আবু বকরের জবানবন্দী

।। ক্যামেলিয়া আলম ।।

এমডি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি কি বুঝতে পারছেন? আপনার চাকরির নিয়োগপত্র অনুযায়ী আপনার দুই বছর দুই মাস আগে চাকরি শেষ হয়ে গেছে। এই বাড়তি সময় অবৈধ ভাবে ছিলেন।’
‘স্যার, আমি তো কাজে ফাঁকি দেই নাই। প্রতি ঈদের সময়ও আমি একাই ডিউটিতে থাকতাম।’
কিঞ্চিৎ কঠোর গলায় এবার বললেন,‘ আপনি যে বাড়তি সময় ছিলেন তা এক ধরণের প্রতারণা। আপনি কি বুঝতে পারছেন? আপনি কেন আমাদের জানাননি?’
‘স্যার, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার বয়স।’

আবু বকরের জবানবন্দী

আবু বকরের সমস্যার মানবিক কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে কিনা জানা নাই। কারণ তার সমস্যার মাঝে অর্থনৈতিক ধ্বস যেমন আছে, তেমনই চতুরতার ইঙ্গিতও আছে। আবার তাকে চতুরতা বলা যাবে কিনা নাকি শুধুমাত্রই সে জগত সংসারের হিসাবনিকাষে উদাসীন সেও ধাঁধায় ফেলে দেয়। তবে অবস্থাদৃষ্টে এটুকু দৃশ্যত যে সে এক বিচ্ছিরি সমস্যায় নিপতিত হলো। আর তাতে তার মানবিক, সামাজিক, পারিবারিক এক বিপর্যয় ঘটে গেল। 

২২ এপ্রিল, রবিবার, সকাল ৬টায় ঘুম ভাঙলো কর্কশ এক বালতি টানার শব্দে। এমনিতেই কিছু দিন হয় ব্লাড সুগারের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রেশার বাড়ছে। প্রেসারের ওষুধ ক্যাভাপ্রো ৭৫ আগে ভাগ করে দুইদিন খেতো। প্রেসারটা না নামাতে হার্ট এটাকের ভয়ে এখন একটা খাওয়াও শুরু করেছে। তবু প্রেসারের যন্ত্রে ১৬০ আর ১১০ হয়ে কেমন নষ্ট ঘড়ির কাটার মতো একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে। তো কর্কশ ডাকা সেই সকালে খুব বিচ্ছিরিভাবে ঘুমটা ভাঙাতে মনটা তেতো হয়ে থাকলো। কিন্তু মনের তিতা দেখা যায় না বলে আর তার ভারী ভ্রু-এর নীচে কোটরাগত দুইটি চোখ, কপালে ভারী ভাজ আর চোয়াল বসে যাওয়া নির্বিকার মুখ একইরকম দেখে সাহারা বানু বুঝতে পারে না সাত সকালে বালতি এভাবে হেঁচড়ে নেয়ায় আবু বকরের মানসিক বোধের কথা। এছাড়া বোবা মানুষের শত্রু নাই বা বোবা মানুষের সাথে লড়াই করা যায় না বলে মিথটা এই ৩৬ নাম্বার রাজারবাগের একতলা চলটে ওঠা নীল দেয়ালে বেমালুম মিথ্যা হয়ে আছে। নির্বিকার মুখের আবু বকরকে একটানা ৪ ঘন্টা গালমন্দ করার রেকর্ডও আছে সাহারা বানুর। বড় ঘর থেকে ছোটলোকের ঘরে এলে তার দুর্গতি ঠিক কতটুকু তা বিবাহিত জীবনের ৪৫ বছরে আবু বকর হয়তো ৪ হাজারের অধিকবার শুনেছে। যে কোন ঘটনা থেকেই মেজাজ গরম হোক না কেন শেষ হয় সাহারা বানুর এই বিলাপ দিয়ে।

