অরূপে দ্যাখো রূপমাধুরী (পর্ব-১)

ভাবগদ্য

।। রূপসা ।।

আধুনিক ধর্মীয় পরিচয়বাদ চেষ্টা চালায়, সকল বৈচিত্র্য খারিজ করে সকল বিশ্বাস ও যাপনপদ্ধতিকে এক ছাঁচে ঢালতে! যা থেকে রূপবাহার ও নানাবিধ রূপরসবর্ণগন্ধ নির্দিষ্ট হতে পারে একটি মাত্র আকারে৷ একটি মাত্র রূপে। একটি মাত্র বর্ণে। অথচ এই ভারত তো ছিল নানা ফুলের মালা। সেই ভারতের বাংলার প্রান্তে প্রান্তরে গ্রামে গঞ্জে গড়ে উঠেছে শীতলা মন্দির, মনসার থান, সত্যপীরের থান, দরগা, ইমামবাড়া। আবার সেই ভারতের কোথাও গুরুদ্বারের পাশেই রয়েছে মসজিদ, আবার এই ভারতের কোথাও কোথাও কান পাতলেই শোনা যেত মসজিদের আযানের রেশ নিয়ে শুরু হয়েছে কীর্তন, ভারতে রামায়ণ ছিল বহুবিধ, রাম যেমন কারো আরাধ্য ছিল তেমনই রাবনও তো দেবতা দ্রাবিড়ভূমে… 

পর্ব-১

বড়জোর দু’বছর বয়স। বাবা ভ্যান চালান মেয়েটার। ঘিঞ্জি জনবসতিতে থাকে সে, একঘরে, চার ভাইবোন আর বাবা-মাকে নিয়ে। মানিকতলা নর্থ রোড থেকে রাজাবাজারের দিকে যেতে, শহরের অলিগলি পাকস্থলীতে কোনো এক বসতিতে বাস তার। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ভ্যানের উপর পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখতে পারেন আপনি ওকে। আপনার হাতে কাগজ পেন্সিল দেখলে ও ছুট্টে এসে বায়না করতে পারে আপনার কাছে, ফুটপাথে চক দিয়ে একটা মাছ বা একটা ফুল বা একটা পুতুল বা একটা কালীঠাকুরের ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। মেয়েটার নাম তামান্না।

ও জানে, ‘‘অত গুরুতর নয় সব। গোদা মানুষের কলরব।’’

গোদা মানুষরা যে কোনও দিন তামান্নার মনের তল পাবে না, জানি আমি। তল পাওয়ার দরকারই বা কি? তাতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তখন তামান্নাকে নিয়ম শিখতে হবে। বুঝতে হবে, ভেদাভেদ। জীবনের সহজ আনন্দগুলো, রাস্তার কলে ছোট্ট মাথায় ফেনা করে করে শ্যাম্পু মাখার পর হঠাৎ জল ফুরিয়ে যাওয়ার বিস্ময়টুকু তার তখন থাকবে না। বুঝে নিতে হবে, হিসেব। সময়ের হিসেব। জলের হিসেব। আনন্দের হিসেব। শ্যাম্পুর হিসেবও।

ছবি: জাফর পানাহির সিনেমা ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ থেকে

কলকাতা শহর, আর তার গলিঘুঁজি রাস্তাঘাটে এমন ভাবেই কতো কতো তামান্না, আলিয়ার সঙ্গে বাস করে সোনালী, প্রিয়াঙ্কা, পিঙ্কি, আলতা, আশারা। এই কথাটা সকলে জানে। তবু জেনেও না-জানার ভান করে। যেন এই এক সঙ্গে থাকাটার কোনও অস্তিত্বই নেই। যেন এই স্বাভাবিক যাপনটা স্বাভাবিক নয়, তাই তার নাম দেয় বিজ্ঞজনেরা— সম্প্রীতি! অথচ এই যে লোকজীবন, তাতে কখনও ভেদ ছিল না, ভেদ নেই। বাহিরে-অন্দরে সহজ সেই চলাচলকে ভুলতে বসেছি আমরা, তাই আলাদা করে এ সব কথা লিখতে হয়!

