আহমদ ছফার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার

।। পুনর্মুদ্রণ ।।


‘স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না’

ভূমিকা

কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার ‘স্বাধীন বাংলা সাময়িকী’র পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কেশব মুখোপাধ্যায়। পরে ওই পত্রিকা থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়ে বাংলাদেশের ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’ তাদের পাঠক-পাঠিকাদের জন্য তিন কিস্তিতে (১৮ মাঘ ১৪০৫ / ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯, ১৯ মাঘ ১৪০৫ / ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ এবং ২০ মাঘ ১৪০৫/২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) আবার ছাপে। পরে ২০০১ সালে ফরহাদ মজহার সম্পাদিত পাক্ষিক ‘চিন্তা’ পত্রিকার ‘আহমদ ছফা সংখ্যা ২০০১’-এ এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি আবার ছাপা হয়। সীমান্তের দুই পাশে বাংলাভাষীরদের সম্পর্ক নিয়ে এটি সম্ভবত আহমদ ছফার সবচেয়ে গোছানো, বাস্তব এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাক্ষাৎকার। আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের চিন্তাশীল লেখক ও সাহিত্যিকদের সবচেয়ে আগুয়ান অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা ‘প্রতিপক্ষ’ ওয়েবজিনে এটি আবার ছাপছি মূলত পশ্চিম বাংলার চিন্তাশীল ভাবুক ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের জানাশোনা ও বোঝাবুঝির জায়গা আরও প্রশস্ত করবার জন্য। আমাদের ধারণা এই সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশকে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

এই সাক্ষাৎকারটি আবার ছাপাবার আরেকটি ভিন্ন কারণ রয়েছে। ‘কলকাতা কিছু দিতে পারবে না’ – আহমদ ছফা এই কথাটি কোন ইগো বা জাত্যাভিমান থেকে বলেন নি। পুরা সাক্ষাৎকার পড়লে তা অনায়াসেই বোঝা যায়। বাস্তব ইতিহাসের বিচার এবং ইতিহাসবোধ থেকেই তিনি কথাটা বলেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনগনের চেতনার স্তরে যে আবেগ ও সংকল্পের বীজ রোপন করে দিয়েছে তার অংকুরোদ্গম দৃশ্যমান হচ্ছে, তার বিকাশ ঘটবেই। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করবে, পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সেই আনুকুল্য পাবে না। পাবার কথা নয়। পেতে হলে পশ্চিম বাংলাকে লড়তে হবে। দুই দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার কোনো অবদান থাকবে না।

কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা যেভাবে দাবি করেছিলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ‘রাজধানী’ ঢাকা, আহমদ ছফা তা মানতে রাজি ছিলেন না। তিনি দৃঢ় ভাবে মনে করতেন এই দাবি স্রেফ ব্যবসায়িক স্বার্থজাত বুলি। এর কোন মূল্য নাই। তদুপুরি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য পশ্চিম বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী চিন্তকদের অবদানকে সুনীলের উক্তি হেয় বা হীন করে। বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং পশ্চিম বাংলার বাস্তবতা তুলনীয় নয়। পশ্চিম বাংলার বাস্তবতায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তার নিজের টিকে থাকবার দায়েই লড়বে। আমাদের কাজ ঐতিহাসিক ভিন্নতা এবং উভয়ের সুনির্দিষ্ট চর্চার ধরণ ও স্বাতন্ত্র্য আমলে নিয়ে বড় পরিসরে ভাবতে শেখা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘আমরা/ওরা’ জাতীয় বালখিল্যতা পরিহার করা দরকার, কারন সাহিত্যের যাতায়াতে কোনো পাসপোর্ট বা ভিসা লাগে না। ফলে ইতিহাস, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের দিক থেকে যতো পার্থক্যই থাকুক, সাহিত্য কাঁটাতার, দেয়াল কিম্বা কূটনীতি ভেদ করে বড় ভূগোল তৈরি করতে সক্ষম। সাহিত্যের দিগন্ত অনেক বড়, তার কাজ কাজ দেয়াল তোলা না, দেয়াল ভাঙা।

আশা করি আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারটি আমরা সেভাবেই পড়ব।

– সম্পাদক, প্রতিপক্ষ

‘স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না’

১৯৩০-এর পর বাংলা ভাষা চতুর্থ ভাষা হয়ে গেল কলকাতায়। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা উর্দু। তারপর মহাযুদ্ধ, ওই যুদ্ধ বাঙালির অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিল এবং বাঙালির রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর হয়ে গেল পশ্চিমী অবাঙালিদের ওপর। বাংলা ভাগের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের অর্থটা দিয়েছিল টাটা। যে কারণে সুভাষ বোসকে কংগ্রেস ছাড়তে হল, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশও ছাড়তে হলো। গান্ধী এবং নেহেরুকে টাকা দিত মাড়ওয়ারি এবং গুজরাটিরা। একজন বাঙালি সভাপতিকে তারা টাকা দিতে রাজি ছিল না এবং গান্ধী নেহেরু কখনই চান নি সুভাষ বসুর মতো একজন বাঙালি কংগ্রেস দলের সভাপতি হোন বা থাকুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ না হলে এবং বাঙালির অর্থনীতিটা ভেঙে না গেলে হয়তো বাঙালির এই পরিণামটা হতো না।

প্রশ্ন: ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এর বাংলাদেশ এই পর্ব দুটি আপনার চিন্তার জগতকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?

আহমদ ছফা: পাকিস্তান যখন হয় তখন আমি শিশু। পরবর্তী সময়েও পাকিস্তান আমার মনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ক্লাস থ্রি বা ফোরের ছাত্র ছিলাম। সে সময় বাংলা ভাষার দাবিতে আমিও মিছিলে গেছি এবং আমার এক ভাই একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে মুসলিম লিগারদের হাতে মার খায়। তার থেকেই পাকিস্তানের কোনও প্রভাব আমার মনে কখনো কাজ করে নি। বরং আমার আকর্ষণ ছিল কলকাতার প্রতি। ওখানকার পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের প্রতি আমার ছিল প্রবল টান। ‘নবজাতক’ নামে মৈত্রেয়ী দেবী কোলকাতা থেকে একটা পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৫ সালে সেই পত্রিকা তিনি আমার কাছে পাঠাতেন, আমি পত্রিকা বিক্রি করে তাকে টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম। পূর্ব বাংলায় আমাদের বাঙালি অবস্থানটা শক্ত করার প্রয়োজনেই সেই সময় আমরা কলকাতার দিকে অণুপ্রেরণার জন্য তাকাতাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর, অন্য আর একটা অনুভব আমার মধ্যে এল, তা হচ্ছে-ভবিষ্যতে হয়তো কলকাতার দিকে আর আমরা তাকাতে পারবো না। কিংবা কলকাতার প্রতি আমাদের আকর্ষণের প্রেরণাটাও আর হয়তো থাকবে না। কারণ কলকাতা আমাদের অতীতের প্রেরণা এবং অতীত ঐতিহ্যের উৎস হতে পারে, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিশেবে কলকাতা আর আমাদের কিছু দিতে পারবে না এবং আমাদের কক্ষপথ আমাদেরই আবিষ্কার করে নিতে হবে। সেই কক্ষপথ অনুসন্ধানের জন্যে, আমাদের সমস্ত কাজকর্ম ও চিন্তা নিয়োগ করেছি। শুধু আমরা নয়, বাংলাদেশের একটা অংশের মানুষের মধ্যে এ চিন্তাটা এসেছে যে, বাংলাদেশকে তার নিজের মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়াতে হবে, নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে।

প্রশ্ন: বাঙালি মুসলমান মানসে পাকিস্তান আন্দোলন কোনো প্রক্রিয়া সে সময় সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তারা পাকিস্তান চেয়েছিল?

আহমদ ছফা: এটা খুব জটিল বিষয়। আমার খুব আশঙ্কা হয় সে কারণটা এখনো যায় নি। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছিল। মুসলীম লীগের ভিত্তি এবং শক্তি ছিল বাংলাতেই। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আপনি লক্ষ্য করবেন যে, বাংলার অ্যাসেমব্লির মুসলমান সদস্যরা বাংলা ভাগ চান নি এবং তারা স্বাধীন বাংলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বাংলার অ্যাসেমব্লির যে সব সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিলেন হিন্দু এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ক্রমাগত এটাই বলেলেন যে ভারতকে এক রাখ কিন্তু বাংলাকে ভাগ করে দাও। হ্যাঁ, বাংলার মুসলমান জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে বাংলা ভাগ জিন্নাহও চাননি। অনেক সময় বাংলা ভাগের জন্যে বাংলার মুসলমানদের দায়ী করা হয়, এটা সঠিক নয়।

প্রশ্ন: এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি বাংলার হিন্দুদেরই বাংলা ভাগের জন্য দায়ী করবেন?

আহমদ ছফা: অচিন্ত বিশ্বস, ‘তপসীলি রাজনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় বলেছেন, তিন থেকে ছ’ভাগ লোকের (বর্ণহিন্দু) স্বার্থে বাংলা ভাগ করা হয়েছে। বক্তব্যটা অমূলক নয়। জয়া চ্যাটার্জি ‘Bengal divided Hindu Communalism and partition’ বইতে এসব তুলে ধরেছে।

বাংলার অ্যাসেমব্লির যে সব সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাদের চার ভাগের তিন ভাগ ছিলেন হিন্দু এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ক্রমাগত এটাই বলেলেন যে ভারতকে এক রাখ কিন্তু বাংলাকে ভাগ করে দাও। হ্যাঁ, বাংলার মুসলমান জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু সুক্ষ্মভাবে দেখলে বাংলা ভাগ জিন্নাহও চাননি। অনেক সময় বাংলা ভাগের জন্যে বাংলার মুসলমানদের দায়ী করা হয়, এটা সঠিক নয়।

প্রশ্ন: ‌’৪৭-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনে আবুল হাশিম এবং শরৎ বসুদের প্রচেষ্টা সফল না হবার কারণও কি ওই তিন থেকে ছ’ভাগ বর্ণহিন্দুর স্বার্থ?

আহমদ ছফা: না, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। ওই একটি কারণেই ওই রকম একটা বিরাট ঘটনা ঘটে নি। প্রথমত প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ১৯৩০-এর পর বাংলা ভাষা চতুর্থ ভাষা হয়ে গেল কলকাতায়। প্রথম ভাষা ইংরেজী, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা উর্দু। তারপর মহাযুদ্ধ, ওই যুদ্ধ বাঙালির অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিল এবং বাঙালির রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর হয়ে গেল পশ্চিমী অবাঙালিদের ওপর। বাংলা ভাগের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের অর্থটা দিয়েছিল টাটা। যে কারণে সুভাষ বোসকে কংগ্রেস ছাড়তে হলো, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশও ছাড়তে হলো। গান্ধী এবং নেহেরুকে টাকা দিত মাড়ওয়ারি এবং গুজরাটিরা। একজন বাঙালি সভাপতিকে তারা টাকা দিতে রাজি ছিল না এবং গান্ধী নেহেরু কখনই চান নি সুভাষ বসুর মতো একজন বাঙালি কংগ্রেস দলের সভাপতি হোন বা থাকুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ না হলে এবং বাঙালির অর্থনীতিটা ভেঙে না গেলে হয়তো বাঙালির এই পরিণামটা হতো না।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করেন যে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই, পর্ব বাংলার মানুষ বাংলাদেশ পেয়েছে। আপনিও কি এই মতের অনুসারী?

আহমদ ছফা: এর মধ্যে সত্যতা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাসের আরও পেছনে যাওয়া দরকার। যেমন পশ্চিম বাংলার অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল লেখক ড. অশোক মিত্র বলেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে, অর্থাৎ তখন যদি বঙ্গ বিভাগ হতো তবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটতো এবং বিকশিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিত। ফলে ১৯৪৭ দেশ ভাগের কোন প্রয়োজন ঘটতো না। বাংলা ভাগ না হলে ভারতও ভাগ হতো না। কারণ বাংলার বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ত্ব কোথাও ছিল না। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছে এবং এখানেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের জনভিত্তি। এছাড়া চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যদি কার্যকার হত, তাহলেও বাংলা ভাগ হতো না। তারপর ধরুন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, যাতে বাংলা আসামকে একটা জোন করা হবে বলা হয়েছিল। এটা মেনে নেয়া হলেও বাংলা ভাগ হতো না। অর্থাৎ কিছু ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দীর্ঘকাল ধরে যা হয়ে আসছিল তার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাংলা ভাগ হয়েছে।

প্রশ্ন: পাকিস্তান ভাঙার পেছনে কোন ঐতিহাসিক অনিবার্যতা কাজ করেছিল?

