আমার কবিতা জৈব, আমার কবিতা অযৌক্তিক: উৎপলকুমার বসু

।। সাক্ষাৎকার: অতনু সিংহ।।

পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে এক সময় প্রকাশিত হওয়া কবিতা পত্রিকা ‘লালন’-এর জন্য জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়ে ছিলেন ‘লালন’-এর সাবেক সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও ‘প্রতিপক্ষ’র এখনকার নির্বাহী সম্পাদক অতনু সিংহ, ২০০৮ সালে৷ সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার কবি শৈবাল সরকার, কবি প্রকাশ মাঝি ও কবি ঋপন চন্দ৷ কিন্তু প্রবল মূদ্রণ বিভ্রাটের জন্য পত্রিকা ছাপা হওয়ার পরেও ওই সংখ্যাটা তুলে নেওয়া হয়৷ দুয়েকজনের হাতে গিয়েছিল অবশ্য৷ কিন্তু মূল পত্রিকায় মুদ্রণ বিভ্রাটের জন্য পরেও নানা ভুলত্রুটি সহ সাক্ষাৎকারটি কয়েক জায়গায় পুনর্মুদ্রিত হয়৷ যদিও সম্ভবত কলকাতার কবি কবি প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্রিকায় শুদ্ধ করে একবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল৷ উৎপল কুমার বসুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ‘প্রতিপক্ষ’র পাঠকদের জন্য ফের সাক্ষাৎকারটি ফের প্রকাশ করা হলো।

আমার কবিতা জৈব, আমার কবিতা অযৌক্তিক’: উৎপল কুমার বসু

অতনু সিংহ: আপনার কবিতায় প্রধান একটি দিক যৌথ নির্জ্ঞানকে স্পর্শ করা এবং এই বিষয়টির আরও একটু বিস্তারে গিয়ে আপনি লিখে ফেলেন ’তারা কেউ ধূর্ত নয়, দয়াশীল/বিনীত ভাষায় বলে তুমি ভুলে যাও জ্ঞানের কথা../’ পুরী সিরিজ৷ এরকমই আপনি বলেছিলেন, একদা চৈতন্য যেমন জ্ঞান পুস্তিকাকে জলের মধ্যে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন… আপনার কবিতায় এরকম কোনো প্রেরণা কাজ করেছে?

উৎপল কুমার বসু: হ্যাঁ, আমি তো ভয়ঙ্কর রকমের পড়াশুনা বিরোধী, পুস্তক বিরোধী। ’চন্ডালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে’ মাইকেল বলেছিলেন। আর আমার বন্ধু সন্দীপন বলতো আমার বুক সেল্ফে চব্বিশটা বই থাকে আর একটা বই বেশি ঢোকালে সবকটা পড়ে যাবে। একটা সময় পড়ার সংখ্যা সত্যিই কমে আসে। আমারও একই ব্যাপার।

অতনু: কিন্তু আপনিতো প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্য দর্শন বিষয়ক চর্চা-টর্চা করেন। উত্তর আধুনিকতা নিয়েও আপনাকে কথা বলতে দেখা যায়। তো আকাদেমিয়া আর কবিতা দুটোকে কিভাবে মেলান? আবার জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধেও যৌবনে তো অনেক কথা বলেছিলেন।

উৎপল: কবিতাও অন্যভাবে একই জ্ঞানচর্চা করে। কিন্তু আকাদেমিয়ার থেকে কবিতা অনেক বেশী অরগ্যানিক। বিশেষত আমি এবং আরও হাতে গোনা কয়েকজন এই অরগ্যানিক ব্যাপার-স্যাপারগুলোকে ছুঁতে চেয়েছি। ধরা যাক একটা গাছ জন্মালো, সেই গাছ বড় হয়ে যে কত বড় হবে, তার কোথা দিয়ে ডাল বেরোবে, কোথা দিয়ে ফুল বেরোবে – এ আমরা কেউ জানিনা, এবং এই রহস্যটা আছে বলেই আমরা খুব সুখে আছি, বা অন্তত এই ইন্টারনেট, এই তথ্য উন্মুক্তি, এই প্রযুক্তিনির্ভরতা, এই বিজ্ঞানকেন্দ্রিকতার যুগের চেয়ে কিছু দিন আগেও অন্তত সুখে ছিলাম বলা যেতে পারে। আর যারা রিডাকশনিস্ট (reductionnist,) যারা এই রহস্যটাকে ভাঙতে ভাঙতে অনু-পরমানুর সংযোগ বি-সংযোগে একটা বোমা বানাতে চায়, একটা চুল্লি বানাতে চায় – প্রতিটি সৃজনকর্ম ওসবের বিরোধী। বৃক্ষরোপন থেকে শুরু করে সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রকলা– এই সব তো অরগ্যানিক, সব কিছুর মধ্যেই শ্বাস-প্রস্বাস… প্রতিটি সৃজনকর্ম একটা সিস্টেমের কথা বলে। যে সিস্টেমটা পৃথিবীর শুরু থেকে আছে। সৃজনকর্ম তো atomistic নয় আর তাই প্রতিটি সৃজন পৃথিবীর কথাই তো বলে এসেছে। তার জন্য আমার সঙ্গে রাস্তার কুকুরেরও অসম্ভব মিল। আমি তো কুকুর বেড়ালের প্রতিটা চলাফেরা, অভিব্যাক্তি বোঝার চেষ্টা করি। ওদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। মেশার চেষ্টা করি।

