আফগানিস্তানের কবিতা

।। অনুবাদ: অমৃতা সরকার ।।

“যে কবি লিখেছে শেকলের কথা
সে কি জানে রাতে কেমন শীত কারাগারে?
তাকে কি কখনো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বিছায় ভরা গর্তে
তার হাড়ের ভিতর বারংবার হূল ফোটে?
আমি কখনো ভুলতে পারি না সেই জ্ঞানীর কথা:
দেশ জ্বলে যে আগুনে, সে আগুন ধরানো হয়েছিল দেশেই।”

আব্দুল বারি জাহানি

শাকিলা আজিজ্জাদা

কাবুল

কাবুলের জন্য যদি
আমার বুক ধুকপুক করে,
তাহলে সে বালা হিসারের ঢালের জন্য
যার পায়ের কাছে শুয়ে আছে
মৃত পরিজন।

যদিও ধুকপুকাবে না,
কোনো হৃদয়
আমার জন্য।

যদি আমার মন কাঁদে
কাবুলের জন্য,
তা শুধু লায়লার দীর্ঘশ্বাস
‘হে! আল্লাহ!’
আমার বুড়ি দাদীর হা হুতাশ।

এ শুধু গুলনারের জন্য
যার চোখ তন্নতন্ন করে সব রাস্তা
ভোর থেকে সাঁঝ, বাহার থেকে পতঝড়,
এই চেয়ে থাকার কাছে
পথেরা কেমন ছন্নছাড়া
আমার কিশোরকালের দুঃস্বপ্নে
অলিগলি যেন খোলস ছাড়ে।

যদি আমার বুক কাঁপে
কাবুলের জন্য,
তা শুধু ধীর পায়ে আসা গরমের দুপুরের খাতিরে,
আমাদের সাবেক বাড়ির দুপুরঘুমের জন্য,
সে বাড়ি মধ্যদিনের ঘুমে ভারী
আমার পাঁজরে চেপে বসে আজও ।

ডান কাঁধের দুষ্টু জ্বিনটা
ছুটে আসা বুলেট থেকে বাঁচতে
ভুলে যায় প্রায়ই।

সেই ফেরিওয়ালাদের হাঁকের জন্য,
সবজিওয়ালাদের টহলের জন্য,
যা হারিয়ে গেছে আমার পড়শির ভেঙে যাওয়া ঘুমে,
সেই সবের জন্য আমার মন কাঁপে।

তেলাওয়াত

তার নাম, নাজনিন, আরও হাজার
নরম স্পর্শের মতো
পুড়িয়ে দিচ্ছে তার মায়ের গলা
আগুনের মতো , হল্কার মতো।

তার বুক খুঁড়লে হয়তো
দেখবে লুকোনো হাজার
স্মৃতির তোরঙ।

লা ইলাহা ইল্লালাহু!
মোল্লা পথের থেকে খানিক দূরে।
তুলসি সুবাস মিলছে হাওয়ায়
লা ইলাহা! থেমে যায় তার দোয়া।

এলানো চুল গুছিয়ে দেয়
তার মায়ের আঙ্গুল
কানের উপরে তুলে দেয়
একটা একটা চুলের গোছা।

মায়ের কোলে
তার মাথা এলানো,শুয়ে আছে,
ডুবে আছে যেন ফুলের চাদরে।

নাজনিন! তার মা ডুকরায়,
মাথা চাপড়ায়,আঙুলের ফাঁকে
সাদা চুল যেন ছিন্নভিন্ন
ঝোপ গমের, যবের।

সফেদ চাদর সরে যায়।
বুকের ক্ষত, সেই মেয়েটির বুকের ক্ষত
উদোম হয়ে যায়! মায়ের ক্ষত তাজা হয় আরও!

লা ইলাহা… মোল্লা বিড়বিড়ায়।

আতর ছেটানো বন্ধ করে
সে মুখ ফেরায়।

কর্পূরের বাস মিশে যায়
বিলাপে, অভিযোগে-
খোদা এখানে নেই।
খোদা এখানে নেই।
খোদা এখানে নাই।

শাকিলা আজিজ্জাদা

জন্ম ১৯৬৪ সালে কাবুলে। নেদারল্যান্ডসের ইউট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচ্যীয় ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর পড়াশুনা। নেদারল্যান্ডসেই বসবাস করছেন। যদিও নিজের দেশ আফগানিস্তানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। কবিতা ছাড়া|ও গল্প লেখেন নিয়মিত। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ও গল্পের বই রয়েছে।

রেজা মোহাম্মদী

বৃষ্টি

যদি বৃষ্টি হয়
মরহুমের জুতো পায়ে দিয়ে
বাড়িতেই আটকে যাবে আমার বন্ধু
বন্ধ হয়েছে শহরের ফাটক।
মুখ থুবড়ে পড়েছে রীতি রেওয়াজের থাম
একের পর এক।
বদলা নেওয়ার আগে
নিজেদের মৃতদেহ লুকিয়েছি মাটির নীচের ঘরে
পুঁতে রেখেছি বারুদের বাক্সের নীচে
পূর্বপুরুষের ক্রোধের তলায়।

যদি বৃষ্টি হয়
বদলা নেওয়ার দিন পিছিয়ে যাবে আবার।

বৃষ্টি পড়া অপরাধ
বৃষ্টি নষ্ট করে স্বপ্ন
যদি বৃষ্টি হয়
সে রাস্তা থেকে ধুয়ে ফেলবে
আমার রক্ত।

তুমি সীমান্ত পেরিয়েছ

তুমি সীমান্ত পেরিয়েছ: তোমার দেশের কোনো ভাষা ছিল না,
বা হয়তো কিছুই বলার ছিল না।
সীমান্ত পেরোলে, ভেবে নাও এটাই তোমার দেশ।
কী আছে তোমার দেশের যা গোটা দুনিয়ায় নেই?