আহমদ ছফা: বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবোধ। কিন্তু শূন্য থেকে তো জাতীয়তাবোধ জন্মায় না। এখানে (পূর্ব বাংলা) যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল তারাই প্রথম অনুভব করলো রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্য প্রতিরোধ করতে না পারলে, বাঙালি হিশাবে তাদের বিকাশ সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। পরে পাকিস্তানকেও ভাঙতে হলো, কারণ ভাগে মিলছিল না। এটা একটা হিশাব, আর একটা হিশাব আছে। অর্থাৎ একটা জাতি কোন উপলক্ষে জেগে ওঠে, কতো গভীরে তার প্রভাব পড়ে, অতি তুচ্ছ কারণেও কোনো ঘটনা ঘটতে পারে- কিন্তু তার প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেই দিক থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্রভাব সঞ্চারী বড় কোনো ঘটনা নেই।

প্রশ্ন: পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধানে এবং জাতি পরিচয় জেগে ওঠার পেছনে বাংলা ভাষার প্রশ্ন বা প্রভাব কতটা ছিল?

আহমদ ছফা: ভাষাভিত্তিক জাতি পরিচয়ে ভাষাই প্রধান। ভাষা হলো অধিকার উচ্চারণের প্রধান মাধ্যম। এই ভাষার সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টাও যুক্ত ছিল যে নিউ মিডল ক্লাস তৈরি হচ্ছিল, তারা চাকরিবাকরি পেত না যদি বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হতো। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন তাদের অধিকার এবং অংশ চাইছিল। পূর্ব বাংলাকে তখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে চাওয়া হয় নি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়েছি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবার পর অন্য ইস্যুগুলো এলো, বৈষম্যগুলো পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকলো চাকরিতে বৈষম্য, সামরিক বাহিনীতে বৈষম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈষম্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যগুলোকে রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তুলে ধরা হলো এবং তাতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত অস্ত্র তুলে ধরলেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্যে। তবে পূর্ব বাংলার প্রতি নানা বৈষম্যের প্রতিবাদে যারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এক সময় এরা ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা।

পশ্চিম বাংলার অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল লেখক ড. অশোক মিত্র বলেছেন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ না হলে, অর্থাৎ তখন যদি বঙ্গ বিভাগ হতো তবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটতো এবং বিকশিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিত। ফলে ১৯৪৭ দেশ ভাগের কোন প্রয়োজন ঘটতো না। বাংলা ভাগ না হলে ভারতও ভাগ হতো না। কারণ বাংলার বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ত্ব কোথাও ছিল না। মুসলিম লীগ এখানেই হয়েছে এবং এখানেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগের জনভিত্তি। এছাড়া চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যদি কার্যকার হত, তাহলেও বাংলা ভাগ হতো না। তারপর ধরুন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, যাতে বাংলা আসামকে একটা জোন করা হবে বলা হয়েছিল। এটা মেনে নেয়া হলেও বাংলা ভাগ হতো না। অর্থাৎ কিছু ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দীর্ঘকাল ধরে যা হয়ে আসছিল তার চূড়ান্ত অভিঘাতে বাংলা ভাগ হয়েছে।

প্রশ্ন: এখানে কি আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উল্লেখ করছেন?

আহমদ ছফা: তা বলতে পারেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য এবং গুরু শিষ্য দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। বাংলাদেশ যারা স্বাধীন করেছেন এক সময় তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগের Extension or junior partner।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং মুক্তিযুদ্ধে এখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বামপন্থী, বুর্জোয়া এবং চরম দক্ষিণপন্থী জামাত শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক অবস্থান?

আহমদ ছফা: শেখ মুজিবের প্রতি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের একটা সন্দেহ ছিল। শেখ মুজিব গোড়া থেকে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা এবং আমি আগেই বলছি, তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ব্লকের লোক। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এখনকার বামপন্থী দলগুলো যে বিরাট ভুল করেছে তা প্রায় আত্মহননের শামিল। একটা সময় বামপন্থীরাই ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান রাজ্যনৈতিক শক্তি। ১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ব বাংলা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ন্যাপের সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংঘ, মহিলা পরিষদ শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি। সব মিলিয়ে একটা বিরটা শক্তি। সে সময়টা ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান দৈন্যদশা দেখে পূর্বের অবস্থা কল্পনা করতে পারবেন না। চীন না সোভিয়েত কে সাচ্চা, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। যার আঘাত নেমে আসে পূর্ব বাংলার বাম রাজনীতিতে। দু’টুকরা হয়ে যায় ন্যাপ। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে এনে ছ’দফা ঘোষণা করেন তখন পূর্ব বাংলার বামপন্থী মস্কো এবং পিকিং শিবিরে ভাগ হয়ে পারস্পরিক বাদ-বিসংবাদে মত্ত। এবং দুই শিবির থেকেই ছ’দফার নিন্দা এবং বিরোধিতা করা হয়। অথচ ১৯৫৪ সালে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তকটি লিখে পূর্ব বাংলার জাতিসত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হবার পর পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের কাছে আন্তর্জাতিক ভাবনাই একমাত্র গুরুত্ব পেল।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতার পর মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বললো, আমরা অখণ্ড পাকিস্তানে বিপ্লব করবো। অন্যদিকে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পিকিং-এর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করেছে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে মাও সেতুং ভাসানীকে বললেন, ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব, সে (আইয়ুব) সমাজতন্ত্রেকে সমর্থন করবে। ফলে সে সময় চীনপন্থীদের মধ্যে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধীতা না করার মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মুজিবের ছয়দফার মধ্যে তারা (চীনপন্থী কমিউনিস্ট) সিআইএ-এর গন্ধ আবিষ্কার করলেন। অন্যদিকে ছ’দফার সমর্থনে শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ সর্বত্র প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সে সময় পূর্ব বাংলার যে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে, বাঙালির একটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, সংগ্রামের একটা স্তরে সে উন্নীত হয়েছে- মস্কো বা পিকিং দুই পন্থীরাই তা শনাক্ত করতে পারে নি। বাঙালির জাতিগত আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক উন্মেষকালে এরা সঠিক কোনো অবস্থান নিতে পারে নি। ছয় দফার প্রতি মানুষের সমর্থন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থীরা ছ’দফার প্রতি সমর্থন জানাতে গেলে, শেখ মুজিব এক বাক্যে তাদের জানিয়ে দেন, দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগ দিন।

এছাড়া চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি চীনপন্থী কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর আমি পশ্চিম বাংলায় ছিলাম। সে সময় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে দেখেছি সিপিআই(এম-এল)-এর পক্ষে শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা রয়েছে। এক সময় আব্দুল হক এবং মোহাম্মদ তোয়াহা ভাসানীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারা দেশে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদী নির্বচারে চালাচ্ছে, আবদুল হক সাহেব তখন অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার আবদুল হকের বিরোধিতা করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমানরা উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেন। চিনপন্থী সিরাজ শিকদার স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করার লক্ষ্যে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তিনি(সিরাজ শিকাদর) পাকিস্তান এবং ভারত-এই দুই থাবা থেকেই পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

বামপন্থীদের সংগ্রাম থেকেই বাঙালি জাতীয়তার বোধটি এখানেই অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ও কর্মীদের পরিচর্যায় তার বিকাশ। সেই কারণেই নানা অত্যাচার ও নির্যাতন তাদের এক সময় ভোগ করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে পাকিস্তান সংহতির শত্রু, বিদেশী গুপ্তচর, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি অভিযোগ। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক অবস্থান না নিতে পারার কারণে সে সবই ব্যর্থ হয়, সৃষ্টি হয় এক ব্যাপক গণবিচ্ছিন্নতা। আজ সেই গণবিচ্ছিন্নতারই ভিতরে রয়েছে এখনকার বামপন্থীরা। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমস্ত অপকর্মের দোসর জামায়তের ঘৃণ্য ভূমিকা তো জানেন।

একটা সময় বামপন্থীরাই ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান রাজ্যনৈতিক শক্তি। ১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ব বাংলা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। ন্যাপের সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংঘ, মহিলা পরিষদ শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সমিতি। সব মিলিয়ে একটা বিরটা শক্তি। সে সময়টা ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান দৈন্যদশা দেখে পূর্বের অবস্থা কল্পনা করতে পারবেন না। চীন না সোভিয়েত কে সাচ্চা, এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন। যার আঘাত নেমে আসে পূর্ব বাংলার বাম রাজনীতিতে। দু’টুকরা হয়ে যায় ন্যাপ।

প্রশ্ন: যে লক্ষ্য এবং স্বপ্নকে সামনে রেখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ২৬ বছর পর সেই স্বপ্ন কতটা সফল, কিংবা স্বাধীনতা প্রাপ্তির ছাব্বিশ বছরের এই পর্বটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আহমদ ছফা: প্রথম স্বপ্নটা তো বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিকে যারা পরিচালনা করতেন, তারা ছিলেন উচ্চবর্গীয় অভিজাত। এখন সন অফ দি সয়েলরা রাজনীতিতে আসছেন। অন্যদিকে আশংকার দিকটি হলো এখানে রাতারাতি একটি ইকোনমিক ক্লাস গ্রো করেছে। এই ইকোনমিক ক্লাসটি গড়ে উঠেছে ইকোনমিক প্লানডার(plunder) এবং লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনটা হয়েছে ব্যাপকহারে। এমন কয়েকজনকে আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ২৫শ’ টাকা ছিল না, এখন তাদের ক্যাপিটাল ২৫শ’ কোটি টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে তারা এই টাকা আয় করেছে। এর ফলে যে সমস্যার মধ্যে আমরা পড়েছি- যদি পশ্চিম বাংলার সাথে বিষয়টি তুলনা করি বুঝতে সুবিধা হবে। পশ্চিম বাংলার মতো (১৯৯৬) বিধানসভা নির্বাচনের আগে (১৯৯১) বর্ধমানে কালু ডোম বলে এক ব্যক্তি কংগ্রেসের এক সর্বভারতীয় ব্যক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। এ চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। কারণ আওয়ামী লীগ বলুন, বিএনপি বলুন, জাতীয় পার্টি বলুন, জামায়াতের কথা একটু স্বতন্ত্র, সব দল চলছে বাংলাদেশের নব্য ধনীদের অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকার ওপর। কাজেই পশ্চিম বাংলার কালু ডোমদের মতো কোনো প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংসদে যেতে পারবেন না। এখানকার পত্রপত্রিকায় ‌ঋণখেলাপী বলে একটা ব্যাপার দেখে থাকবেন। ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে, ঋণ শোধ করা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না, কারণ এদের পক্ষে আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সব বুর্জোয়া দল চলে এদের চাদায়। এর ফলে বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেই সংসদে জনগণের সত্যিকার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্খার কোন প্রতিফলন ঘটছে না। আপনি ঢাকায় এসে দেখলেন বিএনপির দু’জন এমপি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি এইভাবে অন্য দলের এমপি ভাগিয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছেন। এইভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিটা একটা দুষ্ট চক্রের মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হয়েছে।

বাম দলগুলো নিজেদের চরম ক্ষতি করছে জাতিমুক্তির প্রশ্নটিকে অনুধাবন করতে না পারার কারণে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিন্যাসটা একটু বোঝা দরকার। আমাদের এখানে যদি উৎপাদন ভিত্তিক, মানে শিল্পপতিরা যদি কলকারখানা তৈরি করতেন, তবে শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পলিটিক্স তৈরি করতেন। কোনো উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি এখানে গড়ে ওঠে নি। এখানে যা আছে তা ট্রেডিং। স্বাধীনতার পর শিল্প কারখানা এখানে হয় নি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। জাতির একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কোনো সরকার তৈরি করতে পারে নি। পরিবর্তে এখানে একটা ট্রেডিং ক্লাস তৈরি হয়েছে এবং এই ট্রেডিং ক্লাসটা টিকে আছে, ট্রেডিং পলিটিক্স-এর কারণে।

প্রশ্ন: এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ কি আপনি দেখছেন?