যামিনী রায় বলতেন সারা পৃথিবী দুভাগে ভাগ – ভারত এবং অ-ভারত। এখানে আমার একটা সংযোজন আছে। যামিনী রায় এই ‘অ-ভারত’- এর কথা শিখেছিলেন অ-ভারত থেকেই। ভারতবর্ষীয়রা কখনই এটা ভারত ওটা অ-ভারত এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ভারতবর্ষ একটা বিচিত্র দেশ। এত পুরানো একটা সভ্যতা, অথচ দেখ কখনো কোনো দেশকে আক্রমণ করেনি। (কলোনিয়াল উত্তরসুরীদের কথা বাদ দিয়ে বলছি) আমাদের কোনো অ্যাগ্রেসিভনেশ নেই। আমরা নতুন কিছু দেখলে বিস্মৃতি হয়েছি। নতুন কিছু কিভাবে আত্মস্থ করা যাবে, ভেবেছি যেহেতু আমাদের চিন্তা অরগ্যানিক। ইন্দ্রিয়চেতনা আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আরোহন করতে পারি আর তাই আমাদের ভাবনার বিস্তার। রাজশেখর বসুর মহাভারতের কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসে।

অতনু: নান্দনিকভাবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকে বহন করে (ইন্দ্রিয়কে মিডিয়াম করে) পরাইন্দ্রিয় থেকে sprituality তে যাওয়া সম্ভব? ইউরোপীয় ভাববাদী অর্থে কিন্তু বলছিনা, সৌন্দর্যতার অর্থে বা সৃজনের অর্থে?

উৎপল: ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমরা সবছেয়ে প্রাধান্য দিই চোখকে। কিন্তু ধারণা সবছেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ত্বক। ত্বক এমন কিছু জিনিস অনুভব করে যা চোখ কান কখনোই পারে না। আমি স্মৃতির ক্ষেত্রে বলি- ধরা যাক আমার পুরোনো একটা কথা মনে পড়লো, যেটা মনে পড়ার কথা নয়। মনে পড়লো কারণ আমার হাতের ওপর এমনভাবে চল্লিশ বছর আগে ওই একভাবে, একই অ্যাঙ্গেলে ত্বকের রোদ এসে পড়ছিলো, তখন সে মুহূর্তে, পূর্বস্মৃতি ত্বক ঘটমানে নিয়ে এলো। এভাবে ত্বক বহু কিছু সংবাদ বহন করে। আমরা ভারতবর্ষীয়রা ত্বককে রেখে ঢেকে রাখিনা। তাই আমাদের নন্দন চেতনায় বস্তুর মধ্যে ভাব।

অতনু: আর তাই প্রেম/কামের এত গুরুত্ব আমাদের এখানে?

উৎপল: মেটাফিজিকসেরও বিরাট গুরুত্ব এইখানে। এখানকার শিল্পচর্চার মেটাফিজিকাল বোধ ইন্দ্রিয় চেতনায় বরাবর খুবই কেন্দ্রে থেকেছে। মেটাফিজিকসের চর্চা ভারতবর্ষীয়রা বারংবার করেছে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে মহাকাব্যেও। কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামলবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। আমি ওনাকে বলছিলাম – ভারতীয় মন্দির শিল্পে এত কিছু আছে। কামকলা আছে, শিকার আছে অথচ কৃষি নেই। উনি আমাকে বললেন চন্দ্রকেতু গড়ে -এ কৃষিকাজের ভাস্কর্য আছে। কাস্তে দিয়ে কৃষক ফসল কাটছে। এগুলিই হচ্ছে ব্যাপার। যামিনী রায় বলতেন সারা পৃথিবী দুভাগে ভাগ – ভারত এবং অ-ভারত। এখানে আমার একটা সংযোজন আছে। যামিনী রায় এই ‘অ-ভারত’- এর কথা শিখেছিলেন অ-ভারত থেকেই। ভারতবর্ষীয়রা কখনই এটা ভারত ওটা অ-ভারত এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ভারতবর্ষ একটা বিচিত্র দেশ। এত পুরানো একটা সভ্যতা, অথচ দেখ কখনো কোনো দেশকে আক্রমণ করেনি। (কলোনিয়াল উত্তরসুরীদের কথা বাদ দিয়ে বলছি) আমাদের কোনো অ্যাগ্রেসিভনেশ নেই। আমরা নতুন কিছু দেখলে বিস্মৃতি হয়েছি। নতুন কিছু কিভাবে আত্মস্থ করা যাবে, ভেবেছি যেহেতু আমাদের চিন্তা অরগ্যানিক। ইন্দ্রিয়চেতনা আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আরোহন করতে পারি আর তাই আমাদের ভাবনার বিস্তার। রাজশেখর বসুর মহাভারতের কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসে।

অতনু: জীবনানন্দ পরবর্তী সময়ে কি শিল্প সাহিত্যে পশ্চিমি আলোকায়ণ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কি ভাবেন ওই আলোকায়ণ প্রসঙ্গে?

