অভিবাসী জীবন

।। অপর্ণা হাওলাদার ।।

ভিক্ষুকের মতো জ্ঞানপাত্র হাতে
আমিও
ঘুরেছি অনেক তোমাদের সভা সেমিনারে
অনুগ্রহ করে, গুরু, কৃপা হয় যদি,
অজ্ঞানে দিয়ে যান কিছু দিশা

বিনিময়ে এই আছে আমার মেরুদণ্ড
প্রাচ্যের নারীসুলভ কমনীয়তা
কণ্ঠ, চামড়া, রক্ত, ঘাম,
আরও কী চাই, গুরুদেব, বলুন।

ইঁদুর

ইঁদুরেরা ছুটে ছুটে আসে যায় এই ঘরে, বিশেষত নিচে;
বসবার ঘরে রান্নার ঘরে বাসনের ভেতর নড়েচড়ে—
ছোটো ছোটো ইঁদুর, জলের পাইপ বেয়ে আসার মতো
ছোটো এবং চতুর—
খুব কাছে থেকে কয়েক মুহূর্ত দেখেছি
ওদের আমি, ভয় করে সরে আসার আগে—
ভয়ার্ত ইঁদুর কিংবা ভয়ার্ত আমি পরস্পরকে আড়চোখে অনুভব করি,
আমাদের চোখাচুখি হয়না যদিও—
সেইদিন সকালের নাস্তায় আধখাওয়া রুটি খুলে—
দেখে ভাবি আমারই দাঁতের দাগ, আজকাল অন্যমনে
কতভুল থেকে যায়, তেমন দাঁতের দাগ—
অযথাই পরে জানা গেলো সেও ছিলো ইঁদুরের মুখ।
ইঁদুরের দাঁত কিছু লেগে আছে আমার দাঁতেও তাই,
ইঁদুরের মুখ কিছু আমার মুখে,
ইঁদুরের জিহ্বার স্বাদ নিয়ে আমি ঘুরে ফিরে আসি উপরের ঘরে—
মাঝরাতে মাংসের ঝোলে চড়িয়ে ছড়িয়ে যায় ইঁদুরের দল
ফ্রিজারে লুকিয়ে রাখা যায় কিছু বাসি তরকারি, তবু
ইঁদুরের জন্য মায়া করে আমি ফেলে রাখি কিছু
চুলার উপর
অভিভাবকহীন। মাঝরাতে—

মানুষের সাথে কথাটথা হয় না আজকাল তেমন—
রান্নাঘরে দৌড়ে চলে যাওয়া ইঁদুরটাকেও আবার—
আবার ডেকে এনে দেখতে ইচ্ছে হয়।

ঘোর লাগা একাকীত্ব

আজ বিকেলে একটা হরিণের সাথে দেখা হয়ে গেল।
হঠাত ট্রেইলে হাঁটতে গিয়ে—

মনে পড়লো, অনেককাল কারও সাথে দেখা হয় না।

হঠাৎ আমার মতো বড়সড় মানুষ দেখে—
হরিণটা চমকে ঠায় দাঁড়িয়েছিলো দিক ঠিক না বুঝে;
ছোটো হরিণ, দলছুট হয়ে গেছে হয়তো—
এদিকে মানুষ আসে না— আমি ভুলে ঢুকে গেছি,
বিকেলে হরিণটার অত চমকে যাওয়া দেখে মনে হোলো
অনেকদিন কারও চোখ দেখা হয়নি এত কাছে থেকে,
চমকে যাওয়া চোখ! নিজেরও না।
অথচ আয়নায় চোখ পড়ে প্রতিদিনই;

ভয়ে চমকে যাওয়া শিশু হরিণটাকে পথ ছেড়ে দিতে গিয়ে
আমি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম আরও গভীর জঙ্গলে
এইদিকে পথ কিছু চিনি না তেমন—

হঠাত হরিণটাকে দেখে মনে পড়লো—
কারও এত কাছে যাওয়া হয়নি আজ অনেকদিন।

যাওয়া যে হয়নি, সেই কথা—
আজকাল আর তেমন মনে পড়ে না।


আবর্তিত

প্রতিবার যখন ফুল হাতে আসো এই পুরোনো শ্মশানে—
দূর থেকেই দেখতে পাই তোমায়

প্রতিবারই তোমার আসতে থাকা আমার মনে
প্রথমবার দেখা হওয়ার মতো আকস্মিক চঞ্চলতা জাগায়—

এই এত যুগ হোলো, কতো বছর যেন?

প্রতিবারই আমি ভুলে যাই অপরাধবিজ্ঞানের মতে
খুনী বারবার ঘটনাস্থলে ফিরে আসে নিশ্চিত হতে ।

আমার এই এক দেহ তুমি আর কতবার চিতায় তুলবে?

জ্ঞানপাত্র (পোস্ট পিএইচডি ডিপ্রেশন)

অনেক শিখেছি আমি
পূর্বে ও পশ্চিমে
দালানে দালানে

ভিক্ষুকের মতো জ্ঞানপাত্র হাতে
আমিও
ঘুরেছি অনেক তোমাদের সভা সেমিনারে
অনুগ্রহ করে, গুরু, কৃপা হয় যদি,
অজ্ঞানে দিয়ে যান কিছু দিশা

বিনিময়ে এই আছে আমার মেরুদণ্ড
প্রাচ্যের নারীসুলভ কমনীয়তা
কণ্ঠ, চামড়া, রক্ত, ঘাম,
আরও কী চাই, গুরুদেব, বলুন।

অনেক শিখিয়াছি আমি উহাদের কাছে।

সব তীর্থ চাষ শেষে ফিরে দেখি দর্পণে
ক্লেদময় মুখ ও চোখ, কণ্ঠে আনত ভৃত্যের তোষণ
সমগ্র শরীর চিৎকার করে অনবরত বলতে থাকে,
“যতদিন বেঁচে আছেন,
গোলাম হোসেনকে গোলাম বলেই জানবেন হুজুর”

এইসব জ্ঞানপাত্র আমি এখন
কোনো গঙ্গায় তর্পণ করে পাপমুক্ত হই?

ব্ল্যাসফেমি

মুঠোর মধ্যে ছিলো যতটা পয়সা দরকার খাবার কিনতে;
দু’য়েক পয়সা বেশি, হয়তো চাইলে ফুলও জুটে যেত –
খাদ্য এবং ফুলের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও
ক্ষুধার্ত কিংবা পুষ্পবিলাসী আমি পথে নেমে

কেবল মদের দোকান খোলা পেলাম।

The genuine faces of immigrattion II (2019) by Nikola Gulev.

অপর্ণা হাওলাদার

জন্ম বরিশাল, বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ঢাকা শহরের উদয়ন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ২০১১ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে প্রবাসে, ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি শেষ করেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় থেকে। মূল কাজের ক্ষেত্র পরিবেশ ও কৃষি। বর্তমানে আমেরিকার চাথাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

Share