আহমদ ছফা: ১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে একটা বই লিখেছিলাম। সাম্প্রতিক তার একটা নতুন সংস্কৃরণ আমার দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছে। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর তাতে পাবেন। আমি মনে করি, ১৯৬৫-এর আগে বামপন্থী শক্তির যে ঐতিহ্যটা পূর্ব বাংলায় ছিল তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ‘যুবক এবং সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তারা যে অবস্থান সে সময় তৈরি করেছিল তা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনও ভবিষ্যৎ দেখছি না।

প্রশ্ন: এখনকার বাম দলগুলোর মধ্যে সেরকম কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা কি আপনি লক্ষ্য করছেন?

আহমদ ছফা: বাম দলগুলো নিজেদের চরম ক্ষতি করছে জাতিমুক্তির প্রশ্নটিকে অনুধাবন করতে না পারার কারণে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বিন্যাসটা একটু বোঝা দরকার। আমাদের এখানে যদি উৎপাদন ভিত্তিক, মানে শিল্পপতিরা যদি কলকারখানা তৈরি করতেন, তবে শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পলিটিক্স তৈরি করতেন। কোনো উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি এখানে গড়ে ওঠে নি। এখানে যা আছে তা ট্রেডিং। স্বাধীনতার পর শিল্প কারখানা এখানে হয় নি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। জাতির একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড কোনো সরকার তৈরি করতে পারে নি। পরিবর্তে এখানে একটা ট্রেডিং ক্লাস তৈরি হয়েছে এবং এই ট্রেডিং ক্লাসটা টিকে আছে, ট্রেডিং পলিটিক্স-এর কারণে। ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা দু’ভাবে জনগণকে শোষণ করে। প্রথমত তারা যখন বাইরে কাচামাল রফতানি করে এবং দ্বিতীয়ত যখন বাইরে থেকে ফিনিসড গুডস আমদানি করে। সমস্ত বামদলগুলোকে একসাথে বসাবার চেষ্টা করেছি, মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করতে চাইছি এবং বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে একটা কিছু করাতে চাইছি। কিন্তু একবার যদি সুবিধাবাদের দিকে রাজনীতিটা চলে যায়, তবে সেখান থেকে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল। বামপন্থীরা এখন যেটা করছে, তা হল, একটা অংশ হয়তো বিএনপি’র সাথে, অন্য অংশটি আওয়ামী লীগের এ্যালাইজ(allies) হিশেবে কাজ করছে। এগুলো সবই আত্মধ্বংসী।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারার কারণ কি? এখানে কি কোন দর্শনগত সমস্যা আছে?

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, দর্শনের একটা ক্রাইসিস তো আছেই। কিন্তু আমি মনে করি মার্কসবাদ যদি জগতে ব্যর্থও হয়, শ্রেণী সংগ্রাম তো ব্যর্থ হবার কথা নয়। মার্কসবাদকে যারা সমাজ পরিবর্তনের একমাত্র টুলস হিশেবে মনে করে এবং যারা দেখছেন যে তাদের টুলসটা আর কাজ করছে না, অনিবার্যভাবেই তখন তারা উদ্যম এবং আকাঙ্খা হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু মার্কসবাদ সমাজে কাজ না করলেও নির্যাতিত শ্রেণীর সংগ্রাম কি বসে থাকবে?

প্রশ্ন: সে সংগ্রামে কারা নেতৃত্ব দেবেন?

আহমদ ছফা: আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সামনের সময়টা বামপন্থীদের অনুকূলে আসবে, যদি তারা সক্রিয় হয়। যদি তারা মেধা বা আন্তরিকতা দিয়ে সমস্যাগুলো মূল্যায়ন করেন এবং একটা বিকল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছক যদি তারা তৈরি করতে পারেন। এখন একটা বুর্জোয়া সরকার আছে, বিশ্বব্যাংক আছে, এনজিও আছে, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া আছে, এদের বিপরীতে একটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, জাতিকে বাঁচাবার জন্য একটা উন্নয়নের ছক এবং উপায় আবিষ্কার করা আমার মতে খুব কঠিন কাজ নয়।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম, সব ক্ষেত্রেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে-

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, এটা একটা মজার প্যারাডক্স। যেমন ধরুন বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলেন, মুসলমানরা জলকে পানি। কিন্তু বাংলার বাইরে সবাই, হিন্দু-মুসলমান উভয়েই পানি বলেন। এই জল-পানি নিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানরা একশ বছর লড়াই করছে। যাহা জল তাহাই পানি। যাহা পানি তাহাই জল। এখন আমাদের এখানে কী হচ্ছে? দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো, লড়াইয়ের যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে কেউ যেতে চাইছে না বলে কতগুলো প্রতীক তৈরি হয়েছে। যে কোনো ইতিহাসকে দলীয়করণ করার এই যে অনুদারতা, অসত্যতা, এর কারণ ইতিহাস বলতে তারা জনগণের ইতিহাস বোঝেন না। বোঝেন দলের ইতিহাস, ব্যক্তির ইতিহাস। ইতিহাস তো জনগণের ইতিহাস হবে। কিন্তু এখানে নেতা এবং দলের ইতিহাস সবাই তুলে আনছেন। এর কারণ হচ্ছে, সংঘাতের আসল ক্ষেত্র থেকে, জনগণকে সংঘাতের প্রতীকে ফেরত নেয়া। যেমন আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী? বাঙালি না মুসলমান? এগুলো একটা থেকে আর একটার বিরোধী নয়। আমরা যেমন বাঙালি, তেমনি বেশিরভাগ লোক মুসলমান। আমরা যেমন বাংলাদেশী তেমনি বাঙালিও। কিন্তু এগুলো তৈরি করা হচ্ছে, ক্ষমতার মালিকানা কে নেবে, এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস এখনো অনুসন্ধান করা হচ্ছে। রুশ বিল্পবের সময় স্টালিন এবং ট্রটস্কির ভূমিকা নিয়ে লাখ লাখ পাতা লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির এতবড় একটা ঘটনা, সেটা নিয়ে মতদ্বৈততা, বিতর্ক এসব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু এখানে সবাই মিথ্যা বলছেন কেন? মিথ্যেকে পুজো করছেন কেন? এর একমাত্র কারণ মিথ্যে বললে এখানে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমি থ্রি ফোরের ছাত্র। ছাত্র বয়সে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে গেলে এসব কথা আমরা শুনতাম। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, বাংলায় পাস করে আমরা চাকরি পাব না, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবো, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাব। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেবের(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) একটা কথা- পাকিস্তানিরা যখন বললো, ইসলামের ভিত্তিতে যেহেতু পাকিস্তান, তাই ইসলামের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ইসলামকেই যদি তোমরা অগ্রাধিকার দিতে চাও তবে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করো, তোমরাও শিখবে, আমরাও শিখবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে রাজি হয় না। এইভাবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষা আন্দোলনে আজকে আমরা যা আবিষ্কার করেছি সেই জিনিসটা প্রথমে ছিলনা।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে যে অসাম্প্রদায়িক জাতি চেতনার উন্মেষ তার চূড়ান্ত রূপ স্বাধীনতা। এই সুত্রে আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠবে। ওই আশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আহমদ ছফা: প্রথমত আমি অনেকগুলো পরিচিত চিন্তার বিরোধিতা করব। যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত ছাত্র, বেশিরভাগ মুসলমান। আওয়ামী মুসলীম লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এককালে ছিলেন পাকিস্তানি। আমার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তার কাছে শেখ মুজিবের কিছু ছবি আছে, সেই ছবিতে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব হাউমাউ করে কাঁদছেন। হিন্দু-মুসলমানদের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হল। তারপর পশ্চিমাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে তারা (বাঙালি মুসলমানরা) পারে না। এল সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত নির্বাচন। এইভাবে একটা প্রেক্ষিত তৈরি হল এবং বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের টেনে আনলেন। এই ক্ষেত্রে প্রেমের চাইতে যে জিনিসটা বেশি কাজ করেছে, তা হল তাদের বাস্তব প্রয়োজন। অর্থাৎ যে অর্থে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলতে আমরা যা চিন্তা করি, একটা আইডিয়াল সিচুয়্যেশন, সেটা বোধ হয় এ ক্ষেত্রে কল্পনা করা ঠিক হবে না। তবে কোলকাতা থেকে এটা কল্পনা করার বোধ হয় সময় এসেছে এই কারণে যে, ভাষা আন্দোলন তার নিজস্ব প্রেক্ষিত ছাড়িয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যরকম একটা তাৎপর্য নিয়ে আসছে। কিন্তু উৎসের(ভাষা আন্দোলনের) দিকে গেলে দেখব লক্ষ্য ছিল চাকরি/বাকরি ইত্যাদি। আগেই বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি থ্রি ফোরের ছাত্র। ছাত্র বয়সে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে গেলে এসব কথা আমরা শুনতাম। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, বাংলায় পাস করে আমরা চাকরি পাব না, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবো, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাব। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেবের(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) একটা কথা- পাকিস্তানিরা যখন বললো, ইসলামের ভিত্তিতে যেহেতু পাকিস্তান, তাই ইসলামের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ইসলামকেই যদি তোমরা অগ্রাধিকার দিতে চাও তবে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করো, তোমরাও শিখবে, আমরাও শিখবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে রাজি হয় না। এইভাবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষা আন্দোলনে আজকে আমরা যা আবিষ্কার করেছি সেই জিনিসটা প্রথমে ছিলনা।

‘চীন দেখে এলাম’ বইতে মনোজ বসু লিখেছিলেন, শেখ মুজিব পিকিংএ তাঁকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে ছাড়ব। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মনোজ বসু বইটা প্রত্যাহার করে নেন। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা শেখ সাহেবের মনে থাকতে পারে। আমার মনে হয় এতে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। বীরেন শাসমলের ছেলে নিমলানন্দ শাসমল, ‘ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইতে তিনি লিখেছেন, আজকে যে কারণে আমরা শেখ মুজিবকে মালা দেই, সেই একই কারণে শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে প্রথম ভৌগোলিক দুরত্বের কারণে। ভারতের সাথে কাশ্মীরের কন্টিগিউয়াস(contiguous) এরিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখলে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হবে। আর এ সমস্ত ইস্যুতে আমি একজন সামান্য মানুষ। চূড়ান্ত মতামত দেবার ক্ষমতা আমার নাই।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের অনেক কবি, সাহিত্যিক দাবি করেন, ঢাকাই হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী। এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা আছে-

