আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

।। রওশন সালেহা ।।

রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুণরায় প্রকাশ করছি।

আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

শৈশবের কিছু ভাবনা

বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় মা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন, সাথে করে দশ এগার বছরের মেয়ে নিয়ে কেউ যায়? এতো রাত করে? আমরা ঘরে এলাম, মা বকা শুরু করেন, এই রাতে সোনারূপা ভেজান পিতলের কলসির পানি দিয়ে আমাদের দুজনকে গোসল করিয়ে শান্ত হলেন। ভূত প্রেত এবং জ্বীনের ভয় তাড়ানোর ঐ ছিল তার অবশ্য করণীয়। সোনা ও রূপা এমন এক ধাতু, যার ছোঁয়া থাকলে পানিতে আপদ বালাই ধুয়ে নিয়ে যায়। আমি বড় হয়ে কী হব, এমন সুখের কথাগুলো বলার সাহসও আমার তখন অন্তর্হিত। তার রাগে আমাদের প্রচণ্ড ভয়, মা অনশন করা শুরু করলে, সেটি ভঙ্গ করতে অনেক সাধ্য-সাধনা লাগে। আমরা শুয়ে গেলাম, মা তখন জায়নামাজে বসলেন।

সংসারে মা হলে মেয়েদের এমন একটা আসনে বসতে হয়, সেখানে তার সকল সাধ আহ্লাদ বলতে কিছু থাকে না। সারাক্ষণ এর জন্যে, ওর জন্যে করার একটা মন গড়ে নেয়। আমার মাকে সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত, কি খাওয়া নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতে কখনো দেখতাম না। পরিচ্ছন্ন পোশাকে ছোটখাট মানুষটি সংসারে এবং বাবার বৈঠকখানা রাজনীতির তাঁবেদারি নিয়ে দিনরাত চরকির মতো ঘুরতেন। কখনো হাসছেন, কখনো গোস্বায় থমথম করছেন। এদিকে গরীব দুঃখীদের মা জননীও তিনি।

সাজ পোশাক নিয়ে সেকালে বাড়াবাড়ি ছিল না, আমরাও নতুন জামাকাপড় পেতাম বছরে রোজার ঈদে। বরুণ সাহেবের দীঘির পাড়ে বড় শাড়ির দোকান কমলালয়া। মুগা সূতার কাজ-করা পাড়ে, হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি মায়ের জন্যে দু’খানা কী তিনখানা, আমার জন্যেও দু খানা, ভাইবোনের জন্যেও জামা, প্যান্ট ঐ দোকান থেকে কেনা হতো। জুতো কিনতাম আব্দুল গফুর সওদাগরের দোকান থেকে। শহরের সেরা দোকান ছিল এ দুটো। শাদার উপর ফুল তোলা শাড়িও মা পরতেন, বিশেষত নানার বাড়ি এবং ফেনীতে বেড়াতে গেলে। গহনাও ছিল অতি সামান্য গায়ে, হাতে দু’খানা চ্যাপ্টা সোনার চুড়ি, গলায় চেন, কানে রুবি পাথরের টব। তখন মেয়েরা সারা কান ফুটো করে গোল গোল বালি পরতো। তারও ফুটো ছিল, কিন্তু কোনোদিন পরতে দেখিনি। এই আমাদের মা। বেশ রাশভারি, কথার কিন্তু নড়বড় করতেন না। উপোষ মেরে দিনরাত কাটিয়ে দেবেন কিন্তু যা বলেছেন, অন্যদের সেটা মেনে নিতে হবে, এমন ইস্পাত কঠিন। আমরা ভয়ে মরতাম।

তার অপুষ্টি, গায়ে গায়ে জ্বর, অনিদ্রা রোগ লেগেই থাকতো, তদুপরি – সেই যে ঘুমালে বোবায় ধরা রোগ আবার ফিরে এসেছে, শহরের বাড়িতে গাঁয়ের বাড়ির মত মাটির সরায় আল্লাহর নাম কালাম লিখিয়ে চার কোণায় টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো। মিলাদ তো প্রতি সপ্তাহে বাবা পড়াতেন। তথাপি মাকে এই ভয় থেকে পার পেতে দেখতাম না। স্বপ্ন দেখেও কেঁদে জেগে উঠতেন, কে যেন দুঃখিত গলায় শোনাত, রূপধন, তোর একটা সন্তানকে মেরেছি, আরেকটা কেটে দেব। আমাদের একটা  বোন খুব সুন্দর ছিল বলে বাবা কোহিনূর নাম রেখেছিলেন। তারপর এক ভাই, খুবই সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান, নাম দিলাম মন্টু। উভয়েই ছয় মাস বয়সে মারা গেল। তার পরেও এসব দুঃস্বপ্নে আমাদের সেই সময়গুলো ভীষণ খারাপ গিয়েছে। মা নামাজ পড়তে বসলে উঠতেন না। বাবার ভোটে দাঁড়াবার কথা ছিল। নাম তুলে নিলেন। কিন্তু তারপরেও জ্বীন আর বোবায় পাওয়া মায়ের শরীরের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতদসত্ত্বেও আমাদের যে নিয়মিত গ্রীষ্মের ছুটিতে নানার বাড়ি এবং পূজার ছুটিতে বাটৈয়া গ্রামে যাওয়া বন্ধ হয়নি। যেমন সংসারের অন্য কাজও থেমে থাকতো না। আইনজীবীদের জীবন বোধকরি এমন। এমন জীবন চাই না। মনে। মনে ঠিক করেছিলাম, কখনো আইন পড়বো না, উকিল হবো না। ‘বড় হলে তুমি কি হবে একদিন খুব আন্তরিক হয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন। তারপর বললেন, আমি চাই তুমি আইন পড়, উকিল হবে। মুসলমান পরিবারের মেয়েদের হক আদায়ের কেসগুলো হাতে নিয়ে আমরা হিমশিম খাই। মেয়েদের জবানবন্দি করতে জান খারিজ হয়ে যায়, না বোঝে নিজের ভালো, না বোঝে আমাদের কথা। আমি যে কমিশনে যাই, তোমাকে একবার নিয়ে যাব। একটু বড় হয়েছে, বুঝতেও পারবে। সামনে কমিশন বসানোর একটা তারিখ আছে, আমাদের গ্রামের পরের গ্রামে, তুমি যাবে তো?

কোথায়ও যাওয়ার কথা শুনলেই আমার খুশি লাগে। কমিশন বসান কী, সেটা দেখার আগ্রহে আরো খুশি। গিয়েছিলাম হেঁটে, গ্রামের সরু রাস্তা, মাথায় ছাতি ধরা ছিল, আশ্বিন-কার্তিক মাসের রোদ। কিন্তু যেবাড়িতে গেলাম, তারা বেশ অবস্থাপন্ন, খাওয়া এবং মেহমানদারি করেছিল প্রচুর পরিমাণ, তবে আসল ব্যাপার ছিল এসবের বাইরে। পর্দা ঘিরে একজন মহিলাকে বসানো হলো। পর্দার বাইরে বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিলরা বসেছেন। বাবা ছিলেন বাদী পক্ষের। মহিলাটিকে দাঁড়িয়ে কি বলতে হবে তার স্বামীর কাছে বাবা তা শিখিয়ে দিচ্ছেন। সাক্ষী দেয়ার জন্যে পর্দার কারণে মহিলারা কোর্টে না গেলে বাড়িতে কমিশন বসার নিয়ম। মহিলাটি তোতাপাখির মতো বুলি শিখছে, আর ভুলে যাচ্ছে। আমি রেগে যাচ্ছিলাম, এ সাধারণ বাক্যটি কেন পারছে না? বালিশের কভারে রঙিন সূতায় ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’ এত বড় বাক্য তুলতে পারলো আর মুখে তার শেখানো কথাগুলো আসছে না। তার বাপের হক ভাই বিক্রি করে দিচ্ছিল, বোনকে বঞ্চিত করছে। সে দাবি করবে একথাও মুখে আসেনা? কমিশনিতে গেলে এই সাক্ষীর জবানবন্দি করতে মাত্র দু-তিনটে কথা। অথচ লেগে যায় সারাদিন, এমনকি তার পরের দিন।

রাতে খাওয়ার পর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলে মা। লেখাপড়া শেখার কতো দরকার। এরা যদি সামান্যও লেখাপড়া শিখতে, আমাদের এমন কষ্ট হতো না, তারা নিজেরাও এমন দুর্ভোগের মধ্যে পড়তো না, গোটা মুসলিম সমাজটাও বেঁচে যেত। তুমি উকিল হলে এদের সাহস হতো, অন্তত মুখ খুলে কথা বলতো, এমন হাঁ না করে মাথা নাড়তো না, নিজের মান সম্মান কি সেটা বুঝতো। সেদিন রাতেই আমরা বাড়ি রওয়ানা দিই। এ মহিলা আমাকে তার হাতের তৈরি আয়না বসানো, ঝালর দেয়া হাতপাখা উপহার দিলেন। আস্তে করে বললেন, ‘হুদদো আলার লগে কতা কইলে শেরেকি গুনা, হাবিয়া দোজখ, আঁর সোয়ামী আছে না! (পুরুষ মানুষের সাথে কথা বললে শেরেকি গুনাহ, হাবিয়া দোজখে যাবো, আমার স্বামী আছেন)।

উনিশশো উনচল্লিশ সালের প্রথম দিকের ঘটনা ছিল এটি। আমি বাবাকে একলা পেয়ে আর দেরি করিনি, বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে দিলাম, আমি উকিল হব। জানেন আব্বা, মেয়ে উকিল দেখলে আজকের এই মহিলা কথা বলতেন। উনি আমাকে বলেছেন সে কথা। আমাকে একটা উপহারও দিয়েছেন। এই দেখেন, আমি পাখা দিয়ে বাবাকে বাতাস করে দেখালাম, ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন। হাসি হাসি মুখে আমাকে চোখ মেলে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, বাড়িতে গিয়ে আপনার আমাকে বলবেন একথা। আমাকে ‘আপনি বলতেন বাবা বেশি আদর করার জন্যে, তার মন যখন চাইতো।

বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় মা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন, সাথে করে দশ এগার বছরের মেয়ে নিয়ে কেউ যায়? এতো রাত করে? আমরা ঘরে এলাম, মা বকা শুরু করেন, এই রাতে সোনারূপা ভেজান পিতলের কলসির পানি দিয়ে আমাদের দুজনকে গোসল করিয়ে শান্ত হলেন। ভূত প্রেত এবং জ্বীনের ভয় তাড়ানোর ঐ ছিল তার অবশ্য করণীয়। সোনা ও রূপা এমন এক ধাতু, যার ছোঁয়া থাকলে পানিতে আপদ বালাই ধুয়ে নিয়ে যায়। আমি বড় হয়ে কী হব, এমন সুখের কথাগুলো বলার সাহসও আমার তখন অন্তর্হিত। তার রাগে আমাদের প্রচণ্ড ভয়, মা অনশন করা শুরু করলে, সেটি ভঙ্গ করতে অনেক সাধ্য-সাধনা লাগে। আমরা শুয়ে গেলাম, মা তখন জায়নামাজে বসলেন।

আমাদের নোয়াখালীর বাসায় একবার কমিশন বসিয়েছিলেন বাবা। তার মক্কেল মহিলা সাক্ষী নিয়ে সপরিবারে উকিল সাহেবের বাসায় আসেন, তিনটে গরুর গাড়ি ভর্তি মহিলা, শিশু, ঝি, চাকরানি, তদুপরি হাঁটা লোকতো আছেই। বেশ বড় মারামারির কেস, জমির দখল, সংক্রান্ত। মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে একজনের রক্তারক্তি চেহারা। জামা কাপড়ে চাপচাপ রক্ত। বৈঠকখানায় তাঁকে রাখা হয়েছিল দেখেছিলাম। ভারে ভারে চাল, ডাল, কুমড়া, দই, মিষ্টিতে তারা সাথে এনেছে, আরো এনেছে একটা বড় গরু, একটা খাসি ছাগল, রীতিমত জিয়াফত খাওয়া চলছিল তিনদিন। মহিলা সাক্ষীদের কথা বের করা যে কি পরিশ্রম, সহনশীলতা ও ধৈর্য নিয়ে করতে হয় বাবাকে, মা দেখে অস্থির হয়ে যেতেন, মন মেজাজ খারাপ হয়ে যেত।

তখন আমার ছোটো ভাইটির পেটে অসুখ ছিল, অথচ মা রান্নাবান্না খাওয়ানানোর কাজে তদারকিতে ওকে দেখতে সময় করতে পারেননি। ফলে স্কুল কামাই করে আমি ওকে কোলে-কাঁখে করি, ছাটো পিতলের বদনায় নিপল লাগিয়ে গরুর দুধ খাওয়াই, আমার বানো নূরজাহানও সাথে—দুবানো মিলে ওকে রেখেছি—তবুও ওর পেট খারাপ হওয়া আরো বেড়ে গেল। দুধে পানি মেশানোর পরিমাণ ঠিক হয়নি, মা এ নিয়ে আমাদের অপরাধীও করলেন। এদিকে ভাইটি ভুগতেই লাগলো। ডাক্তার সকালে বিকালে এবং শেষে রাতদিন করে দেখতে ছিল এক মাস যাবত। রক্ত আমাশয় হলে ঐ শিশু বাঁচে না। আমরা কোরান শরীফ নিয়ে পড়তাম ওর মাথার কাছে বসে। বাইরের ঘরে মৌলভী সাহেবরা দরূদ পড়ছিল। ওষুধে না বাঁচুক, আল্লাহ তুমি ওকে হায়াত দাও।

মাকে দেখতাম ওর মুখের দিকে অপলক চেয়ে রয়েছেন, মুখে শব্দহীন ঠোট নেড়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটু নড়ে ভাইটি শরীর এলিয়ে দিল। বাবা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তাকে এ যাবত আমরা এমন কাঁদতে দেখিনি। মা, বসা অবস্থা থেকে ঢলে পড়ে গেলেন। সেবা করতে যে বুয়াটি সে মায়ের অবস্থা টের পেয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। অজ্ঞান হয়ে দাঁত খিচে মরমর অবস্থা। ডাক্তার দু’জন যারা ভাইকে দেখতেন তারা তখনো ছিলেন। পর্দার কারণে মায়ের হাতে কাপড় পেঁচিয়ে নাড়ি দেখানো হল ঐ অবস্থায়। আমরা তিন ভাইবোন জড়াজড়ি করে বিহ্বল। চোখের পানিও থমকে ছিল বুঝি। এক সময় দেখলাম পাশের বাসার খালাম্মা এসেছেন। আমাদের টেনে নিলেন বুকে, বাই তো গেছে, তোরা মায়ের লাই আল্লার কাছে কাঁদ।

 শোকের বাড়িতে উনুন জ্বালতে নেই। আগুনের তাপে নাকি  শোক বেড়ে যায়। এ বাড়ি, সে বাড়ি করে চল্লিশ দিনের প্রতিদিন দু বেলায়। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, দই এসবতো আসতোই, সাথে থাকতে এক বাটি কড় কড় করে ভাজা তিতা করলা। খাওয়ার শুরুতে শুধু তিতা গিলে খাওয়ার নিয়ম। এতে শোক-দুঃখের মধ্যে কম ব্যথা দেয়। কী জানি, ঘরের বড় মেয়ে, আমাকেই এ কাজটি করতে হয়েছিল জোর করে। মা এবং বাবা দুজনেই শোকে পাথর হয়ে আছেন। মুখ খুলে খাওয়ানো বড় কঠিন কাজ ছিল। পাড়া-পড়শিরাও আসতেন। সেকি খাওয়া? না বিষ গেলা? আমরা চোখের পানি মুছতাম। সে যে যাওয়ার সে সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেল।

বাবার অফিস, মায়ের ঘরকন্না, আমাদের স্কুল সবই নিয়মের মধ্যে, না করলে হয় না। কেবল মায়ের শরীর সেরে ওঠে না। আমার স্কুলে থেকে শিশির দি, মনিকা দি প্রত্যেকদিন এসে কত গল্প করতেন মায়ের সাথে, একসাথে বসে খেতেন, যাতে মায়েরও খাওয়া হয়। তারা ঠিক আমাদের পরিবারের লোক হয়ে গিয়েছিলেন। মাকে তারা এত ভালবাসতেন, আগে কখনো জানতে পারিনি। সেই সিঙ্গার মেশিনের মহিলাও আসতেন, মাকে সারিয়ে তোলার জন্যে তারও আপ্রাণ চেষ্টা ছিল। সত্যি দেখলাম, ধীরে ধীরে মা শোক সামলিয়ে উঠেছেন। তারপরও তাঁর ভয় থেকে গেল, ভাই বাট্টুর জন্যে মনে দুশ্চিন্তা করতেন। ওর গায়ে কোনো আঁচড় লাগলে উনি পাগলের মতো হয়ে পড়তেন। আবার পূজার ছুটিতে বাড়ি আসার নিয়মটাও বাবাকে রক্ষা করার জন্যে সহায়তা করে গেলেন। গ্রামে আসা বাবার জন্যে দরকার। দাদিমার বৃদ্ধ বয়সে তার কাছে ছোট ছেলে কিছুক্ষণ থাকবে, গ্রামের লোক উকিল সাহেবকে পূজার ছুটিতে গ্রামে আসতে দেখে, গ্রামের ছেলে বড়লোক হয়ে তাদের ভুলে যায়নি, এই খুশি নিয়ে তারা। অপেক্ষায় থাকে। মায়ের শরীর অসুস্থ হলেও এর ব্যত্যয় হতে তিনি কখনো দিতেন না। বাবাতো এতসবের মধ্যে থাকেন না। তার রুটিন কাজ এ সময় দেশের বাড়ি আসা। তিনি আসবেন। মা জেনেশুনে অসুস্থতা চেপেও থাকতেন।

এদিকে আমরা একপায়ে খাড়া, বেড়াতে যাওয়ার জন্যে মন অস্থির, ঘোড়ার গাড়ি চড়ে  সোনাপুর রেল স্টেশনে এসে দেখেছিলাম ট্রেন এখনও আসতে দেরি। চৌমুহনী থেকেই ছাড়েনি। ওয়েটিং রুম একটাই প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের জন্যে। লাল ইটের ঘর, মোজাইকের দেয়াল, মেঝেটাও ঝকঝকে। খাট, ইজিচেয়ার, টেবিল, সব ফিটফাট। লাগোয়া বাথরুম আরো সুন্দর। সবই চমৎকার। বাবা বললেন,

একটাই বিপদ, কোনো ব্রিটিশ কর্মকর্তা বা জজ ম্যাজিস্ট্রেট এসে পড়লে আমাদের কামরা ছেড়ে দিতে হবে। ভাগ্য ভালো, কেউ সেবার উটকো বিপদ ঘটাতে উপস্থিত হয়নি।