উৎপল: পশ্চিমি আলোকায়ন স্বতন্ত্রভাবে হয়েছিল। একটা political order, একটা Ecomomical order, একটা ধর্মবিরোধিতার order-এসব ফ্যাক্টর সেক্ষেত্র কাজ করেছে। আর ভারতীয় সাহিত্য শিল্প বরাবরই এসবের বাইরে। একটা পশ্চিমি গল্প শুরু হয় once upon a time দিয়ে, আর আমাদের গল্পে অস্থি গোদাবরী তীরে একটা শালমনি তরু’…তার তীরে বিচিত্র সব ঘটনা…। আসলে আমাদের চেতনা, সময় চেতনাটা ঘটমান বর্তমান। কাল চেতনায় আমরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম। … একটা মজার কথা বলি -আমায় একজন বলেছিলেন সিঙ্গাপুর গিয়ে তিনি দেখলেন সাত সাতটা ওভারব্রীজ, স্ক্রাইস্কাপার একটা অন্যটার গায়ের ওপর দিয়ে, পেটের তলা দিয়ে, আকাশে বিছিয়ে আছে। এবং সবকটার ওপর দিয়ে সাঁ-সাঁ গাড়ি… এরইমধ্যে সবচেয়ে বিষ্ময়কর ঘটনা; কোন একটা ব্রিজে একটু জল জমেছে আর তাতে একটা লোক ছিপ ফেলে বসে আছে মাছ ধরবে বলে। তাহলেই বোঝ এটাই হল মানুষের স্পিরিট। এই এত ফ্লাইওভার, হাইস্পীড গাড়ি… ওখানে জল জমেছে, আর একজন ভাবছে সেই জলে মাছ আসবে আর সেই মাছ ধরা যাবে। আমরা হলাম ওই লোকটার মতই।

অতনু: কিন্তু কবিতা প্রসঙ্গে একটু নিদির্ষ্টভাবে বলি, যে আপনাদের সমসাময়িক বা আপনাদের পূর্বসূরী কয়েকজন কলোনিয়েল নন্দনতত্ত্বের ল্যাঙ্গুয়েজের কেন্দ্রে থেকেছেন, সেক্ষেত্রে বোধহয় ব্যতিক্রম বিনয়, আল মাহমুদ, স্বদেশ সেন এবং আপনি। আপনাদের কবিতার মধ্যে লোকায়ত অরগ্যানিক মোটিফগুলো ঘুরে ফিরে এসেছে। ওই যুক্তি ফাটলের কথা যদি বলেন তাহলে কলতে হয় বিনয় এবং আপনার কবিতায় সিনেমাটিক কাট এর ব্যবহার বিষেয়ত অনেকক্ষেত্রে জাম্পকাট… এবং একটা ওপেন এন্ডেড থিম… কি বলেন?

উৎপল: জীবনানন্দ ব্যবহার করলেন ওইখানে সরোজিনী শুয়েছিলেন… তারপর হঠাৎ সরোজিনী চলে গেল মেঘের ওপারে। এসবই তো জাম্পটাক, আসলে আমরা যুক্তিবাদকে বুঝতে বা প্রয়োগ করতে পারিনা তা ঠিক নয়। কোথাও মনে হয় যুক্তির বাইরেই আমাদের জগৎ। Beyond Logic আমাদের জগৎ। আমাদের কবিতা। সরোজিনী ওই হঠাৎ

স্যুরিয়্যাল ভাবে মেঘের ওপরে চম্পট। হাঃ হাঃ…!