আহমদ ছফা: ‘রাজধানী’ করার শব্দটা খুব ভাল শব্দ নয়। তবে এ শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরা তো ব্যবসায়ী লেখক, যখন যেখানে যেমন বোঝেন কোপ মারেন। আবার ‘দেশ’ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায়(২১ ফ্রেবুয়ারী ১৯৯৮ সংখ্যা) ‘প্রবাসে বাংলা ভাষা’য় বাংলাদেশের ভূমিকাকে তিনি গৌণভাবে দেখিয়েছেন। রাজধানী শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কারণ মানুষ যেখানে থাকেন, তার সংস্কৃতিও সেখানে থাকে। এক সময় ব্রজবুলি সাহিত্য তৈরি হয়েছিল, এক সময় মঙ্গলকাব্যও লেখা হয়েছিল, একসময় পুঁথিসাহিত্যও তৈরি হয়েছিল। সারা বাংলা জুড়ে নানা বাঁকে নানা সাহিত্য তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাহিত্য এখনকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, এখানকার জীবন, সংগ্রাম,রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়ে লেখা হবে। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সেখানকার মতো বিকশিত হবে। তবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা। সেই কারণে বাংলা ভাষা এখানে যে পেট্রোনাইজেশনটা পাচ্ছে সেটা পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা পাচ্ছে না। বাংলা ভাষা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) একটি ‘প্রাদেশিক’ ভাষা, এবং হিন্দির দ্বারা চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার জন্যে যে প্রেট্রোনাইজেশনটা দরকার আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা তা পাচ্ছে না। কারণ, জাতিগতভাবে বাঙালি সেখানে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা খুব পরিচিত, একটা সময় পর্যন্ত তারা এখানকার সাহিত্যকে সার্ভ করেছেন তাদের অনেকেই এখন সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা সময় যারা জ্বলে উঠেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বর্জ্য পদার্থের কাছাকাছি এসে গেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে পলিটিক্যাল ডেসটিনি না থাকলে, পলিটিক্যাল গোল ক্লিয়ার না থাকলে, শিল্প সাহিত্য তার প্রধান ভিকটিম হয়। এখন বাংলাদেশের চিত্র কোন দিকে যাবে তার দিশা নেই। আপনি দেখবেন হাজার হাজার পাতা পত্র-পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শ করার মত পঞ্চাশটি পাতা আপনি সেখানে পাবেন না। কাজেই অতিকথন করে লাভ নেই। তবে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনা আছে, সেই সম্ভাবনাকে যদি একসপ্লয়েট করতে পারি, তাবে বাংলার এই অংশের সাহিত্যে একটা নতুন যুগ আসতে পারে। এবং তা যদি হয় তবে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাও সাহিত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। সেসব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু শক্তি ও প্রেরণা দিতে পারবে। ‘রাজধানী’ শব্দটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েন করেছিলেন বাংলাদেশে বই বেচার জন্যে।

অন্য কোনো প্রকাশকের বই নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজার বইয়ের বিরুদ্ধে। যে বইয়ের জন্যে ইলিয়াসকে (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই বইতেই(খোয়াবনামা) আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালির শত্রু। বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না। বই যেমন সংস্কৃতির বাহন, তেমনি পণ্য। ইকোনমিক্স-এ একটা কথা আছে-Nurse the baby protect the child, Free the adult আমাদের প্রকাশনা শিল্প পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিদ্বন্দী না পরিপূরক?

আহমদ ছফা: কোনো সাহিত্য বা সংস্কৃতি কারো প্রতিদ্বন্দী হয় না। সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে প্রবাহে প্রবাহে সম্মিলন। ধর্ম প্রতিদ্বন্দী হতে পারে, হয়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি কখনই হয় না।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার বই আমদানির ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্প মার খাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনার স্বার্থে পশ্চিম বাংলার বই আমদানি বন্ধ করার কথাও শুনেছি এবং পশ্চিম বাংলার কোন বইকে এ বছর(১৯৯৮)ঢাকার একুশের বই মেলায় ঢুকতে দেয়া হয় নি। এ বিষয়ে-

আহমদ ছফা: আগে যেটা হত আমদানি তো হতই, অনেকে কলকাতার প্রকাশকের কাছ থেকে ট্রেসিং নিয়ে এসে এখানে ছেপে বিক্রি করতেন। এতে আমাদের বইমেলা বা বইয়ের বাজারে আমাদের(বাংলাদেশের) বই বিক্রি হতো না। ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কলকাতার বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং কলকাতার সেই বইয়ের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে কোনও বইয়ের বাজার এখানে গড়ে ওঠে নি। বই লেখা তো যথেষ্ট নয়, বই প্রমোট করা, বইয়ের আলোচনা করা, নানা কারণে সেসব এখানে হয় নি। স্বাধীনতার পর নানারকম দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের গ্রন্থশিল্পটা বিকশিত হতে পারে নি। কিন্তু কলকাতার গ্রন্থশিল্প অনেকদিন আগে থেকেই বিকশিত। সেই সুত্রে কলকাতার বই বাংলাদেশের সমস্ত বইয়ের বাজার দখল করে নিল। এর মধ্যে আনন্দ বাজারের বইই ছিল শীর্ষে। পুলিশ দিয়ে এটা বন্ধ করা যায় না। ১৯৯৪ সালে বুকে পোস্টার দিয়ে এর প্রতিবাদ করলাম। অন্য কোনো প্রকাশকের বই নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজার বইয়ের বিরুদ্ধে। যে বইয়ের জন্যে ইলিয়াসকে (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই বইতেই(খোয়াবনামা) আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালির শত্রু। বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না। বই যেমন সংস্কৃতির বাহন, তেমনি পণ্য। ইকোনমিক্স-এ একটা কথা আছে-Nurse the baby protect the child, Free the adult আমাদের প্রকাশনা শিল্প পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।

ভারতের বইয়ের কপিরাইট কিনে এখানকার প্রকাশকরা ছাপুন আপত্তি নেই। সুনীলের(গঙ্গোপাধ্যায়) কোনো বই কপি রাইটে কিনে এখানে ছাপা হলে আমাদের কমপোজিটার, ছাপা খানা, দপ্তরি, পাইকার সবাই টাকা পাবে। তবে Medical Science, Technology-এর বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলি না। কারণ এসব বই আমেরিকা থেকে আনলে যদি পাচ’শ ডলার লাগে, ভারত থেকে আনতে লাগে এক’শ ডলার। এবং আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনার বইয়ের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করিনা।

প্রশ্ন: কলকাতার বই মেলা তো—

আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে) দেখুন, আমরা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা কেন কলকাতাকে অনুসরণ করতে যাবো। আপনার পত্রিকাতেই পড়েছে- কলকাতা বই মেলার আমন্ত্রণপত্রে প্রথমে হিন্দি তারপর ইংরেজী এবং শেষ তিন নম্বরে বাংলার স্থান। যদি ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলায় ওই তিন নম্বর স্থান থেকেও বাংলা ভাষা মুছে যায় মোটেই অবাক হবো না। কারণ এটাই ভারত সরকারের পলেসি এবং এতেই ভারতের ‘ঐক্য সংহতি’ দৃঢ় হবে। আমাদের একুশের মেলা বাংলা ভাষার মেলা, বাংলাদেশের বইমেলা। একটি স্বাধীন জাতি হিশেবে, স্বাধীনভাবেই আমাদের চলার পথ আবিস্কার করতে হবে। আপনারা (পশ্চিম বাংলা ও ভারতের বাঙালিরা) জাতি হিশেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে স্বাধীন নয়, আপনারা দিল্লি এবং হিন্দি সমান। সবক্ষেত্রে দিল্লি এবং হিন্দির নির্দেশ মেনেই আপনাদের চলতে হয়। পরাধীন জাতি হিশেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা(ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না। কিন্তু আমরা ‘পাকিস্তান সংহতি’কে কবরে পাঠিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই পশ্চিম বাংলা বা কলকাতাকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে যাব না। যদি কোনদিন স্বাধীন হয়ে স্বাধীন চিন্তা এবং পথকে আবিস্কার করতে পারেন, সেদিন নিশ্চয় আমরা পশ্চিম বাংলা ও কলকাতার দিকে তাকাব।

প্রশ্ন: আপনি আনন্দবাজার প্রকাশনার কথা বললেন, কিন্তু অন্য প্রকাশনার বইও তো একুশের বইমেলায় ছিল না?

আহমদ ছফা: না, একুশে মেলার বিষয়টা আলাদা। একুশের মেলা ছাড়া অন্য যেসব বইমেলা হয় তাতে থাকে। একুশের মেলা হল বাংলাদেশের লেখকরা কতটুকু উঠলেন, কতটুকু বিকশিত হলেন তার মান নির্ণয়ের মেলা। এখানে অন্য বই থাকবে না। আন্দোলন করে একুশের মেলাটিকে আমরা নিজেরে বইয়ের মেলা করতে চাইছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অন্য কোনো স্থানের বই একুশের বইমেলায় থাকবে না। এই দাঁড়াচ্ছে মূল ব্যাপারটা-

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, তবে কোনো ভারতীয় বই যদি বাংলাদেশে ছাপা হয় তাবে সে বই মেলায় থাকতে পারবে। এইটুকু যদি না করতে পারি, তবে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম কেন? আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে বলি। একবার আনন্দবাজারের বাদল বসু আমার একটা ইন্টারভিউয়ের প্রতিবাদ করে খুব খারাপ কথা বলেছিলেন। তারপর আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক শওকত ওসমান বললেন, আহমদ ছফা খুব খারাপ লোক। উনি(শওকত ওসমান) খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দটা আমি বলছি না। এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোনো বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোনও বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদি দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিশেবে ছোট লেখক নন, তাঁর অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভাল। এই অবস্থা দেখে শওকত ওসমানকে আমি বললাম, দেশটা আমরা বল ছেড়ার জন্য স্বাধীন করেছি? আনন্দবাজার ‘দেশ’ পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) সংখ্যায় বদরুদ্দীন উমরের রচনা নিয়ে যা করলো, এসব বদমাইশি আর আমরা হতে দেব না। আপনারা তো দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে কাজ করছেন। আর আনন্দবাজার আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে সংখ্যা বের করেছে স্রেফ বাংলাদেশে তাদের মার্কেট রাখার উদ্দেশ্যে।

হিন্দির বড় এজেন্ট হচ্ছে আনন্দবাজার। আমি এইভাবে ব্যাখ্যা করবো। জানি না আপনারা পশ্চিম বাংলার লোকেরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন। নানাভাবে ভারত ফাঁদ পেতে রাখছে। সেই ফাঁদে আমাদের পড়ার অপেক্ষা। আমরা যদি ভারতের ফাঁদে পড়ি, পশ্চিম বাংলার লোকদের কর্তব্য হবে- আমাদের স্বাধীন অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। না হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অবস্থাও গয়া হবে। পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।

প্রশ্ন: দিন কয়েক আগেই স্বাধীন বাংলা পত্রিকার জন্যে বদরুদ্দীন উমরের একটি সাক্ষাতকার আমরা গ্রহণ করেছি। সেই সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন যে, এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায়(২১ফেব্রুয়ারি ’৯৮ সংখ্যায়) তাঁর (বদরুদ্দীন উমর) একটি লেখা প্রকাশের জন্যে বাংলাদেশ সরকার দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি এখানে(বাংলাদেশে) নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বদরুদ্দীন ওমর আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কিন্তু জানান নি। বরং আমাকে কোলকাতা গিয়ে তাঁর লেখাটি পড়তে বলতেন। বাংলাদেশ সরকার যদি ‘দেশ’ পত্রিকার কোনো সংখ্যা এখানে আসতে না দেয়, তা হলে আনন্দবাজারের কী করার থাকতে পারে? এবং এখানে তাদের ‘বদমাইশিটাই বা কোথায়?

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, এটা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, কিংবা সব ঘটনাটি জেনেছি। ব্যাপারটা হচ্ছে-‘দেশ’ পত্রিকা একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে ভাষা আন্দোলনের গবেষক লেখক বদরুদ্দীন উমরের কাছে একটি লেখা চাইলে, উমর তাদের জানান যে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার ঘরানার লেখক নন। এরপর আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে বদরুদ্দীন উমরকে জানানো হয় যে, ভাষা আন্দোলনের উপর তিনি যা লিখবেন তাই দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে। এবং দেশ পত্রিকায় উমরের ওই লেখাটি ছাপা হলে দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যার চালান বর্ডারে আটকে দেয়া হয়। এতে দেশ পত্রিকার সম্পাদক উমরের লেখাটি প্রকাশ করার জন্যে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশন মারফত বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃপ্রকাশ করে ক্ষমা চায় এবং উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে শওকত আলীর একটা লেখা যোগ করে দেয় পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। শওকত আলীর লেখাটিও ২১ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশ পত্রিকার মূল সংখ্যায় শওকত আলীর লেখাটা ছিল না। পরে যখন তারা (দেশ পত্রিকা) বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দেন তখন সেই শূন্যস্থান তারা পূরণ করেন শওকত আলীর লেখাটি দিয়ে। এই মিথ্যাচার এবং কপটতা আনন্দবাজারের পক্ষে সম্ভব। লেখা চেয়ে নিয়ে লেখা ছাপার পর তা পত্রিকা থেকে বাদ দেয়া এবং লেখাটি আনন্দবাজার ভুল করে ছেপেছে বলে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্য লেখা যোগ করে তা (দেশ পত্রিকা) এখানে পাঠানো এসব করতে গিয়ে আনন্দবাজার একবারও বদরুদ্দীন কিংবা শওকত আলীকে কিছু জানাবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আপনি বলুন এসব বদমাইশি ছাড়া আর কি?

