আমার এক নদীর জীবন (ষষ্ঠ পর্ব)

।। রওশন সালেহা ।।

রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুণরায় প্রকাশ করছি। এই পর্বে রয়েছে, লেখকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, কথাসাহিত্যিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-সহ নানা প্রসঙ্গ।

আমার এক নদীর জীবন (ষষ্ঠ পর্ব)

একটি দুঃসাহস আমায় কঠিন শিক্ষা দিয়েছিল!

বিদেশ থেকে ঢাকায় আপন বলয়ে ফিরে এলাম সময়পূর্তির আগে। এসে যা দেখলাম, বুকে মৃত্যুশেল হানার মতো বিদীর্ণ অবস্থা। একটি বছরও নয়, কেবল নয় মাস দশদিনের অনুপস্থিতি এতখানি ক্ষয় নিয়ে এলো সংসারে? প্রচুর জামা-কাপড়, আল্লাহু লকেটসহ সোনার চেইন, কয়েকখানা, ফেবার লুবা হাতঘড়ি, আরও কত শখের সদাই সুটকেস ভর্তি করে এনেছিলাম। আমার কৃচ্ছসাধনা ছিল কঠিন, না হলে এসব আনা সম্ভব ছিল না। সকলকে খুশি করলাম, আনন্দের একটা.হুল্লোড় নিয়ে কয়েকদিন কাটলো।

স্বাভাবিক হতেই আমার দৃষ্টিতে সংসারটি এক ভয়াবহ চিত্র নিয়ে দাঁড়ায়। খাওয়া-দাওয়া এসবে যথেষ্ট কর্তৃত্ব করেছেন স্বামী, গুরুত্ব দেননি সন্তানদের স্কুল-যাওয়া, বেতন দেয়া, তার কঠোর দমননীতিতে ভীত ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকেছিল। ঘরে ফিরলে ধমক খাওয়া, নয় বেত খাওয়া। বড় ছেলেকে আমি যাওয়ার আগেই মাইজদি বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, চৌমুহনী কলেজে ভর্তি করে। সে এই কঠিন পরিবেশের বাইরে ছিল। সে অবস্থায় আমি কেবলই ভাবছিলাম, আমি একা অনুপস্থিত, সেখানে আরও- তিনজন বাড়তি মানুষ ছিল। তারা শুধুই আমার খরচ বাড়িয়েছে? যা টাকা দিয়ে গিয়েছিলাম-সব শেষ এবং শেষে কর্জ করে চলেছিল। অথচ আমি হিসেব করেই পরিমাণমতো অর্থ রেখে গেলাম। সংসার জীবনে একজন মায়ের ভূমিকা শুধু স্নেহ-মমতা ও সেবার কাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়। দেখলাম, চারাগাছ যেমন পানির অভাবে, প্রয়োজনীয় পরিবেশের অভাবে শুকনো হয়, আগাছায় খেয়ে যায়, এরাও তেমনটি হয়ে গেছে। এদের সুস্থ ও সজীব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমাকে ভাবতে হবে, যা দরকার তা দিয়ে পরিচর্যা করতে হবে। আমি শুধু ওদের মা নই, সংসারের একজন সংগঠক, পরিচালক। সৃজনশীল কাজের ধারক। এবার প্রমাণ হলো, আমি ওদের অভিভাবকও। স্বামী-স্ত্রী মিলে সংসারের হাল ধরে রাখার কঠিন দায়িত্বও আমার।

স্বামীর কর্তাগিরি সমাজের ব্যবস্থা, আমার মাথার উপরে, উপায় তো নেই। আমি নীরবে বিদ্রোহ করি। আমার এই কঠিন শপথগুলো সমাজ সংসার মেনে নেবে না, নেয়নি দেখলাম। প্রত্যেক সময় ঝগড়াঝাটি এবং বিচ্ছিরি ঘটনা শুরু হয়ে গেল ঘরে। আমি উন্নত দেশের, সুন্দর পরিবেশের শিক্ষায় শিক্ষিত; আমি হার মানবো কেন! এদিকে আমার দৈহিক স্বাস্থ্য, যা ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিল, তার উপর স্বামীর আক্রোশ; অথচ আমার মনে তখন যুদ্ধ। এই গৃহ, এই স্বামী-সন্তান, এদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উন্নতি যদি আমি না করতে পারলাম, সফল না হলাম-তবে আমি বৃথা জীবন। ধারণ করবো, মৃত্যুই আমায় শ্রেয়। আমি অত্যন্ত জেদী এবং অনমনীয় হয়ে পড়লাম। মনে পড়তো ডক্টর কুরআনীর সুন্দর কথাগুলো। উনি আরবীয় অ্যামেরিকান, সত্তর বছরের বৃদ্ধ, আমাদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান,আমাকেডাকতেন, Brave young lady. অন্যদের দেখিয়ে বলতেন, জীবনের কাছেও হার মানেনি। স্বামী, পুত্র-কন্যা রেখে পড়তে এসেছে, আমি ওকে উইস করছি। এই দরদী এবং মনোবিজ্ঞানী মানুষটি আমার এমন উপকার করলেন, সেটা জীবনেও পরিশোধযোগ্য হবার নয়। সামারকালীন তিন মাসের ছুটি, আমি দেশে আসার জন্য দরখাস্ত করি। উনি বললেন, তোমাদের হাইকমিশনের পারমিশন যদি পাও, আমি ব্যবস্থা করে দেবো। রেহানাকে ব্যাপারটা বলতেই সে আমাকে নিয়ে গেল। ফার্স্ট সেক্রেটারি আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং আশ্বাস দিলেন, সম্ভব হতে পারে। তবে আপনাকে তিন মাসের স্কলারশিপের দাবি তুলে নিয়ে, তাতে প্লেনের টিকিট করার আবেদন করতে হবে। তক্ষুণি করলাম এবং রিটার্ন টিকিটসহ তিনি ব্যবস্থাও করে দিলেন। ওদিকে ডক্টর কুরআনীও প্রস্তুত, একখানা খামে লিখে দিলেন আমি কি পড়লাম, ক্রেডিট কি। বললেন, মনে হচ্ছে তুমি আর Back করবে। না। তবুও আই উইস ইউর হ্যাপী রিটার্ন। এই অভিজ্ঞ এবং উদার মনের মানুষটি ঠিকই বলেছিলেন। আমিও এখন ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অটল হিমাচল হয়ে রইলাম। পড়া বাদ, ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়া ঘরকে গুছিয়ে তোলা একমাত্র কাজ।

ঘরের আসবাবপত্র কিছু সংযোগ করে নিলাম। নতুন পর্দা, সোফাসেট, একখানা ড্রেসিং টেবিল এবং সিঙ্গার সেলাই-এর মেশিন। ঘরের ভেতর কয়েকটি টবের বাগানও করলাম। ছেলেমেয়েরা এতে খুব উৎসাহবোধ করছিল। আমার না যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ওরাও ওয়েলকাম করলো। মায়ের অভাব ওদেরকে যে নিপীড়নের কবলে রেখেছিল, ওরা কি সে কথা ভুলতে পারে! ওদের বাবার স্নেহ কতকগুলো পাশবিক চেতনায় বন্দি থাকে, উনি ব্যুরোক্রাটিক, সেটা আমি চাই না। বিশেষত বৈরুত থেকে আসার পর আমার মধ্যেও প্রভূত পরিবর্তন এসে গিয়েছে। স্বামিত্ব বা প্রভুত্ব অযৌক্তিক হলে আমি প্রতিবাদ করতাম। ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘিরে রাখতো তখন। ওদের ভয় ছিল, বাপ হয়তো মারধোর করবে। আমারও মানসিক বিপর্যয়। মনে হতো, এমন স্বামীর দরকার নেই। আমি একা থাকতে চাই। খুব খারাপ মনের অবস্থা। উন্নত পরিবেশে থেকে আমার দেহ-মন বিদ্রোহ করছিল। আমার মানসিক চিন্তাধারার উৎকর্ষ, অপরপক্ষে স্বামী ছিলেন পুরনো ধাঁচের মন-মেজাজ নিয়ে। এ তীব্র সংকট মোকাবেলা করবো। কি উপায়ে! আমি হতাশ হয়ে পড়ি। এভাবে ঐ সময়কালটা আমার জীবনে দুঃসময় হয়ে দাঁড়ায়।

আমার সন্দেহপ্রবণ স্বামী ইতোমধ্যে নতুন একটা কু পেয়েছেন; যে নারীর অন্য পুরুষে মন, তার নাকি মন উচাটন থাকে, স্বামীকে কেয়ার করে না। আমারও সেই অবস্থা। বৈরুতে কাউকে পেয়েছি, তার আশায় পথ চেয়ে আছি। উনি আমার চিঠিপত্র সেন্সর শুরু করলেন। কিছু না পেয়েও জ্বালাতন করতেন, সন্দেহ পাকা করতে চান। বলেন, আমি কত টেকনিক শিখে এলাম, তাই দিয়ে চেপে রেখেছি। তখন আমার মনে হতো, এত বছরেও যে লোক আমাকে বিশ্বাস করছে না, তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে আমি পরোয়া করি কেন? সমুদ্রে নিমজ্জমান মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়-আমিও এই শক্তি আহরণ করে উঠে দাড়াই। বললাম, পাগলে কি না বলে!

স্কুলে যোগ দিলাম। স্বাভাবিক জীবনে চালাতে প্ল্যান করি। স্কুলেও আমি বেশি ঈর্ষান্বিত সবার কাছে, বয়স বুঝি দশ বছর কমে বিশে নেমে গেল, আমাকে দেখতে সে রকম লাগে। আগের থেকে অনেক স্মার্ট, সাজ-পোশাকে আগের দীনতা নেই বরং সকলের থেকে আকর্ষণীয়। এতে একটা সুখ এলো মনে, আত্ম-প্রতিষ্ঠার সুখ। বড় ছেলেকে মাইজদি থেকে নিয়ে নটরডেম কলেজে বিএ’তে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। সাকী ইডেন কলেজে, শামীম ম্যাট্রিক দেবে। মন এখন আমার এদের গড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এ পথেই আমার উত্তরণ ঘটাব। তাছাড়া হাতে ধরলাম আগেকার কলম; অবজারভার পত্রিকায়, চিত্রালীতে লেখা পাঠাই, ছাপা হয়।

এত কিছুর পরও আমি দেখি, অন্তরের তিয়াস মেটে না। কী পড়ে এলাম? শিক্ষা প্রশাসনের প্রশিক্ষণ! আমার তো মাস্টার্স হলো না? এ যে ‘ভবি ভুলবার নয়?’ উনিশ শ চৌষট্টি সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশনে পার্ট টাইম স্টুডেন্ট হয়ে ভর্তিও হয়ে গেলাম। যা থাকে কষ্ট আমার, মাথা পেতে নেব, তবুও পড়বো। অসম্ভব বললো কেউ, অবাস্তব আর অমানুষিক খাটাখাটুনি, বললো অনেকে-মারা পড়বে নাকি। ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা এক রত্তি বিশ্রাম নেই। পড়তে যাই, ছোট ছেলে আর মেয়ে দুটোকে সাথে, ইউনির্ভাসিটি ল্যাব স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। আসা-যাওয়া আমার সাথে।

শখ ছিল রিসার্চের, নিলাম। বিষয় হয়, মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিত্বের ধরন এবং বিকাশ। আমি গবেষণার জন্য মতিঝিল বালক ও বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের Test করি। ফলাফল পেলাম, এই বয়সের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের স্বরূপ সারাজীবনের সঙ্গে ‘হাইলি রিলেটেড। এই Personality traits-গুলো ইউএসএ-তে স্কুলগুলোয় Test করা হয়, আমি বাংলায় অনুবাদ করে এদেশী ছেলেমেয়েদের উপর পরীক্ষা করেছিলাম। এ হচ্ছে আমার উনিশ’শ পঁয়ষট্টি সালের এম.এড পড়ারও ডিগ্রি নেয়ার চিত্র। এ থিসিস আমার জন্য আবারও বিদেশে পড়ার সুযোগ এনে দেয়, শিক্ষায় পিএইচডি। সুযোগ আর নিলাম না। হয়তো নিজের জন্য আর নয়, ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়েছে, অন্যান্য বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হতে হয়েছিল।

আমার সন্দেহপ্রবণ স্বামী ইতোমধ্যে নতুন একটা কু পেয়েছেন; যে নারীর অন্য পুরুষে মন, তার নাকি মন উচাটন থাকে, স্বামীকে কেয়ার করে না। আমারও সেই অবস্থা। বৈরুতে কাউকে পেয়েছি, তার আশায় পথ চেয়ে আছি। উনি আমার চিঠিপত্র সেন্সর শুরু করলেন। কিছু না পেয়েও জ্বালাতন করতেন, সন্দেহ পাকা করতে চান। বলেন, আমি কত টেকনিক শিখে এলাম, তাই দিয়ে চেপে রেখেছি। তখন আমার মনে হতো, এত বছরেও যে লোক আমাকে বিশ্বাস করছে না, তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে আমি পরোয়া করি কেন? সমুদ্রে নিমজ্জমান মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়-আমিও এই শক্তি আহরণ করে উঠে দাড়াই। বললাম, পাগলে কি না বলে!