আর এই স্যুরিয়্যালইজম কোন স্বতন্ত্র ব্যাপার নয়, জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। যা একই সঙ্গে লেখা, ছবি আঁকা ও সিনেমাকে প্রভাবিত করেছে। আমরা কিন্তু বহুকাল ধরেই পরাবাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত। ব্রেঁত, দালি – এদের বহু আগে থেকেই আমাদের প্রাচ্যের শিল্পচেতনায়, জীবনচর্যায় বাারবার পরাবাস্তবতার বোধ খেলা করেছে। আমরা বারবার গল্পে ম্যাজিক রিয়্যালিটি থাকলে কোন প্রশ্ন করিনা। ধ্যুর… বলে উড়িয়ে দিইনা। এখন ন্যারেটোলজি নামে জ্ঞানচর্চার একটা সেক্টর তৈরি হয়েছে। কিন্তু তোমরা ভাবো তো কতদিন আগেই সাধু ফকিররা এই ন্যারেটোলজির চর্চা করেছেন যেমন কেউ কেউ কোথাও থেকে ঘুরে কোন আখড়ায় এল, সাধুরা প্রশ্ন করল – কি বৃত্তান্ত… এবং ওই! বৃত্তান্তের বর্ণনায় কত ইমেজ উঠে এল কতভাবে, সেসব নিয়ে কোথাও কি যুক্তির অঙ্ক আছে কোনো? গন্ধ আছে? আর আমাদের পুরাণ, দশ-অবতার সবইতো স্যুরিয়্যালইজম… ওই যে নৃসিংহ অবতার, কুম্ভ অবতার… যদিও আমরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অনেকেই আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে তালমেলানোর জন্য ইংরাজি ভাষাটাকে প্রধান মাধ্যম করেছি। কিন্তু বাংলাটা বোধ হয় ভুলে যায়নি। এটা হল এথেন্টিক। আমি যে বাংলায় বড় হয়েছি, সেখানকার নদী-পাহাড়…, আমি যদি হাঙ্গেরীতে জন্মাতাম হাতলে আমি সেখানকার মত হতাম। আমি হচ্ছি Cultural order দিয়ে নির্মিত একটা লোক। political order দিয়ে নির্মিত একটি লোক। Economics, politics, culture। তিনবিন্দু ত্রিভুজের মাঝখানে আমি একজন মানুষ।

পশ্চিমি আলোকায়ন স্বতন্ত্রভাবে হয়েছিল। একটা political order, একটা Ecomomical order, একটা ধর্মবিরোধিতার order-এসব ফ্যাক্টর সেক্ষেত্র কাজ করেছে। আর ভারতীয় সাহিত্য শিল্প বরাবরই এসবের বাইরে। একটা পশ্চিমি গল্প শুরু হয় once upon a time দিয়ে, আর আমাদের গল্পে অস্থি গোদাবরী তীরে একটা শালমনি তরু’…তার তীরে বিচিত্র সব ঘটনা…। আসলে আমাদের চেতনা, সময় চেতনাটা ঘটমান বর্তমান। কাল চেতনায় আমরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম। .

অতনু: কাউন্টার কালচার, কাউন্টার ইকোনমিক্স, কাউন্টার পলিটিক্স? আর কাইউন্টার ইডিওলজির ধারণাও ব্যক্তির ভিতরে থাকে!

উৎপল: হ্যাঁ, এই কাউন্টার লজিক আমার মর‍্যাল ভ্যালুজের যে প্যাটার্ন তার একটা অংশ। আমি তো আর সতীদাহ কিংবা গুজরাট দাঙ্গা সমর্থন করব না, আমার মর‍্যাল ভ্যালুজ আমায় আটকাবে।

অতনু: কিন্তু আমাদের বঙ্গের যে প্রাচীন ঐতিহ্য, আমাদের যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য– সেখানেতো এরকম কোন বিষয় নেই, আর মনুবাদী দর্শন ও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের আগে থেকে তো আমাদের লোকায়ত পরম্পরা…

উৎপল: বিষয়ের ব্যাপার এটাই যে আমার কাছে এই মুহূর্তে ২০০৮ সালের মর‍্যাল ভ্যালুজই আছে। এবং আমি আমার কাল ও স্থানচেতনাকে ভিত্তি করেই প্রাচীন মর‍্যাল ভ্যালুজকে বিচার করবো। যেমন ভাষার ক্ষেত্রে আমার কাছে বাংলা ভাষাই প্রধান। আমি যদি হাঙ্গেরির লোক হই তাহলে হাঙ্গেরির ভাষাকে ভিত্তি করেই লিখব (ইংরাজিতে লিখলেও)। আমাদের মর‍্যাল ভ্যালুজের মধ্যে যেমন পশ্চিমি আলোকায়ণ প্রভাব রাখে, তেমনই তা আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য দ্বারাও সমৃদ্ধ। মহাভারতের কথাই ধরো না ওই যে শান্তিপর্ব, জনক রাজা সভা করছেন – সভায় হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হাজির। মেয়েটি সভায় এসে জনক রাজাকে বলেন- আপনারা সব পন্ডিত, আপনারা যে সব বিষয় চর্চা করেন- সে সব বিষয়ে আপনারা নির্ভিক Fearless Speach- এর চর্চার মধ্যে সেটা কি বাস্তবে প্রাক্টিস করেন? জনক রাজা চমকে উঠে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কে? তুমি এই সভায় যোগিনীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার মধ্যে প্রবেশ করছ। মেয়েটি তখন বলে- হ্যাঁ আমি একজন যোগিনী, আর তোমার শরীর একটা পরিত্যক্ত বাগানবাড়ির মতো যেখানে আমি বাড়তি একটা রাত থাকবো। আবার কাল সকালে চলে যাবো। সেসব নিয়ে ভেবো না। কিন্তু আগে তুমি বল যে, তুমি Fearless Speach- এর চর্চা কর কিনা? এরপর জনক রাজার সঙ্গে মেয়েটির খুব দোস্তি হয়ে যায়… আর আজ এই এতদিন পর মিশেল ফুকো Fearless Speach নামে একটা বই লিখলেন। ওঁদের কাছে এসব নতুন বিষয়। আমাদের এসব মজ্জাগত। চেতনার অন্তঃপুরে, নির্জনে যেসব বিষয় আপনা আপনি যৌথ পরম্পরার মধ্যে রয়ে গেছে- আমাদের কবিতা, শিল্প – কোথাও না কোথাও ওই জায়গায় এথেনিক।

