মাধবী । তখনও ওর চোখের কোণে কালি পড়েনি । মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি আজকের মতো । ওর ওই দুটো চোখ পরবর্তী কয়েক বছর ধরে ছিল আমার নিশ্চিত আশ্রয় । কতোবার, যখন সি.আর.পি.এফ-কোবরার জয়েন্ট অপারেশন চলছে, ক্রমাগত ব্রাশফায়ার করছে সরকারি বাহিনী, পিছু হটতে হটতেও আমি টের পেয়েছি, আমার পিছনে চালচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে, মাধবী । আমার সমস্ত শক্তির নেপথ্য উৎস । আমার মিউজ। আমরা এক মহাকাব্যের পার্শ্বচরিত্র । আমাদের সকলের প্রেরণা হয়েই যেন শব্দ সাজিয়ে চলেছেন জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । নিয়তি।

Salva Judum by Tushar Waghela

সেদিন রাতের ঘটনার পর থানায় ছুটে যাওয়া, লোকাল কাউন্সিলারের কাছে দরবার করা, মানবাধিকার সংগঠনের বন্ধুদের জানানো, তাদের নিয়ে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া—সব কাজই একা হাতে সামলেছে মাধবী । কলকাতায় ফিরে আসার পর একধরনের তীব্র ডিপ্রেশন শুরু হয় আমার । বিভিন্ন থার্ড ফ্রন্টের বন্ধুরা এসে আবার কাজ শুরু করতে বলে । কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে ফুরিয়ে গিয়েছিলাম । আমার চরম  নিঃসঙ্গতা, অবসাদ, শারীরিক অসহায়তা একা হাতে সামলেছে মাধবী । বিকেলবেলায় একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতে যেত সে । আর আমি পাড়ার মোড়ে বুয়াদার চায়ের দোকানে চুপচাপ বসে থাকতাম ।  সকালের বাসি কাগজ পড়তাম । ফেরার পথে মাধবী আমায় নিয়ে ঘরে ফিরত । ওই রাস্তাটুকুও আমার একক জীবনে এক অনন্য অনুভূতির উদ্ভাস নিয়ে আসত প্রত্যেকটা দিন । রাতে মেঝেতে গোল হয়ে আমি, মাধবী, তিতাস যখন একসঙ্গে খেতে বসতাম, মনে হতো, কোনো কিছুই ফুরোয়নি আমার জীবন থেকে । চোখের সামনে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে নতুন ক্লাসে উঠছে তিতাস । এক চেনা সাংবাদিক বন্ধুর সৌজন্যে একটা ইংরেজি কাগজে সাপ্তাহিক কলাম লেখার বরাত জুটে গেল । সামান্য হলেও একটা অস্থায়ী রোজগার । যদিও পুলিসের কাছে প্রত্যেক মাসে হাজিরা দিতে হত আমায় । রুটিনমাফিক । নতুন বাসা দেখার চেষ্টা করছিলাম আমরা । এই বাড়িটা সত্যিই ছেড়ে দিতে হবে । 

পার্টির পুরোনো লোকজন মাঝেমধ্যে আসত । আমি অবশ্য আজ আর জানি না এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির ঠিক কী অবস্থা । আমাদের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড লালগড়ের জঙ্গলে পুলিশের গুলিতে মারা যাবার পর দক্ষিণবঙ্গে সংগঠন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । একদিন স্বপনদা এলো । সন্ধ্যার দিকে । আমি তখন সদ্য চায়ের দোকান থেকে ঘরে এসে বসেছি । বলল—

— আছিস কেমন অনিমেষ ?
— জানি না স্বপনদা । আমার আর কোনো কিছুতেই উৎসাহ নেই…
— খোঁজখবর রাখিস কিছু ?
— না গো । আমার সাথে কারো কোনো যোগাযোগ নেই আর…
— কৌশিককে মনে আছে ?
— লম্বা কৌশিক ? গড়িয়ায় থাকত ?
— হ্যাঁ । ও তো অ্যাবস্কন্ড করে ছিল…বাবা মারা যাবার পর একরাতের জন্য বাড়ি এসেছিল…
— আচ্ছা । এখন কোথায় সে ?
— এনকাউন্টারে মারা গেছে । গতমাসে…
— কোথায় মারা গেছে ? ও তো নর্থ বেঙ্গলে কাজ করত…
— খবরটা পুরো ব্লকড করা হয়েছে অনি…ও মারা গেছে ঝিটকার জঙ্গলে…
— এখনও ওখানে স্কোয়াড আছে নাকি ?
— ছিল না । দুটো স্পেশাল স্কোয়াড অনেক কষ্টে কাজ করছে গত একবছর…

NAKED by Tushar Waghela

মাধবী থামিয়ে দিল আমাদের । বলল—‘স্বপন-দা, ওকে আর এইসব বলে কী হবে ? আমি চাই না ও আর এসবের মধ্যে জড়াক । তার উপর খোঁড়া লোক । ওকে দিয়ে কিছুই হবে না কারো…ওকে ছেড়ে দিন আপনারা…”। চায়ের কাপ হাতে সে ততোক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের মাঝখানে…। “তার উপর এই ভাড়াবাড়ির ঝামেলায় আমরা এমনিতেই নাকাল হচ্ছি স্বপন-দা । আপনি তো জানেন আমি কোনোদিন ওকে বাধা দিই নি”

— শুধু তাই নয় মাধবী । তুমি ছিলে পার্টির বহু নতুন ছেলে-মেয়ের চোখে আইডিয়াল…কী স্যাক্রিফাইসটাই না করেছ তুমি…আজও করে চলেছ…
— ওসব কথা আজ থাক স্বপনদা । বউদি কেমন আছে ? ছেলে কী করছে আপনার ?
— বউদির শরীর ভালো নেই । আর পলাশ তো এই সদ্য স্কুলের চাকরিটা পেল…
— বাঃ ! দারুণ খবর তো । আপনিও নিশ্চিন্ত হলেন তবে…
— এই নিশ্চিন্তি কি সত্যিই চেয়েছিলাম মাধবী ? এই জীবন কি চেয়েছিলাম ?
— কোনো কিছুই আমাদের মনের মতো হয় না স্বপন-দা—
মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠি আমি । বাস্তবিক, এই কথাগুলোর কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি । স্বপন-দাও চা খেয়ে আস্তে আস্তে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে গেল । খোলা দরজা দিয়ে দেখলাম, সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে, বরাবরের মতো…