ষাটের দশকে জীবনে মূল্যবান কিছু কাজ করতে পারার সুযোগ। পেয়েছিলাম, অনেকগুলােতে সফলতার সঙ্গে কাজ করে এসেছি, এটি নাই-বা হলো। বৃদ্ধ বয়সে করার জন্য ঝাঁপিতে তুলে দিয়েছি। ছেলেমেয়েদের আবেগ জড়িয়ে বলেছি, পিএইচডি করা আমার একটা পরম চাওয়ার সুযােগ, কিন্তু করছি না। তােরা করবি সেজন্য। মা হয়ে। ততাদের নিয়ে ক, খ, গ থেকে এ পর্যন্ত সঁতরিয়ে এলাম। বাকিটা তােরা মায়ের ইচ্ছা পূরণ করিস। অবশ্য ঐ সময়টিতে আমি অন্য আঙ্গিনায় বিচরণ শুরু করে দিয়েছি। লেখালেখির জগতে একটা পরিচিতি পেয়ে যাই। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সংখ্যায়, ইত্তেফাক; সাপ্তাহিক ললনা, ডিটেকটিভ, মাহে নও, বেগম… যেখানেই লেখা পাঠিয়েছি, সেখানেই ছাপা হয়েছিল। মাসিক বিচিত্রার যাত্রা শুরু, তাতেও লেখা পাঠিয়েছি। পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড-এর সদস্যও হলাম। রেডিওতে আমার নিয়মিত স্কুল ব্রডকাস্ট এবং মহিলা মহলে গল্প বলা ইত্যাদিতে প্রােগ্রাম করেছি। মাসিক এলান-এ বহু গল্প ছাপা হয়েছে। একটি সংকলনের সম্পাদনাও করেছিলাম, ‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি’। কবি শামসুর রাহমান এবং অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের লেখা সগ্রহ করেছি। একাজে আমার বড় মেয়ে সাকী উৎসাহ দিয়েছে এবং সাথেও থেকেছে।

স্কুলের কাজের স্বীকৃতিও পেতাম। ইসলামাবাদ থেকে মিসেস মালিক পরিদর্শনে এলেন। আমার পড়ানো তাকে আকৃষ্ট করে। তিনি রিপোর্টে বড় করে আমার নাম লিখে Best teacher বললেন। অন্যান্য শিক্ষিকাদের ডেমনস্ট্রেশন লেসন দিতে এখানকার প্রধান শিক্ষিকা মিসেস তারেন্দা আক্তারকে নির্দেশ দিয়ে যান। অনেকেই খুশি হলেন। আমার সাফল্যে, তবুও কেউ কেউ আমার এই রিকমেন্ডেশন লুকিয়ে ফেলেছিল। আমার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার কথাও হচ্ছিল কিনা। অবশ্য রাষ্ট্রীয় পদক থেকে বড় আকাংক্ষার বস্তু আমি পেয়েছি, তাই আমি ধন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের এক বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করি। প্রধান শিক্ষিকা নেয়া হবে, ক্লাস ওয়ান গেজেটেড; বেতন… প্রাদেশিক সরকারের কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের স্কেল। লিখিত এবং মৌখিক উভয়ক্ষেত্রে আমার উৎরিয়ে আসা এবং এক নম্বরের স্থান পাওয়া কি করে সম্ভব হয়েছিল, বলতে পারবো না। তবে একথা ঠিক, আমি দুঃখ-কষ্ট আর শ্রম সাধনায় পুড়ে পুড়ে ছাই হইনি। কিছু অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম, এ ছিল তারই পুরস্কার।

চিলেকোঠাকে বড় আপন করে নিয়েছিলাম

আমার ফ্লাটটি এফ প্যাটার্নের। বড় কামরাটিতে মাঝখানে পর্দা ঝুলিয়ে একপাশে বড় ছেলে আর মেজকে শোয়ার আর পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি, অন্যপাশে বসার জন্য আটপৌরে ব্যবস্থা। মেয়ে দুটো এরই মধ্যে মানি প্লান্ট ও অন্যান্য পাতাবাহার লাগিয়ে শৈল্পিক চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেয়ালে আমার নিজের হাতের দুটো সূচিকর্ম শোভা পেত।একটা সিঙ্গল চৌকি, কয়েকটা বেতের মোড়া এবং একখানা লম্বা সোফা, মাঝে টেবিল-এ ছিল সরঞ্জাম। তবুও তাই যে কত ভাল লাগতো, আজও মনে সেই অনুভূতি পাই। এখনকার সজ্জিত বড় ড্রইংরুম কেন যেন সেই মনোরম ভাললাগার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

খাওয়ার জায়গা বড়সড় রাখতেই হতো। বড় টেবিল, চেয়ার, টুল মিলিয়ে অনেকে একত্রে বসতাম খেতে। অবশ্য রাতে, দিনে কে কখন, রান্না ঘরে পাত পেতে খেতাম, সময়ের মিল ছিল না। কিন্তু আমার স্বামীকে টেবিলে যত্নসহকারে খাওয়া দিতেই হতো। অন্যভাবে দিলে পছন্দ করতেন না। এমনকি রাগ করে খেতেন না। চট করে নিয়ম উল্টিয়ে দেয়াতে তার মন সায় দিত না। শত অসুবিধা, কাজের মানুষের অভাব, এসব কখনও তার কাছে বলা হলে তিনি বলতেন, খেয়ে তুষ্টি পেরতা, দেখে তুষ্টি দেবতা। কষ্ট হচ্ছে আর একটু কষ্ট হোক তাতে কী। খাওয়ার পরিবেশনা ঠিক রেখেই খেতে দাও। মেয়ে দুটো পড়ার মধ্যে এত কাজ করছে, ছোটটাও হাত লাগায়, আমারও দিনান্তে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। কিন্তু খাওয়া এবং শোয়ার ব্যবস্থা সর্বক্ষণ পরিপাটি রাখতেই হতো। এর মধ্যে মেহমানদের আসা-যাওয়াতে ছিলই। মাটিতে বিছানা পড়তো আমাদের, তারটা যথাযথ রাখা হতো। তখন ঢাকায় থাকার মধ্যে আমি এবং থাকিও কমলাপুর রেল স্টেশনের অতি কাছে-হাঁটাপথে চলে এসেছে। নোয়াখালী থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ছাত্রছাত্রী (আত্মীয়) ঢাকায় পড়তে আসলে হোস্টেল পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমিই তাদের দায়িত্ব নিতাম। তাছাড়া বিভিন্ন কাজ উপলক্ষে দেশ থেকে ঢাকায় প্রায়শ মানুষজন আসতো। আমি চাকরি করি, ছোট বাড়ি। থাকার জায়গা নেই, ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশি, অর্থের টানাটানি, এসব সেকালে কেউ চিন্তার মধ্যে রাখতো না। ঢাকায় থাকার জন্য একটা জায়গা হিসেবে আমার বাড়িকে সবাই বেছে নিয়েছে দেখতাম। আমার স্বামীও খুশি হতেন। মেহমান আসা ভাগ্য, এ কথা বলে আমাদের উৎসাহ দিয়েই তার কাজ শেষ। কষ্টে এবং অসুবিধায় পড়তাম আমি। সেটি তিনি একটুও বুঝতেন না। কিছু বলতে গেলে উল্টো চেঁচামেচি; কষ্টে না পড়লে আমাদের কাছে কেউ আসতো না। ওদের খেতে দাও, শুতে দাও।

এ পর্যন্ত যা কিছু বর্ণনা দিলাম তা শুধু একটা বিশেষ কথা বলার জন্যই। সে আমার অন্তরের বেদনা। যা করতে আমি চাই, আমার যা করতে ভাল লাগে, সেটি করার সময় পেতাম না। যন্ত্রণাকাতর মন প্রায় সময় সংসারের বোঝা টানার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিল। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতাম, সেটি লেখার জন্য মন তাড়া করতো। অন্য কিছু তখন করতে গেলে খারাপ হয়ে যেত। এভাবে বহুদিন আমি ভাত নরম করে ফেলেছি। তরকারি পুড়ে ফেলতাম, দুধ উথলে পড়ে যাচ্ছে, কী করবো, বুঝতাম না। সবচেয়ে করুণ অবস্থায় পড়তাম, শুলে ঘুম হতো না। আর বেশিরভাগ সময় স্বামীর থাকতো নাইট ডিউটি। তার আবার তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ার অভ্যাস। সেই সাথে অন্য অভ্যাসও ছিল, আমাকে টেনে তার শয্যাসঙ্গী করা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কত কী যে করতাম আর আক্রোশবিদ্ধ হতাম। কোনো কোনো দিন তিনি রাগ করেই বলতেন, তুমি কি ফেরেস্তা হয়ে গেলে? নাকি আমাকে চাও না? আমি কি চলে যাব? এমন শক্ত হয়ে থাক কেন? আমি বসে বসে কাঁদতাম। এ কী যন্ত্রণা আমার, হে খোদা! আমি কী করবো! আমি সাধারণ একজন ঘরণী হতে পারি না কেন! আমাকে বিপরীত চলার পথে এমন। তাড়িয়ে নিচ্ছে কে? আমি কেন চুপচাপ থাকতে পারি না? সারাদিন যেত খাটাখাটুনি নিয়ে, রাতের অবসরে এমন সব দুশ্চিন্তায় প্রায় রাত বিনিদ্র যেত। এর থেকেই ঘরের ঐ ৬ x ২১/২ কোটি বেছে নিলাম। ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল আর একখানা হাতলহীন চেয়ার ঢুকিয়ে দিলাম তাতে। পড়বো, লিখবো, ছবি আঁকবো ইচ্ছামতন, মনের ভারতে হালকা করা চাই।

আসলে ঐ ঘরটি এফ টাইপ বাড়ির ভাড়ার ঘর (স্টোর রুম)। আমি গৃহিণী হতে পারিনি ঠিক অর্থে, চাকুরে গিন্নী, তাও স্বামী-পুত্র-কন্যায় ভরপুর সংসার। কাঁচা বাজার, চাল-ডাল সঞ্চয় করে রাখার চেয়ে দৈনন্দিন খরচের ভার ছিল বেশি। মাসের চাল, তেল, ঘি ইত্যাদি কিনে রান্নাঘরের তাকেই তুলতে পেরেছি। ভাড়ার ঘরকে করেছিলাম পাঁচ ওয়াক্ত নিয়ম মেনে নামাজ পড়া স্বামীর নামাজ ঘর। একখানা ছোট নামাজের চৌকি পেতেও দিয়েছিলাম। তাকগুলোয় রাখতাম কোরান শরীফ, অজিফা, কায়দা, বেহেস্তের কুঞ্জি এবং অন্যান্য ধর্মপুস্তক। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন তো থাকতোই। আমার পড়ার টেবিলচেয়ার দেখে নামাজী লোকটির মেজাজ তুঙ্গে; গালিও দিলেন। নিজেরা নামাজ পড়বে না, ছেলেমেয়েগুলো নামাজ পড়ে না, হয়েছে মায়ের মতো। তাকেও নামাজ পড়তে না দেয়ার ব্যবস্থা। উনি টেবিল-চেয়ার বের করে দিলেন। আসলে কিন্তু তাতে তার কোন অসুবিধা ছিল না বরং সুবিধাই হতো। টেবিলে একটা বাতি রেখে তার কোরান তেলাওয়াতে সুবিধা ছিল। আর ছেলেমেয়েদের যার পরীক্ষা থাকতো তাকে একটু নিরিবিলি স্থানে বসিয়ে দেয়া। তাছাড়া দিনের বেলায় কেউ তাকে ডিস্টার্ব করার কথাও নয়। কিন্তু ঐ অধিকার খর্ব হওয়ার ব্যাপার মনে করে মনোক্ষুন্ন হওয়া যাকে বলে। নিজের ভুল বুঝতে তার কয়েকদিন সময় নিয়েছিল। অতঃপর নিজেই টেবিল, ঢুকিয়ে হাসতেন। গিন্নীর কাছে কে না হার মানে! ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম এডোয়ার্ড রাজত্ব ছাড়লেন, আমি কোন্‌ ছার। আমাদের ঘরে তখন বিনোদনের জন্য কেবল একটি ছোট্ট ফিলিপস রেডিও। টেলিভিশন কেন্দ্র ঢাকাতে ছিল। কিন্তু আমার টিভি কেনার সামর্থ নেই। ছেলেমেয়েরা ভাল প্রোগাম হলে এক বাসায় যেত, তারা করাচি থেকে বদলি হয়ে এসেছিল। বড় টিভি ওদের। একদিন ওরা দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। অপমানিত হয়ে ওরা ঘরে ফিরে আসে। আর সে বাসায় গেল না।