হয়তো ধান ভানতে শিবের গীত হচ্ছে। আসলে তো আমি লিখতে বসেছিলাম, অন্য কিছু নিয়ে- পারমার্থিক কোনো একক সম্ভাবনার আশায়। তবু কাল রাতে তামান্নার গল্প শুনে, তার ছবি দেখে, এই অন্য কথা আর আসছে না। কারণ, আমার মনে তামান্নার যে ছবিটা ভাসছে, তাতে বসত গেড়েছে ঈশ্বর। তার হাসি ঝরে পড়ছে তামান্নার চোখে।

১৩০০ শতক। কাশ্মীরের পাম্পোরা গ্রাম। এক মহিলা থাকতেন সেখানে। নাম তাঁর লাল্লা। এই নামে আপনি যদি না চেনেন তাঁকে, তবে বলি, তাঁর নাম লাল্লা যোগেশ্বরী। বা আরও পরিচিত যে নামটা, সেটা হল লাল্লা আরিফা। অনেকেই জানেন তাঁর কথা। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি। এই লাল্লা ছিলেন যোগিনী, শৈব যোগিনী। সিদ্ধ শ্রীকান্তের কাছে দীক্ষা তাঁর। কিন্তু সাধনায় এক সময়ে গুরুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কোনও ধর্মীয় স্থানে নয়, কোনও লিঙ্গপুজো বা চিহ্ন পুজো নয়, তিনি ঈশ্বরকে অনুভব করতেন নিজের হৃদয়ে। তাঁর চিত্তাকাশে প্রকাশিত ছিলেন ঈশ্বর। কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা আচার নয়, তাকাতে চাইতেন নিজের ভিতরে। আর তাই হয়তো লাল্লা যোগেশ্বরীর কোনও সমস্যাই হয়নি, পরবর্তীকালে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে— যদি অবশ্য তাঁকে ধর্মান্তরণ বলা যায়। সিদ্ধ শৈব যোগিনী দীক্ষা নিয়েছিলেন সৈয়দ হুসেইন সমনানির কাছে— নিজের আধ্যাত্মিক সাধনাকে আরও সূক্ষ্ম, আরও পবিত্রতর করে তুলতে।

ছবিতে লাল্লা যোগেশ্বরী বা লাল্লা আরিফা বা লাল দেদ

সহজভাষে কথা বলতেন লাল্লা। এত সহজ সেই ভাষা, এত সহজ সেই কথা— তা বোঝার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের নিভৃত গৃহকোণটিই যথেষ্ট ছিল। ছুটতে হয়নি মন্দির-মসজিদে। তাই সাধিকা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের দেদ। বাংলা ভাষায় খানিকটা দাদি-ঠাকুমার মতো একটা উপাধি। মুসলমানদের তিনি যতটা, হিন্দুদেরও তিনি ততটা

তামান্নার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। লাল দেদের কথায় ঢুকলাম। কিন্তু বলতে চাইছি যা, তা হলো, ধর্মের নামে নির্মিত আধুনিক পরিচয়বাদের বাড়বাড়ন্ত অনেক সময়েই আমাদের ভুলিয়ে দেয় যে, মানুষের জীবন একেবারেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলে না। জীবন যত বিচিত্র, জীবন থেকে উঠে আসা ধর্মাচরণও তেমনই বিচিত্র।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এত ধর্মের কথা বলছি?

বলছি, তার কারণ, ধর্মের নাম করে আধুনিক ধর্মীয় পরিচয়বাদ তার প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো নিয়ে এই মুহূর্তে জনজীবনের কাছে একটা বড় ধাক্কা আকারে সামনে আসছে, বিশেষত এই উপমহাদেশে। 

পশ্চিম বাংলার মানুষ আমি। দেখছি, কী ভাবে এক দেশ, এক নীতি থেকে এক ধর্মের দিকে ঝুঁকছে ভারত রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদীরা। অর্থাৎ, ধর্মাচরণের স্বাধীনতার উপর লাগাম পরাতে চাইছে তারা। বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যে ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বঙ্গের বিবিধ ধর্মাচরণের নকসিকাঁথা, তাকে ছুড়ে ফেলে হিন্দুত্বের এক বগ্গা এক রঙা একঘেঁয়ে চাদরে ঢেকে দিতে চাইছে তারা!