বাড়ি-সংক্রান্ত এইসব ঝুটঝামেলা কিছুটা মিটলে মাধবীই পরিকল্পনা করে তাজপুরে বেড়াতে আসার । আমাদের চেনা এক বন্ধুর দৌলতে এখানে একটা ফাঁকা বাড়ির উপরতলায় দু’রাত থাকার বন্দোবস্ত হল । ভাবতে অবাক লাগে, বিয়ের পর এই প্রথম আমি আর মাধবী একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে এলাম । যখন আমাদের মেয়ে রীতিমতো বড়ো হয়ে গেছে । আকাশ আর একটু অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন । আরও দূর  সমুদ্রের পেটের ভিতর ছুটে যাচ্ছে মা আর মেয়ে । বারান্দায় বসে অন্য টুরিস্টদের দেখছিলাম আমি । দু’জোড়া ছেলেমেয়ে ছুটতে ছুটতে এক ডাবওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল । মেয়ে দুটোর টাইট হটপ্যান্ট আর শরীর-কামড়ে-ধরা স্লিভলেস গেঞ্জিতে উদ্ধত যৌবনের দাপট । ছেলেদুটোর পোশাকেও এই জগৎদুনিয়াকে তাচ্ছিল্য করার ঔদ্ধত্য আর দৃপ্ত অহংকার । আচ্ছা, ওরা কী জানে, এখান থেকে চোদ্দোশ-পনেরোশ কিলোমিটার দূরে ওদেরই বয়সী ছেলেমেয়েরা, যাদের পরিবার দৈনিক কুড়ি টাকাও রোজগার করতে পারে না, যাদের ভিটেমাটিটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে এই রাষ্ট্রের উন্নয়নের হাতছানিতে, তারা, কোন অসীম সাহসে এই দেশেরই বুকে কয়েকহাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বুনে চলেছে এক বিকল্প স্বপ্নের ভ্রূণ ? যারা, খোলামকুচির মতো টাকা ওড়ানোর কথা ভাবতেও পারে না, বরং তাদের শক্ত, কড়া-পড়ে-যাওয়া আঙুল নিশপিস করে গরম ইনসাসের ট্রিগার ছুঁয়ে সেই স্বপ্নের কেল্লার এক একটা আলগা ইঁট গাঁথার কাজকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে । এতোক্ষণে মাধবী আর তিতাসকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাই আমি । গোটা শরীর জলে ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে আসছে বালি ভেঙে । এখন অফ সিজন । মার্চের মাঝামাঝি । খুব শান্ত, নিরিবিলি সাগরসৈকত । আমি ক্রাচে ভর দিয়ে বারান্দার রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়াই । মা-মেয়ে আমায় দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে । আমিও পালটা হাত নেড়ে  সাড়া দিই তাদের । রান্নার জায়গাটা বেশ বড়ো । আমি চায়ের জল চাপাই । ওরা এসে পড়ে । তিতাস বলে, “আজ তুমি কী যে মিস করলে বাবা…”। আমি হেসে বলি, “জানি, আমি বারান্দায় বসেই দেখেছি তোদের মা-মেয়ের কীর্তি”। টাকা নেই আমাদের । মাথার উপর ছাদটুকুও স্থায়ী নয় এই মুহূর্তে । তবু, কোন অমোঘ মন্ত্রবলে এই অদম্য শক্তি অর্জন করেছে মাধবী ? কোন মন্ত্রে সে আমার মতো একটা বাতিল, ফসিল-হয়ে-যাওয়া লোককেও জুগিয়ে যাচ্ছে বেঁচে-থাকার রসদ ?

সন্ধেবেলা, ঘরে বসে টিভিটা অন করি আমি । ইংরেজি আর হিন্দি চ্যানেলগুলোয় চোখ আটকে যায় । মুহূর্তে মনে হয়, আমি কি স্বপ্ন দেখছি ? মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে কয়েকদফা দাবিসনদ নিয়ে এক লক্ষ কৃষকের দৃপ্ত মিছিলটা ঢুকছে বাণিজ্যনগরী মুম্বাইতে । লালে লাল আজাদ ময়দান চত্বর । গোটা টিভি স্ক্রিন জুড়ে কেবল লাল পতাকার ঢেউ । লাল লহর । আমার শরীরে কাঁটা দেয় । চোখ ফেটে জল আসে । মাধবী  কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরও পাইনি । আমার কাঁধে হাত রাখে সে । আমিও ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরি তার আঙুল । মারাঠা ডাব্বাওয়ালা, ধারাভি বস্তির গরিব জনতা, গোটা মুম্বাইয়ের মেহনতী মানুষ তৃষ্ণার জল আর কৃষকের ফাটা পায়ের শুশ্রূষার জন্য নতুন চপ্পল নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে । মাধবী বলে, “শোনো, রাস্তা থেকে খাবার কিনে আনব আজ…কেমন ?”। আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। তিতাসকে নিয়ে আর একবারের জন্য বাইরে বেরিয়ে যায় মাধবী । 

আমি একদৃষ্টে টিভি স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ঠায় বসে থাকি । লাল রঙের তেজ আর জৌলুস বাড়তেই থাকে…

মনে আছে নদী পেরিয়ে গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের ঘরে সেদিন রাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা । চাটাই পেতে শুয়েছিলাম, যখন আমাদের স্কোয়াড কম্যান্ডার কৃষ্ণমূর্তির মোবাইলে খবরটা এল । গোটা ছত্তিশগড় জুড়ে আমাদের নিকেশ করার জন্য সরকার তখন সালওয়া জুড়ুম-এর অভিযান শুরু করেছে । গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে, উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে । আমার ঘরে ফেরার কোনো উপায় ছিল না । মেয়েকে প্রথম দেখতে পেলাম যখন ওর এক বছর বয়স । খড়দার এক পার্টি-কর্মীর বাড়িতে খুব গোপনে একরাতের জন্য এসে আমি দেখে গিয়েছিলাম আমার তিতাসকে । ওকে কোলে নিয়ে আমি যখন কেঁদে ফেললাম, মাধবীর চোখে তখন এক অভূতপূর্ব গর্ব । আমার কাছে কোনওদিন কোনও কিছু দাবি করেনি সে । যেন তাঁর অন্তরাত্মা বুকের গভীর  থেকে বলে উঠেছিল, “মেয়েকে নিয়ে ভেবো না । আমি তো আছিই”।

কোচাবাম্বা, বলিভিয়া  

ইভো-বিরোধী আন্দোলন পুরোটাই ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ২১ অক্টোবর, শহরের কেন্দ্রে মূল গণনাকক্ষের সামনে বিরাট মিছিল এসে জমায়েত হয়। বিশেষত, সোপোকাচি এবং মিরাফ্লোরেস—লা-পাজের এই দুটো অঞ্চলে শুরু থেকেই উত্তেজনা ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোটযন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম লুটের চেষ্টা রুখে দেয় পুলিশ। আন্দোলন হিংস্র হয়ে ওঠে, চুকিসাকা অঞ্চলে ইভোর একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই মহিলা পুলিশদের একটি বাহিনী সার্জেন্ট সিসিলা চালানির নেতৃত্বে একটি শান্তিমিছিল বের করে, এরা উত্তেজিত জনতার উপর কোনওরকম বলপ্রয়োগের পক্ষপাতী  ছিল না। তারিজায় ব্যালট বক্সে আগুন লাগানো হয়। কার্লোস মেসার সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন রীতিমতো ধ্বংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে এবং সেন্ট্রাল ইলেকশন কমিশনের নিকটবর্তী বাড়িগুলোয় পরপর আগুন লাগাতে থাকে। হোটেল প্রেসিদেন্তে, হোটেল রিয়াল, ক্যাম্পো ফেরিয়াল দ্য কোচাবাম্বা সর্বত্র আক্রমণ সংগঠিত হয়। হোটেল রিয়ালে ইভো-বিরোধী জমায়েতের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের মারে জখম হন সা আন্দ্রেস ইউনিভার্সিটির রেক্টর  ওয়াল্ডো আলবারাসিন। হোটেল প্রেসিদেন্তের ভোটগণনা স্থগিত হয়ে যায়। পরদিন রিবেরালতার মেয়র ওমর রড্রিগেজের বাড়ির সামনে প্রাক্তন ভেনেজুয়েলান প্রেসিডেন্ট উগো শাভেজের মূর্তির ভাঙা মাথা পাওয়া যায়, যে মূর্তিটি তার ঠিক আগেরদিন বিক্ষোভকারীরা চূর্ণ করেছিল। চুকিসাকা, সান্তাক্রুজ, তারিজা, বেনি এবং কোচাবাম্বায় অনির্দিষ্টকালীন পাবলিক স্ট্রাইক আরম্ভ হয়। ২৫ অক্টোবর পূর্ণাঙ্গ রেজাল্ট বেরোনোর পর যখন দেখা যায়, মোরালেস ফের বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন,  হাজার হাজার বিরোধী জনতার মিছিল লা-পাজের সড়ক দখল করে নেয়। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড—‘বলিভিয়াকে কিউবা অথবা ভেনেজুয়েলা হতে দিচ্ছি না’। ৮ নভেম্বর পুলিশবাহিনী সরাসরি বিদ্রোহে সামিল হয়। লা-পাজ, সান্তাক্রুজ সহ একাধিক শহরের পুলিশস্টেশনের মাথায় ইভো-বিরোধী পতাকা উড়তে থাকে। পরদিন মোরালেস সরাসরি বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিরোধী দলনেতা কার্লোস মেসা সরাসরি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১১ নভেম্বর রাজধানী লা-পাজের রাস্তার দখল নেয় বিদ্রোহী জনতা, দেদার বাজি-পটকা ফাটতে থাকে এবং পুলিশ কার্যত সরে যায়। ১২ নভেম্বর মোরালেসের দেশত্যাগের পরপরই দেশ ছাড়েন আলভারো গার্সিয়া। সন্ধে ৬:৪৮-এ জেনাইন অ্যানেজ বলিভিয়ান সংসদীয় আইনের  ১৬৯ নং ধারায় প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেন।  ঠিক এরপরেই গোটা পৃথিবী জুড়ে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায়, বলিভিয়ার পুলিশ তাদের ইউনিফর্ম থেকে জনজাতির চিহ্ন ‘উইফালা’ অংশটি কেটে ফেলছে। এমনকী অসংখ্য সরকারি অফিস থেকেও এই জনজাতির স্মারক অপসারিত হয়, বলা হয়, বলিভিয়া যিশুখ্রিস্টের দেশ, এখানে উপজাতি আর জনজাতির রাজত্ব খতম হয়েছে।