অতনু: কখনও এরকম হয়েছে যে আপনি এমন কিছু লিখেছেন যে, পরে জানলেন এখনও কেউ কোথাও আর একজন ঐ রকম কিছু লিখেছেন। আমি এটাকে কিন্তু পজেটিভ অর্থে বলছি।… যৌথ নির্জ্ঞানের প্রেক্ষিত থেকে।

উৎপল: কৃত্তিবাসের গোড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারার ফলে অনেকেই এরকম লিখেছেন। একই বিষয়ে, আলাদা ফর্মে কিন্তু তোমরা যা বলছ সেটা ইন্টারেস্টিং… ভালো বলেছ। কিন্তু এর উত্তরে আমি যা বলছি ভেবো না ঢপ। ‘অন্নদাতা জোসেফ’ নিশ্চই তোমরা পড়েছ। আমায় একজন দেখালো যে আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে লেখা ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’র সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। আমি এর আগে কখনও নামই শুনিনি। পরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। দেখি সত্যিই কত মিল আমার ‘অন্নদাতা জোসেফ’ -এর সঙ্গে।

অতনু: হ্যাঁ, এটা আপনার কবিতায় তো মাঝে মাঝেই দেখা যায় যে, আপনি ইমেজের পর ইমেজ সাজাতে সাজাতে স্থান কালের একরৈখিকতাকে ভেঙে দিয়েছেন, কখনও কখনও একটা প্রত্ন সময় উঠে এসেছে… আচ্ছা এর মধ্যে কোন উদ্বাস্তু চেতনা রয়েছে? যেমন ধরুন ঋত্বিক তাঁর সুবর্ণরেখার একেবারে শেষে এমন একটা জায়গায় যেতে চাইলেন, যেখানে আমাদের শিকড় রয়েছে।

উৎপল: ছেড়ে যাওয়া বিষয়টা আমায় বারবার টানে। আর এই বিচ্ছিন্নতা… তারপর আবার সেখানে ফিরে যাওয়া বা ঘুমের ভিতর পুরানো কিছু আবিষ্কার করা। এভাবেই আমার কবিতায় ফাঁকা ব্যালকনি..

অতনু: ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

উৎপল: (হেসে উঠে) হ্যাঁ।

অতনু: বাংলা ভাষার মধ্যেও উদ্বাস্তু চেতনা রয়ে গেছে কি?

উৎপল: এটা পুঁজিবাদ ও পশ্চিমি আলোকায়ণের ফল। আমার একটা প্রিয় গান ‘চল মিনি আসাম যাবো, আসাম গেলে চাকরি পাবো’ -এই ‘আসাম যাবো’; মানে নিজ ভিটে মাটি ছেড়ে অন্যদেশে চলে যাওয়া কাজের সন্ধানে – বাজারের জন্য যা কিছু লাগে সেসব বেসিক জিনিসের সন্ধানে। কারণ আমাদের নিজস্ব জিনিসগুলো কবেই কারা যেন তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের এখন আসাম বা আমেরিকা যেতে হয় – চাকরির খোঁজে।

পুঁজিবাদ তো কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না! পুঁজি নিজস্ব সার্কেলটাকে ঠিকঠাক কাজ করাতে সে ভাষার উপরেও থাবা বসায়। বাংলা ভাষা বিপন্ন – এসব বলছিনা। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার মোটিফগুলো বাংলা ভাষায় সুস্পষ্টভাবে রয়ে গেছে।

অতনু: কমলকুমার ও আপনার সমসাময়িক আবহ আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে?