কালীঘাটের কালী

এ কথা তো সত্যি, সনাতন ধর্মকেও যদি ধরি, তার বিন্যাস অঞ্চলভেদে আলাদা। উড়িষ্যার এক সাধারণ মন্দিরের দরিদ্র পুরোহিত বলছিলেন,বঙ্গীয় ঠাকুর দেবতা সম্পর্কে। তাঁর কথা থেকে অবাক হয়ে জানলাম, এ বঙ্গে যদি সর্বাধিক পূজিতা কোনও দেবী থেকে থাকেন, তাঁর নাম মনসা। সাপের দেবী। মনসার দুঃখকষ্টের কথা কোন বাংলার মেয়ে না জানে, যেমন সে জানে বেহুলার কথা। যেমন সে জানে কলার মান্দাসে ভেসে বেহুলার স্বর্গে পাড়ি দেওয়ার কথা, এবং শেষ পর্যন্ত জিতে ফিরে আসার কথা। আর মনসা- সেও তো বেহুলার অন্য পিঠ একটা। যে দেবী অন্ত্যজের, যে দেবীকে পুজা পাওয়ার জন্য কতই না লড়াই লড়তে হয়েছে। এই মনসা এখানে পূজিতা, কারণ নদী নালার এই বঙ্গে দেশে সাপের ভয় যে প্রবল। কে কবে শুনেছে, এই হিন্দুত্বের রাজনীতির হুঙ্কারে মনসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা! শোনেনি কেউ। মাছেভাতে বাঙালি হিন্দুর পূজা উপাচারে মাছের ভোগ পায় লক্ষ্মী, মাছের ভোগ পায় কালী। এই বাঙালির কালী বা লক্ষ্মী- হিন্দুত্বের রাজনীতির ঠিক কোথায়? আমরা জানি না। যেভাবে বাঙালির দুর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্র, যিনি কি না নিজের পদ্মআঁখিটি দিয়ে অকালবোধন করেছিলেন দেবী দুর্গার, সেই নরমকান্ত রামই বা কোথায় জয় শ্রীরামের উল্লাসধ্বনিতে!! নেই। অথচ, মেনে নিতে হবে, উত্তর ভারতের গোবলয়ের হিন্দুত্বই আমার হিন্দুত্ব! এই যে এক করে দেওয়ার রাজনৈতিক প্রয়াস, তা তার চরিত্রগত কারণেই ইনক্লুসিভ নয়। বরং এক্সক্লুসিভ।

এই আধুনিক ধর্মীয় পরিচয়বাদ চেষ্টা চালায়, সকল বৈচিত্র্য খারিজ করে সকল বিশ্বাস ও যাপনপদ্ধতিকে এক ছাঁচে ঢালতে! যা থেকে রূপবাহার ও নানাবিধ রূপরসবর্ণগন্ধ নির্দিষ্ট হতে পারে একটি মাত্র আকারে৷ একটি মাত্র রূপে। একটি মাত্র বর্ণে। অথচ এই ভারত তো ছিল নানা ফুলের মালা। সেই ভারতের বাংলার প্রান্তে প্রান্তরে গ্রামে গঞ্জে গড়ে উঠেছে শীতলা মন্দির, মনসার থান, সত্যপীরের থান, দরগা, ইমামবাড়া। আবার সেই ভারতের কোথাও গুরুদ্বারের পাশেই রয়েছে মসজিদ, আবার এই ভারতের কোথাও কোথাও কান পাতলেই শোনা যেত মসজিদের আযানের রেশ নিয়ে শুরু হয়েছে কীর্তন, ভারতে রামায়ণ ছিল বহুবিধ, রাম যেমন কারো আরাধ্য ছিল তেমনই রাবনও তো দেবতা দ্রাবিড়ভূমে… 