কেবল ছিল বই পড়া, সংবাদপত্রে চাকরির বদৌলতে তার নামে কয়েকটি কাগজ আসতো, আমিও লেখালেখিতে। সুতরাং আরও কিছু ম্যাগাজিন, কাগজ ঘরে বিনে পয়সায় পেতাম। উনি সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়তেন, আমারও তাই। দেখাদেখি ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস আপনা থেকেই এসে গিয়েছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল, আমাদের অজান্তে মেজ মেয়ে রাখী সাত ভাই চম্পাতে গল্প পাঠাত এবং তা ছাপা হতো। লেখার প্রশংসা করে অন্যদের থেকে চিঠি পেয়ে আমি তো অবাক। রাখী চৌধুরী যে আমার মেয়ে। বড় মেয়ে সাকীও ইউনিভার্সিটি পত্রিকায় সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখতো, পরে আমি জানতে পারি। এছাড়াও সাকী নিজের উদ্যোগে ‘বাফা’-তে গান লিখতে যেত। ঘরে একটা হারমোনিয়াম কিনে আনে। পরে ‘গ্রুনডিগ’ রেকর্ড প্লেয়ার কিনলো নিজের স্কলারশিপের পয়সা খরচ করে। ক্লাস টেন-এ থাকতে যখন ওর বয়স মাত্র তেরতে; সাইকেল ভাড়া করে রমনা পার্কের চারপাশ চক্কর দিত, আজিমপুর বান্ধবী দীপুর বাসায় যেত। আমি শুনে তো ভয়ে মরি, কিন্তু ওকে থামাতে পারিনি। শেষে ওর গলায় তাবিজ করে, নাম-ঠিকানা ঝুলিয়ে দিয়েছি, আর বলেছি সেই লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে পড়ার সময়কার রোকেয়ার (কবীর) কথা; রোকেয়া আমার মাথার ঘোমটা টেনে ফেলে দিয়ে বলেছিল,‘তোদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ও দুঃসাহসী মেয়ে, প্যান্ট পরতো তখন। সাইকেলে চড়ে কলেজে আসতো, আর আমরা কলেজের বাসে নয়তো রিকশায়। নিজের মেয়ের চাঞ্চল্য আর সাহসী চেতনা দেখে চোখে পানি আসতো। কি জানি, মনে ভয় হতো। বিপদ হবে না তো!

আমি মেয়েদের শিক্ষাদানের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে অনেক আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রবক্তা ছিলাম। মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে লেখালেখি করেছি, The position of women under Islam– এই শিরােনামে একটা রিসার্চমূলক বইও লিখেছিলাম (প্রকাশ করতে পারিনি)। কিন্তু নিজেই আবার ছেলে আর মেয়েতে বৈষম্যের ব্যবহার করেছি, করতে হতো। ভাল খাবার স্বামীর জন্য তুলে রেখেছি-মুরগির রান আর। বুকের মাংস না হলে তিনি খেতেন না। ভাত ছুঁড়ে ফেলে উঠে যেতেন। তারপর শেয়ার ছিল ছেলেদের, বোনরাই তুলে দিত ভাইদের পাতে, নিজেরা গলার হাড়ি, পাখনা-পা, কলিজা আর সুরুয়া মেখে ভাত খেয়েছে। ভাইদের পড়ার আর থাকার সুবিধা ওরাই করে দিত। নিজেদের কথা পরে চিন্তা করেছে। ভাইরা তাদের একদল বন্ধু ঘরে নিয়ে এলে, মুখ ভার কখনও করেনি, মা স্কুলে কী অন্য কাজে, ওরা কী সুন্দর আপ্যায়ন করতো। আমার আজও ভাবতে ভালোলাগে। মেজ ছেলে শামীম সাইকেল করে ঢাকা কলেজে আসা-যাওয়া করতো। বাসায় বোনরা আমার মতই দুশ্চিন্তায় ভুগতো, ও ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত ভাত না খেয়ে বসে থেকেছে। আমার মাঝে মধ্যেই রাগ হতো, ওকে আমি নটরডেমে পড়তে বলেছিলাম, সে রাজি না হয়ে বন্ধুদের সাথে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। অন্যের বাসায় টিভি দেখতে যাওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল একদিন ওদের বাবা। আমিও তাতে.সায় দিলাম। তখন এক কাণ্ড। তারা দলবদ্ধ হয়ে টিভি কেনার প্রস্তাব দেয়, নতুবা তারা যাবেই, বিশেষত নাটক দেখবেই তারা। বাধ্য হয়ে আমি ভাবতে থাকি। একটা কিছুতো করতেই হবে। তাছাড়া আত্মসম্মানের প্রশ্নটি বড় হয়ে আমার কাছে দেখা দিল। ওদের বাবা সামান্য আয়ের মানুষ, মা স্কুলে মাস্টারি করছে কত বেতন? এটি সমাজের কাছে আর দেখিয়ে বেড়ানও ঠিক নয়, একটা টিভি কিনতে না পারা আমার জন্য লজ্জার ব্যাপার। ভাগ্য ভালই বলতে হবে, আমার ছোট ভাই আলাউদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো এবং সাথে সাথে আমেরিকায়। এক বছরের জন্য পড়তে গিয়েছে। ওকে লিখলাম, আর কিছু নয়, আমার জন্য একটা টিভি আনিস, নচেৎ মান থাকছে না। ও আমাকে ১৬ ফিলিপস টিভি এনে দিয়েছিল। এভাবে সমস্যার সুন্দর সমাধান হয়ে গেল, যা চিরকাল আমরা মনে রেখেছি। সময়ের দাবি কি প্রচণ্ড ছিল আর সুযোগ পাওয়াও ভাগ্যের বৈকি।

পৃথিবীর একটি মানুষও নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের মধ্যে থাকে না। যে মানুষটার পেটে ভাত নেই, কী পরনে কাপড় শতছিন্ন, সেও হাসে, আনন্দ করে। দুঃখকে কত আর ধরে রাখে মানুষ। টিভি পেয়ে সেদিন আমি তেমনি আনন্দ করেছিলাম। ভাল রান্না করলাম, বন্ধু-বান্ধব দাওয়াত দিলাম। আর মনে খুশির ঢেউ। কিন্তু আমার স্বামী বেঁকে বসলেন। ছেলেমেয়েদের পড়া নষ্ট, নামাজ করার বাধা পড়ে। কলকাতার সেই সুন্দর মানুষটি কি-ই যে হয়ে গেল! সেই সময়টায় আমাকে নাটক দেখাবার জন্য কতই না টানাটানি করেছিল। সন্ধ্যা হলেই সিনেমা হলে কি আউটরাম ঘাটে নিতে কত আগ্রহ। যায় দিনসুখের।

আমার চিলে ঘরটির টেবিলটায় বসলে ভালোলাগতো। রাত গভীরে সেখানে চুপচাপ বসে থেকেছি। এক সময় মনে হয়েছে, আমি আমাকেই ভালবাসি। এখানে বসে কিছু ভাবতে, লিখতে, পড়তে তাই আমার ভাল লাগে। হোক নিজেকে দেয়া। অতঃপর কত সমস্যা দেখি,বড় মেয়ের বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসে,ভাল ভাল ছেলে, কোনটায় সায় দিই না। এক সময় একটিতে পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু ছেলের পক্ষ ফিরে গেল;মেয়ের বংশ ভাল হোক, মেয়ে সুন্দরী হোক, ওর বাপ তো খবরের কাগজের প্রুফ রিডার। শুনে মাথা ধরে গেল, কিসের জন্য আমি এত প্রাণপাত শ্রম করছি ।সমাজে মেয়েদের কোন দাম নেই! মেয়েটি বায়োকেমেস্ট্রিতে এমএস করছে। রূপে-গুণে কেউ ঠেকাতে পারছে না। আমি এত লেখাপড়া করলাম। প্রথম গ্রেড স্কুলের শিক্ষিকা,প্রধান হওয়ার সিলেকশন পেয়েছি। তারপরেও এই কথা শুনতে হল। এই সমাজ কিছুই কি দিতে পারে না! কেবল বিপরীত উচ্চারণ!মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করে তার চাকরি নিয়ে কথা বলে?

সত্যি আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। রাত নিশুতি হচ্ছে, চিলে ঘরে বসে কত কিই যে প্রত্যক্ষ করি, কাউকে বলি না। হুসহাস শব্দে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে দামী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি কাকে নামিয়ে দিয়ে গেল! মেয়েটি বোরখা ঢাকা, কার বাড়ির মেয়ে? শুনছি ইস্ট পাকিস্তান এসেম্বলিতে সেশন চলছে, মেয়েদের ডে-নাইট ডিউটি, কিসের কাজ? এখানে কি কোন ধস নেমেছে? কোনো মেয়ে কি সংসারের দশ বারটি পোষ্যের মুখের অন্ন যোগাতে বিকিয়ে যাচ্ছে? তখন তো জিনিসপত্রের দাম তেমন ছিল না! কিন্তু অভাব ছিল তা আমি নিজেই টের পেয়েছি। ঐ মেয়ের কি বাপ-ভাই নেই? কি জানি! তখন আরও কি সব ঘটনা শুনে শিউরে উঠতাম। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত এলাকায় তো সামাজিক মূল্যবোধের এমনতর অবক্ষয় সহজে আসে না, রাজনীতির ভাষায় তখনকার যুগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করছে। এই কি শোষণের আর এক রূপ। একদিন খবরের কাগজের এককোণে ছোট্ট একটি সংবাদ-জি টাইপ কোয়ার্টারের বাথরুমে এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কী জানি বিশ্বাস করলাম না। এ আত্মহত্যা নয়, মেয়েটি বোধ হয় আর যেতে চায়নি। দামী গাড়িটা ফেরত চলে গিয়েছিল … এ তারই পরিণতি? আমার ধারণাই সত্যি ছিল, পরে জানতে পেরেছিলাম।

অন্য একটি ঘটনা, আমার এক ছাত্রীর অপমৃত্যু। মেয়েটির নাম ঠিক মনে নেই। যেমন ভাল লেখাপড়ায়, তেমন সুন্দর, ফুলের মতন।

ইডেন কলেজে আইএসসি পড়ছিল। বাবা এবং মা উভয়েই নাকি অশ্রাব্য গালি দিয়েছিল। কলোনির কোনো এক ওয়ার্ক সরকারকে ভালবেসেছিল মেয়েটি। এডোলেসেন্ট প্রেম। বাবা এজি অফিসের কেরানি। মেয়েটিকে ডাক্তার বানাবে স্বপ্ন দেখছিলেন।এরই মধ্যে বোকা মেয়ে তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে!ও কলেজ থেকে নাইট্রিক এসিড না কি যেন লুকিয়ে নিয়ে আসে (প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করার সময়)। তাই গলায় ঢেলে দিল। প্রিয় ছাত্রীর এই সংবাদ পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। না দেখলেই ভাল ছিল। জিহবা-গলা থেকে পেট-সব পুড়ে গিয়েছিল।কাঁচা হলুদ রঙ পুড়ে বিভৎস!

