অভিমান জেনে গেছে তাকে কেউ ডাকবে না আর

।। লুবনা চর্যা ।।

“এই মুহূর্তে তুমি খুন হচ্ছো
তোমারই বিষের বাগানে ফোটা ফুলের সুগন্ধে।

প্রতারক বলে সকালের রোদে
যার দিকে পিঠ তুলে দাঁড়িয়েছ
সে নিজেই ঝুলে আছে অন্য কারো
প্রতারণার গোলাপি ফাঁসের দড়িতে।

অভিমান জেনে গেছে তাকে কেউ ডাকবে না আর
মিষ্টি কোনো ডাকনামে।”

শেষ থেকেই শুরু করি

এই জ্বরে-ধরা পোড়ো বালিশ কাঁথার নিচে
কোথাও একটা জাদুর বাঁশি লুকানো আছে-
আমি নিশ্চিত। এমত বিশ্বাসে
জাহাজ ডুবে গেলেও উদ্ধার নিজের প্রয়াসে।
দূরে কোনো অচিন গাঁয়ে গরু নিয়ে ফেরে
গায়ক রাখাল। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে
শর্ষে ফুলের মাঠে। কংক্রিটের কফিনে বন্দি
আমি সেই গ্রামের চেনা গন্ধটা শুঁকি।

সবকিছু জানিয়ে দিয়ে সময়- অজানা সেজে আসে
রোজ তোমার অধীর জানালায়।
হাড়হাভাতের কান্না শুকায় রাতের সমুদ্র ঘুমে।
মিলনের অংক মিলাতে ব্যর্থ চাঁদ
গরমিলে পায় উত্তরের জিয়নকাঠি।
আমি ফিরি ফের, তুমিও ফেরো মেঘে মেঘে
অতিথি পাখিদের দেখে
ফেরার অধিকারে।

আরো বহুবার, যতবার খুশি
চলো শেষ থেকেই শুরু করি।

অসীমকাল ধরে অকালপুরুষ চোখ বুজে করে যায় শিকার

অ্যাশট্রের ভিতর ছাই বিছানার থেকে জেগে
দেখি আমার পাশে কুণ্ডলী পাকানো যত ধোঁয়া
দলে দলে উড়ে যাচ্ছে তেপান্তর পেরিয়ে
নিভে যাওয়া আগুনের খোঁজে
জলের ধারে বনস্পতির মতো জ্বলা আগ্নেয়গিরির ভাঁজে।
আগুনের ফুলকি তারার মালা হয়ে ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে
সময়ের প্রবাহে। তাদের মতে,
এটা নাকি রডোডেনড্রনের বাগান…

শীতে জড়োসড়ো উন্মুখ মেঠোপথ
ভেবেছিল প্রেম বুঝি সেই উত্তাপের ত্রাণ।
কিন্তু সে-ই হিম বাতাসের পাখা
মেলে রাখে উত্তুরে কাঁটার জানালায়।

ফুটওভার ব্রিজের উপর পা ছড়িয়ে
এক জন্মান্ধ ঈশ্বর দেখে যায় লাল সবুজ কমলা নীল
আলোর সিগনাল। অথচ কোনো সিগনাল করুণা করে
দেখায় না তাকে অন্ধকারে হারানো বিজলী চেরা পথ…
তাই অসীমকাল ধরে অকালপুরুষ চোখ বুজে করে যায় শিকার।

শ্যাওলা সবুজ বনের গভীরে যে ছায়া
মনে চেনায় সূর্যের চলাচল, সে ছায়াগুলো মেঘের মুখে
বিলীন হলে আমি শুধুই স্তব্ধ অস্তাচল।
রাত ও দিনের দূরত্ব ঘোচায় রবি’র নেটওয়ার্ক…..

কেউ বাড়ায় না হাত কারো নিমগ্ন প্রদীপে-
কিনেছি রঙিন টব, গাছগুলো পোড়ামাটির দেয়ালে
একা একা বড় হবে।
মিলনের ঊষর জমিতে
ফোটে ধারালো ক্যাকটাস।
সাগরের অতল ঠিকানা পেলে কে করে
অ্যাকুরিয়ামে মুক্তার চাষ???