FURY by Tushar Waghela

জেনাইন অ্যানেজের এই অবৈধ প্রেসিডেন্ট পদে বসার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ময়দানে নেমে পড়ে ইভোর সমর্থকেরা। বিশেষত বলিভিয়ার গ্রামাঞ্চলে, যেখানে ‘মুভমেন্ট টুওয়ার্ডস সোশ্যালিজম’-এর পোক্ত ঘাঁটি, সেখান থেকে হাজার হাজার উপজাতি ও জনজাতির মানুষ পায়ে হেঁটে মিছিল করে আসতে থাকে শহরগুলোর দিকে। রাজধানী লা-পাজের চারিপাশে যে পার্বত্য এলাকা, সেখান থেকে লক্ষাধিক মানুষের মিছিল ঢুকে পড়ে শহরের কেন্দ্রস্থলে। তাদের হাতে ছিল দেশজ হাতিয়ার, লাঠি এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। তাদের হাতে বিশাল ব্যানার আর ফেস্টুনে লেখা ছিল—‘প্রয়োজন হলে গৃহযুদ্ধই পথ’। ১২ অক্টোবরেই রাজধানী লা-পাজ আর মোরালেসের গড় বলে পরিচিত এল আল্টো দখল করে নেয় হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তাদের হাতে ছিল দেশজ ‘উইফালা পতাকা’, যা তারা মার্কিন-নির্দেশিত ‘ক্যু’-র বিরুদ্ধে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বিশেষত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা নিজেদের উর্দি থেকে ওই বহুবর্ণ ব্যাজ ছিঁড়ে ফেলছে, এই দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিদ্রোহ আর ‘উইফালা’ পতাকা হয়ে ওঠে সমার্থক। ১৪ নভেম্বর পুলিশ একডজন মোরালেস-পন্থী সেনেটরকে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করে। এরপরেই বিক্ষোভ আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। এইসময় থেকেই বলিভিয়ান আর্মি এবং পুলিশ মোরালেস-পন্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। গোটা  দেশজুড়ে বিদ্রোহীরা নিহত হন। সবচেয়ে বড়ো গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে কোচাবাম্বায়, এটি ইভো মোরালেসের সমর্থকদের দূর্গ বলে পরিচিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার-কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট একে ‘ভয়ানক ঘটনা’ বলে অভিহিত করেন। ২১ নভেম্বর যখন সঙ্গীদের মৃতদেহ নিয়ে হাজার হাজার ইভোর সমর্থক এল আল্টো থেকে লা-পাজে ঢোকার চেষ্টা করে, পুলিশ নির্মমভাবে বাধা দেয়। টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয় এবং বিক্ষুব্ধ জনতাকে শহরের সানফ্রান্সিস্কো স্কোয়ারে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মোরালেস অজ্ঞাত স্থান থেকে পাঠানো এক টেলিভিশন বার্তায় ঘোষণা করেন, মার্কিন মদতপুষ্ট বলিভিয়ার দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলো এই জনবিরোধী ‘ক্যু’ এবং গণহত্যা সংগঠিত করছে।

১৪ নভেম্বর, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট জেনাইন অ্যানেজ একটি ডিক্রি জারি করেন, যার ফলে গোটা দেশজুড়ে মিলিটারির হাতে কার্যত যাবতীয় শক্তি তুলে দেওয়া হয়, যেকোনও প্রতিরোধ ভেঙে দেবার জন্য বলপ্রয়োগের। এরপরেই কোচাবাম্বার কোকো-চাষীদের উপর নির্বিচার গুলিচালনা শুরু হয়। লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর মিলিত মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান হোসে মিগুয়েল ভিভাঙ্কো পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে বলেন, অ্যানেজ-সরকার মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। মিশেল ব্যাশেলেট জানান—“পূর্ববর্তী সংঘর্ষগুলো ঘটছিল দুই বিপক্ষীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে, কিন্তু ক্রমশ একতরফা শাসকগোষ্ঠী এইবার তাদের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে যথেচ্ছ বলপ্রয়োগ করার। এইধরনের বলপ্রয়োগ সমস্ত ডায়ালগের সম্ভাবনা খারিজ করে দেবে”। তিনি আরও অভিযোগ করেন,  গণহারে গ্রেপ্তার এবং ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বলিভিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার যদি আন্তর্জাতিক  মানবাধিকার-বিধি মেনে না চলেন তবে দ্রুত পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। পাওলো অ্যাব্রাও, ইন্টার-আমেরিকান কমিশন অন হিউম্যান রাইটস, তিনদিনের বলিভিয়া সফর শেষে জানিয়েছেন, ভয়ঙ্করতম মানবাধিকার-লঙ্ঘন ঘটে চলেছে বলিভিয়ায়। পরিস্থিতি ক্রমশ বাস্তব গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। প্রায় উইচ-হান্টিং-এর মতো পুরো দেশব্যাপী ‘মুভমেন্ট টুওয়ার্ডস সোশ্যালিজম’-এর সদস্য ও নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে নয়তো তুলে নিয়ে গিয়ে জাস্ট নিকেশ করে দেওয়া হচ্ছে।

তাদের হাতে বিশাল ব্যানার আর ফেস্টুনে লেখা ছিল—‘প্রয়োজন হলে গৃহযুদ্ধই পথ’। ১২ অক্টোবরেই রাজধানী লা-পাজ আর মোরালেসের গড় বলে পরিচিত এল আল্টো দখল করে নেয় হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তাদের হাতে ছিল দেশজ ‘উইফালা পতাকা’, যা তারা মার্কিন-নির্দেশিত ‘ক্যু’-র বিরুদ্ধে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বিশেষত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা নিজেদের উর্দি থেকে ওই বহুবর্ণ ব্যাজ ছিঁড়ে ফেলছে, এই দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিদ্রোহ আর ‘উইফালা’ পতাকা হয়ে ওঠে সমার্থক। ১৪ নভেম্বর পুলিশ একডজন মোরালেস-পন্থী সেনেটরকে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করে। এরপরেই বিক্ষোভ আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। এইসময় থেকেই বলিভিয়ান আর্মি এবং পুলিশ মোরালেস-পন্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।