ঘুমিয়ে রয়েছে নিজের সন্তানেরা।ওদের দিকে অপলক তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতাম।এদের ভাল আমি কতটুকু রক্ষা করতে পারবো! আমার শরীরের নিচে রক্তের লাল প্রবাহ দ্রুত বয়ে যায়-মুখে রক্তের শিরা দাপাদাপি করে,আমি কি নিরন্তর সংগ্রামের সুফল পাইনি? এরা একজন শিক্ষিত মায়ের হাতে গড়ে উঠেছে।এটাই ওদের পরম ভাগ্য অবশ্যই চারদিকে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ওদের ঘিরে আছে, অবশ্যই ওরা সে সব চিনতে শিখবে।আমি আর কি দেব ওদের।প্রাণ দিয়ে ভালবাসার যে শক্তি তা দিয়েছি। আমাকে আরও কাজে নামতে হবে। অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।

আমার চিলে ঘরটির টেবিলটায় বসলে ভালোলাগতো। রাত গভীরে সেখানে চুপচাপ বসে থেকেছি। এক সময় মনে হয়েছে, আমি আমাকেই ভালবাসি। এখানে বসে কিছু ভাবতে, লিখতে, পড়তে তাই আমার ভাল লাগে। হোক নিজেকে দেয়া। অতঃপর কত সমস্যা দেখি,বড় মেয়ের বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসে,ভাল ভাল ছেলে, কোনটায় সায় দিই না। এক সময় একটিতে পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু ছেলের পক্ষ ফিরে গেল;মেয়ের বংশ ভাল হোক, মেয়ে সুন্দরী হোক, ওর বাপ তো খবরের কাগজের প্রুফ রিডার। শুনে মাথা ধরে গেল, কিসের জন্য আমি এত প্রাণপাত শ্রম করছি ।সমাজে মেয়েদের কোন দাম নেই! মেয়েটি বায়োকেমেস্ট্রিতে এমএস করছে। রূপে-গুণে কেউ ঠেকাতে পারছে না। আমি এত লেখাপড়া করলাম। প্রথম গ্রেড স্কুলের শিক্ষিকা,প্রধান হওয়ার সিলেকশন পেয়েছি। তারপরেও এই কথা শুনতে হল।এই সমাজ কিছুই কি দিতে পারে না! কেবল বিপরীত উচ্চারণ!মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করে তার চাকরি নিয়ে কথা বলে?

সকল লোকের মাঝে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা

আড়াই কামরার ‘এফ টাইপ’ বাড়িটাতে আমারই সব স্বামী পুত্র কন্যা,আত্মীয়,আশ্রিত মিলে বার জনের ঠাঁই; লেখাপড়ার ছোট্ট পরিসর করতে হিমশিম খাই।রাতে ঘরময় যখন বিছানা পড়ে,দেখতে মন্দ লাগে না। মনে পড়ে যায় কথাগুলো,‘ভোজনং যত্রতত্র,শয়নং হট্ট মন্দিরে’। আমি আর ভাল থাকা আর খাওয়া নিয়ে মন খারাপ করি না।যা আয় এর বেশি স্বপ্ন দেখলে লাভ নেই। উল্টো অবুঝ সন্তানদের থেকে সত্য লুকাতে হবে।তা ওদের জন্য ভাল নয়। কিন্তু মুশকিল হল অন্য ব্যাপারে, একা আমাকে নিয়ে। একটু নিরিবিলি স্থান চাই,লেখালেখির সুবাদে বাসায় বেশ চিঠিপত্র আসতো। উত্তর  দিতে হতো। তখন মনে হতো, রাত জেগে তো লিখি, বাতির আলোতে অন্যদের ঘুম নষ্ট করার মত অন্যায় করছি। অতএব বেছে নিলাম আবার হাফ কামরার ভাড়ার ঘরটি,যদিও সেখানে আগেই নামাজের চৌকি ঢুকিয়ে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। থাক। রাতে তো কেউ আসছে না। তাই ছোট্ট একটা টেবিল আর হাতলবিহীন একটা চেয়ার কোনো মতো সেট করে লেখার ঠাঁই করে নিলাম। উপর দিকটায় ছোট্ট একটা ভেনটিলেটার, জানালার বাতাস বলি, নয় তো ফ্যানের বাতাস ওর থেকেই যা পাই চালিয়ে নিতে অসুবিধা কী? এবার স্বামীর পক্ষ থেকে আপত্তি নেই। মেজাজ কতো আর করবেন। সারেন্ডার করেছিলেন।

পাঠকদের চিঠির কত যে মূল্য তখন বুঝিনি। উত্তর দিলেই তার শেষ মনে করেছি। আসলে সেগুলোকে আমার প্রেরণার উৎস হিসেবে সংরক্ষণ করলে ভাল করতাম। গল্পে আমি যে উপমা ব্যবহার করতাম, সে গুলোর কথাই বেশি পাঠকদের থেকে পেতাম। যেমন, জীবনকে ডানাওয়লা পঙ্খীরাজ ভাবা কিংবা জীবনের সবুজ দরজা, বুকের ছাটনার হাড়গুলো খুশিতে হারমোনিয়ামের রীড হয়ে সুর তোলে, পিয়ানোর রীডে কেউ চাপ দিলে তা বেজে উঠে, টেলিফোনে রিসিভার নামিয়ে রীতা গুণ গুণ করে ওঠে, কিংবা চোখের সামনে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো পতপত করে উড়ছে, এসবের ব্যবহার করতাম গল্প লিখতে। ঐ ষাটের দশকে আমি হাতে হলুদ মাখা নিয়েও কাগজকলম কাছে রাখতাম আর লিখে যেতাম। তখনকার সাহিত্যপত্রে, ম্যাগাজিনে, মাসিকী ইত্যাদিতে লেখা না পাঠালে ঘরে তাগিদ আসতো দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এবং আমার লেখার পত্রিকাগুলোতে। ছেলেমেয়েরা আমি দেখার আগেই দেখে চেঁচিয়ে উঠতো, মা তোমার গল্প… স্কুলের কোনো কোনো শিক্ষক নিয়ে আসতেন-আপা আপনার লেখা পড়লাম, আপনি দেখেছেন? অমুক কথাগুলো বুঝিনি, কিংবা আপনার উপমা ব্যবহার সুন্দর। আমি যে সাহিত্যের জগতে পরিচিত হয়ে যাচ্ছি, তার জন্য আরও মনোযোগ লাগিয়ে সাধনা করার প্রয়োজন। এক পা এগিয়ে দিয়েছি যখন, পিছনের পাকে তবে সামনে ফেলতেই হয়; নইলে এগুবো কি করে! ঐ সময় কবি আহসান হাবীব এবং হাসান হাফিজুর রহমান এঁদের সান্নিধ্যে আসি। ছোট্ট ভাড়ার ঘরটাই নিশুতি রাতে তাই ঠাই করে নিয়েছিলাম।

রেডিওতে মহিলা সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিমাসে আমার ছোটগল্প পড়ার প্রোগ্রাম আসতো। স্কুল ব্রডকাস্টে বাংলা সাহিত্য পড়ানোর পোগ্রামও নিতাম। এসব কাজে আমার উৎসাহের সীমা থাকতো না। কোনোদিন গরহাজির ছিলাম না। নিয়মিত হাজির হয়েছি এবং চেষ্টা করেছি। ভালভাবে পড়বো। স্কুল ব্রডকাস্টে অংশগ্রহণকারী মেয়েদেরও আমি সাথে করেই নিতাম। রেডিও কর্তৃপক্ষ আমার সেই উৎসাহব্যঞ্জক কাজকে তাদের সহযোগিতার দৃষ্টিতেই মূল্যায়ন করেছিলেন। এবং সেখানে আমাকে সেজন্য সম্মানও করতেন। তখনকার ‘এলান’ পত্রিকায় আমার বহু লেখা ছাপা হয়েছিল (আমার কাছে এগুলোর কপি নেই)।

‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ নামে একটা সাহিত্য সংকলন বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। প্রথম সংখ্যা বের করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার সময় ও অর্থ দুটোরই যথেষ্ট অভাব। এ কাজে অন্য কেউ এগিয়ে যে সাহায্য করবে সে রকম মানুষেরও অভাব। বড় মেয়ে সাকী এগিয়ে এলো এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু (পরে জামাই) ফরহাদ মজহার লেখা সংগ্রহের কাজ করে দেবে আশ্বাস দিলেন। তাদের সহায়তায় বরেণ্য সাহিত্যিকদের লেখা পেলাম, যেমন কবি শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর, ফজল শাহাবুদ্দীন, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, আহমেদ নূরে আলম, জাহানারা হাকিম। অভিজ্ঞতায় যা দেখলাম, লেখা পাওয়া যত না কঠিন, অর্থের যোগান দেয়া তার চেয়ে বেশি কঠিন। বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য কত যে ঘুরতে হয়েছিল আমাকে, যা পরে আমাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়েছিল। অবশেষে গোলাম মোরশেদ (ক্রিকেট খেলোয়াড়, তখন নতুন একটা ব্যবসা শুরু করেছিল, আমার বড় ছেলের নটরডেম কলেজের সহপাঠী বন্ধু) আমার একটা সুন্দর প্রচেষ্টা অর্থের কারণে সফল হচ্ছে না জানতে পেরে সম্পূর্ণ মুদ্রণ খরচ বহন করেছিল। সেই থেকে মোরশেদ আমাদের পারিবারিক সংস্পর্শে আসে এবং পরবর্তীতে আমার মেজ মেয়ে রাখী চৌধুরীকে বিয়ে করে।

‘ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ নামক সাহিত্য সংকলনের আর কোন সংখ্যা বের করা সম্ভব হয়নি। ছেলেমেয়েরা এ দায়িত্ব নিতে সাহস করেনি। তাদেরও লেখাপড়ার চাপ। সংসারের অভাব অনটন, পড়ার খরচ বেড়ে যাওয়া, ওদের বাবার অসুখ ইত্যাদি আমার এক অনুপম ইচ্ছার সমাধি রচনা করে দিয়েছিল। মনের দুরাশার মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম; একটা। উপন্যাস লেখার তাগিদ অনুভব করছিলাম।

কয়েকদিনের জন্য বৈরুতে পড়ার সময় সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। সেটি যদিও শিক্ষা সফর, চল্লিশজন ছাত্রছাত্রী মিলে দল। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে কয়েকটি বাঙালি পরিবার আমাকে দাওয়াত করেছিল। প্রবাসে অর্থ ও সুখ আশা করে অনেকেই যায়। দেখলাম সবই মরীচিকা। বাঙালিরা যেখানে যায়, মেয়েদের জীবন দেশেও যা বিদেশেও তা। নিপীড়ন ওদের পিছু ছাড়ে না। দুজন নারীর গা-ভরা গহনা ওদের দেহে সুখের ঝলমলানি দিতে পারেনি, দিচ্ছে পীড়ন। একজন দুঃখ করে জানালেন, আমিতোবোকা ছিলাম না। প্রাইমারি বৃত্তি পেয়েছিলাম। তবুও আব্বা পড়ালেন না। অন্যের ছেলেকে ডাক্তার বানিয়ে মেয়ে বিয়ে দিলেন। মূর্খ মেয়েলোক বলে গাল খাই। কোনো পার্টিতে আমাকে উনি নেন না। ওর সম্মানে লাগে। অন্যদের বৌরা ডাক্তার নয়তো বি. এ, এম. এ পাস। পরের ছেলে কোনোদিন আপন হয়! দেশ থেকে এসব ব্যবস্থা উঠে যাওয়া উচিত। অপর নারীটির দুঃখ ছিল তার সন্তান নেই। স্বামীকে একা দেশে যেতে দেন না। যদি শাশুড়ি আবার বিয়ে করিয়ে দেয়। স্বামী তো মায়ের কথা শুনতে পারে!