যেমন, বহু বছর আগের ঘটনার সূত্রপাত করি। আড়াই বছরের রিয়াকে আবু বকরের সামনে বসিয়ে সাহারা বানু রান্না ঘরে গেছে। মেয়ের হাতে পুতুল আর ঝুমঝুমি বেশ কয়েকবার বাজিয়ে বিরক্ত আবু বকর মেয়ের সামনে ঝুমঝুমিটি রেখে টেবিলে রাখা খবরের কাগজটি আনতে গেছে। আবু বকরের বোধের বাইরে ছিলো যে, সেই মেয়ে ঠিক দশ সেকেন্ডে এক গোলাপী ঝুমঝুমির প্রতি আগ্রহ হারাবে আর খাটের মধ্য থেকে এতো দ্রুত স্থানান্তর হবে।  ফলে সেই মেয়ে মেঝেতে, একই সাথে পড়ার শব্দ আর চিৎকারে সাহারা বানুর ঠিক পনেরো সেকেন্ডের মাঝে প্রবেশ। আর এরপরই দ্রুত আবু বকরের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বরফ ডলতে ডলতে  বড় ঘর থেকে ছোট ঘরে আসবার ব্যর্থ ভাগ্যের আহাজারি। আবু বকর প্রায়ই ভাবে, এই সাহারা বানুকে সে কী চেনে? বাবা মা মরা আবু বকরকে নিয়ে ওর মামা যখন কাজী বাড়ি গিয়ে স্নিগ্ধ এই মেয়েটাকে দেখলো নত মুখের। আবু বকরের মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেছিলো। বেসরকারী অফিসের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করা আবু বকর সামান্য বেতনই পেতো, উপরিও মাঝেসাঝেই ভাগ্যে জুটতো। তবে সংসারে অভাববোধটা কী করে যেন স্থায়ী হয়ে গেছিলো। বারেবারেই ভাবতো, আর কয়েকটি দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কই ? ঠিক তো হল না।

বিয়ের প্রথম এক মাস খুব ভালোভাবেই কাটলো। আত্মীয়স্বজনের উপহারের টাকায় ওই একটা মাসই আবু বকর আর সাহারা বানুর প্রেম জাগ্রত থাকলো। এরপরে পিয়াস এলো গর্ভে। তখন থেকেই সাহারা বানুর ছ্যানছ্যানে ব্যবহার পাওয়া শুরু। আবু বকর ভাবলো, বাচ্চা পেটে থাকলেই এক ধরণের মেজাজ ঘিরে থাকে নারীদের মুখ জুড়ে। এও তা। কিন্তু তা স্থায়ী হয়ে গেল সাহারা বানুর সাথে। ছেলে পিয়াস হবার পরে শুরু হলো আসল টানাটানি। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি মানেই অফিসের বসের আর্দালির কাজও করিয়ে নেয়া জীবন। ফলে প্রাণান্ত পরিশ্রমের পর যখন সাহারা বানুর সামাজিক অবস্থান রাখায় ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকলো আবু বকর তখন থেকেই তার ছোটলোকের সাথে বিয়ের পস্তানি শুরু। আবু বকর কিন্তু তখনও বিশ্বাস করেছিল অর্থকষ্ট আর আহাজারির জীবন সাময়িক। দুধের বাড়তি পয়সা কমে গেলেই খরচ কমে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। কিন্তু এরপরে রিয়ার আগমন ঠিক হতে দিলো না। আগের অবস্থাই বজায় থাকলো। যদিও বেতন বাড়লো এর মাঝে তিনগুণ। কিন্তু খরচ বাড়লো এবার তারও তিনগুণ । এই করতে করতে হাল ছেড়ে দীর্ঘ বছরগুলো পাড়ি দেয়ার চিত্রগুলো সেলুলয়েডের মতোন দেখতে থাকে আবু বকর। প্রতিদিনের হন্যে হওয়া জীবনকে বয়ে যেতে দিত কেবল। সেই জীবনটা এইবার সত্যিকারের প্রশ্নের মাঝে পড়লো আজ। এর পেছনে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই আবু বকরকে দায়ী করতেই হয় আমাদের।