 চিংড়িহাটা, কলকাতা

— আপনি ঠিক কী চান বলুন তো?
— সেটা তো আমাদেরও প্রশ্ন। তোমরা কী চাও?
— অনেক বড়ো প্রোজেক্ট শুরু হবে অনিমেষদা। বাড়িটা আপনাদের ছাড়তে হবে।
কাউন্সিলারের ডানহাত পল্টু বলে। পল্টু আমায় ভিন্নসুত্রে চেনে।
— আমরা কী একবারও বলেছি, উঠব না?
— কিন্তু ডেডলাইন পেরোলেও তো উঠছেন না দাদা।  
— কিন্তু তার জন্য তোমরা বাড়িতে গুণ্ডা পাঠিয়ে ভাঙচুর করবে?
— তার জন্য আমি স্যরি বলেছি একবার। রমেন পোদ্দার বলে।
— আমরা কীসের ভিত্তিতে উঠব ভাই? আমাদের আর্থিক অবস্থা তোরা তো জানিস পল্টু।
— কমপেন্সেশন দেব আমরা। একসপ্তাহের মধ্যেই দেব।
— কিন্তু ওই টাকায় আমাদের চলবে? তোমাদের বৌদি কীভাবে সংসার চালায় তোমরা জানো…
— চাপ দিয়ে আরও কিছু বেশি টাকা নেবেন, এই তো? ঠিক আছে, আমরা বিল্ডারের সঙ্গে কথা বলছি।
— চাপ দিয়ে নয়। এই তল্লাটে একটা নতুন বাড়ি ভাড়া নিতে গেলেও যে টাকা লাগবে তা আমাদের কাছে নেই। তোমরা সমস্ত জেনেও এই জুলুম করছ।
— আপনার পাস্ট আমরা সমস্ত জানি দাদা। টাকা আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। আর, নিজেরা না পেলে বলবেন, আমরাই নতুন ঘর দেখে দেব…

আমি চুপ করে থাকি…এদের সঙ্গে আর একটাও কথা বলতে ইচ্ছে করে না…

— আচ্ছা দাদা…আপনি তো সবরকম আর্মস চালিয়েছেন, তাই না?
— এখনও চালাতে পারি। দরকার হলে চালাব…আর একটা কথা…
— কী কথা? রমেন পোদ্দারের চোখে সন্দেহ আর কৌতুক!
— আমার ডান হাত আর বাঁ হাত একসঙ্গে কাজ করে রমেন। নিশানা এখনও একটুও কমেনি!

এরপর মাসতিনেক কেটে গেছে । আমরা ওই বাড়ি থেকে উঠে এসেছি । লোকাল পার্টির ছেলেরাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যে টাকা দেবে বলেছিল, তার চেয়ে খানিকটা বেশিই দিয়েছে ওরা। ওই পুরোনো বাড়িটায় হাইরাইজ উঠবে। কোন একটা মুম্বাই-বেসড কোম্পানির বিশাল আটতলা অফিস-বিল্ডিং উঠবে। এখন  চিংড়িহাটা অটো স্ট্যান্ডের কাছে ‘নবপল্লি’ বলে একটা কলোনিতে আমরা দেড় কামরার ঘর নিয়েছি একটা । মাধবী এর মধ্যে একটা ছোটো প্রাইভেট স্কুলের মন্টেসরি সেকশনে পড়ানোর চাকরি পেয়েছে । আমার জীবন কেটে চলেছে একইভাবে,  গতানুগতিক । বদল নেই কোনো । তবে বেশ কিছুদিন এই চত্বরে থাকতে থাকতে অনেক নতুন লোকজনের সঙ্গে চেনা-পরিচয় হয়েছে । তারা নিতান্তই সাধারণ এলাকাবাসী । বিশেষত এখানকার অটো ইউনিয়নের  ছেলেগুলো খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আমার । যখন নিজেকে বাতিল, ছুঁড়ে-ফেলা আবর্জনা বলে মনে হত  এক একদিন, তখনই একটা লোকাল ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি আমি । পাশেই ট্যাংরা পুলিশ স্টেশন । সেখান থেকে অটোচালকদের উপর হুজ্জোত করাটা একরকমের রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল এখানে । আর, বেআইনি অটোর সংখ্যা এই রুটে প্রচুর । আমিও পরম মমতায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম এই গরিব, কম-লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোর সঙ্গে । এমনকী, তাদের পরিবারের লোকজনও আমার আত্মীয় হয়ে উঠছিল ক্রমশ । ইউনিয়ন সেক্রেটারি সাধন ছেলেটা গ্র্যাজুয়েট । এলাকায় দাপিয়ে শাসকদলের সংগঠন করে । অথচ, ওর বাড়িতেই  এক রাতে রেইড করল পুলিশ । সকলেই জানে কলকাতার প্রত্যেকটা অটো রুটে পুলিশকে নিয়মিত কমিশন দিতে হয় । এরাও দিত । কিন্তু বছরখানেক আগে সল্টলেক স্টেডিয়ামে যুব-বিশ্বকাপ চলাকালীন ইস্টার্ন বাইপাসের ওই এলাকা জুড়ে ব্যাপক বস্তি উচ্ছেদ হয় । সৌন্দর্যায়নের নামে এই বেপরোয়া উচ্ছেদে এলাকার গরিব মানুষ রীতিমতো বিরক্ত ছিল পুলিশ-প্রশাসনের উপরে । সাধনের বাড়িতে পুলিশ রেইডের  পর আমি থানায় গেছিলাম ওকে ছাড়িয়ে আনতে । আশ্চর্য লাগল, ওসি আমায় বেশ ভালোই চেনেন দেখে । কাগজপত্রে সইসাবুদ চুকে গেলে, সামান্য হেসে আমায় জিগেস করলেন—“ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে…আপনার পুরোনো নকশালি অভ্যেসগুলো এখনও ছাড়তে পারলেন না, তাই না ?” আমায় এখনও নিয়মিত লালবাজারে হাজিরা দিতে যেতে হয়, সেটাও উনি দেখলাম খুব ভালোই জানেন । যেভাবে কথা বলছিলেন, মনে হল প্রচ্ছন্ন হুমকির সুর মিশে আছে তাতে । আমি অবশ্য ভয় পাইনি একটুও ।  যে মারাত্মক জীবন কাটিয়ে এসেছি এতোদিন, তাতে ভয় পাবার কারণও নেই । আমার এই খতরনাক অতীতের জন্যই এখানকার মানুষ আমায় আজ এইটুকু সম্ভ্রম করে । আমার যদিও আজ আর কোনো স্বপ্ন অবশিষ্ট নেই । শুধু, চারপাশের মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার আদিম ইচ্ছেটুকু মরেনি । তিনমাস আগে তাজপুরের ওই বাড়িতে বসে টিভি-তে দেখা সেই হাজার হাজার উত্তাল লাল পতাকার মিছিল এর মধ্যেও বেশ কয়েকবার স্বপ্নে দেখেছি ।  মাধবীর স্মার্টফোনে গুগল সার্চ করেও ওই সংক্রান্ত যাবতীয় ক্লিপিংস দেখি মাঝেমধ্যেই । এখানেও একটা ছোট্ট চায়ের দোকান আমার সারাদিনের অস্থায়ী ঠেক হয়ে উঠেছে । সকালে মাধবী আর তিতাস বেরিয়ে গেলে কিছুক্ষণ বইপত্র নাড়াচাড়া করি । তারপর আস্তে আস্তে ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে আসি এই রঞ্জিতের চায়ের দোকানে । প্রথম প্রথম এই বস্তি-এলাকার বাচ্চাগুলো আমি রাস্তায় বেরোলেই আওয়াজ দিত—“ল্যাংড়া যাচ্ছে”। কেউ কেউ বলত “ল্যাংড়া নকশাল”। পাশের বাড়ির কুসুমের মা ওদের একটা বাচ্চার গায়ে হাত তোলে এই কথা শুনে । আমি আপত্তি করেছিলাম । কিন্তু, সেদিনের পর থেকে বাচ্চাগুলো আর পিছনে লাগার সাহস পায়নি ।