ওদের কথা নিয়ে ‘দূরবর্তী সৈকত’ নাম দিয়ে একটি উপন্যাসের ছক সাজাই, মন মত হয় না। রাত গভীরে চোখে ঘুম নেই। এক সময়। গায়ে ঝাঁকানি খেলাম। পেছনে স্বামী। কতবার বললাম আজ আমার নাইট ডিউটি নেই, শুনতে পাও না? আমিও চোখ পাকিয়ে বলি, কেন। শুনতে পাবো না? সব স্ত্রী স্বামীর ডাক শুনে, তাদের শুনতে হয়। না হলে আল্লাহ গুনাহ দেয়। আমার কথায় তার মন নেই। চোখে অনুনয়, বলেন, ঝামেলা করো না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, ওরা বুঝতে পারবে। অতঃপর আমার হাত ধরে টানেন।

ঐ বাড়িতে আমাদের বেডরুম বলতে কিছুই ছিল না। আপন ঘরে কোনোমতে লুকোচুরিতে সেরে নেয়ার মত অন্যরা করতো কিনা কে জানে, আমাদের তেমনটি হতো বলে স্বামীর খুব আফসোস ছিল। কলকাতার সুখের দিনগুলোর কথা শোনাতেন। বলতেন, তুমিও আমার কথা শুনতে। এখন শোন না।

আমার রাত জেগে লেখার চিন্তা-ভাবনা নিমিষে উবে যেত এভাবে প্রায়শ। অন্যদিকে তাকে দেখতাম অতঃপর স্নাত শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে নামাজের চৌকিতে, আমি সেখান থেকেও বহিস্কৃত। মনের ক্ষেদে নিজকে কতদিন ধর্ষিতা, নিপীড়িতা মনে করে তার ওপর চড়াও হয়েছি। আমি আর চাকরি করবো না, শান্ত সুবোধ ঘরণী হব। তোমার দেহের খোরাকি হয়ে থাকবো, পারবে আমাকে সেভাবে পালতে? এই পুরুষরাই মেয়েদের লেখার খুঁত ধরে। বলে মেয়েদের লেখায় আগে পরে লিংক থাকে না। গভীরতা কম, ভাল কিছু লেখা সোজা কথা নয় … আরও কত কী! এই হিংসুটে পুরুষেরা লিখতে দেয় না কি? দুই নারীর নির্যাতন আর দুঃখ নিয়ে চিন্তাগুলো গুছিয়ে। লিখতেছিলাম, সব নষ্ট করে দিয়েছে। এখন দেখি আমার দুঃখ ওদের থেকে কম নয়। আমরা এক সারিতে, তফাৎ এই, এক একজন এক এক দুঃখ ও নির্যাতনের শিকার।

আমার এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর প্রায়ই পেতাম না। তিনি তো আল্লাহর। কাছে প্রার্থনা করে মনকে শান্ত করে রেখেছেন। কখনও বলতেন, তুমি যে কি চাও বুঝি না। তোমার নিজকে ভাগ্যবতী ভাবা উচিত।তোমাকে আমি সুন্দর সুস্থবান সন্তান দিতে পেরেছি,আমি একজন সক্ষম পুরুষ। তাও তুমি চিল্লাও। দেবী সরস্বতী হতে চাও? আসলে আমাকে আর এখন ভাল লাগে না। বলতেন,চলে যাব। বাড়িঘর তো আছে।

অতঃপর তাকে খুশি করার একটা কথা মনে করি। সোজা বলি,বাজে কথা নয়,একটা কাজের কথাই বলা হয়নি। লেখালেখি আমার শখের জিনিস,ও বাদ দিতে অসুবিধা নেই। আমি সেই যে সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম,খুব ভাল করেছি। করাচিতে পোস্টিং হবে,দু টো পোস্ট; একটি এডুকেশন অ্যাডভাইজার, বেতন প্রায় দ্বিগুণ,অন্যটা চাকলালা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। এখানেও বেতন সে রকমই পাব।স্কুলেতো সাড়া পড়ে গিয়েছে।তোমারও গ্রেট চান্স। মক্কার কাছাকাছি হজ্বে পাঠাতে পারব। সেই যে আমি ওমরাহ করতে গিয়ে মানত করেছিলাম,আল্লাহ আমার চাওয়াটাকে কেমন মঞ্জুর করেছেন দেখলে তো!  ভেবেছিলাম দারুণ এক সুখবর, উনি বুঝি আনন্দের আতিশয্যে কোনো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে দেবেন তক্ষুণি। কিন্তু না,উনি উল্টো রেগে উঠেন। আমাকে কি পেয়েছ তুমি? তোমার পেছন পেছন ছুটবো? গেলে তোমরা যাও। আমি এখানেই থাকবো, অবজারভারের চাকরিটা তো আছে। ও তুমি কি আমার এবং ছেলেমেয়েদের ভাল চাও না? আমার কথায় উনি রেগে উঠেন;ওদের বাপ লাগবে না।

অতঃপর কথা চলে না। ঘটনার পরিসমাপ্তি আমিই দিলাম। যেতে আমারও ইচ্ছা নেই। মতিঝিলের হেড মিস্ট্রেস হতে পারলে অন্য কোথাও যেতে চাই না। এই স্কুলের একটা ইট পর পর গাঁথুনি নিয়ে চোখের সামনে বিরাট অট্টালিকা হয়েছে। আমারও স্বপ্ন ছিল এখানেই থাকি।কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বড় আপা তায়েন্দা আখতার ঢাকায় কোথাও পোস্টিং না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।চাকরির সিনিয়রিটির মূল্য তো পাব না।মনে সেই চিরাচরিত ক্ষোভ,এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি,যেখানে নারীর জীবনের মূল্য কেউ দেয় না,সেখানে তার চাকরি করতে পাওয়াইতো যথেষ্ট ভাগ্যের কথা। তাকে আবার চাকরির স্টেটাস নিয়ে কে মাতব্বরি। করতে দেবে!

অতএব চাকরির সিনিয়রিটি এবং পদমর্যাদা ইত্যাদির লোকসান মাথায় নিয়ে নিজকে তখন গুটিয়ে নিলাম। লেখার জগতে বিচরণ করতে লেগেও গেলাম। সেই উপন্যাস লেখায় মন লাগিয়ে দিলাম, লিখেও চললাম। প্রায় সাহিত্য সভা থেকে ডাক আসতো। রাইটার্স গিল্ড-এ একবার সদস্য হয়েছিলাম, পরে আর ছিলাম না। তবুও সেখান থেকে দাওয়াত পেলাম। তাছাড়া নানান প্রতিষ্ঠান থেকে বেগম রোকেয়া স্মৃতিসভা, ইসমাইল হোসেন সিরাজী … জাতীয় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে আহ্বান পেতাম। রেডিওতে অনেক সমালোচনা অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। সে সময় দুঃখ বলার মতো এইটুকু অনুভব করতাম, ছেলে হয়ে জন্মালে আজ আমি এডুকেশন অ্যাডভাইজার পদে করাচিতে চাকরি করতাম। সে যাক, ছেলেমেয়েরা আমার সে সাধ পূরণ করবে। সে রকম আশায় বুক বেঁধেই চলতাম। সাতজন সন্তান বা সপ্তর্ষীমন্ডল হয়ে আকাশে উজ্জ্বল থাকবে, মায়ের দুঃখ দূর করবে।

উপন্যাসটি শেষ করেছি। সাপ্তাহিক ললনায় ‘ফসিলের রঙ’ নাম দিয়ে প্রায় দুবছর পর্যন্ত ছাপা হয়েছিল। ইতিমধ্যে আমিও মতিঝিল স্কুলের দায়িত্বভার পেয়ে যাই। উনিশ’শ উনসত্তর সাল। সময়টা বড় উত্তাল। দেশে আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলন। জঙ্গি জেনারেল ইয়াহিয়া খান, রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো প্যাঁচ ফেলেছেন বাঙালিদের নিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠক করছেন। দেশ জোড়া আন্দোলন। আমাদের স্কুল তো তোপের মুখে। এখানে রয়েছে অবাঙালি ছাত্রছাত্রীদের জন্য উর্দু মিডিয়াম, সকাল বেলায় বসে এই স্কুল। আমি এদেরও হেড মিস্ট্রেস। স্কুলের নামফলকে উর্দুতেও লেখা, বাংলার পাশে। আর একটি বিশেষ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়ি অল্প কয়েকদিনের মধ্যে। উর্দুভাষী দুজন শিক্ষিকা (Unmarried, পাঞ্জাবি) কলোনির বাসা ছেড়ে নিরাপত্তা চেয়ে স্কুলে উঠে আসে। মাঠের মধ্যে স্কুল। দোতলায় বাড়তি ঘর আছে। কিন্তু সেই অবাঙালি বিদ্বেষ সময়টিতে ওদের সেখানে রাখা যে আরও বিপজ্জনক। দুটো পঁচিশছাব্বিশ বছর বয়সী সুন্দরী আর স্বাস্থ্যবতী মেয়ের চিন্তায় আমি আহার-নিদ্রা ছেড়ে দিলাম। হায়! আল্লাহ আমাকে এমন সময়ে কী গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিলে। এদেশে ওদের কোন নিকট আত্মীয়ও ছিল না।অবশেষে দায়টুকু নিজের ঘাড়েই নিলাম। হেড মিস্ট্রেস হয়ে সাত কামরার বাড়ি, তাও আবার রেন্ট ফ্রি,পেয়ে কত আনন্দ,এবার হাত পা ছড়িয়ে থাকবো। নিজস্ব বেডরুম হবে,ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ বেড আর পড়ার টেবিল পাবে। বলি এই বুঝি কপালে সইলো না। ঐ মেয়ে দুটোকে সামনের দিকে একটা রুমে থাকতে দিলাম। অলক্ষ্যে নিজের আরেকটা ক্ষতি ডেকে আনলাম। এ বাড়ি অবাঙালির বলে বাইরে অনেকের চোখে মনে হয়েছিল। ভাগ্য ভাল সত্তরের মাঝামাঝি ওরা ফেরত চলে গিয়েছিল।

সে সময় স্বাধীনতার আন্দোলন পুরোপুরি তুঙ্গে;বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রী সংগঠন থেকে মেয়েরা আসতো। স্কুলের মেয়েদের মিছিলে নিয়ে যেত। আমাদের শিক্ষিকাদের নিয়ে সংগ্রাম কমিটি করার জন্য নির্দেশাবলী দিয়ে গেল। উর্দুভাষী মেয়েরা প্রায় অনুপস্থিত, কিন্তু শিক্ষিকাদের তো আসতে হতো। এখানে অবশ্য একটা সুবিধা ছিল। এদের মধ্যে প্রায় সকলেই বাঙালি। কারও স্বামী, কারও বাবা কি মা বাঙালি। ওরা শাড়ি পরতো,বাংলায় কথা বলতো। তবে জাতে অবাঙালি, ইনফরমারের কাজ করতো বলে আমরা ওদের থেকে সাবধানে থাকতাম। অতি গোপনে অ্যাকশান কমিটি গঠন করি।পাশের স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকও এই কমিটিতে ছিলেন। সৈয়দা দীপ্তি ছিল আহবায়িকা। ২৬ মার্চ স্কুলে মিলিটারি ঢোকার আগে ঐ ফাইল আমরা পুড়িয়ে ফেলি। ভীষণ ধর-পাকড় চলছিল।স্কুলের একদিকে ক্যাম্প হয়ে গেল। এর মধ্যে আমাদের স্কুল চালানোর হুকুম,স্কুলের নামফলকের বাংলা তুলে ইংরেজি, আর উর্দু লেখা হল।আমাদেরকে আইডেনটিটি কার্ড করতে হল।এখানে আমরা দীপ্তির নামের শেষের রাণী তুলে দিয়ে এবং বাগানের মালী সুখুরামকে শুক্কুর মিঞা করে কার্ড বানিয়ে আত্মরক্ষার একটা পথ তৈরি করে নিয়েছি।

কিন্তু শেষ রক্ষা কি আর হয়? একদিন কটমট করে কয়েকজন পাঞ্জাবি সৈন্য একজন ব্রিগেডিয়ারসহ আমাকে ঘেরাও করে বলে, দীপ্তি মুক্তি আছে, তোমার টিচার, ওকে ডেকে আনো। আমার সেদিন এত বুদ্ধি কেমন করে হল জানি না। কাশেম নামের এক পিয়নকে কাছে ডেকে বাংলায় ত্যাড়াবাকা করে লিখে দিলাম একটা চিরকুট। লুকাও, বাসায় যেও না। এদিকে মুখে বললাম, দীপ্তি আপাকে আসতে বলো; এরা দেখা করতে এসেছেন। অন্যদিকে উর্দু সেকশনের সহকারী প্রধান শিক্ষিকাকে ডেকে বললাম, রেহানা এদের চা দেবে না? দেখলাম ওরও চোখেমুখে ভয়, ওর স্বামী বাঙালি, সামনে এলো না। ততক্ষণে কাশেম সংবাদ নিয়ে এল দীপ্তি আপাকে স্কুলে দেখছি না, আসেননি। একথা শুনে তক্ষনি ইংলিশে ওদের জানিয়ে দিই। ওরাও ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে কাশেমকে বলে ওর বাসায় নিয়ে চলো আমাদের। ততক্ষণে দীপ্তিরা সকলে উধাও। আশেপাশে ফ্লাটেও মানুষজন ছিল না। সে যাত্রা কি যে বাঁচার মতো বাঁচলাম, ভাবতে গেলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