বালতির শব্দে ঘুম ভাঙা আবু বকর বালিশের নীচে সিম্ফোনি মোবাইল খানা বের করে দেখলো ৬ টা বেজে ১৬। ধীরে উঠে বাড়ির একটা মাত্র বাথরুমে আগে যাওয়া। ছেলেমেয়ে ওঠার আগেই বাথরুমের কাজ সারতে হয়। কারণ, প্রত্যেকেরই ব্যস্ত জীবনের ধাক্কাধাক্কি নাহয় শুরুই হয় বাথরুমের দরজায়। বাথরুমে ঢুকতে গিয়েই মাথায় এক ধাক্কা খেলো। এই ধাক্কার কথাটা মনে থাকাটাও মিথের কারণে। কারণ এই ধাক্কাতেই নাকি দুর্গত ভবিষ্যতের আভাষ মেলে। কিন্তু তার এই ৬২ বছর তিন মাস দশদিন বয়সে কি কখনও আর ধাক্কা খায়নি?  না খাবার কি কথা? ভাবতে থাকে আবু বকর। তো সেই ধাক্কাটাকে মামুলি ভেবে মাথা ডলতে থাকা আবু বকর বাথরুম সারে। বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে রেডি হতে হতে মা মেয়ের ধাক্কাধাক্কি টের পায় আবু বকর বাথরুমের দরজায়।

আবু বকর কিন্তু তখনও বিশ্বাস করেছিল অর্থকষ্ট আর আহাজারির জীবন সাময়িক। দুধের বাড়তি পয়সা কমে গেলেই খরচ কমে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। কিন্তু এরপরে রিয়ার আগমন ঠিক হতে দিলো না। আগের অবস্থাই বজায় থাকলো। যদিও বেতন বাড়লো এর মাঝে তিনগুণ। কিন্তু খরচ বাড়লো এবার তারও তিনগুণ । এই করতে করতে হাল ছেড়ে দীর্ঘ বছরগুলো পাড়ি দেয়ার চিত্রগুলো সেলুলয়েডের মতোন দেখতে থাকে আবু বকর। প্রতিদিনের হন্যে হওয়া জীবনকে বয়ে যেতে দিত কেবল। সেই জীবনটা এইবার সত্যিকারের প্রশ্নের মাঝে পড়লো আজ। এর পেছনে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই আবু বকরকে দায়ী করতেই হয় আমাদের।

ইতিমধ্যে সাহারা খাতুনের ঘুম চোখের ভেজা মুখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরে গিয়ে এক ডানোর পট নিয়ে সামনের সবুজ রাবার ক্লথের ছোট টেবিলটায় রাখে। টেবিলের কাছের র‍্যাক থেকে থালা নিয়ে সেই পট থেকে আবু বকর একগাদা ছাতু থালায় ঢালতে ঢালতে বলকে উঠা গরম দুধ সামনে রেখে যায় সাহারা বানু। আবু বকর হাত ডুবিয়ে তা চটকে বলের মতোন করে মুখে পুরতে পুরতে মোবাইলের সময়টা দেখে ৭টা ১০। এরপরই থালায় হাত ধুয়ে দ্রুত বের হতে গিয়ে আরেক বাধা। সাহারার চিৎকার, বলি, চোখের মাথা খেয়ে বসে আছ? শার্টের এ কী দশা! নিচু হয়ে তাকাতেই চোখে পড়ে বুতামের ঘর ভালোই উল্টোপাল্টা। প্রায় দুইটা ডিঙিয়ে লাগানোতে শার্ট একপাশ দিয়ে প্রায় আধাহাত উঠানো। বামপাশে শার্টের চেপে বসার রহস্য ধরতে পারলো আবু বকর। ফলে গেটের কাছে আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে যখন পথে নামলো তখন প্রায় পৌনে ৮ টা। ৮টার মাঝে অফিসের স্বাক্ষর। প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ ব্যাপারে সামান্য ঢিলাও দেয় না। অন্যদিন রাস্তায় পা চালিয়ে হাটলেও আজ দ্রুত ২০ টাকায় রিক্সা নিয়ে নিলো সময় বাঁচানোর জন্য। অফিস গেট এ ঢুকলো ঠিক ৭ টা ৫৬ মিনিটে।

দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার রুমে গিয়ে খাতায় স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখে এক বড় লাল কালির আঁচড় টেনে কাটা তার সারা মাসের এটেনডেন্সের পাতা। আর দুইদিন বাকি ছিল মাসের। পাশেই দাড়াঁনো শরিফ মিয়ার চোখেও পড়লো। দুইজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আবু বকর চিন্তায় পড়লো। প্রতিষ্ঠানে এমন কোন অসদাচরণ করেছে কি সে? তার উপস্থিতির স্বাক্ষরের জায়গা কেন কাটা ? নির্বিবাদী আবু বকর প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, সে এখনও আসেনি। ইতিমধ্যে দুলাল মিয়া, মালেক, শায়দুল, বিলকিস, ফজিলা একে একে স্বাক্ষর করতে লাগলো। আবু বকরের সমস্যা তাদের গল্পের বিষয় হিসেবে সকালেই স্থান পেলো? প্রত্যেকেই জানতে চাইলো, অফিসের সাথে তার কী ঝামেলা? আবু বকর প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বেশ কয়েকবার রিং করাতে অপর প্রান্ত থেকে খবর পেলো, আপনি আমার রুমেই বসেন। কাজে যাবেন না। কথা আছে। ৯ টা অবধি সামনে থাকা মনা মণ্ডলের সাথে তার আঁচিলের সমস্যা নিয়ে বহু কথা বললো। আঁচিলের সমস্যা যে ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ তা নিয়ে কথা বলতে বলতেই দরজা ঠেলে ঢুকলো শাহজাহান তালুকদার। প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আড়চোখে আবু বকরকে দেখে নিজ টেবিলে বসে আগে কম্পিউটার ওপেন করা শুরু করলো। এরপর আবু বকরকে ডাকলো। আপনি একটু বসেন, স্যার আসলে আপনার সাথে কথা বলবে। আবু বকর বলতে চাইলো, তার এটেনডেন্সের পাতা কাটার বিষয়। হাত নাড়িয়ে কথা বন্ধ করে দিলো শাহজাহান তালুকদার। আবু বকর ভাবতে চেষ্টা করলো, প্রতিষ্ঠানটি বড় হচ্ছে। নবীন কর্মকর্তা কর্মচারী প্রচুর নিয়োগ পাচ্ছে। তাকে কী স্যাক করা হয়েছে তবে! গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বললো, স্যার, আমার চাকরি কী নাই? ফাইল চোখের সামনে ধরা শাহজাহান তালুকদার এক পলক তাকালো আবু বকর্রে দিকে। কিন্তু বললো না কিছু। গভীর মনোযোগে কাজে ডুবে গেল। শাহজাহান স্যারকে অচেনা মনে হল। সর্বসময় কাজে ব্যস্ত আবু বকরের চোখের সামনে ভাসতে থাকলো বিভিন্ন রুমের তালা খোলা, টেবিল মুছে বসে স্যারদের ফাইলগুলো গুছিয়ে বিভিন্ন টেবিলে দিয়ে আসা, মাঝে সাঝে চা পানি আনতে দোকানে যাওয়া। স্যারদের প্রতিদিনের সংসারের গল্প, রাজনীতির হালচাল আর প্রশাসনের মুন্ডুপাতের শব্দগুলো ভীড় জমাতে লাগলো আবু বকরের মাথায় । ঠিক দশটায় শাহজাহান তালুকদারের টেবিলের ফোন ঝনঝন করে বেজে উঠলো।

 আবু বকরকে সাথে নিয়ে এমডি’র রুমে আসে প্রশাসনিক অফিসার। এমডি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বসতে বলে এক ঠাণ্ডা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকলো দণ্ডায়মান আবু বকরের দিকে। গলা খাঁকারি দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কথা শুরু করে ‘ আপনার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই বছর দশ মাস। বুঝতে পারছি, এ আমাদের ভুল।’ শাহজাহান তালুকদারের নত মাথার দিকে এক ঝলক তাকালো। ‘ কিন্তু আপনি কী জানতেন না আপনার চাকরি শেষের সময়টি? নিশ্চয়ই জানতেন। আপনি অফিসকে তা অবগত করেননি।’ আবু বকর শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকলো।‘ গত দুই বছর আপনাকে বেতন দেয়া হয়েছে ভুলবশত। আপনাকে যে এগার লক্ষ নব্বই হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। তা অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে’।

আবু বকরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ‘স্যার, আমার চাকরি আর থাকছে না?’ 