ANCESTORS by Tushar Waghela

সেদিন পুরোনো বইপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে আমারই নিজের একটা ডায়েরি খুঁজে পেলাম । বস্তারে থাকার সময় একটা টানা গদ্য লিখছিলাম । ভয় ছিল, পুলিশের হাতে যেন কোনওভাবেই এটা না পড়ে । অবশ্য কোনো গোপন সাংগঠনিক কথা বা তথ্যই লিখতাম না এখানে । আসলে এর বিরাট অংশ জুড়ে ছিল তিতাসকে লেখা আমার একটা লম্বা চিঠি । মনে আছে শুরু আর শেষের এন্ট্রির সময় তিতাসের বয়স মাত্রই তিন আর চার বছর । প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হত যেকোনও দিন পুলিশের  বুলেট এসে বিঁধবে আমার বুকে । আমার যে সন্তানকে আমি কোনোদিন দেখতে পাব না, যার জন্য পার্থিব কোনো কিছুই রেখে যেতে পারব না আমি, তার জন্য আমার এই নিঃসঙ্গ, একক স্বপ্নের পাঠমালা, এটাই ওর জন্য ওর বাবার শেষ উপহার হয়ে থাকুক । পাতাগুলো কিছুটা হলেও আলগা হয়ে এসেছে । সেদিন একলা ঘরে বসে পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা নির্দিষ্ট এন্ট্রিতে চোখ আটকে গেল :

তুই কী করছিস এখন ? আমি যে নদীটার কিনারে বসে আছি তার নাম শঙ্খিণী । আমার এই  লেখা যখন তোর কাছে পৌঁছবে, সেদিন হয়তো আর আমি বেঁচে থাকব না । আমায় চিনিস তুই ? সম্ভবত না । কেবল গল্প শুনেছিস আমার… তাও মায়ের মুখে । তোর বাবা একটা অসম্ভব স্বপ্নের পিছনে ছুটেছিল । এই স্বপ্নই আমায় পিষে মারবে একদিন…পাখি ডাকছে চারপাশে ।  জানিস, আজ প্রায় এক সপ্তাহ বাদে চুনো মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম । আমি যে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাই, যাদের মধ্যে কাজ করি, তারা এর চেয়েও কম খাবার খেয়ে বেঁচে  থাকে…মাথার উপর দিয়ে এইমাত্র উড়ে গেল একঝাঁক বুনো টিট্টিভ । তুই স্কুলে ভর্তি হয়েছিস আমি জানি । কী টিফিন নিয়েছিস আজ ? আমি যেখানে আছি, সেখানকার লোক ইলেকট্রিক লাইট দেখেনি, সিনেমা হলে যায়নি কোনওদিন । কিন্তু এদের আত্মসম্মান বোধ প্রবল । এরা গত  দুশো বছর ধরে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে । হেরে গেছে । তবু লড়েছে । তোর বাবাও আসলে একটা হেরে-যাওয়া লোক । যে জানে তার এই অসম যুদ্ধ শেষ অব্দি ব্যর্থ হবে । তবু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি লড়ব । তোর মতো হাজার হাজার বাচ্চার জন্য আমায় এই লড়াইটা  চালিয়ে যেতে হবে । তুই কী আদৌ কোনোদিন বুঝবি আমায় ? হয়তো বড়ো হয়ে ঘেন্না করতে শিখবি আমায় । যেরকম ঘেন্না আমি পেয়েছি আমার নিজের বাবা-মা-ভাইয়ের কাছ থেকে চিরকাল । তবু যদি কোনোদিন মনে হয় তোর বাবা সামান্য হলেও ঠিক পথে হাঁটার চেষ্টা করেছিল, মাঝে মাঝে মনে করিস আমায়…সূর্য ডুবে আসছে । আমিও এখন গাছের নীচে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরব এইবার । নীল ত্রিপল গাছের নীচে বিছিয়ে রাতে ঘুমোই আমরা । আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগে না । শুধু তোর আবছা মুখটা মনে পরে । শুধুই তোকে মনে পড়ে আমার…

জানি, এই লেখায় আবেগই বেশি । আবেগ ছাড়া এর কোনোই মূল্য নেই । কিন্তু, আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে তিতাস একেবারেই অন্যরকম হয়েছে । সেটা হয়তো ওর মায়ের জীবনের কঠোর পরিশ্রম আর শিক্ষায় । আজও ওর বন্ধুরা প্রায় সকলেই এই বিরাট অঞ্চলের বস্তির ছেলে-মেয়েরা । ওর সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসে পড়া বুঝতে যে মেয়েটা, সেই মালতী সন্ধেবেলা লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে । মালতীকে দেখলেই আমার, কেন জানি না, বস্তারের স্বরূপার কথা মনে পড়ে । সেদিন যখন নদীর পাড়ে বসে ডায়েরি লিখছি একমনে, স্বরূপা আমার কাছ ঘেঁষে বসল । বলল : “কী লিখছ গো ?”। আমি বললাম চিঠি লিখছি মেয়েকে । একমুহূর্তে উদাস হয়ে গেল ও । জিগেস করলাম কী হয়েছে ? দেখলাম মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে । মনে হল কাঁদছে । বলল, ওরও একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল, স্বামী ছিল । স্বামীকে মিথ্যে কেস দিয়ে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ, কারণ, সে গ্রামের জোতদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল । লক-আপে পিটিয়ে মেরে ফেলে পুলিশ তার স্বামীকে । তারপর একদিন ছোট্ট মেয়েটার এল প্রবল জ্বর । হাতে-পায়ে ধরেও কয়েক  কিলোমিটার দূরের ডাক্তারকে আনতে পারল না স্বরূপা । বিনা চিকিৎসায় মারা গেল ওর ছোট্ট মেয়েটা । শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অপবাদ দিল ও নাকী ডাইনি । বরকে খেয়েছে, মেয়েকে খেয়েছে । এবার পরিবারের বাকী সকলকে খাবে । সেখানেও ঠাঁই হল না ওর । বাড়ি ছেড়ে পালাল স্বরূপা । ঘুরতে ঘুরতে এই স্কোয়াডে যোগ দিল । এখানে এসেই শিখল রাইফেল চালাতে, শিখল সামান্য ডাক্তারি, যা সেদিন জানলে ওর মেয়েটা অকালে ওভাবে মারা যেত না । বস্তারের গভীর অরণ্যের ‘মুক্তাঞ্চল’-এ পৌঁছেও কয়েকদিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি । কোবাড গান্ধির সঙ্গে কথা বলার সময় কখনও মনেও হয়নি এই নিরীহ লোকটারই মাথার দাম কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা । একটা ছড়ানো এলাকা  জুড়ে ক্যাম্প, ভলিবল আর ব্যাডমিন্টনের কোর্ট । একপাশে অস্ত্রাগার । সারি সারি কালাশনিকভ আর  অটোমেটিক রাইফেল । যে মেয়েটা কিশোরীর উচ্ছলতায় ভলিবল খেলছে, সে মুহূর্তের ভিতর ইনসাস রাইফেল হাতে হয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্রের মৃত্যুদূত ।

এক পলকে ঘোর ভেঙে গেল আমার । দরজাটা ভেজানো ছিল । তিতাস এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল । বলল : “খবর পাওনি বাবা ? শিগগির চলো বড়ো রাস্তায়…আমাদের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে!” আমি চমকে উঠে জিগেস করারও সময় পেলাম না, কী হয়েছে, ও আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে

নিয়ে চলল চিংড়িহাটা মোড়ের দিকে । আমি তখনও হতচকিত, বুঝতেই পারছি না ঠিক কী ঘটেছে । নাবাভাঙার মাঠটা পেরিয়ে আমি আর তিতাস গলি-ঘুঁজি দিয়ে চলেছি বড়ো রাস্তার মোড়ের দিকে । বাঁদিকে ক্যাপ্টেন ভেড়ির দিক থেকে, মেট্রোপলিটন কো-অপারেটিভ সোসাইটি  আর চব্বিশ নম্বর কলোনি থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ছুটে যাচ্ছে থানার সামনেটায় । কী ঘটেছে ওখানে ? তিতাসের অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে বুঝলাম একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে । তিনটে স্কুলের বাচ্চা ছেলে-মেয়ে রাস্তা ক্রস করছিল । একটা সরকারি বাস ওদের পিষে দিয়েছে । গোটা এলাকায় বীভৎস জ্যাম । গোটা রাস্তা জুড়ে মানুষ নেমে এসেছে । ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয়েছে রাস্তা । থিকথিক করছে মানুষের মাথা আর পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ গোটা অঞ্চল ।

যখন একলা থাকি, প্রায়ই ভাবি, এই যে দেশের কয়েকটা প্রত্যন্ত পকেটে ঘন অরণ্য অঞ্চলের ঘেরাটোপে কিছু মানুষ হাতে রাইফেল নিয়ে একটা অবাস্তব স্বপ্নকে সাকার করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের বিস্তীর্ণ খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে তার কোনো প্রভাব আছে ? আমি নিশ্চিত ছিলাম, নেই । কেউ জানেই না, তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে আরও একটু সহনীয়, সুন্দর করে তোলার জন্য কিছু নির্বোধ মানুষ আজও রাতের পর রাত মাইল মাইল পথ হেঁটে চলেছে, মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে স্বেচ্ছায় । কিন্তু আজ, বড়ো রাস্তায় পৌঁছে যখন দেখলাম উত্তাল জনতা একের পর এক সরকারি বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, টের পেলাম কয়েক মাস আগে যুব বিশ্বকাপের জন্য গণহারে উচ্ছেদের দগদগে ঘা এখনও ওদের মন থেকে বাসি হয়ে মিলিয়ে যায়নি । জনগণ কোন অসতর্ক মুহূর্তে কীভাবে, কোন অচেনা পদ্ধতিতে নিজেদের ক্ষোভ জানায়, তা জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও ঢের দেরি আছে । উন্মত্তের মতো ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ । পুলিশ অসহায় দর্শক । গণ-হিংসার এই অভূতপূর্ব চেহারা কেউই দেখেনি ইদানিং কালে । তাই, একে থামানোর পদ্ধতিও জানা নেই প্রশাসনের । এই কলকাতা শহরের নীচের তলায় যে আশি ভাগ মানুষ কোনোক্রমে বেঁচে থাকে, জন্তুর মতো, অবমানবের মতো, আজ তাদের সব অপমান যেন ফিরিয়ে দেবার দিন । আজ এই অপরিকল্পিত, খাপছাড়া বহ্নুৎসব সেই দিনের পর দিন ধরে চেপে রাখা  ক্ষোভের এক স্ফুলিঙ্গ, এক আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ, যার কোনো সমাজতাত্ত্বিক বা দার্শনিক উৎস খুঁজে বের করা দুরূহ । প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয় ।

সাধনকে দেখলাম । সে এই গোটা অপারেশন লিড করছে আজ । আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এই আগুন যদি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশ জুড়ে একদিন, যদি প্রত্যেকটা বড়ো শহরের মানুষ ঝান্ডা ছাড়া, ব্যানার, ফেস্টুন ছাড়াই নেমে আসে রাস্তায়, মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে যে উত্তাল পঞ্চাশ হাজার কৃষকের মিছিলের দৃশ্য টিভিতে দেখে সেদিন শিহরণ জেগেছিল, সেরকমই একের পর এক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে-পড়া নীচুতলার মানুষের মিছিল যদি একদিন হঠাৎ সবকটা মেগাসিটির প্রাণকেন্দ্রগুলো একযোগে দখল করে নেয়…১৯৭৪ সালে টানা চব্বিশ দিনের ঐক্যবদ্ধ রেল ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশ, যা

অনিবার্য ভাবে ডেকে এনেছিল ’৭৫-এর ‘জরুরি অবস্থা’, যদি আর একবার, আর একটিমাত্র বার দেশের মানুষ জেগে উঠে নিজেদের জানান দেয় নিজেদের অস্তিত্ব, কোথায় থাকবে এই রাষ্ট্রের মিলিটারি আর আমলাতন্ত্র ?

কল্পনায় আমি টের পাচ্ছিলাম, চিংড়িহাটা মোড় নয়, এটা আসলে আমাদের ক্রমাগত মানুষ-মেরে, উচ্ছেদ করে ‘উন্নয়ন’ আর ‘প্রগতি’-র দিকে ছুটে চলা শহরের বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা একচিলতে ‘রেড করিডর’। দুপাশে খাড়াই আর মধ্যিখানে সরু খাত। সেই নীচু খাতে আটকে পড়েছে একটা আস্ত সি.আর.পি.এফ কনভয়ের সাত-আটটা গাড়ি। আর, ওই ঢালু খাত বেয়ে নেমে আসছে কয়েকশ জলপাই উর্দি-পরা রেড স্কোয়াডের সশস্ত্র একটা দল । এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছে তারা সেনা-কনভয় লক্ষ করে। নগান্না, অনিল, সুজাতা আক্কা, বিষ্ণু, পুষ্পা এক হিংস্র আক্রোশে ম্যাগাজিন খালি করে দিচ্ছে সেনাজওয়ানদের লক্ষ করে। পরপর ছোঁড়া দুটো রকেট লঞ্চারের আঘাতে বিকট বিস্ফোরণে শূন্যে উড়ে গেল দুটো সেনাবাহিনীর জিপ।

তিতাস আমার হাত ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে । এলোপাথারি ঢিল ছুঁড়ছে ছেলেমেয়েরা পুলিশকে লক্ষ করে । পুলিশ কাঁদানে গ্যাস আর লাঠিচার্জ করে এই উন্মত্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে । স্বাভাবিক । এই উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে গুটিকতক রাষ্ট্রের পাহারাদারও আজ অসহায় । দাউদাউ করে জ্বলছে পরপর তিনটে সরকারি বাস । আমার চেনা এলাকার মানুষগুলোকে এইভাবে এক ভয়ানক মারণ-খেলায় মেতে উঠতে দেখে আশ্চর্য লাগছিল সেদিন । ম্যাক্সিম গোর্কি যাদের ‘লোয়ার ডেপথ’ বলেছিলেন, সেই অবদমিত, প্রাত্যহিক জীবনে অপমান সহ্য-করে-বেঁচে-থাকা মানুষগুলোর ভিতর কী তবে আজও কোথাও লুকিয়ে আছে এক তীব্র প্রতিশোধের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা ? যার হদিশ আমাদের শিক্ষিত মনে ধরা পড়ে না ? তিতাস এখন আরও সামনে এগিয়ে গেছে । আমার একবার হঠাৎ করে মাধবীর কথা মনে পড়ল । রাস্তার ধারের একটা দোকানের সামনে এসে মোবাইলে ধরলাম ওকে । মাধবী তখন ক্লাসে । ও দেখলাম  অলরেডি জানে সবটুকুই । আমায় বলল , তুমি কেন ওখানে গিয়েছ ? তিতাস ওখানে কী করছে ? ওকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও । আমি সে কথায় আমল দিলাম না । কারণ, তিতাস ততোক্ষণে জ্বলন্ত বাসের একেবারে সামনের দিকে চলে গিয়েছে । আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে তর্ক করছে ও । আমার আশ্চর্য লাগল । আমার রক্ত তবে কোথাও কথা বলছে ওর ভিতর দিয়ে ? আবছা হয়ে আসছিল আমার চারিপাশ ।