সমুদ্রের ফেনা থেকে ওঠে ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ণবিলাসী প্রজাপতি
একটা মরা জাহাজের মাস্তুল টেনে নিয়ে যায়
বিগত প্রণয়ের দগ্ধ চোরাবালিতে।

এক জন্মান্ধ কঙ্কাল ঝর্নার দিকে চেয়ে শুধু জলের প্রপাত গুণে যায়
কি-বোর্ডের সাদাকালো অক্ষরগুলো ঝাপসা চোখের সামনে
রংধনু জড়ানো প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু তার কোনো শখ নাই
প্রজাপতি ধরার। টেবিলে অহিংসুক কাঁটাচামচের মতো মেলে দিয়ে দু’হাত
শুনে যায় সে দূর বনে শূন্যতার মাইক্রোফোনে বাজা ঝিঁঝি’র ডাক…

আমি বলতে চাই না আর কোনোকিছু
শুনতে চাই না কোনোকিছু
জানতে চাই না কোনো প্রগতির দুর্গতি, তথ্যের মহামারী
নক করতে চাই না কারো নিঃসঙ্গতার নগ্ন ক্যানভাস।
দেহের ভিতরে মৃত মনের সৈকতে পড়ে আছে
ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্যাকাসে রঙা অক্টোপাস।
তবু ছুটি নাই, দেয়াল ঘিরে নাচানাচি তুমুল শোরগোল…
প্রখর দুপুরে রিক্সার ভারী চেইনের মতো ঘুরে চলে অনর্থক জীবন…

ঘরের চালা বেয়ে বৃষ্টির ধারা পড়ে পড়ে
ঘরের চালা বেয়ে বৃষ্টির ধারা পড়ে পড়ে
ঘরের চালা বেয়ে বৃষ্টির ধারা পড়ে পড়ে একটা শূন্যের আকার।
একটা চোরাগুহা নাই কোথাও পালাবার।
এখানে অসুখ, এখানেই শুশ্রুষা হোক তোমার-

আমি বলতে চাই না আর কোনোকিছু
শুনতে চাই না কোনোকিছু
জানতে চাই না কোনো প্রগতির দুর্গতি, তথ্যের মহামারী
নক করতে চাই না কারো নিঃসঙ্গতার নগ্ন ক্যানভাস।
দেহের ভিতরে মৃত মনের সৈকতে পড়ে আছে
ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্যাকাসে রঙা অক্টোপাস।
তবু ছুটি নাই, ছুটি নিতে হবে যেতে হবে অসুস্থ পারপারের অপারে…

এক জন্মান্ধ কঙ্কাল ঝর্নার দিকে চেয়ে শুধু জলের প্রপাত গুণে যায়…

অন্ধকারে উধাও ও আমার বোবা গায়ক নদী

অন্তর্গত তৃষ্ণার টানে ছুটে চলা
প্রভু, এ কি শয়তানের লীলাখেলা?
এক পিপাসার শ্রাবণ খুঁজে যেখানে যাই
সেখানে সৃষ্টি হয় আরো গভীর কোনো মরুভূমির তাড়া।

সরিষা ফুলের মতো ঝাঁঝাঁলো রোদ চোখে নিয়ে
চোখ বুঁজে খুঁজে চলি নদীর যত শত স্মৃতি।
সানগ্লাস ডুবে গেছে যে নদীতে তার পিছে পিছে
আমিও মিছে নদীর গভীরে পালাতে হই নিখোঁজ।

অন্ধকারে উধাও ও আমার বোবা গায়ক নদী,
সমস্ত শরীরে নাচের ঝড় তুলে তুমি
দাঁড়িয়ে আছো মানচিত্রে একই জায়গায়।
আমাদের ছুটে যাওয়া আর তোমার বয়ে চলা
কীভাবে যেন সমার্থকেই মিলে যায়।

জানি এই মিল খোঁজার গরমিলই শাশ্বত শুধু
জোড়াতালির দৈনন্দিন হিসাব ক্রুশে পাওয়া মধু।