ছবিতে কাশীর গঙ্গার ঘাট ও মন্দির

খোদ উত্তর প্রদেশে বহু বহু বছর ধরে রয়েছে রামনামিদের সংস্কৃতি। ঠিক তেমনই তো উত্তরপ্রদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ছিল বাবরি মসজিদ৷ এই উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দি মাদ্রাসা তো গোটা বিশ্বের মধ্যে ইসলামিক জ্ঞানসাধনার উজ্জ্বল এক পীঠস্থান৷ আবার এই ভারতবর্ষের নৃতাত্ত্বিক জনপোষ্ঠীগুলির টোটেম-নিবিড় দৈবভাব বিশ্বাস ও যাপনের রূপমাধুরীকে রঙিন করে রেখেছে৷ আর তা মাতৃভূমির আত্মভুবনকে করেছে গৌরবান্বিত। মনে পড়ে, নিয়মগিরির কথা। যেখানকার ভূমিপুত্ররা দেবতার থানের কসম খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে৷ তৈরি হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। নিজের মতো করে।

অর্ধনারীশ্বর

এই সকল বহিরঙ্গের রূপমাধুরীর ভিতরে তারপরেও ছিল এক একাত্ম ও একত্বের অরূপের প্রতি অব্যক্ত প্রেম৷ সকলেই গাইতো বোধহয়, সাহেব মেরা এক হ্যায়…

তাই আজ যদি প্রাতিষ্ঠানিক ও আধুনিক ধর্মীয় পরিচয়বাদকে খারিজ করতে হয়, তবে ফিরে তাকানো জরুরি, এই লোকজগত বা কর্মমুখর মানুষের ভিতরকার প্রেমের ধর্মে। লোকধর্ম, অর্থাৎ মানুষের ধর্ম। মানুষেক দৈনন্দিনতায়, মানুষের জীবনে-মননে যে ধর্ম জ্যান্ত হয়ে চলাচল করে। যে ধর্মের উপাচার একটু ফুলের মালা, আর একটু সস্তার সন্দেশ, আর একটু মোমবাতির আলো। আর একবুক বিশ্বাস আর ভালোবাসা। মন্দিরের সোনার ইটের গাঁথনি থেকে তার দূরত্ব শতশত মাইল দূরে।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতির (রহঃ) দরগা

কিন্তু মজার কথা হল, এই যে অসীম মায়াভরা বিশ্বাস, সেটাই কিন্তু জোরের জায়গা। যে জোর থেকে বলা যায়, তোমার মাটির ঠাকুরে, সোনায় গড়া মূর্তিতে আর যাই থাক ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর আছেন চিত্তাকাশে। যেভাবে তাকে চাও, পেতে পারো সেভাবেই। সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বজরা, এ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট দেবভূমিগুলি আজও সেই শিক্ষা, সেই বিশ্বাসকেই বয়ে নিয়ে চলে।

আর তাই যখন, পারস্যের কবি, সৈয়দ মীর হামদানির সঙ্গে দেখা হয় আমাদের লাল্লার, এক মহাকাব্য তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই সম্ভাবনার খোঁজ হিন্দু ভারতের রামলালা রাখেন না নিশ্চিত। আর সেটাই ব্লাশফেমি।

যে ভাবে একটা ব্লাশফেমি হয়ে পথচলতি শিল্পীকে একটা কালী ঠাকুরের ছবি এঁকে দিতে বলে তামান্না- আমাদের লাল্লা যোগেশ্বরীর উত্তরাধিকার।

(চলবে)


লেখক পরিচিতি:
লেখক গায়েবে বা আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন। তাই দালির আঁকা ছবিতে নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন।
রূপসা রায়

লেখক, গবেষক, সাংবাদিক। জন্ম ১৯৮৭ সালে৷ এক সময়ে বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার ছাত্র রাজনীতি ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন৷ পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে৷ এমফিল-এর কাজ ‘চটকল শ্রমিকদের মৌখিক ইতিহাস নিয়ে, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস’, আন্দোলনের ইতিহাস, সত্তার ইতিহাস। প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর সুদানের তায়েব সালিহ।

Share