প্রথমেই চোখের জলে তোমাকে স্বাগত জানিয়েছিল
কঠিন মুখের এই কোমল হৃদয় বন্ধু,
নোংরা ধুলো থেকে উঠে দুঃখ তোমায় জড়িয়েছিল
যেকোনো বন্ধুর চেয়ে বেশি শক্ত আলিঙ্গনে
রোগা বুড়ো মানুষটা তোমায় অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সাদরে
গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে সে ক্লান্ত।
আনন্দ কিনতে চেয়েছিলে তুমি।
কিন্তু আনন্দ এখন বিক্রি করে শুধু চোরাচালানকারীরা।

সীমান্ত পেরিয়েছ তুমি: ভেবে নাও এটাই তোমার দেশ।
কী আছে তোমার দেশের যা গোটা দুনিয়ায় নেই?
ওহে কবি, তুমি শোকের পৃথিবীতে এসেছো,
এখানে কোনো আকাশ নেই,
এখানে কবি করে মানবিকতার বেসাতি,
এখানে বন্ধ করা হয় জ্ঞানীর মুখ,
এখানে কুকুরেরা মন্ত্রী, গাধারা ইমাম,
ঘুষ না দিলে মসজিদ থেকে ভেসে আসে না কোনো প্রার্থনার সুর।
কী আশা করো তোমার দেশ থেকে?
খাবারের টেবিলে এখানে কী শুধু হাড়ের স্তূপ নেই?

কবি! তোমার দেশ এখন হারিয়ে যাওয়া অতীত।
অপমান, লালসা,যন্ত্রনা আর একঘেয়েমি ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই এর।
কবিতা না থেকে যদি তোমার থাকতো সোনা অথবা ক্ষমতা-
পবিত্র প্রতিভার এখানে মূল্য নেই কোনো।

রেজা মোহাম্মদী

১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে জন্ম। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কৃত হন। ইরান থেকে ইসলামিক আইন ও দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। পরে লন্ডনের মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোলকায়ণের ওপর এমে ডিগ্রি লাভ করেন। ফার্সি ভাসার তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। পড়াশুনা সূত্রে ইরানে বাস করার সময় থেকেই তিনি ইরানের তরুণ ফার্সি ভাষার কবিদের মধ্যে অন্যতম।

আব্দুল বারি জাহানি

গর্ব

যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প কী দারুন
সাবাস বলা আর প্রশংসা করা কত সহজ
নির্ভীক মানুষের কথা বলা কী আনন্দের
তাদের জীবনের গল্প চমৎকার
পুরনো গান শুনতে কত মধুর
মেয়েরা গান গায় সেই সিংহহৃদয়দের
গর্বিত সুন্দরীরা গোছা গোছা ফুলের মতো
দুলতে চায় শহীদবেদীতে।

কিন্তু কেউ শহীদকে জিজ্ঞেস করেছে তার ক্ষতের কথা?
বীরকে কেউ জিজ্ঞেস করেছে তার যন্ত্রনার কথা?
মৃত্যুর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা তার চোখের দিকে কেউ দেখেছে?
তাদের মুছে যাওয়া আশার গল্প পড়েছে কেউ?
কেউ দেখেছে শহীদের মায়ের ভাঙা-মন?
কেউ দেখেছে যুবতি বিধবার ধ্বংস-জীবন?
কেউ হোঁচট খেয়েছে স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপে?
যে কবি লিখেছে শেকলের কথা
সে কি জানে রাতে কেমন শীত কারাগারে?
তাকে কি কখনো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বিছায় ভরা গর্তে
তার হাড়ের ভিতর বারংবার হূল ফোটে?
আমি কখনো ভুলতে পারি না সেই জ্ঞানীর কথা:
দেশ জ্বলে যে আগুনে, সে আগুন ধরানো হয়েছিল দেশেই।

আব্দুল বারি জাহানি

আফগানিস্তানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি। সোভিয়েত আগ্রাসনের আগে কিছুদিন মন্ত্রী ছিলেন।

অমৃতা সরকার

গল্পকার, প্রাবন্ধিক। অনুবাদও করে থাকেন। পেশায় অধ্যাপক। ইংরাজি সাহিত্য পড়ান। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায়। দলিত সাহিত্য, মানবীবিদ্যা, লোকসংস্কৃতি এবং ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ইমেইল আইডি- aruvi01@gmail.com

Share