অন্তর্গত তৃষ্ণার টানে ছুটে চলা
প্রভু, এ কি শয়তানের লীলাখেলা?
এক পিপাসার শ্রাবণ খুঁজে যেখানে যাই
সেখানে সৃষ্টি হয় আরো গভীর কোন মরুভূমির ইশারা।

অন্ধকারে উধাও ও আমার বোবা গায়ক নদী,
যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে অনেক রাতে
তারাদের রূপের আয়না হয়ে তুমি তাকিয়ে আছো
ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।
‘ঐশ্বরিয়া রায়’-এর রূপালী গাউন ঢেউ হয়ে
মিলিয়ে যায় বেসুরো পোড়া বাস্তবতায়।

পুরনো দিনের জীবাণু

গভীর সমুদ্রে চর জাগার মতো এই বৃষ্টির সকালের
লাজুক গালে জেগে উঠছে ফিকে একটা রংধনু।
নতুন দিনের রক্তে মিশে যাচ্ছে পুরনো দিনের জীবাণু-

গতরাতে শিয়রে জ্বলা মোমের সাথে পুড়ে শেষ
ভয় দ্বিধা প্রশ্ন আলোড়ন…
আজ প্রবাহিত বাতাসে একা আমি ভেঙে হই
অনিঃশেষ তুমির মার্বেল।

জলজ অন্ধকারের চোখে দেশলাই জ্বেলে
চলো চিনে নেই পরস্পরের ক্ষতবিক্ষত মুখে
প্লেগের মতো আরো কিছু
ধ্বংসকামী সৃষ্টির অসুখ…

তুমি অ্যাবসেন্ট, তুমি মুক্ত

এই মুহূর্তে তোমার দুইচোখে অন্ধকারের
সর্ষেফুল কুড়িয়ে কোথাও আকাশের কিনারে
জ্বলছে গান গাওয়া তারা।
উটকো ভবঘুরে শিশুর মতোন ঐ সমুদ্রকে ছুঁতে
প্রদীপ ভাসায় জন্মান্ধ জেলের কঙ্কাল…

এই মুহূর্তে তুমি খুন হচ্ছো
তোমারই বিষের বাগানে ফোটা ফুলের সুগন্ধে।

প্রতারক বলে সকালের রোদে
যার দিকে পিঠ তুলে দাঁড়িয়েছ
সে নিজেই ঝুলে আছে অন্য কারো
প্রতারণার গোলাপি ফাঁসের দড়িতে।

অভিমান জেনে গেছে তাকে কেউ ডাকবে না আর
মিষ্টি কোনো ডাকনামে।

এখানে তুমি আছো স্থান কাল পাত্র অপাত্র মনে রেখে।
তোমার মন ভয়ে গাংচিল হয়ে
তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়েছে।

দাসের দ্যাশে তোমার চাকরি প্রতিনিয়ত…
লাল কাঁকড়ারা পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বলে,
“তুমি অ্যাবসেন্ট, তুমি মুক্ত!!!”

বোকামি…

এই দৃশ্য সাবানের রঙধনু ফেনার মতো
উড়ে যাবে বাতাসের কঙ্কালে।
অসীম গিরিখাদের প্রান্তে
একা এক উটকো ছাতিম গাছ দেখবে
পতনের গভীর সুড়ঙ্গ।

খুন হওয়ার আগে যদি খুনির সাথে তার হয়ে যায় বন্ধুত্ব…

এই ক্ষতি শূন্যতার ওজন মাপা মেশিনে
অপরিমেয়।

ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে ফেরারী পাখিরা
ফিরে যায় গৃহে।
গৃহে শান্তি আর সান্ত্বনার গৃহযুদ্ধ।

যেখানে কেউ নেই, কিছু নেই নো ম্যানস ল্যান্ডে
একাকীত্ব আরো ঋজু হয়ে দাঁড়ায়।
নদীর দুই কূল যতো দূরে সরে যায়
ততো বাড়ে জনপদের জলাঞ্জলি……