উৎপল: কমলদা আমাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিতেন। ওঁর সঙ্গে খালাসিটোলায় যেতাম আমরা। আমি, দীপক, শক্তি আরও অনেকে। কমলদার গদ্যে সিনট্যাক্স – ওর নিজস্ব ডিকশ্ন আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। এ তো সবাই জানে। তবে কৃত্তিবাসের বন্ধুরা আর কমলদা ছাড়াও আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব। দেশ-বিদেশে। যেমন রুবি। রুবি হচ্ছে খিদিরপুর ডক এলাকার একজন মাস্তান (ছিল)। তবে একেবারে কংগ্রেসি কায়দায় শাদা পাঞ্জাবি পাজামা পড়ে থাকত। আমায় ও বলত তুই ওই মুর্খ লোকটার সঙ্গে মিশিস কেন? তো আমি জিজ্ঞাস করি যে, কে? ও বলে ওই যে খালাসিটোলায় তোরা যার সঙ্গে যাস। যারা পেছন ঘুরে বেড়াস। তোদের কোন প্রোফাইল সেন্স নেই। আমি বুঝতে পারি যে রুবি কমলদার ব্যাপারে বলছে আর কমলদাও আমাকে রুবির সঙ্গে দেখলে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সে এক মজার ব্যাপার। আর একটা মজার ব্যাপার মনে পড়েছে – আমি দীপক আর কয়েকজন একবার ঠিক করলাম ‘দয়ালবাবার আখড়া’ নামে একটা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় খুলব। যা হবে সমান্তরাল ভাবনা চিন্তার একটা ঠেক। যেমন ধর সেখানে ফাটাকেষ্ট পড়াবে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’, পোস্তার কোন এক ব্যবসায়ী পড়াবে ‘ইন্টারন্যাশান্যাল ট্রেড’। তার ক্লাস হবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে। এই ধর আজ হেদুয়া তো কাল কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে। ব্যাপার অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা নিয়ে সর্বসম্মতিতে পৌঁছানো গেল না। প্ল্যানটাই ভেস্তে গেল।

অতনু: কৃত্তিবাসের সবচেয়ে ঘনিষ্টতা কার সঙ্গে ছিল?

উৎপল: দেখো বাছা, আমি যতদিন দেশে ছিলাম বা বিদেশ থেকে যখন ফিরেও এসেছি – যখন সেভাবে আর কৃত্তিবাসের উদ্যম নেই, বরাবরই আমার সন্দীপনের সঙ্গে দোস্তি বেশি। সন্দীপন ওর শেষ উপন্যাসের উৎসর্গে লিখল ‘উৎপল কুমার বসু নমস্তে’, ব্যাপারটা মাথায় ঢোকেনি। তাছাড়া শক্তি, দীপক সবাই ভালো বন্ধু।

একটা মজার ব্যাপার মনে পড়েছে – আমি দীপক আর কয়েকজন একবার ঠিক করলাম ‘দয়ালবাবার আখড়া’ নামে একটা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় খুলব। যা হবে সমান্তরাল ভাবনা চিন্তার একটা ঠেক। যেমন ধর সেখানে ফাটাকেষ্ট পড়াবে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’, পোস্তার কোন এক ব্যবসায়ী পড়াবে ‘ইন্টারন্যাশান্যাল ট্রেড’। তার ক্লাস হবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে। এই ধর আজ হেদুয়া তো কাল কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে। ব্যাপার অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা নিয়ে সর্বসম্মতিতে পৌঁছানো গেল না। প্ল্যানটাই ভেস্তে গেল।

অতনু: হাংরি জেনারেশনের বন্ধুরা?

উৎপল: ওঁরা আমার চেয়ে অনেকেই বয়েসে বেশ অনেক ছোট। তবু প্রথমে আমি, সন্দীপন, শক্তি, বিনয় সবাই হাংরি আন্দোলনে ছিলাম। আমার এজন্য চাকরি জীবনে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সংগঠনিক বিষয় তেমন একটা ছিল না। আজ ধর এখান থেকে কেউ হাংরি বুলেটিন ২৮ বের করল তো পরশু ত্রিপুরা থেকে কেউ হাংরি বুলেটিন ১৫ বের করল। তবে বাসুদেব দাশগুপ্তর ‘রন্ধনশালা’ বইটার আমি ছিলাম প্রকাশক আর ফালগুনীর সঙ্গে জীবনে একবারই রাস্তায় দেখা হয়। ও তখন ভাঙ গাঁজা কিছু একটা খেয়ে টলছিলো। ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ বইটা আমায় বটতলার পানুর মত করে হাতে গুঁজে দিয়ে বলে ‘পট্টভির পরাজয় আমার পরাজয়’। আমি বুঝলাম – এ খুব কড়া জিনিস। ওর দাদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। মলয়ের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল।

অতনু: আপনি কি এখনো নিজেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনে করেন?