দ্বিতীয় ঘটনা আমার উপর। ২৭ মার্চ থেকে স্কুলের বাসা, যেখানে সযতনে সাজিয়ে গুছিয়ে মাত্র বসেছিলাম, বাসাটা ছেড়ে মিলিটারির কলোনির এ বাড়ি-ও বাড়ি থাকতে হয়েছিল। জীবন বাঁচার সম্বল হিসেবে চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন আর সামান্য নগদ টাকা সর্বদা বয়ে বেড়াতাম। স্কুলে আসার পথে ওরা অর্থাৎ পাক সৈন্যরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল। কিছু রিকশায়, কিছু হেঁটে আসতাম। নিচে স্কুল, উপরে আর্মি ক্যাম্প। আমাকে উর্দু সেকশন চালাতে হতো। বাঙালি মেয়েরা, টিচারও আসতো, না এলে মেরে ফেলার হুমকি। এদিকে আমি এর বাড়ি, তার বাড়ি এক মাস, দু মাস করে থেকে বহু ঘোরাঘুরি করলাম। আর কোথায়ও থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না। সে জন্য ছেলেমেয়ে–স্বামীসহ স্কুলের বাসায় উঠলাম। ভাগ্য এতই বিড়ম্বিত। ঐ দিন রাতে কমলাপুর রেলওয়ে স্কুলে আগুন লাগে এবং পাশের ছেলেদের স্কুলের লাইব্রেরিতে বোমা ফাটে। ঝটিতে আর্মি স্কোয়াড় ঘটনাস্থলে আসে এবং আগুন নিভানোর পর আমার কোয়ার্টারে এসে তল্লাশি চালায়। আমার ঘরে মুক্তি এসে আশ্রয় নিয়েছে, এটাও তারা চার্জ করলো। আমাদের কাউকে বিশ্বাস নেই, সবাই মুক্তি, বাংলাদেশ চায়। আমার শ্মশ্রুমণ্ডিত স্বামীকে বলে ইন্ডিয়ান ঠাকুর। অবশেষে ঘরে নামাজের চৌকি ও জায়নামাজ, কোরআন শরীফ দেখিয়ে সে যাত্রা পার পেলাম। কিন্তু জীবনের উপর যে মারাত্মক ভয় এসেছিল, তা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল।

একাত্তরের ১৭ অক্টোবর। রমজান মাস চলছিল। বড় মেয়েকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে কোথায় আর নেব? ওর একটি মেয়ে হয়েছিল, সাতদিন পর স্কুলের বাসায় আবার এসে উঠি। মাসখানেক থাকার পর চিন্তা করছিলাম, এখানে আর থাকা যাবে না। স্কুলের ক্যাম্পে বহু রকম নির্যাতনের কথা কানে আসতো। হিন্দু মনে করে ধরে এনে হাত-পা উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে চাবুক মারতো, কেউ আর এমন মার খেয়ে বেঁচে থাকে? মৃতদেহগুলো মাইক্রোবাসে ভরে রাজারবাগ পুলিশ মাঠে গণ কবর দিয়ে আসতো। জিনিসপত্র তো সাথে নিই না। নিজেরা কেবল ছুটাছুটি করছিলাম। এবার এক শিশু নিয়ে বিপদ, ভাল এবং নিরাপদ স্থান পেতে দেরি হচ্ছিল। আজ যাই কাল যাই, হঠাৎ রাতের অন্ধকারে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল। ঘরের বাইরের দিকে ডিনামাইট প্রকট শব্দে ফেটে গেল এবং সেই সাথে বাড়ির ঐ অংশ চুরমার। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কে কোথায়! ধুয়া! অন্ধকার! কেবল আকাশের চাঁদ থেকে আবছা আলো। ওদিকে সাকীর চিৎকার, মাগো! আমার শিশুটি নেই, ওর যে কবর হয়ে গিয়েছে, কেন এ বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলে? বিপদে কিন্তু হতবুদ্ধি হল না আমার ছোট ছেলে শায়ের। ফরহাদকে ডেকে বলে, দুলাভাই আসেন, আমরা ইট সুরকি সরিয়ে ওকে তুলি। সাকী চিৎকার করছে, ওর রক্তমাখা মাংসপিণ্ড আমি দেখতে চাই না।

সবাইকে সেদিন বিশ্বাস করতে হল, শিশুর সঙ্গে ফেরেস্তা থাকে। ওর কিছু হয়নি। বেবী কট আর কোলবালিশের মধ্যে যেমনটি শোয়ান ছিল, তেমনটি নিপল চুষে যাচ্ছে। তখনকার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা বোধ করি মানুষের থাকে না। আমারও ছিল না। কে কোথায় আছে, খোঁজ নিলাম না? সোনার গহনা, আর টাকা ছিল বালিশের নিচে, মনে পড়লো না। এক ছুটে স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের রুমের দিকে দৌড়াই। চাবিটা ছিল আমার ব্যাগে তাও ভুলে গিয়েছি। আমার দৌড় দেখে বন্দুক উঁচিয়ে এক মিলিটারি হাঁক দেয়; হল্ট! তোম আপনা ঘরমে বম্ব মারকে ছুটতা হায়! বাঙালি আদমি এতনা হারামি হায়। একটু হলেই পিস্তলের গুলি সে ছুঁড়তো। রক্ষা করতে এল ছোট ছেলে, মা হাত তোল, থাম। আত্মরক্ষার জন্য পাক সেনাদের কাছে কত কথাই বললাম। ওরা বিশ্বাস করলো না। শেষে হাত তুলে দাড়িয়ে গেলাম। সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আমরা সকলেই অক্ষত থেকে বেরিয়ে এলাম কি করে জানি না। আমরা প্রত্যেকে দেশপ্রেমিক, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত ছিলাম। স্কুল চালিয়েছি, কি অসহায় দুই পাঞ্জাবি শিক্ষিকাকে আশ্রয় দিয়েছি। তার জন্য যদি কেউ আমাদের শাস্তি দিতে চেয়েছিল, তারা ভুল করেছিল, আল্লাহ সেটাই চাক্ষুষ প্রমাণ করে দিলেন।

বিজয়ের পর অবশ্য জেনেছিলাম, এটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটা ভুল তথ্যের উপর অ্যাকশন নেয়া হয়, আপ-টু-ডেট ইনফরমেশন ছিল না। এই বাড়িটি ছিল হেডমিস্ট্রেসের কোয়ার্টার। আমার আগের হেডমিস্ট্রেসের স্বামী এসপি ছিলেন এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রে আয়ুর খানের মামলার রাজসাক্ষী ছিলেন। দেড় বছর আগে তারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সেই তখনকার চিহ্নিত বাড়িতে নতুন হেড মিস্ট্রেস বাস করছে, এই খবর জানা ছিল না তাদের। ভুলক্রমে আমরা মরণের মুখোমুখি হয়েছিলাম। এ হল কপালের লিখন, কে খণ্ডন করতে পারে? ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটি দেখে কারও বিশ্বাস হয়নি, এর থেকে কেউ রক্ষা পেতে পারে। যখন শুনলো ‘নো ডেথ ক্যাসুয়েলটি’, তখন একটি কথা সবাই কবুল করে গেল, আল্লাহ তো একজন আছেন, তার এক নেক বান্দা এ গৃহের বাসিন্দা। এ তারই পুণ্যফল (আমার স্বামীকে মসজিদে এবাদত করতে লোকেরা দেখেছিল)। তাকে সৎ ব্যক্তি বলে জানতো।

সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের মূল্য অনেক, তখন বুঝতে পারলাম। সাথে সাথে ডি টাইপ বাড়ি বরাদ্দ হয়ে গেল, না বলতে। একজন হোমরা-চোমরা অফিসিয়েল চাইলেন, আমার কি কি জিনিস নষ্ট হয়েছে তার তালিকা দিন ভাল কম্পেনসেশন আছে এর জন্য। আমার তখনও কানে ডিনামাইট ফাটার বিকট শব্দ। চোখের সামনে আগুন আর বারুদের ঝাঁজ! দুঃখ করে বলতে হল, ধন্যবাদ! জীবনে বেঁচে থাকার মূল্য অনেক, আমাকে আল্লাহ তাই দিয়েছেন। আপনারা আর কি দেবেন? দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যারা প্রাণ দিচ্ছে তাদের পরিবারের জন্য কি করতে পারবেন?ঐ ভদ্রলোক আমার কথা শুনে বুঝতে পারছিল না। জিজ্ঞেস করলো, আপনাকে ওরা মারতে চেয়েছিল কেন? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে।

একাত্তরের ১৭ অক্টোবর। রমজান মাস চলছিল। বড় মেয়েকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে কোথায় আর নেব? ওর একটি মেয়ে হয়েছিল, সাতদিন পর স্কুলের বাসায় আবার এসে উঠি। মাসখানেক থাকার পর চিন্তা করছিলাম, এখানে আর থাকা যাবে না। স্কুলের ক্যাম্পে বহু রকম নির্যাতনের কথা কানে আসতো। হিন্দু মনে করে ধরে এনে হাত-পা উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে চাবুক মারতো, কেউ আর এমন মার খেয়ে বেঁচে থাকে? মৃতদেহগুলো মাইক্রোবাসে ভরে রাজারবাগ পুলিশ মাঠে গণ কবর দিয়ে আসতো। জিনিসপত্র তো সাথে নিই না। নিজেরা কেবল ছুটাছুটি করছিলাম। এবার এক শিশু নিয়ে বিপদ, ভাল এবং নিরাপদ স্থান পেতে দেরি হচ্ছিল। আজ যাই কাল যাই, হঠাৎ রাতের অন্ধকারে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল। ঘরের বাইরের দিকে ডিনামাইট প্রকট শব্দে ফেটে গেল এবং সেই সাথে বাড়ির ঐ অংশ চুরমার। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কে কোথায়! ধুয়া! অন্ধকার! কেবল আকাশের চাঁদ থেকে আবছা আলো। ওদিকে সাকীর চিৎকার, মাগো! আমার শিশুটি নেই, ওর যে কবর হয়ে গিয়েছে, কেন এ বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলে? বিপদে কিন্তু হতবুদ্ধি হল না আমার ছোট ছেলে শায়ের। ফরহাদকে ডেকে বলে, দুলাভাই আসেন, আমরা ইট সুরকি সরিয়ে ওকে তুলি। সাকী চিৎকার করছে, ওর রক্তমাখা মাংসপিণ্ড আমি দেখতে চাই না।

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান

তা ভালোই হলো। থাকার কষ্ট, যাযাবরের মত এর বাড়ি ওর বাড়ি করার মধ্যে নিজের ঘরে বাস করার প্রচণ্ড ইচ্ছার মৃত্যু; কাজটি আমার জন্য ভালই হল। অতঃপর স্কুল করার পরিবেশ আর ছিল না। মতিঝিল এলাকা পঁচিশে মার্চের রাতের মত ভয়াবহ এবং ভয়ঙ্কর হয়ে গেল।পাক সেনারা দখল করেছিল রাজারবাগ পুলিশ এলাকা,কমলাপুর রেলস্টেশন,বাস ডিপো। তদুপরি অবাঙালিদের এলাকা তো সেন্ট্রাল গভঃ কলোনি হিসেবে আগে থেকেই ছিল। বাঙালিদের জন্য এটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ এলাকাই ছিল।কখনও শুনতাম বাড়িতে শেল এসে পড়েছে,রাতে আকাশে রকেটের শব্দ,আগুন। দিনরাত ধরে কারফিউ। সামান্য কয়েক ঘন্টার জন্য কারফিউ তুলে নিলে। লোকজনের ঢাকা শহর ছেড়ে যাবার দৌড়াদৌড়ি লেগে যেত। আমি মহাচিন্তায় পড়েছি। কী করবো! স্কুলের একজন অবাঙালি কেরানি অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের বেতন বিল সই করে নিয়ে গেল।বিপদের সময় টাকার বেশি প্রয়োজন।জমানো টাকা প্রায় শেষ।দিনও ছিল তখন রাতের মত অন্ধকার।ঘরের জানালা বন্ধ;পর্দার উপর কালোমোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হতো। মানুষ নেই বোঝাতে সর্বপ্রকার চেষ্টা। রেডিওর শব্দ হতে দিতাম না। কানে লাগিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম।