কল্পনায় আমি টের পাচ্ছিলাম, চিংড়িহাটা মোড় নয়, এটা আসলে আমাদের ক্রমাগত মানুষ-মেরে, উচ্ছেদ করে ‘উন্নয়ন’ আর ‘প্রগতি’-র দিকে ছুটে চলা শহরের বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা একচিলতে ‘রেড করিডর’। দুপাশে খাড়াই আর মধ্যিখানে সরু খাত। সেই নীচু খাতে আটকে পড়েছে একটা আস্ত সি.আর.পি.এফ কনভয়ের সাত-আটটা গাড়ি। আর, ওই ঢালু খাত বেয়ে নেমে আসছে কয়েকশ জলপাই উর্দি-পরা রেড স্কোয়াডের সশস্ত্র একটা দল । এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছে তারা সেনা-কনভয় লক্ষ করে। নগান্না, অনিল, সুজাতা আক্কা, বিষ্ণু, পুষ্পা এক হিংস্র আক্রোশে ম্যাগাজিন খালি করে দিচ্ছে সেনাজওয়ানদের লক্ষ করে। পরপর ছোঁড়া দুটো রকেট লঞ্চারের আঘাতে বিকট বিস্ফোরণে শূন্যে উড়ে গেল দুটো সেনাবাহিনীর জিপ। মাত্রই দেড়ঘন্টার অ্যামবুশ। কমপক্ষে তিরিশজন মিলিটারি নিহত। হয়তো মিথ্যা আর অত্যন্ত সাময়িক এই বিজয়ের স্বস্তি। এরপর এলাকার গ্রামগুলোতে চিরুনি তল্লাশি চালাবে ‘গ্রে-হাউন্ড’ আর ‘কোবরা’ বাহিনী। আবার জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানোর অনিশ্চিত জীবনে চলে যেতে হবে আমাদের…কিন্তু, এই মুহূর্তে আমার রক্ত সচল হয়ে উঠছে আবার। আমার চোখের সামনে ক্রোধোন্মত্ত জনতা আর দাউদাউ জ্বলতে-থাকা তিনটে এয়ারকন্ডিশনড সরকারি বাসের কঙ্কাল…

লা-পাজ, বলিভিয়া এবং গল্পসূত্র 

চরিত্র এবং নিউজফিডের বাইরে নিয়ে এসে যদি এই আখ্যানসূত্রকে স্বাধীনভাবে দাঁড় করাই, তাহলেও রক্তমাংসের চেনা চরিত্রের গল্পের ভিতরে ঢুকে পড়বে অনেক সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ, কারণ ওই টুকরো স্থানিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি আসলে আমাদের দৈনন্দিন যাপনসূত্রের অংশ হয়ে ওঠে হামেশাই। কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট করা কোন এক অনিমেষ কবে কোনও এক অশরীরী স্বপ্নের মরীচিকার টানে ঘর ছেড়েছিল, দান্তেওয়ারার ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে রাইফেল চালানো শিখেছিল, তাতে আমাদের, পাঠকদের আদৌ কিস্যু যায়-আসে না। ওরকম তো কতো ছেলেমেয়েই হারিয়ে যায়! এই ছোট্ট লেখা আসলে একটা বিরাট বড়ো কোনও ভবিষ্যৎ-গল্পের প্রস্তুতি। যে গল্প হয়তো আদৌ কখনও লেখাই হবে না। কারণ অনিমেষের রিট্রিট আর একুশ শতকের গোড়ায় সাড়া-জাগানো বলিভিয়ার  সমাজতান্ত্রিক সরকার—দুটোই আসলে একটাই সমান্তরাল ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে, যে ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে আমাদের জীবনেরও টুকরো আখ্যান।  এরকম অজস্র প্যারালাল ছোটো সময়ের গ্রন্থি আমাদের একটাই ফ্রেমে বেঁধে রেখেছে। কারণ, এই বড়ো ইতিহাসের মধ্যেই আমরাও বেঁচে রয়েছি আমাদের দৈন্য, ক্লীবতা আর পঙ্গু অবস্থান নিয়ে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের ওই দম-আটকানো বেঁচে থাকার তোয়াক্কা করে না।  আমাদের অজ্ঞাতসারে অথবা চেনাজানার পরিসরেই ঘটনাগুলো ঘটে যায়,  আমরা খেয়ালও করি না। যেমন  বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস বছর পনেরো আগে যেদিন ক্ষমতায় এসেছিলেন, আমাদের মেইনস্ট্রিম নিউজপেপারগুলোর ভিতরের সাতের পাতায় হয়তো ছোট্ট খবর করেছিল। আমরা জানতেও পারিনি। আজ  যখন প্রতিবিপ্লবী শক্তি ওই ছোট্ট দেশটায় ফের একবার ফিরে আসছে, গোটা দেশে জারি হচ্ছে মার্শাল ল’, তখনও আমরা সেই খবর আদৌ রাখছি না বা জানতেই পারছি না। ইদানীং ইন্টারনেট বিপ্লব ঘটে যাবার পর স্মার্টফোনে বিশেষ কিছু নিউজস্ট্রিম সাবস্ক্রাইব করা থাকলে লাতিন আমেরিকা বা গোটা দুনিয়ার পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এইসব টুকরো খবর চোখের সামনে আসে। নইলে তো এগুলো জানাই যায় না । যেমন জানা যায় না অনিমেষের ফিরে আসা, সারাদিন ঘরে অথবা সন্ধেবেলা রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে নিঃসঙ্গ বসে থাকা, এলাকার মানুষের বিপদে-আপদে সামান্য পাশে দাঁড়ানোর খবর, যেগুলো আজ বাতিল, উলুখড়ের চেয়ে একটুও ভারী নয়। কিন্তু এই দুটো গল্পই আসলে একটাই ন্যারেটিভের অংশ…