উৎপল: ওসব ভাবনা। লিখতে হলে লিখি- লেখা ছাড়াও আমার প্রচুর কাজ। আমি তো ট্যাক্সি ড্রাইভারি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকমীদের রেড ইউনিয়ন অবধি করেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছি, পড়িয়েছি। তবে এখন কবিতার নাম করে যা সব হচ্ছে – উরিবাবা! আমার ‘নবধারাজলে’ কবিতাটাকে বিজ্ঞাপনের ভাষায় বদলে দিল – প্যানপ্যানানি প্রেমের একটা অডিও ভিসুয়্যাল… কিছু একটা… নব্বই দশকের একটা ছেলে এটা করেছে। করুক। আমার যায় আসে না। তবে এখনও অনেকে আছেন যাঁরা অন্যকিছু করার কথা ভাবছেন। সেটাই আসল। যদি কেউ দলবদ্ধ হয়ে কিছু একটা ভাবনা চিন্তা করে লেখালিখি করে…

মানিকবাবুকে ওর কমিউনিষ্ট বন্ধুরা শেষ করে দিয়েছেন। ওঁর ছোটগল্পের সংগ্রহে ছোট বকুলপুরের যাত্রী রাখাই হয়নি। আর আমি মনেও করি সন্দীপন, বাসুদেব আমার বন্ধুরা যা লিখেছে তার তুলনায় মানিকবাবু কিছুই করেননি। শুধু মানিক বাবু নন – ওনার তবু অনেক অবদান আছে – তিরিশের ঐ বুদ্ধদেব বসুদের তো আমার ক্রিমিনাল মনে হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে কবিতা লেখা আর কিভাবে আমেরিকা যাবো তার ছক করা – এইতো ওনার কাজ ছিল। ওদের তো আমি লেখক বলে মনেই করি না। বুদ্ধদেব বসু তো প্রতিক্রিয়াশীল, ধান্দাবাজ। বিষ। এসব তোমরা লেখো, আমার কুছ পরোয়া নেই।

অতনু: আপনার সব বইতো চিকন, বিশেষ করে টুসু আমার চিন্তামণি, সলমাজরির কাজ…

উৎপল: হ্যাঁ এটা এক প্রকার বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ। প্রচুর টাকা না থাকলে বা দাদা বাবাদের ধুতির কোঁচ ধরে না ঘুরলে নাকি কবিতার বই বেরোয় না। আমি বলি দ্যাখ শালা…

অতনু: তাহলে আনন্দ পুরষ্কার নিলেন কেন?

উৎপল: আরে ব্যাটা শোনো তবে, আমি তো ভাবিনি আনন্দবাজার আনন্দ করে আমাকে পুরুষ্কার দেবে! খবরটা পাওয়ার পর আমার ঘুম ছুটে যায় পুরষ্কার নেব কিনা ভাবতে গিয়ে। রিজেকশনের কথা ভাবি, তারপর হঠাৎ কেউ একজন আমাকে ফোনে বলেন, উৎপলবাবু, আপনি এসব করবেন না, করলে, আনন্দবাজার আপনার পিছনে গুন্ডা লেলিয়ে দেবে! হা হা! তো এই বৃদ্ধ বয়সে ওই চাপ না নিতে পেরে ওই পুরষ্কারটা নিয়ে নিই। তারপর মঞ্চে উঠে দেখি মঞ্চের সামনে অশিক্ষিত বদমাইস সব লোকজনেরা বসে আছে। আনকালচারড। আমি মঞ্চে উঠে বলি, আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন আমি কিভাবে এই পুরষ্কার নিচ্ছি? আমার নিজের কাছেও এই প্রশ্ন আমি কিভাবে নিতে পারছি এই পুরষ্কার?

অতনু: হিহি! এটা কিরকম যেন বাংলা সিনেমার মতো হলো!

উৎপল: দ্যাখো ভাই, আমি বাংলা কবিতার জন্য বিশেষ চিন্তিত নই। এখানে ওই একটাই প্রেম, চাঁদ, ফুল একই বিষয়, ন্যাকা বোকা সব কবির দল, ওরাই আবার প্রতিষ্ঠানের দাদা, মাস্তান। অসহ্য। আমার অন্য অনেককিছু ভাবার আছে।

অতনু: আর গদ্য?

উৎপল: আমার গদ্যও কবিতার মত। আমি কমল চক্রবর্তীর গদ্যের খুব ভক্ত। কমলই আমার ধূসর আতাগাছ বইটা কৌরব থেকে প্রকাশ করেছিল। তবে বাংলা গদ্য পদ্যর থেকে আমি এখন, অনেকদিনই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছি। যদিও আমার স্মৃতি, আমার উচ্চারণ সবেতেই বাংলা। কিন্তু তার ফর্মটা আলাদা, সিনট্যাক্স আলাদা, ডিকসান। আমার এখনও উত্তর বাংলার প্রতি টান। ওখানেই তো লেখাপড়া করেছি, বড় হয়েছি। ‘নবধারাজলে’ কবিতার ওই অংশ…

অতনু: কোনটা?