সেবার বাড়িতে থাকার শেষের দিকে একটা জমিদারি অনুষ্ঠান দেখেছিলাম, যার নাম ‘পুণ্যাহ’। দিনটি আমাদের রায়ত-প্রজাদের বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্যে ঢোল-শহরত করে হাটে। মাঠে এবং ঘাটে তহশিলদার অফিস থেকে  ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আমাদের কাছারির সামনের ময়দানে সকাল থেকে  ঢোলের ড্রিম ড্রিম শব্দ বাজছিল। একদিকে মেলাও বসে গেল। নানান জিনিসের মেলা— মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কাঠের পিঁড়ি, বেলুন, আলনা, চৌকি, রেশমি চুড়ি, পুঁতির মালা, বাতাসা, জিলাপি এমনই সব বেচাকেনা। মেলা জমে উঠেছিল দুপুরের পর। রায়ত প্রজারা স্নান সেরে, তেল মেখে মাথায় সিঁড়ি কেটে, পরিষ্কার ধূতি-লুঙ্গি পরে, কেউ বা ফতুয়া, কেউ পাঞ্জাবি (একদিন পরার জন্যে অথবা কোন বিশেষ কাজে কোর্টে যেতে হলে এই জামা তুলে রাখে) গায়ে চড়িয়ে একে একে বা ছেলেমেয়ের হাত ধরে আসতে দেখলাম; আমার জেঠাজিও আজ  ধোপ-দুরস্ত পাঞ্জাবি-পায়জামা (লুঙ্গিও হতে পারে মনে নেই) এবং মাথায় লাল রঙের ফেজটুপি পরে কাছারি ঘরে চৌকিতে বসেছিলেন। মুসলমানরা পায়ে ধরে সালাম এবং হিন্দুরা ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সামনে টাকা রাখছিল। সাথে তারা নজরানাও এনে থাকে। যেমন গাছের পাকা শসা, খাসি করা  মোরগ, ছাগল, রুই-কাতল মাছ, রাজহাঁস। আরো দেখতাম বেণী পাকানো রসুনের মালা, বেঢপ বড় মিষ্টি কুমড়া, বিড়া বাধা পান। কলার কাঁদি, সরু চাল, নারকেলের সন্দেশ, গাওয়া ঘি এবং আরো কত কি! শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কম ছিল না তাদের মধ্যে। আমার দাদিমা পর্দা করতেন না। এদের সামনে লাঠি ভর করে  ঘোরাঘুরি করতেন। কুশল জিজ্ঞেস করতেন। এই সম্পত্তি দাদা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে  মোতোয়াল্লী করে ‘ওয়াকফ’ করে গেছেন। ঐ দেখাই শেষ। কারণ এরপরের বার এবং তারপরেও আমার আর যাওয়া হয়নি। গ্রামের বাড়ি কেবলই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছিল।

অবরোধে পড়ে মন মানে না

আমার প্রথম শাড়ি পরা বড় বিছরি, অগোছালো; ফ্রকের উপর চুলের ফিতায় গিঁট দিয়ে শাড়ি আটকিয়ে এক প্যাঁচ দিয়ে নিজেই পরলাম। মা খুশি মনে হাতে তুলে দিয়েছেন দু খানা শাড়ি, দশ হাত লম্বায়। একখানা টিয়া রঙের, পাড় ছিল কড়া লাল, অন্যটা জাম নীল, তাতে খয়েরি পাড়। টিয়া রঙেরটা পরে একবার ঘুরে ফিরে নেচে নিলাম। আয়নায় দেখার মত বড় আয়নাতো ছিল না। মা বলেছিলেন, বেশ লাগছে। কাল থেকে স্কুলে পরে যাবি। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি, কেন, স্কুলে তো সবাই ফ্রক পরে যায়, আমি শাড়ি পরে গেলে ওরা হাসবে, আমাকে খেলায় নেবে না।

স্কুলে কি খেলতে যাস? শাড়ি পরার বয়স হলে পরতে হয়। ক্লাস সিক্স শেষ করে ফেললি, আর কত? পরদিন থেকে শাড়ি পরে না গেলে স্কুলে যাওয়ার জন্য তোর বাবাকে ঘোড়ার গাড়ি কেয়ারা করতে হবে … মা থামলেন। দেখলাম পেটিকোট, ব্লাউজ তিনি সেলাই করে রেখেছেন। আমি খুশি হব কি? চোখ ভিজে গেল। কেঁদে দিলাম। বান্ধবীরা সব খুকি আর আমি ওদের থেকে বড় হয়ে গিয়েছি। মা এত পর্দায় থাকেন, কিছু বোঝেন না। সমবয়সীরা কেমন ভেঙচি দেবে। অসহ্য লাগবে। কি আর পড়ালেখা, এদিকে বৃত্তি দেয়ার জন্যে আমার নাম দিয়েছে স্কুল থেকে।

উপায় ছিল না। শাড়ি পরিয়ে নিজের ব্রুস আটকিয়ে মা আমাকে তৈরি করিয়ে দিয়েছেন। স্কুলে গেলে বান্ধবীরা হাসি-তামাশা তো করলোই অনেক। শেষে ‘এই  মোসলা’ বলে উপহাস করছিল। ওরা এরকমই বলতো, মুসলমান মেয়েদের শাড়ি পরতে দেখলে, নাকে নোলক দেখলে, মুখে এই এক শব্দ। অসহ্য লাগছিল, কিন্তু ওদের এক গুষ্টি মেয়ের সাথে আমি একা পেরে উঠবো না জেনে, ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিয়েছিলাম, শাড়ি পরাতো ভালো, পা ঢেকে যায়, পা দেখা যায় না। আমার আম্মা বলেছেন, মুসলমানদের এই নিয়ম অনেক ভাল সুন্দর। তাদের মায়েরা নিজেরাই কেবল শাড়ি পরে ভাল থাকে, সুন্দর থাকে, তোদের কিছু বলে না। আসলে তোদের আদর করে না, বুঝলি।

ছবি আমার বিশিষ্ট বান্ধবী ছিল ও আমাকে সাপোর্ট করতেই অন্যরা ওর সঙ্গে আড়ি দিল, কয়েকদিন আমাদের খেলায় নিত না। বড়দিমনিও আমার শাড়ি পরা লক্ষ্য করলেন। হেসে আদর করলেন। তোমার মাকে আমি দেখেছি, উনি খুব পর্দা করেন। কিন্তু খুব গুণবতী, লেখাপড়াও করেছেন, ক্লাসের মেয়েরা তোমাকে জালাতন করলে বল, আমি ওদের বুঝিয়ে দেব। যার ধর্মে যে বিধান সেটা মানতে হয়, এটা হাসির কথা নয়। আসলে বান্ধবীদের কি আর দোষ দেব, একটি মেয়ে। জবুথবু শাড়ি পরা ক্লাসে, না দৌঁড়াতে পারে, না খেলতে পারে, ওঠা বসায়ও কষ্ট। তখন আমরা গোল্লাছুট, বুড়ি ছুট, হাডুডু খেলতাম। আর শাড়ি খুলে যাওয়ার ভয়ে আমি বসে থাকতাম। মনে কি যে দুঃখ হতো। মুসলমান হয়েছি তো ঠিক আছে, ছেলে হলাম না কেন? মেয়েদের জন্যে পর্দা আর ছেলেরা দিব্যি হাফপ্যান্ট পরে চলতে পারে!

একদিন আমার পেটিকোটে দড়ি ছিল না। গিট দিয়ে শাড়ি পরে স্কুলে গেলাম। সেদিন ককফাইট খেলার কমপিটিশন ছিল। আমি নাম দিয়েছিলাম। আগেই হুড়মুড় করে মাঠে গেলাম। ককফাইট তো এক পায়ে নাচতে থাকে আর অন্যকে ধাক্কা মেরে তার দুপা নামিয়ে দিয়ে ফেলে দেয়া। এই খেলাতে গিয়ে আমার পেটিকোটের গিট খুলে গেল। ভাগ্য ভালো টের পেলাম আর লজ্জা পাওয়ার আগেই শাড়ি ধরে মাঠ থেকে ছুট। শাড়ির পেছন দিকটা পড়েও গিয়েছিল। এমন হলে কি আর খেলতে মন চায়! নাম কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমি সেদিন দাঁত দিয়ে শাড়ির অনেকখানি কেঁটে ছিঁড়েও দিয়েছিলাম, বেশ মনে আছে।

শাড়ির কেচ্ছা-কাহিনী আর হতে দিইনি। বয়স যা হোক, দেখতে আমি বড়, মাথায় উঁচু, গতরে নিটোল, হয়ে চলেছি। ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে গেলাম উমা গালর্স হাই স্কুলে। যাই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে।

বন্ধ জানালা, খিড়কিও ফাঁক করতে পারা যেত না। কাঠ মেরে খড়খড়ি চেপে দেয়া। ভেতরে চার পাঁচজন মেয়ে ঘেমে নেয়ে যেতাম, তবুও হাসতাম খিলখিল শব্দে। স্কুলে যাওয়ার এই সামান্য মুক্তি,হোক না বন্ধ গাড়ি,এক সময়ে এটি আমাদের পৌঁছে দেবে স্কুলে। সেখানে  খোলা হাওয়া,অনেক আলো,নানান বয়সী মেয়েদের মেলামেশা।স্কুলের চারপাশে উঁচু হাওলি বেড়া, গেটে দারোয়ান। অন্য কেউ ঢুকতে আসে না। শিক্ষকদের অধিকাংশই মহিলা।শুধু তিনজন পুরুষ শিক্ষক অতি বয়স্ক,পন্ডিত,মৌলভী এবং অংকের স্যার। ভেতরে প্রচুর খোলা জায়গা, খেলার মাঠ,আম-কাঁঠালের বাগান। চমৎকার পরিবেশ। ইতিমধ্যে শাড়ি পরা রপ্ত করে নিয়েছি। আর কোন কেলেঙ্কারি হয়নি। কিন্তু হিংসা হতো যখন দেখতাম হিন্দু মেয়েরা ক্লাস টেন অবধি ফ্রক পরে,দু বেণী গেঁথে খুকি সেজে স্কুল করতো। ওরা ওড়নাও নিত না। বুকের লজ্জা ওরা শক্ত কাপড়ের এক নীমা বানিয়ে পরে চেপে রাখতো।ফলে বয়স বারো কি তের,আর আমরা তিন চার জন মেয়ে। মা কি দাদি-নানি।আরবি পড়ানোর মৌলবী সাহেবতো ছিলেন।বকবক করার জন্যে, এই তোরা ঘোমটা দিস না কেন? মাথার চুল দেখা গেলে শেরেকি গুনাহ। দোজখে যাবি।দুপুরে যোহরের নামাজ পড়েছিস? এদিকে আরবি ক্লাসে তিনি টেবিলে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুম,পড়া দাগিয়ে দিয়েই তিনি দায়িত্ব শেষ করতেন। পরীক্ষার জন্যে প্রশ্ন দিতেন বেছে বেছে যেন যা পড়া দিয়েছেন আমরা তার সবটা পড়ে মুখস্ত রাখি। নম্বরও দিতেন কিপটেমি করে।ওদিকে পণ্ডিত মশায় ছিলেন দিলখোলা আর হাত খোলা শিক্ষক,হিন্দু মেয়েরা সংস্কৃতে নব্বই,আশি পেয়ে যায়। আমাদের ষাটের উপরে নম্বর উঠতো না, ক্লাসে প্লেস পাওয়া নিয়ে আমরা মুসলমান ছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম একথা তাকে বোঝাতেই পারতাম না। সারা স্কুলে মাত্র ছয় কি সাত জন মুসলিম ছাত্রী,তাদের আরবি ক্লাস নেয়ার জন্যে মৌলবী সাহেব আসেন পার্টটাইম। তার নামে বলবো কি, মনে করতাম তিনি তো দয়া করে আসেন। নিজেদের পড়া কিভাবে ভাল করতে পারি সবাই চেষ্টা করতাম।

আমাদের সকলের বাসায় সেকালে জায়গির মাস্টার থাকতো,জেলা স্কুলের সেরা ছাত্রটি ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশের বাড়ির পাশে কোন বাড়ির ছিল। মেধাবী বলে বাবা তাকে ঘরে রেখেছিলেন। তার থেকে শিখে নিয়ে মাস্টার হওয়ার দায়িত্ব আমাকে চাপিয়ে দিল স্কুলের প্রায় সব মুসলিম ছাত্রীরা। আমি সেভেনে পড়লে কি, মা আমাকে বড় হয়েছি এই সুবাদে মাস্টারের কাছে পড়তে যেতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন, একথা অন্যদের কাছে বলতে লজ্জা হচ্ছিল। নিজের দায়িত্ব কিন্তু বুদ্ধি খাটিয়ে বেশ চালিয়ে নিয়েছিলাম। ছোটবোন আর ভাই সকাল-বিকাল মাস্টার সাহেবের ঘরে পড়তে যেত। ভাবলাম এ সুযোগটা নিতে হবে। কিন্তু নুরজাহান ছোট হলে কি হবে, বুদ্ধি , টনটনে, সহজে আমার পড়ায় এগিয়ে আসবে না। দুবোনে কমপিটিশনও ছিল, কে বেশি ভাল পড়ালেখায় এরকম। ওর ম্যাপ এঁকে দেয়া, বিজ্ঞান ক্লাসের গাছ, লতা-পাতার ছবি এঁকে দেয়া এ জাতীয় কাজগুলো ও বলার আগেই করে দিতাম আর বলতাম, বড় হওয়া একটুও ভাল না, তুই ছোট হয়েছিস খুব ভাল, আমি মাস্টারের কাছে পড়তে যেতে পারি না, তাইতো পড়ায় ক্ষতি হচ্ছে আমার, তুই মাস্টার সাহেব থেকে আমার আরবি ভাষার পড়াগুলো লিখিয়ে আনবি। আমি তোকে কত ভালবাসি। দিবি? তোর স্কুলের সেলাইও আমি করে দেব, তুই ফার্স্ট হবিএবার। এমনি অনেক প্রলোভনের কথা বলতাম। কাজটি ও ভালই করতো এবং আমিও স্কুলে আরবি মাস্টার হতে পেরেছিলাম।

স্কুল বসার আগে একটা প্রার্থনা সঙ্গীত ছিল যাতে শেষে ‘ওঁ দেবায়ে নমঃ’ বলতে হতো। আমরাও বলে যেতাম সবার সঙ্গে। কিন্তু মহব্বতপুর মাদ্রাসা থেকে সেভেনে ভর্তি হয়েছিল সুফিয়া। ও সর্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিত এবং আমরা দিতাম না বলে ঝগড়া করতো। এই প্রার্থনা সঙ্গীতে ও আমাদের পড়তে মানা করে, বলে মুসলমানদের কি দেব-দেবী আছে? কাকে নমঃ করিস তোরা? ধর্ম নষ্ট করলে কবরে তোদের জায়গা হবে না, সোজা চলে যাবি দোজখে। সুফিয়া এমন ভয় পাইয়ে দিল যে, আমরা আর লাইনে যেতাম না। বড়দি সৌদামিনী চৌধুরী কড়া মহিলা। এসে ধরলেন, ব্যাপারটি জানিয়ে দিল ক্লাস এইটের ছাত্রী মনা। আশ্চর্য বড়দি হেসে দিলেন, বললেন আমারই ভুল। তোমরা সংশোধন করে দিলে। স্কুলে প্রার্থনা সঙ্গীত না গাইলেই বরং ভাল, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং ডি.এল. রায়ের গান ঠিক করে দেয়ার জন্যে বড় ক্লাসের মেয়েদের নিয়ে একটা কমিটি করে দেব। তিনি এ বিষয়ে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, স্কুল আমাদের কাছে পবিত্র স্থান। বিদ্যার উপাসনা এখানে চলে। গানের কথাগুলো সেরকম হওয়া চাই . . . ঠিক আছে। এরপর আমাদের স্কুলের প্রারম্ভিক সঙ্গীত হিসাবে আমরা গাইতাম-

‘তুমি নির্মল কর, উজ্জ্বল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে …
(২) হও ধর্মেতে ধীর, হও কর্মেতে বীর, হও উন্নত শির নাহি ভয় …।

স্কুলে যেতাম ঘোড়ায় টানা পাল্কি গাড়ি করে। কোচোয়ান ছিল বোঁচা মিঞা নামে, আসলে দেখতে সে বুঝি লাট বাহাদুর, আর তার ঘোড়া দুটো তার সাগরেদ। আমরা বন্ধ গাড়ির ভিতর কয়েকজন নিরীহ প্রাণী ওর দয়ায় স্কুলে যেতে পারছি। স্কুল বসতো দশটায়, আমরা তৈরি থাকতাম নয়টায় কিন্তু আমাদের সময়মতো স্কুলে হাজির করা বোঁচা মিঞার এবং ওর ঘোড়া দুটোর মর্জিমাফিক। দশটার গাড়ি বারটার মতন। এক একদিন ইচ্ছে হতো যে যা বলুক, আমি হেঁটে রওয়ানা দেব, কিন্তু কোনদিন যাইনি, পাড়াটায় গায়ে গায়ে বাড়ি ঘর, উকিল সাহেবের মেয়ে বেপর্দা হয়ে রাস্তায়, পায়ে হেঁটে কোথায় যায়। পথ ছিল পুরুষের, একটি মেয়ে, এমন কি ভিখারিনীও সে সময় দিনে পথে হাঁটতো না (বোষ্টোমীদের গ্রামে দেখতাম।

অন্য একটি মজার চিন্তাও মাথায় ভর করতো। কাজটা করতেন আমার ছোট ফুফু। তার থেকে আইডিয়া পেয়েছিলাম। বাবা কোর্টে চলে গেলে ফুফু বাবার আচকান, পায়জামা এবং জুতা-মোজা পরে, মাথায় টুপি দিয়ে ছাতাটি মেলে ধরে সামনের রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসতেন। বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ বেরিয়ে যেতেন। আমাদের হাসানোর জন্যে কি তিনি পুরুষ সাজতেন? নাকি মেয়েদের অবরোধ বাস থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ ছদ্মবেশ নিয়ে স্বাধীনতা উপলব্ধি করতেন?আমি কল্পনা করতাম, ইশ আমার ভাইটা বড় হবে কবে?