আমাদের ইতিহাস আমরা লিখবো না, লিখবে আনন্দবাজার। এত রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা, তার একটা দাম আছে। একবার নীরদ চৌধুরী তথাকথিত বাংলাদেশ লেখার কারণে দেশ পত্রিকা এখানে বন্ধ হয়ে যায়। এত সাপ্তাহিক দেশ পাক্ষিকে পরিণত হয়। এখন যদি ‘দেশ’ আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেই তবে তা মাসিক হবে। সেটা আমরা এখনই করতে চাই না, কারণ পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাটা টিকিয়ে রেখেছেন লেখকরা। আর কোনো ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার চর্চা নেই। বাংলা ভাষার ওপর ওখানে(পশ্চিম বাংলায়) যে আক্রমণটা চলছে সেই সময় আমরা যদি পশ্চিম বাংলার বই আমদানি করা বন্ধ করে দেই, তবে তার সুযোগ নেবে এখানকার মৌলবাদীরা, এবং ওখানকার বাংলা ভাষার চর্চা চরম বিপদে পড়বে। দীঘদিন ধরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার অনুকূলে নয়। পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মাড়ওয়ারী এবং গুজরাটিরা। আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হয় দিল্লি থেকে। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হয় হিন্দি বলয়ের স্বার্থকেই। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে বাংলা ভাষা পশ্চিম বাংলায় টিকে আছে তার কারণ সেখানকার লেখকরা এখনো বাংলা ভাষায় লিখছেন। বাংলা ভাষার প্রতি প্রেমের কারণেই আমরা পশ্চিম বাংলার এই আমদানি বন্ধ করছি না। এমনকি আমরা চাই না ‘দেশ’ পত্রিকার মত একটি কাগজ বন্ধ হয়ে যাক। পশ্চিম বাংলার প্রতি আমাদের এই অনুভবটা আপনি পৌঁছে দিবেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বাংলাদেশে তিনজন মানুষ মারা গেছেন। আর মমতা বন্দোপাধ্যায় এখানকার ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, কলকাতা শহরতলীতেই মারা গেছেন একশজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একশ জনকে আমরা পঞ্চাশ ধরতে পারি। এই তিনজন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আনন্দবাজার যে কাণ্ডটা করল এটা কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি কোন ভদ্রোলোক করে না। মনে বিষ না থাকলে এটা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: যদি বলা হয় প্রতিযোগিতায় না পারার কারণে এই ক্ষোভ?

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, একথা বলতে পারেন। তবে আমি রেপড হচ্ছি, আপনি ভাববেন না আমি মজা পাচ্ছি। আনন্দবাজারের একটা সাকসেসফুল ব্যাপার আছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালির টাকা নেই। কিন্তু আনন্দবাজার টাকা করেছে। সাহিত্যটাকে তারা ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করেছে এবং সমস্ত লেখককে তারা পূজা সংখ্যার লেখক-এ পরিণত করেছে। তারা তাদের পঁচাত্তর বছরের ঐতিহ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রোয়িং প্রসেসে হস্তক্ষেপ করেছে। একজন সাধারণ লেখককে পুরস্কার দিয়ে তুলে ধরে, অন্যদিকে একজন সত্যিকার ভাল লেখককে অপমান করে। যেমন তারা তসলিমা নাসরিনকে পুরস্কার দিয়ে দুই কোটি টাকা আয় করেছে। আপনি যদি চান আমি হিশাব দেব। এখানে তারা পাঁচটি আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের হস্ত এখানে প্রসারিত হচ্ছে। হিন্দির এত বড় এজেন্ট হচ্ছে আনন্দবাজার। আমি এইভাবে ব্যাখ্যা করবো। জানি না আপনারা পশ্চিম বাংলার লোকেরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন। নানাভাবে ভারত ফাঁদ পেতে রাখছে। সেই ফাঁদে আমাদের পড়ার অপেক্ষা। আমরা যদি ভারতের ফাঁদে পড়ি, পশ্চিম বাংলার লোকদের কর্তব্য হবে- আমাদের স্বাধীন অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। না হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অবস্থাও গয়া হবে। পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।

সাপ্তাহিক দেশ পাক্ষিকে পরিণত হয়। এখন যদি ‘দেশ’ আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেই তবে তা মাসিক হবে। সেটা আমরা এখনই করতে চাই না, কারণ পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাটা টিকিয়ে রেখেছেন লেখকরা। আর কোনো ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার চর্চা নেই।

প্রশ্ন: বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-

আহমদ ছফা: পাকিস্তান ভেঙে যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেন তবে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলোই বা তা পারবেন না কেন? এবং কোন অধিকারে দিল্লি তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাঙালি, কাশ্মীরী, নাগা ইত্যাদী জাতিগুলোর ওপর রাজনৈতিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির ওপর হিন্দির স্টিমরোলার চালাবে? আনন্দবাজার শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও শত্রু এবং বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের প্রয়োজনে শুধু দিল্লি বা হিন্দির বিরুদ্ধে নয়, আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে একদিন আপনাদের (পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের) দাঁড়াতে হবে। ফারাক্কা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে পশ্চিম বাংলার কম ক্ষতি হয় নি। ভারতের পানি অবরোধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানি যখন ফারাক্কা অভিযান (১৯৭৬) করেছিলেন, লক্ষ্য করে দেখবেন, আনন্দবাজার কী কুৎসিত এডিটোরিয়াল লিখেছেন। এখন আবার দেখবেন, কী ভাবে তারা ভাষা পাল্টালেন। বাংলাদেশের রস পায় বলে পশ্চিম বাংলায় আনন্দবাজার দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দবাজারকে কিভাবে টোন ডাউন করতে হয় আমরা জানি। এমনিতে আনন্দবাজার যথেষ্ট ভাল বই ছাপে, দেশ পত্রিকা একটি সুসম্পাদিত পত্রিকা। কিন্তু একটি পত্রিকা একটি জাতির সুসাহিত্যকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে রাখে, এটা পৃথিবীর অন্য কোথাও আপনি পাবেন না।

প্রশ্ন: নিজস্ব কোন সাহিত্য ধারা আপনারা কি তৈরি করেছেন?

আহমদ ছফা: এখনো পারিনি। কিন্তু আমরা বসে থাকব, এটা ভাবাও ঠিক নয়।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার পাঠকদের সম্পর্কে-

আহমদ ছফা: পশ্চিম বাংলার পাঠকরা এত ভাল। সেখানে গলির মোড়ে মোড়ে বিদগ্ধ লোক পাওয়া যায়। দেশ পত্রিকাতে যে সমস্ত পাঠক চিঠি লেখেন, চিঠিগুলো যেভাবে গুছিয়ে লেখেন, পৃথিবীর কম দেশেই এমন গুছিয়ে লেখেন। অন্য পাঁচটা দেশের সাহিত্য এবং পত্রিকা পড়েই একথা বলছি । পশ্চিম বাংলায় ভাল মানুষের সংখ্যা কম নয়, অনেক Unfortunately তারা অসহায়। অর্থনৈতিকভাবে তারা অসহায় এবং সংস্কৃতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তারও অসহায় শিকার তারা।

প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বা বাংলা নবজাগরণ বিষয়ে-

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার রেজাল্ট আমরা সবাই কমবেশি ভোগ করেছি। বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে, আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক সংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এসব আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা থেকে। তবে একে রেনেসাঁ বলা ঠিক নয়। তবে এর মধ্যে রেনেসাঁর অঙ্কুর ছিল। পরবর্তীকালে যা হয়েছে, তা হলো রিভাইভিলিজম। বঙ্কিম, ভুদেব থেকে এমনকি রামমোহন রায় হিন্দু রিভাইভলিজাম থেকে মুক্ত নন। আমি জানি না, পশ্চিম বাংলার বিদগ্ধ সমাজ আমার কথাগুলোকে কীভাবে নেবেন। আমি মুসলিম সমাজের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছি। যেমন বিদ্যাসাগর তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অত্যন্ত কম। একথা রামমোহন রায় এবং তার সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম নয়, নিম্মবর্গের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরের এর কোন প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।

প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দির বিতর্কিত চরিত্র বঙ্কিম, তার সাহিত্য প্রতিভা এবং রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে-

আহমদ ছফা: বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে বাংলার মুসলমান লেখকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমকে সমর্থন করেন এমন লোক বাংলাদেশে অল্প নয়। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিমকে দেখেন। আমি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে যে বইটি (শতবর্ষের ফেরারী) লিখেছি তাতে নতুন কথা কিছু লিখিনি। সুশোভন সরকারের ছেলে সুমিত সরকার ইংরেজী ভাষায় বঙ্কিম ও হিন্দুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের বই লিখেছেন। লেখক হিশেবে বঙ্কিম নবযুগের উদগাতা। তিনি মানবিক এবং সেকুলার চিন্তার ধারক-বাহক। কিন্তু বঙ্কিম যখন রাষ্ট্র চিন্তা করেন, তখন হিন্দু রাষ্ট্র চান। গিরিলাল জৈন ফেনামেনন বলে একটা বই লিখেছেন। এই বইটিকে বিজেপির বাইবেল বলা হয়। এই বইটিতে তিনি বঙ্কিমকে কীভাবে দেখেছেন। আজকে বিজেপির কোন ফোরাম থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না, রবীন্দ্রনাথ তাদের কোনো কাজে আসবে না। স্বয়ং নীরদ চৌধুরী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ খ্রীস্টান চিন্তা-চেতনা প্রচার করেছেন। আমি বুঝতে পারি না, পশ্চিম বাংলার লোক বঙ্কিমের প্রতি অন্ধ অনুরাগ কেন রাখবেন? তারা তো অনেক বেশি মুক্তচিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বঙ্কিমের প্রশ্নে তারা ঢোক গেলেন কেন?

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য চর্চায় আপনি কি সাম্প্রদায়িকতার কোন আভাস পান?

আহমদ ছফা: না, এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।

প্রশ্ন: বিদ্বেষহীন সুস্থ সম্পর্কের জন্যেই প্রয়োজন খোলামেলা মত প্রকাশ-

আহমদ ছফা: এটা অব্শ্য ভাবার বিষয়। হ্যাঁ, কিছু পাইতো বটেই। যেমন পশ্চিম বাংলার এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক যিনি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় তার একটি উপন্যাসে লিখেছেন, মুসলমানরা কোরআন পড়েন উর্দু ভাষায়।

প্রশ্ন: কেউ যদি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের জটায়ুর মতো লেখেন যে উট তার পাকস্থলিতে জল বোঝাই করে মরুভূমির পথে হেটে চলছে…এটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কি? এ ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতা নয়, অজ্ঞতা বলাই কি যুক্তিসঙ্গত নয়?