উৎপল: ওই যে ভোর হচ্ছে…

অতনু: তোমার গ্রামে রেলব্রিজের তলে/ সকালবেলার রৌদ্রে বসে বাজার…”

উৎপল: হ্যাঁ… হঠাৎ মনে পড়ল…

অতনু: আচ্ছা উৎপলদা বাংলা সাহিত্যের একজন পথিকৃৎ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে আপনি যে মূল্যায়ণ করেছেন…

উৎপল: দ্যাখো, মানিকবাবুকে ওর কমিউনিষ্ট বন্ধুরা শেষ করে দিয়েছেন। ওঁর ছোটগল্পের সংগ্রহে ছোট বকুলপুরের যাত্রী রাখাই হয়নি। আর আমি মনেও করি সন্দীপন, বাসুদেব আমার বন্ধুরা যা লিখেছে তার তুলনায় মানিকবাবু কিছুই করেননি। শুধু মানিক বাবু নন – ওনার তবু অনেক অবদান আছে – তিরিশের ঐ বুদ্ধদেব বসুদের তো আমার ক্রিমিনাল মনে হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে কবিতা লেখা আর কিভাবে আমেরিকা যাবো তার ছক করা – এইতো ওনার কাজ ছিল। ওদের তো আমি লেখক বলে মনেই করি না। বুদ্ধদেব বসু তো প্রতিক্রিয়াশীল, ধান্দাবাজ। বিষ। এসব তোমরা লেখো, আমার কুছ পরোয়া নেই।

আমি তো ভাবিনি আনন্দবাজার আনন্দ করে আমাকে পুরুষ্কার দেবে! খবরটা পাওয়ার পর আমার ঘুম ছুটে যায় পুরষ্কার নেব কিনা ভাবতে গিয়ে। রিজেকশনের কথা ভাবি, তারপর হঠাৎ কেউ একজন আমাকে ফোনে বলেন, উৎপলবাবু, আপনি এসব করবেন না, করলে, আনন্দবাজার আপনার পিছনে গুন্ডা লেলিয়ে দেবে! হা হা! তো এই বৃদ্ধ বয়সে ওই চাপ না নিতে পেরে ওই পুরষ্কারটা নিয়ে নিই। তারপর মঞ্চে উঠে দেখি মঞ্চের সামনে অশিক্ষিত বদমাইস সব লোকজনেরা বসে আছে। আনকালচারড। আমি মঞ্চে উঠে বলি, আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন আমি কিভাবে এই পুরষ্কার নিচ্ছি? আমার নিজের কাছেও এই প্রশ্ন আমি কিভাবে নিতে পারছি এই পুরষ্কার?

অতনু: এসময়ে কাদের লেখা ভালো লাগে?

উৎপল: কবিতা?

অতনু: হ্যাঁ

উৎপল: ষাটের ভাষ্কর, সত্তরের রণজিৎ আর তারপর এত কবি, গুচ্ছকবি, কার কথা বলব। বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসু, মাসুদ খানদের ভালো লাগে।

অতনু: ‘নতুন কবিতা’র ধারা?

উৎপল: ভাষার একরৈখিক, যুক্তির বুননকে যদি ভাঙার চেষ্টা করা হয় তাহলে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। ‘ন-নৈরামণি’ নামক বাংলাদেশের একটা নাটক প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ডোম আর ডোমিনীর সংলাপ ঘিরে এই নাটক। তো কথা প্রসঙ্গে জানলাম নেপালের একটা ভাষার মধ্যে এখনও চর্যাহীন, দেয়ালাপূর্ণ কথায় তো আমাদের পারস্পারিকতা, লোকজীবন পূর্ণ। কবিতায় সেই রকম কিছু হলে তো ইন্টারেস্টিং।

অতনু: আপনাকে তো অনেকে এই নতুন কবিতা ধারার বীজপর্ব বলে মনে করেন?

উৎপল: করেন বুঝি? হয় তো, আমি এতশত বুঝি না। নিজের মত লিখি। তবে ঐ যে ওই ‘অযৌক্তিক’, ‘অরগানিক’ আর সিনট্যাক্স, ডিকসান এর অন্যরকম আঙ্গিকের জন্য ওঁরা হয়ত এসব ভাবেন। স্বপন-রঞ্জন এদের কথা বলছ তো?

অতনু: হ্যাঁ ঠিক তাই।

উৎপল: হুমম

অতনু: একসময় দেখা গেল কবিতার ভাষায় বিজ্ঞাপনের ভাষা, বিপণনের ভাষা ঢুকে পেছে।…

উৎপল; হাঃ হাঃ, হ্যাঁ… ওসব লক্ষ্য করেছি। কি আর করা যাবে। যাঁরা লিখছেন, লিখুন, বললাম তো আমার কবিতাকেও ওরা বিজ্ঞাপন করে ছেড়েছে…

অতনু: এই নগরায়ন, উন্নয়ন এসব কিভাবে দ্যাখেন?

উৎপল: ভালো লাগে না। কষ্ট পাই। উচ্ছেদ। যে কোন উচ্ছেদ মানবতার অপমান। আর এসবের ফলে আমাদের আবহমান কবিতারও একদিন উচ্ছেদ হবে, এই ভেবে আশঙ্কিত হই।

Share