এই কোচম্যান ব্যাটার তোয়াক্কা না করে ওর পোশাক গায়ে চড়িয়ে স্কুলে হাজির হব। সেটি কল্পনায় থেকে যেত। আমার ভাই অনেক ছোট, আমার থেকে ছয় বছরের ছোট ছেলের পোশাক আমার গায়ে আঁটবে না। গাড়ির পেছনে এক বুড়ো দাড়িয়ে থাকতো। তার কাজ আমাদের বাড়ির দরজায় হাঁক দেয়া, দিদি গাড়ি দাঁড়াই রইছে জলদি আইয়েন। এক দৌঁড়ে মাথা ঢেকে গাড়িতে উঠে যেতাম। সবাই এমনই করেছি আমরা।

ঘোড়া ঠিকমতো গাড়ি টানলে বোঁচা মিঞা গান ধরে, হিন্দি গান। কখনো মুখে খারাপ খিস্তি ঘোড়া বসে গেলে। মেরা বিবিজান গোস্বা কেঁউ, চানা নেই মিলা চুম্পা নেহি মিলা … আযাও মেরা জান .. . ইত্যাদি সোহাগের কথাও সে বলতো। ঘোড়া দুটো আসলে রুগ্ন অচল হয়ে পড়েছিল, সে গাড়ি কিনেছিল যখন অবস্থা তার এবং ঘোড়াদের উভয়েরই তেজি ছিল। শুনেছি ওর বৌ মরে যাওয়ার পর ও মদ-তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকে, ঘোড়ার যত্ন নেয় না। সওয়ারীও ঠিকমত নেয় না কি পায় না—সে কেয়ার করে না। স্কুলের কাজটা নিয়েছে বাধা বেতন আছে তাই। আমরা মাসে দু টাকা করে দিতাম, পরে তিন টাকা। স্কুলের বেতন বোধ করি ক্লাস সেভেনে এক টাকা ছিল। টিফিন ছিল চার আনা। চিড়া দই, কি সাবু দানা ভেজান নারকেল চিনিসহ অথবা মুড়ি মাখা এসব টিফিন খেতাম। সিঙ্গারা অথবা লুচি তরকারি মাসে দু’মাসে একবার খেতে পেতাম। বাইরের খাওয়ার মধ্যে চীনে বাদাম বিক্রি করতো একজন পিয়ন। এই ছিল টিফিন। বাড়ি ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে যেত। গাড়ি না এলে স্কুলে যাওয়া আর হতো না। মনের অবস্থা হয়ে যেত কয়েক টুকরা ভাঙ্গা কাঁচ, সারাদিন শরীরে বিঁধতো আর কষ্ট দিত। কোনদিন উপোষ দিয়ে গল্প লিখতে বসে যেতাম। শরৎচন্দ্রের ছোট ছোট উপন্যাস আগেই পড়া ধরেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি ছোটগল্পের আমাদের বাংলা দ্রুত পঠন বই ছিল। রাধারাণী রথের মেলায় ফুলের মালা বিক্রি করতে গিয়ে বিফল হয়ে ফিরে আসছিল, তখন যে রোমান্টিক কাণ্ড ঘটে, সে রকম একটা গল্প লেখার ইচ্ছা নিয়ে রাতের পর রাত জেগেছিলাম।

মনের মতো হতো না, আর কাগজ ছিড়ে স্তুপ বানিয়ে ফেলতাম। একদিন স্কুলে যেতে না পেরে তক্ষুণি বসে গেলাম লিখবোই। প্রেম ট্রেম হবে না আমাকে দিয়ে, স্কুল নিয়েই লিখলাম। ছেলেদের পোশাক পরে একটি তের বছরের মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কেউ তাকে লক্ষ্য করছিল না। হঠাৎ ধরা পড়ে গেল রাজ প্রহরীর হাতে। ( ভোর রাতে উঠে এক দিন কোর্ট বাগানে ফুল চুরি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে পড়েছিলাম, সেই ঘটনা)। সে রাজার সামনে হাজির করলো সুন্দরী ত্রয়োদশীকে বালকের পোশাকে। রাজা ফুলের তোড়া দিয়ে মেয়েটিকে তার দুঃসাহসের পুরস্কার দিলেন, কিন্তু দেশাচার না মানার অপরাধে তাকে বনে পাঠিয়ে দিলেন। ক্ষিদেতে কাতর মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ে এবং স্বপ্ন দেখে সে কোন এক রাজ্যে চলে গিয়েছে। সবাই এক রকমের পোশাক পরেছে, ছেলেমেয়ে বলে কোনো তফাত নেই। তার ভীষণ ভাল লাগলো, এদেশ ছেড়ে সে নিজের দেশে আর আসবে না। এদিকে বাঘের গর্জনে সে জেগে গেল,পালাবার পথ না পেয়ে বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বনের মধ্যে সুখে বসবাস করতে লাগলো।

গল্পটি মনে থাকার কারণ ছিল। খেয়ালের বশে লিখেছিলাম এবং বাবা কোর্ট থেকে যেমন অন্যদিন আমাদের দু’বোনকে ডাকেন, পড়া-স্কুল নিয়ে জানতে চান, সেদিনও তেমন ডেকেছিলেন। আমি স্কুলে যাইনি এই গল্প লিখেছি। পড়বেন আব্বা? তিনি গায়ের গাউনটিও তখন পর্যন্ত খোলেননি, তিন পৃষ্ঠার গল্পটি হাতে নিলেন এবং পড়ে গেলেন। পড়া শেষে ফেরত দিলেন। বললেন, এরকম গল্প লিখবেন না আম্মা। এতো আদেশ নয়, কেমন কষ্ট জড়িয়ে বলা! কি এমন লিখলাম যে বাবা দুঃখ পেলেন। আমি তৎক্ষণাত গল্পটি ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। নিজের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। তারপর কয়েকদিন অতিবাহিত, বাবা কৈফিয়তের মতো করে বলেছিলেন, গল্পটা খুব ভাল হয়েছে, আমার । শেষটুকু পছন্দ হয়নি, কষ্ট লাগছিল।

গাড়ি আসতো না, স্কুলে প্রায়ই যাওয়া হতো না। যাতায়াতের অন্য ব্যবস্থাও করা যায়নি। মনে হতো স্কুলের কি আর আসে যায়, গুটিকয় মুসলমান মেয়ে না গেলেও স্কুল ঠিকই চলবে। স্কুল কমিটিতে সদস্য

ছিলেন বাবা এবং ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন সেক্রেটারি। তার হাজার কাজ ফেলে স্কুলের ঘোড়ার গাড়ি নিয়মমত আসে না, এ নিয়ে ব্যস্ত হতেন না তিনি, তার মেয়েরও স্কুল যাওয়া হল না। তখন এক অভিনব শব্দ একদিন ঘটনাচক্রে শুনে ফেলি। আমার মায়ের ছোট মামা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মায়ের শরীর প্রায় অসুস্থ থাকতো। সেজন্যে তিনিও ফেনী থেকে কোন মামলার উপলক্ষ নিয়ে নোয়াখালী আসতেন। ভাগনিকে চিকিৎসা দিতেন। তার মুখ থেকে শুনলাম, ভাগনিকে বলছেন। তোর মেয়ে বালেগা হয়েছে, দেখতে লাগে সেরকম, ওর বিয়ের কথা ভাবছিস? শুনেই রান্নাঘরে বুয়ার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “বালেগা’ শব্দের অর্থ কি? বুয়া পানের খিলি মুখের মধ্যে নেড়েচেড়ে বলে—মাসিক আননে সেয়ান অইছেন (আপনি বড় হয়েছেন)। তারপর বললো, দু মাস আগে আমায় নিয়ে মা কি করলেন, সে সকল কথা সাতদিন পর গোছল দিয়ে নতুন কাপড় পরিয়েছেন। সিথানে লোহা-আগুন-কয়লা কত কি রেখে আপদ বালাই ঘরে ঢুকতে দেননি। মাছ-মাংস খেতে দেননি। দুধ, কলা, সবজি, ভাত খাইয়েছেন। ঐ সাতদিন ঘরের মধ্যে থাকতে হয়েছিল, সূর্যের আলো গায়ে লাগতে দেননি। আমি রাগ করেছি কি ভয়ে কেঁদেছি, তখন সান্ত্বনা দিয়েছেন, মেয়েদের শরীরের উপর আরও কত জ্বালা আসে, আল্লাহর পেয়ারা বান্দা নারী যেমন তিনি ভালবাসেন, তেমন কষ্ট দেন। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, এর মহিমা বুঝবার ক্ষমতা মানুষের নেই। কাঁদবি না, ভাল হয়ে যাবি। মেয়েরা যে দুনিয়ায় সংসার। বাড়ায়।

একে একে মায়ের কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছিলাম। বুয়া বললো সেয়ান হয়েছি। বুক কেঁপে উঠলো। গাড়ি না এলে স্কুলে যেতে পারি না। আল্লাহ সেও তো ভাল। এখন বিয়ে দেবে আমাকে চিরকালের জন্যে স্কুল শেষ। ডাক্তার নানা ফর্দের মত করে লম্বা এক লিস্ট তার জোব্বার পকেটে রেখে দিলেন। বিয়ের জন্যে পাত্র চাই তেমন নাম ঠিকানা ইত্যাদিতে ভর্তি। মা বলেছিলেন, মামা, শহরের বাড়িটা ছোট, কয়েকদিন চুপ থাকেন। নতুন ঘরবাড়ি তুলতে দেন আপনার জামাইকে, তারপর দেখা যাবে। বাবার কানেও কথাটি গেল। তিনি বললেন, আরও দেখেন মামা, আমার ঘরে একটা মেয়ে বড় হয়েছে। স্কুলে যায়, বিয়ের জন্যে আমার কাছেও নানান পাত্রের খোঁজ আসে, আরও দেখি।

বাবার বাক্যগুলো বুঝি সাত সমুদ্রের পানি বয়ে এনে দিল। আমি স্নান করে শীতল হয়ে গেলাম, এমন লাগছিল। তবে নানার ঐ লিস্ট চুরি করে রেখে দিই। যেদিন স্কুলে গেলাম সাথে নিয়ে যাই, বান্ধবীদের দেখাই আর বলি, তোদের জন্যে বরের এত লম্বা লিস্ট লাগে? আমার এসেছে, কিন্তু বাবার একজনও পছন্দ হলো না। ছবির মুখে তক্ষুণি সুকুমার রায়ের ছড়া, গঙ্গারামটি পাত্র ভাল-যদিও দেখতে বেজায় কাল’, চিনু মুখ বাড়িয়ে বললো, তোরই কপাল ভাই রওশন, না চাহিতে তারে পাওয়া যায় … আমাদের কপালে ঢু ঢু, উপরে এখনও দু বড় বোন লটকে আছে, ওরা নামবে কবে হায় রাম!

সবাই তোরা এত ডেপো হলি কী করে? বাবু শরৎচন্দ্র মাথাটি খেয়েছে? সবে ক্লাস এইট। হয়ে গেলি স্বর্ণের গেইট।

আমার নতুন বান্ধবী পামেলা। ওর বাবা ডিস্ট্রিক্ট জজ। নতুন এসেছে। কলকাতায় থাকতো ওরা। আমাদের দুষ্টু দুষ্ট স্বভাব ওকেও ধরে গেল। কলকাতা আর দিল্লির গল্প শোনাতো আমাকে। একদিন বললো,জানিস, কল্পনা দত্ত, সুজাতা কৃপানলি, অরুণা আসফ আলী নোয়াখালী এসেছেন। এরা কংগ্রেসের নামকরা মহিলা। দেবালয়ে বক্তৃতা দেবেন আজ। টিফিনের সময় আমরা স্কুল পালাবো। পুকুর ঘাটের বাঁশের বেড়া ভাঙ্গা দেখে রেখেছি। আমি ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। প্রথম সারিতে বসে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম, এরা এত সুন্দর কথা বলছেন। মেয়েদের জাগার কথা বলছেন। বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে স্কুলে ফিরে এলাম। সুন্দর নামগুলো বার বার উচ্চারণ করছিলাম। কথাগুলোও সুন্দর।

আমার উপর ঝড় বয়ে গেল

ও, মুসলমান হলে কী হয়? আমার কপালে কিছু লেখা আছে? ওরা গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝলাম ওরা আমাকে ঐ একটি কারণেই দলে নেবে না। কিন্তু আমি কি আর রাগ করে থাকতে পারি! দলের একটি মেয়ে কাছে টেনে আদর করে বললো, রাগ করলে কেন! আমরা তামাকে তো প্রশংসা করেছি। মুসলমান মেয়েদেরকে এত সাহস করতে কখনও দেখিনি। তুমি আমাদের মত পর্দা কর না। দিব্বি চিনুর সঙ্গে ছেলেদের স্কুলে চলে এসেছ, খুব ভাল।

উনিশশো একচল্লিশ সন শুরু হল। বাবার পেশায় যেমন প্রসার, রাজনীতিতেও তেমন প্রচার বেড়েছে। শহরের থাকার ঘরটি ভেঙে বড় এবং মানানসই না করলে নয়। নোয়াখালী সদরে ঐ সময় পাকাবাড়ি তৈরির কথা কেউ চিন্তা করতো না, কখন নদী এসে গ্রাস করে নেবে, এই ভয় ছিল। পাকা ভিটের উপর টিনের বাঙলো প্যাটার্নের বাড়ি তোলার কাজে বাবা হাত দিলেন। আগের ঘরটি সরিয়ে রান্নাঘরের সঙ্গে তুলে দিয়েছেন। ঘরে আমাদের দুই খালাকে মা নিয়ে এসেছেন, তাঁর সুন্দরী দর্পহারিণী মা আকস্মাৎ ঘুরে পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান এবং ছয়মাস ভুগে মারা যান। শোকে মুহ্যমান মায়ের তিন বোন কিছুকাল একত্রে কাটাবেন। মামা তখন সংসার পেতেছেন, নানাজি বাড়িতে তাদের সঙ্গেই থাকলেন। সান্ত্বনা দেয়া কিংবা নিজস্ব অন্য কাজেই হোক, মায়ের সেই হোমিওপ্যাথ মামা ওরফে আমাদের ডাক্তার নানা ঘন ঘন আসা-যাওয়া করছিলেন। ভাগনীদের ওষুধপত্র তার চিকিৎসাতেই চলতো। উনি এলে ঘরের সকলেই খুশি হতেন। আমরা দু’বোন অবশ্য পছন্দ করতাম না। ধর্মের কথা বেশি বললে সে লোককে আমার ভাল লাগে না। কোনো মতলববাজ মনে হয়। আমাদের মা এমনিতেই অতি ধর্মপরায়ণা, ধর্মের ভয়ে তিনি একবারে নয় কয়েকবার অজু বানান, পাছে অজু ঠিক মতন না হয়, তাহলে নামাজ পড়াও আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। উনি এই মাকে ধর্ম শেখাতে আসেন? মনে করতাম স্বার্থ একটা তার আছে। আসলে তার স্বার্থও ধর্ম বিশ্বাসের উপর গড়ে উঠেছে। তার পোশাক একদম পীর-দরবেশের মতো। শাদা জোব্বা গায়ে, পায়ের উপরে ওঠানো পায়জামা, মাথায় শাদা পাগড়ি, দেখলে ভয়ে লুকিয়ে থাকতাম। আর উনি এসেই খোঁজ নেবেন, ভাগনী তোমার বড় মেয়েটি বেশ ডাগর হয়েছে, ওর বিয়ে-শাদীর কিছু ঠিক করেছ? একটা সৎপাত্রে কন্যা দান করলে হাজার রাতের এবাদৎ হয়; আর না দিলে তুমি গুনাহগার। ভাগনী আমার সন্ধানে একটি সৎপাত্র আছে। আমাদের আত্মীয়, দূর সম্পর্কের। মা তার জন্য ভালমন্দ রান্না করতেন এবং সুস্বাদু খাদ্য নিঃশেষ করতেন নানা, এসব কথা বলার মধ্য দিয়ে।

ধর্মের ভয় তো আমাদের আছেই। আরবি পড়া শুরু করি আমরা অ-আ-ক-খ পড়া ধরার আগে। প্রতিদিন ভোরে কোরান তেলওয়াৎ করতাম। বাংলা ও ইংরেজি তরজমাসহ বিরাট আকারের কোরান শরীফ প্রতিদিন একবার নিয়ে বসতাম এবং আলমারির উপরে তুলে রাখতাম চুমু খেয়ে। নানার কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন উঠে আবার নিভে যেত। আমার কারণে মা-বাবা গুনাহগার হবেন। ভাবতে গিয়ে দুঃখ পেতাম। আমার মায়ের ধর্ম ভয় এদিকে তার সন্তানকে গ্রাস করছে। মা একদিন বাবাকে অনুনয় করে বলেন, আপনার সময় হয় না, কোনোদিক দেখতেও পারেন না। ডাক্তার মামা এদিকে আমাকে ধর্মের দোহাই দিচ্ছেন। মেয়েটার বিয়ে দেয়া দরকার। পড়ালেখার জন্য বিয়েতো আটকিয়ে রাখা না জায়েজ-গুনাহর কাজ। পাত্রের খোঁজ-খবর তাঁর কাছে আছে, আমরা গুনাহগারী হই কেন তাহলে? সে সময় মেঝেতে পাটি পেতে খাওয়া দেয়া হতো। একখানা পাখা হাতে নিয়ে শীত-গ্রীষ্ম মাকে দেখতাম সামনে উঁচু পিড়িতে বসে সংসারের নানান কথা বাবাকে বলে যেতেন। গরম ভাত-তরকারি ঠাণ্ডা করা এবং পোকা-মাকড় এবং মশা-মাছি তাড়াতে সেকালে হাত পাখা কাজ দিত। রান্না স্বাদের হয়েছে অনেক খেয়ে নিলাম, এ জাতীয় কথা বাবা কোনোদিন উচ্ছাস নিয়ে বলতেন না, মায়েরও এসব নিয়ে কোনো মান-অভিমান হতো কিনা কোনোদিন জিজ্ঞেসও করেননি। দু’বেলা বাবাকে নাগালের মধ্যে পেয়ে মা কেবল আমাদের কথা বলে যেতেন। সংসারে মেয়ে বড় হতে থাকলে মায়েদের চোখে ঘুম থাকে, না। প্রায়ই এ কথা মাকে বলতে শুনেছি। এদিকে নানা দিব্বি সুযোগ বুঝে ভাগনীকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবিয়ে দিচ্ছেন। ঘটকালি তিনি করেন না, সোমত্ত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তারও সওয়াব হবে। আল্লাহ খুশি থাকলে আরও কত কি পাওয়া যায়, আল্লাহ মাবুদ জানে… ঠিক এভাবের কথাগুলো তিনি বলতেন।

বাবা খাওয়া শেষ করে চিলমচিতে হাত ধুয়ে কুলকুচো করলেন। জলগামছা মা এগিয়ে দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কি আপনি গুনাহগার করতে চান; ডাক্তার মামার সন্ধানে একটি পরহেজগার ছেলে আছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দেখতেও সুন্দর। শিক্ষিত ছেলে বি. এ. পাস করে ওকালতি পড়ছে।

‘দেখতে বলবেন’ পানের খিলি মায়ের হাত থেকে নিয়ে কথা কয়টি বলে বাবা ফের বৈঠকখানা ঘরে চলে যান। আমার ভীষণ অভিমান হল বাবার ওপর। তাঁকে অন্যরকম মনে হতো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে বেহেস্ত পাওয়ার লোভ অন্তত তাঁকে পেয়ে বসবে না, এই ভেবেছিলাম । তাহলে আমার পক্ষে আর কেউ রইলো না? আমার দুই খালা আমার থেকে বয়সে বেশ বড়, তাদের বিয়ে তখনও হয়নি। সেজন্য নানা এবং নানী দুজনেই কি পাপ করেছেন; নানীমা কি বেহেস্তের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকছেন? এই নানা নিজের একমাত্র বোন (আমার নানীমা)। এবং ভগ্নিপতির বেহেস্তে যাওয়ার কথা কেন বলেননি, এখনও বলেন না, এদিকে আমার পেছনে উঠে পড়ে লেগেছেন। এবার আসুক, সামনে এসে তাকে এ সকল কথার কৈফিয়ৎ চাইব। আমি কেন ওনার শত্রু হলাম? স্কুলে যাই বলে? কিন্তু আমি তো পর্দা করেই স্কুলে যাচ্ছি। বাবার কাছে কোন নালিশ কেউ করেনি—উকিল সাব, আপনার মেয়ে। নিন্দার কাজ করছে! উনি কেন আমার সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মাকে ‘বয়স হলে মেয়ে বিয়ে না দিলে পাপ’ এসব কথা শুনিয়ে শুনিয়ে দুর্বল বানিয়ে দিচ্ছেন! কিন্তু একজন যা খুশি বলবে, মা নিজের ধর্মজ্ঞান এবং শিক্ষা দিয়ে কেন বিচার করছেন না! তিনি যে অনেক সাহসী, বাবার মান রক্ষার জন্য নিজের শাড়ি-গহনা হেলায়-ফেলায় তুলে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের হাতে। আমাদের লেখাপড়ার জন্য গ্রামের দালানকোঠা ফেলে শহরের ছোট কুঁড়েঘরে বাস করতেও কষ্ট গায়ে তোলেননি। তাঁকে আরেকজন ধর্মের কথা বলে দুর্বল করে দিচ্ছে, ভাবতে দুঃখ লাগছিল। সে রাতে ভাত খেলাম না, বই-এর পাতা উল্টালাম না। সারারাত ঘুমাতে গেলাম না, ঠায় পড়ার টেবিলে বসে কাটিয়ে দিলাম। শেষে দোষ চাপিয়ে দিলাম ঐ সুন্দরী অহংকারী গত হয়ে যাওয়া নানীমাকে। নয় বছর না হতে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে এতই পুণ্য করলেন যে, পরের দুটো মেয়ের বিয়ের কথা ভুলে চলে গেলেন। আমার মা তার মায়ের মত না হয়ে আর হবেন কেমন। প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি এই বেড়া ডিঙিয়ে অবশ্যই যাব। আমার নানী যা করেছেন, মা যা করছেন-আমি কখনও তা করবো না।