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। কিন্তু এত অজ্ঞ হওয়ার তো কথা নয়। আর এত অজ্ঞ হলে উপন্যাস লিখতে এসেছো কেন? এমন-কী ‘প্রেম নেই’ বলে যে উপন্যাসটার তারিফ করা হয়, তাও লেখা হয়েছে মুসলিম লীগের স্ট্যান্ডটাকে ভেরিফাই করার জন্যে। কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হয় নি। যে প্রেক্ষিতটা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) রয়েছে, আমার বিবেচনায় তা দূষিত। অনেকেই লিখবার আগে ধরে নেয় জিন্নাহ একজন ক্রিমিনাল। পশ্চিম বাংলায় প্রচুর সুস্থ লোক রয়েছে, অসাম্প্রদায়িক লেখক আছেন যথেষ্ট কিন্তু এনটায়ার প্রেক্ষিতটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছেন না।

সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাম উপন্যাসের নায়ক। এরপর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তাঁর পুত্রকে হত্যা করার হুমকি দিল। সুকুমার সেন বলেছেন, রাম শব্দের অর্থ হলো পূর্ণতা। এটি এসেছে ইরান থেকে এবং ‘রামরাজ্য’ শব্দটি গান্ধীজী নিয়েছিলেন টলস্টয়ের Kingdom of God এর ভারতীয় শব্দ হিশেবে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে ধর্মীয় অভিধায় যুক্ত করে রাজনীতিতে এটা প্রধান শক্তি হওয়া, সে জিনিস বাংলাদেশে নেই।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলা বা কলকাতা সম্পর্কে আপনার এই সমালোচনা কী যুক্তিবাদী মননশীল জায়গা থেকে না কোনো ধর্মীয় অনুভূতি থেকে-

আহমদ ছফা: বাইরের লোক যখন দেখেবেন, আমি যখন সাফারার, অন্য লোক এর মধ্যে ধর্মীয় সত্তা খুঁজে পাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আমার জীবনে। আমি আমার গ্রামে থাকতে পারি না, মোল্লারা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কারণ আমি ইসলামের কিছুই করি না, বিশ্বাসও করি না। আমার জীবনের মধ্যে কাজ করে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উপজাতি। মুসলমান সমাজকে সকলে কনডেম করেন। বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। সুতরাং আমার জনগোষ্ঠীর ওপর যে সাংস্কৃতিক অত্যাচারগুলো হয়েছে, আমি সেটাকে যদি ডিফেন্ড করি অনেকে সাম্প্রদায়িক মনে করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় না পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাকে ভুল বুঝবেন। আমি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত একটা জিনিসকে তুলে ধরছি। আপনি যদি এখানকার (বাংলাদেশের) হিন্দুদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন তারা শামসুর রাহমান বা অন্যান্যদের থেকে আমাকে বন্ধু হিশেবে বেশি পছন্দ করবেন, যদি মাঝখানে ভারতের প্রসঙ্গটা না আসে। আমাদের দেশে যদি একজনও হিন্দু না থাকে তবে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের নিয়ে আমি বাচতে পারবো না।

প্রশ্ন: স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা মৌলবাদী বাধা কি এখানে আছে?

আহমদ ছফা: না, সেরকম আমি কিছু মনে করি না।

প্রশ্ন: স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার এখানে আছে?

আহমদ ছফা: এটা একটা কথা, আমি যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। ধর্মীয় বা মৌলবাদের প্রভাব নয়, এটা একটা অবিকশিত সমাজের লক্ষণ। আরো দেখবেন মৌলবাদের যে উপাদান সেটা বাংলাদেশের সোসাইটিতে নেই। বাংলাদেশে পাঁচজন লোক খুঁজে পাবেন না, যে আরবি জানেন। পাঁচজন লোক পাবেন না, যে সংস্কৃত জানেন। কিন্তু আপনাদের দেশে তা ভুরিভুরি পাবেন। মৌলবাদ প্রথম জন্মায় ধর্মগ্রন্থ থেকে। বাংলাদেশে তার কোনো অবস্থান নেই। এখানে যা আছে তা মধ্যযুগীয়তা। মধ্যযুগীয়তা আর মৌলবাদকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। ভারতবর্ষে মৌলবাদ জন্মাচ্ছে সরাসরি ধর্মগ্রন্থ থেকে। যেমন, রাম মন্দির, রাম মন্দির ছিল কিনা ঐতিহাসিকরা কোন কথা বলতে পারছেন না। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাম উপন্যাসের নায়ক। এরপর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা তাঁর পুত্রকে হত্যা করার হুমকি দিল। সুকুমার সেন বলেছেন, রাম শব্দের অর্থ হলো পূর্ণতা। এটি এসেছে ইরান থেকে এবং ‘রামরাজ্য’ শব্দটি গান্ধীজী নিয়েছিলেন টলস্টয়ের Kingdom of God এর ভারতীয় শব্দ হিশেবে। কিন্তু এই শব্দগুলোকে ধর্মীয় অভিধায় যুক্ত করে রাজনীতিতে এটা প্রধান শক্তি হওয়া, সে জিনিস বাংলাদেশে নেই।

প্রশ্ন: রাম শব্দের যে প্রভাব উত্তর ভারতে বা হিন্দি বলয়ে আছে বাংলায় তা নেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদ বধ কাব্য’-এ রামকে এক ক্লীব চরিত্র বা ভিখিরি হিশেবে উপস্থিত করেছেন। এই জন্যে তিনি কারো দ্বারা আক্রান্ত হন নি-

আহমদ ছফা: মাইকেল মধুসূদন দত্তর বই একশো কপির বেশি ছাপা হত না। বঙ্কিমের বই দু’শ আড়াই’শ কপির বেশি ছাপা হত না। একটা বই নিয়ে আজকে যে জনমত তৈরি হয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়, সে যুগে এটা কল্পনা করা যেত না। মাইকেলের আর একটা সুবিধে ছিল তখন শাসকরা ছিলেন ইংরেজ এবং মাইকেল নিজে খ্রীস্টান হয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টানরা তখন রাজার আনকূল্য পেতেন। মাইকেলের পক্ষে মেঘনাদ বধ লেখা সম্ভব হয়েছিল দুটো কারণে। প্রথমত তিনি হিন্দু পরিমণ্ডলের বাইরে মাদ্রাজ চলে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজ গিয়ে তিনি মহারাষ্ট্র পুরান পড়েছিলেন। আর তামিলরা রামকে নয়, রাবনকেই পূজা করেন। এসব মাইকেলকে প্রভাবিত করে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন যখন রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। তিনি যখন কারবালাকে নিয়ে ট্রাজেডি লিখতে চাইলেন, তার বন্ধুরা বাধা দিলেন। কাজেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তিনি তার অবস্থার কাছে অনেক বেশি নতি স্বীকার করেছেন।

বিসর্জন লেখার পর কালীমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না। রাজর্ষি লেখার পর রামকৃষ্ণ মিশনে রবীন্দ্রনাথের কোনো কিচ্ছু উচ্চারিত হয় না।

প্রশ্ন: পরবর্তী পর্যায়েও কিন্তু বাংলার পাঠকরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বর্জন করেন নি…

আহমদ ছফা: তা করেন নি। কিন্তু এখনো একটা বিতর্ক থেকে গেছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত না শ্রী মধুসূদন। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। মোহিতলাল থেকে প্রমথনাথ বিশী, ক্তো বই লেখা হয়েছে। এখনো লেখা হচ্ছে, এমনকি ক্ষেত্র গুপ্তর সাম্প্রতিক বই। এসব আপনাদের নির্ণয় করতে হবে। আর আমি মনে করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক লেখক।

অন্যদিকে দেখুন বিসর্জন লেখার পর কালীমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না। রাজর্ষি লেখার পর রামকৃষ্ণ মিশনে রবীন্দ্রনাথের কোনো কিচ্ছু উচ্চারিত হয় না।

প্রশ্ন: যুক্তিবাদী সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে….

আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে) যুক্তিবাদী, সহনশীল, মুক্তবুদ্ধি এগুলি খুব খারাপ শব্দ। পরিবেশ বিশেষে এসব হয়ে যান অনেকে। আসল কথাটি হল জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি।

প্রশ্ন: লালন বা হাছন রাজার গান কী এ ক্ষেত্রে—

আহমদ ছফা: সাহিত্যবিলাসী লোকেরা এসব খুব বলাবলি করে। লালনেরও আগে চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। হিন্দু সমাজের মানুষ অবশ্য এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাই। বাঙালি জাতিসত্তা হিশেবে লালনকে আমরা চিন্তায় লালন করি, কারণ গৌতম বুদ্ধের যে চিন্তা, তা কবীরের কাছে বাহিত হয়ে লালন তা ধারণ করেছেন। লালনের গানগুলোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও চিন্তা এখনো বেঁচে আছে। অবচেতনে তা আমাদের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথও সেখানে একবার প্রণত হয়েছে। আর একটা জিনিস, লালনের গানের মধ্যে কবীরের দোহার হুবহু অনুপ্রাণিত গান আছে কয়েকশত। বুদ্ধদেবের শিষ্যরা বুদ্ধদেবের শিক্ষাটাকে নানা ছদ্মবেশে বাচিয়ে রেখেছেন। এটা আমাদের খুবই প্রয়োজনীয় ঐতিহ্য। তবে এসব কখনোই সমাজের চালিকা শক্তি হয় নি। থেকে গেছে Sub culture এর স্তরে।

প্রশ্ন: ‘শিখা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে দুইয়ের দশকের ঢাকায় মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন হয়েছিল—

আহমদ ছফা: মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে যাকে গৌরবান্বিত করা হচ্ছে, তাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এই কারণে যে, এদের মধ্যে একজন ছিলেন real serious লোক। He died quite earlier। আবুল হুসেন ছাড়া আর যারা ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে তারা কী কাজ করেছেন? নজরুল একা যে কাজ করেছেন, এরা সকলে মিলে কী কাজ করেছেন? যেমন আবদুল ওদুদ, এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাক্ষণ হওয়া। হুমায়ুন কবীরের রচনার মধ্যে যে যুক্তিবাদিতা, তার মধ্যে আমি বড় কিছুই খুঁজে পাই নি। বেগম রোকেয়া এর থেকে অনেক বড় কাজ করেছেন। আব্দুল ওদুদ-রা কী মুক্তবুদ্ধি করবেন! আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির একজন লোক, যিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কাজেই এগুলো যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মনের মিল নেই। আবার এ আন্দোলনটার মধ্যে একেবারেই কিছু ছিল না, তাও ঠিক নয়। অশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতায় আকীর্ণ বাঙালি মুসলমান সমাজের কিছু তরুণের মধ্যে প্রথম একটা হাওয়া লেগেছে, স্পন্দন লেগেছে, আলো পড়েছে। কিন্তু ঐ চর্চা স্থায়ীত্ব পায় নি, সমাজে তারা প্রভাবও পড়ে নি।

যুক্তিবাদী, সহনশীল, মুক্তবুদ্ধি এগুলি খুব খারাপ শব্দ। পরিবেশ বিশেষে এসব হয়ে যান অনেকে। আসল কথাটি হল জনগণকে তার সংস্কৃতি নির্মাণে কোনও সুযোগ দেওয়া হয় নি।

প্রশ্ন: বাঙালি জাতির সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে অন্তরায় মনে করেন

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, একটি বাধা আছে। বাঙালি যখন সর্বভারতের দায়টা কাঁধে নেন, সর্বভারতীয় চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন হন, তখন তার জাতীয়তার ভাগে শূন্যতা উপস্থিত হয়। বাংলা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে under Drain, দিয়েছে বেশি পেয়েছে বঞ্চনা। বাংলাতেই প্রথম ব্যাংক, শিপিং কোম্পানি, ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। বাংলাতে প্রথম বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের সুত্রপাত ঘটেছিল। বাঙালিরা সেসব কিছুই ধরে রাখতে পারে নি। কর্নওয়ালিস বাঙালিকে নকল ভূস্বামী বানিয়ে দিল। তখন বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্য সব চলে গেল। এবং বাঙালি একদিকে হলো একদিকে বাবু অন্যদিকে কেরানি। তারপর সবক্ষেত্রে বাঙালি দিয়েছে অনেক, পেয়েছে কম। দেশ ভাগের সময় আবুল হাশিম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের হলোটা কী? ১৯০৫ সালে যারা মাতৃঅঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, অবাঙালির অর্থে, অবাঙালির চিন্তা ও মতামতের বাহক হয়ে, তারাই আজকে বাংলাকে ভাগ করছেন। যে জাতি জন্ম দিয়েছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চন্দ্র, সুভাষ বসুর মতো মানুষদের, তারাই আজকে বাংলার বাইরের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাকে ভাগ করছেন। এদের আজকে কী হল! What happened to the Bengali Hindus?