এমডি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি কি বুঝতে পারছেন? আপনার চাকরির নিয়োগপত্র অনুযায়ী আপনার দুই বছর দুই মাস আগে চাকরি শেষ হয়ে গেছে। এই বাড়তি সময় অবৈধ ভাবে ছিলেন।’
‘স্যার, আমি তো কাজে ফাঁকি দেই নাই। প্রতি ঈদের সময়ও আমি একাই ডিউটিতে থাকতাম।’
কিঞ্চিৎ কঠোর গলায় এবার বললেন,‘ আপনি যে বাড়তি সময় ছিলেন তা এক ধরণের প্রতারণা। আপনি কি বুঝতে পারছেন? আপনি কেন আমাদের জানাননি?’
‘স্যার, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার বয়স।’
শোনেন, উকিলকে হাইকোর্ট চেনাবেন না। চাকরি করার দিন থেকেই আমাদের চাকরি শেষের হিসাব নিকাষের দিন গুণি। এ এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সাহায্য সংস্থা না। নিয়মের বাইরে এক ঘটনা এখানে ঘটে গেছে। আপনি জানেন? আপনার জন্য কতজনের প্যানাল্টি হয়েছে কাজে অবহেলায়।’
‘কিন্তু স্যার..’

এবার শাহজাহান তালুকদার হিসহিস করে বললো, ‘আপনি বাড়তি কথা বললে শুধুশুধু আইনি ঝামেলায় পড়বেন। মিউচুয়ালি বিষয়টি মিটমাট করে ফেলুন। আপনার গ্রাচুয়েটি তো তেমন নাই, আপনি বেশ কয়েকবার লোন নিয়েছেন। সর্বশেষ ছেলের ফরম ফিলাপের জন্যও ত্রিশ হাজার তুললেন। এখন প্লাস মাইনাস করে আপনি দুই লাখ টাকার মতোন পাবেন। তবে আপনার এগার লাখ টাকা শোধ করার পরেই কেবল টাকাটা আপনি পাবেন।’ 
আবু বকর তবু বোকার মতোন বলে, ‘আমি কী করে  পাবো এই টাকা? কে দেবে?’
শাহজাহান তালুকদার বলে,‘ দেখেন, আপনি না দিতে পারলে মামলায় জড়িয়ে যাবেন। বুঝতে পারছেন কী ঝামেলা?’
আবু বকর ঘ্যানঘ্যান সুরে তবু বলে, ‘আর স্যার আমার চাকরি? এতো এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কোনভাবে যদি.. ।’

এমডি এবার মুখ খুললেন, ‘আপনি এবার আসতে পারেন।’ শাহজাহান তালুকদারকে শুধু জানালো, ‘ওনার অফিসিয়াল প্রসিডিওর শেষ করে দিও আজই।’

আবু বকরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ‘স্যার, আমার চাকরি আর থাকছে না?’ 

সব ফরমালিটি শেষে আবু বকর যখন বেরিয়ে আসে অফিস থেকে তখন সূর্য হেলে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে। সাদা দেয়ালের হলুদ বিবর্ণ রেখার বারান্দায় একবার চোখ গেল। ভ্যাপসা দুপুরে কেউ নাই সেখানে। প্রতারণার ভার ছাড়াও আবু বকরকে জেঁকে ধরলো আরেক অস্বস্তি। প্রতিদিনের অভ্যস্ততার সংজ্ঞায় এখন তার কেবল স্থিরতা। মামুলি এক ছাপোষার জীবন থেকে চলমানতা হারিয়ে গেলে কার কী যায় আসে? তাই তো রাস্তায় নামা আবু বকরকে ব্যস্ত হয়ে পাশ কাটালো আরেক আবু বকর। আবু বকর তাকে দেখে।

মাথার উপর পড়ন্ত বিকেলের আলোয় পার্কে গিয়ে বসে থাকা আবু বকর ভাবে, আবু বকর তো সত্যিই জানতো না তার কাজের সমাপ্তি দিন। অফিস থেকে ৩৬ নম্বরের বাড়ির কাছে প্রতারক হিসেবে প্রমাণিত হওয়া আবু বকর শেষ জবানবন্দী দেয় নিজের কাছে,  ত্রস্ত জীবনের হিসাব মেলাতে মেলাতে বয়স ভুলে যাওয়াই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতারণা।

ক্যামেলিয়া আলম

সহকারী, অধ্যাপক, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা। গল্পের পাশাপাশি প্রবন্ধ লেখেন। কিছুদিন ‘বার্তা-২৪’-এ ‘নারীশক্তি’ পেজের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। একসময় থিয়েটার সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

Share