স্কুলের গাড়ি ঠিকমতো আসে না, ঘরে থেকে পড়তে চেষ্টা করি। ক্লাস এইটের ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠ্য তালিকায় ছিল নামকরা লেখকদের গল্প-উপন্যাস-নাটক। আমার বান্ধবী ছবি এবং চিন্ময়ী, ওদের সাথে কলকাতার মেয়ে পামেলা। সাহিত্য নিয়ে ওদের ঘরে যা আলোচনা হতো, স্কুলে দিদিরা যা বলতেন, আমি শুনে শুনে সাহিত্যের দিকে মনোযোগী হয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পের বই ‘গল্পগুচ্ছ’ সব সময় হাতে নিয়ে ঘুরতাম, পারলে মুখস্ত করে নিয়েছি। প্রমথ চৌধুরীর ভাষা মনে হতো এত সহজ, এত মধুর, সে রকম লেখার চেষ্টাও করতাম। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো রাত জেগে পড়ে শেষ করতাম। ইংরেজি ছিল তিন পেপার। কত পড়তে হতো! শেক্সপিয়ার, চার্লস ডিকেন্স এদের লেখা বেশি ছিল সিলেবাসে। চিন্ময়ী মাঝে মাঝে স্কুল থেকে উধাও হতো। ওকে ক্লাসে না দেখলে দিদিরা আমাদের ধরতেন, ও কোথায় গেছে। আমরা জানতাম ও কল্যাণ স্কুলে যেত, সেখানে ওদের একটা সংগঠন আছে, রাজনীতি নিয়ে বেশি আলোচনা হতো। ঐ স্কুলটি একটি কাঠের নড়বড়ে দোতলা বাড়ি। কিন্তু শিক্ষকদের খুব নাম। হিন্দুরা অনেকেই ইচ্ছা করে ঐ স্কুলে পড়তো। ওদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরাধী মনোভাব কথা বললেই বাঝা যেত। আমিও একদিন স্কুলের ক্লাস থেকে চিনুর সঙ্গে পালিয়ে কল্যাণ স্কুলে উপস্থিত হই। ওখানকার মেয়েরা নতুন মেয়ে দেখে যেমন আদর করলো, তেমনি প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করে জানতে চাইলো, সত্যি কি আমি ওদের দলে কাজ করতে পারবো কিনা। একসময় বললো, ওমা! তুমি মুসলমান, দেখে কিন্তু একটুও বুঝতে পারিনি।

ও মুসলমান হলে কী হয়? আমার কপালে কিছু লেখা আছে? ওরা গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝলাম ওরা আমাকে ঐ একটি কারণেই দলে নেবে না। কিন্তু আমি কি আর রাগ করে থাকতে পারি! দলের একটি মেয়ে কাছে টেনে আদর করে বললো, রাগ করলে কেন! আমরা তামাকে তো প্রশংসা করেছি। মুসলমান মেয়েদেরকে এত সাহস করতে কখনও দেখিনি। তুমি আমাদের মত পর্দা কর না। দিব্বি চিনুর সঙ্গে ছেলেদের স্কুলে চলে এসেছ, খুব ভাল।

ও এখন কেউ চিনতে পারবে না তাই চলে এলাম। বাসা থেকে আসার। সময় পর্দা না করে আসা যায় না, সবাই চিনতে পারবে। উকিল সায়েদুল হক সাহেব মেয়েটাকে বেপর্দা বানাচ্ছে, স্কুলে পাঠিয়ে বেদীন বানাচ্ছে-বাবাকে এসব কথা শোনাতে চাই না। শেষে আমার স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেলে আমারই সর্বনাশ। স্কুলে আসতে পারি বলে কত লাভ, আপনাদের সাথে দেখা করতে আসলাম।

কল্পনাদি বোধ করি পড়ুয়া ছিলেন। চট করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবরোধবাসিনী’ পড়েছ? বেগম রোকেয়া এক স্কুল দিয়ে টের পেয়েছিলেন, মুসলমান সমাজে কত কুসংস্কার রয়েছে। সাংঘাতিক স্পষ্টবাদী লেখিকা, বিদ্রোহের কলম ধরেছিলেন তিনি। আমার কাছে আছে, তোমাকে পড়তে দেব। আরেকদিন এসে নিয়ে যেও।

দুঃখের বিষয় ঐ একদিন শেষ যাওয়া। স্যার আশুতোষ মুখার্জী এসেছিলেন সে সময় নোয়াখালীতে, কল্পনাদিরা আমাকে যেতে খবর পাঠাল। চিনু অনেক টানাটানি করলো। সেদিন স্কুল পালান কি কারণে যেন হয়নি। তবে জন্মের পর থেকে তেরটি বছর যে সমাজের অনুশাসনে বড় হয়েছিলাম, তার বেড়া ডিঙাতে গিয়ে অন্য কিছু ভেবেও থাকতে পারি-কি জানি। ঘরের পরিবেশ ক্রমশ আমার জন্য কঠিন শৃঙ্খলের মত মনে হচ্ছিল। নতুন ঘর প্রায় তৈরি, এবং মায়ের শরীর খুবই খারাপ। খালারা দুজন তার সেবায় থাকলেও আমি না থাকলে মা বকাবকি করতেন। স্কুল প্রায় কামাই দিতে হতো সেজন্য। নয় মাস পূর্তির আগেই মায়ের প্রসব বেদনা উপস্থিত। জমে-মানুষে টানাটানি করে অবশেষে মা এবং নবজাত ভাইটি দুজনেই বেঁচে গেল। তখন খ্রিস্টান ধাই মা আনা হয়েছিল। মুসলমান ধাই না হলে মা মরে যাবেন, তাও ভাল। কিন্তু হিন্দু কি খ্রিস্টানের হাতে তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবেএকথা ভাবতে পারতেন না। ইসলামে আছে জীবন বাঁচানো ফরজ। অবশেষে এই কথার দোহাই পেড়ে মৌলবী ডেকে তাকে তওবা পড়িয়ে রাজি করাতে হয়েছিল। ঐ সময় আমি অবরোধবাসিনী পড়েছিলাম, কুসংস্কারের কারণে অযথা মৃত্যুর মুখোমুখি হই আমরা সত্য কথা। আমার মা শিক্ষিতা বাবা উচ্চ শিক্ষিত, শিক্ষিত পরিবেশে আমরা বড় হচ্ছি। এত সব অনুকূল পরিবেশ কোন কাজে আসে না? সমাজের মধ্যে এবং অধিকাংশ অশিক্ষা ও কুসংস্কার আঁকড়ে ধরে থাকে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই? সবাই বলছিল মাযের হায়াত ছিল বলে বেঁচেছেন, নইলে বাঁচার মত অবস্থা ছিল না। শরীরে খিচুনি দেখা দেয়া ভাল নয়। আমি ভাই পেয়ে মহাখুশি, ওর নাম তক্ষুনি দিলাম পিন্টু। এ ছিল আমার গোপন সাধ। বান্ধবী ছবি সর্বক্ষণ পিন্টুদার গল্প করতো আমাদের সঙ্গে। কলকাতার যাদবপুরে পড়ে, ভীষণ ভাল ছাত্র আর দেখতে অপূর্ব। অবশ্য এ কথা কাউকে বলিনি, আমার দেয়া ডাক নাম সবার পছন্দ হয়ে গেল। ‘নামে কিবা আসে যায়’-এ কিন্তু সে রকম কথা নয়। আমি নিজের ইচ্ছা ভাই-এর মধ্যে দেখতে চেয়েছি। ও ছেলে, আমার মতো বন্দিজীবন নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যত ওর জন্য নয়। তবে ওর জন্য উচ্চাকাঙ্খা করবো না কেন! বড় ভাই বাটুকে নিয়ে তখন আমরা চিন্তিত। স্বাস্থ্য ভাল যায় না, পড়বে কী। বন্ধুদের নিয়ে খেলে বেড়ায়। মাথায় এক ঝাকড়া কাল চুল নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট ভাই পিন্টু আমাদের মনে আনন্দের জোয়ার এনে দিল। আমরা সাত দিনের মধ্যে নতুন ঘরে উঠে এলাম।

নতুন ঘর তোলার পর একটা নতুন গুঞ্জন কানে এল। আমাকে দেখতে আসবে, আমাকে দুলাহর বড় বোন পছন্দ করলেই হল। বিয়ের তারিখ পড়ে যাবে। মায়ের শরীর সুস্থ হওয়ার আগে এত দূর অগ্রসর হওয়ার কারণ কি! আমি কি অরক্ষণীয়া! শরৎবাবুর উপন্যাস? মায়েরা তিন বোন আবেগ জড়িয়ে গলাগলি করে কাঁদেন দেখি, কারও কান্না দেখলে

এমন অস্থির লাগে কেন? আজও লাগে। তখন ঐ সময় চোখ ফাটিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছি। আমার বোনও কাঁদতো, পরে জানতে চাইতো- আপা, আমরা এ রকম কাঁদি কেন?ওর প্রশ্নের কি উত্তর দেব, আমি নিজেও যে জানি না। একদিন ছোট খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা একত্র হলে এমন কাঁদেন কেন?কান্না কি ভাল? তিনি জানালেন, খুশির কান্না; বড় বুকে আমরা ফিরে পাব, সে আশাতো ছিল না,কাঁদলে আল্লাহ খুশি হয়, বুবুর হায়াত বাড়বে। তোর জন্য সুন্দর দুলাহ আসবে।

 ও আমাকে তাড়িয়ে দেয়ার আগে ডাক্তার নানাকে বলেন, আপনাদের জন্য বিয়ের বর খুঁজতে। আমি স্কুলে যাই, লেখাপড়া বন্ধ করার জন্য উনি আমাকে তাড়াচ্ছেন। গুনাহ হলে আমার হবে, ওনার কি? উনি তো আপনাদের মামা, বলে দেবেন একথা ।

ছোট খালা কাঁদলেন। সবতো ঠিক, তোকে দেখতে আসবে। পছন্দও হবে। তোর বিয়ে হয়ে যাবে। তোর মত ভাগ্য সবার হয় না মা-মনি, বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি ঐতিহ্যবাহী ভুইঞাবাড়ির ছোট মেয়ের কথা বুঝতে পারলাম না। সান্ত্বনার কথা বলতে পারলাম না। উল্টো বলে দিলাম, মাকে বলা যাবে না। ভীষণ রাগী, বাবাকে বলতে পারবো, এমন সুপাত্রের জন্য আপনিই ঠিক খালা, দেখতে আসলে আপনাকে দেখিয়ে দেবেন। আপনি আমার চেয়ে সুন্দরী, পছন্দ হয়েই যাবে। আমরা আপনার বিয়েতে খুব মজা করবো। ছোট খালা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, তাহলে মেজখালার কি হবে, ওর আঠার বছর বয়স। গায়ের রঙও কাঁচা হলুদের মত।

এ সকল প্রাণের কথা আমরা নিজেরাই বলাবলি করেছি। এর বেশি বাইরে যাবার স্পর্ধা আমরা কোথায় পাব! স্কুলে যাওয়াকে যেখানে বেপর্দা হওয়া ধরা হয়, বাবা-মা এর জন্য গুনাহগার হয়, পরন্তু বিয়ে দিয়ে মুসলিম সমাজে অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার সম্মান পাওয়া যায়, আমরা সেখানে বাস করি। সুতরাং আমার স্থলে অন্য দিয়ে পূরণ হবার নয়। আমার জন্য কি সুপাত্রের অভাব হতো তখন? আমার বাবাতো দরিদ্র ছিলেন না যে, তার মেয়ে ভাতে-কাপড়ে কষ্ট করছে, বিয়ে দিলে তিনিও বাঁচলেন, মেয়েও বাঁচলো। একি আমাকে নিয়ে তার আযান দেয়ার মত কোন ঘটনার জের! মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলাম। জন্মের সময় সাবেহ-সাদেক, বাবাকে আযান দিতে হয়নি। মসজিদ থেকে আযান হয়েছিল সেই শুভ মুহূর্তে। এখনও কি সেই মুহূর্ত! তিনি যা করতে চান তা পারলেন না। কন্যার উঠতি বয়স, পড়ালেখা করায় বেপর্দা, সমাজের চাপে ও মন-মানসিকতায় তিনি সায় দিয়ে যাচ্ছেন কেবল?

মেয়ে দেখার আনুষ্ঠানিক পর্ব হিন্দু সমাজে যে রকম আবশ্যিক ছিল, সেকালে মুসলমানদের মধ্যে তদ্রুপ ছিল না। বংশ পরিচয়, বাড়ি-ঘর, আচার-আচরণ ইত্যাদি দেখে-শুনে অভিভাবকরাই বিয়ে ঠিক করতেন। যৌতুক দেয়ার তেমন প্রচলনও ছিল না, দেয়ার মধ্যে বিছানাপত্র, বাসন-কোসন ইত্যাদি, যা মেয়ের নতুন অবস্থায় ব্যবহারী জিনিস, তাতে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এটাও দেখতাম, আমার সাথে কয়েকজন মেয়ের বিয়ে হল, তাদের তুলে নেয়া হয়নি, আকদ করা হয়েছিল। জামাইকে পড়ার খরচ দেবেন শ্বশুর। জামাই পড়বে ডাক্তারি, নয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়া শেষ হলে শ্বশুর মেয়েকে জামাইয়ের কাছে যাওয়ার জন্য সম্মতি দেবেন। আমার ঐ সব খেলার সাথীরা কেউ ক্লাস থ্রি-ফোর অবধি পড়ে আর বিদ্যালয়মুখী হয়নি। তাদের বাবারাও উচ্চ শিক্ষিত উকিল-মোক্তার। জামাই পছন্দ করে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমাকে কেন বাবা দেখাতে রাজি হলেন? আমার মূল্য কি দিয়ে ধার্য হবে? যদি এমন হয় তবে বরের বড় বোন কেন, সে নিজেই আসুক! আমিও তাকে দেখে নিতাম। হিন্দু বান্ধবীদের মুখে শুনতাম, তাদের সমাজে কনে দেখতে আসে বর তার বন্ধু-বান্ধবসহকারে।

আমার মনের খোঁজ কে নেবে? তাদের মতে, মেয়েদের বিয়ে হওয়ার মত সৌভাগ্য আর কিসে? দুঃখ শুধু আমারই, বলার মানুষ নেই। স্কুলে যাই না। হিন্দু মেয়েরা মুসলমান পাড়ায় আসে না, ভয় পায়। দল বেঁধে প্যামেলা একদিন আমাদের বাসায় এল। আমাকে সাহস দিয়েও গেল, তোর কলকাতায় যাওয়ার পথ হল। অনেক সুন্দর আর অনেক বড় শহর হল কলকাতা। সেখানে তোকে নিয়ে গেলে তুই পড়বার জন্য বরের কাছে বায়না ধরবি। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে পড়বি। আরও মজা বরের সঙ্গে ইডেন গার্ডেনে ঘুরতে পারবি।, সেটা হল বড় জায়গা। কে পর্দা করলো, কে না করলে এ নিয়ে কেউ কথা বলতে আসে না। প্যামেলা জজ সাহেবের মেয়ে, কলকাতায় জন্ম। ওর কথাগুলো সুন্দর। আমাকে মুগ্ধ করে দিল। যেখানে অন্য উপায় নেই, সেখানে শান্ত মনে মেনে নিলে ভাল। ওরা সেদিন দুপুরে আমাদের বাসায় খেল। মুরগির কোর্মা, পোলাও, চিংড়ি মাছ ভাজা এসব। মায়ের দু বয়ম আমের আচারও শেষ করে গেল। ওরা আসাতে মা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার শুকনো মুখ আর ছলছল চোখ তাকেও কাঁদাতো আমি বুঝতাম।

নির্দিষ্ট দিনে আমাকে দেখাদেখির পর্ব হয়ে গেল। আসলে খাওয়ার ধূমধাম ছিল। খাওয়ার মধ্যে ভাল অংশ নিয়ে প্রশংসা যত না ছিল, তার চেয়ে ত্রুটি ধরা হল বেশি। চায়ের পেয়ালা মেইড-ইন-লন্ডন নয়, চা পাতা দার্জিলিঙের বাগানের নয় কেন। প্লেটে ঘি-এর আস্তর জমা হয়নি, এত কম ঘি ঢেলে রান্না কে খায়!

মহারানী ভিক্টোরিয়ার মত চেহারা এবং হীরে মুক্তায় সজ্জিতা মহিলাটি ভারিক্কি গলায় অনেক কিছু বলে শেষমেষ আমাকে ডাকলেন। খালারা রান্নাঘর নিয়ে ব্যস্ত। তাদের সামনে আসাও নিষেধ। ছোট বোনের হাত ধরে আমি চলে এলাম। আমাকে কেউ সাজিয়েও দেয়নি। মাকে খুব ক্লান্ত এবং গভীর দেখাচ্ছিল। শুধু গ্রাম থেকে আসা আমার ছোট ফুফু এসবে নির্বিকার। ছড়া কাটলেন, ‘মাইয়া অইলো ভূতের ছালা, ঠেলিঠেলি হুইত হালা (মেয়েছেলে ভূতের ছালা, ঠেলে ঠেলে পুকুরে ফেলা)। তার মুখে হাসি লেগে থাকতোসব সময়, এখনও সে রকম। ফুফুকে সেই মহারানী কাছে ডেকে বলেছিলেন, আপনার ভাইঝি পুকুরে পড়বে না, আমাদের দেখে কি সে রকম মনে হয়? ইতিমধ্যে আমার হাতে একখানা গিনির চাকতি দিয়ে আমাকে চলে যেতে বললেন তিনি। বরের বোনের দাপট থাকলে তো দেখাবেই … এতে মন খারাপ করবে কে! শুনলাম ভাগনীকে বোঝাচ্ছেন তার ডাক্তার মামা। তিনি বাবাকেও বুদ্ধি দিলেন। নতুন টি-সেট কেনার জন্য । কলকাতায় থাকে, বড় লোক, চোখ বড়, বেশি দেখতে পায় .

আপনি বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন, কিছু সইতে হবেই। বিয়েশাদিতে এমন কত কথা হয়, ইত্যাদি …।

 বিয়ের তারিখ এক মাসের মধ্যে ঠিক করে সদলবলে মহারানী চলে গেলেন। আমার মায়ের এই ঝামেলা বয়ে যাওয়ার স্বাস্থ্য ততদিনে ঠিক হবে কিনা একথা তারা আমলে আনলেন না। দেয়া-থোওয়া মানে যৌতুক দেয়া লাগবে না। ওরাই কনে সাজিয়ে নেবেন। এ পক্ষ যা দেয় কোনো ওজর-আপত্তি নেই। তারা চলে গেলেন কিন্তু একটি বিয়ের আঞ্জাম দিতে টাকা-পয়সা, লোকজন লাগে। বাবা বাড়ি তুলেছেন, হাতে তেমন অর্থ নেই। মার শরীরে তখন প্রসবের পর চল্লিশ দিনও আরাম দিতে পারেননি। এদিকে সময়ও কম। বাড়ি থেকে মেজ জেঠীমা, ফুফু তারা এলেন-সাজ সাজ রব করতে করতে দিন ঘনিয়ে আসে। মেয়েদের বিয়ের আড়াই দিন আগে হলুদে বসান হয়। নতুন হলুদ শাড়িতে নিরাভরণ কিশোরী ঘোমটা মুড়ে নতুন পাটিতে বসে রইলাম ঘরের এক কোণে। এই আড়াই দিন ধরে গায়ে হলুদ এবং সুগন্ধী জাতীয় মশলা বেটে জবাকুসুম তেলসহ গায়ে ঘষাঘষি চলেছিল। হাতে মেহেদি লেপটে লাগিয়ে দিলেন। এই ঘ্রাণ ছয় মাস পর্যন্ত থাকতে হবে। নববধূর ঘ্রাণ, যেখান দিয়ে হেঁটে যাবে, অন্যে জানবে ঐতো নতুন বৌ। বর আসার পর কনেকে গোসল দেয়ার নিয়ম ছিল। তারপর বরের দেয়া সাজ-পোশাক পরানোর পালা। আমাকেও ঐ নিয়ম ধরে তৈরি করা হল।

বিয়ের দিন বিশে এপ্রিল, বৈশাখের ৩রা। ঝড় বাদলের দিন। মা মিলাদ পড়ারেন যেন ঝড়-তুফান না হয়, নির্বিঘ্নে শুভ কাজ শেষ হয়। বরযাত্রী আসছে ফেনীর উত্তরাঞ্চল থেকে, ট্রেনে। স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে দুলাহ আনা নিয়ে বর পক্ষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল। শহরে কি মোটর গাড়ি কারও নেই? উকিল সাহেব জামাই-এর এমন সমাদর করলেন? আমার বাবা এ ধরনের চিন্তা করার মানুষ নন। নিজের নেই বলে জজ সাহেব কি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব থেকে চেয়ে তিনি গাড়ি নেবেন না। তখন হিন্দু জমিদারের মধ্যে একজনের গাড়ি ছিল। তাও নড়বড়ে। আর কোথায় গাড়ি। কিন্তু কলকাতার বাবুদের মোটর গাড়িতে না আনলে রাগ হলে, তিনি কি করবেন। তিনি নিজেও কলকাতায় পড়েছেন, রাজনীতি করেছেন, এমন অভ্যাস তার হয়নি, নোয়াখালীতে ঘোড়ার গাড়ির চল; দুলাহকে আনতে উনি মোটর পাঠাবেন কেন!