টাইম বোমা বহনকারী গেরিলার রঙিন শার্টকে
ফুল ভেবে কয়েকটা প্রজাপতি নেচে ওঠে।
মৃত্যুর খোলাচিঠি হাতে পেয়ে
প্রজাপতিদের মতোন সেও ভুল করে
প্রেমকে ভালবাসতে গিয়ে ভালবেসে ফেলে
নিশ্চিত মরনের হাতছানি।

আমি কেরানীগঞ্জের কেরানি না
আমি কেরানীগঞ্জের কেরানি না
তবু প্রতিদিন সূর্যোদয়ের অমাবস্যায়
আমার ডাক আসে কেরানি হওয়ার।
“বদলে যাও, বদলে দাও হে আমার
সকল অস্বস্তি, অসুখ, অপমানের কালি
কেরানিগিরির স্মার্টনেসে…”

শো-রুমে প্লাস্টিক ফুলের অরণ্যে
ফুলের গর্ভকেশরে বেড়ে ওঠা ছাইয়ের পরাগ থেকে
ললিপপের তাজা মধুর ঘ্রাণের মতো
বিজ্ঞাপনের হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার সুরে
জাতীয় সঙ্গীত গায় আগামির কেরানি কিন্ডারগার্টেন।

হাসপাতালে অচেনা নেশাখোর ডোনার
চোখ বুজে বেচে যায় রক্ত, কিডনী, ফুসফুস।
আমি সেই ডোনারের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের মায়ায়
বেচে দিই আমার মস্তিষ্ক
পাকস্থলি ড্যামেজ হবার আশঙ্কায়।

সন্ধ্যায় বন্ধ জানালা দিয়ে দেখি উড়ে বেড়ায়
প্রেমের মনোগ্যামী, পলিগ্যামী, বাই, লেসবিয়ান
কিংবা গে রঙের বেলুন ইকারুসের কোমল ডানায়।
যেন মৃদু তুষারপাত হচ্ছে অহঙ্কারী পর্বতের মাথায়,
পর্বতের ঘন নীল উপত্যকায় পৃথিবীর সব পুরুষ নারী
নিজেদেরকে প্রাণী ভাবার শর্তে মিলিত হচ্ছে
চরম নিঃশর্ত প্রাণীজ মিলনে।

আমি পেতে চাই নি বুদ্ধের নির্বাণ,
রাধা হয়ে গাধা বানাতে চাই নি
পথের কোন কৃষ্ণকে। আমি চিরদিন
হতে চেয়েছি মাতা মেরীর মতো নির্জন ভার্জিন।
আমার সময় নেই কারো পিছনে ছোটার,
অথবা নিজেই ছুটে গিয়ে তার আকাশে
তারা হয়ে খসে পড়ার।

অভিনব এ কেরানি গড়ার কয়েদখানায় গরাদে
কালো কালো মানুষের মাথার চুলের মতো
কালো অক্ষরের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আমি।
আমি সেই কালো চিতার চোখের সামনে
ক্রীতদাস, নাকি এক নির্জীব গ্লাডিয়েটর?

পণ্যের মোড়কের পিঠে
ডট দিয়ে আঁকা একটা বিশুষ্ক সমুদ্রে
ডটের হাঙর হয়ে হারিয়ে গেছি আমি।
আমি কেরানীগঞ্জের কেরানি না
তবু প্রতিদিন সূর্যোদয়ের অমাবস্যায়
আমার ডাক আসে কেরানি হওয়ার।

“বদলে যাও, বদলে দাও হে আমার
সকল অস্বস্তি, অসুখ, অপমানের কালি
কেরানিগিরির স্মার্টনেসে…”

ছবি- লুবনা চর্যা

লুবনা চর্যা

জন্ম: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১, খুলনায়। বেড়ে ওঠা ওখানেই। কৈশোরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর একসময় থিয়েটার ছেড়ে নিজের লেখা ও আঁকার দিকে মনোযোগী হন। মাস্টার্সের পর ঢাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসাবে কাজ করেছেন। একসময় সেটাও ছেড়ে দিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেন, ছবি আঁকেন, লুবনার বক্তব্য, “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই…”।

Share