একদিন নিজ কানকে পরিষ্কার করে বার বার শুনি; এ যে দীপ্তির গলা, খবর পড়ছে। শেষে শুনলাম বলছে-ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার সেই উদাত্ত আহবান। দীপ্তি লোহানী নামটি শুনে আমি আনন্দে প্রায় চিৎকার করছিলাম,আমার ছোট মেয়ে মুখ চেপে ধরলো; শব্দ করবে না মা। গলা চুপ হলেও চক্ষু ভেসে গেল অশ্রুর বন্যায়।দীপ্তিরা নিরাপদ আছে! দেশের কাজ করছে স্বাধীন। আমি এক হতভাগী! হাত পা বাঁধা পড়ে আছি।

এমন সময় জাহানারা আপা এক প্রস্তাব নিয়ে এলো। বুড়িগঙ্গার ওপারে এক মুক্ত এলাকা আছে; ওর বাবার বাড়ি সেখানে। থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। সে নিয়ে যাবে। মনে হল আল্লাহ স্বয়ং ওকে পাঠিয়েছেন, মুহূর্তে ছেলেমেয়েদের তৈরি হতে বলি। তারাও প্রস্তুত। এই অন্ধকার মৃত্যুকূপের মধ্যে আর যে থাকা যায় না। মান-ইজ্জত আর জীবন বাঁচানো বড়ই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বড় ছেলে পি. আই. এ তে তখন চাকরি করছিল। থাকে চাটগাঁয়, ওর জন্য মন পুড়ছিল, খবর পাচ্ছিলাম না। এদিকে স্বামীও বেঁকে বসে আছেন। ঢাকাতে থাকবেন। আমাকে বলেন, মরণের হুকুম আসলে, যেখানে মানুষ থাকে, সেখানেই তার মরণ হবে। তাকে কিছুতেই নাড়ানো গেল না। ফলে আমিও থেকে গেলাম এবং আমাদের জন্য সেজ ছেলে নকীবও গেল না।

যাওয়ার প্রস্তুতি অবিকল বাঙালি পথিকের বোসকা কাঁধে চলার মতো দৃশ্য। চাল, ডাল, মুড়ি, চিড়া আর গুড় নিয়ে পুটলি। সামান্য দু-একখানা জামা-কাপড়। সাকী এসব না নিয়ে দুধের টিন আগলে আছে, দেখে চোখে পানি নেমে আসে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে পাওয়া শিশুর জন্য খাদ্য! কে আর ভেবেছে? সে যে মা। তীর্থযাত্রীর মত সকলে বেরিয়ে গেল। এগিয়ে দিতে গেলাম না, ফি আমান্ ইল্লাহ পড়লাম কয়েকবার। ঠিকমতো গায়ে পৌঁছবার সংবাদও পাব না। পথে পথে পাক সৈন্য। মৃত্যু ফাঁদ। বাঙালি লোগ ভাগতা হায়’ বলে বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর দিয়ে ওরা গুলি ছোড়ে। মর্টার ছোঁড়ে। যে বারদিন ওরা বাইরে ছিল কোন সংবাদ পাইনি। শুধু আল্লাহকে ডেকেছি-ওরা যেন বেঁচে থাকে। ফিরে আসে। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যে টুকু খবর শুনতে পেতাম, মনের অস্থিরতা তাতে কমতো না। সেই বিভীষিকার দিনগুলো মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। বেঁচে ছিলাম নেহায়েত আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন-তাই।

বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুর খবর শুনে নিজেদের বাঁচার ক্ষীণ আশাও নিভে গেল, খাটের তলায় বিছানা পাতা, স্বামী এসব নিয়ে সর্বক্ষণ আল্লাহকে ডাকছেন। বাইরে গুলির শব্দ যখন তখন। বহু সৈন্য অস্ত্র শস্ত্র আসছে বুঝি! টেলিফোনও নেই। কারও সাথে কথা নেই। দেখা নেই। আর একদিনও এ ভাবে থাকতে পারবো না। ঘরে খাবারও নেই। মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। হঠাৎ কানে এল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। বিকাল চারটা হবে, ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু চারপাশে বন্দুকের গুলি ছোড়ার শব্দ। জানালার কাঁচ ঝন ঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়ছিল।

এরই মধ্যে বিজয়ের সংবাদ বহন করে মুক্তিযোদ্ধা সালাম শাহজাহানপুর রাস্তা ধরে ট্রাক মিছিল করে আসছিল। সালাম নকীবের ক্লাসফ্রেন্ড। ‘জয় বাংলা’ শুনে আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। সালাম ট্রাক থেকে নেমে ওর গলার মালা আমায় পরিয়ে সালাম করে বলে, খালাম্মা? যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ঘরে ঘরে অস্ত্র রয়েছে, দেখছেন একটা গুলি আমার হাতে লেগেছে পাঞ্জাবিতে রক্ত। আপনি ঘরে যান! সাবধানে থাকবেন।

১৭ ডিসেম্বর রাতের গভীরে দরজায় জোর আঘাত; ভয়ে দরজা খুলি না। শেষে গলার আওয়াজে বুঝতে পারি, এ যে আমাদের হুমায়ুন বীরবিক্রম জাফর ইমাম। দরজা খুলতেই সে এসে তার জ্যেঠা ও আমাকে সালাম করে, সাথে তার পুরো ব্যাটেলিয়ন। সে আশ্বাস দিয়ে গেল, দেশ স্বাধীন, ভয়ের কিছু নেই। আমরা আবার এসে আপনাদের দেখে যাব। আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, আমরা যে এখানে আছি-জানলি কি উপায়ে? ও হাসে। আরে-আপনাদের পাব না-কি যে বলেন? এই নয়মাস যুদ্ধ করে বিজয়ী হতে পেরেছি কেন তবে?

ওকে একগ্লাস শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলাম, পারিনি। ঘরে সামান্য চিনি ছিল। সেটি দিলে ওর জ্যেঠাকে সকালে কি দিয়ে চা দেব? তাই হাতের তালুতে একটু চিনি দিয়ে বললাম, এই নে, পানি খেয়ে মিষ্টি মুখ কর। ও তাই করেছিল।

বুড়িগঙ্গার ওপারের ছেলেমেয়েরা আর বেশি দেরি করেনি। ১৮ ডিসেম্বর ফিরে আসে। তাদের চোখেমুখে অভিজ্ঞতা ফুটে রয়েছে—ছোট ছোট খড়ের ঘর, খড়ের বিছানা, ভাড়া দিয়েছিল পরিবার প্রতি বিশ টাকা, পায়খানা পেশাব খোলা জায়গায়, সামান্য একটু ঘেরাটোপ। তবুও আনন্দে আটখানা, দেশ স্বাধীন। ওরা ঘরে ফিরে এসেছে, সবাই ভাল আছে।

স্কুলের খবরটি যে আমাকে নিতে হলো। আমার রুমের তালা ভাঙ্গা। আয়রন সেফ ভাঙ্গা। স্কুলের মাঠে খোড়াখুঁড়ি, কবরস্থান করেছিল পাকসেনারা। প্রমাদ গুণি। এসব ঠিক না করে স্কুল খোলা যাবে না।

সাহায্য চাইলাম পিডব্লিউডি এর কাছে। কাজ হয়ে গেল। ট্রাক ভর্তি করে মাটি ফেলে প্রথমে মাঠ ভরাট করে। তারপর ট্রাক্টর চালিয়ে উঁচুনিচু সমান করা হলো। বাগানের মালিদের দিয়ে আমি ঘাস লাগিয়ে দেয়ার কাজটি করলাম। ছাত্রীদের জানতে দিলাম না, এখানে যে কত লোকের কবর ছিল! ওদের বললাম, নতুন করে তোমাদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করলাম। স্বাধীনতার পর আমরা একটা জমকালো স্পোর্টস করবো।

নিজের নতুন ডি টাইপ কোয়ার্টারটি গুছিয়ে নেয়ার কোন জিনিস তা আমার অবশিষ্ট ছিল না। শোয়ার জন্য দুখানা খাট নড়বড়ে অবস্থায় উদ্ধার করি, আর অক্ষত পেলাম খাওয়ার টেবিল আর এক লম্বা  বেঞ্চি। ছেলেমেয়েরা নিজেদের বৃত্তির টাকা দিয়ে স্টিলের চেয়ার আর একটা সোফা কিনে আনে-চৌকিও কিনলো। ভাঙ্গা ফ্রিজটা সারিয়ে নিলাম।

কিন্তু মনের গভীরে যে ব্যথা টনটন করছিল তা হল, আমার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের আলমারি দুটো উদ্ধারকারীরা রক্ষা করতে পারেনি। আগুন নেভাতে গিয়ে সব ভস্মীভূত এবং হেঁড়া, কাদাভর্তি করে দিয়েছিল। পরে আমি লোকজন নিয়ে মাটি খুঁড়ে চেষ্টা করে কোনো কিছুই পাইনি। উই পোকায় অবশিষ্ট যা ছিল তাও খেয়ে শেষ। বইগুলোর সাথে হারিয়েছি আমার আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের (বৈরুত) সার্টিফিকেট; ঢাকার মাস্টার ডিগ্রির থিসিস বই, সমাজকল্যাণমূলক কাজের পুরস্কারের সেই অমূল্য সার্টিফিকেট, যা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড ম্যাকমিলান দিয়েছিলেন, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেয়া মেডেলের সাথের ঐ প্রশংসাপত্র। আর গেল পারিবারিক ফটো এলবামগুলো।

আমার মনের দুঃখ ছেলেমেয়েরা বুঝতে পেরে কত বই যে কিনে আনলো, বেতের দুটো শেলফ কিনে সাজিয়ে দিল মাকে, তবুও সেই সব হারানোর দুঃখ কি কমে? সারাক্ষণ মনে কাঁটার মত বিধে আছে-আমার ঐ বই ছিল, সেই বই ছিল সেকি তোরা খুঁজে আনতে পারবি? জীবন দিয়ে হলেও বইগুলো যদি সরিয়ে রাখতাম!

কিন্তু এ নিয়ে দুঃখ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। অক্ষত বেঁচে গিয়েছি বলে এতসব ভাবছি, বলছি। আসলে জীবনে বেঁচে থাকার তুলনা নেই।

আমি যে বারবার নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ি, আর তা সফলতার সঙ্গে কাটিয়ে ওঠার লড়াই করি, সেটি আল্লাহর দান। আমার স্বামীকে অবজারভার পত্রিকা থেকে জোর করে অবসরে ঠেলে দেয়ার বিষয় এ যাবৎ কাউকে বলিনি। সামান্য হাজার পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাকে স্বাস্থ্যগত কারণে বসিয়ে দিয়েছিল কাগজ কর্তৃপক্ষ। তার দোষ অবশ্য সাংঘাতিক ও তিনি এডিটর ও অন্যদের ইংরেজিতে ভূল ধরেন। বলেন-ওরা আমাদের মানুষ হিসেবে পাত্তাই দিতে চায় না। আমরা যেন মানুষ নই-প্রুফ রিডার। অথচ ওরা যারা নিজেকে এক একজন বড় সাংবাদিক হিসেবে মনে করেন, তারা আয়নায় একবারও নিজেদের চেহারা দেখে না। আমরা যারা প্রুফ দেখে ওদের এক একজনকে সাংবাদিক বানাতে সহায়তা করছি, হীনমন্যতার কারণে ওরা তা স্বীকার করছে না। ওরা চাচ্ছে না আমরা ওদের কাতারে শামিল হই, ওদের থেকে বড় হই। জীবনেও আমাকে ওরা সাব এডিটর করবে না। আসলে তার উপরোক্ত মরোভাব উর্ধতন কর্তৃপক্ষের রক্ষণশীল মনোভাবে আঘাত দিয়েছিল। তার চাকরি না থাকা মানে তার জন্য আর কোন বাইরের যোগাযোগ নেই। ঘরে থেকে খুঁটিয়ে সংবাদপত্র পড়বে আর চেঁচামেচি-একটা জাতীয় পত্রিকায় এত ভুল? কেউ প্রতিবাদ কেন করে না?আমার কাছে নালিশ, তোমরা চুপ থাক কেন? আমি যে এক চুনোপুঁটি, তদুপরি কত ঝামেলা মাথায় নিয়ে ঘুরি।। তোমাদের ঐ বড় বড় চিন্তা আমার নেই গো! দুবেলা দুমুঠো খাবার , যদি দিতে পারি তোমাদের সামনে-তাহলে মনে বড় শান্তি পাই-আমার আর কোন চাহিদা নেই।