কত অজানার মধ্যে যাত্রা

অফুরান আলো ঝরছিল হ্যাজাক বাতিগুলো থেকে। রাতকে দিন করে দিয়েছে। লোকজন আসা-যাওয়া আর ছুটাছুটিতে যেন কোনো অসুবিধায় না পড়ে বাবা সে রকম ব্যবস্থা রেখেছেন। প্রচণ্ড গরম, বৈঠকখানা ঘরের টানা পাখা দুই বাহুর পেশী ফুলিয়ে জোরে জোরে টেনে যাচ্ছিল কয়েক জন হাত বদলিয়ে। তাছাড়া কোর্ট এলাকায় বরফ জমান হতো সাহেবদের জন্য। মুটকি ভর্তি খাওয়ার পানিতে বার বার চাক চাক বরফ তুলে দিচ্ছিল একজন লোক। সোডা, লেমোনেইডও আনিয়ে দিচ্ছিলেন বাবা। দিনের খাওয়ার পর শহরের দাওয়াতিরা চলে গেলেও বরযাত্রীদের যাওয়া হবে রাত দশটার ট্রেনে। তাদের জন্য রাতের খাওয়া আটটার মধ্যে সমাধা করার তাগিদ রয়েছে। বর পক্ষের কর্তা, যিনি বরের ছোট ভাই, বাড়ির কর্তা, তিনিও সময়মত রেল স্টেশনে পৌছানোর জন্য তাগাদা করছিলেন। ঝড় উঠলেও তাদের বাড়ি ফিরতেই হবে। পরের দিন তাদের বাড়িতে বিরাট আয়োজন। ছোট ভাইয়ের আগে বিয়ে হলেও বড় ভাই-এর জন্য সে বৌ তুলে আনতে পারেনি। বৌ আনার জন্য তাকে বর সেজে দল বল নিয়ে যেতে হবে। বাবার লোকজন কাজের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাত্রার আয়োজন সম্পন্ন করে দিয়েছিল।

ঘোড়ার গাড়িতে মালপত্র ভালো শেষ। আমার সাথে কে যাবে, বাড়িতে যাওয়ার মতো দাদি-নানি কেউ নেই। দু’জন বুয়া ঠিক আছে, কিন্তু নিজের লোক আমার ফুফু রাগ করে বললেন, কাউকে না পাওয়া গেলে আর কী। ওর কপালে একা যাওয়া আছে! আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠি, তাহলে আমি যাব না। আমার কান্না তখন সকলকে কাঁদিয়ে দিল। বোন নুরজাহান তো আমাকে ঝাপটে ধরে আছে। ছোট খালা ওকে টেনে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। চোখের পানিতে আমার গোলাপি রঙের বেনারসী ভিজে নেতিয়ে পড়ে যাচ্ছে। মেজ খালা কোলে তুলে নিলেন, কাঁদে না লক্ষ্মী মা, বলে নিজেও কেঁদে যাচ্ছেন। বাবা তাগিদ দিতে এসে আমাদের বেহাল অবস্থা দেখে কি আর শক্ত করে রাখতে পারেন নিজকে! ভাঙা ভাঙা গলায় আমায় ডাকলেন, মাগো, কাঁদলে ভালো। বুক হালকা হয়। কিন্তু তোর মায়ের মুখ চেয়ে কান্না থামিয়ে নিবি তো! ওনার শরীর ভাল না। পরশু আমরা যাব, তোর শ্বশুর বাড়িতে বিরাট জিয়াফৎ দিচ্ছে তারা। সারা গ্রাম ভেঙে পড়বে তোকে দেখতে, আর সবাই খেয়ে যাবে, একে বলে ‘আম দাওয়াত’। তোকে আল্লাহর রহমতে আমরা বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছি, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। বাবার কথায় সান্ত্বনা পাব কি, আরও কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু এবার নিরব অশ্রুপাত, আমায় যে যেতেই হবে। দুয়ারে দাঁড়ান অশ্রুমুখী আত্মীয়-পরিজন। কারও দিকে না তাকিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়িতে উঠে গেলাম। বাইরে তখন দমকা হাওয়া। “ফি আমান ইল্লাহ’ বলেছেন বাবা শুনতে পাইনি। আবার বাবাকে এত কাছে এত স্নেহে কখনও পাইনি। বিদায়ের সময় নাড়ির টানগুলো ছিন্ন ভিন্ন হতে থাকে কেন এত, যা লুকানো থাকে, তা কেন এমন ধারা বেরিয়ে আসে! আমার কান্না সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। সোনাপুর রেল স্টেশনে ঘোড়ার গাড়ি আসা অবধি কাঁদলাম। ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (ই. বি. আর) বগি প্লাটফরমে তৈরি। মামা কোলে করে গাড়িতে তুলে দিলেন। গাড়ি ছেড়ে দিল। সুন্দর কম্পার্টমেন্ট, এমন আগে দেখিনি। ড্রেসিং টেবিল দেখে দাঁড়িয়েছি সামনে। শাড়িগহনায় আমি নিজেকে চিনতে পারি না। কিন্তু ভাল লাগছিল। ওদিকে পাশের মানুষটি পাগড়ি, শেরওয়ানি খুলে আলনায় ঝুলায়, তারপর আমাকে বলে, খুলবে? আরাম পাবে। চেঁচিয়ে রেগে বলি, না। আমার ভয় লাগছে, বুয়া কোথায়?ভাইকে কোথায় দিয়েছেন? আয়নায় তার সহাস্য প্রতিবিম্ব, ইজি চেয়ারে বসে পায়ের জুতা-মোজা খুলছেন।

ও আজকের রাত তোমার-আমার জন্য। চিন্তার কিছু হয়নি। ভাইমামা পাশের রুমে। এই রাতকে কী বলে তুমি নিশ্চয়ই জানো? বান্ধবীরা বলে দেয়নি? হাবভাবে তোমাকে খুকি দেখাচ্ছে। শোন, এ হচ্ছে ফুলশয্যার রাত, বাসর ঘর আমাদের এই ট্রেনের কামরাটি।

আমি শাড়ি পরা জবুথবু মেয়েটি তখন যেমন ক্লান্ত, তেমন ভীত। বিয়ে বাড়ির ঝক্কি, ঝড় বাদলের তাণ্ডব বাইরে শুরু হয়ে গিয়েছে। আড়ষ্ট হয়ে শয্যায় বসি এবং গাড়ির দুলুনিতে হেলে দুলে ঘুমিয়ে যাই। মড়ার মত ঘুমিয়ে থেকে বেশ সময় কেটে গেল। গাড়ি কোথাও থামলে আমি জেগে নিজের শাড়ি-গহনা পরা শরীর এপাশ ওপাশ করছিলাম। আমি নতুন বধূ, শ্বশুর বাড়ি চলেছি, সাথের মানুষটি কলকাতায় থাকে, আমার স্বামী… একে একে সকল কথা মনে করছিলাম। সে সময় উনি ডাকছেন, খুকির ঘুম ভাঙলো। ফুল নেই বলে এত রাগ, কাছেও আসতে দিলে না, এক ঘুমে রাত কাবার! ঠিক আছে তোমার ইচ্ছায় সব, ফুল নেই, শয্যাও নেই, সে অন্য দিন সমারোহে করবো। আজ নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন জায়গায় যাচ্ছ, বাকি রাত আমাদের বাড়ি ঘরের গল্প শুনে কাটিয়ে দাও। আমার আর শুনতে ইচ্ছা হয়নি। মনের মধ্যে খুকি শব্দটি কটকট করছিল। বলে দিলাম, আমি খুকি নই। তের বছর বয়সে কেউ খুকি থাকে না। ক্লাস এইটে পড়ি।

ও বুঝেছি, খুব নাটক নভেল পড়ে সেয়ানা হয়েছে, তবে আমার বয়সটা জান না। তোমার ডাবলেরও বেশি। শুকনা-পাতলা গড়নের শরীর। দেখতে তেমন বয়সী লাগে না। আমাকে তোমাদের বাড়িতে আঠার বিশ বলেছে কেউ কেউ। তোমার কি মনে হয়? কার উপন্যাস বেশি পড়েছ.. শরৎচন্দ্র?

আমি মাথা নেড়ে জবাব দিতেই বললেন, তবে আর কথা কি! আমার থেকে তুমি বেশি জান, আমাদের সমাজ কি! উনি অবশ্য হিন্দু সমাজের কথাই বেশি লিখেছেন। তাহলেও আমরা সেই সমাজেই বাস করি। তোমাকে একটা কথা এখন বলে রাখি, আমার এক বিধবা ভাবী আছেন, ওনাকে ‘অপয়া’ বলে বিয়ের কোন অনুষ্ঠানে আসতে দেয়া হয়নি। এটা অন্যায় কাজ। আমি ওর সুন্দর শাদা শুভ্র শাড়ি ঢাকা মুখ দেখতে পাইনি। আসলে উনি যে কষ্ট পেয়েছেন জানি, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তুমি ওকে খুঁজে নিয়ে সালাম করবে, কাছে বসবে। স্বামী নেই বলে কি তার বিয়ে বাড়ির কাজে হাত লাগাতে পারবেন না? এদিকে যে বাড়ি ভর্তি লোকের রান্না  রেঁধেই যাচ্ছেন সেটা কেউ দেখে না। ও বাড়িতে ঐ বিধবা ভাবী ছাড়া অন্য কারও কথা বললেন না কেন? বুঝেছি ওকে আপনি ভালবাসেন।

ও কিছুই বোঝনি। উপন্যাস পড়ে মাথা ঠিক রাখতে পারোনি। এই বয়সে সেজন্য উপন্যাস পড়তে দিতে হয় না। ইঁচড়ে পেকে যায়। তোমারও সেই অবস্থা। যা বলেছি তা মনে রাখবে। বাড়ির অন্যরা বিশ-পঁচিশ জন ট্রেন ভর্তি হয়ে নোয়াখালীতে তোমাকে দেখতে গিয়েছিল, ওদের তুমি চিনতে পারবে। সেজন্য আমি তাদের কথা বলিনি। তাছাড়া আমাদের বাড়ি গ্রামে হলেও শহরের মত। অন্য কোন হিস্যা নেই, একটা পরিবার নিয়েই বাড়ি।

 কথা বলতে বলতে উনি নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকেও বললেন, হাত-মুখ ইত্যাদি যাবতীয় সকাল বেলার কাজ সেরে নিতে। সামনেই ফেনী স্টেশন, আমরা সেখানে নামব। প্লাটফর্মে ট্রেন দাড়িয়ে গেল। বিরাট স্টেশন। লেখা পড়লাম ফেনী জাংকশন। আমরা নেমে যেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। অন্য ট্রেন ঐ লাইনে আসার সংকেত। স্টেশনটিকে এত ব্যস্ত হতে দেখে আমাদের ব্যস্ত হতে হল। মাথায় আমার পিন আঁটা ঘোমটা, গায়ে সুন্দর একখানা ঝলমলি চাদর, পায়ে নাগরা জরির ফুল তোলা। নতুন বৌ বুঝতে আর কি বাকি। লোকজন দেখছিল। আমার ইচ্ছা ছিল সকালের এই রোদ ঝড়-বৃষ্টি কাটিয়ে কত ঝকঝকে … তাকে দু চোখ মেলে দেখি। উপায় নেই। মাথায় ছাতি ধরে দাড়িয়ে পাশে দুজন, ওরা আমার সেজ এবং ছোট দেবর। আমরা ওভার ব্রিজের কাছে আসতেই ওদের দুজনের কেউ একজন কোলে তুলে নিতে গেলে ওদের ভাই বাধা দেন। গাঁয়ের কুসংস্কার মানতে হবে না তোদের! ও স্কুলের ছাত্রী। হেঁটে যাক। ওর ভাইকে কোলে তুলে নে। ছোট মানুষ কেমন লাফালাফি করছে, পড়ে যাবে।

বড় ভাই-এর আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু আমার চঞ্চল ভাইটি কোলে উঠে চিৎকার, সে কাঠের পুল, লোহার রেলিং কখনও হেঁটে পার হয়নি। ও হেঁটে যাবে। ওদিকে বিলোনিয়ার ট্রেন লাইনে তৈরি, যাত্রীরা বোঝাই হয়েছে। আমরা সকলে এবার একই কামরায় উঠেছি। এখানে ইস্ট বেঙ্গলরেলওয়ের প্লাটফর্ম নেই। অত উঁচুতে আমি উঠতে পারছিলাম না। আমার ছোট দেবর। আই. এ. পড়ছিল ফেনী কলেজে। সে কাউকে সুযোগ না দিয়ে নিজেই পাজা কোলে করে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। অল্পক্ষণের মধ্যে সর্শদি ও গুণবতী স্টেশন ছেড়ে আমরা পৌছে গেলাম পীরবক্স মুন্সীর হাট স্টেশনে। চাদর ঘেরা পালকি ট্রেনের দরজার সাথে লাগানো হল। আমাকে ধরে স্বামী তুলে দিলেন। তারা সকলে ঐ এক মাইল দূরত্ব পায়ে হেঁটে আসেন। মনে পড়লে আজও প্রাণের ভয়ে শিউরে উঠি। ঐ বেয়ারারা কী দোলন দুলিয়ে যে বাঁশের সাঁকো, একটা নয় তিনটে, পালকি কাঁধে করে পার হয়েছিল। প্রতি মুহুর্তে আমার ভয় হচ্ছিল, এই এক্ষুণি ওদের পা পিছলে গেলেই পালকি নদীর মধ্যে পড়ে যাবে। আমার সলিল সমাধি হয়ে গেল। কাউকে দেখবো না, কোথায় আমার অসুস্থ মা, কোথায় আমার অসহায় বাবা, চাপে পড়ে যারা মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।

আমার ভয় ছিল অমূলক। এরা দক্ষ বেয়ারা। ওরা প্রত্যহ বহু নারী পারাপার করে। একবারের জন্যও পা পিছলে কোন দুর্ঘটনা ঘটায়নি। নিরাপদে সুন্দর এক কোলাহল মুখরিত বিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলাম। আমি পালকির দরজা মাঝে মাঝে মুক্ত রাখতে পেরেছিলাম। কারণ সম্পূর্ণ মেঠো পল্লীতে লোকালয় তো ছিল না, কোন লোকজনও পাশে আসেনি। কেবল কয়েক জন উৎসুক কৃষক ক্ষণিকের জন্য মাঠে হাতের কাজ থামিয়ে দেখেছিল, পালকিতে বৌ আসছে . . . ওদের দাওয়াত আছে .. যার নাম আম দাওয়াত। ঐ গ্রামের সকলে যে যখন আসবে, ওদের পাতে খাওয়া দেয়া হবে। সময়ের কোন বাঁধাধরা হিসাব করা দাওয়াত দিলে গ্রামের জনমানুষ আসে না। রাগ করে।

গ্রামে বৌ তোলার অনুষ্ঠান আমার ভাল লেগে গেল। চমকপ্রদ লাগছিল। ট্রেনে ওঠার মতো ব্যাপার। ওটা ছিল বড় ঘর, শাশুড়ি অহিদুননেসা চৌধুরানীর মজলিস ঘরের উঁচু ভিটে। মাটির ঘর, কিন্তু শাদা সিমেন্টের মত ধবধবে শক্ত। পাকা বলেই ভ্রম হল। দুজন সুন্দরী তরুণী ঝটপট আমাকে কোলে তুলে ফরাসে বসিয়ে দিল। বাতাস করছিল কেউ। তার পর একজন দুধভরা গামলা, অপরজন কাদামাখা গামলা সামনে রাখে, আগে কোনটায় আমি পা রাখবো? আমি কিছু ভাবার আগেই এক সুন্দরী চোখ রাঙিয়ে বলে, দেখি বুদ্ধি আছে কতখানি। বড় ভাই তোমার বশ হবে নাকি আমার বশ হবে! অন্যজন বলে, তুই থাম আমেনা, তোর বশ হতে যাবে কেন, হবে আমার বশ, এই বলে আমার পা দুটো ধরে কাদার গামলায় দাঁড় করিয়ে দিল, তারপর দুধের মধ্যে ডুবিয়ে নিজেই পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুইয়ে মুছে বসিয়ে দিল আবার। তারপর মুখে সেই খই ফোটানো কথা; মাফ করে দাও নতুন বৌ, গ্রামের আচার-অনুষ্ঠান। মানতে হয় … এর অর্থ কি জানি না, শুনেছি এ হচ্ছে গ্রামের জীবন, কাদা লাগলে মনে কষ্ট নিতে নেই, শাদা দুধ রয়েছে। তোমাকে সুখ স্বাস্থ্য দেবে। সম্পদ এনে দেবে। ওদিকে ‘আমেনা’ নামের তরুণী ‘বর কই’ চেঁচিয়ে ডাকে। অবশেষে তাকে ধরে সেই কাদামাটি পা ধুইয়ে আমার পাশে বসিয়ে দিল।

 আমাদের বাড়িতে শাহনজর অনুষ্ঠান হয়েছিল কান্নামাখা। কোনমতে বাবা আমাকে সঁপে দিলেন দুলাহর হাতে। মা কান্নার আবেগে নিজেই ভেঙে পড়েছেন। সামনেই আসেননি। কেউ যেন দু রাকাত নফল নামাজ পড়ার জন্য স্বামীকে বলছেন, আমাকেও ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। উনি ঠিকমত পড়ে মোনাজাত করেন। কিন্তু আমায় দিয়ে কিছুই হল না। কৌতুক ইত্যাদি করার লোকজনও সেখানে ছিল না। এ বাড়িতে দেখছি কয়েকজন আধুনিকা, বেশভূষায় কলকাতা থাকে সেরকম লাগছিল। আমেনা বেগম ক্লাস নাইনের ছাত্রী আমার থেকে বড় গার্ড সাহেবের মেয়ে। অন্যজন ওর মামাতোবোন, নতুন বিয়ে হয়েছে, কলকাতায় থাকে। আমেনারা থাকে ঈশ্বরদি জংশনে। বিয়ে

উপলক্ষে এরকম সকল কাছের ও দূরের আত্মীয়-কুটুমের বহু মেহমান এসেছিল। দু ভাই একত্রে বিয়ে করছে, নিমন্ত্রণের তালিকা থেকে কাউকে বাদ দেয়া হয়নি শুনেছিলাম।

আয়নায় কি দেখছেন ভাই–আসমানের চাঁদ নাকি জমিনের চাঁদ? শিগগির বলেন, না হলে এখান থেকে যেতে দেব না।

ও কিবলবো, মুখ তো দেখতে পাই না, ঘোমটা তুলে ধর আমেনা।
ও ছিঃ এত বেহায়া আপনি? সারারাত ধরে দেখলেন … তারপরেও! আর দেখাব না। বলেন কিদেখলেন।

‘আসমানের চাঁদ’ বলে যেই উনি উঠতে যাবেন, আমেনারা ছিঃ ছিঃ করছে। হাসিতে কথা বের হচ্ছিল না এত হাসছে ওরা। কোনমতে হাসির বেগ কমে এলে বলে কিনা … ছিঃ ছিঃ পুরুষ মানুষের কি লজ্জা হয় না! একরাতেই বৌ-এর বশ হয়ে গেল। যান ভাই পরীক্ষায় পাস, ছেড়ে দিলাম।

একজনকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে পেয়ে বসলো আমেনাদের দল। ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। বরকে আর পাচ্ছ না। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই তোমার। চলো আমাদের সঙ্গে, যা করতে বলবো- সেটা করলে বরকে কাছে আসতে দেব।

আমি অবাক। শহরে বড় হলাম। স্কুলে যাই আসি। এমন কথা বলতে যে শিখিনি। এরা আরও বড় শহরে মানুষ, এদের বাবা-মা মেয়েকে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয় না; দূর আত্মীয়-কুটুমের বাড়িতে আসতে দেয়, পুরুষদের সামনে হাসি-তামাশা করতে দেয়। আমি গ্রামে এসে এত আশ্চর্য ব্যবস্থা দেখবো, ঠিক আমার হিন্দু বান্ধবীদের মতো, ভাবতে গিয়ে নিজেকে বড় দুঃখী মনে হল। ওদের ভাগ্যকে হিংসা করতে গিয়ে অযথা একরাশ কান্না এসে গেল। আমেনা দেখেই ছড়া কাটলো, “বর আসলে রান্নাবাড়ি, বর গেলে কান্নাকাটি’। তারপর সোহাগ দেখিয়ে বললো, ও খুকি বৌ! স্বামীর জন্য লোক দেখিয়ে কাঁদতে নেই। স্বামীর আত্মীয়রা দোষ ধরে। কান্না রাতের জন্য তুলে রাখো। রাতে তার দেখা পাবে।

আমার সাথে একটি দশ বছরের মেয়ে সর্বক্ষণ থাকছে। ওরা পরিচয় করিয়ে দিল। ও তোমার ভাসুর কন্যে। কিরণ। চাচাদের নয়নের মনি। জন্মের আগে বাপ কবরখানায় শুয়েছে, মা জনমের জন্য এ বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থাকলো। দেবররাও তেমন মাথায় করে রেখেছে। অতি বড় সুন্দরী না পায় বর . . . ঐ দেখ না, দূর থেকে তোমাকে কেমন দেখছে।

দেখলাম, জরির পাড়ের শান্তিপুরী শাড়ি পেঁচিয়ে সারা শরীর ঢেকে, মাথায় কাপড় টেনে এক নারী। শাদা শাড়িতে রূপ আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সালাম করার কথা মনে হতেই দৌড়ে গেলাম। উনি সরে গেলেন। মুখে বললেন, দূর থেকে দোয়া করছি গো, কাছে আসতে হয না, বিয়ের অনুষ্ঠানে সমাজের এটাই নিয়ম। আমার পোড়া কপাল আমারই থাক। বড় মিঞা আর কথা পায়নি, তোমায় ‘সবক’ দিয়েছে। আমাকে সেলাম করার জন্য। ও কলকাতায় থাকে, দেশের নিয়ম জানে না।দেখ বৌ, আমার জন্য উনি কত সুন্দর শাড়ি এনেছেন! কি, সুন্দর মানিয়েছে? দেখলাম; উনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। কারও কান্না দেখলে আমারও কান্না পায়। আবারও কাঁদলাম।

বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ-এর মধ্যে সারাদিন কেটে গেল। সন্ধ্যায় আরেক নতুন বৌ তোলা হল। কয়েকটি হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হল। রাতে জেয়াফতের রান্নার আয়োজন বাইরে শুরু করে দিলেন দু ভাই। জিনিসপত্র আনা-নেয়া হচ্ছে মায়ের বড় ঘর থেকে। রসুই ঘরে সাধারণ রান্না খাওয়ার জন্য কয়েকটি মাটির অনির্বাণ আগুন জ্বলছে। আমাদের থাকার ঘর দু’কামরার একটি বাংলো প্যাটার্নের টিনের ঘর। মাঝে ভাড়ার ঘর জাতীয় একটি কামরা-সামনে বারান্দা, ইজি চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। আমার ভাইটি নতুন দুলাভাই-এর সাথে। তাকে যে মানুষটি এত আপন করে নিতে পারে, তার প্রতি আমার ভালবাসা অজান্তে এসে যাচ্ছে। একটু দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। রাত গভীর থেকে গভীরতর হলেও লোকজন, হৈ চৈ কমেনি। সে সময় মেজ দেবর, যিনি পাশের কামরায় যাচ্ছিলেন, এসে আমার খোঁজ করলেন, বড় মিঞা আসেনি! অনেক আগেই তাকে পাঠিয়ে দিলাম। আচ্ছা ভাবী, ওনার ওখানে কি কোনো কাজ আছে? কলকাতার মেহমান উনি। ঘরে আসলে যেতে দেবেন না, দেখবো পারেন নাকি।

আমার উত্তর শোনার জন্য সে আসেনি, দেরি না করে নিজের ঘরে গিয়ে খিল তোলে দরজায়। আমার ঘরে অতঃপর আমেনা এসে হানা দেয়, তোমার বরকে কান্না দেখাবে না? আড্ডা দিচ্ছিল, কানে ধরে নিয়ে এলাম। ওনার নাকি ছুটি নেই, কালই যাবে, চাচি আম্মা আর বড় বোনদের জানিয়ে এসেছে। ওকে ঘরে ঢুকিয়ে আমেনা বাইরে শিকল তুলে দিল শব্দ করে। উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখনও ঘুমাওনি? আমি খুব দুঃখিত। বিয়ে বাড়িতে কত রকমের কাজ থাকে। গ্রামীন দাওয়াতির এক তরফের খাওয়া, মুসলমান রায়ত-প্রজাদের জন্য গরুর গোস্ত, হিন্দুদের জন্য রুই মাছ, আমাদের এ অঞ্চলে কচু ভাল হয়, আলুও ভাল হয়। কই মাছ আলু কচুর ডাল হিন্দুরা খুব পছন্দ করে খায়। তাছাড়া শহরের মেহমানদের জন্য পোলাও কোর্মা, মুরগি মোসল্লাম এসব রান্না বাড়িতে মেজবুবু ও ভাবীর দায়িত্বে দিতে হল। কত লোকজন বেহিসেবি কারবার। আমার মা আর এই নুরুল্ল্যা করে বসে আছে। ঐ সব কথাবার্তা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে। তারপর বলেন, ঘুমাওনি কেন? ভয় করছিল?মনে বেশ রাগ এসে গেল, এখনও খুকি বলছে?এত লোক আছে, এর মধ্যে ভয় কিসের? কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ না করে লম্বা হাই তুলে ঘুমাবো জানিয়ে দিতেই উনি বললেন, মেজবু কনে দেখে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি জানেন আমাদের একটা যুব সংঘ আছে। আমরা প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, ষোল বছরের কম বয়সী মেয়ে হলে বিয়ে করবো না। বিয়েতে যৌতুক নেব না। জেনেশুনে উনি আমাকে বিপদে ফেললেন, এখন আমি না তোমার কাছে থাকতে পারি, না

তোমাকে কলকাতা নিতে পারি। কাল সন্ধ্যায় আমাকে চলে যেতে হবে। মেজবু আপত্তি করতেই একটু বড় গলায় চোটপাট করে এলাম। তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছ, একটা রাগী লোকের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে।আমার কলকাতা যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেল। যাক। তবুও তার যুব সংঘের প্রতিজ্ঞাকে মূল্য দিলাম। মেয়েদের দিতে হয়। আমার মা দিয়েছিলেন নয় বছরের বালিকা বধূ হয়ে। আমি শুয়ে গেলাম। শুনছি উনি বলছেন অদূরে বসে; কাল বিকেল তিনটার ট্রেন ধরবো। শ্বশুর সাহেব তো সকালে এসে পৌছাবেন। দুপুরে খাওয়া, উনি রাত থাকবেন না। সন্ধ্যা আটটার ট্রেন ধরে ফেনীতে চিটাগাং মেইল ধরে সকালে নোয়াখালী পৌছবেন। তুমি তার সাথে চলে যেতে পারবে।

তখন যদি জানতাম জোড়ে ফিরানি না গেলে বাপের বাড়িতে কথা ওঠে, জামাই-এর মেয়ে পছন্দ হয়নি, ফেলে চলে গিয়েছে! তাহলে আমার অন্তরে যে ধনুভাঙ্গা একটা পণ বান্ধবীদের সামনে উচ্চারণ করেছিলাম, ‘দেখিস আমি তোদের সাথে উনিশশো চুয়াল্লিশ সালেই ম্যাট্রিক দেব, বর আমাকে আটকাতে পারবে না, সুযোগ বুঝে সে কথাটি আমিও তাকে বলে দিতাম। কোন হারজিত হত না। আমি যে হেরে গেলাম, তুচ্ছ হয়ে গেলাম! এই মানুষটি আমার কলকাতা যাওয়ার স্বপ্নটাও নিভিয়ে দিয়েছে। মনে মনে বললাম, ঠিক আছে। কলকাতার মানুষ ভাল নয়, কারও মনের খোঁজ করে না। ক্লান্ত শরীরে আর কতক্ষণ; ঘুমিয়ে নিলাম।

গ্রামের বৌভাত, বন্দিপাখিরা

ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছিল। স্বামীকে দেখছিলাম তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিরণ যেতে দেবে না বলে পথ আটকালো। আমাদের দুজনকেই ‘আবার আসবো’ বলে তিনি দৌড়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যান। সেখানেই ভাই-বোনেরা এবং মা সকলে উপস্থিত ছিলেন এবং তাকে যাওয়ার পথে বাধা দিল। ঝগড়া তুঙ্গে উঠলে তিনি রাগের মাথায় কি সব বলে ছুটে বাইর-বাড়িতে চলে গেলেন। সেখানে আমার বাবা এবং তার মেহমানরা বৌভাতের অনুষ্ঠানে যারা এসেছিলেন, তাদের কাছে বিদায় নিয়ে সোজা স্টেশনের পথে হাঁটা দিয়েছেন। কিরণ আমাকে ঘরের পেছনে নিয়ে দেখিয়েছে। কিন্তু ঐ যাওয়ার জের বাড়িতে তুমুল আকার ধারণ করলো। ষাট উর্ধবয়সী পোড় খাওয়া মা আস্ফালন করছেন, হারামজাদা, দু’পয়সার চাকরি করে আমার বাড়ির মান-সম্ভ্রম চোখে দেখলি না? আমার বাড়িতে যেসব মেহমান এসেছে, এরা আর কবে আসবে; তুই এত দেমাগী। তোর এই দেমাগের উচিত শিক্ষা আমি দিলাম। তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করলাম। আমি অহিদুননেছা চৌধুরানী, মুন্সী তমিজউদ্দিন সাব রেজিস্ট্রার সাহেবের একমাত্র সন্তান, ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে মহল্লায় ঘোড়া ছুটিয়েছি …

সোমবারের সকাল থেকে শরীরের উপর দিয়ে কত কী যাচ্ছে। বাড়িতে শোয়ার থাকার জায়গা নেই, তবুও মেহমান সর্বক্ষণ, সাহেব বাড়িতে বৌ দেখতে আসার গ্রামীণ মেহমান। মাথা নিচু করে ঘোমটা টেনে হাঁটু মুড়ে বসে থেকেছি। ঘাড়ে সেই যে পালকিতে ঘাড় গুঁজে বসে কাঠের ঘষা খেয়ে চামড়া ছিলে গিয়েছিল, সেখানটায় টনটনে ব্যথা। কাকে এসব দুঃখ কষ্টের কথা বলা যায়। চোখের পানি ঝরতে দেখলেও যে উল্টা কথা আমেনাদের মুখে খল খল করে। একদিন কখন যে মেয়েলোকদের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে শুয়ে পড়ে এক অসাড় ঘুমে অচেতন হলাম, আর শাড়ি হাঁটুর উপর উঠে গেল, তাতেই কত কুৎসা! যার হাতে বাবা সঁপে দিলেন তার আদুরী কন্যাকে, তার কণ্ঠস্বর যদিওবা শুনি, তার দেখা যে পাই না। আড়াই দিন এভাবে কাটিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম, কড়া জ্বরে পড়লেই বুঝি এসব জ্বালাযন্ত্রণা বুঝতে পারবো না। আল্লাহকে কত ডেকেছি, আমাকে গা পুড়ে যাওয়া জ্বর দাও, আল্লাহ্ … তবুও সইতে পারবো। অসুখ হল না। এদিকে খাওয়ারও অত্যাচার, কতজন যে হাতে দলা পাকিয়ে নিজের পাতের খাওয়া মুখে পুরে দিচ্ছে … বিষের মত গিলে যাচ্ছিলাম। অন্যের বাঁকা কথা শুনতে আমার কষ্ট হয়। উত্তরে কোন কথা বলার নিয়ম নেই। বৌকে চুপ করে থাকতে হবে।

এর মধ্যে একটি দশ বছরের মেয়ে আমায় অনেক শান্তি দিয়েছিল। মেয়েটি আমার সেই পিতৃহীন ভাসুর কন্যে কিরণ। মায়েরই মতো ছিপছিপে উজ্জ্বল শরীর। মায়াভরা দুটো ডাগর চোখ, মুখে ঝটপট কথা দিয়ে আমাকে অনেক উপদ্রব থেকে বাঁচাতে সদা ব্যস্ত ছিল। বড় আদরে কথা বলেছে, চাচীমা, তুমি কাঁদ কেন? আমরা কি খারাপ? কষ্ট দিচ্ছি? আমার হাতের আঙ্গুল নিয়ে চুমু খেয়ে বলেছে … কী সুন্দর, এমন নরম! আমার পায়ের পাতা আর আঙুল নিয়েও ওর কত আদর! আলতা পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। কলকাতা থেকে চাচা সুন্দর ফ্রক এনে দিয়েছে, সেটিই পরে আছে। মাথায় দু’বেণীতে ফিঁতে বাধা। চাচার বড় আদরের ভাইঝি।

ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছিল। স্বামীকে দেখছিলাম তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিরণ যেতে দেবে না বলে পথ আটকালো। আমাদের দুজনকেই ‘আবার আসবো’ বলে তিনি দৌড়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যান। সেখানেই ভাই-বোনেরা এবং মা সকলে উপস্থিত ছিলেন এবং তাকে যাওয়ার পথে বাধা দিল। ঝগড়া তুঙ্গে উঠলে তিনি রাগের মাথায় কি সব বলে ছুটে বাইর-বাড়িতে চলে গেলেন। সেখানে আমার বাবা এবং তার মেহমানরা বৌভাতের অনুষ্ঠানে যারা এসেছিলেন, তাদের কাছে বিদায় নিয়ে সোজা স্টেশনের পথে হাঁটা দিয়েছেন। কিরণ আমাকে ঘরের পেছনে নিয়ে দেখিয়েছে। কিন্তু ঐ যাওয়ার জের বাড়িতে তুমুল আকার ধারণ করলো। ষাট উর্ধবয়সী পোড় খাওয়া মা আস্ফালন করছেন, হারামজাদা, দু’পয়সার চাকরি করে আমার বাড়ির মান-সম্ভ্রম চোখে দেখলি না? আমার বাড়িতে যেসব মেহমান এসেছে, এরা আর কবে আসবে; তুই এত দেমাগী। তোর এই দেমাগের উচিত শিক্ষা আমি দিলাম। তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করলাম। আমি অহিদুননেছা চৌধুরানী, মুন্সী তমিজউদ্দিন সাব রেজিস্ট্রার সাহেবের একমাত্র সন্তান, ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে মহল্লায় ঘোড়া ছুটিয়েছি … তোকে হাতে পেলাম না, ভাতে মারবো। তোর ভাগের সম্পত্তি আমি বৌমাকে কবলা করে দিয়ে যাব। শিক্ষিত বাপের শিক্ষিত মেয়ে আমি ঘরে এনেছি, তোর পছন্দ না হওয়ার তামাশা তখন গলায় উঠবে … হারামজাদা অতঃপর আর কোন সাড়া নেই।

এর পরের কাহিনী হৃদয়বিদারক। কিরণ থেকে শুনতে পেলাম, তার দাদু এখন মূর্ছিতা তারই সেবাদাসীরা যা করবার করে তাকে সুস্থ করে তুলবে। আমি বিস্ময়বোধ করি, ঐ শুকনো জার্ণ দেহখানি থেকে এত শক্তিশালী গালি আসে কেমন করে! কী অসম্ভব তেজ কথার মধ্যে। আরও দুঃখ পেলাম, তাদের ধারণা স্বামী তাদের পছন্দকে এমন অবহেলা করে তাদের অবাধ্য হয়েছে। আমি পছন্দ করার মত, জিদের বশে সে গোলমাল করেছে। যা বলা যায় না, তা সহ্য করার মত মনের শক্তি সেদিন আমার ছিল না। জোরে কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম। তখন ঘরে কেউ ছিল না। কিরণ আমাকে ধরে শুয়ে পড়ে আরও কত কাহিনী বলে। আমার চাচা-ফুফুরা সবাই রাগী, দাদিতো জমিদারনী। বাপের গদিতে বসে। কিন্তু দাদির মনে সুখ নেই। চাচ্চুদের বড় একটা ছেলেও যে তার জীবিত নেই, ঐ কবরখানায় শুয়ে আছে। দাদির বুক খালি লাগলে ইচ্ছামতন যখন যেটা খুশি একটা কবর বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে। সেজন্য কলকাতার চাচু কবরখানায় বাগান করে রেখেছে, গোলাপ আর গন্ধরাজ আর সুন্দর ঘাস। দাদির ওসব লাগে না, ফুল ধরেও দেখে না, কবরকে চুমু খায়। চাচ্চুকে দাদি স্বপ্নে পেয়েছিল। ঐ তাবিজ কি করে লিখতে হবে তাও স্বপ্নে পেয়েছিল। তোমায় ওর গলার তাবিজটা দেখায়নি? জান! ঐ সোনার বাধান তাবিজকে মোরলীর তাবিজ বলে। দাদি একজন মুন্সীকে চল্লিশ দিন খাওয়ায় আর মসজিদে নামাজ পড়তে দেয়। তারপর নিজেই কালি-কলম কিনে দিয়ে একটা দোয়া লিখিয়ে নেয় তাকে দিয়ে। যাদের বাচ্চা হওয়ার পর মরে যায়, দাদির থেকে এই তাবিজ লিখিয়ে নেয়। আমাদের সবাই এই তাবিজ পরি, কখনও খুলি না। আমার চার চাচাও এই তাবিজ পরেন।

কিরণ জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকালো। ওর মনে সন্দেহ, আমি শহরে থাকি, বড় স্কুলে পড়ি, এ সবে বিশ্বাস করবো কিনা। আমরা তখন ভাব-সম্প্রসারণে কত লিখেছি ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু। সেই কথাটি মনে করে ওকে বললাম, কেন বিশ্বাস করবো না। আল্লাহর নাম কালাম রয়েছে। সেদিন আমরা দুজনে জড়াজড়ি করে শুয়ে আরও অনেক কথা বলেছি। তার মধ্যে ওর দাদা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। তিনি মোক্তারি করতেন ফেনী কোর্টে। ওর দাদির এক আলমারিতে অনেক মোটা মোটা বই আছে। মনে কষ্ট হলে দাদি মুখস্থের মতো পড়েন ঐ সকল বই। সেগুলো সম্পর্কে জানতে আমার কৌতূহল হল এবং দুজনেই ঘুমিয়েছিলাম অনেকক্ষণ। ঘরের মধ্যখানে কে ইনি দাড়িয়ে! মহারানী ভিক্টোরিয়ার আগমন কেন?এমন রণরঙ্গিনী রূপ ধরেছেন কেন? আমার দণ্ডাদেশ দেবেন? আগুনের মত চোখ দাপাদাপি করছেন! কেন? নিজের ভাই-এর দোষটি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে ঐ রাগ ঝাড়বেন! আমি সভয়ে চোখ বুজে ধড়ফড় করে উঠে বসি। শুয়ে থাকলে রাগ আরও বেড়ে যাবে-এমন ভয়ও করছিলাম। উনি নিজেই তো মেয়ে, তদুপরি নিজের পছন্দ করা মেয়েকে ভাইয়ের জন্য নিয়ে এলেন। নিজের শাড়ি-গহনা দিয়ে যাকে সাজিয়েছেন, তার উপর এমন খড়গহস্ত হওয়ার কোনো কারণ আমার মনে পড়ে না। ইচ্ছা হচ্ছিল, তাকে বলি, আপনাদের শরীরে এত রাগ কেন! এমন রাগ ভাল নয়। আমার মাথা ঝিমঝিম করলেও খুঁটি গেঁড়ে শক্ত হয়ে থাকি, যা করে, করুক, চুপ থাকবো।

রানীর মত দাপটে মেজবুবু এগিয়ে এলেন, আমারই পাশে খাটে বসে গেলেন। আমি আরও শক্ত, ঘাবড়ানো মুখ নামিয়ে রাখি। অতর্কিতে আমার মাথার ঘোমটা টেনে নামিয়ে মুখখানা তুলে ধরে কি যেন অনুসন্ধান করলেন। তারপর ঠেলে শুইয়ে দিলেন। তিনি বুঝি যা চেয়েছেন, পেয়ে ছুঁড়ে দিলেন আমাকে। মুখে শব্দ! উনি করুণায় উদ্বেল! আমাকে অভাগী বলেছেন। ভাইকে বললেন পাগলটা এমন। ক্ষেপোমি করে গেল কেন বুঝতে পারলাম না। দশ দিনের ছুটি ছিল, “ছুটি পাই নাই’ অজুহাত দেখিয়ে গেল। কারণ কি! বউ পছন্দ হয়নি। এমন কথা আমার কোন শত্রুও বলতে পারবে না। শরীর স্বাস্থ্যে এর কাছে কে দাঁড়ায়। আয় দেখি তো, আমেনা … মিলিয়ে দেখবো। তারপর পোকন্যাকে (তার ভাইয়ের আদরের নাম) আমি দেখে নেব! বাড়িভর্তি লোকের মধ্যে কী পাগলামিই করে গেল! তোর কী মনে হয়, আমেনা?