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা বড় কাজ করছে। এখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকুক, না থাকুক, মুক্তচিন্তার অবকাশ থাকুক, না থাকুক, অন্যন্য মুসলিম অঞ্চল থেকে বাংলাদেশ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালিকে বাঙালি পরিচয়েই বাচতে হবে সে আরবীয় হতে পারবে না, সে চাইনিজ হতে পারবে না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হয়তো যাবে, কিন্তু বাঙালি পরিচয়েই আমাদের বাচতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের শেকড়টা কোথায়, কিংবা তাদের জাতি পরিচয়ের চেতটনাটা কতটুকু স্পষ্ট আছে। এ বিষয়ে আমাদের ঘোর সংশয় আছে। ভারতীয় পরিচয়ের ভার বহন করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জাতি পরিচয়টা মুছে যাচ্ছে। এসব বুঝতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটু সময় লাগবে। দিল্লি-হিন্দির আধিপত্যের গুণগান কোলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবীদরা যত করে থাকেন, ভারতের অন্য কোন শহরে এ চিত্র আপনি পাবেন না। কারণ অন্য শহরের মানুষের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে যে শিকড়ের সম্পর্ক আছে কোলকাতায় তা নেই। তাই হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কোলকাতাতেই বেশি মেনে নিচ্ছে। আবার কোলকাতার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায় এলে, তাদের বাংলা ভাষা প্রেম আকাশ স্পর্শ করে। এই দ্বিচারিতা কোলকাতার মজ্জাগত। কারণ কোলকাতা শহরটা হচ্ছে কলোনাইজেশনের প্রথম ডিচ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গোড়াপত্তন হয় ঐ শহরে। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব কলকাতা শহরে যতোটা কাজ করে ভারতবর্ষের অন্য কোনও শহরে তা করে না। কোলকাতার লোক ভারত প্রেমিক, বিশ্বপ্রেমিক হতে পারেন, ভারতকে, বিশ্বকে বুকে মাথায় নিতে পারেন। কিন্তু বাংলার সমগ্র অন্তজ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলা ও বাঙালির জন্যে কতটা কি করতে পারবেন, এ বিষয়ে আমার গভীর সংশয় আছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের বাঙালির সামনে কোন বাধা?

আহমদ ছফা: Absolute নয়, একমাত্র ভারত যদি আমাদের কুঁজো করে না রাখে। কারণ আমাদের উন্মেষের মধ্য দিয়ে দুটো জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। ভারত যখন ভাগ হয় জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতের হিন্দু মুসলমান দুই জাতি। গান্ধী, নেহরু বলেছিলেন ভারত এক জাতি। পাকিস্তান হয়ে গেল ঠেকানো গেল না। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি এই পরিচয়েই ভাল হলো। এরপর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন আর একটি ঐতিহাসিক সত্য উঠে এল। ভারত এক জাতি নয়। দ্বিজাতি নয়। ভারত বহুজাতি। একটু আগেই আপনি প্রশ্নটা করেছিলেন, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ হয়েছে ইত্যাদি। কথাটা সত্য আবার সত্য নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়ত কথা সত্য, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কথাটা সত্য নয়। বহুজাতিক ভারত রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগুলোর জাতি পরিচয় এবং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক বড় প্রেরণা এবং দৃষ্টান্ত। নানা অপূর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিশেবে বাংলাদেশের উত্থান ভারত উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে সব-চাইতে অভিনব ঘটনা।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ‘সর্বভারতীয়’ দক্ষিণপন্থী দলগুলো মনে করে বাংলাদেশ হল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভুল সংশোধন। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। কারণ এটা শুধু দ্বিজাতি তত্ত্ব নয়, ভারতীয় এক জাতি তত্ত্বেরও ভুল সংশোধন। এই সত্যকে ভারতের বাম-দক্ষিণ কোনো ‘সর্বভারতীয়’ দলই স্বীকার করতে চায় না। কারণ এই সত্যকে স্বীকার করলে ‘ভারতীয় ঐক্য সংহতি’ রক্ষার নামে বহুজাতিক ভারতবর্ষের জাতিগুলোর ওপর দিল্লি-হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী ঐক্যনীতি চালানো সম্ভব নয়।

বাঙালি যখন সর্বভারতের দায়টা কাঁধে নেন, সর্বভারতীয় চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন হন, তখন তার জাতীয়তার ভাগে শূন্যতা উপস্থিত হয়। বাংলা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে under Drain, দিয়েছে বেশি পেয়েছে বঞ্চনা। বাংলাতেই প্রথম ব্যাংক, শিপিং কোম্পানি, ইন্সুরেন্স কোম্পানির ব্যবসা শুরু হয়েছিল। বাংলাতে প্রথম বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের সুত্রপাত ঘটেছিল। বাঙালিরা সেসব কিছুই ধরে রাখতে পারে নি। কর্নওয়ালিস বাঙালিকে নকল ভূস্বামী বানিয়ে দিল। তখন বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্য সব চলে গেল। এবং বাঙালি একদিকে হলো একদিকে বাবু অন্যদিকে কেরানি। তারপর সবক্ষেত্রে বাঙালি দিয়েছে অনেক, পেয়েছে কম। দেশ ভাগের সময় আবুল হাশিম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের হলোটা কী? ১৯০৫ সালে যারা মাতৃঅঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, অবাঙালির অর্থে, অবাঙালির চিন্তা ও মতামতের বাহক হয়ে, তারাই আজকে বাংলাকে ভাগ করছেন। যে জাতি জন্ম দিয়েছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চন্দ্র, সুভাষ বসুর মতো মানুষদের, তারাই আজকে বাংলার বাইরের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাকে ভাগ করছেন। এদের আজকে কী হল! What happened to the Bengali Hindus?

প্রশ্ন: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ছাব্বিশ বছর পরও এখানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র, শোষণ, অশিক্ষা এবং জাতি পরিচয় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের জাতিগুলোর সামনে যে দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণা স্থাপিত হয়েছে, তা কি অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে না?

আহমদ ছফা: হ্যাঁ, এটা খুব ঠিক কথা। প্রথমত এখানে বুর্জোয়া সমাজ গঠিত হয় নি বলে, বুর্জোয়া চিন্তার যে বিকাশ, তা এখানে হয় নি। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কারণ বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকা শক্তি হতে পারি নি। বাঙালি বা বাংলাদেশী এই দুই রাজনৈতিক শিবিরে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আসলে একটা আর একটার বিরোধী নয়। এই পলিটিক্যাল ক্যাটগরিগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তির ভার পায় নি। এই ভার যখন সে পাবে, শোষিত জনগণের হাতে যখন ক্ষমতা আসবে তখন এই কৃত্রিম ক্যাটগরিগুলো থাকবে না। অন্য ক্যাটগরি তৈরি হবে। সেদিন বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত রাষ্ট্র তৈরি হবে। প্রতিবেশি ভারতের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি এটা কখনোই হতে দিতে চায় না। ভারত বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী রাষ্ট্রই পছন্দ করে। এখানে একটি প্রকৃত সেকুলার সরকারের পরিবর্তে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র সরকারকেই পছন্দ করে। কারণ তাতে ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক অবস্থানটা যেমন অটুট থাকে। অন্যদিকে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের প্রেরণটাও এতে ভোঁতা হয়ে যায়। কাজেই এখানে সাম্প্রদায়িক না থাকলে ভারত তা সৃষ্টি করবে এবং তথাকথিত সেকুলারিজম-এর নামে তাদের যে কলোনিয়াল কালচার পকেট আছে, একটু আগে আনন্দবাজারের ভূমিকা সম্পর্কে যা বলেছি, এরাও এখানে সক্রিয়। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস এবং অস্থিরতা তার পিছনে ‘র’- এর(R.A.W) ভূমিকা কম নয়।

এই সুত্রে আপনাকে বলি, পশ্চিম বাংলার জনগণের সহযোগিতা ছাড়া আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। এত তাড়াতাড়ি পেতাম না। ইতিহাসের ঋণ শোধের একটা ব্যাপার আছে, পশ্চিম বাংলা যদি কোনও দিন স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করে আমাদের কর্তব্য হবে আপনাদের আন্দোলন সাহায্য সহযোগিতা করা তবে পশ্চিম বাংলা একা পারবে না। ভারতবর্ষের সকল নিপীড়িত জাতিগুলো মুক্তির লক্ষ্যে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে লড়াই চালালেও সকলের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকা উচিত এবং আধুনিক রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা তা আজ অনেক পাল্টে যাচ্ছে। একসময় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হত। তারপর ভাষাভিত্তিক। এখন ইকোলজিক্যাল বা পরিবেশভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাটা চলে আসছে, বেঙ্গল, আসাম, উড়িষ্যা এ সমস্ত অঞ্চল মিলে একটা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা অনেকেই উড়িয়ে দেননি।

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস এবং অস্থিরতা তার পিছনে ‘র’- এর (R.A.W) ভূমিকা কম নয়।

প্রশ্ন: এনজিওরা বাংলাদেশে একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট চালাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশে প্রায়ই শোনা যায়। এই অভিযোগ সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ এনজিওদের ভূমিকা বিষয়ে

আহমদ ছফা: এনালিটিক্যালি জিনিসটা আমি দেখতে চাই। এনজিও ওরা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন ধরুন ভারতের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন এগুলো সবাই এনজিও সঙ্গে যুক্ত। বতর্মান পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে যেখানে বিশ্বব্যাংক যাবে, সেখানে এনজিও যাবে। বিশ্ব ব্যাংককে যদি আপনি এয়ারফোর্স ভাবেন, তবে এনজিও-কে ভাবতে হবে ইনফেন্ট্রি হিশেবে। এরা হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশে এনজিওরা একটা প্যারালাল অবস্থান নিয়েছে। এবং সেটা আশঙ্কাজনক মনে করি। আমি নিজে একটি এনজিওর সঙ্গে ছিলাম। সিভিল লিবার্টির নামে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার একটা অংশ দাবি করছে। সেটা আতঙ্কের কারণ এবং প্রগতিশীল রাজনীতির প্রধানতম অন্তরায় এনজিওগুলো। এটাকে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, তার পলিসি, স্ট্রাটেজি, তার ফিলসফি এগুলো এখনো স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসি নি। বিশ্বব্যাংককে কেউ ঠেকাতে পারবে না। চীনেও এনজিও গেছে। পশ্চিম বাংলায়ও এনজিও কাজ করছে। কিন্তু পলিটিক্যাল কর্তৃত্বের ভিতরে রাখার জন্যে যে সংগঠিত চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতি নির্মাণ প্রয়োজন তা এখনো দেখা যাচ্ছে না।

প্রথম দিকে ওনজিওরা যে কাজগুলো করেছে নারী জাগরণ গ্রামের জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা, নতুন টেকনিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা-এসব হল ইতিবাচক দিক। আর নেতিবাচক দিক হলো এনজিওরা ম্যানুফ্যাকচারিং-এ চলে যাচ্ছে। যেমন অধ্যাপক ইউনুস, তিনি নিজে একজন শিল্পপতিও বটে। আমাদের রেজিস্টার্ড এনজিও আছে ঊনিশ হাজার। ঊনিশ হাজারের মধ্যে যেটাকে এ্যডাব বলা হয়, এনজিওদের শিক্ষিত প্রতিষ্ঠান তার সদস্য সংখ্যা আটাত্তর। কিন্তু মাত্র ছয়টি এনজিও কন্ট্রোল করে ৮২ শতাংশ রিসোর্স। এবং এই ছয়টি এনজিওই একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট তৈরি করছে। এরা ব্যবসা বাণিজ্য করছে কিন্তু কোন ট্যাক্স দেয় না। হিউম্যান রাইটসের কথা বলে, কিন্তু তাদের কর্মীরা কোন রাইট পায় না। এ ব্যাপারে আপনি আমাদের বন্ধু ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। বড় বড় এনজিওগুলোতে কর্মীদের ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।

বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক চলছে। কারণ বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকা শক্তি হতে পারি নি। বাঙালি বা বাংলাদেশী এই দুই রাজনৈতিক শিবিরে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। আসলে একটা আর একটার বিরোধী নয়। এই পলিটিক্যাল ক্যাটগরিগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তির ভার পায় নি। এই ভার যখন সে পাবে, শোষিত জনগণের হাতে যখন ক্ষমতা আসবে তখন এই কৃত্রিম ক্যাটগরিগুলো থাকবে না। অন্য ক্যাটগরি তৈরি হবে। সেদিন বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত রাষ্ট্র তৈরি হবে। প্রতিবেশি ভারতের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি এটা কখনোই হতে দিতে চায় না। ভারত বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী রাষ্ট্রই পছন্দ করে। এখানে একটি প্রকৃত সেকুলার সরকারের পরিবর্তে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র সরকারকেই পছন্দ করে। কারণ তাতে ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক অবস্থানটা যেমন অটুট থাকে