উনি আপন মনে রুষ্ট থাকেন। উপায় কি, আমিইবা কতক্ষণ ঘরে থাকি! স্বাধীনতার পর স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। আগের সুনাম রাখতে হলে স্কুলের জন্য নানাবিধ নতুন কাজ করতে হবে। মতিঝিল স্কুলের ছাত্রীদের সুনাম কলেজের শিক্ষিকারা (যেখানে ভর্তি হতো) যেমন আগে করতেন, পরেও যেন করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাম যেমন, খেলার মধ্যেও তেমন। আমি এগুলো নিয়ে বেশি সময় দিতাম। ব্যান্ড টিম ছিল আমার সেরা গ্রুপ। রাজারবাগ পুলিশ সেন্টার থেকে ট্রেনার এনে শিখিয়েছি। রাষ্ট্রীয় অতিথিরা এলে আমাদের এই টিম ব্যান্ড বাজাতে নিয়ে যাওয়া হতো। গার্লস গাইডেও তেমনি। কর্মতৎপর করে তুলি মেয়েদের।

১৭ ডিসেম্বর রাতের গভীরে দরজায় জোর আঘাত; ভয়ে দরজা খুলি না। শেষে গলার আওয়াজে বুঝতে পারি, এ যে আমাদের হুমায়ুন বীরবিক্রম জাফর ইমাম। দরজা খুলতেই সে এসে তার জ্যেঠা ও আমাকে সালাম করে, সাথে তার পুরো ব্যাটেলিয়ন। সে আশ্বাস দিয়ে গেল, দেশ স্বাধীন, ভয়ের কিছু নেই। আমরা আবার এসে আপনাদের দেখে যাব। আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, আমরা যে এখানে আছি-জানলি কি উপায়ে? ও হাসে। আরে-আপনাদের পাব না-কি যে বলেন? এই নয়মাস যুদ্ধ করে বিজয়ী হতে পেরেছি কেন তবে?

উনিশ’শ তিয়াত্তর সালের এক আনন্দ স্মৃতিময় ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন তাঁর জন্মদিন। সাজেদা চৌধুরী আমাদের গাইড গ্রুপের একজন উর্ধ্বতন ব্যক্তিত্ব। তাকে জানালাম আমাদের গাইডের মেয়েরা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁর শুভেচ্ছা কামনা করতে চায়-ফুল দেবে। অনুষ্ঠান করবে। আশ্চর্য হলাম! কোনো ফরমালিটি নয়, কোনো আয়োজন নয়, তক্ষুণি নিয়ে যাওয়ার কথা জানালেন তিনি। এখনকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, যেটি রমনা পার্কের উল্টো দিকে বেইলি রোডের শেষ মাথায় অবস্থিত-সেখানে নিয়ে গেলাম। সোজা প্রধানমন্ত্রীর সামনে, সাজেদা আপাও ছিলেন। মেয়েরা একে একে রজনীগন্ধার তোড়া দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে। সামনাসামনি এই মানুষটিকে আগে দেখিনি, এমন সুন্দর আর দরদী। কথায় আমাদের মাতিয়ে দিলেন। তাঁর হাতের একগুচ্ছ রজনীগন্ধা তুলে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি দূরে কেন, আমায় শুভেচ্ছা দিন! নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ঐ ফুলের তোড়ার স্পর্শ দিলেন আমার মাথায় ছঁইয়ে। মেয়েদেরকেও অনেক মজার কথা বলে হাসালেন। সেদিনকার কথা কোথায়ও লেখা নেই। যে মেয়েদের নিয়ে গিয়েছি তারাও আজ কোথায় জানি না। শুধু আমার স্মৃতিতে একজন বড় মাপের রাষ্ট্রনায়কের কাছে এত সহজে মূল্য পাওয়া এ যে। ভাবাও যায় না।

ঐ বছরটি আমায় আরও পুষ্পিত করেছিল। মেঝছেলে (শামীম) বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যালে ইঞ্জিনিয়ার হলো। বেশ ভালো পাশ করে ভালো চাকরিও পেল। বড় ও মেঝ মেয়ে দুজনই স্বামীর কর্মস্থলে বসবাস করতে গেল। আমি স্পষ্টত দেখতে পেলাম, খোদার দরজায় আমার সেই প্রার্থনা মঞ্জুরের সময় উপস্থিত। স্বামীকে হজ্বব্রত পালন করার জন্য পাঠাতে হবে। খোঁজ-খবরে জেনে নিলাম, টাকা লাগবে সাত আট হাজার। আমার পক্ষে এ টাকা সংগ্রহ করা কষ্টের হবে না। সুখবরটি তাকে জানাতেই হাউকাউ লাগিয়ে দিলেন। না তিনি যাবেন না, একা তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আমাকে যেতে হবে। অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে বললাম, এত টাকার ব্যাপার, আমার পক্ষে যোগাড় করা অসম্ভব। মনকে শক্ত কর, কত লোক সাথী পাবে। কোন অসুবিধা হবে না। তোমার থেকে বয়সে বড়, বেশি অসুস্থ লোকও হজ্ব করতে যায়, একাই যায়। আমার এত আপ্তবাক্যে তার সাড়া পাইনি। এক কথা তিনি যাবেন না। আমি মন খারাপ করে থাকি, আল্লাহর কাছে দোয়া চাই-যদি তার মনে সাহস সঞ্চার করেন তিনি। আমার অস্থিরতায় বিধাতার আসন টলে উঠেছিল বলতেই হবে।

আমাদের আশ্রিত ও পালিত এক লোক মুবারক সে আমাকে আম্মা ডাকে। শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ফার্মে চাকরি করে। তাকে ইসলাম সাহেব তার বাবার বদলি হজ্ব করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিশজনের এক গ্রুপ। আকস্মিকভাবে মুবারকের হজ্বে যাওয়া এবং আমারও সেই সুযোগ নেয়া—ঐ দলে ঢুকিয়ে দিলাম স্বামীকে। সংবাদটি তাকে জানিয়ে দিতেই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যান, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমার সেদিনের মন্তব্য-ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানই বয়। আমি কোন ছার। ফার্স্ট ফ্লাইটে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তোমরা ভাগ্যবান হজ্বযাত্রী। আসলে মুবারক সাথে যাওয়ায় আমারও চিন্তা কমলো। একা দিতে পারতাম কিনা বলা কঠিন।

ফিরে এসেছিলেন লাস্ট ফ্লাইটে। যতদিন থাকা যায়, থেকে এসেছেন। ঘটনা আরও মজার। খোদ ইসলাম সাহেব তার খাওয়ার তদারকি করেছিলেন। রোজ রোজ মুরগির স্যুপ, আপেল, আঙ্গুর খেতে দিয়েছেন। দেশে এসেও ওসব খাওয়া ভুলতে পারছিলেন না। খেতে বসে আমাদের শোনাতেন। তার মস্ত বড় ক্যান ভর্তি আবে-জমজম বয়ে আনাটাও অসাধারণ। কেউ এত পানি বয়ে আনে!

উনিশ’শ তিয়াত্তর সালের এক আনন্দ স্মৃতিময় ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন তাঁর জন্মদিন। এখনকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, যেটি রমনা পার্কের উল্টো দিকে বেইলি রোডের শেষ মাথায় অবস্থিত, সেখানে নিয়ে গেলাম। সোজা প্রধানমন্ত্রীর সামনে, সাজেদা আপাও ছিলেন। মেয়েরা একে একে রজনীগন্ধার তোড়া দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে। সামনাসামনি এই মানুষটিকে আগে দেখিনি, এমন সুন্দর আর দরদী। কথায় আমাদের মাতিয়ে দিলেন। তাঁর হাতের একগুচ্ছ রজনীগন্ধা তুলে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনি দূরে কেন, আমায় শুভেচ্ছা দিন! নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ঐ ফুলের তোড়ার স্পর্শ দিলেন আমার মাথায় ছুঁইয়ে। মেয়েদেরকেও অনেক মজার কথা বলে হাসালেন। সেদিনকার কথা কোথায়ও লেখা নেই। যে মেয়েদের নিয়ে গিয়েছি তারাও আজ কোথায় জানি না। শুধু আমার স্মৃতিতে একজন বড় মাপের রাষ্ট্রনায়কের কাছে এত সহজে মূল্য পাওয়া এ যে। ভাবাও যায় না।

এ যাবত কত ঘটনার কথাই বলে গেলাম, লৌকিক, কি অলৌকিক কিংবা কেউ যদি ভাবেন পুরুষশাসিত সমাজে আমি কোনও কারণবশত উন্নত অবস্থায় আছি। আমি যা করতে চাই তা করে যাচ্ছি। এত ঘটনার মধ্য দিয়েও স্বচ্ছন্দে এবং নির্বিঘ্নে চলছি। সেখানে আমার একটা কথা বলার আছে, আমি কোন উন্নত অবস্থার মধ্যে কি করে থাকতে পারি? আমার প্রচুর বিত্ত নেই, বড় বড় আত্মীয়-কুটুম নেই। পরন্তু আমি নিজেকে যে অবস্থায় এক এক সময় দেখতে পাই, তা একজন নির্যাতিতা নারীর দেহ মন আমার। আমার কষ্ট-শ্রমসাধনা দিয়ে ভাল কাজ করা এবং ভাল থাকা নিয়ে অনেকের কটুক্তির সম্মুখীন হয়েছি। নিজ স্বামীর মুখে কুকথার গালি হজম করেছি শুধু এই লক্ষ্যে, যা চাই তা যেন ভুল করে না চাই। বুদ্ধি দিয়ে, সাধনা করে, দিনরাতের শ্রম ঢেলে সেটি অবশ্যই যেন পেতে পারি। এ আমার অসম্ভব চাওয়া ছিল না। আর একটা বিষয়কে খুবই মনে করে রাখতাম, আমাকে অধৈর্য এবং অলস হলে চলবে না।

স্কুলের কাজ-কর্মে কেবল একজন দক্ষ হেড মিস্ট্রেসের মধ্যে আমাকে সীমাবদ্ধ রাখার কথা কখনও ভাবিনি। অতিরিক্ত সময় নিজে যেমন ব্যয় করতাম, তেমনি অন্যদেরকেও সেভাবে পরিচালিত করেছি। স্পোর্টস ম্যাগাজিন (বিদেশী) কিনতাম, স্কুলের মেয়েদের বিভিন্ন কলাকৌশলের ড্যান্স শেখানোর জন্য ইউরোপ, আমেরিকার মেয়েদের ছবি দেখিয়ে মেয়েদের উৎসাহিত করেছি। ওরা পারে, তোমরাও পারবে, কেন পারবে না বল? বাড়ি থেকে আপত্তি। তাহলে গার্জেনদের ডেকে বুঝাব। গার্লস গাইডের একটা খুব বড় প্রোগ্রাম করলাম। মেয়েরা ক্যাম্প করলো, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, হাতুড়ে চিকিৎসা, ভিক্ষাবৃত্তি, ভোট দেবেন কাকে। এসব নিয়ে কমিক, নাটক পরিবেশন করছিল মেয়েরা। স্কুলের শিক্ষিকাদের ভাল সহযোগিতা ছিল এতে।

তবুও নানা সমালোচনায় পড়েছিলাম। লেখাপড়া বাদ দিয়ে আলতুফালতু করে মেয়েদের নাচাচ্ছি। শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, এসব কথা বলতে শুনলে মন খারাপ হয়ে যেত। তবে ধৈর্য কখনো হারাতাম না। বলতাম যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আমার এসব মেয়েরা লেখাপড়ায়ও কৃতিত্ব দেখাতে জানে। সেটাও স্কুলে শিক্ষা দেয়া হয়।

ভাল কাজের সুনাম পাওয়া দুর্লভ, দুর্নামই রটে বেশি। মেয়েদের আমি পুরুষদের মত তৈরি করে দিচ্ছি। এরা সমাজের ত্রাস হয়ে দাঁড়াবে কালে—এ ধরনের কথা প্রচার কাজের ছিলনা মেয়েদের স্কুল থেকে কোন গার্জেন তুলে নেয় না, উল্টো ভর্তি করাতেই বেশি আসছিল। মেয়েকে শিক্ষিত এবং আধুনিক সমাজের জন্য তৈরি করতে সব পিতামাতাই চান।

আমার এক নদীর জীবন (পঞ্চম পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (চতুর্থ পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)

মা

মার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (প্রথম পর্ব)

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share