আমেনার মুখে সেই ছড়া, উজ্জ্বল হাসিখুশি আমেনা গানের কথা বলছে, ‘বর আসলে রান্নাবাড়ি, বর গেলে কান্নাকাটি’, ‘উঠে বসেন গো নতুন বৌ, মুখে চন্দ্রপুলি দিচ্ছি, একটু খাও।’ মেজবুবুকে মেয়েটা একটু শরম করে না, আশ্চর্য! তিনিও ঘামছিলেন, গায়ের সঙ্গে শাড়ি লেপটে গিয়েছিল। আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন বার বার। তিনি সত্যি মহারানী, যেমন দেখতে, তেমন অন্তরে। আমি মিছেই ভয় পেয়েছিলাম। ফর্সা মানুষদের চেহারা দেখে অন্তর বুঝতে পারা যায়। কী রাগী আর ভয়ংকর ভেবেছিলাম ঐ লাল হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে। স্নেহের কথাই যে সব বলে গেলেন, ঠিক মায়ের মতন।

আমিনা খিলখিল করে হাসছে, ওর সাথে আমি হাসলাম। এ মেয়ে তো দূরের কেউ নয়, একই বাড়ির একই বংশের। শেখ ইজ্জত ওদের পূর্ব পুরুষ। ইজ্জতপুর গ্রাম ওদের পিতৃপুরুষের ঠিকানা। কেবল শ্বশুর সাহেব ঘর জামাই হয়ে নোয়াপুর সাহেব বাড়িতে উঠে এলেন। নিজের বাড়ির অংশ ভাইদের দিয়ে আসেন। সহজ সরল নির্লোভ মানুষটাকে , তাও এরা সমালোচনা করে। নিজের পৈতৃক ভিটে ছাড়া ঠিক হয়নি। সেটা যে আসল ঠিকানা। আমেনারা ভোগ করছে, আমি যেন খুশি হলাম। জান্নাতবাসী শ্বশুরকে সালামও জানালাম।

সে সময় মেজ দেবর নুরুল্যা এসে আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল, তার বৌ এর সাথে পরিচয় করা হয়নি, সে করিয়ে দেবে। সে বাড়িতে থাকে। মুন্সীর হাট ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। পলিটিক্স করা মানুষটির এমন সৌখিন মন! সুন্দর চকচক করছিল তার কাল মেহগনি কাঠের রেকর্ড প্লেয়ার সেট। ছোট্ট একটা আলমারি। উপরের তাকে রেকর্ড বাজিয়ে দিল সে। নিচে রেকর্ডের বড় গোল চাকতিগুলো থরে থরে সাজান। রেকর্ড ঘুরছে। পাম্প দেয়ার হ্যান্ডেলটিও চমৎকার। আমাকে বললো, পংকজ মল্লিকের রবীন্দ্র সংগীত। আপনিতো গান ভালবাসেন ভাবী, এটা আপনার উপহার, তবে এক শর্তে; আমি চোখ তুলে চাইতেই বললো, আপনাকে গান শোনাতে হবে। আমি উঠে ছুট লাগাতেই আমার হাত ধরে তার বৌয়ের পাশে বসিয়ে বলে, এই ঘুমাও কেন? সে কথা ভাবীকে বলতে পারবে? আমি এত ভাল করে ওকে আগে দেখিনি। কালো বর্ণের মানুষটি এত সুন্দর কী করে হয়! ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রেকর্ড বেজে চলেছে, কোন গান কিছু বুঝি না। কিন্তু নুরুল্যার অন্য কথা, বাজিয়ে বাজিয়ে এটার দফা শেষ, অন্যটা দেব! আমার বাইরের কাজ পড়ে আছে। ভাবী, বড় মিঞার কাণ্ডজ্ঞান তো দেখলেন। আপনি গান শোনেন এ ঘরে, আমি যাই।

আমাদের শহরবাস মনে হয়েছিল কোনো গণ্ডগ্রাম। এরা গ্রামে বসে গ্রামাফোন শোনে। দার্জিলিং চা খায়, সুন্দর কাপে ধোঁয়া বের হয়। আমার মা বাবা গানের কথা শুনতেও পারেন না, কেবল রান্না, নামাজ-রোজা, বাবার আছে কেবল কোর্ট আর আইনের বই। সে সময় আমার ভাই সালেহউদ্দিন উঠানে একটা ছেলের সাথে খেলছিল দেখলাম। ওর গায়ে নতুন জামা-প্যান্ট, পায়ে সু! কে দিল? অবশ্য বুঝতে পারলাম স্বামীর কীর্তি। শ্যালককে নতুন কাপড় দিয়ে খুশি করে গিয়েছে। শ্বশুর বাড়ির লোককে খাতির করলো। আহা-রে।

ঐ ছেলেটির পরিচয় দিলো কিরণ নিজে। ওরই ভাই। বাপ ভিন্ন। দাদির জমিদারিতে এমন অনেক ঘটনা আছে। ওর বাপের মৃত্যুর পর মাকে নিয়ে যেতে এসেছিল মামারা। দাদি এই বলে তাদের বিদেয় করেন, নিয়ে তোমরা ওকে কি করবে? বিয়ে দেবে? সাহেব বাড়ির বৌয়ের জন্য পাত্র তোমরা কোথায় পাবে। ওর দায়িত্ব আমি নিলাম। তারপর দাদি নিজের ছেলেদের জোর করলেন, তোরা কেউ একজন ওকে বিয়ে কর। মায়ের কথায় ওরা চটেমটে বাড়ি ছেড়ে ভাগলো। এদিকে দাদি বিয়ে পড়নোর জন্য কাজী ডেকে এনেছেন। বাড়িতে তখন বড় ফুফু থাকতেন। ফুফাকে ধরে এনে বিয়ে করিয়ে দেন। ফুফু খুব কেঁদেছিলেন, কিন্তু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে সতীন মেনে নিয়েছেন। দাদি জমিদারির চেয়ারে বসলে মরদ হয়ে যায়। রাগ যেমন, হুকুমও তেমন। কেউ অমান্য করতে পারে না। চাচারা অনেক দিন বাড়ি আসেনি। দাদির অসুখ হয়ে গেল। তবে ডাক্তার নিয়ে আসে।

‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর’–মা সুন্দরী কিনা; তাকে ফেলে ফুফাও মরে গেলেন। বাহার এতিম, আমিও এতিম। দাদির পুষ্যি-একথা সবাই বলে। মায়ের আগুনের মত রূপ জ্বলে গেছে। সারাদিন চুলার পাশে থাকতে হয়। দাদির জমিদারির কিছু ভাগ মাকে লিখে দিয়েছে দাদি।
‘তাহলে তুমিও জামিদার; ঐ চেয়ারে বসলে মরদের মত কথা বলবে। আমার কথায় কিরণ বালিকাসুলভ হাসে। বলে ঠিক হয়নি, দাদির
ভাগ্য ভাল। বাপের সম্পত্তি পেয়েছে, চৌধুরানী হয়েছে। আমারতো বাপ মারা গেল দাদির সামনে। কিছু পাব না।
ও কে বলেছে এসব কথা?
কিরণ ডাগর চোখ মেলে বলে, সব সময় শুনি, দাদির কাছে কত বৈঠক হয়। বিচার করে দাদি। কিন্তু চাচারা আমাকে আদর করে, আমার আর কিছু চাই না। আমার এই ফ্রকটা কত সুন্দর, দেখ-চাচা দিয়েছে, মাকেও সুন্দর সুন্দর শাড়ি এনে দেয়।
ও তবেতো তুমিও তোমার দাদির চেয়ে কম নও। তাঁর মত দাপট করো চাচা-ফুফুদের ওপর। মা-বাবার ওপর দাপট করা যায় না। তাদের কথাও অমান্য করা যায় না।

ও চাচী, তুমি যাবে না। এখানে স্কুল আছে। পড়তে পারবে। তোমার বিয়ে হয়েছে। বাপের বাড়ি কেন থাকবে? কিরণ মনের খেয়ালে এত কথা বলছিল। কারণ ও দেখতে পেয়েছিল, পালকি এসে গিয়েছে উঠানে। আমিও দেখে মনে করলাম, আবার পালকিতে উঠে ঐ পুলগুলো পার হতে হবে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ওরা আমাকে ডুবিয়ে দেবে। কিরণকে বললাম, পালকি চড়তে আমার ভয় করছে; মেজবুবুকে বলে আস, আমি হাঁটতে পারবো। ‘নতুন বৌ’ হাঁটে না, এই কথা কিরণের গলা থেকে বুঝি নয়, দাপটের কেউ নিষেধ করে দিচ্ছে আমাকে– এরকম শোনাল।

কিরণের মা ততক্ষণে সময় করে গোসল সেরে সামান্য পরিচ্ছন্ন হয়ে আমার কাছে আসেন। আমি চট করে সালাম করে নিলাম। তিনি কিন্তু খুশি না হয়ে দুঃখিত হলেন। নিজের অপরাধ হয়েছে ভেবে চট করে বলে দিই, আমার কোন দোষ নেই, আপনার দেবর আমাকে বলে গিয়েছে আপনাকে সম্মান করতে, সালাম করতে। ওর কথাতো মানতে হয়!
উনি তওবা করে আল্লাহ মাফ কর’ ইত্যাদি বলা শেষে করুণ করে আমার কথার জবাব দিলেনঃবোন, তোমার কাজ তুমি করেছ,

তোমার ভাগ্য আমার ভাগ্যের ছোঁয়ায় খারাপ না হয়, সেজন্যে আমি মাফ চাই। আমি জানি অনেকের কথা শুনে চলায় কত যন্ত্রণা, দোয়া করি সারা জনম একজনের কথা মেনে যেন জীবন শেষ করতে পার। উনি চোখ মুছে এক ঝলক হাসলেন। আমি এমন সুন্দর হাসি দেখে চেয়ে থাকি। উনি বললেন, বড়বি, ছোট হলেও তুমি এখন এ বাড়ির বড় বৌ, আমি হলাম শাশুড়ি মায়ের আন্ধাবোট। তার সঙ্গে আছি। তিনি যতদিন আছেন, চিন্তা নেই। উনি আমার কথা ভেবে ছেলেমেয়েদের কাছে নিন্দনীয় হয়েছেন। তার জন্য আমি একটা ছেলে পেলাম। কিছু জায়গা জমিও লিখে দিয়েছেন। আমার জন্য তোমরা আর চিন্তা করবে না বোন। বড় মিঞা বিয়ের রাতে আর কোন কথা পেল না, আমার মত ‘আবাগীর’ কথা বলে গুনাহগারী করেছে আমাকে। ও ভাল করেনি, বড় বি…। আমাকে দেখা তার শেষ, রান্নাঘরে কি কাজ ফেলে এসেছে-এই অজুহাত তার পালানোর। বুঝলাম প্রথম স্বামীকে তিনি যেমন ভালবাসেন, তার ভাইকেও তিনি তেমনই ভালবাসেন। কোন অম্লান স্মৃতি তার অন্তরে। আমার মনেও তার জন্য ভালবাসা। আমরা বন্দিপাখি!

ফিরানি উৎসব রোদন ভরা

এবার ছুটিতে আসার মূলে তার এক প্রিয় সহকর্মী বন্ধু সাহিত্যিক বিমল কর। তখন তিনি কবিতা লিখতেন। ‘তোর বৌ দেখালি না সেলিম’। তার ফর্সা মুখ লালচে হয়ে গেল লজ্জায়। বৌ আনতে পারেননি-এ কথা শুনে কানটা ধরে কয়েক টান দিয়েছিল কর বাবু। বুঝেছি তুই একটা ইডিয়ট। মুসলমানদের ঘরে কচি কচি বৌ পাওয়া যায়। দেখতে কত মিষ্টি। আর তুই কিনা আস্ত বেরসিক। ওকে নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখবো-কত আশা করে রেখেছি। বাসায় আমি যাওয়ার পর স্বামী একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। তার বন্ধু বিমল কর আমাকে এক তোড়া তাজা গোলাপ ফুল এবং কবিতা উপহার দিয়েছিলেন।

নতুন বৌ বাড়ি ফিরানি যাচ্ছে। কিরণ আলতার শিশি নিয়ে বসলো, বেসখিনা বাক্স থেকে মুর্শিদাবাদী সিল্ক শাড়ি বেছে নিল। নীল আকাশি রঙের শাড়িতে সারি সারি বলাকা উড়ে চলেছে। আর্মলেট, ব্রেসলেট, টিকলি এবং আর সব গহনায় আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে সে। আমি পরতে চাইনি। যে এতসব দিয়ে এনে রেখে চলে গেল, তার সাজ পড়ে থাক এ বাড়িতে। বাবার সাথে যাচ্ছি, আমার লজ্জা। এগুলো গায়ে কাঁটার মত বিঁধছিল। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার থোড়াই পরোয়া করলো আমেনা ও সখিনারা। আমার ঝলমলি পোশাকি চেহারা আয়নায় দেখে কান্না পেল। ভাবী; বুঝেছি আর কাঁদতে হবে না। মনে কর যাচ্ছ বরের সাথে। এই চোখের কাজলে মায়া দিয়েছি, স্বপ্নে তাকে দেখতে পাবে। আমি ওদের কেমন করে বলতে পারি; কোন বিরহের জন্য আমি কাঁদছি না। শুনেছি ফিরানি জোড়ে যাওয়ার নিয়ম, আমি একা গেলে কি জানি কী হবে। এটা ভাল নয়, দেখতেও কেমন হবে। মা দুজনকে দেখতেই বসে আছেন। শুধু আমি  কেন, শাশুড়ি আম্মা এবং মেজবুবু, ছোটবুবুও নানান কথার মধ্যে একটা কথাই বলে গেলেন; পোকন্যাকে একবার হাতে পাইতাম, ফুটো পয়সার চাকরি। ঘুচিয়ে দিতাম। আমাদের বড় মুখ ছোট করার খেদ তুলতাম।

 ট্রেনে উঠেছি। ফেনী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন মেজ দেবর এবং অন্যরা। চা-মিষ্টি, পান ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করলো বাবা এবং অন্যদের। আমার মনে সেই দুঃখ, এত আয়োজনের মধ্যে কে যেন নেই। ‘ভাবী’ বলে পা ছুঁয়ে সালাম করে মেজ দেবর বলে, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে, আমরা নেমে যাই। আমি বোকার মত কেবল ঘোমটা টানলাম। কাগজের মত সিল্কের শাড়ি তবুও বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। ওদের বলতে চেয়েছিলাম, আমাকে দেখতে যাবেন; কিন্তু বলিনি। উল্টা শুনিয়ে দিল মেজ দেবর, ‘দাওয়াত দিলেন না তো আমাকে; না দিলেও যাব, আপনাকে দেখতে যাব। বড় মিঞা না থাক, আমি সেটা শোধবোধ করে দেব।’ ট্রেনের জানালায় মুখ বাড়িয়ে ওর কথা শুধু শুনে গেলাম। আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে-কি আর বলবো, ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকি। এরা কত ভাল। গাড়ি ছেড়ে দিল।

বাবা তার দলবলসহ আমাকে ইন্টার ক্লাসে তুলেছেন, এত গহনাগাটি যার গায়ে তাকে ফার্স্ট ক্লাসে দিতে হয়। উনি এত কিছু ভেবে দেখেননি। তার সুবিধার কথা জানিয়ে দিলেন, লাকসাম ট্রেন বদলাতে হবে, রাতের ট্রেন, একসাথে থাকলে ভাল। কিন্তু আমার মনে হল, বাবার মান-সম্মান নিয়ে যে উদাসীন মন, ওরা হয়তো অন্য রকম ধরে নিয়েছে। কিপ্টে স্বভাবের, এরকম ভাবলে বিছরি। মা কেন খেয়াল করে বলে দিলেন না! নতুন সম্পর্কের মধ্যে মান-সম্মান নিয়ে। কথা হতে শুনেছি। যাক সে! ঘুমিয়ে জেগে যাত্রা শেষ। পরের দিন সকালে নোয়াখালী পৌছে যাই।

যা আশংকা ছিল মনে, ঘটে গেল অতি দ্রুত। মা খুঁজছিলেন, জামাই কোথায়! দেখছি না কেন! ফিরানি অনুষ্ঠান, সে ছাড়া তুই এসেছিস কেন। বাবাকে বলেন, আপনি কি কোর্ট-কাচারি ছাড়া আর কিছু বোঝেন না?আপনার মেয়ের পেটে কত কত বুদ্ধি জানেন?