প্রশ্ন: ভারতীয় সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে একুশ বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় একটি বামপন্থী সরকার চলছে। বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারটি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন

আহমদ ছফা: ১৯৭১ সালে আমি ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। আমি কমরেড মোজাফফর আহমদের পিএ হিশেবে কাজ করতে চেয়েছিলাম, করেছিও। আমি নিজে মার্কসবাদী ঘরানা থেকে তৈরি হয়েছিলাম। পশ্চিম বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং অর্থনীতিতে বামফ্রন্ট কিছু কাজ করতে পেরেছে। এসব কোনো বৈপ্লবিক কাজ নয়। সে ক্ষমতাও তাদের নেই। শহরে বামফ্রন্ট কিছুই করতে পারে নি। শহরগুলোতে যে capital accumulated হয়েছে সেগুলো সব অবাঙালীদের capital। বামফ্রন্ট সরকারকে এদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পশ্চিম বাংলাতে চিন্তা চেতনার যে চর্চা, তাতে সিপিএম-এর মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতিহীনতা কাজ করে। রাজনীতিকভাবে (পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় থাকার প্রশ্ন) যে সাফল্য তারা অর্জন করেছেন, চিন্তা চেতনা উজ্জীবনে তাদের অবদান খুবই দুর্বল। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের শূন্যতা। চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোন লোক সিপিএম-এ আসছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল কৃষ্ণ গহ্বর। যার প্রথম আউট বাস্ট দেখলেন মমতা বন্দোপাধ্যয়ের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং শ্রীমতি বন্দোপাধ্যায় বিজিপেকে সঙ্গে নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে বেশ কিছু সাফল্যও পেয়ে গেলেন। হয়ত এরকম আরো আউট বাস্ট দেখার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। যে পশ্চিম বাংলাকে আমরা দেখতাম সেকিউলারিজমের একটা আদর্শ, আপনারা কতদিন সে আদর্শকে ধরে রাখতে পারবেন, এ বিষয়ে সন্দেহ জাগছে। হয়তো আর একটা নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিজয়ী হবে। কিন্তু তারপর? বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের মধ্যে যে ক্লান্তি, যে মন্থরতা, স্টেগনেন্সি তাকে কাটিয়ে তোলার জন্য সিপিএমএ বামফ্রন্ট কিছু করে উঠতে পারে নি। আর পশ্চিম বাংলার বাঙালির যে সার্বিক অবক্ষয়, তাও তো বাম শাসকরা আটকাতে পারেন নি। পশ্চিম বাংলায় হিন্দির যে চাপ এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কোণঠাসা অবস্থা, সে সম্পর্কেই বা বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভুমিকা কী? আজকে হয়তো বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি সেভাবে হতে হচ্ছে না। কিন্তু আগামী দিনে বাঙালি জাতির অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটা পশ্চিম বাংলার প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে উঠে আসবে, সেদিন কোন বক্তব্য নিয়ে সিপিএম বাঙালি জাতির সামনে দাঁড়াবে?

শহরে বামফ্রন্ট কিছুই করতে পারে নি। শহরগুলোতে যে capital accumulated হয়েছে সেগুলো সব অবাঙালীদের capital। বামফ্রন্ট সরকারকে এদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পশ্চিম বাংলাতে চিন্তা চেতনার যে চর্চা, তাতে সিপিএম-এর মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতিহীনতা কাজ করে। রাজনীতিকভাবে (পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় থাকার প্রশ্ন) যে সাফল্য তারা অর্জন করেছেন, চিন্তা চেতনা উজ্জীবনে তাদের অবদান খুবই দুর্বল। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের শূন্যতা। চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোন লোক সিপিএম-এ আসছে না। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল কৃষ্ণ গহ্বর। যার প্রথম আউট বাস্ট দেখলেন মমতা বন্দোপাধ্যয়ের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে…

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের কাঠামোগত পরিবতর্ন ঘটেছে। ইসলামকেরাষ্ট্রধর্মবলে ঘোষণা করা হয়েছে। গত একুশে ফেব্রুয়ারি(১৯৯৮) সকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে একটা ব্যানার চোখে পড়লো। যেখানে লেখা ছিল একুশের চেতনা রাষ্ট্রধর্ম মানে না। এ বিষয়ে-

আহমদ ছফা: আমি স্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়ে লিখেছি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে, ইসলামের কোন সহায়তা করা হয়নি। বিশেষ বিশেষ শ্রেণী এবং বিশেষ বিশেষ গ্রুপের স্বার্থেই এসব করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোন উপকার করা হয় নি। আর রাষ্ট্রের যে চারিত্রের কথা বললেন, শেখ মুজিব যে সংবিধান তৈরি করলেন তা তিনি নিজেই অমান্য করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে ইসলামি কনফারেন্সে তিনি নিজেই গেলেন। সংবিধান পাল্টে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন। শেখ মুজিব বেচে থাকতেন, তাহলেও এক সময় না এক সময় বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা তিনি নিজেই করতেন বলে আমার ধারণা। আজকে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সব পরিবর্তনগুলো কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যগুলো তৈরি হয়েছে, শেখ মুজিবের সময় থেকেই এর সূচনা। তিনি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রের পথ ধরলেন। পরবর্তীকালে অন্যরা সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। রুচিশীল নাগরিক যারা আছেন, তারা সকলেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধীতা করেছেন, প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রধর্মকে বাতিল করছে না।

আগামি দিনে বাঙালি জাতির অস্তিত্ত্বের প্রশ্নটা পশ্চিম বাংলার প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হিশেবে উঠে আসবে, সেদিন কোনো বক্তব্য নিয়ে সিপিএম বাঙালি জাতির সামনে দাঁড়াবে?

প্রশ্ন: কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের রেল স্কুলের দেওয়ালে একটি দেওয়াল লিখন চোখে পড়ল। সেই দেওয়াল লিখনে একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে –‘বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বাতিল করা’—

আহমদ ছফা: ধর্মশিক্ষাকে আমি সমর্থন করি না। তবে ধর্মশিক্ষা বাতিল করার যে পদ্ধতিটা বলা হচ্ছে, সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি। সরকার বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষাগুলো চেঞ্জ করবেন। কিন্তু স্কুল কলেজে ছাত্র যত মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তাদের ওপর জোর করে যদি কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তারা বিরোধীতা করবে। এবং এতে পরিবর্তনটা আটাকে যাবে। আমার বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষার লোকাদের সঙ্গে বসো, কনভিন্স করো যুগের প্রয়োজন। অর্থাৎ যাদের জন্য পরিবর্তন করবেন তাদেরও যদি আপনি অংশীদার না করেন, তবে সেটা কার্যকর হবে না। সুতরাং যেভাবে কাজ করলে পরিবর্তনটা সম্ভব, সেই প্রক্রিয়াটা কেউ গ্রহণ করছেন না।

অক্সফোর্ড কেমব্রিজ একসময় মাদ্রাসা ছিল। সেখানে ধর্ম শিক্ষাই দেওয়া হতো। যুগের প্রয়োজনে সেখানে কি পরিবর্তন হয় নি? এই মাদরাসাগুলোকে কারিগরি শিক্ষা এবং আরো আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হিশেবে গড়ে তুলতে পারি। মাদ্রাসার লোকজনদের বুঝিয়ে নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা, তাদেরকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে তৈরি না করে, তাদের ওপর কতগুলো পরিবর্তন চাপিয়ে দিলে তা আর পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, হয়েছে কী? উল্টোটা হয়েছে। ধনতন্ত্র হয় নি, সমাজতন্ত্র হয় নি , পরে হয়েছে একটা লুটপাটতন্ত্র।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কারো কারো মন্তব্য ধর্মীয় অনুশাসনই নারী মুক্তির প্রধান বাধা

আহমদ ছফা: ধর্ম তো এখানে আছেই। ধর্ম তো সবার ব্যাপারে কথা বলছে, তবুও নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে ধর্ম একটা বাধা হয়ে আছে, একথা আমি মনে করি না। আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমাদের গ্রামে একটা সৈয়দ বাড়ি আছে, ছোট বেলায় সেই বাড়ির মেয়েদের আমরা কখনো চোখে দেখতাম না। সেই বাড়ির মেয়েরা ছিল অসূর্যস্পশ্যা। শুনতাম সৈয়দ বাড়ির অমুকের একটা মেয়ে আছে, সে বড় হচ্ছে। ওই মেয়ের কি রকম রং, কী রকম চেহারা নিয়ে সে বড় হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের কৌতুহল ছিল। কিন্তু কখনোই তাকে চোখে দেখার সুযোগ ঘটে নি। প্রায় বিশ বছর বাদে গ্রামে গিয়ে দেখি, সেই সৈয়দবাড়ির মেয়েরা বাসে চড়ে শহরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। বিশ বছর আগে এটা কল্পনারও অতীত ছিল। আপনি তো নিশ্চয়ই দেখেছেন ঢাকা শহরের হাজার হাজার মেয়ে প্রতিদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাচ্ছে। এ দৃশ্য আগে কল্পনা করা যেত না। কাজেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে ধর্ম কোন বাধা থাকে না। শিল্প স্থাপন হলে নারী জাগরণের পথকে কোন অনুশাসনই আটকে রাখতে পারে না।

প্রশ্ন: সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তার পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক শুনছি

আহমদ ছফা: আইয়ুব খার আমলে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছিলাম, ফলে সে সময়ে আমার ওপর হুলিয়া জারি হয়। আড়াই বছর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে ছিলাম। আমার হিন্দু বন্ধুরা ভারতে চলে গেল, আর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাহাড়ী মানুষের সরলতা, আতিথেয়তা, বিশ্বাসপরায়ণতা ইত্যাদি আমি যেভাবে অনুভব করেছি খুব কমই লোকই তা করেছেন এবং ১৯৬৪ সালে পাহাড়ি জনগণের রাইটের সপক্ষে আমি লেখালেখি করছি। আপনি তো লক্ষ্য করে থাকবেন কিছু দিন আগেও আমাদের এখানে একটি চাকমা মেয়ে স্কুলের মাস্টার ছিল। আমি শান্তি চেয়েছি, চাকমাদের অধিকারও চেয়েছি। কিন্তু যে চুক্তিটা হয়েছে, আমি মনে করি না, তা শান্তি আনার পক্ষে অনুকুল হবে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে সংগ্রাম, তার পাশাপাশি এটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য জাতিগুলোর যে সংকট ও সংগ্রাম তার সঙ্গে যুক্ত। পাশে ভারত না থাকলে এই সংকট এত তীব্র হতো না। সুতরাং এত তাড়িঘড়ি কিছু না করে আমার প্রস্তাব ছিল আস্তে আস্তে মনোরঞ্জন করে তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে শান্তিতে পৌছানো যেত। এখন তড়িঘড়ি কতগুলো শর্ত ও দফা দিয়ে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যা যেটা আমি বলেছিলাম, যা বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা ইত্যাদিরা প্রচার করেছে, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মূলধন খাটে, তার পাঁচভাগও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নয়। সমতল অঞ্চলের মূলধন ওখানে গিয়ে তাদের শোষণ করে। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে প্রায় দুশো বছর আগে । তাই প্রথম কর্তব্য ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে capital accumulate করার জন্য কিছু ব্যবস্থা করা। সেটা হচ্ছে, যেমন তাদের লঞ্চের ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা এসব ওদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সেসব কিছু না করে একটা চুক্তি করা হল। এতে কী পাহাড়ে শান্তি আসবে। আমার মনে হয় না।

শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, হয়েছে কী? উল্টোটা হয়েছে। ধনতন্ত্র হয় নি, সমাজতন্ত্র হয় নি , পরে হয়েছে একটা লুটপাটতন্ত্র।



Share