মেক্সিকোয় একমাস থাকার পর আর্জেন্টিনায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন মোরালেস। তারপর থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সেখানেই মিট করছে তাঁকে। তিনিও একের পর এক ভিডিও বার্তায় পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন না। বরং আসন্ন বলিভিয়ান নির্বাচনে জোরকদমে অংশ নিচ্ছে তাঁদের ‘মুভমেন্ট টুওয়ার্ডস সোশ্যালিজম’। ইতিমধ্যে জেনাইন অ্যানেজ সরকার এক বিশেষ ডিক্রির মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করেছে, বলিভিয়ায় দুটো টার্মের বেশি কেউই আর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবে  না। এর পিছনে মোরালেসকে আর নির্বাচনী পরিসরে দাঁড়াতে না দেবার উদ্দেশ্যই প্রধান।  মোরালেসের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে যে-দুটো নাম উঠে আসছে তাঁরা হলেন দীর্ঘ একদশকেরও বেশি বলিভিয়ার অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব যিনি সামলেছেন, সেই প্রবীণ অর্থনীতিবিদ লুই আর্কে কাতাকোরা এবং কোকা চাষী ইউনিয়নের অতিতরুণ নেতা আন্দ্রোনিকো রড্রিগেজ। কাতাকোরার নেতৃত্বেই বলিভিয়ার পৃথিবীবিখ্যাত দারিদ্র-দূরীকরণ কর্মসূচি সফল হয়েছিল, গণ-দারিদ্র হ্রাস পেয়েছিল বিপুল হারে। কিন্তু পার্টির মধ্যেই কাতাকোরাকে অনেকেই মানতে চাইছেন না, কারণ জনজাতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কম, তিনি কিছুটা উদারনৈতিক পাশ্চাত্যঘেঁষা রাজনীতিক। তাঁর বিপক্ষে উঠে আসছে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ডেভিড চোকুয়েহুয়াঙ্কার নাম, যিনি নিজে জনজাতির মানুষ এবং একেবারে তৃণমূল-স্তর থেকে রাজনীতি করে এসেছেন। আর রড্রিগেজের বয়স খুবই কম, মাত্রই ২৯ বছর, তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য খোলাখুলি জেনাইন অ্যানেজের স্বৈরাচারী শাসনের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। এইমুহূর্তে কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের কারণে মে মাসের নির্বাচন-প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফের রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করবে সমস্ত দল এবং সংগঠন ও তাদের নেতারা। ইতিমধ্যেই বলিভিয়ায় কোভিড সংক্রমণ একটা অন্যতম প্রধান নির্বাচনী ইস্যু হতে চলেছে। অ্যানেজ-সরকার সমস্ত স্কুলে নথিভুক্ত বাচ্চাদের ৭৫ মার্কিন ডলার করে মাসিক অনুদানের ব্যবস্থাও করেছে। কিন্তু দেশের আইনব্যবস্থায় সামগ্রিক বদল এনে দেশকে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক ফান্ডব্যাঙ্কের কাছে বিক্রি করে দেবার চক্রান্ত করছে অন্তর্বর্তী সরকার—দাবি, কাতাকোরার।

আমাদের অজ্ঞাতসারে অথবা চেনাজানার পরিসরেই ঘটনাগুলো ঘটে যায়,  আমরা খেয়ালও করি না। যেমন  বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস বছর পনেরো আগে যেদিন ক্ষমতায় এসেছিলেন, আমাদের মেইনস্ট্রিম নিউজপেপারগুলোর ভিতরের সাতের পাতায় হয়তো ছোট্ট খবর করেছিল। আমরা জানতেও পারিনি। আজ  যখন প্রতিবিপ্লবী শক্তি ওই ছোট্ট দেশটায় ফের একবার ফিরে আসছে, গোটা দেশে জারি হচ্ছে মার্শাল ল’, তখনও আমরা সেই খবর আদৌ রাখছি না বা জানতেই পারছি না। ইদানীং ইন্টারনেট বিপ্লব ঘটে যাবার পর স্মার্টফোনে বিশেষ কিছু নিউজস্ট্রিম সাবস্ক্রাইব করা থাকলে লাতিন আমেরিকা বা গোটা দুনিয়ার পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এইসব টুকরো খবর চোখের সামনে আসে। নইলে তো এগুলো জানাই যায় না ।

এই নাগরিক জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে আরও কিছু বছর কাটিয়ে দেবে অনিমেষ। তার মেয়ে তিতাস বড়ো হবে। নিজের কাজকর্ম, সংসার এইসবে জড়িয়ে যাবে, অথবা হয়তো জড়াবে না। আরও অনেক অনেক ছেলেমেয়ে ঘর ছাড়বে। জঙ্গলে যাবে গেরিলা ট্রেনিং নিতে। দেশের অর্থনীতি হয়তো আরও বেহাল হবে। প্রতি একান্ন মিনিটে একজন কৃষক এবং প্রত্যেক সতেরো মিনিটে একজন কৃষিমজুর আত্মহত্যা করবে।  তারপরেও এদেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেনে ভোট হবে। কাকাতুয়া আর ময়নাদের হরেকরকম প্রতিশ্রুতি মিথ্যে প্রমাণিত হলেও একটা বিরাট অংশের মানুষ গতানুগতিক জীবন কাটিয়ে যাবে। তাদের কোনও কিছুতেই হেলদোল থাকবে না। আর তারপরেও কিছু অবাধ্য, অকুতোভয় মানুষ এই বানানো বাস্তবতার মিথ্যে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। তারা ছড়িয়ে পড়বে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল, ওড়িশার মালকানগিরি-কোরাপুট, তেলেঙ্গানার প্রত্যন্ত গ্রাম, দণ্ডকারণ্যের পাহাড়-জঙ্গলঘেরা নো-ম্যানস ল্যান্ড অথবা  মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি ছেড়ে কোনও স্বপ্নের ব্ল্যাকহোলের ভিতর নিজেদের ধ্বংস করে দেবার অদম্য  প্রেরণায়। আর, আবছা টিউবলাইটের আলোয় বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে অনিমেষের মতো কেউ কেউ একটা প্রচ্ছন্ন অথচ তীব্র স্বপ্নের অবশেষ বুকের ভিতরে বয়ে বেড়াবে, যতোদিন না স্বাভাবিক মৃত্যু তাদের ডেকে নেয়।

এরপরেও এই ন্যারেটিভ, এই গল্পসূত্র ছিন্ন হবে না। এরপরেও ব্রাজিলের শ্রমিকবস্তি থেকে, আমাজনের গহন অরণ্য থেকে মানুষের মিছিল এসে ঘিরে ফেলবে বোলসেনারোর দুর্ভেদ্য প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ, ফের ক্ষমতায় আসবে ওয়ার্কার্স পার্টি। উরুগুয়ের ‘ব্রডফ্রন্ট’ আবার বিপুল মার্জিন নিয়ে সরকারে ফিরিয়ে আনবে অন্য কোনও হোসে মুজিকাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের রাস্তা মাসের পর মাস দখল করে নেবে ছাত্র-যুববাহিনী, মেক্সিকোর ওব্রাদর সরকার পড়ে গেলেও ফের জনগণের বিপুল ভোটে ক্ষমতায় ফিরবে ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’। কলম্বিয়ায় দীর্ঘ পাঁচ দশকের গৃহযুদ্ধ শেষ হলে ফের হয়তো কারাকাসের রাস্তায় প্রকাশ্য মিছিল করবে ‘ফার্ক’, বন্দুক নামিয়ে রেখে গণতান্ত্রিক পথেই জোট সরকার গড়বে তারা। ভেনেজুয়েলায় এক অস্বাভাবিক এবং অবিশ্বাস্য লড়াই চালিয়ে যাবে মাদুরোর সরকার। তারা  পরবর্তী নির্বাচনে হেরে যেতে পারে, কিন্তু সাইমন বলিভারের স্বপ্ন থাকবে অমলিন…

আর, ফের ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’ ক্ষমতায় ফিরবে বলিভিয়ায়। মার্কিন সরকার আর ফার-রাইট উইং চক্রান্ত ছিন্ন করে দেশের গ্রাম ও শহরের লড়াকু মানুষ ফের জয়ী হবে। হবেই…

আর, দীর্ঘ কয়েকবছরের দুঃসহ দেশান্তর কাটিয়ে, অজ্ঞাতবাস থেকে দেশে ফিরবেন ইভো মোরালেস…

ছবি সূত্র: শিল্পী তুষার ওয়াঘেলা (1/2 FREEDOM, আভি আজাদি) এবং The Hindu

প্রচ্ছদ- অতনু সিংহ

অর্ণব সাহা

কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেনব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি। পেশায় অধ্যাপক। তাঁর কয়েকটি বিশিষ্ট কবিতার বই : ধর্ম নেই কোকাকোলা নেই, ব্ল্যাকহোলের বাকি অংশ, প্যারানইয়া, ২০ জুনের ডায়েরি, নিচু গিলোটিন, নীল রঙের হাভেলি, স্বপ্নের কশেরুকা। অর্ণব বাংলাভাষার সেই বিরল কবিদের একজন যিনি মনে করেন, অক্ষরমাত্রই রাজনৈতিক।

Share