 বাবা অপরাধীর মত নরম সুরে বললেন, কি জানি আমাদের তো বলে গেল সে ছুটি পায়নি। না গেলে চকরিতে অসুবিধা আছে। বেকারের সংখ্যা কলকাতায় কম নয়। আমিও ভাবি সে গেছে ভাল করেছে।

মায়ের তখনকার রাগ এবং দুঃখ সব উপচে পড়লো, সাজিয়ে রাখা খাওয়ার টেবিলের ওপর। জামাই-খানার প্রচুর আয়োজন ছিল সেখানে। এক ধাক্কায় ঠেলে ফেলে নাস্তানাবুদ করলেন। প্লেট-বাটি ইত্যাদির কিছু আস্ত ছিল না। মায়ের রাগ এমনই প্রচণ্ড ছিল। আমাকে পরবর্তী আক্রমণ করতে পারেন, এই ভয়ে সোজা মেজ খালাকে

জড়িয়ে ধরি। বলি, শিগগির গায়ের গহনাগাটি খুলে নাও, লুকিয়ে রাখ। তিনি চটপট কাজ সেরে মায়ের আঁচল থেকে চাবি নিতে গেলেন। মা তাকেও এক চোট বকে দিলেন। মায়ের এটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মারতে গেলে সকলকে মারবেন, বকতে শুরু করলেও সে রকম। এতে আমরাও অভ্যস্ত। খালা চাবি নিয়ে বড় কাঠের আলমারির চোরা কুঠুরিতে সব গহনা তুলে রাখলেন। আমাদের গহনা ছিল না আগে, গলায় সরু চেইনও না। মায়ের সামান্য হাতে-কানে এবং গলায়, যা না পরলেই নয়। তখন সোনার ভরি ষাট টাকা। বিয়ের সময় আমাকে তিন ভরির এক ছড়া নেকলেস দিয়েছেন বলে দাম শুনেছি। জামাই-এর আঙ্গুলে একটি আংটি মা তো পরিয়ে দেননি, নূরজাহান দিয়ে থাকবে। গহনা পরার প্রতি আমাদের আগ্রহ ছিল না।

রান্নাঘরে বুয়ারা পান খাচ্ছিল আর খোশগল্পে মশগুল। আমার মাথা ঘুরে উঠলো। সর্বনাশ ওরা বুঝি ঐ বাড়িতে মা-ছেলে ঝগড়াঝাটির কথা রসিয়ে বলে যাচ্ছে। বলারই কথা। সে রকম হৈ চৈ মার্কা তর্কাতর্কি আমরা কখনও শুনিনি। আমার বাবাতো নিজের সন্তানদেরই কত আস্তে ‘আম্মা-আব্বা-আপনি’ ইত্যাদি করে কথা বলেন। মা রাগেন কিন্তু ঐ বাড়ির চেঁচামেচির তুলনায় নস্যি। কিন্তু আমার ভয় অমূলক। নতুন শাড়ি পরনে, পায়ে চটি পরে বুয়ারা সে বাড়ির খানাপিনার গল্প জুড়েছে। জিয়াফতে কত লোকজন এসেছিল এবং তাদের জন্য যে মাটিতে বাসনের আকারে খাদ বানিয়ে দুই পরতা কলাপাতা দিয়ে খাওয়ার বাসন তৈরি করা দেখে বুয়ারা অবাক। প্রচুর ভাত, গোস্ত, কলাই-এর ডাল, কুমড়া কলাপাতার পাতে কি সুন্দর করে গাঁয়ের মানুষগুলো খেয়ে ঢেকুর তুলেছিল। তা বলে শেষ করা যাবে না। মস্ত বড় পুকুর, তাতে সান বাঁধানো ঘাট। হাত ধুয়ে দাওয়াতিরা পান-শাদা-তামাক খেয়েছে ঘাসে বসে। আমারও অবাক লাগছিল। এতসব দেখিনি যে, ঘোমটা দিয়ে মাঝ ঘরে বসে থাকলে দেখার সুযোগ কেমন করে পাই। বৌদের এসব দেখতেও নেই, গায়ের কারবারি-দরবারি লোকদের সেখানে তারা যায় না। পর্দাতো অবশ্যই, তার উপর বাড়ির মান-সম্মান হিসাব করা। কে কতদূর যাবে, কথা বলবে, মাপ আছে যে।

পরদিন স্কুলে যাই। আগের মত সবই। কেবল নতুন শাড়ি ছিল পরনে। বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, এরকম জিজ্ঞাসা করছে বান্ধবীরা। এমনকি দিদিমনিরা কেউ ভাবতে পারেনি তিনদিন বাদে স্কুলে যাওয়া যায়, অথচ আমি গেলাম। মুসলমান মেয়েদের পড়া, ঐ বিয়ে। শেষে মন্তব্য করলো, তুই একটা গর্দভ। মাথায় ঘিলু কেবল পড়ার জন্য? স্বামী ভদ্রলোকটি তোকে স্কুলে আসতে দিল?তোর এত বাধ্য হল কেন? সেটাইতো জিজ্ঞাস্য। স্বাস্থ্যবান তরুণ যুবক, সাধু সন্ন্যাসী নয়তো!বলার নয় যে কথা, হাসির আবরণে সেটি ঢেকে দিয়ে আমি সর্বক্ষণ তৎপর। আমি ঘরে-বাইরে, অনাহুত আলোচনার বস্তু হয়ে আছি। তবুও তাকে একবার চিঠি দিলাম না। দুঃসহ অভিমান আমার মধ্যে বিবমিষার রোগ করে দিল। কাউকে বলতে পারলে উগলে দিয়ে সুস্থ হতে পারতাম। সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছিল। মায়ের ওপর ক্ষেদ দেখাতাম, আমার পড়ার মধ্যে তিনি যে বিঘ্ন সৃষ্টি করলেন, সে সঙ্গে তার ডাক্তার মামাকে শত্রু ভাবতে শুরু করলাম। আমার সরলপ্রাণ মাকে তিনি প্ররোচিত করেছেন। ধর্মের কথা দিয়ে মায়ের মুখ বন্ধ করে মা ও মেয়ে দুজনকে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দিয়ে কি ফায়দা লুঠলেন পাগড়িওয়ালা লোকটা, আমরা জানি না …

এত কিছু সহ্য করতে চেয়েছি শুধু একটি আশায়, তাকে আর এ বাড়ি ঢুকতে দেব না। এবং পড়ালেখায় অতিরিক্ত খাটুনি দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব। ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষায় বেশ ভাল করলাম দেখে আমার প্রিয় বান্ধবী চিনু ঈর্ষান্বিত হয়ে যা বলেছিল একদম মোক্ষম। বিয়ে একটা হল এমন! তোর কারও কাছে গিয়ে থাকতে হল না, পরাধীন হয়ে অন্যের মতে চলতে হল না। এমন না হলে আমাদের রওশন সব বিষয়ে সত্তর, আশি পাবে কেন! তোর বিয়ে হয়েছে না ঘোড়ার ডিম।

বান্ধবীদের ঈর্ষাকাতর হৃদয় থেকে আমি সেদিন মহাসত্য পেয়ে গেলাম। তাই তো! এ যে পরম সৌভাগ্য, যা অন্য নারীদের কপালে জোটে না। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। চমৎকার। বেশ সাহস সঞ্চার হল। কল্যাণ স্কুলের সেই মেধাবী ছাত্রীদের দলে আবার ভিড়ে গেলাম। ওরা আমাকে বললো, তোমার জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখ না কেন? মুসলমান সমাজে এখনও মেয়েদের বিয়ের নামে প্রহসন হয়! শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায় থাকলেই এর শিকার। বেগম রোকেয়ার বই পড়েছ। কিভাবে লিখতে হয়, বুঝে নিও। রাত জেগে লিখতে থাকি, কিন্তু মনমতো হয় না। কেবল মনে আসে মায়েরা মেয়েদের পশুর মত কোরবানি দেয়, পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য বেহেস্তে যাওয়ার কি মোহ-আশ্চর্য। নিজের মাকে দোষী করলাম। রাগে-দুঃখে ছিড়ে ফেলি, আবর্জনা লাগছিল নিজেকে পর্যন্ত। কিন্তু লেখার জন্য প্রতিরাতেই বসতাম। শেষে মুসলমান মেয়েদের সমাজে সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবা হয় না-এ জাতীয় কিছু লিখে ওদের কাছে দিয়েদিলাম। ওরা রেখে দিল বটে, তবে বলে দিল তোমার আরও পড়তে হবে। লেখার বিষয়বস্তু ঠিক বোঝাতে পারনি।

দিন যায়, আগের মত আমরা আশ্বিনের ছুটিতে বাড়ি গেলাম। সেখানেও জেঠাতো বোনেরা পাকড়াও করে, বিয়ে হলো, বর ছাড়া এলি কেন! আমাদের ভয়ে! তোকে কেমন চমৎকার বয়স হতেই বিয়ে দিলেন চাচাজি আর দেখ-এই আমরা, আইবুড়ো সব কয়টি। কবে যে বর জুটবে। তোদের মত শহরে থাকতাম, পড়তাম-তাহলে কপাল খুলতো। মেয়েদের জন্মই হয় বিয়ের জন্য … সংসার ধর্ম করা পুণ্যের কাজ … ইত্যাদি … এক একজন সতের থেকে উপরে… আমার অবাক লাগে… ওদের কেন বিয়ের জন্য এমন হাহাকার! পরাধীন হয়ে কী লাভ! ভাত-কাপড়ের অভাবতো নেই। আমিও ঝগড়া করে বলতাম, চল না শহরে। আমাদের বাসায়। থাকবে। মায়ের এক মামা আছেন, ঘটকালি করেন। বাবা বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। আসলে এসব ছিল খুনশুঁটি, গ্রামের মেয়েদের আরও তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়, এরা মিঞাবাড়ির মেয়ে। উপযুক্ত পাত্রের খবর সম্ভবত আসছে না। হিন্দু ধর্মের মত আমাদের মধ্যে পেশাদার ঘটক নেই, সেটা একটা সমস্যা।

এদিকে আমার ছোট ভাই পিন্টুর সাংঘাতিক অসুখ টিটেনাস। অবশেষে দেহে খিচুনি দেখা দিল। গ্রামে ভাল ডাক্তার নেই। মা এর আগ থেকে কলজে ব্যথায় ভুগছিলেন। কবিরাজি চিকিৎসায় ছিলেন। এখন পিন্টুর অসুখ এবং কষ্ট দেখে উনি নিজেই মৃতপ্রায়, কে কাকে দেখে। জেঠাজি কোথায়ও শুনে এসেছেন, মোটা বাঁশের এক গিট থেকে অপর গিটের মধ্যে নিজের থেকে ধনুক লতা সৃষ্টি হয়, ওটা পাওয়া গেলে তার ভিজান পানি খাওয়ালে ধনু রোগ (টিটেনাস) সেরে যায়। চারদিকে লোক পাঠান হল, যে সব বাড়িতে এ বাঁশ পাওয়া যায়, কিংবা যার ঘরে এই মহৌষধ আছে, তক্ষুনি যেন হাজির করে। সকলের মুখে এক কথা, আল্লাহ ওকে ততক্ষণ হায়াত দিয়ে রাখ। কয়েক গ্রাম চষে পাওয়া গেল বাঁশের ধনু এবং ভাইকে খাওয়ান হল। আশ্চর্য ফললাভ হয়েছিল। এদিকে যখন ওর অবস্থা সামান্য উন্নতির দিকে, তখন শহর থেকে ডাক্তারও উপস্থিত হয়। ও ভাল হল, কিন্তু মা। একেবারে শয্যাশায়ী থাকলেন। এবং ভাল হলে পর কালবিলম্ব না করে আমরা শহরে চলে আসি। আমার দাদিমা তখন অসুস্থ ছিলেন, তথাপি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন শুয়ে থেকে। দাদিমাকেও সেবার শেষ দেখে আসি। উনি বলেছিলেন, আমার বয়স হয়েছে, আল্লাহ তুমি আমাকে তুলে নাও, এই মাসুম বাচ্চাকে ওর মাবাবার বুক ভরিয়ে আয়ু: দাও। দাদিমার দোয়া কবুল করেন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা। তাঁর মৃত্যুও বড় শান্তিতে হয়েছিল। শুনেছি সকলের থেকে মাফ চেয়ে, আল্লাহর কালেমা পড়তে পড়তে চোখ। বুজে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন।

জীবনে কত রহস্য আছে, আবার তাকে মানুষই ভাঙে, কখনও গড়ে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কলকাতা থেকে চিঠি পেলাম, উনি আসছেন। আমি সহজ আনন্দে এ যাত্রা তার আসাকে গ্রহণ করতে পারলাম না। ঝটপট ফেরত ডাকে জানিয়ে দিলাম, গত পরীক্ষাগুলো। অসম্ভব ভাল হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষায় খারাপ করতে পারবো না। সেটা নিন্দনীয় কাজ হবে। আপনি এখন আসবেন না। অতঃপর পরীক্ষা চলার সময়ে আমার নামে এক পার্সেল এলো। আমি স্কুলে ছিলাম বলে ফেরত গেল এবং পরের দিন বার লাইব্রেরিতে বাবার সই নিয়ে পার্সেলটি দিয়ে যায়। চিঠিপত্র নেই, ছিল প্রত্যেকের জন্য কাশ্মিরি শাল, বাবার জন্যও কলকাতার ওয়াসেল মোল্লার দোকানের পছন্দসই জিনিস। আমরা শীতের কাপড় দেখে খুশি, আগে এসব পরিনি। পরে স্কুলে গেলাম। বাবাও কাঁধে তুললেন সুন্দর নকশাপাড়ের চাদর। শুধু মা পরলেন না। কেবল হাত বুলিয়ে কয়েকবার চোখের পানি মুছে নিয়েছেন। আরও ঘটনা এসে দাঁড়িয়েছে আমার দুয়ারে। উনিশ শ বিয়াল্লিশের মার্চ মাস। বসন্তের বাতাস মন মাতিয়ে তুলেছে। প্রজাপতির সংবাদ। উনি আসছেন। একদিকে আমার বুকে দুরু দুরু শঙ্কা, অন্যদিকে বাড়িতে সাজোসাজো রব। রান্নাঘরে ঠাঁই হচ্ছিল না। মা একে একে সুখাদ্য বানিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িঘর রঙিন কাগজে সাজিয়ে দিচ্ছে আমার ভাই-বোন দুজনে। আমার লজ্জায় লুকোবার জায়গাটুকও নেই। সারাবাড়ি উৎসব করছে। তাকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসেন মুহুরি সাহেবরা। ভাই বাট্টও সাথে। বাড়ি পৌছলে বাবা ও মাকে সালাম করলেন। মা ছিলেন আড়ালে, পায়ে মোজা। জামাইএর সাথে তাকে পর্দা করতে দেখলাম। তারপর পথের ক্লান্তি বিনোদনের জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম এগিয়ে দিচ্ছিল চাকররা, একজন ক্রমান্বয়ে হাত পাখা করে যাচ্ছে। খাওয়ার আয়োজনে দুলামিঞা একা বসলেন না, স্ত্রীর ভাইবোনরা বসে-এই নিয়ম। নুরজাহান এবং বাটু দুজনেই খুশি হয়ে বসেছে। মা আড়াল থেকে তদারকি করে চলেছেন। ছোট খালা আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। আমি তখন ‘খুলিয়া দক্ষিণ দুয়ার কল্পনায় অবগাহন করছিলাম কিনা বলা কঠিন। খালা ডেকে বলেন, তোর খাবার, জলদি খেয়ে নিতে বলেছেন বুবু।

আমরা দু’বোনে একত্রে শুই। একখানা পড়ার টেবিল দুজনের। এক আলনায় কাপড় গোছাই। ঘরের দেয়ালে ছবি এঁকে ঝুলিয়ে রাখি। মেঠোপথে গরু নিয়ে ছেলেরা যাচ্ছে এবং পুকুর থেকে কলসি কাঁখে একটি মেয়ে পানি আনছে, এ দুটো ছবি বাঁধিয়ে রেখেছি। আমার এ ছবি দুটো লেডি কারমাইকেল ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিল, সেজন্য বাধিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম কেন বাড়তি একটা লোক এসে আমাদের মধ্যে ঝামেলা করে দিল। এদিকে খোলা দরজা দিয়ে চাকরের মাথায় নিজের সুটকেসসহ তাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। কী করবো, ভেবে না পেয়ে পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে গেলাম। শব্দ পাচ্ছি সুটকেশ খুলছেন। আমার সামনে এক বাক্স চকলেট, লজেন্স রেখে গম্ভীর মুখে বললেন, খুকির রাগ ভাঙাতে আর কি চাই? বই এখন তুলে রাখ।

আরও অনেক সদাই একের পর এক সুটকেস থেকে বের করেন আর বলেন, কলকাতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বুঝি লেগেই গেল। জাপানিরা কলকাতা আক্রমণ করবে এই শুনেই জিনিসের দাম বেড়ে গেল। তোমাদের পছন্দ হয়েছে? নুরজাহান এবং বাটু অবাক হয়ে দেখছিল কলকাতার কাপড় জামা। কলকাতার মানুষটিকেও। উনি যুদ্ধের খবর বলে যাচ্ছিলেন, ফেনী শহর যুদ্ধঘাঁটি হয়ে যাচ্ছে, এয়ারোড্রোম বানানো শেষ, সৈন্য উঠানামা করবে। ‘Feni has become the London of the East.’ ব্রিটিশ জায়গাটা কেন বেছে নিল, বলতে পারবে? কলকাতা থেকে উড়ে আসা যাবে যখন তখন, কাছাকাছি কিনা। আমাদের ভয় দেখাতে এসব বলছিলেন। নোয়াখালীতেও বােমা পড়তে পারে বললেন। আমার ভাই বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে দিল ‘জানি’ জাপানি প্লেন দেখা যায় না, অনেক উপর থেকে বোমা ফেলবে।

ও ‘দেরি আছে, এত সোজা না’ বলে নুরজাহান চলে যাচ্ছিল, ও তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্রী।
ও তাহলে তো ভাল, আমি তোমাদের কলকাতায় নিয়ে যাব। বোনের সাথে যাবে না?
ও আমি আপনার কাছে যাব কেন? আপা কেন যায় না? ওকে ধরে নিয়ে যান দুলাভাই। বলেই ছুট দিল নুরজাহান। এবার আমাকে যেতেই হবে, রেহাই পাব না। সামনে টেবিলে সাজান বই, ম্যাট্রিক সিলেবাস দেখে আগাম কিছু বইও টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিলাম। ওদিকে তাকাতে গিয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম। আর উনি হাসছেন, কলকাতার মেয়েরা পড়ে, মুসলমান মেয়েদের জন্য সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুল আছে, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ করেছেন। লেডি ব্রাবোর্ন কে জান? বাংলাদেশের লাট সাহেবের স্ত্রী, বিলাতি মেম সাহেব, কিন্তু মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য খুব চেষ্টা করে ঐ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করলেন। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।

আমার কলকাতা যাওয়ার খবর স্কুল পর্যন্ত পৌছে গেল। সৌদামিনী চৌধুরী তার শিক্ষকদের নিয়ে ছুটে আসেন। সেকি কথা। ওকে এখন নিতে এলেন কেন জামাই বাবাজি। ওতো স্কুলের আশা-ভরসা। ও ভাল রেজাল্ট করলে-আপনারও আনন্দ, আমাদেরও লাভ। নোয়াখালী জেলা স্কুলের সঙ্গে আমরা কমপিটিশন দিয়েছি। ও স্কুলের নাম রাখবে। অন্য মেয়েদের জন্য আদর্শ স্থাপন করবে।

শুভাকাঙ্খী শিক্ষকদের কথা তিনি না শুনে পারেন কী করে! এমন শিক্ষকদের কাছে আপনি মাথা নুইয়ে আসে, মুখে কথা বলা বেয়াদপি হয়। অথচ বড় আশা করে ছুটে এসেছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন, অভাবনীয় অলংঘনীয় বাধা পেয়ে তিনি ফিরে গেলেন। মাত্র দু দিন থাকলেন।

এবার ছুটিতে আসার মূলে তার এক প্রিয় সহকর্মী বন্ধু সাহিত্যিক বিমল কর। তখন তিনি কবিতা লিখতেন। ‘তোর বৌ দেখালি না সেলিম’। তার ফর্সা মুখ লালচে হয়ে গেল লজ্জায়। বৌ আনতে পারেননি-এ কথা শুনে কানটা ধরে কয়েক টান দিয়েছিল কর বাবু। বুঝেছি তুই একটা ইডিয়ট। মুসলমানদের ঘরে কচি কচি বৌ পাওয়া যায়। দেখতে কত মিষ্টি। আর তুই কিনা আস্ত বেরসিক। ওকে নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখবো-কত আশা করে রেখেছি। .[ কলকাতার বাসায় আমি যাওয়ার পর স্বামী একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। তার বন্ধু বিমল কর আমাকে এক তোড়া তাজা গোলাপ ফুল এবং কবিতা উপহার দিয়েছিলেন।

(ক্রমশ)

আমার এক নদীর জীবন (প্রথম পর্ব)

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share